সুন্দা ধীবরদের একটা বিরাট মাছ-ধরা নৌকোয় ফিরছিল সুদীপ্তরা। আস্কারি দ্বীপের লোকরা তাদের যে দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, তার পাশ দিয়ে ধীবরদের নৌকো যাওয়ার পথ। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই জানা ছিল সেই দ্বীপবাসীদের। একটা ধীবরের নৌকো তুলে নিয়েছে তাদের। উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে নৌকোর এক কোণে পাশাপাশি বসে ছিলেন দুজনে। হেরম্যান এক সময় বললেন, ‘সোনালি ড্রাগনের ব্যাপারটা তুমি বুঝেছ?’
সুদীপ্ত বলল, ‘আবছা একটা অনুমান করছি।’
হেরম্যান তাঁর ব্যাগ থেকে সেই ছোট্ট কাঠের বাক্সটা বের করে খুললেন। তারপর তর্জনী দিয়ে শূন্য বাক্সের ভিতরটা ঘসে আঙুলটা ধরলেন সুদীপ্তর সামনে। সোনালি রঙে মাখামাখি আঙুলটা সূর্যের আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে।
হেরম্যান আঙুলটা দেখিয়ে বললেন, ‘সোনার গুঁড়ো! সালুইন ছেলেটাকে তাড়া করে পৌঁছে গিয়েছিল স্বর্ণকক্ষে। সোনার গল্পটা মিথ্যে নয়। আমার ধারণা, কোনো কারণে গুঁড়ো অবস্থায় মাটির নীচে সোনা লুকিয়ে রেখেছিল সেদিনের মানুষেরা। আস্কারি দ্বীপের মানুষরা ওই সোনাই যুগ-যুগ ধরে পাহারা দিচ্ছে। ওদিকে তারা তাই কাউকে যেতে দিতে চায় না। ঘণ্টাধ্বনিতে তারা সতর্ক করে সবাইকে। আর ওই মাটির নীচের ঘরেই বাস করে সেই অতিকায় জীবন্ত ড্রাগন। কাজেই আমার এই আঙুলের মতো তারও…!’ কথাটা আর শেষ করলেন না তিনি।
সুদীপ্ত একটু বিমর্ষভাবে বলল, ‘তা হলে এবারও দেখা মিলল না ক্রিপটিডের?’ হেরম্যান হেসে বললেন, ‘দেখা পেয়েছি তো!’
সুদীপ্ত অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে?’
হেরম্যান বললেন, ‘তা হলে শোনো। ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপে নাকি এক সময় ছোট্ট বামনরা বাস করত বলে প্রচলিত ধারণা ছিল। ব্যাপারটা প্রাথমিক অবস্থায় সুন্দা ধীবরদের লোককাহিনি বলেই মনে করা হত। কিন্তু কিছুদিন আগে ফ্লোরেসের লিয়াং বুয়া গুহা থেকে নৃতত্ত্ববিদরা খুঁজে পান সাতটি খুব ছোট মানবকঙ্কাল। তাদের বয়স তিরিশ হাজার বছর। নৃ-বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে রায় দিয়েছেন, তাদের গড় উচ্চতা ছিল সাড়ে তিন ফুটের মতো। অর্থাৎ পিগমিদের চেয়েও এক ফুট কম। তিরিশ হাজার থেকে এক লক্ষ বছর আগে এ অঞ্চলে বসবাস করত তারা। শিকার করা, সাঁতার কাটায় বেশ দক্ষ ছিল সেই আদিম মানুষরা। বিজ্ঞানীরা তাদের নামকরণ করেছেন ‘হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস’। ক্রিপ্টোজুলজিস্টদের বিশ্বাস, ওই বামন মানুষরা নাকি আজও এই সুন্দাদ্বীপমালায় লুকিয়ে আছে। যদিও বিজ্ঞানীরা অবশ্য এ কথা বিশ্বাস করেন না।’ কথাগুলো বলে একটু চুপ করে থেকে হেরম্যান বললেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমাদের উদ্ধারকর্তা ছেলেটা বা দ্বীপবাসীদের সঙ্গে আসা ওর মতো ছোট্ট ছেলেরা আসলে ছোট নয়। যে কারণে ছেলেটা সমুদ্রে ঝাঁপাতে পেরেছে, ক্ষিপ্র গতিতে ছুটতে পেরেছে, সব কাজই পরিণত মানুষের মতো। ছেলেটা আসলে তোমারই মতো একজন পূর্ণাঙ্গ যুবক। ফ্লোরেস দ্বীপে হাজার-হাজার বছর ধরে একসঙ্গে কাটিয়েছে কোমোডো ড্রাগন আর ফ্লোরেসিয়েনসিসরা। তাই হয়তো কোমোডাকে বশ মানানোর কৌশল জানা আছে ছেলেটার। আস্কারি দ্বীপের লোকরা ওদের নিজেদের দলে নিয়ে রক্ষা করছে। প্রতিদানে তারাও হয়তো কোমোডোর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে তাদের। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা টিকিয়ে রেখেছে ক্ষুদ্র মানুষের অস্তিত্ব।’
সব শুনে বিস্মিত সুদীপ্ত বলল, ‘আপনার ধারণা যদি সত্যি হয় তবে ওরা ব্যাগ ফিরিয়ে দেওয়ার পর ছেলেটার ফোটো তুলে রাখলেন না কেন?’
হেরম্যান উদাসভাবে দর্শনিকের মতো বললেন, ‘কী হবে ফোটো তুলে? আমার হয়তো কিছু খ্যাতি হবে তাতে, কিন্তু এ ফোটো বিপন্ন করতে পারে ওদের জীবন। মানুষের লোভ সর্বগ্রাসী। তার চেয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে তারা সুখে থাকুক। খ্যাতি নয়, জ্ঞান সঞ্চয় করাই আসল ব্যাপার।’ এরপর তিনি বললেন, ‘তবে এ দ্বীপরাজ্যে আবার আসব আমি।’
লোকশ্রুতি, জাভার জঙ্গলে আজও নাকি পাওয়া যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক উড়ন্ত দানব। তার ডাক শোনা যায়। স্থানীয় আদিবাসীরা তাকে বলে, ‘আ-হুল…’!
নতুন এক ক্রিপটিডের গল্প শোনাতে শুরু করলেন হেরম্যান। সুন্দাদ্বীপমালার সমুদ্র তরঙ্গে দুলতে-দুলতে ভেসে চলল সুদীপ্তদের নৌকো।