সুন্দাদ্বীপের সোনার ড্রাগন – ৮

সময় এগিয়ে চলল। দুপুরের দিকে সুদীপ্ত একবার উঁকি দিল নীচে চত্বরের দিকে। নিঝুম দুপুরে কেউ কোথাও নেই। জঙ্গলের দিকটাও কেমন যেন থমকে আছে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তারপর এক সময় জঙ্গলে-ঢাকা প্রাচীন মন্দিরের মাথায় দিনান্তের লাল আভা ছড়িয়ে সূর্যদেব সমুদ্রে নেমে গেলেন। ধীরে-ধীরে অন্ধকারে ঢেকে গেল মন্দির চত্বর। অন্ধকার গাঢ় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল সুদীপ্তরা। তারপর বাইরে বেরিয়ে মন্দিরের গায়ের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। অন্ধকার হাতড়ে সাবধানে উঠতে থাকল তারা। অনেকক্ষণ সময় লাগল দ্বিতীয় ধাপে উঠতে। কিন্তু এর পরেই সমস্যায় পড়ে গেল। এই দ্বিতীয় ধাপ পর্যন্ত তাদের চেনা পথ ছিল। কিন্তু মন্দিরের সর্বোচ্চ ধাপে তারা ওঠেনি। খসে যাওয়া মন্দিরের গায়ের সিঁড়ি বেয়ে প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান উচ্চতায় অন্ধকারের মধ্যে ওঠা আত্মহত্যারই নামান্তর। হাত-পা একটু ফসকালেই দুশো ফুট নীচে পাথুরে চত্বরে আছড়ে পড়তে হবে। সুদীপ্তরা চাঁদ ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চাঁদ উঠল। ধোঁয়া-ধুলোহীন আকাশে সোনার থালার মতো উজ্জ্বল চাঁদ। তার আলো মন্দিরের গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা ধীরে-ধীরে উঠতে লাগল উপরে।

কোথাও-কোথাও সিঁড়ির ধাপ খসে গিয়েছে। দেওয়ালের খাঁজে হাত রেখে অনেকটা সাপের মতো উঠতে হচ্ছে। প্রথমে হেরম্যান, পিছনে সুদীপ্ত। অরণ্যের মাথায় চাঁদ যেন রহস্যময় হাসি হাসছে তাদের দুজনকে দেখে।

সুদীপ্তরা তখন সর্বোচ্চ তলে প্রায় পৌঁছে গিয়েছে, মাথার উপরে হঠাৎ একটা শব্দে আর-একটু হলে পড়ে যাচ্ছিল সুদীপ্ত। মাথার উপরে ঢং ঢং শব্দে ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। তার শব্দ মন্দিরের চূড়া থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে চন্দ্রালোকিত অরণ্যের মাথায়, দূরে সমুদ্রের দিকে।

সুদীপ্তরা থামল। হেরম্যান মুহূর্ত খানেক ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আমরা উপরে যাব। যা আছে কপালে! এ রহস্যের সমাধান করতেই হবে!’

সতর্কভাবে ধীর পায়ে আবার তিনি সুদীপ্তকে নিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। মাথার উপর বেজেই চলল ঘণ্টা ঢং ঢং ঢং…।

শেষে এক সময় উপরে উঠল তারা। আর সেখানে পা রাখার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘণ্টাধ্বনি থেমে গেল। চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আ ঘরগুলো। তার মাথায় স্তম্ভের উপর ঘণ্টাঘর দেখতে পেল তারা। তবে তার চারপাশ আচ্ছাদিত। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সুদীপ্তরা এগোল ঘরগুলোর দিকে। তাদের ঢোকার মুখে দু’পাশে বিশাল দুটো কোমোডো ড্রাগনের মূর্তি। সুদীপ্তরা ঢুকল ভিতরে। আর তারপরই তারা বুঝতে পারল এ তলে একটাই মাত্র ঘর। বিরাট বড় হলঘর। তার ছাদ নেই। ঘরের মাঝখানে একটা কোমর সমান উঁচু বেদির মতো জায়গা। তার চারদিক থেকে উঠেছে ঘণ্টাঘরের স্তম্ভ। ছাদহীন ঘর হলেও চারপাশের দেওয়ালের কোণে বিরাজ করছে গাঢ় অন্ধকার। সুদীপ্তরা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সেই বেদির সামনে। উলটো দিকের দেওয়ালের ছায়া সেখানে ঢেকে রেখেছে চাঁদের আলো। বেদির গায়ে দাঁড়িয়ে তারা তাকাল মাথার উপর ঘণ্টাঘরের দিকে। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে বড় ঘণ্টা। একটা মোটা দড়ি সেখান থেকে নেমে এসেছে মাটিতে।

হেরম্যান দড়িটা ধরে বললেন, ‘ঘাসে বোনা দড়ি। নিশ্চয়ই আদিবাসীরা লাগিয়েছে।’ সুদীপ্ত তাকিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করছিল ঘণ্টাটা। তার মনে হল, বেদির উপর দাঁড়িয়ে ভালো করে ঘণ্টাটা দ্যাখে। এই ভেবে সে হাতে ভর দিয়ে বেদিতে উঠতে যেতেই হঠাৎ তার হাত দুটো যেন শূন্যে ঢুকে গেল। আর একটু হলেই সামনে ঝুঁকে পড়ে যাচ্ছিল। মুহূর্তের মধ্যেই তাকে ধরে ফেললেন হেরম্যান।

ব্যাপারটা বুঝতে পারল দুজনে। এটা আসলে বেদি নয়, বিরাট গহ্বর। তার চারপাশে পাথরের রেলিং থাকায় অন্ধকারে বেদি বলে ভুল হয়েছে। আর-একটু হলেই সুদীপ্ত পড়ে যাচ্ছিল ভিতরে। বিস্মিত সুদীপ্ত আর হেরম্যান রেলিং ধরে ঝুঁকে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার ভিতর শুধুই অন্ধকার।

হেরম্যান বেশ বড় একটা পাথরখণ্ড নিয়ে তার ভিতর ফেললেন। অনেক নীচে নেমে অস্পষ্ট ক্ষীণ শব্দ তুলল পাথরটা।

হেরম্যান বললেন, ‘এটা সম্ভবত একটা বিরাট কূপ বা টানেল। মন্দিরের চূড়া থেকে অন্যতল ফুঁড়ে নীচে নেমেছে। একে কেন্দ্র করেই নীচের তাকের ঘরগুলো গোল করে সাজানো। যে কারণে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের হিসেব মিলছিল না।’

হেরম্যান এর পর একটা দেশলাই জ্বালালেন। হালকা আলো কূপের মুখ আলোকিত করল। তাতে হাত খানেক নীচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কূপের মুখের একপাশে নীচে নামার জন্য দেওয়ালের গায়ে খাঁজগুলো অস্পষ্টভাবে দেখা গেল।

দেশলাই নিভে গেল। হেরম্যান তাকিয়ে রইলেন অন্ধকার গহ্বরের দিকে। সুদীপ্ত বলল, ‘আপনি নীচে নামবেন নাকি?

হেরম্যান বললেন, ‘তা এখন আর সম্ভব নয়। আমি ভাবছি এরকম অদ্ভুত কূপ সেই প্রাচীন মানুষরা বানিয়েছিলেন কেন? নিশ্চয়ই জল তোলার জন্য নয়!’

এরপর হেরম্যান খসে পড়া দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালেন। জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে দূরে সমুদ্রতট দেখা যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘ওই তট বরাবর যেদিকে জাঙ্ক নোঙর করেছিল, সেদিকে যাব আমরা। চলো, এবার নীচে নামি।’

সুদীপ্ত বুঝতে পারল, কথাগুলো বলার সময় ব্যর্থ অভিযানের চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক থেকে। সুদীপ্তরা পিছন ফিরল। ঠিক সেই সময় ছাদহীন বিরাট হলঘরের একটা কোণ থেকে অস্পষ্ট একটা শব্দ কানে এল। দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। দেওয়াল-খসা পাথরে একটা ঢিপিমতো হয়ে আছে সেখানে। চাঁদের আলো সেখানে যাচ্ছে না। খুব অন্ধকার।

সুদীপ্তরা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে শব্দের কারণ বুঝতে না পেরে আরও দু’পা এগোতেই এবার বেশ স্পষ্ট শব্দ হল। তারপর সম্ভবত ঢিপির উপর থেকেই পাথরের একটা ছোট টুকরো গড়িয়ে এল ঘরের মাঝখানে। সঙ্গে-সঙ্গে থেমে গেল তারা। অন্ধকারে সেদিকে কিছু না দেখা গেলেও সম্ভবত সেখানে জীবন্ত কেউ আছে। তার নড়াচড়ায় পাথার খসছে!

সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, ‘কী, ওখানে কোমোডো নয় তো?’

পরমুহূর্তে তাদের মনে পড়ে গেল চত্বরে দেখা লু-সেনের শেষ মুহূর্তগুলো! হেরম্যান চাপাস্বরে বললেন, ‘ইয়তো তাই। আমাদের ছুরি ছাড়া অস্ত্র নেই। আর উপায় নেই। মশাল জ্বালাতে হবে। আগুনকে সব প্রাণী ভয় করে। মশাল দিয়ে ঠেকাবার চেষ্টা করতে হবে।’

মুহূর্ত খানেক ব্যবধান। দেশলাই ঘসার খস-খস শব্দ, আর তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মশালের আলোয় ঘরের অন্ধকার কেটে গেল। কোণের দিকের ঢিপি লক্ষ করে মশাল তুলে ধরতেই তারা দেখতে পেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে বুকের মধ্যে কী যেন চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সালুইন জায়া!

সালুইন কিছুটা টলোমলো ভঙ্গিতে ঢিপি থেকে নেমে ঘরের মাঝখানে দাঁড়ালেন। তারা এবার ভালোভাবে দেখা পেল তাঁর। পোশাক শতছিন্ন, সারা গায়ে রক্ত মাখা, বাঁ হাত দিয়ে বুকের কাছে ধরে রেখেছেন একটা ছোট কাঠের বাক্স। মুখে ফুটে উঠেছে পৈশাচিক হাসি। তবে চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ঘোলাটে।

সাপের মতো হিসহিস করে তিনি বললেন, ‘আমি জানি, আপনারাও আমার মতো সোনা খুঁজতে এসেছিলেন। পাননি, আমি পেয়েছি। ছেলেটাই শেষ পর্যন্ত আমাকে পৌঁছে দিল সেখানে। সোনা! সোনা! অনেক সোনা সেখানে…! সব আমার…সব আমার…!’

হেরম্যান বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, ‘আপনাকে আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি, সোনা খুঁজতে আমরা আসিনি। ওতে আমার আগ্রহ নেই। পথ ছাড়ুন, আমরা বাইরে যাব।’

পৈশাচিক হেসে সালুইন বললেন, ‘যাবেন তো যান। বাইরে যাওয়ার একটাই দরজা নাকি? আমি যে পথে এখানে এলাম, সে পথে যান, নিশ্চিন্তে নীচে পৌঁছে যাবেন।’ এই বলে তিনি আঙুল তুলে দেখালেন কুয়োটা।

সুদীপ্ত আর হেরম্যান এবার সেখানে সালুইনের উপস্থিতি কীভাবে ঘটল বুঝতে পারলেন। চত্বর থেকে সুড়ঙ্গ-পথেই জায়গাটায় পৌঁছেছেন তিনি।

হেরম্যান বললেন, ‘না, ও পথে আমরা যাব না। যে পথে উঠেছি সে পথেই নামব।’ সালুইন জায়া ঘোলাটে চাউনিতে তাকিয়ে বললেন, ‘এত কাছে এলেন, সোনা দেখবেন না? সোনা? রাশি-রাশি, ঘর-ভর্তি সোনা! নামুন-নামুন, কুয়োয় নামুন, ঠিক পৌঁছে যাবেন সেখানে। সারা জীবন এই স্বর্ণভাণ্ডার খুঁজেছি আমি। কতজনকে মেরেছি, আমার কত লোক মরেছে এর জন্য! লু-সেন পর্যন্ত বাঁচল না! শুধু আমিই মৃত্যুকে ফাঁকি দিলাম। কুকুরের মুখে রুটির টুকরোর মতো সামান্য ত্যাগ করতে হয়েছে আমাকে। এ ক্ষতি আমি পুষিয়ে নেব।’ এই বলে বাঁ পা সামান্য একটু তুলে ধরে হা হা করে হাসতে লাগলেন সালুইন জায়া।

সালুইন জায়ার হাসির ভঙ্গি আর চোখের দৃষ্টি দেখে সুদীপ্তর কেন জানি মনে হল, সালুইন কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। সুদীপ্ত বইয়ে পড়েছে, প্রচুর সম্পদ কেউ হাতে পেলে অনেক সময় ভারসাম্য হারায়। আর তারপরেই সুদীপ্তর দৃষ্টি গেল সালুইনের পায়ের দিকে। তাঁর ডান পা’টা ঠিকই আছে, কিন্তু বাঁ পায়ের পাতা কেউ যেন জুতোসুদ্ধ ছিঁড়ে নিয়েছে। তাঁর হাইহিল বুটের ছিন্ন অংশ থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল মাংস! শিউরে উঠল সুদীপ্ত।

হেরম্যান সুদীপ্তকে মশালটা দিলেন। তারপর কঠিন কণ্ঠে সালুইনকে বললেন, ‘অনেক হয়েছে। এবার আমরা যাব। নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। সরে যান।’ এই বলে সামনে এগোতে গেলেন তিনি।

তাঁর কথা কানে যাওয়া মাত্রই হাসি থামিয়ে সালুইন চিৎকার করে বললেন, ‘যেতে হলে আপনাদের ওই কুয়ো দিয়েই নামতে হবে। আমি চাই না আপনারা কোনো দিন এখানে ফিরে আসুন।’

হেরম্যান আবার দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘না, যাব না।’

সালুইন জামার নীচ থেকে রিভলভার বের করে চিৎকার করে বললেন, ‘যাবেন না?’

আর তারপরই তিনি হেরম্যানকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দিলেন। প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল ঘর। গুলির আঘাতে বেশ কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে স্থির হয়ে গেলেন হেরম্যান। টলোমলো পায়ে সালুইন এগোতে থাকলেন সুদীপ্তর দিকে। মুখে পৈশাচিক হাসি। ঠোঁটের কষ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। মশালের আলোয় তাঁকে মনে হচ্ছে জীবন্ত প্রেতমূর্তি।

হঠাৎ একটা অন্যরকম শব্দ কানে এল। ফোঁস-ফোঁস শব্দ। সুদীপ্ত শব্দ অনুসরণ করে তাকাল কুয়োর দিকে। কুয়োর ভিতর থেকে লাফ দিয়ে ঘরের মেঝেয় নামল বিশাল এক কোমোডো ড্রাগন। তাকে দেখার সঙ্গে-সঙ্গে সুদীপ্তর মনে হল, কেউ যেন তার পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে ধরেছে। মুহূর্তের মধ্যে সুদীপ্ত ভুলে গেল সে একটা হিংস্ৰ মানুষের রিভলভারের সামনে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে। চোখ ফেরাতে পারল না সুদীপ্ত। মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাগন। মশালের আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে প্রাণীটার সোনার শরীর! হেরম্যানের সোনার ড্রাগন! জ্বলন্ত চোখে সে তাকিয়ে আছে সুদীপ্তর দিকে। মাঝে-মাঝে তার চেরা জিভ ছুড়ে দিচ্ছে বাতাসে।

সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে নিয়ে প্রাণীটা মুখ ফেরাল সালুইনের দিকে। সালুইনের চোখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। দরজার দিকে পিছোচ্ছেন তিনি। তাঁর রিভলভারের নল প্রাণীটার দিকে। তাঁকে দেখামাত্র প্রাণীটা বাতাসে শ্বাস নিয়ে এগোতে শুরু করল তাঁর দিকে। রক্তের গন্ধ পেয়েছে প্রাণীটা। আর দেরি না করে আতঙ্কিত সালুইন তাঁর শেষ গুলিটা চালিয়ে দিলেন প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে। গুলি তার গায়ে লাগল কি না বোঝা গেল না। পনেরো ফুটের দানব ড্রাগন মাটি থেকে একটু লাফিয়ে উঠে এগিয়ে গিয়ে লেজ দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করল সালুইনকে। দরজার কাছাকাছি মাটিতে ছিটকে পড়লেন তিনি, হাতের বাক্সটাও ছিটকে গেল মেঝেয়।.

ড্রাগনটা আক্রমণ করার জন্য আবার এগোল তাঁর দিকে। প্রাণ বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা করলেন তিনি। সঙ্গে-সঙ্গে সালুইন উঠে দাঁড়িয়ে তিরগতিতে ছুটলেন দরজার বাইরে। তাঁকে তাড়া করল সোনার ড্রাগন। কিন্তু দরজার বাইরে কয়েক হাত তফাতে যে অতলস্পর্শী রেলিংহীন গহ্বর অপেক্ষা করছে তা বোধ হয় খেয়াল করেননি তিনি। দরজার বাইরে পা রাখার পরই সুদীপ্তর কানে এল সালুইনের আর্ত চিৎকার। সেই চিৎকার ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে নীচের দিকে। ড্রাগনটা দরজার মুখেই ছিল। সে ঘুরে-ঘুরে ধীর গতিতে এবার এগোতে লাগল সুদীপ্তর দিকে। ভাঁটার মতো জ্বলছে তার দুটো চোখ। আধো অন্ধকারে উজ্জ্বল আভা ছড়াচ্ছে তার সোনালি দেহ। ক্রুদ্ধ ফোঁস-ফোঁস শব্দের সঙ্গে তার দীর্ঘ জিভ বাতাসে লাফাচ্ছে। সুদীপ্ত ঘরের এক কোনায় পিছু হটতে লাগল। কোনোও অস্ত্র নেই তার হাতে, শুধু একটা মশাল। ঘরের মাঝে এসে একবার থমকে দাঁড়িয়ে বিরাট হাঁ করল প্রাণীটা চোয়ালে সারবদ্ধ ভয়ংকর দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পেল সুদীপ্ত।

আবার এগোতে শুরু করল প্রাণীটা। সুদীপ্ত জ্বলন্ত মশালটা বেশ কয়েকবার নাড়াল। প্রাণীটা ভ্রুক্ষেপই করল না। সে এগোতে থাকল। সুদীপ্তর হাত-পনেরো দূরে এসে সে দাঁড়াল। সম্ভবত সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে সে আক্রমণ হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুদীপ্ত শক্ত মুঠিতে চেপে ধরল মশাল। প্ৰাণীটা কাছে এলেই জ্বলন্ত মশালটা গুঁজে দেবে তার মুখে। বাঁচার শেষ চেষ্টা সে করবে। দুজনের সতর্ক দৃষ্টি দুজনের চোখের দিকে স্থির। এগোতে শুরু করল জীবন্ত ড্রাগন…!

হঠাৎ মাথার উপর ঘণ্টাটা আবার ঢং ঢং করে প্রচণ্ড জোরে বেজে উঠল। আর তারপরই যেন শূন্য থেকে সুদীপ্ত আর কোমোডোর ঠিক মাঝখানে ঘরের মেঝেয় এসে নামল সেই ছেলেটা! ঘণ্টাঘরের অন্ধকার থেকে দড়ি ঝুলে নেমে এসেছে সে।

তাকে দেখে ভয়ংকর প্রাণীটা কেমন যেন থমকে দাঁড়াল। ছেলেটা আর প্রাণীটা দুজনেই পাথরের মতো স্থির। প্রাণীটা কি ছেলেটার উপর লাফিয়ে পড়বে? এর পরই এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখল সুদীপ্ত। ছেলেটা মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত টক-টক শব্দ করতে-করতে এগোল প্রাণীটার দিকে। ছেলেটা একবার মুহূর্তের জন্য সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় থেমে থাকতে বলে, তারপর হাঁটুমুড়ে বসে হাত রাখল সেই ভয়ংকর প্রাণীটার মাথায়!

প্রাণীটা কিন্তু কিছু করল তাকে। এবার ছেলেটা তার মাথায় হাত বোলাতে লাগল, ঠিক যেমন পোষা প্রাণীকে কেউ যেভাবে আদর করে, সেভাবে। বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়াল ছেলেটা, মুখ দিয়ে দু’বার অদ্ভুত শব্দ করল। এতক্ষণ পর প্রাণীটা নড়ে উঠল। মুখ ঘুরিয়ে ধীরে-ধীরে এগোল কুয়োর দিকে। কুয়োর পাথুরে রেলিংয়ে উঠে একবার সে তাকাল সুদীপ্তদের দিকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার সোনালি দেহ ধীরে-ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়োর অন্ধকারে।

সুদীপ্ত এবার ফিরে তাকাল হেরম্যানের দিকে। কখন যেন উঠে বসেছেন তিনি। তাঁর বিস্ফারিত চোখ কুয়োর দিকে। সুদীপ্ত তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁকে দাঁড় করাল। সালুইনের গুলি তাঁর কোমরের চামড়া ছুঁয়ে চলে গিয়েছে। রক্তপাত হলেও আঘাত তেমন মারাত্মক নয়। ইতিমধ্যে ছেলেটা ঘরের মধ্যে পড়ে থাকা সালুইনের সেই বাক্সটা কুড়িয়ে এনে দাঁড়িয়েছে তাদের সামনে। হাসি-হাসি মুখে সে বাক্সটা তুলে ধরে দেখাল। কাঠের তৈরি কারুকাজ করা ছোট্ট বাক্স। তার উপর খোদিত আছে কোমোডো ড্রাগনের ছবি। দেখেই বোঝা যায় জিনিসটা অনেক প্রাচীন। ছেলেটা এর পর বাক্সটা নিয়ে এগোল কুয়োর দিকে। সুদীপ্তদের দিকে পিছন ফিরে বাক্স খুলে ভিতরটা উপুড় করে দিল কুয়োর মধ্যে। তারপর বাক্স বন্ধ করে সেটা নিয়ে এসে তুলে দিল হেরম্যানের হাতে। সুদীপ্তদের সে ইশারা করল তাকে অনুসরণ করার জন্য।

ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল তারা। মাথার উপর জ্যোৎস্না। চাঁদ যেন হাসছে তাদের দিকে চেয়ে। হঠাৎ নীচের দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠল তারা। অরণ্যের ভিতর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে জংলিরা। কিছু মানুষ ইতিমধ্যেই মন্দিরের নীচে জমা হয়েছে। তাদের মশালের আলোয় ইতিমধ্যেই চত্বর আলোকিত। সম্ভবত ছেলেটার ঘণ্টাধ্বনি আস্কারি দ্বীপ থেকে ডেকে এনেছে তাদের। প্রাচীন মন্দির রক্ষা করতে ছুটে এসেছে তারা। সুদীপ্তরা তাদের দেখেই দাঁড়িয়ে গেল। কী হবে এবার? নিচ থেকে তাদেরও দেখতে পেয়ে গিয়েছে লোকগুলো। অচেনা ভাষায় ক্রুদ্ধ, গর্জন শুরু হল। দু’-একজন তির-ও ছুড়তে শুরু করল। ছেলেটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ধাপের কিনারে। তাকে দেখে যেন একটা উল্লাস ধ্বনি উঠল সমবেত জনতার মধ্যে। তির ছোড়াও বন্ধ হল। নীচের লোকগুলোর উদ্দেশে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চিৎকার করে যেন কী বলল ছেলেটা। ধীরে-ধীরে শান্ত হতে শুরু করল আদিবাসীরা। ছেলেটা এর পর সুদীপ্তদের দিকে ফিরে ইশারায় জানাল তার পিছন পিছন নীচে নামার জন্য।

সুদীপ্তরা চত্বরে নেমে এল। সঙ্গে-সঙ্গে তাদের ঘিরে ফেলল আদিবাসীরা। অনেক লোক। অন্তত শ-তিনেক তো হবেই। বিচিত্র তাদের সাজ-পোশাক। মুখে কালো উল্কি। কাঁধে ধনুক, টাঙ্গি। অস্ত্রের ফলা ঝলকাচ্ছে মশালের আলোয়। মাথায় পালকের সাজ, নাকে বাঁশের টুকরো বেঁধানো, বাহুতে কোমোডোর উল্কি আঁকা। বর্ণাধারী এক দীর্ঘদেহী প্রথমে কাছে এগিয়ে এল। দুর্বোধ্য ভাষায় তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর ছেলেটা সুদীপ্তদের দিকে তাকিয়ে হাসল। ছেলেটা এর পর সর্দারকে কী যেন বলল। তা শুনে সে উচ্চস্বরে কী যেন বলল তার সঙ্গীদের। ভিড়টা একটু ফাঁকা হয়ে গেল। আর তাদের আড়াল থেকে বেরিয়ে সুদীপ্তদের সামনে এসে দাঁড়াল যেন বাচ্চাদের একটা দল। তাদের পিঠে ধনুক, হাতে ছোট বর্শা। তারা আকারে অনেকে ছেলেটার চেয়েও চেয়েও ছোট। কী আশ্চর্য! যুদ্ধ করতে এরা বাচ্চাদেরও সঙ্গে আনে নাকি? ছেলেটাকে দেখেই তারা তাকে ঘিরে আনন্দে নাচতে শুরু করল। যাকে বলে উদ্দাম নৃত্য। সুদীপ্তরা অবাক হয়ে দেখতে লাগল সেই নাচ। ইতিমধ্যে একজন এসে ধরিয়ে দিয়ে গেল সুদীপ্তদের ব্যাগ দুটো। আরও অবাক হল তারা। সম্ভবত জঙ্গলে লোকগুলো কুড়িয়ে পেয়েছে সেগুলো। নাচ শেষ হতে সুদীপ্তদের নিয়ে তারা বনের মধ্যে দিয়ে এগোল সমুদ্রের দিকে। চত্বরের এক পাশে পড়ে রইল সালুইন জায়ার নিথর দেহ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুদীপ্তরা পৌঁছে গেল সমুদ্রতীরে। অনেক নৌকো সেখানে। সেই ছেলেটা, হেরম্যান, সুদীপ্ত আর জনাতিনেক চাপল একটায়। বাকিরা অন্যগুলোয়। সেই লোক-বোঝাই নৌকোগুলো এগোল আস্কারি দ্বীপের দিকে, সঙ্গে সেই ছেলেরা। আর চাঁদের আলোয় সমুদ্রে সুদীপ্তদের নৌকো পাড়ি দিল অন্য দিকে। পিছনে পড়ে রইল ‘ওরা’ দ্বীপ, তার প্রাচীন মন্দির আর সেই মন্দিরের কোনো প্রাচীন ঘরে হেরম্যানের সোনালি ড্রাগন। ঢেউয়ের ছলে দ্রুতবেগে এগিয়ে চলল সুদীপ্তদের নৌকো।

আস্কারি দ্বীপের লোকরা যখন সুদীপ্তদের একটা দ্বীপে নামিয়ে দিল, তখন ভোর হতে বেশি বাকি নেই। ছেলেটা তার ভাষায় কী যেন বলল সুদীপ্তদের উদ্দেশে। সম্ভবত বলল, ‘আমার আর কোনো দিন দেখা হবে না তোমাদের সঙ্গে। বিদায় বন্ধু। আমার প্রাণ রক্ষার জন্য ধন্যবাদ। মনে রাখব তোমাদের…!’

সুদীপ্তও মনে-মনে একই কথা বলল তার উদ্দেশে। লোকগুলো ছেলেটাকে নিয়ে উঠে বসল নৌকোয়। উত্তাল ঢেউয়ে ভাসতে-ভাসতে আস্কারি দ্বীপের দিকে যাত্রা করল তাদের নৌকো।