সুদীপ্তরা হাজির হল মন্দির চত্বরে। পাথর বাঁধানো চত্বরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে প্যাগোডা ধাঁচের বিশাল মন্দির। সুদীপ্তরা অনুমান করল, মন্দিরের উচ্চতা অন্তত আড়াইশো ফুট হবে। মহাকাল আর দূর থেকে ভেসে আসা সমুদ্রের নোনা বাতাস মন্দিরের গায়ে থাবা বসালেও তার কাঠামোটা মোটামুটি অক্ষতই আছে। চত্বর থেকে প্রশস্ত ধাপ উপরে উঠে মিশেছে মূল প্রবেশদ্বারে। চত্বরের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের মূর্তি-স্তম্ভ। তবে তাদের একটা অংশ ভেঙে পড়েছে। মন্দিরের অন্য তিন দিক ঘিরে রেখেছে গভীর জঙ্গল।
সুদীপ্তরা মন্দির প্রদক্ষিণ করতে লাগল। চত্বরে আর মন্দিরের গায়ে কত অপরূপ সব মূর্তি। কোথাও বিষ্ণু, কোথাও ব্রহ্মা, কোথাও বা মহাদেব। কয়েক জায়গায় আবার রয়েছে বুদ্ধমূর্তি বা স্তম্ভের গায়ে খোদিত জাতক-কাহিনির নানা দৃশ্য। ঠিক তেমনই রামায়ণের কিছু দৃশ্যও চোখে পড়ল। সুদীপ্ত ব্যাপারটা হেরম্যানকে বুঝিয়ে বলার পর তিনি বললেন, ‘সম্ভবত দুই ধর্মের ঐক্য স্থাপন করতে কোনো হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজা এ মন্দির তৈরি করান।
সুদীপ্ত বলল, ‘তা হলে মন্দিরে সোনা লুকিয়ে রাখার গল্পটাও সত্যি হতে পারে?’
হেরম্যান বললেন, ‘হয়তো তাই।’
হঠাৎই এক জায়গায় থমকে দাঁড়ালেন হেরম্যান। বললেন, ‘আরে, ওই দ্যাখো…!’ মন্দিরের গায়ে খোদিত একটা ছবি। কয়েকজন মানুষ লড়াই করছে বিরাট এক কোমোডো ড্রাগনের সঙ্গে! এর পর এরকম আরও কয়েকটা মূর্তি। কোথাও কোমোডো ড্রাগনকে পুজো করা হচ্ছে, কোথাও তার মুখে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে অপরাধীকে। হেরম্যান ছবিগুলো দেখতে-দেখতে একটা ছবির সামনে থমকে দাঁড়ালেন।
গোটা দশেক লোক সেখানে একটা কোমোডো ড্রাগনের পিঠে সওয়ার। লোকগুলো সশস্ত্র। সম্ভবত কোমোডোর পিঠে চেপে যুদ্ধে যাচ্ছে! ছবিটা খুঁটিয়ে দেখে হেরম্যান বললেন, ‘ছবিটা অদ্ভুত তো! ড্রাগনটা দানবাকৃতি, নাকি ওর পিঠের লোকগুলো বামন, নাকি দুটোই সত্যি??
মন্দির চত্বরে বেশ কয়েকটা গভীর কুয়োও দেখতে পেলেন তাঁরা। মুখগুলো বেশ চওড়া, ভিতরের দেওয়াল পাথর দিয়ে বাঁধানো। নীচে নামার জন্য দেওয়ালের খাঁজের অংশবিশেষ এখনও কিছুটা রয়েছে। তবে ভিতরটা এত অন্ধকার যে, তার তল পর্যন্ত দৃষ্টি যাচ্ছে না।
মন্দিরের পিছনে একটা ছোট জলাধার আে সম্ভবত বৃষ্টির জল জমা আছে সেখানে। পাথুরে সিঁড়ি নেমেছে ওই জায়গায়। সুদীপ্তরা নীচে নেমে প্রাণ ভরে জল খেয়ে নিল। হেরম্যান বললেন, ‘চলো, মন্দিরের ভিতরটা এবার দেখব। তারপর কীভাবে অনুসন্ধান চালাব সে নিয়ে ভাবতে হবে।’
সুদীপ্তরা মন্দির চত্বর ঘুরে উপরে ওঠার সিঁড়ির সামনে দাঁড়াল। হেরম্যান বললেন, ‘দেশলাই আমার কাছে আছে। ভিতরে নিশ্চয়ই অন্ধকার। উপরে যাওয়ার আগে মশাল বানিয়ে নিতে হবে। এখানকার কিছু গাছে রজন আছে, মশালের মতো জ্বলে। তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি আসছি।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশের জঙ্গল থেকে কিছু ডাল জোগাড় করে আনলেন তিনি। তারপর সিঁড়ির ধাপ বেয়ে তাঁরা উপরে উঠতে শুরু করলেন।
তিনটে ধাপে তৈরি মন্দির। প্রায় সত্তর ফুট উঠে প্রথম ধাপে পৌঁছলেন তাঁরা। আরও সিঁড়ি মন্দিরের গা বেয়ে ক্রমশ উঠে গিয়েছে উপরে। রেলিংহীন ধাপ, কিনারে দাঁড়ালে বেশ ভয় করে। উপর থেকে নীচের চতুর পুরো দেখা যায়। ধাপের মাঝখান থেকে চারপাশে ছড়িয়ে আছে মন্দিরের অনেক ঘর। আর ঘরগুলোর চারপাশে প্রতি তলার ধাপে গোল রেলিংহীন বারান্দা। ঘরের বাইরেও নানা দেবমূর্তি, নক্শার অলঙ্করণ। ঘরের ভিতর জমাটবাঁধা অন্ধকার। মশাল জ্বালিয়ে তাঁরা ঢুকলেন ভিতরে। মাটিতে পুরু বালুকণার স্তর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমুদ্রের বাতাস বয়ে এনেছে এই বালুকণা। মশালের আলোয় দেখা যাচ্ছে দেওয়ালের গায়ে একের পর এক দেবমূর্তি, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের। মূর্তিগুলো জায়গায়-জায়গায় ক্ষয়ে গেলেও তাদের সৌন্দর্য এখনও অটুট।
বিস্মিত সুদীপ্তরা এ-ঘর থেকে সে-ঘর দেখে বেড়াতে লাগল। একটা ঘরে রয়েছে সেই সময়ের দ্বীপবাসীদের জীবনযাত্রার খোদাই-করা চিত্র। শিকার-দৃশ্য, মাছ ধরার দৃশ্য, যুদ্ধযাত্রা, ধর্মানুষ্ঠানের দৃশ্য। সেখানে আবারও একটা অদ্ভুত ছবি দেখল তারা। একটা বিরাট কোমোডো ড্রাগনের হাঁ-করা মুখের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ!
ছবিটা দেখে সুদীপ্ত বলল, ‘আপনার সেই সোনার ড্রাগন সত্যি আছে বা ছিল কি না জানি না, তবে দানবাকৃতির কোমোডো ড্রাগন এক সময় নিশ্চয়ই ছিল। নইলে কোমোডোর মুখের ভিতর মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বা কোমোডোর পিঠে বসে একদল লোক যুদ্ধে যাচ্ছে, এমন আশ্চর্য কল্পনা সে যুগের প্রাচীন শিল্পীরা করলেন কীভাবে?’
মন্দিরের এ ধাপের ঘরগুলো দেখা শেষ হতে তারা বাইরে বেরিয়ে এসে দ্বিতীয় ধাপের দিকে উঠতে শুরু করল। মন্দিরের গায়ের সিঁড়িগুলো কোথাও-কোথাও ভেঙে গিয়েছে। পা ফসকালেই মৃত্যু নিশ্চিত। দ্বিতীয় ধাপে উঠে এল তারা। প্রায় দেড়শো ফুট নীচে মন্দিরের সেই শান বাঁধানো চত্বর। এত উঁচু থেকে জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে অনেক দূর দেখা যাচ্ছে। হেরম্যান হঠাৎ জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে দূরে একদিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘আরে, ওই তো সমুদ্র দেখা যাচ্ছে।’
সুদীপ্তও দেখতে পেল। তবে তার দূরত্ব মন্দির থেকে অন্তত মাইল তিনেক হবে। সুদীপ্তরা এত উঁচুতে বলে দেখতে পাচ্ছে। ভালো করে সেদিকে দেখার পর আরও দূরে সমুদ্রের ভিতর কালো বিন্দুর মতো কী একটা নজরে এল দুজনেরই।
হেরম্যান বললেন, ‘ওটা সম্ভবত আস্কারি দ্বীপ। তার মানে’ আমরা দ্বীপের পিছনের অংশে এসে পৌঁছেছি। আস্কারি দ্বীপের কাছাকাছি বলে দ্বীপের এ অংশ বিপজ্জনক। সালুইনরা যে কারণে এদিকে জাঙ্ক ভিড়াননি।’
দ্বিতীয় তলায় অনেক ঘর, তবে এখানকার দেওয়ালের সমুদ্রের বাতাসে আরও বেশি ক্ষতি হয়েছে। জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে নোনা বাতাস গায়ে এসে লাগছে। এখানকার ঘরগুলোয় শুধু বিভিন্ন ভঙ্গিমার বুদ্ধমূর্তি।
হেরম্যান বললেন, ‘রিচার্ড তাঁর লেখায় মন্দিরকে হিন্দু মন্দির হিসেবে চিহ্নিত করলেও আসলে এ মন্দির ছিল দু’ধর্মের মিলনক্ষেত্র। ইতিহাসের গতি বড় বিচিত্র। এই দ্বীপরাজ্যে হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজারা নিজেদের আধিপত্য কায়েমের চেষ্টায় দীর্ঘদিন লড়াই চালালেও পরবর্তীকালে উভয়ের নিরাপত্তার স্বার্থেই পরস্পরের কাছাকাছি আসতে বাধ্য হয়েছিল।’
সুদীপ্ত বলল, ‘আচ্ছা, মন্দিরে মূল গর্ভগৃহ বলতে যা বোঝায়, সেরকম কিছু তো দেখছি না।’
হেরম্যান বললেন, ‘ব্যাপারটা আমারও মনে হয়েছে। আমি আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করছি। বৃত্তাকারে সাজানো তলাগুলোর এ-মাথা থেকে সে-মাথার ব্যাস প্রায় একশো ফুটের বেশি। কিন্তু প্রতি তলার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দু’পাশের ঘরের দৈর্ঘ্য পাওয়া যাচ্ছে আশি ফুটের মতো। আমার ধারণা বৃত্তাকার তলের কেন্দ্রবিন্দুতে ফাঁপা জায়গা আছে। হয় ঘর অথবা টানেলের মতো কিছু। যেখানে ঢোকার পথ হয়তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’
হেরম্যান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অনেক দূর থেকে বাতাসে গুমগুম একটা শব্দ ভেসে আসতে লাগল। রাইফেলের শব্দ! সুদীপ্তরা তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে সংকীর্ণ অলিন্দে এসে দাঁড়াল। শব্দটা আসছে জঙ্গলের ওপাশে সমুদ্রতীরের দিক থেকে। পরপর গুলির শব্দ!
তাদের মনে হল, রাইফেলের শব্দ যেন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ধীরে-ধীরে মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু তারপরই হঠাৎ সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সুদীপ্ত বলল, ‘হঠাৎ সব কিছু থেমে গেল কেন?’
হেরম্যান বললেন, ‘ঘটনাটা কী তা বোঝা যাচ্ছে না, তবে যাই হোক না কেন, মন্দিরের বাইরে যাওয়া উচিত নয়।’
সুদীপ্তরা উপর থেকে জঙ্গলের মধ্যে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখার চেষ্টা করতে লাগল। হঠাৎ সুদীপ্তর চোখ গেল অনেক নীচে চত্বরের দিকে। কী যেন একটা নড়ছে! সে বলল, ‘আরে, দেখুন-দেখুন, ছেলেটা! টুসু!’
একটা থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে একটা বিষ্ণুমূর্তির পাদদেশে খোলা চত্বরে বসল সে। এত উঁচু থেকে তার মুখ বোঝা না গেলেও মনে হয় বেশ ধীরস্থির ভাব। সম্ভবত সে রোদে বসে চারপাশে তাকাচ্ছে।
সুদীপ্ত বলল, ‘ওকে ডাক দেব?’
হেরম্যান বললেন, ‘এত উঁচু থেকে ওকে ডাকলে, সে শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত যাবে। সালুইনের দলবল কাছাকাছি থাকলে আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে। তবে ওকে আমাদের দরকার। আমরা নীচের ধাপে নামি। তারপর একজন আরও নীচে নেমে ওকে তুলে আনব।’
হেরম্যানের কথা মতোই উপর থেকে প্রথম ধাপে নেমে এলেন দুজনে। ঠিক তখনই হেরম্যান তাকে থামিয়ে বনের দিকে ইশারা করলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে চত্বরের দিকে আসছেন সালুইন। বেশ সন্ত্রস্ত ভঙ্গি তাঁর। চলতে-চলতে পিছন ফিরে জঙ্গলের দিকে তাকাচ্ছেন। চত্বরে উঠে তিনি কিছুটা এগোতে দুজনে দুজনকে দেখতে পেয়ে গেলেন। লাফিয়ে উঠে ছেলেটা অমনি দৌড়তে শুরু করল মন্দিরের দিকে। তার পিছু ধাওয়া করলেন সালুইন। ছেলেটা মন্দিরের কাছাকাছি এসেও আবার বাঁক নিয়ে হঠাৎই চত্বরের মাঝখানে ছুটে এসে ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল।
হেরম্যান আঁতকে উঠে বললেন, ‘ও সম্ভবত কোনো কুয়োয় ঝাঁপ দিল।’ সালুইন জায়াও প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই পৌঁছলেন কুয়োর কাছে। কয়েক মুহূর্ত সেখানে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর তিনিও ঝাঁপ দিলেন। চত্বর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন দুজনেই।
হেরম্যান এবার বললেন, ‘ছেলেটা নয় বাঁচার জন্য ঝাঁপ দিল, কিন্তু সালুইন লাফালেন কেন? নাকি ওই কুয়োর মধ্যে দিয়ে নামার রাস্তা আছে?’
সুদীপ্তরা মন্দিরের উপর দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল তাদের কর্তব্য কী? কিন্তু এর পরই এমন ঘটনা তারা চাক্ষুষ করল, যা না করলেই ভালো হত। একটা ঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে চত্বরটা লক্ষ করছিল দুজনে। হঠাৎ জঙ্গল থেকে ছুটতে ছুটতে বাইরে বেরিয়ে এল লু-সেন। স্পষ্টতই সে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। তার হাতে ধরা আছে রাইফেল। সে এসে চত্বরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে সম্ভবত সালুইনকে খুঁজল। তারপর চিৎকার করে ডেকে উঠল, ‘সালুইন, সালুইন আপনি কোথায়?’ কোনো উত্তর না পেয়ে আবার সে তার নাম ধরে ডেকে বলল, ‘আপনি কি মন্দিরে? যে ক’টা জংলি এসেছিল নিকেশ করেছি। আমাদের সব লোকও গিয়েছে। জংলিদের বড় দল আসার আগে দ্বীপের অন্য দিকে পালাতে হবে।’
তার কথার জবাব মিলল না।
আরও বার দুই ডাকার পর মনে হল, একটু ঘাবড়ে গেল লু-সেন। সে রাইফেল উঁচিয়ে শূন্যে কয়েকবার গুলি চালাল। শূন্য মন্দির চত্বরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই শব্দ। আর এর পরেই সূচনা হল সেই ভয়ংকর ঘটনার। ঘুম ভেঙে মনে হয় একটা স্তম্ভের মাথার উপর থেকে লু-সেনের সামনে লাফিয়ে নামল বিরাট এক কোমোডো। সুদীপ্তরা তার উপস্থিতি খেয়ালই করতে পারেনি। প্রাণীটা এগোল লু-সেনের দিকে । সঙ্গে-সঙ্গে গুলি চালাল সে। কিন্তু তার গুলি শেষ। কোনো শব্দ হল না। প্রাণীটা এগোচ্ছে তার দিকে। বেশ বড় আকার। সুদীপ্তরা অনুমান করল ন’-দশ ফুট হবে। গুলি না চলায় লু-সেন একটু হতভম্ব হয়ে রাইফেলের নলটা ধরে অস্ত্রটাকে মুশলের মতো করে ধরল। ড্রাগনটা এসে কামড়ে ধরল বন্দুকের কুঁদো। কিন্তু প্রাণীটা অসীম শক্তিধর। সে এক ঝটকায় অস্ত্রটা লু-সেনের হাত থেকে খসিয়ে ছুড়ে ফেলল দূরে। তারপর কয়েক পা পিছিয়ে আবার লু-সেনকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হল। সুদীপ্তরা অবাক হয়ে দেখল লু-সেন কিন্তু পালাল না। জামার নীচ থেকে একটা লম্বা ছুরি বের করল। সূর্যের আলোয় ঝলসে উঠল তার ফলা। তারপর মুহূর্তেই প্রাণীটা ঝাঁপাল তার দিকে, আর সে-ও প্রাণীটার দিকে। ড্রাগনটাকে জড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল লু-সেন। শুরু হল মরণপণ লড়াই। প্রাণীটা দাঁতের কামড়ে, লেজের ঝাপটায় ঘায়েল করতে চাইছে শত্রুকে, আর লু-সেন নিজেকে বাঁচিয়ে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে ড্রাগনের শরীরে। রুদ্ধশ্বাসে তারা দেখতে লাগল ভয়ংকর লড়াইয়ের দৃশ্য। শেষ পর্যন্ত কিন্তু এ লড়াইয়ে লু-সেনের জয় হল। একটা অদ্ভুত আৰ্তনাদ করে প্রাণীটা উলটে স্থির হয়ে গেল। লড়াইয়ের জায়গাটা লাল হয়ে গিয়েছে। ড্রাগনটার বুকের উপর বসে রাগে তার বুকে আরও কয়েকবার ছুরি চালাল। তারপর উঠে দাঁড়াল। তারও সর্বাঙ্গ লাল। হেরম্যান বিস্ময়ে মন্তব্য করলেন, ‘লোকটা মানুষ না দানব?’
লু-সেন উঠে দাঁড়িয়ে ঘৃণায় একটা লাথি কষাল মৃত কোমোডোর শরীরে। তারপর আবার সালুইনের নাম ধরে ডেকে মন্দিরের দিকে কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। ও দাঁড়াল কেন?
তার পরমুহূর্তেই সুদীপ্তরা দেখল এক বিস্ময়কর দৃশ্য। চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল মূর্তি-স্তম্ভের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল অনেক কোমোডো! অন্তত সংখ্যায় গোটা দশেক হবে। ব্যূহ রচনা করে এগিয়ে যাচ্ছে তারা লু-সেনের দিকে! পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে লু-সেন। ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে চক্রব্যূহ। শেষ মুহূর্তে একটা কাজ করল লু-সেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা লাফ দিয়ে উলটো দিকে ছুটল।
ড্রাগনগুলোও বিদ্যুৎগতিতে অনুসরণ করল তাকে। লু-সেন পালাতে পারল না। মাটিতে পড়ে গেল। বাঁচার জন্য সে তার শরীরটাকে গড়িয়ে নিয়ে অদৃশ্য হল একটা মূর্তি-বেদিকার আড়ালে। কোমোডোর দলও ছুটল সেদিকে। তারাও অদৃশ্য হল বেদির আড়ালে। সুদীপ্ত আর হেরম্যান উত্তেজনায় ধাপের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেই বেদির আড়ালে কী ঘটছে তা তাঁরা দেখতে না পেলেও কোমোডোদের সম্মিলিত শব্দ আর লু-সেনের আর্তনাদে বুঝতে অসুবিধে হল না সুদীপ্তদের। ব্যাপারটা অনুমান করে কাঁটা দিয়ে উঠল সুদীপ্তর শরীরে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লু-সেনের গগনভেদী শেষ আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। একটা রক্তস্রোত বেদির আড়াল থেকে বেরিয়ে জমা হতে লাগল চত্বরের মাঝে। সুদীপ্তদের কানে মাঝে-মাঝে ভেসে আসতে লাগল বেদির আড়ালে ড্রাগনগুলোর ঝটাপটির অস্পষ্ট শব্দ। নরমাংস নিয়ে সম্ভবত তারা ভোজ শুরু করেছে।
হেরম্যান আক্ষেপের স্বরে বললেন, ‘এরকম একটা সাহসী লোক নিজের কর্মফলে প্রাণ হারাল!’ এর পরেই তিনি বললেন, ‘আমাদের এভাবে দাঁড়ানো ঠিক নয়, চলো আড়ালে যাই।’ ধাপের কিনার ছেড়ে সুদীপ্তরা একটা ঘরে আত্মগোপন করল।
সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, ‘কিন্তু ছেলেটা আর সালুইনের কী হল?
তিনি বললেন, ‘জানি না। তবে অন্ধকার যতক্ষণ না নামবে, ততক্ষণ বাইরে যাওয়া যাবে না। সারাদিন এখানেই কাটাব আমরা।’ এক জায়গাতে সামান্য কিছু শুকনো ঘাস পড়ে আছে দেখলাম। তা দিয়ে একটা মশাল বানিয়ে ফেলি। রাতে কাজে লাগতে পারে।’