সুন্দাদ্বীপের সোনার ড্রাগন – ৬

গাছের গায়ে বাঁধা অবস্থায় বসে রইলেন হেরম্যান আর সুদীপ্ত।

‘এখন কী করবেন? এভাবে মৃত্যুই কি আমাদের ভবিতব্য?’ জিজ্ঞেস করল সুদীপ্ত। হেরম্যান বললেন, ‘দ্যাখো, মৃত্যু যেমন কঠিন ব্যাপার নয়, তেমন খুব সহজ ব্যাপারও নয়। তুমি ঘাবড়িও না, শেষ পর্যন্ত যদি অন্তিম পরিণতি নেমেও আসে, তবে তা আমাদের পক্ষে কম গৌরবজনক নয়। আমরা মরব বীরের মতো এই অজানা দ্বীপে।’ কথাগুলো বলে হাসলেন হেরম্যান।

সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু কোনো অভিযানে অর্ধেক পথে এভাবে মৃত্যু কি খুব ভালো?

ওরা যেভাবে আমাদের রেখে গেল তাতে মুক্তির তো কোনো উপায় দেখছি না।’ হেরম্যান বললেন, ‘আমার পকেটে একটা বড় ছুরি আছে, তবে ওরা আমাদের হাত এমনভাবে বেঁধেছে যে…!’

সুদীপ্ত বার কয়েক শরীরটাকে মুচড়ে চেষ্টা করল যদি কোনোভাবে বাঁধন খুলে বেরিয়ে আসা যায়। হেরম্যান চুপচাপ কী যেন ভাবছেন।

কিছু দূরে মৃদু একটা শব্দ হল। সুদীপ্তরা দেখল, একটা ঝোপ হঠাৎ দুলে উঠল । কী ওখানে? ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা কোমোডো! হেরম্যান চাপাস্বরে বললেন, ‘মড়ার মতো চুপচাপ থাকো। ও আক্রমণ করতে এলে একসঙ্গে চিৎকার করে ঘাবড়ে দিতে হবে।’

ড্রাগনটা দেখছে সুদীপ্তদের। মাঝে-মাঝে লম্বা জিভ মুখের বাইরে বের করছে। মাঝারি আকারের কোমোডো। প্রাণীটা কিন্তু একটু এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। তারপর সুদীপ্তদের কিছুটা দূর দিয়ে অন্য একটা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রাণীটা দূরে চলে যাওয়ায় সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, ‘ও চলে গেল কেন?’

হেরম্যান বললেন, ‘এত সুন্দর খাবার মজুত আছে দেখে মনে হয় বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করতে গেল। একদম গ্র্যান্ড ফিস্ট!’

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধে নামল। বসে থাকতে-থাকতে মনে হয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল সুদীপ্ত। হেরম্যানের ধাক্কায় তাকাল সে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসা চাঁদের আলোয় অন্ধকার কিছুটা ফিকে। হেরম্যান চাপাস্বরে বললেন, ‘কেমন যেন একটা শব্দ হচ্ছে!’

সুদীপ্তও শুনতে পেল সেই শব্দ। শুকনো পাতার উপর হালকা পায়ের শব্দ। যে গাছে তাদের বাঁধা হয়েছে সম্ভবত তার গুঁড়ির আড়াল থেকে। কিন্তু ফিরে দেখার উপায় নেই।

সুদীপ্ত বলল, ‘সেই কোমোডোটা ফিরে এল নাকি?’

হেরম্যান বললেন, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। চুপ করে থাকো, শব্দ’কোরো না। ভাগ্যে যা আছে হবে।’

ক্রমশ সুদীপ্তদের পিছনে এগিয়ে আসতে লাগল শব্দ। তাকে দেখতে না পেলেও সে যে গাছের গুঁড়ি লক্ষ করে এগোচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। শব্দটা থামল এসে তাদের ঠিক পিছনেই। হঠাৎই যেন ঘাড়ে একটা শীতল স্পর্শ অনুভব হল সুদীপ্তর। সাপের স্পর্শ? নিজেকে বাঁচাবার জন্য চিৎকার করে উঠল সে। হেরম্যানও চেঁচালেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই গাছের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল সেই ছেলেটা। তার হাতে ধরা একটা পাথরখণ্ড। ছেলেটা প্রথমে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল। বিস্মিত সুদীপ্তরা। ছেলেটা তার হাতের পাথরখণ্ডটা ঘসতে শুরু করল। দড়ি কাটার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পর পাথরের ঘসায় দড়িটা ছিঁড়ে গেল। সুদীপ্তও হাতটাকে সামনে এনে ছেলেটার চেষ্টায় আলগা করে ফেলল হাতের বাঁধন। তারা উঠে দাঁড়াল।

ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। সুদীপ্ত-হেরম্যান দুজনেই বিস্মিত। ছেলেটা নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে দুবার বলল, ‘টুসু-টুসু।’

সম্ভবত তার নাম টুসু। তারপর ছেলেটা সুদীপ্তদের ফ্যাসফ্যাসে গলায় আরও কিছু বলল, কিন্তু তার বিন্দুবিসর্গ তারা বুঝতে পারল না।

হেরম্যান বললেন, ‘সালুইনদের কথা শুনে যা বুঝেছি তাতে ও আস্কারি দ্বীপের বাসিন্দা। প্রকৃতির সন্তান। আসলে সাধারণ সভ্য সমাজের এইটুকু ছেলের পক্ষে যা অসম্ভব, ওর ক্ষেত্রে তা সম্ভব। তবে ওর গলার স্বর শুনে আমার মনে হচ্ছে ও ছোট হলেও আমরা ঠিক যত ছোট মনে করছি ও ঠিক তত ছোট নয়। ওর বুদ্ধি ও সাহস যথেষ্ট। হয়তো ও-ই আমাদের বাঁচার পথ দেখাতে পারে।’

সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু ওর কথা তো বোঝা যাচ্ছে না!’

হেরম্যান কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ছেলেটা হঠাৎ উত্তেজিতভাবে একদিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে শব্দ করল, ‘হুই! হুই!’

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সুদীপ্তরা দেখতে পেল দূরে জঙ্গলের মধ্যে দুটো উজ্জ্বল আলোর বিন্দু ঘোরাফেরা করছে। না, সেগুলো কোমোডোর চোখ নয়, টর্চের আলো!

সেগুলো এদিকেই আসছে। কেমন যেন পাংশু হয়ে গেল ছেলেটার মুখ। ভয় পেয়ে সে কী যেন বলল সুদীপ্তদের। তারপর ছুটতে শুরু করল জঙ্গলের অন্য দিকে। সম্ভবত সালুইন আর লু-সেন কোনো কারণে ফিরে আসছেন!

হেরম্যান বললেন, ‘পালাও।’

ছেলেটা যেদিকে ছুটছে সেদিকেই ছুটতে শুরু করলেন তাঁরা। জঙ্গল ভেঙে ছোটার শব্দে তাঁদের গতিপথ টের পেয়ে গেলেন সালুইনরা। সঙ্গে-সঙ্গে পরপর গর্জে উঠল তাঁদের রাইফেল। ছুটন্ত সুদীপ্তদের মাথার হাতখানেক উপর দিয়ে রাইফেলের বুলেট গিয়ে লাগল একটা ডালে। ঝোপঝাড় ভেঙে সুদীপ্তদের তাড়া করলেন তাঁরা।

দুজনে ছুটেই চলছে বাঁচার জন্য। পড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে-সঙ্গে উঠে আবার ছুটছে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে হাত-পা, অন্ধকারে গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা লেগে থেঁতলে যাচ্ছে শরীর। ছেলেটা কোন দিকে গেল, তারা কোন দিকে যাচ্ছে, কিছুই খেয়াল নেই। শুধু ছোটা আর ছোটা! এক সময় তাদের পিছনে পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল, তবুও তারা থামল না।

ঘণ্টা তিনেক ছোটার পর তাদের শক্তি ফুরিয়ে এল। একসময় আর এগোতে পারল না। একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল দুজনেই। উঠে বসার মতো শক্তি তখন আর নেই।

রাত তখন কত খেয়াল নেই। উঠে বসে সুদীপ্ত দেখল, হেরম্যানও উঠে বসেছেন। কেন তার ঘুম ভাঙল সুদীপ্ত পরক্ষণেই বুঝতে পারল। দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে স্পষ্ট একটা শব্দ। ঘণ্টাধ্বনি! বেশ গম্ভীর শব্দে বাজছে। আলো-আঁধারি মাখা জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ছে সেই শব্দ। রহস্যময় চাঁদের আলো আর ঘণ্টাধ্বনি মিলেমিশে কেমন যেন ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে!

হেরম্যান বললেন, ‘শুনতে পাচ্ছ?’

সুদীপ্ত বলল, ‘হ্যাঁ, পাচ্ছি। সুন্দা ধীবরদের কথা তা হলে মিথ্যে নয়?’

তিনি বললেন, ‘না, মিথ্যে নয়। রিচার্ডের দেখা সেই মন্দিরও আছে। হয়তো বা সেই সোনালি ড্রাগনও মিথ্যে নয়।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেরম্যান বললেন, ‘আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। হয় মানুষ বাজাচ্ছে, নয়তো বাতাস বা অন্য কোনোভাবে দুলছে ঘণ্টাটা।’

সুদীপ্ত বলল, ‘সালুইন বা তাঁর দলবল বাজাচ্ছেন না তো?’

হেরম্যান বললেন, ‘তাদের আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। তারা নিশ্চয়ই নিজেদের উপস্থিতি জানান দেবে না। ঘণ্টার শব্দ দ্বীপের বাইরেও যায়।’

বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাজার পর এক সময় থেমে গেল সেই শব্দ। হেরম্যান বললেন, ‘শব্দটা আসছিল উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। আলো ফুটলে ওই দিকেই এগোব।’ সুদীপ্ত তাকিয়ে দেখল শুকতারা ফুটে উঠেছে।

হেরম্যান হঠাৎ বললেন, ‘আচ্ছা, জঙ্গলে ঢোকার পর তুমি ছেলেটাকে আর দেখেছিলে?’

সুদীপ্ত বলল, ‘দেখিনি। হয়তো ওর সন্ধানেই সালুইনরা ফিরে এসেছিলেন।’

হেরম্যান বললেন, ‘ওর জন্যই আমরা এখনও বেঁচে আছি। জানি না আর ওর সঙ্গে দেখা হবে কিনা!’ উত্তর দিক থেকে বেশ ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে। হেরম্যান বললেন, ‘সম্ভবত সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থান করছি আমরা। ঠান্ডা হাওয়া সেখান থেকেই আসছে।’ সুদীপ্তরা ছেলেটার কথা ভাবতে-ভাবতে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করতে লাগল। একসময় সত্যিই ভোর হল।

সুদীপ্তরা উঠে দাঁড়াল, হাঁটতে শুরু করল উত্তর-পশ্চিম দিকে।

একসময় জঙ্গল ফিকে হয়ে এল। আর তারপরই গাছপালার ফাঁক দিয়ে সুদীপ্তরা দেখতে পেল খোলা জায়গায় সূর্যের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে কালো পাথরে তৈরি ভগ্নপ্রায় বিশাল এক প্রাচীন মন্দির!

হেরম্যান সুদীপ্তকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আছে! আছে! দ্যাখো, ভাগ্য আমাদের ঠিক জায়গায় এনে ফেলেছে! আমার মন বলছে কষ্ট বিফলে যাবে না।’ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তাঁরা এগোলেন মন্দিরের দিকে।