সুন্দাদ্বীপের সোনার ড্রাগন – ৪

জাঙ্ক থেকে নেমে হাঁটুজল পেরিয়ে পারে উঠল সুদীপ্তরা। জাঙ্কের থেকে সকলেই নামল। সেই ছেলেটার কোমরে দড়ি বেঁধে লু-সেন তাকে নামাল। ছোট ছেলেটার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। হেরম্যান পারে উঠে সালুইনকে বললেন, ‘ছেলেটাকে কি লু-সেন বেঁধেই রাখবে? আমার দেখতে খুব খারাপ লাগছে!’

সালুইন বললেন, ‘ব্যাপারটা আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু উপায় নেই। এত বড় জঙ্গলে ও যদি পালিয়ে যায়, তা হলে খোঁজা মুশকিল হবে’

জাঙ্কের নাবিকরা জিনিসপত্র সব নামিয়ে ফেলল। সুদীপ্তদের জিনিসপত্র তেমন নেই।

দুটো রুকস্যাক, দিনকয়েকের মতো কিছু শুকনো খাবার, সামান্য পোশাক, ক্যামেরা, ছুরি, কাগজপত্র আর টুকিটাকি জিনিস। এ ছাড়া আছে একটা হালকা অথচ মজবুত তাঁবু।

তটরেখার কিছু দূর থেকেই শুরু হয়েছে জঙ্গল। সালুইন বাইনোকুলার দিয়ে চারপাশ দেখে নেওয়ার পর সকলে জঙ্গলে ঢুকল। দলের সব শেষে সেই ছেলেটা আর তার কোমরের দড়ি হাতে লু-সেন। জঙ্গলের ভিতর বেশ কিছুটা এগোবার পর বিশাল একটা গাছের সামনে সালুইনরা থামলেন। গাছটা দেখে অবাক হয়ে গেল সুদীপ্ত। পাঁচজন মানুষও বেড় দিয়ে ধরতে পারবে না গাছটার গুঁড়ি। সেই গুঁড়ি যেন উপরে উঠে স্তম্ভের মতো আকাশকে ধরে রেখেছে।

সালুইন বললেন, ‘ট্রপিক্যাল রেন ফরেস্টে এ ধরনের বড় গাছ দেখা যায়।’ তারপর হেরম্যানের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি এখানে তাঁবু ফেলব। আপনারা এখানেই ফিরবেন।’ হেরম্যান বললেন, ‘ঠিক আছে। তা হলে এই কথাই রইল। তিনদিনের মধ্যে ফিরে আসব আমরা।’

এর পর সালুইন আর লু-সেনের থেকে বিদায় নিয়ে এগোতে যাচ্ছিল সুদীপ্তরা। হেরম্যান সেই ছেলেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না। তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।’ তিনি কথাগুলো ইংরেজিতেই বললেন, যা ছেলেটার বোঝার কথা নয়। কিন্তু কথাগুলো বলে তিনি যেই পা বাড়াতে গেলেন, হঠাৎ ছেলেটা হেরম্যানের কোটের প্রান্তটা খামচে ধরে উদ্ভট ভাষায় কী বলতে যেন শুরু করল। হেরম্যান দাঁড়িয়ে পড়লেন। ছেলেটার কথা হেরম্যান বা সুদীপ্তর বোধগম্য হচ্ছে না। সালুইন হেরম্যানের কোটটা ছাড়াবার জন্য ছেলেটার কাছে এগিয়ে এলেন। কিন্তু সে আরও জোরে চেপে ধরল কোটটা এবং চেঁচিয়ে হেরম্যানকে কী যেন বলার চেষ্টা করতে লাগল। লু-সেন এবার চিৎকার করে একটা হ্যাঁচকা টান দিল দড়িতে। সেই টানে হেরম্যানের কোট ছেড়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল ছেলেটা।

সুদীপ্ত তাড়াতাড়ি মাটি থেকে তাকে তুলে দাঁড় করাল। হেরম্যান বললেন, ‘না, ওর মাথা একদম খারাপ হয়ে গিয়েছে। ও আমাকে কী বলছিল?’

লু-সেন বলল, ‘তেমন কিছু না। জল দেখে ও ভয় পেয়েছে। আপনারা যাত্রা শুরু করুন।’

হেরম্যান বললেন, ‘ওকে বেশি বকাবকি করার দরকার নেই। ঘরবাড়ি ছেড়ে এত দূরে এসেছে তো!’

ছেলেটা উঠে দাঁড়াবার পর আর কোনো কথা না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সুদীপ্তদের দিকে। হেরম্যান আর না দাঁড়িয়ে অরণ্যের ভিতরে ঢোকার জন্য সুদীপ্তকে নিয়ে এগোলেন।

হেরম্যান বললেন, ‘আমার অভিযান এবার বিফলে যাবে না। মাঝেমধ্যে ভাবতে খুব খারাপ লাগে যে, প্রচলিত বিজ্ঞানের চর্চা যাঁরা করেন, তাঁরা আমাদের নিয়ে কত হাসাহাসি করেন! এ কাজে না আছে টাকাপয়সা, না আছে খ্যাতি।’

সুদীপ্ত বলল, ‘তা হলে এ কাজ করেন কেন?’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘বলতে পারো, এটা একটা নেশা।’

সুদীপ্ত বলল, ‘আচ্ছা, এসব জঙ্গলে সত্যিই কি সোনা লুকনো থাকতে পারে?’ হেরম্যান বললেন, ‘প্রাচীন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সম্পদ লুকিয়ে থাকা অসম্ভব নয়। আসলে এসব নিয়ে নানা মিথ গড়ে ওঠে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে হিন্দু ও বৌদ্ধদের আগমন ঘটে এসব অঞ্চলে। সুমাত্রা ও জাভা অঞ্চলে গড়ে ওঠে শ্রীবিজয় রাজ্য। দ্বাদশ শতাব্দীতে পূর্ব জাভার মাজাপাহিত হিন্দু রাজ্যের উত্থান হয়। শ্রীবিজয় রাজ্যের পতন ঘটে। বৌদ্ধদের প্রায় গোটা ইন্দোনেশিয়ায় কায়েম হয় মাজাপাহিতদের শাসন। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সুমাত্রায় আরবদের আগমন হয় এবং সেই সঙ্গে শুরু হয় মাজাপাহিতদের শাসন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আরবারই জয়ী হয়। প্রবাদ আছে, আরবদের আক্রমণে যখন মাজাপাহিতদের পতন ঘটতে চলেছে, তখন বরবুদুরের নির্মাতা শৈলেন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজাদের বংশধররা ও যবদ্বীপের হিন্দু রাজারা নাকি দীর্ঘদিনের শত্রুতা ভুলে হাতে হাত মিলিয়ে তাদের সব সম্পদ কোনো এক অজানা দ্বীপে মন্দিরের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেন। আশা ছিল, আরবরা চলে গেলে সেইসব সম্পদ ভাগ করে নেবেন। কিন্তু আরবদের পর একে-একে আসে পোর্তুগিজ-ওলন্দাজ-ইংরেজরা। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে নাকি হারিয়ে যায় সেই মন্দিরের ঠিকানা। তবে স্থানীয় লোকের বিশ্বাস, আজও নাকি অজানা মন্দিরে লুকোনো আছে সেই সম্পদ।’

খবর আপনি জানলেন কীভাবে?’

সুদীপ্ত আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘এত বড় হেরম্যান বললেন, ‘প্রত্নবিদ রিচার্ডের লেখা থেকে জেনেছি। কথা প্রসঙ্গে রিচার্ড মন্দিরের গুপ্তধনের মিথের ব্যাপারটা উল্লেখ করেছেন।’

সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে জঙ্গল আরও গভীর হতে লাগল। টানা ঘণ্টাচারেক চলার পর দুপুরের খাবারের জন্য কিছুক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়ালেন তাঁরা। ঠিক সেই সময় প্রথম একটা প্রাণী দেখল সুদীপ্তরা। অনেকটা শূকরের মতো দেখতে বড় প্রাণী। নাকটা শুঁড়ের মতো।

হেরম্যান বললেন, ‘ও হল টেপির।’

দুপুরের সামান্য কিছু আহারের পর আবার চলা শুরু হল। কিছু ম্যাকাও গোত্রের পাখিও এবার দেখা গেল যাত্রাপথে। বেলা চারটে নাগাদ হেরম্যান হিসেব করে দেখলেন, জঙ্গলের মধ্যে মাইল দশেক পথ পেরিয়ে এসেছেন। বললেন, ‘আরও এক ঘণ্টা চলব আমরা, তারপর তাঁবু ফেলব।’

সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি যদি সোনালি কোমোডোর খোঁজ পান, কী করবেন?’ তিনি বললেন, ‘তাকে ধরা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তার ভিডিয়োগ্রাফি করে সভ্যসমাজে হাজির করব। ওর বাসস্থানও চিহ্নিত করব আমরা, যাতে ভবিষ্যতে লোকজন তাকে চাক্ষুষ করতে পারে। বিজ্ঞানীরা তো আবার চোখে না দেখলে কিছু বিশ্বাস করেন না!’

আরও কিছুটা চলার পর হঠাৎই যেন থমকে দাঁড়ালেন হেরম্যান। সুদীপ্ত তাঁকে বলতে যাচ্ছিল, ‘কী হল?’

কিন্তু তার আগেই তিনি আঙুল তুলে কী যেন দেখালেন। সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠল সুদীপ্ত। কিছু দূরে একটা গাছের ফোকর থেকে উঁকি দিচ্ছে বিরাট বড় মানুষের একটা মাথা! দাঁত বের করে বিরাট মাথাটা যেন সুদীপ্তদের গিলে খেতে চাইছে। তারা এর পর তার দিকে এগিয়ে গেল। পাথরের তৈরি প্রাচীন রক্ষীমূর্তি। গাছের উপর থেকে নেমে আসা মোটা ঝুরির আড়ালে দেহটা এমনভাবে অদৃশ্য যে, শুধু তার ভয়ংকর মুখটাই নজরে আসছে। কালো পাথরের তৈরি রক্ষীমূর্তি, উচ্চতায় প্রায় পনেরো ফুট হবে। জায়গাটা ভালো করে দেখে হেরম্যান উৎফুল্লভাবে বললেন, ‘এটা দেখে মনে হচ্ছে প্রাচীন ধ্বংস্তূপের কাছাকাছি পৌঁছেছি আমরা। হয়তো কোনো তোরণ ছিল এখানে। সূর্য ডুবতে বেশি দেরি নেই। এখানে তাঁবু ফেলা যাক। কাল ভোর থেকে আবার অনুসন্ধান শুরু হবে।’

মূর্তিটার কিছু দূরে একটা ফাঁকা জায়গা বেছে সুদীপ্তরা তাঁবু খাটিয়ে ফেলল। হেরম্যানের পরামর্শমতো শুকনো ডালপালা জোগাড় করে তাঁবু ঘিরে একটা প্রাচীরও দেওয়া হল। ধীরে-ধীরে বনে আলো কমে আসতে লাগল। রাতের খাওয়া সেরে সুদীপ্তরা তাঁবুতে ঢুকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুদীপ্তর চোখে ঘুম নেমে এল।

তখন সম্ভবত মাঝরাত। হেরম্যানের মৃদু ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল সুদীপ্তর। হেরম্যান চাপা স্বরে বললেন, ‘বাইরে কিছু শুনতে পাচ্ছ?’

সুদীপ্ত কান খাড়া করতেই শুনতে পেল সেই শব্দ। কেউ যেন বাইরে শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে! কখনও তাঁবুর কাছে আসছে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে। কে ও? শব্দটা কিছুক্ষণ শোনার পর সুদীপ্তরা তাঁবুর দরজা ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিল। চাঁদ উঠেছে। তার আলোয় সুদীপ্তদের নজরে পড়ল সেই বীভৎস মুখটা। অরণ্যের প্রাচীন প্রহরী সুদীপ্তদের তাঁবুর দিকে তাকিয়ে যেন এক রহস্যময় হাসি হাসছে। এরপর তারা দেখল, মূর্তির পায়ের কাছে গাছের গুঁড়ির নীচে ঘুরে বেড়াচ্ছে দু’জোড়া জ্বলন্ত চোখ! পাতা ভাঙার শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে একটা হিসহিস শব্দও কানে আসছে সেদিক থেকে। হেরম্যান চাপাস্বরে বললেন, ‘ওগুলো কী অনুমান করতে পারছ?’

সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, পারছি।’

হেরম্যান টর্চ বের করলেন। তারপর সেই জায়গায় আলো ফেললেন।

সুদীপ্তরা দেখল, হ্যাঁ, তাদের অনুমানই ঠিক। সেই আলোর মধ্যে ধরা পড়েছে দুটো জীবন্ত কোমোডো ড্রাগন! উজ্জ্বল আলোয় মনে হয়, তাদের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছে। তারা তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। মাঝেমধ্যে শুধু তাদের চেরা লম্বা জিভ মুখের বাইরে বের করছে। টর্চের আলোয় তাদের ভাঁটার মতো চোখ জ্বলছে। আকারে প্রাণী দুটো সম্ভবত ফুট ছ’য়েক হবে।

হেরম্যান বললেন, ‘সম্ভবত খাবার খুঁজতে বেরিয়েছে ওরা।’

টর্চের আলোয় বিস্ময়ের ভাব কাটিয়ে একটা প্রাণী হাঁ করল। মুহূর্তের জন্য তার মুখের ভিতরের সাজানো দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। সুদীপ্ত বলল, ‘প্রাণীগুলো আমাদের আক্রমণ করবে নাকি?’

কিন্তু তারা কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে গাছের আড়ালে চলে গেল। তারা চলে যাওয়ার পর হেরম্যান বললেন, ‘ভোরের আলো ফুটলেই বেরিয়ে পড়ব আমরা। তবে আলো ফুটতে এখনও ঘণ্টাপাঁচেক বাকি। এ সময়টা ঘুমিয়ে নিই।’