সুন্দাদ্বীপের সোনার ড্রাগন – ৩

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সুদীপ্তরা যখন ডেকে পা রাখল, বাতাসে বেশ ঠান্ডা ভাব। সালুইন, লু-সেনসহ জাঙ্কের নাবিকরা ডেকেই হাজির। নাবিকদের দুজন পাল খাটাতে শুরু করেছে।

হেরম্যান পালের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘জাঙ্ক কি এবার পালে চলবে?’

সালুইন বললেন, ‘পুরোটা নয়, কিছুটা। ট্রাইবাল আইল্যান্ড পেরোতে হবে। কুয়াশার জন্য দ্বীপবাসীরা হয়তো আমাদের দেখতে পাবে না। ইঞ্জিনের শব্দ ওদের কানে যেতে পারে। দ্বীপের অধিবাসীরা আদিম। সভ্য মানুষদের পছন্দ করে না। আমরাও দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইঞ্জিন বন্ধ করে দেব।,

সুদীপ্ত বলল, ‘ওই দ্বীপের নাম কী?’

সালুইন বললেন, ‘নামটা অদ্ভুত! ‘আস্কারি অফ গড’ অর্থাৎ ‘ভগবানের প্রহরী’। ওই দ্বীপ থেকে ‘ওরা’ দ্বীপের দূরত্ব মাত্র মাইল দুই। আমরা অবশ্য নামব ‘ওরা’ দ্বীপের উলটো পারে নিরাপদ জায়গায়।

‘দ্বীপটার ও নাম কেন?’ জানতে চাইলেন হেরম্যান।

সালুইন বললেন, ‘লোকে বলে, হাজার বছর আগে যখন ‘ওরা’ দ্বীপে মানুষ থাকত, তখন ওখানে নাকি রক্ষীদল থাকত। নামটা অবশ্য সাহেবরা দিয়েছে।’

পাল খাটানো হয়ে গেল। সালুইনের সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বলে লু-সেন চলে গেল ইঞ্জিনঘরে। তারপরই জাঙ্ক চলতে শুরু করল। ডেকে দাঁড়িয়ে রইল সালুইনসহ সুদীপ্তরা। দ্বীপটা কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। জাঙ্কের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। ইঞ্জিনঘর থেকে বেরিয়ে এল লু-সেন। হাতে একটা বাইনোকুলার। সেটা তুলে দিল সালুইনের হাতে। বাইনোকুলার দিয়ে সালুইন দ্বীপের দিকে চোখ রাখলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বীপের প্রায় কাছাকাছি চলে এল জাঙ্ক। তারপর দ্বীপটাকে পাশে রেখে এগিয়ে চলল। সালুইন আর লু-সেনের দৃষ্টি দ্বীপের দিকে। ডেকের কোণ থেকে দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার শোনা গেল। সুদীপ্ত তাকিয়ে দেখল, এক কোণে রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে রাখা কাঠের পিপের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে সেই ছেলেটা। আঙুল তুলে দ্বীপের দিকে দেখিয়ে উত্তেজিত স্বরে কী যেন বলছে! লু-সেন ছেলেটার দিকে এগোল। হঠাৎই সকলকে চমকে দিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিল ছেলেটা! প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সালুইন চিৎকার করে উঠলেন, ‘ছেলেটার মনে হয় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে! ওকে জাঙ্কে তোলো।’

লু-সেন বলল, ‘কিন্তু জাঙ্ক আর দ্বীপের কাছে নেওয়া যাবে না। অসভ্যরা আক্রমণ করতে পারে। তবে ও পালাতে পারবে না।’ লু-সেন আর সময় নষ্ট করল না। রেলিংয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে সে-ও লাফ দিল জলে। ছেলেটা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। ওকে তাড়া করল লু-সেন।

সালুইন জাঙ্কের লোক দুজনকে বললেন, ‘নোঙর ফেলে জাঙ্ক দাঁড় করাও। কাছি ধরে থাকবে। ওরা জাঙ্কে উঠলেই নোঙর তুলে নেবে।’

তাঁর কথামতো কাজ হল। ছেলেটা মনে হয় বুঝতে পারল লু-সেন তার পিছনে রয়েছে। সে গতি বাড়িয়ে দিল। ক্রমশ তারা দুজনেই সেই দ্বীপের দিকে এগোতে লাগল। হেরম্যান আর সুদীপ্ত দেখতে লাগলেন রুদ্ধশ্বাস সেই দৃশ্য। কিন্তু লু-সেনের সঙ্গে সাঁতারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারল না ছেলেটা। লু-সেন-তাকে ধরে জাঙ্কের দিকে টেনে আনতে লাগল। তাকে নিয়ে কাছি ধরে জাঙ্কে উঠল। ছেলেটা কাঁপছে। লু-সেন ডেকে উঠে ছেলেটাকে তার ঘরের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর ছুটল ইঞ্জিনঘরের দিকে। ফের ইঞ্জিন চালু হল। দ্বীপটাকে পাশে রেখে দ্রুত এগিয়ে চলল জাঙ্ক৷

যতক্ষণ না জাঙ্ক সে দ্বীপের সীমানা পেরোল, ততক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর মাইলখানেক দূরে চোখে পড়ল আর-একটা দ্বীপ।

সালুইন আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে ‘ওরা’ দ্বীপ। দ্বীপটাকে বেড় দিয়ে অন্য পাশে নামব আমরা।’

হেরম্যান বললেন, ‘ও হঠাৎ ঝাঁপ দিল কেন?’

সালুইন বললেন, ‘জল দেখে মনে হয় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তবে দ্বীপে উঠলে জংলিরা ওকে মেরে পুড়িয়ে খেত!’

সুদীপ্ত বলল, ‘এখানে কি ক্যানিবল আছে নাকি?’

তিনি বললেন, ‘এ দেশের বোর্নিওতে আছে। শুনেছি, আস্কারি দ্বীপের বুনোদেরও নাকি এ ব্যাপারে অরুচি নেই!’

‘ওরা’ দ্বীপ এগিয়ে আসতে লাগল। সকালের সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে সোনালি বালুতট। তার কিছুটা তফাত থেকেই শুরু হয়েছে ঘন গাছের জঙ্গল। জঙ্গল এত ঘন যে বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। দিনমানেও সূর্যের আলো মাটি ছুঁতে পারছে না। দ্বীপের কাছে পৌঁছেও জাঙ্ক কিন্তু প্রথমে তটরেখা স্পর্শ করল না। দ্বীপটাকে বেড় দিয়ে এগিয়ে চলল।

সালুইন হেরম্যানকে বললেন, ‘দ্বীপে পা রাখার আগে দু’দলের কর্মপন্থা ঠিক করে নেওয়া দরকার। তা হলে এক দলের জন্য অন্যদের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে না।’

হেরম্যান বললেন, ‘আমিও কথাটা বলতাম। আপনার পরিকল্পনাটা জানাবেন?’ সালুইন বললেন, ‘আমার কাজ শেষ হতে তিন থেকে সাতদিন লাগতে পারে। গোটা জঙ্গল ঘুরে ভালো গাছ বাছতে হবে তো। সমুদ্রতটের কাছাকাছিই তাঁবু ফেলব। আপনারা আপনাদের মতো কাজ করুন, আমরা আমাদের মতো। তিনদিন পর পরশু সন্ধের মধ্যে তাঁবুর কাছে ফিরে আসবেন। তারপর স্থির করব দ্বীপে থাকার দরকার আছে কি না।’

হেরম্যান বললেন, ‘ঠিক আছে। এটাই ভালো বন্দোবস্ত।’

সালুইন বললেন, ‘জঙ্গলে তো নামতে যাচ্ছেন! আপনাদের সঙ্গে কোনো হাতিয়ার আছে তো? এ সময়টায় আবার কোমোডো ড্রাগনের ডিম থেকে বাচ্চা বেরোয়। ভিমে তা দেওয়ার ফলে ক্ষুধার্ত থাকে ওরা। ওরা দূর থেকে মাংসের গন্ধ পায়। ওদের চোয়ালে কত দাঁত আছে জানেন? ষাটটা! আমার বা আপনার মতো একটা মানুষকে খেয়ে নিতে পারে!’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘ওদের সম্বন্ধে আমিও কিছুটা পড়েছি।’

এরপর জাঙ্কের একজন লোক এসে সালুইনকে বলল যে, লু-সেন তাঁকে ডাকছে। কাজেই সালুইন সেদিকে এগোলেন।

সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, ‘দ্বীপটায় কীভাবে অনুসন্ধান চালাবেন?’

হেরম্যান বললেন, ‘প্রতুবিদ রিচার্ড প্রাচীন এক ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি প্রাণীটাকে দেখেছিলেন। ও জাতীয় ধ্বংসস্তূপ দ্বীপের কোথায় কোথায় আছে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা একদিক থেকে শুরু করে গোল হয়ে অনুসন্ধান চালাব।’

সুদীপ্ত বলল, ‘আর সালুইন যে হাতিয়ারের কথা বললেন?’

হেরম্যান বললেন, ‘আমার কাছে রিভলভার আছে। ওর চেয়ে বেশি কিছুর দরকার হবে বলে মনে হয় না।’

সুদীপ্ত চেয়ে রইল ‘ওরা’ দ্বীপের দিকে। এগোতে শুরু করল জাঙ্ক।