পরদিন সুদীপ্তরা যখন বন্দরে গিয়ে পৌঁছল তখন সূর্যদেব সবে উদয় হচ্ছেন। হেরম্যান বলেছেন তাদের জাঙ্কের নাম ‘ঘোস্ট’।
হেরম্যান বললেন, ‘চলো, ঘোস্টকে খুঁজে বের করার আগে কফি খেয়ে নেওয়া যাক।’
সুদীপ্তরা দোকানে ঢুকল। দু’মগ কফি নিল। কফি শেষ করে হেরম্যান যখন দাম মেটাতে যাচ্ছেন তখন দোকানদার বলল, ‘না, পয়সা লাগবে না।’
হেরম্যান বললেন, ‘কেন, আমরা বিদেশি বলে?’
চুপ করে থেকে লোকটা জবাব দিল, ‘আমাদের বিশ্বাস আছে, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে পানীয় দান পুণ্যের কাজ।’
সুদীপ্তরা বেশ অবাক হল তার কথা শুনে। হেরম্যান প্রশ্ন করলেন, ‘কী বলতে চাইছেন আপনি?’
বৃদ্ধ বলল, ‘কাল বিকেলে আপনিই তো ‘ওরা’ দ্বীপে যাওয়ার জন্য নৌকো খুঁজছিলেন! আপনারা যে ওখানে যাচ্ছেন সেটা চাউর হয়ে গিয়েছে। ওই দ্বীপে প্রাচীন পুরোহিতদের প্রেতাত্মারা থাকেন। কোমোডোও আছে অনেক। মার্চ-এপ্রিল হল ওদের ডিম ফোটার সময়। ওরা এখন হিংস্র হয়ে ওঠে। ওই দ্বীপের গা ঘেঁষেই একটা দ্বীপে অসভ্য মানুষের বাস। ওদের তিরে অনেক ধীবরের প্রাণ গিয়েছে। কাজেই এত বিপদকে ফাঁকি দিয়ে আপনাদের ফিরে আসাটা…!’ কথাটা শেষ করল না লোকটা।
হেরম্যানও আর কথা বাড়ালেন না। সুদীপ্তকে বললেন, ‘অসভ্যদের দ্বীপের কথাটা জানা ছিল না। তবে চিন্তার কিছু আছে বলে মনে হয় না। বিদেশি দেখলে স্থানীয় মানুষরা অনেক কথা বাড়িয়ে বলে!’
সমুদ্রের তীর ধরে জাঙ্কের খোঁজে হাঁটতে শুরু করল সুদীপ্তরা। হেরম্যান বললেন, ‘আরে, এই তো আমাদের জাঙ্কের মালিক লু-সেন! আমাদেরই খুঁজতে এদিকে আসছে।’ সুদীপ্ত দেখল এগিয়ে আসছে লম্বা এক চিনা লোক। সে এসে দাঁড়াল সুদীপ্তদের সামনে। পরনে নেটের গেঞ্জি আর জিনস্ । ডান হাতের উপর দিকে কোমোডো ড্রাগনের উল্কি আঁকা। সে তার কুতকুতে চোখে একবার ভালো করে জরিপ করে নিল দুজনকে।
লু-সেন বলল, ‘চলুন, মিস্টার সালুইন জায়া চলে এসেছেন। আপনাদের জন্যই দেরি হচ্ছে।’
সুদীপ্তরা লাগেজ নিয়ে অনুসরণ করল তাকে। যেতে-যেতে লোকটা হেরম্যানের উদ্দেশে বলল, ‘শুনুন মিস্টার, আমি ছাড়া অন্য কেউ যে আপনাকে ‘ওরা’ দ্বীপে নিয়ে যেতে সাহস করবে না তা নিশ্চয়ই বুঝেছেন! টাকা দিচ্ছেন বলে মাথা কিনে নিচ্ছেন ভাববেন না। জাঙ্ক আমার মর্জিমতো চলে। ইচ্ছে না হলে কালই ফিরে আসতে পারি আমি। সেক্ষেত্রে টাকা ফেরত পাবেন। আগেই কথাগুলো জানিয়ে দিলাম।’
অন্য নৌকোগুলো থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়েছিল ঘোস্ট। গায়ে তার নাম লেখা। বেশ পুরনোই। একটা পালও আছে। আরও দুজন মাল্লা আছে। কাঠের পাটাতন বেয়ে লু-সেনের সঙ্গে জাঙ্কে ওঠার পর সে সুদীপ্তদের জাঙ্কের একটা ঘর দেখিয়ে চলে গেল ইঞ্জিনঘরের দিকে। লু-সেনের দেখানো ঘরে ঢুকল সুদীপ্তরা। ভিতরটা মামুলি। কাঠের ঘর, নিচু ছাদ। আসবাব বলতে একটা খাট। সুদীপ্তরা সে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র রাখতে-না-রাখতেই জাঙ্ক কেঁপে উঠল। ইঞ্জিন চালু হয়ে গিয়েছে। সুদীপ্ত ছোট ডেকের চারপাশ ভালো করে দেখল। এক দিকে দুটো খুপরি ঘর, অন্য দিকে রেলিংয়ের সঙ্গে কাছি দিয়ে বাঁধা আছে কয়েকটা পিপে। তার পাশেই একটা খাঁচায় রয়েছে দুটো বাঁদর জাতীয় ছোট প্রাণী। জাঙ্কের খোলে নামার পথ পিছন দিকে। সিঁড়ির কিছু অংশ জেগে আছে ডেকের উপর। সামনে সারেঙের ঘর।
জল কেটে এগিয়ে চলল জাঙ্ক। আশপাশে আরও কিছু নৌকো এগিয়ে চলেছে সমুদ্রের গভীরে।
তটরেখা অস্পষ্ট হতে-হতে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। কুয়াশার আবরণ মুছে গিয়ে ফুটে উঠছে দু’-একটা অস্পষ্ট দ্বীপ। হঠাৎ সারেঙের ঘরের দিক থেকে একজন লোককে হেঁটে আসতে দেখল সুদীপ্তরা। মাঝবয়সি, চোখে কালো সানগ্লাস, পরনে নীল রঙের দামি সুট। ভদ্রলোক সুদীপ্তদের সামনে এসে বললেন, ‘আমি, সালুইন। সালুইন জায়া। আপনারাই তো ‘ওরা’ দ্বীপে যাচ্ছেন? পরিচয় করতে এলাম।’ করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।
পরিচয়দান ও করমর্দন শেষ হলে হেরম্যান জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি তো ব্যবসার কাজে ওখানে যাচ্ছেন শুনেছি? ওই দ্বীপে আগে গিয়েছেন? কত সময় লাগবে যেতে?’
সালুইন বললেন, ‘ওই দ্বীপের পাশ দিয়ে আমি একবার গিয়েছি, কিন্তু নামা হয়নি। বেশ বড়, জনমানবহীন দ্বীপ। সন্ধে নাগাদ ওর কাছে পৌঁছে যাব আশা করা যায়। তবে রাতে তো নামা যাবে না। ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’ একটু থেমে ভদ্রলোক হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা ওদিকে কেন যাচ্ছেন? কোনও গুপ্তধনের খোঁজে নাকি?’
হেরম্যান হেসে বললেন, ‘এদিকে কিছু প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আছে শুনেছি। আমি ইতিহাসে আগ্রহী। সেসব দেখতেই যাচ্ছি। আমাদের দেখে গুপ্তধন সন্ধানী মনে হল কেন?’
সালুইন বললেন, ‘অনেকের ধারণা, প্রাচীন মন্দিরে গুপ্তধন থাকে। তার খোঁজে অনেকে নানা দ্বীপে ঘুরে বেড়ান। তাঁরা দু’-একটা ভাঙা মূর্তি ছাড়া কিছু পেয়েছেন বলে শুনিনি! তাই জেনে নিলাম আপনারা সে গোত্রের কি না?’
হেরম্যান বললেন, ‘না, আমরা সে গোত্রের নই।’
সালুইন বললেন, ‘আপনারা যখন ইতিহাসে আগ্রহী, নিশ্চয়ই ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন মন্দির প্লম্বানন আর বরবুদুর দেখেছেন? প্লম্বাননের ব্রহ্মমূর্তি, বরবুদুরের হাতি আর কোমোডোর লড়াইয়ের পাথর-খোদাই কী অসাধারণ, তাই না?’
হেরম্যান তাঁর প্রশ্নে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে সমুদ্রের দিকে তাকালেন। সালুইন এর পর আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কাছ থেকেই কোনো কিছুতে ঘা দেওয়ার শব্দ শোনা যেতেই সকলে কথা থামিয়ে তাকাল। ডেকের উপর একটা ছোট কাঠের ঘর। তার দরজা তালাবন্ধ, কিন্তু বন্ধ পাল্লা কাঁপছে। ভিতর থেকে কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। সুদীপ্ত বলল, ‘দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ, কিন্তু ভিতরে কেউ আছে নাকি?’ কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই জোরে কয়েকবার শব্দ হল সেখান থেকে, তারপরই ঘরের ভিতর থেকে ভেসে এল দুর্বোধ্য এক কণ্ঠস্বর!
হেরম্যান বললেন, ‘আরে, এ তো মানুষের গলা!’
ঠিক সেসময় সুদীপ্তরা দেখল, ইঞ্জিনঘরের দিক থেকে লু-সেন আসছে। তাকে দেখে সালুইন বললেন, ‘ও ঘরে কাকে আটকে রেখেছ?’
লু-সেন জবাব দিল, ‘একটা ছেলে। ওর বাপ আজই আমার জাঙ্কে ওকে তুলে দিয়ে গিয়েছে কাজ শেখানোর জন্য। ধীবর-নাবিকের ছেলেরা তো এভাবেই কাজ শেখে। কিন্তু ছেলেটা জাঙ্কে থাকতে চাইছে না। জাঙ্ক থেকে পালাবার জন্য জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। তাই আটকে রেখেছি।’
সালুইন বললেন, ‘বুঝলাম। আমরা এখন অনেক দূরে। ও পালাতে পারবে না। তুমি দরজা খুলে দাও।’
সালুইনের কথায় লু-সেন গিয়ে দরজার তালাটা খুলে দিল। অমনি ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা অদ্ভুত খর্বাকৃতি ছেলে। ফুট চারেকও লম্বা নয়। কালচে গায়ের রং। ঝাঁকড়া কালো চুলে মুখের প্রায় অর্ধেক ঢাকা। তবে কেমন যেন রুক্ষ চেহারা।
সুদীপ্ত বিস্মিতভাবে বলল, ‘এইটুকু ছেলে পালাবার জন্য জলে ঝাঁপ দিয়েছিল?’ সালুইন মাথা নাড়লেন। ছেলেটাকে একবার স্থিরদৃষ্টিতে দেখে নিয়ে লু-সেন সালুইনকে বলল, ‘আমি যাচ্ছি। হুইল ধরতে হবে।
সালুইন সদুীপ্তদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমিও এখন যাই। আমরা একসঙ্গে অন্তত দিন পাঁচেক থাকছি। পরে ভালো করে কথা হবে।’
তাঁরা চলে যেতে ছেলেটা সুদীপ্তদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভয়ে-ভয়ে ডেকের এক কোণে গিয়ে দাঁড়াল।
সুদীপ্ত আর হেরম্যান নিজেদের কথায় ফিরে এলেন।
হেরম্যান বললেন, ‘মিস্টার সালুইনকে প্লন্থানন আর বরবুদুর দেখার ব্যাপারে বাধ্য হয়েই মিথ্যে বলতে হল। ইতিহাসে আগ্রহী, অথচ ও দুটো বিখ্যাত প্রাচীন স্মারক না দেখে আমরা ‘ওরা’ দ্বীপের ভগ্নস্তূপ খুঁজছি শুনলে লোকটা সন্দেহ করত।’ সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু ওরাও তো এই দ্বীপে নামবে?’
হেরম্যান বললেন, ‘দ্বীপে নেমে যে-যার কাজে দু’ভাগে ছড়িয়ে যাব। তখন বুদ্ধিমতো কাজ করা যাবে।’
কিছুক্ষণ গল্প করার পর এক সময় আর ডেকে দাঁড়াতে ভালো লাগল না সুদীপ্তদের। তাঁরা ঘরে ঢুকল। বারোটা নাগাদ দুপুরের খাওয়া হলে জাঙ্কের দুলুনি আর একঘেয়ে শব্দে ঘুমিয়ে পড়ল সুদীপ্ত।
বিকেলে ঘুম ভেঙে ঘরের বাইরে এসে সুদীপ্ত দেখল, জাঙ্ক দাঁড়িয়ে পড়েছে। লু-সেনের লোক দুজন নোঙর নামাচ্ছে জলে। আগেই ডেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন হেরম্যান। সুদীপ্তকে বললেন, ‘লু-সেন বলে গেল, আজ এখানেই রাত্রিবাস করব আমরা। ‘ওরা’ দ্বীপ বেশি দূর নয়। দূরে কালো মতন একটা বিন্দু দেখা যাচ্ছে, ওটা একটা দ্বীপ। তার ওপাশেই ‘ওরা’ দ্বীপ। বিন্দুর মতো দ্বীপটায় ট্রাইবালদের বাস। এ সময় নাকি ও জায়গা অতিক্রম করা নিরাপদ নয়। তাই ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
সুদীপ্ত তাকাল দূরের দ্বীপটার দিকে। তার মাথায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সুদীপ্তর চোখ গেল ডেকের কোনার দিকে। সেখানে একইভাবে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটা। তাকে দেখে বেশ কষ্ট হল সুদীপ্তর। এতটুকু ছেলে! কতই বা বয়স ওর? ভবিষ্যতের রুটি-রুজির জন্য এই বয়সে একলা অন্যের নৌকোয় তুলে দিয়ে গেল ওর বাবা।
আলাপ জমাবার জন্য সুদীপ্ত এগিয়ে গিয়ে পিঠে হাত রাখতেই চমকে উঠে মুখ ফেরাল ছেলেটা। ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় ভাষা বাহাসা। সুদীপ্ত জানে না সে ভাষা
বই দেখে কাজ চালানোর মতো কিছু বাহাসা বাক্য শিখেছেন হেরম্যান। তিনি বাহাসায় তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু জবাব মিলল না। কিছুক্ষণ হেরম্যানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ছেলেটা দূরের দ্বীপের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। তারপর ভেক পেরিয়ে, তাকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল সে ঘরে গিয়ে ঢুকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামল সমুদ্রের বুকে।