টেবিলে ম্যাপটা ধরে হেরম্যান বললেন, ‘এ দেশটায় প্রায় চোদ্দো হাজার দ্বীপ। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে তা চন্দ্রকলার মতো ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে ছ’হাজার দ্বীপে মানুষের বসতি আছে। এখনও বহু এমন দ্বীপ আছে, যেখানে আজও মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি!’
এর পর তিনি সুদীপ্তকে বোঝাবার জন্য ম্যাপে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, ‘এই হল সুমাত্রা, জাভা-জাকর্তা। এটা বালি। বালির পূর্ব দিকে এই ফ্লোরেস দ্বীপে রয়েছি আমরা। পূর্বে কোমোডো আইল্যান্ড। চারপাশে আছে রিনকা, গিলিমোটাং, গিলিড্যাসামি ইত্যাদি। এ সবক’টা দ্বীপেই পৃথিবীর বৃহত্তম গিরগিটি বা কোমোডো ড্রাগনের দেখা মেলে। স্থানীয় লোকরা ওদের ডাকে ‘বুয়জি দারাত’ অর্থাৎ ‘স্থল কুমির’ বলে।’
সুদীপ্ত বলল, ‘কোন দ্বীপে যাব আমরা?’
ম্যাপে চোখ রেখে হেরম্যান বললেন, ‘আমরা যাব কোমোডো দ্বীপের আশি মাইল দক্ষিণে একটা দ্বীপে। কোমোডোর মতো ওটাও সুন্দাদ্বীপমালার অংশ। একদম প্রান্তভাগ। ওই দ্বীপ খুব বড় নয়, ম্যাপেও নেই। সুন্দা ধীবররা বলে ‘ওরা দ্বীপ’। ‘ওরা’ কথার মানে ‘গোসাপ’। কোমোডো ড্রাগনকে ‘ওরা’ বলেও ডাকা হয়। ‘ওরা’ দ্বীপ জনমানবহীন, তাই মাছ ধরার নৌকো ওর কাছে যায় না। ওখানে নাকি প্রাচীন ভূতেদের বাস! দ্বীপের ভিতর থেকে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে!’
হেরম্যানের কথায় সুদীপ্ত বলল, ‘ভূতের দ্বীপ যখন, আমরা সেখানে পা রাখলে আপনার সোনার ড্রাগনও ভূতের মতো মিলিয়ে যাবে না তো?’
সুদীপ্তর কথায় গম্ভীর হয়ে গেলেন হেরম্যান, বললেন, ‘তুমি ঠাট্টা করছ? এই যে কোমোডো ড্রাগনের কথা গোটা পৃথিবী জানে, সে-ও কিন্তু একদিন গল্প-গাথার পৌরাণিক প্রাণী বা ক্রিপ্টিড হিসেবেই পরিচিত ছিল। ধীবররা তার কথা বললেও পণ্ডিতরা বিশ্বাস করেননি। অথচ জাভার অনেক লোককথায় ওদের উল্লেখ ছিল। কীভাবে ওদের খোঁজ মিলল? ফান স্টেন ফান হ্যান্ডব্রেক নামে এক ওললাজ বৈমানিক উড়ে যাচ্ছিলেন ওই দ্বীপের কাছ দিয়ে। হঠাৎ তাঁর বিমান সমুদ্রে ভেঙে পড়ে। বেঁচে যান তিনি। কাঠের গুঁড়ি ধরে সাঁতরে রাতের অন্ধকারে পৌঁছে যান ওই দ্বীপে। রাত কাটাবার জন্য গাছের মাথায় উঠে কিছুক্ষণ পর দেখতে পান, নীচে অন্ধকারের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল কুমিরের মতো প্রাণী। অন্ধকারে চোখ জ্বলছে। শরীরের আঘাতে গাছের গুঁড়ি কাঁপছে। অনেক দূর থেকে তাদের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে! অন্ধকারে শিকার ধরে বেড়াচ্ছে মাংসাশী প্রাণীগুলো। তাদের বিশাল আকৃতি ও নিশ্বাসের শব্দে ফান ধারণা করেন, ওগুলো ড্রাগন। ফিরে এসে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা শোনালে প্রাণীবিজ্ঞানীরা অভিযান চালান ওই দ্বীপে। খোঁজ মেলে কোমোডো ড্রাগনের। অথচ তার আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা উড়িয়ে দিতেন তার কথা। তুমি এখন আমার কথায় হাসলেও আমার বিশ্বাস, সোনালি কোমোডো ড্রাগন নিশ্চয়ই আছে।’
একটানা কথাগুলো বলে সুদীপ্তর উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে রইলেন হেরম্যান। সুদীপ্ত বলল, ‘না, আপনার কথা অবিশ্বাস করছি না, তবে সোনালি ড্রাগনের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো প্রমাণ…..
হেরম্যান বললেন, ‘প্রমাণ বলতে এখানকার বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনিতে এবং সুন্দা ধীবরদের লোককথায় এর উল্লেখ আছে। এদের অনেকে দেখেছে বলেও দাবি করে। দুজন ভিনদেশি লোকের কথাও বলি। শেষ খবরটা ‘লন্ডন টাইম্স’-এর, বছর খানেক আগের। ইংরেজ প্রত্নবিদ রিচার্ড বালি দ্বীপের পাশের নানা দ্বীপে ঘুরছিলেন প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ দেখার জন্য। ‘ওরা’ দ্বীপে ওই প্রাচীন মন্দিরের কাছে এক ভগ্নস্তূপে শেষ বিকেলে একলা কাজ করছিলেন রিচার্ড। তাঁর ইচ্ছে ছিল পরদিন মন্দিরে যাবেন। হঠাৎ ফোঁস শব্দ শুনে তিনি দেখলেন, কিছু দূরে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে বিশাল এক সোনালি কোমোডো। সাধারণত এরা দৈর্ঘ্যে আট থেকে দশ ফুট হয়। ওজন সত্তর থেকে একশো কেজি। কিন্তু রিচার্ডের স্থির বিশ্বাস, সেই ড্রাগন ছিল কমসেকম পনেরো ফুট। হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তাঁর দিকে। তার নিশ্বাসে উঠেছিল ধুলোঝড়। তার আক্রমণাত্মক ভঙ্গি দেখে রিচার্ড চিৎকার করে উঠলেন। লোকজনও ছুটে এল। আর তাতেই ঘাবড়ে গিয়ে মন্দিরের দিকে অদৃশ্য হল প্রাণীটি। এর একটু পরেই সন্ধে নামল। রিচার্ডের সঙ্গীরা ভয় পেল ড্রাগনের কথা শুনে। স্থানীয় মানুষরা গল্প শুনেছে, আগে এই মন্দিরে নাকি অপরাধীদের বলি দিয়ে সেই মাংস খাওয়ানো হত ড্রাগনদের। সেসব নিহত মানুষ ভূত হয়ে বাস করে মন্দিরে। কাজেই অনুসন্ধান শেষ না করে পরদিন দ্বীপ ছাড়তে হল রিচার্ডকে।’ থামলেন হেরম্যান। এরপর ঘড়ি দেখে তিনি বললেন, ‘এখন আমি কালকের যাত্রার জন্য নৌকোর ব্যবস্থা করতে বন্দরে যাব। দেখি কী ব্যবস্থা হয়। তুমি হোটেলের ঘরে বিশ্রাম নাও।’ একথা বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
হেরম্যান যাওয়ার পর সুদীপ্ত জানলার ধারে দাঁড়াল। দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। সুদীপ্তর পূর্বপুরুষরা সমুদ্র-সন্ধানে বেরিয়ে দ্বীপময় এই দেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিয়েছিল ভারতীয় সংস্কৃতি। আজও তার চিহ্ন লুকিয়ে আছে ইন্দোনেশিয়ার পান্না সবুজ দ্বীপমালায়। সুদীপ্তরা আজই এসে হাজির হয়েছে ফ্লোরেসে। হেরম্যানকে প্রথমে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে পৌঁছতে হয়েছিল কলকাতায়। তারপর দুজনে মিলে কলকাতা থেকে ব্যাঙ্কক হয়ে দেনপাশার বিমানবন্দরে। সেখান থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইটে ফ্লোরেসের মাউমেরে বিমানবন্দরে।
হেরম্যান মিষ্টভাষী, পরিশ্রমী, পণ্ডিত মানুষ। তাঁর অদ্ভুত শখ। নিজেকে একজন ক্রিপ্টোজুলজিস্ট বলেই পরিচয় দেন। পৃথিবীর নানা প্রান্তে লোকগাথায় এমন অনেক প্রাণী বা উদ্ভিদের কথা শোনা যায়, বিজ্ঞান যাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। এদের বলা হয় ‘ক্রিপটিড’। ক্রিপটিড নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের ডাকা হয় ক্রিপ্টোজুলজিস্ট বলে। হেরম্যান এক সময় বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীতত্ত্ব বিভাগের উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন। পারিবারিক ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট ব্যবসায় মন না দিয়ে তিনি ব্যবসার অংশ বেচে সে টাকায় ক্রিপটিড খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁর সব অনুসন্ধানই ব্যর্থ হয়েছে। এবার এখানে এসেছেন সোনালি কোমোডো ড্রাগনের খোঁজে। তাসমানিয়ার ডিমপাড়া স্তন্যপায়ী প্লাটিপাস বা হংসচঞ্চু, প্রাগৈতিহাসিক যুগের মিলিকাস্থ মাছ, জায়েন্ট স্কুইড, মেগামাউথ শার্কের কথা বিজ্ঞানীরা মানতেই চাইতেন না। অথচ সেসব তো সত্যি! এর আগে সুদীপ্ত তার সাথে আফ্রিকার গহীন অরণ্য প্রদেশে গ্রেট রিফট্ উপত্যকায় এক অভিযানে গেছিল সবুজ মানুষের খোঁজে। অভিযান ব্যর্থ হলেও বহু রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছিল। সেই রোমাঞ্চর খোঁজেই এই ইন্দোনেশিয়াতেও হেরম্যানের সঙ্গী হয়েছে সুদীপ্ত।
হেরম্যান ফিরলেন সন্ধেরও বেশ পরে। সুদীপ্ত শুয়ে পড়েছিল। দরজা খুলে দিতেই চেয়ারের উপর ধপ করে বসে হেরম্যান বললেন, ‘উঃ, নৌকো খুঁজতে জান বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। কেউই যেতে রাজি নয় ওদিকে। শেষ পর্যন্ত কটা চিনা জাঙ্ক জোগাড় হল। এক মালয় ব্যবসায়ী ওদিকে যাচ্ছে জাঙ্ক নিয়ে। তার সঙ্গে শেয়ারে যেতে হবে। কাল ভোরে যাত্রা শুরু করব।’