সুটকেস এবং অ্যালসেসিয়ান

সুটকেস এবং অ্যালসেসিয়ান

বিকেলে ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ড-এ স্প্রে হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন কর্নেল। চ্যাটালো লম্বাটে পাতা, কিনারা ঢেউখেলানো, এই অর্কিডটার আশ্চর্য স্বভাব–যত বেলা বাড়ে, তত গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের কেন্দ্রের দিকে। সূর্যাস্তের পর ক্রমশ আবার ছড়িয়ে পড়ে। কালচে সবুজ রঙের ওপর লাল নীল হলুদ সাদা ফুটকি। ফুল ফুটবে সেই শীতে। বেগুনি রঙের থোকাথোকা ফুল। এপ্রিলে ফুল শুকিয়ে গুটি বাঁধে। হঠাৎ কখন ফেটে যায় গুটিগুলো। অর্কিডের বইতে আছে, এই হিষ্পনোলিয়া সিডারিকা অর্কিডের একটা কেন্দ্র থেকে ৪৪৭৭২০টা করে সূক্ষ্ম বীজ বাতাসে ছড়িয়ে যায়। উড়ে যায়ও বহুদূর। পথে দেবদারু গাছ পেলে তবে বীজ থেকে আবার আঁকুর গজায়। না পেলে ধ্বংস হয়ে যায় প্রাকৃতিক নিয়মে।

কর্নেল হিস্পানোলিয়া সিডারিকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কলকাতার আকাশ আজ প্রায় নির্মেঘ। তিনতলা বাড়ির এই ছাদ থেকে বহুদূর দেখা যায়। কারণ এলাকায় উঁচু বাড়ির সংখ্যা কম। গঙ্গার শিয়রে চাপচাপ সিঁদূরে মেঘ জমে আছে। সূর্য নেমে গেছে তার ভেতরে। ক্রমশ ফুটে উঠছে সেই আশ্চর্য। কনেদেখা আলো। অন্যমনস্কভাবে পকেট থেকে বাঁ হাতে ঊর্মির ফোটোটা বের করলেন কর্নেল। আবার দেখতে থাকলেন।

ফোটোটা সকালে অরিজিৎ পাঠিয়ে দিয়েছেন। মৃগাঙ্ক যেন তার ঘর থেকে ঊর্মির সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছে। আগের দিন তার ফ্ল্যাটে গিয়ে কর্নেল তা লক্ষ্য করেছেন। অথচ মৃগাঙ্ক চাইছে খুনীকে ধরতেই হবে। মিনিস্টার মামাকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছে। এ কি তার নিতান্তই চরিত্রগত জেদ? অর্থাৎ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও কি সে এমনি একগুঁয়ে?

ওকে ঠিক বোঝা যায় না। যন্ত্রমানুষের মতো মনে হচ্ছিল। যেন ভাবাবেগহীন, অকপট, নির্বিকার। সে তত রূপবান স্বাস্থ্যবান মানুষও নয়। অথচ ঊর্মির মতো মেয়ে তার প্রেমে পড়েছিল! অসাধারণ রূপবতী ছিল ঊর্মি। অবশ্য ফোটো অনেকক্ষেত্রে প্রবঞ্চনা করে। ঊর্মির বোনদের মুখোমুখি না হলে কিছু বোঝা যাবে না।

খুনের মোটিভ মৃগাঙ্কেরও থাকা স্বাভাবিক। রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর কথায় বোঝা গেছে মৃগাঙ্কের অনুপস্থিতিতে ঊর্মির কাছে কেউ এসেছে। কিন্তু ঊর্মি নাকি তত আলাপী মেয়ে ছিল না। তাহলে কে আসতে পারে? সমস্যা হয়েছে, বাড়িটা বহুতল, ফ্ল্যাটও অসংখ্য। তাছাড়া এ ধরনের ফ্ল্যাটবাড়ি প্রত্যেকটাই নির্জন একেকটা দ্বীপের মতো–যোগাযোগবিহীন। ঊর্মির কাছে কোনো পরিচিত মহিলা আসতে পারে। আবার কেউ মৃগাঙ্কেরও খোঁজেও আসতে পারে। নিঃসংশয় হওয়া কঠিন। তবে ওর মামা বনবিহারীবাবুর কথাতেও মনে হয়েছে, ঊর্মি নিষ্কলুষ চরিত্রের মেয়ে ছিল না।

মৃগাঙ্কের কী ধারণা স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কে? প্রশ্নটা সরাসরি করতে বেধেছিল কর্নেলের। কিন্তু আভাস পেয়েছেন, ধারণা ভাল ছিল না। মৃগাঙ্ক দুবার বলেছিল, ডিসিশনে ভুল হয়েছিল।

হুঁ, মৃগাঙ্কেরও একটা শক্ত মোটিভ পাওয়া যায়। কিন্তু তার শ্বশুরের হত্যাকাণ্ডটা এক্ষেত্রে জট পাকিয়ে তোলে। একই পদ্ধতিতে হত্যা। শ্বাসনালী কেটে। ডেডবডি দরজার খুব কাছেই পড়ে থাকাটাও একই হত্যাকারীর দিকে নির্দেশ করে। তারিখ সেই এগারো। কিন্তু মৃগাঙ্কের শ্বশুরঘাতী হওয়ার কোনো কারণ আছে কি?

কাজেই এভাবে পাঁচমিনিটের মধ্যে ঊর্মির স্যুটকেস চুরি যাওয়াটা বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। আর অরিজিতের কাছে জানা গেছে, মৃগাঙ্কের অ্যালিবাই খুব মজবুত। বোম্বের হোটেলের রসিদ, প্লেনের টিকিট–সবই ঠিক আছে। বোম্বে পুলিশের কাছে এও জানা গেছে, ঘটনার সময় মৃগাঙ্ক সেই হোটেলেই ছিল। সেদিন বোম্বেতেও প্রচণ্ড বৃষ্টি দিনভর রাতভর।

ষষ্ঠী একটা মোড়া দিয়ে গেছে কফি আনার সময়। স্প্রে রেখে ছবিটা হাতে নিয়ে কর্নেল মোড়ায় বসলেন। কনেদেখা আলোটা মরে যাচ্ছে দ্রুত। পুবের আকাশে খানিকটা অতর্কিত ধুসর মেঘ। রাতে বৃষ্টি নামতে পারে।

রঞ্জনবাবুর স্ত্রী সেই সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ অন্তর দুবার দরজায় নক করার শব্দ শুনেছিলেন। দুবারই ওঁদের অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা চ্যাঁচামেচি করেছিল। রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর কথায় সনির অপছন্দের লোক এসেছিল তিন নম্বর ফ্ল্যাটে।

খাটের তলায় পড়ে ছিল একটা দামী লাইটার।

এবং থানায় কেউ ফোন করে বলেছিল, লেকভিলার সাততলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটে একটা ডেডবডি পড়ে আছে।

হঠাৎ কর্নেলের মনে হল ঊর্মির ছবির ভেতর কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে-না, লাইটার নয়, একটা ড্যাগার। ক্রমশ একটা আদল ফুটে উঠছে। ঋজু, শক্ত একটা কাঠামো। কিন্তু মুখটা অস্পষ্ট।

চেষ্টা করেও তার মুখটা দেখতে পেলেন না কর্নেল। উত্তেজনায় কেঁপে উঠলেন।

সেইসময় ষষ্ঠী সিঁড়ির মাথায় মুখ বাড়িয়ে ঘোষণা করল, নালবাজারের নাহিড়িসায়েবের ফোং বাবামশাই!

 ফোন নামিয়ে রেখেছিস তো?

ষষ্ঠীর দাঁত দেখা গেল। আর নজ্জা দেবেন না বাবামশাই! একবার করিছি বলে কি বারম্বার ভুল হবে?

কর্নেল হাসলেন। ওরে হতভাগা! ভুলের নিয়মই যে এই। একবার করে ফেললে-ওই যে বললি বারম্বার–হ্যাঁ, বারম্বার হয়।..

অরিজিতের গলা শোনা গেল, কর্নেল, খবর আছে।

 বলো ডার্লিং!

হিমাদ্রি রায়ের আঙুলের ছাপের সঙ্গে সেই লাইটারের ছাপ মিলে গেছে।

 হু–ওঁর আঙুলের ছাপ পেলে কীভাবে? অ্যারেস্ট করেছ?

না। নিখোঁজ বলতে পারেন। বাড়িতে বলে গেছেন দিল্লি যাচ্ছি অফিসের কাজে। ফিরতে দেরি হবে। অফিসে ছুটি নিয়েছেন এক মাসের। বলেছেন, স্বাস্থ্যোদ্ধারে পাহাড়ে যাচ্ছেন। যাই হোক, ওঁর গাড়িটা গ্যারেজে ছিল তালাবন্ধ। ওঁর বাড়িতে কেউ ড্রাইভ করার মতো নেই। শুধু এক বৃদ্ধা আত্মীয়া আছেন।

গাড়ি থেকে আঙুলের ছাপ পেলে?

আবার কোথায় পাব? স্টিয়ারি থেকে কয়েকটা ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হল, স্টিয়ারিঙের একখানে একটু রক্তের ছাপ ছিল। টেস্ট করা হয়েছে। আর

কর্নেল উত্তেজনা চেপে বললেন, আর কী?

 মার্ডার উইপন। ইঞ্জিনের পাশে লুকোনো ছিল রক্তমাখা ছোট্ট ইঞ্চিচারেক লম্বা একটা বিদেশী ছুরি। বাঁটে অবশ্য আঙুলের ছাপ মুছে ফেলা হয়েছে।

গাড়ির ভেতর পেয়েছ ছুরিটা?

গাড়ির ভেতর। ব্লেডের মতো ধারালো ছুরি। রক্তমাখা।

 কী করবে ভাবছ–মানে হিমাদ্রিবাবুর ব্যাপারে?

সর্বত্র পুলিশকে অ্যালার্ট করা হয়েছে। দেখা যাক।..অরিজিতের হাসি শোনা গেল। আপনার কাছে এজন্য কৃতজ্ঞ। বনবিহারীবাবুকে ওভাবে প্রশ্ন করার ধৈর্য আমাদের ছিল না–থাকে না কোনোক্ষেত্রেই। অসংখ্য ধন্যবাদ, কর্নেল!

তাহলে তো কেস ইজ সেটলড।

অবশ্যই। সব মার্ডারের ভাইটাল পয়েন্ট যেটা–অর্থাৎ মোটিভ, সেটা হিমাদ্রি রায়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত এস্টাব্লিশড। রুদ্রেন্দুবাবুকে খুন করে সে সুযোগ খুঁজছিল__

একমিনিট, অরিজিৎ! রুদ্রেন্দুবাবুকে খুনের মোটিভ নিশ্চয় স্পষ্ট। কিন্তু ঊর্মিকে?

আবার অরিজিতের হাসি শোনা গেল।সেও আরও স্পষ্ট। আমরা কাল দুপুর থেকে একটানা কাজ করছি। সংক্ষেপে বলছি, শুনুন। মৃগাঙ্কবাবুর যে বন্ধুর বাড়ি বিয়েতে গিয়ে ঊর্মির সঙ্গে পরিচয় হয়, সে-ভদ্রলোকের নাম সুব্রত সিংহরায়। সুব্রতবাবু ওঁদের-মানে মৃগাঙ্কবাবু, ঊর্মি আর হিমাদ্রির কমন ফ্রেন্ড। ওঁর একটা ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং কারবার আছে। ওঁর এক বোনের শ্বশুরবাড়ি পাটনায়। সেই সুত্রেই ঊর্মির সঙ্গে ওঁদের চেনাজানা। হিমাদ্রিবাবুর চেনাজানা মৃগাঙ্কবাবুরই সূত্রে। তো সুব্রতবাবুর কাছে জানা গেছে, মৃগাঙ্কের সঙ্গে ঊর্মির মাখামাখিতে হিমাদ্রি ভীষণ চটে গিয়েছিল। সুব্রতবাবুকে বলেছিল, ঊর্মির চরিত্র ভাল নয়।

শুধু এই?

 ওয়েট, ওয়েট! আরও আছে। সুব্রতবাবু স্বীকার করেছেন, হিমাদ্রি ও ঊর্মির মধ্যে পুরনো প্রেম ছিল। কাজেই ঊর্মি মৃগাঙ্কবাবুকে বিয়ে করায় সে প্রতিহিংসাবশে তাকে খুন করেছে। অবশ্য আমার ধারণা সুব্রত আরও কিছু ব্যাপার জানেন হিমাদ্রি সম্পর্কে। কোনো কারণে চেপে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের হাবভাব দেখেও মনে হয়েছে, কেমন যেন নার্ভাস হয়ে গেছেন। এর একটাই অর্থ হয়। উনি হিমাদ্রিকে ভীষণ ভয় করেন।

কিন্তু

কিন্তু কিসের? দেখুন না, শিগগির আমরা দেশের সব ন্যাশনাল ডেলিতে হিমাদ্রির ছবি ছাপিয়ে ওয়ান্টেড বলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি।

ডার্লিং! হিমাদ্রিকে তাহলে আর খুঁজে পাবে না।

 পুরস্কার ঘোষণা থাকবে। পাবলিক হেল্প করবে টাকার লোভে।

যদি হিমাদ্রি নির্দোষ হয়, ভেবে দেখেছ কি ওর কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে?

 আশ্চর্য, কর্নেল! কেস তো সেটলড।

হুঁ, ইট অ্যাপিয়ার্স অ্যাজ সেটলড। গাড়ির ভেতর মার্ডার উইপন, স্টিয়ারিঙে রক্তের ছাপ, সিগারেট লাইটারে আঙুলের ছাপ। কিন্তু রঞ্জনবাবুর স্ত্রী বলেছেন, দুজন লোক এসেছিল, মৃগাঙ্কের ফ্ল্যাটে। কিছুক্ষণ অন্তর দুবার নক করার শব্দ শুনেছিলেন। তাছাড়া ঊর্মির সুটকেস চুরি গেল। অরিজিৎ, কেস কি সত্যি সেটলড?

ধরুন, হিমাদ্রি খুন করে চলে যাবার পর মৃগাঙ্কবাবুর কোনো বন্ধু বা কোনো চেনা লোক মৃগাঙ্কবাবুর খোঁজেই এসেছিলেন। সাড়া না পেয়ে ফিরে গিয়েছিলেন।

কিন্তু স্যুটকেস কেন চুরি গেল? কে চুরি করল? আর লোকাল থানায় ফোন করে খুনের কথা জানিয়েছিল কে?

হিমাদ্রি নিজে অথবা কোনো ক্রিমিন্যালকে দিয়ে চুরি করিয়েছে। স্যুটকেসে নিশ্চয় পুরনো প্রেমপত্র ছিল। ঊর্মির সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রমাণ হয়ে যাবে ভেবেই একাজ সে করেছে। আর ফোনের ব্যাপারটা তদন্ত করা হচ্ছে।

তাহলেও হুট করে বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত হবে না, অরিজিৎ।

ভীষণ চাপ আসছে রাইটার্স থেকে। সামলাতে পারছি না কর্নেল! বিজ্ঞাপনটা ছাপা হলে বোঝাতে পারব, আমরা চুপচাপ বসে নেই।

বিহার পুলিশ থেকে আশা করি রিপোর্ট পেয়ে গেছ?

কিছুক্ষণ আগে পেয়েছি। তবে হিমাদ্রির নামগন্ধ নেই। সেতাপগঞ্জের জনৈক রঘুনাথ সাহুর সঙ্গে ঊর্মির বাবার বিবাদের কথা আছে। রঘুনাথ ছিল নকশাল। জমি দখল করে হাঙ্গামা বাধিয়েছিল। ডাকাতি খুনোখুনি আর জেলপালানোর দায়ে তার নামে একডজন কেস ঝুলছে। লোকাল পুলিশ রুদ্ৰেন্দু রায়চৌধুরীর মার্ডারের জন্য রঘুনাথের নামে এফ আই আর করেছে।

রঘুনাথ জেল থেকে পালিয়েছিল?

 পাটনা জেল থেকে মাসচার আগে পালিয়ে গেছে।

 একটা শ্বাস ছেড়ে কর্নেল বললেন, আচ্ছা, ছাড়ি ডার্লিং।

 আপনি যাচ্ছেন নাকি সেতাপগঞ্জে?

 দেখা যাক। বলে কর্নেল ফোন রেখে দিলেন।

একটু পরে ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে ঊর্মির ছবিটা আবার বের করলেন। ছবির ভেতর হিমাদ্রির আদল–নাকি অন্য কেউ, মুখটা আগের মতো আবছা। কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। অথচ হিমাদ্রি ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল, তা নিশ্চিত। কিন্তু আরেকজনও নক করেছিল দরজায়।

কে আগে ঢুকেছিল, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। লাইটারটা যখন নিশ্চিত হিমাদ্রির, তখন সে ও ঘরে সিগারেট খেয়েছিল। কথা হচ্ছে, তখন ঊর্মি জীবিত, না মৃত? ঊর্মির লাস পাওয়া যায় দরজার কাছে এবং লাইটারটা বেডরুমের মেঝেয় খাটের নিচে। ঊর্মিকে দরজার কাছে খুন করে তার বেডরুমে গিয়ে সিগারেট খাওয়ানাঃ। যত নার্ভই থাক, এটা পাগলামি স্রেফ। কাজেই জীবিত ঊর্মির সামনেই সিগারেট খেয়েছিল হিমাদ্রি। সেক্সের ব্যাপারটাও এসে যায় এ পরিবেশে। মৃগাঙ্ক সুদূর বোম্বেতে।

কর্নেল চুরুট জ্বেলে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। ঠোঁটে জ্বলন্ত চুরুটটা কামড়ানো। অভ্যাসমতো শাদা দাড়িতে আঙুলের চিরুনি টানতে থাকলেন।

অনুমান নয়, নিশ্চিত তথ্য থেকে ডিডাকশান করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো যায়। এবং তা থেকে এও বেরিয়ে আসে যে হিমাদ্রিই যদি তারপর ঊর্মিকে খুন করে থাকে (ধরা যাক, বেরিয়ে আসার সময় দরজার কাছে গিয়েই তাকে ধরে তার গলায় ড্যাগার চালায়), তাহলে লাইটারের খোঁজে সে ফিরে যেতে পারে ওই ফ্ল্যাটে। কিন্তু তাহলে আবার সে দরজায় নক করবে কেন?সে তো জানে দরজা খোলা আছে!

কাজেই লাইটারের খোঁজে সে দ্বিতীয়বার যায়নি। আরেকজন এসে দরজায় নক করেছিল। দরজা ভেতর থেকে লক করা নেই দেখে সে দরজা খুলেছিল। তারপর ঊর্মির ডেডবডি দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই কি ফোন করেছিল থানায়? কে সে? অরিজিৎ বলল, মৃগাঙ্কের কোনো বন্ধু বা চেনা লোক দ্বিতীয়বার দরজায় নক করে থাকবে। হ্যাঁ, সেও স্বাভাবিক। পুলিশ এভাবেই কেসটা দাঁড় করাচ্ছে। হিমাদ্রির বাঁচার উপায় নেই। ঊর্মির সঙ্গে তার পুরাতন প্রেম যখন, তখন তার সাহায্যে ওদের ফ্ল্যাটের চাবির একটা ডুপ্লিকেট বানিয়ে নেওয়া তার পক্ষে কঠিন ছিল না। স্যুটকেসে প্রেমপত্র ছিল অনেকদিনের। হিমাদ্রি তাই ওটা নিজে না হলেও কারুর সাহায্যে চুরি করিয়েছে। উদ্দেশ্য, কোনো সম্পর্ক থাকার প্রমাণ লোপ। নাঃ, হিমাদ্রি বাঁধা পড়ে গেছে। তাকে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে একেবারে।

আর মোটিভও স্পষ্ট, মজবুত। অথচ…

কর্নেল চোখ খুললেন। হিমাদ্রির পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার। আরও অনেক তথ্য চাই। তার চরিত্র, তার অতীতকাল, তার সাম্প্রতিক গতিবিধি। কারণ কোথায় যেন হিসেবে মিলছে না। কী একটা গণ্ডগোল থেকে যাচ্ছে।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোন তুললেন। সাতটা বাজে। যদি পাওয়া যায় মৃগাঙ্ককে। ফ্ল্যাটে না থাকলে অফিসে। অফিসে নাকি কোনো-কোনোদিন সন্ধ্যার পরও থাকে।

প্রথমে ওর ফ্ল্যাটে রিং করলেন। পাওয়া গেল মৃগাঙ্ককে। কর্নেল বললেন, একটু বিরক্ত করছি, মৃগাঙ্কবাবু!

না, না। আমিই আপনাকে রিং করব ভাবছিলাম!

 তাই বুঝি? তাহলে আপনিই আগে বলুন।

 সেই স্যুটকেসটা পাওয়া গেছে। মিঃ লাহিড়ীকে জানিয়ে দেবেন প্লিজ।

পাওয়া গেছে? কোথায়?

নিচের গ্যারেজে দারোয়ান কুড়িয়ে পেয়ে কাল সকালেই আমাদের কোঅপারেটিভ অফিসে জমা দিয়েছিল। ওরা তো জানত না ব্যাপারটা। হঠাৎ কিছুক্ষণ আগে ফোন করে জানিয়েছিল। ওরা অবশ্য সব ফ্ল্যাটেই ফোন করেছিল। আমি নিয়ে এসেছি।

কী অবস্থায় পেলেন?

তালা ভাঙা। ভেতরে ঊর্মির ছোটবেলার খেলনা, পুতুলের পোশাক, এইসব হাবিজাবি জিনিসপত্র আছে। কিছু ইমপর্ট্যান্ট জিনিস নিশ্চয় ছিল। নৈলে চুরি যাবে কেন?

তেমন কিছু নেই স্যুটকেসে?

না।

 মৃগাঙ্কের ঘরে কেউ আছে যেন। আবছা শোনা গেল, কাকে ধমক দিয়ে কী বলল। কর্নেল বললেন, হ্যালো! হ্যালো!

আছি বলুন কর্নেল!

 একটা কথা জানা দরকার। হিমাদ্রিবাবুর সঙ্গে আপনার কীভাবে আলাপ?

আমার একটা ছোটখাট কারখানাও আছে। কোল-ডাস্ট দরকার হয়। কোল ইন্ডিয়া থেকে কিনি। সেই সূত্রে হিমাদ্রির সঙ্গে আলাপ।

আপনি শুনেছেন কি যে সিগারেট লাইটারটা হিমাদ্রিবাবুর?

কয়েক সেকেন্ড পরে মৃগাঙ্ক আস্তে বলল, আমি জানতাম।

 জানতেন?

মানে জাস্ট অনুমান। তাছাড়া সুব্রত সিংহরায় নামে আমার এক বন্ধু আছে, তার বোন পাটনায় থাকে। সে আমাকে হিমাদ্রি আর ঊর্মির কিছু ঘটনা বলেছিল। আমি পাত্তা দিইনি। আসলে তখন আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

শুনুন। হিমাদ্রিই খুনী বলে পুলিশ সিওর হয়েছে। অরিজিৎ আপনাকে জানাবে সব। ইতিমধ্যে একটা কথা বলতে চাই আপনাকে।

বলুন!

হিমাদ্রি ফেরার হয়েছে। তাকে ধরার জন্য পুলিশ কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে। শিগগির। পুলিশের ধারণা, এ সব ক্ষেত্রে পুরস্কার ঘোষণা না করা হলে পাবলিক হেল্প পাওয়া যাবে না। আপনি কি–

আমাকে কী করতে হবে বলুন, করব।

প্রাইজমানি গভর্নমেন্ট যদি না দেয়, আপনি দেবেন কি?

 নিশ্চয় দেব। কেন দেব না?

 এক সেকেন্ড! ছাড়বেন না প্লিজ! আর একটা কথা আছে।

বলুন।

 কথাটা আপনার প্রতিবেশী রঞ্জনবাবুর কুকুর সম্পর্কে।

 কুকুর সম্পর্কে? কী ব্যাপার বলুন তো?

 কুকুরটা সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

 কুকুর-টুকুর নিয়ে আমি ভাবি না। আপনার প্রশ্নটা ভারি অদ্ভুত!

ভুলে যাবেন না মৃগাঙ্কবাবু! কুকুরটা সেদিন যথেষ্ট

 ড্যাম ইট! হোয়াট হেল আর ইউ টকিং অ্যাবাউট?

 আপনি কি কখনও কুকুর পুষেছেন মৃগাঙ্কবাবু?

নেভার। আই হেট দ্যাট ব্লাডি অ্যানিম্যাল! কিন্তু হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন?

রঞ্জনবাবুর অ্যালসেসিয়ানটার ভয়েই নাকি আপনাদের ফ্লোরের এক নম্বর ফ্ল্যাটের সাউথ ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক ফ্ল্যাট বেচতে চাইছেন!

আমি জানি না। খবর রাখি না।

 আশাকরি কুকুরটা আপনার কোনো প্রব্লেম বাধায়নি কখনও?

 কিন্তু কেন এসব কথা–

শুনুন, আমি একনম্বর ফ্ল্যাটটা কিনতে চাই। আমারও কুকুরভীতি প্রচণ্ড। তাই জিগ্যেস করছি।

তাই বলুন! মৃগাঙ্কের হাসি শোনা গেল। রঞ্জনবাবুর কুকুরটা অনেককেই পছন্দ করে না দেখেছি। আমাকেও করে না। আপনাকে করবে কি না বলা কঠিন। প্রথম-প্রথম তো ছাড়া থাকত। অনেকে কমপ্লেন করার পর আজকাল বেঁধে রাখে। একবার আমার বুকে দুই পা তুলে গলা কামড়াতে এসেছিল। ভেরি ন্যাস্টি ডগ!

ছাড়ছি মৃগাঙ্কবাবু!

কিছু মনে করবেন না যেন। ইদানীং আমার মেজাজটা ভাল যাচ্ছে না।

 জানি। থ্যাঙ্কস মৃগাঙ্কবাবু!

ফোন রেখে কর্নেল হাসতে লাগলেন। ষষ্ঠী কাপ নিতে এসে বলল, হাসছেন কেন বাবামশাই?

তোকে দেখে।

ষষ্ঠী নিজেকে দেখার চেষ্টা করে ক্ষুব্ধ মুখে বলল, আমি কি সার্কেসবাজির কেলাউন সেজেছি নাকি? এই গেঞ্জিটা তো আপনিই কিনে এনেছেন! হাসলে পরে খুলে রেখে দেব।

কর্নেল তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে বললেন, তুই যদি ওটা খুলে রাখিস, আমি নিচের ফ্ল্যাটের মিসেস ডিসুজার কুকুরটা এনে তোর পেছনে লেলিয়ে দেব হতভাগা!

ষষ্ঠী আঁতকে উঠে চলে গেল। মেমসায়েবের কুকুরটা তার গাল চাটতে আসে। ছ্যা ছ্যা।

কর্নেল আবার চোখ বুজলেন। স্যুটকেসটা তাহলে পাওয়া গেছে। কী ছিল ওর মধ্যে? ছোটবেলার খেলনা বা তুচ্ছ অনেক জিনিস কেউ কেউ যত্ন করে রেখে দেয়। মেয়েদের এ স্বভাব আছে। কর্নেলের মা তার বাচ্চা বয়সের পোশাকগুলো রেখে দিয়েছিলেন। পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা যেন বেশি স্মৃতি অনুগামী। ঊর্মির স্যুটকেসের জিনিসগুলো একবার দেখলে হত। মৃগাঙ্কের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, কর্নেলের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ হতেও পারে। কিছু বলা যায় না।

হুঁ–সেতাপগঞ্জ যাবেন। তার আগে কিছু জরুরি কাজ সেরে নেওয়া দরকার।

বাইরের ঘরের ওদিকে কলিং বেল বাজল। একটু পরে ষষ্ঠী এসে বলল, এক ভদ্রলোক এয়েছেন।

নিয়ে আয়।

যিনি ঢুকলেন, তার পরনে ঢোলা প্যান্ট-শার্ট, মাথায় কর্নেলের চেয়েও চওড়া টাক। বয়স বোঝা কঠিন। রোগা চ্যাঙা চেহারা। নাকে নস্যির ছোপ। নমস্কার করে বসে পড়লেন সোফায়…

.

গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার

কর্নেল তাকিয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক খ্যাখ্যা করে হেসে বললেন, চিনতে পারলেন না? নাইনটিন সেভেনটি থ্রির অক্টোবরে মাকড়দহে আলাপ–সেই যে হাবলবাবুর ফার্মে যাঁড়ের কেস! কে কে হালদার। চিনেছেন তো এবার?

কর্নেল হাসলেন। চিনেছি। কেমন আছেন হালদারবাবু? কোথায় আছেন এখন?

কৃতান্তকুমার হালদার চোখে ঝিলিক তুলে বললেন, আপনার মনে পড়তে পারে কর্নেল স্যার, আপনাকে বলেছিলাম, রিটায়ার করলেই প্রাইভেট এজেন্সি করব। করেছি। গণেশ এভেনিউতে আমার শ্যালক টি কে রায়ের লিগ্যাল কনসাল্টিং এজেন্সি। সেখানেই একটা রুম পেয়েছি। ওদিকে গেলে সাইনবোর্ড চোখে পড়বে, হালদার ডিটেকটিভ এজেন্সি।

হালদারবাবু জাঁদরেল পুলিশ সি আই ছিলেন বটে! কর্নেল মুখে প্রশংসা ফুটিয়ে বললেন, বাঃ! খুব ভালো! খাসা! তো কেস-টেস কেমন পাচ্ছেন বলুন?

পাচ্ছি। বেশিরভাগই ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনসার্নের। হালদারবাবু পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করলেন। শ্যালক বিরাট লইয়ার। সেদিক থেকেও সুবিধে হয়েছে। বলে একটিপ নস্যি নাকে খুঁজে হাঁ করে রইলেন। হাঁচির আশা করছিলেন। এল না। তখন ফাঁচ করে হেসে বললেন, আপনাকে কাল সকাল দশটা নাগাদ লেকভিলার ফুটপাতে হঠাৎ দেখতে পেলাম। ডি সি ডি ডির সঙ্গে শাদা ফিয়াটে উঠলেন। নেমে যেতে যেতে আপনারা ততক্ষণে মোড় পেরিয়ে গেছেন।

আপনি লেকপ্লেসে থাকেন বুঝি?

থাকি মানে? লেকভিলারই পাঁচতলায় একনম্বর ফ্ল্যাটটা কিনেছি। বছরখানেক হয়ে গেল প্রায়।

কর্নেল একটু নড়ে বসলেন। আর সব খবর বলুন!

 হালদারবাবু গলা চেপে বললেন, বলব বলেই আসা। আপনাকে কাল দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেছি, ও কেসের অবস্থা জটিল! তবে একটা কথা আগে বলে নিই কর্নেল স্যার, আমি বরাবর গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি মেনে চলি।

বেশ তো!

 মৃগাঙ্কবাবুকে আমি বলেছিলাম কেসটা আমাকে দিন। আমি তো এর ব্যাকগ্রাউন্ড সবই জানি। ভদ্রলোক গাঁইগুই করতে লাগলেন। পুলিশের ওপরমহল কেস নিয়েছে। প্রাইভেট থেকে নাকগলানো ওরা পছন্দ করবে না। শুনে বুঝলেন, আমার রাগ হল। আসলে পয়সা খরচ করতে চায় না। হাড়কেপ্পন। বদমেজাজী লোক একেবারে। মিনিস্টার মামার দৌলতে পয়সার মুখ দেখেছে! গুমোরে মাটিতে পা পড়ে না। অথচ দেখুন, আগের মাসে নামমাত্র ফিতে আমি ওর কাজ করেছি। আমি হোল বাকগ্রাউন্ড জানি।

কর্নেল মুখে নিরাসক্তি ফুটিয়ে বললেন, হু, ভদ্রলোক কেমন যেন।

 কেমন মানে কী? ধুরন্ধর হাড়ে হারামজাদা। কাউকে বিশ্বাস করে না। কাজ করিয়ে পয়সা না দিতে পারলে বেঁচে যায়। দেখুন না, মাত্র পঞ্চাশটা টাকায় ওর ওয়াইফ সম্পর্কে একগাদা ইনফরমেশন সাপ্লাই করেছিলাম। ওনলি ফিফটি রুপিজ। এদিকে আমার ট্যাক্সিভাড়াই গেছে সত্তর-পঁচাত্তর টাকা। বলবেন, কেন তাহলে কেস নিলেন? নিলাম। নেশা। এই আপনার যেমন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।

কৃতান্ত হালদার আবার খ্যাখ্যা করে হাসতে লাগলেন। কর্নেল বললেন, হা-মৃগাঙ্কবাবুকে সন্দেহপ্রবণ লোক মনে হয়েছে। অথচ নাকি প্রেম করে–

হাতি! হাতি! বুড়ো আঙুল দেখালেন কৃতান্ত হালদার। বিহারের মেয়ে মশাই–সাতঘাটে জল খাওয়া চরিত্র। বেশিদিন আমার লাগেনি। কয়েকদিনেই নাড়িনক্ষত্র জেনে গিয়েছিলাম। কলকাতায় পড়ার ছলে চলে আসার কারণ কী জানেন? জেলপালানো এক ডাকুর সঙ্গে প্রেম ছিল। সে মেয়েটার পেছনে। কলকাতায় ধাওয়া করেছিল। তার ভয়েই মিনিস্টারের ভাগ্নের ঘরে এসে ঢুকেছিল। মিঃ লাহিড়ীকে জিগ্যেস করবেন, সব জানতে পারবেন। বলে চোখ নাচালেন হালদারবাবু। পারবেন কী বলছি, আপনার কি তার অজানা আছে? কেস যখন নিয়েছেন।

উত্তেজনা চেপে কর্নেল মৃদু হাসলেন। স্ত্রীর গতিবিধি জানতে তাহলে আপনার সাহায্য নিয়েছিলেন মৃগাঙ্কবাবু?

হ্যাঁঃ। কৃতান্ত হালদার বাঁকা মুখে বললেন। আমার আরও একটা সুবিধা একই বাড়িতে থাকি। মৃগাঙ্কবাবু যখন থাকেন না, তখন কে আসছে-যাচ্ছে ওঁর বউয়ের কাছে, সেটা নজর রাখা কঠিন ছিল না। শুধু একটা ঝামেলা ছিল ওই ফ্লোরে পাশের ফ্ল্যাটে একটা বজ্জাত অ্যালসেসিয়ান আছে। প্রায়ই ছাড়া থাকত কুকুরটা শেষে মৃগাঙ্কবাবুকে বললাম, কুকুরটার এগেনস্টে কমপ্লেন করুন। নৈলে অসুবিধে হচ্ছে। তখন কুকুরটাকে আর ছাড়া হত না।

কারা আসত ঊর্মির কাছে?

 হালদারবাবু ফাঁচ করে হেসে বললেন, গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি কর্নেল স্যার!

বেশ তো। আমি যা জানি বলব আপনাকে।

 সে তো বলবেনই। আমার ক্লেইমটা একটু অন্যরকম।

বলুন।

 আমাকে আপনার অ্যাসিস্টেন্ট করতে হবে ননঅফিসিয়ালি। বলবেন, এতে আমার কী লাভ? আছে। কাগজে আপনার সঙ্গে আমারও নাম বেরুবে। তাতে আমার এজেন্সির সুনাম হবে। তাছাড়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আমার প্রাক্তন কলিগরা বলুন, কিংবা অন্যান্য অফিসাররা যারা আছেন, তারা ভবিষ্যৎ কেসে দরকার হলে আমাকে হেল্প করবেন।

এখন করেন না বুঝি?

বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লেন কৃতান্ত হালদার। সব চাকরিতে এ-রকম। রিটায়ার করলে আর কেউ তাকে মনেও রাখে না, পাত্তাও দেয় না। বরং বেঁগড়বাজি করে। তার ওপর আমাদের দেশের পুলিশকে তো জানেন। প্রাইভেটকে নাক গলাতে দেখলেই তেড়ে আসে ডাণ্ডা উঁচিয়ে। আপনার কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। আপনি স্যার ভি আই পি লোক। ইন্টারন্যাশান্যালি ফেমাস।

কর্নেল হাসি চেপে বললেন, বেশ তো। আপনি আমার সঙ্গে থাকুন। ওদের জানিয়ে দেব, যাতে আপনার কোনো অসুবিধে না ঘটায় কেউ।

কৃতান্ত হালদার আর এক টিপ নস্যি নিতে যাচ্ছিলেন, ষষ্ঠী চা নিয়ে এল। এতক্ষণে বাইরে বৃষ্টির শব্দ। চায়ে চুমুক দিয়ে হালদারবাবু বললেন, এ জন্যই আসা। জানতাম, আপনি ফেলে দেবেন না। উরে বাস! মাকড়দহ ফার্মে ষাঁড়ের কেস–মানে, গোঁজ মেরে মার্ডার করে কেমন যাঁড় বেচারার ওপর দোষ। চাপিয়েছিল বলুন, আমি কী রকম কোঅপারেশন করেছিলাম আর আপনিও আমার অ্যাডভাইস নিয়ে শেষপর্যন্ত–উরে বাস! মনে পড়ে আর এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। এমনি বর্ষার রাত। খড়ের গাদার পাশে ওত পেতে আছি। আসামী রক্তমাখা গোঁজটা খড়ের ভেতর থেকে সরাতে এসেছে। অন্ধকারে খড় খড় শব্দ…

ঊর্মির কাছে কারা যাতায়াত করত হালদারবাবু?

গলা চেপে কৃতান্ত হালদার বললেন, একজন রেগুলার যেত। তাকে ফলো করে নাম-ধাম পেয়েছিলাম। মৃগাঙ্কবাবুরই বন্ধু ভদ্রলোক। সুব্রত সিংহরায় নাম। ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং কনসার্নের মালিক।

মৃগাঙ্কবাবুকে বলেছিলেন সে কথা?

 বলতে বাধ্য। প্রফেশনাল এথিকস বলে কথা। নুন খেয়েছি যে জন্য।

 আর কেউ?

দুদিন এসেছিল এক নন-বেঙ্গলি ভদ্রলোক। তখন জানতাম না, ওই ব্যাটা পাটনা জেল ভেঙে ফেরার হয়েছে। অনেকদিন পরে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে একজন প্রাক্তন কলিগের সূত্রে সব জেনেছিলাম। কিন্তু তখন সে বেপাত্তা।

কী নাম বলুন তো?

রঘুনাথ সাহু। কৃতান্তবাবু ফের গলা চাপলেন। এসব ক্ষেত্রে রিস্ক নিতেই হয়েছে। সাততলার একনম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন মিঃ নায়ার। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে। দাবাখেলার ঝোঁক আছে ভদ্রলোকের। মাঝে মাঝে এ ফ্ল্যাটে এসে থাকেন। বিপত্নীক বড়লোক মানুষ। যাই হোক, ওঁর ফ্ল্যাটটা থেকে নজর রাখার সুবিধে হত। নায়ার তার ফ্ল্যাটের চাবি আমার কাছে রেখে যেতেন। আমি ডাকুব্যাটার ছবি তুলে নিয়েছিলাম। বুঝলেন না? ক্লায়েন্টকে উইথ এভিডেন্স প্রডিউস করতে হবে সব ইনফরমেশান!

কৃতান্ত হালদার পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন। খামের ভেতর একগাদা ফোটো।…এই দেখুন রঘুডাকাত! দেখলেই মনে হয় না মার্ডারার? আর এই দেখুন দরজায় ওয়েলকাম করছেন মৃগাঙ্কবাবুর ওয়াইফ। ইনি হলেন সুব্রত সিংহরায়। এবার এগুলো দেখুন, পার্কস্ট্রিটের একটা বারে তোলা। মুখোমুখি বসে বিয়ার খাচ্ছে-চেনেন কি একে? হিমাদ্রি রায়-কোল ইন্ডিয়ার অফিসার। খুব রিস্ক নিয়ে ছবিগুলো তুলতে হয়েছে। আলো কম বলে একটু আবছা হয়েছে। কিন্তু চেনা যায়।

কর্নেল প্রশংসা করে বললেন, ওয়েলডান মিঃ হালদার!

কৃতান্ত হালদার বিগলিত হয়ে বললেন, একটা করে কপি আপনি রাখুন। দরকার হতে পারে।

মৃগাঙ্কবাবুকে এককপি করে দিয়েছেন নিশ্চয়?

দিতে হয়েছে। বিলের টাকা এখনও পাওনা। ভাবতে পারেন লোকটা কী কঞ্জুস! বলে বাকি ছবি খামে ভরে কৃতান্ত হালদার সোজা হয়ে বসলেন। এবার আমাকে কিছু ইনফর্মেশান দিন স্যার! যাতে আমি ঠিক রাস্তায় এগুতে পারি।

আপনি জানেন কি মৃগাঙ্কবাবুর ফ্ল্যাট থেকে কাল সকালে ওঁর স্ত্রীর একটা স্যুটকেস চুরি গিয়েছিল?

খ্যা খ্যা করে হেসে উঠলেন কৃতান্ত হালদার। জানি মানে? প্রচণ্ড জানি। স্যুটকেসটা পাওয়া গেছে।

আরও হেসে হালদারবাবু বললেন, যাবে না কেন? কোনো ক্লু না পেলে খামোকা ওটা গাপ করে লাভটা কী? খালি মেয়েলি কারবার। খেলনা, হাবিজাবি, পুঁতির মালা, একগাদা কুঁচফল।

কর্নেল হাসলেন। বুঝলাম, আপনারই কীর্তি! চাবি পেলেন কোথায়?

এ লাইনে রিস্ক না নিয়ে উপায় থাকে না। আপনি তো সবই জানেন। দরজার লকের ছাঁচ নিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি করিয়েছি সম্প্রতি। দু নম্বরের কুকুর হারামজাদাটার জ্বালায় সে এক প্রাণান্তকর অবস্থা। তাও তো ভেতরে বাঁধা ছিল। আর ওই নাকগলানে ভদ্রমহিলা! কুকুর চাঁচালেই দরজা খোলেন। অমনি ভালমানুষ সেজে নায়ারের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ি।

রঞ্জনবাবুর স্ত্রী?

আজ্ঞে দিনদুই আগে দরজা খুলেছি, দেখি দু নম্বরের দরজার ফাঁকে মুখ। চোখ পড়তেই বললাম, পুলিশ অফিসার।

মৃগাঙ্কবাবুর ফ্ল্যাটে কোনো ক্লু পেয়েছেন কি মিঃ হালদার?

হালদারবাবু থেকে মিঃ হালদার হয়ে কৃতান্তকুমারের মুখে আত্মবিশ্বাস ও গর্বের ভাব ফুটে উঠল। বললেন, ঠিক কু কি না জানি না, ড্রেসিং টেবিলের তলায় দলাপাকানো ছেঁড়াখোঁড়া একটা টেলিগ্রাম পড়ে ছিল। আজ নাইনটিনথ– ওটা পেয়েছি ফিফটিনহ্ জুলাই। মৃগাঙ্কবাবুর স্ত্রী মার্ডার হয়েছে ইলেভেনথ জুলাই। তো টেলিগ্রামটা জোড়াতাড়া দিয়ে খানিকটা উদ্ধার করেছি। এই দেখুন।

শাদা কাগজে আঁটা কয়েকটুকরো হলদে কাগজ। টেলিগ্রামই বটে। REACHED….. CARGO NOT…. ADVISE…. HEMANTA HOTEL DELIGHT BOMBAY.

কৃতান্ত হালদার বললেন, লোকাল পোস্টঅফিসের নাম ঘেঁড়া। রিসিভিং ডেটটা দেখুন। শুধু ওয়াই এইটুকু আছে। আমার ধারণা জুলাই–মানে এমাসেরই। আমি মৃগাঙ্কবাবুর অফিস-এরিয়ার পোস্টাপিসে আর আমাদের লেক প্লেস এরিয়ার পোস্টাপিসে খোঁজ নিতে গিয়ে হন্যে হয়েছি। একাজ আপনি পুলিশ দিয়ে পারবেন। বুঝলেন না? পুলিশের ইউনিফর্ম দেখলে সবাই জব্দ। এতদিনে হাড়ে হাড়ে সেটা টের পাচ্ছি। ওই যে বলে, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা

হেমন্ত? কর্নেল আস্তে বললেন।

 মৃগাঙ্কবাবুর এক কর্মচারী। হেমন্ত বোস।

কিন্তু টেলিগ্রামটাকে ক্লু ভাবছেন কেন?

 অমন ছেঁড়া অবস্থায় ড্রেসিং টেবিলের তলায় পড়ে থাকার জন্য।

কারবারী লোক। এসব টেলিগ্রাম আসতেই পারে। অন্যমনস্কভাবে ছিঁড়ে ফেলতেও পারেন।

তাই। ফ্যানের হাওয়ায় কিছু টুকরো উড়ে গিয়ে ওখানে আটকেছিল। কৃতান্ত হালদার নস্যি নিলেন। তারপর বিকট হেঁচে বললেন ফের, তাহলেও ওই যে বলে, যেখানে দেখিবে ছাই, পাইলে পাইতে পারো-হেঁ হেঁ, আপনাকে আর কী জ্ঞান দেব স্যার? আপনি হলেন এ লাইনে রাজা–সম্রাটও বলা যায়।

বৃষ্টিটা বেড়েছে। রাস্তায় জল জমবে। কর্নেল উঠে গিয়ে জানালায় বৃষ্টি দেখে এলেন। কৃতান্ত হালদার আবার হাঁচার জন্য হাঁ করে আছেন তো আছেন। ইজিচেয়ারে বসে কর্নেল ডাকলেন, মিঃ হালদার!

ব-চ্ছোঁ! হেঁচে নোংরা রুমালে নাম মুছে কৃতান্তবাবু রিপিট করলেন, বলুন স্যার!

ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

কৃতান্ত হালদার বেজার মুখে বললেন, ঠিক ওইদিনটাতে আমি অ্যাবসেন্ট। কুগ্রহ ছাড়া কী বলব? দমদমে দিদির নাতনির বিয়ে। না থাকলেই নয়। টুয়েলফথ দুপুর নাগাদ ফিরে শুনি ওই সাংঘাতিক কাণ্ড। আমি থাকলে কালপ্রিট হাতেনাতে ধরা পড়ত।

কাকে সন্দেহ হয় আপনার?

গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার এককথায় বললেন, মৃগাঙ্কবাবুই মার্ডারার।

 কর্নেল একটু হেসে বললেন, কেন?

তাহলে ওই যে বলে, সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মাসি হয়, কর্নেলস্যার! ব্যাকগ্রাউন্ডটা তো সবই শুনলেন। বউয়ের ওপর সন্দেহ। ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্যে বউয়ের গোপন গতিবিধি ইত্যাদি খবর যোগাড়। মোটিভ ভেরি ক্লিয়ার। পুলিশ ছিলাম, পুলিশের কারবার তো জানি। তাতে মিনিস্টারের ভাগ্নে। বাকিটা বুঝে নিন। ওই যে বলে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে–তাই করবে। আমার গ্রিভ্যান্সটা তো এখানেই।

কিন্তু আপনি জানেন কি মৃগাঙ্কবাবুর শ্বশুরও মাসতিনেক আগে বিহারের সেতাপগঞ্জের বাড়িতে একইভাবে খুন হয়েছেন? দরজার কাছেই ডেডবডি ছিল শ্বাসনালী কাটা।

কৃতান্ত হালদার নড়ে বসলেন। উরে ব্বাস! তাহলে তো মোটিভ আরও স্ট্রং হল স্যার!

কেন?

 শ্বশুরের ওপর ভীষণ রাগ মৃগাঙ্কবাবুর। খুলে বলি, আমার এজেন্সিকে কেউ কাজ দিলে আগে কিছু ইনফরমেশন চাইবই চাইব। ব্যাকগ্রাউন্ড না জেনে তো এগুনো যায় না। মৃগাঙ্কবাবু সব বলেছিলেন। শ্বশুর ওঁকে নাকি ইনসাল্ট করেছেন। কথা বলেননি। তবে–আশ্চর্য তো! শ্বশুর খুন হওয়ার কথাটা কেন চেপে গেলেন ভদ্রলোক? কৃতান্তবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। চেপে যাওয়াতেই মোটিভ স্ট্রার হলো। আমার কথায় তো ডি ডির কোনো অফিসার কান দেবে না–বরং ঠাট্টাবিদ্রূপ করবে। সবসময় করে। রামগোয়েন্দা নাম দিয়েছে আমার জানেন? ইনসাল্টিং!

কর্নেল সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন, যাতে আপনি কোঅপারেশান পান, চেষ্টা করব। একপেয়ালা কফি খাবেন মিঃ হালদার?

 মন্দ হয় না। বৃষ্টিবাদলার রাতে কফি খেতে ভালই লাগবে আশা করি। তবে একটু বেশি দুধ দিতে বলুন। অনিদ্রার রোগী। সারারাত ঘুম হয় না। তিরিশ বছর পুলিশলাইনের অভিশাপ, বুঝলেন না?

কর্নেল ষষ্ঠীকে ডেকে কফির আদেশ দিলেন। মনে মনে হাসছিলেন। কৃতান্ত হালদারের সারারাত সম্ভবত মাথার ভেতর ধুরন্ধর ক্রিমিন্যাল ঘুরে বেড়ায়। ঘুম হওয়ার কথা নয়। মাকড়দহ ফার্মে সারারাত যা কাণ্ড করেছিলেন।

কৃতান্ত হালদার এতক্ষণে ড্রয়িংরুমের ভেতর চোখ বুলোচ্ছেন। বললেন, ঘরখানা যে যাদুঘর বানিয়ে রেখেছেন স্যার! ইশ! কতসব অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস! কত বই! উরে ব্বাস! ঘরের ভেতর গাছ! ফুলও ফোটে!

চোখে বিস্ময় নিয়ে উঠে গেলেন। সারা ঘর ঘুরে এটাওটা দেখে নাড়াচাড়া করে ফিরে এলেন। অনেকরকম মুখোস দেখলাম। একবার বর্ধমান খনি এরিয়ায় এক ভদ্রলোক মুখোস পরে নিজের বউ আর ছেলেমেয়েকে মার্ডার করেছিলেন। ওই মুখোসের ক্লু থেকেই ধরে ফেলেছিলাম, জানেন? রথের মেলায় আগেরদিন মুখোস কিনে এনেছিলেন—

ষষ্ঠী কফি আনতেই থেমে গেলেন কৃতান্তবাবু। কর্নেল অতিরিক্ত দুধ মিশিয়ে কফির পেয়ালা ওঁর হাতে তুলে দিলে চুমুক দিলে বললেন, মৃগাঙ্ক রায় ইজ দা মার্ডারার। ওকে এখনই অ্যারেস্ট করতে বলুন। আর ওর শ্বশুরের কথা বললেন। বিহারে কোথায় যেন বাড়ি?

সেতাপগঞ্জ। মোতিহারির কাছে।

 আমি এভিডেন্স এনে দেব। আই অ্যাসিওর ইউ। কৃতান্ত হালদার সেই জোড়াদেওয়া টেলিগ্রামের কাগজটা কর্নেলের হাতে গুঁজে দিলেন। পোস্টঅফিস থেকে এটার একটা কিনারা করে ফেলুন। দেখবেন, ওই যে বলে, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। আর এই রইল আমার কার্ড। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস কর্নেলস্যার! মাকড়দহে তো দেখেছেন আমাকে। এবারও দেখুন। শুধু একটা রিকোয়েস্ট।

বলুন!

আমার এজেন্সির পাবলিসিটিটা যেন হয়, স্যার। কাগজের লোকও আপনার হাতে আছে শুনেছি।

ভাববেন না। সব হবে।

গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার আশ্বস্ত হয়ে কফিতে ঘন-ঘন চুমুক দিয়ে বললেন, ব্রিলিয়ান্ট!….

.

শ্রাবন্তী সংবাদ

সুনেত্রা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, তুমি স্রি বুদ্ধ বুড়বক থেকে গেলে হিমুদা! তুমি সঙ্গেসঙ্গে থানায় গেলে না কেন?

হিমাদ্রি হাসবার চেষ্টা করল। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরেও ডিসিশন নিতে ঘণ্টা দেড়েক লাগল। তারপর লেক প্লেস এরিয়ার থানায় রিং করলাম।

বললে, তোমার সামনে খুন হয়েছে?

 সামনে তো হয়নি।

 কী বললে তাহলে?

 নিজের নাম বলি নি। শুধু বললাম লেকভিলার সাততলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটে এক ডেডবডি পড়ে আছে। আর কিছু বললাম না।…হিমাদ্রি একটু চুপ করে থাকার পর ফের বলল, শুধু একটা ব্যাপার তখন বুঝতে পারিনি। ঊর্মি দরজা খুলতে গিয়ে কিন্তু জিগ্যেস করেনি পর্যন্ত, কে নক করছে। তাহলে শুনতে পেতাম। এমন কী লোকটা যে ওর গলায় ছুরি চালাল, চিৎকার পর্যন্ত করেনি!

সুনেত্রা ক্ষুব্ধভাবে বলল, তুমি ভীষণ ব্লান্ডার করেছ! দেখবে, সব দোষ তোমার ঘাড়ে পড়বে।

হিমাদ্রি মাথা দোলাল। আমি ওদের ফ্ল্যাটে ওই প্রথম আর শেষবার গেছি। লোডশেডিং ছিল। কারুর সঙ্গে দেখা হয়নি। সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত।

এই হিমুদা! সুনেত্রা চাপা গলায় বলল। কিছু ফেলে আস নি তো টুকুর ফ্ল্যাটে?

 সিগারেট লাইটার ফেলে এসেছি শুধু। মৃগাঙ্কও সিগারেট খায়। কাজেই ওটা নিয়ে পুলিশ মাথা ঘামাবে না মনে হয়।

সুনেত্রা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। দুপুরে জোর বৃষ্টি হয়ে বিকেলে রোদ্দুর ফুটেছে। ঝলমল করছে চারদিক। ওরা দেতালার একটা ঘরে বসে কথা বলছিল। উত্তরের জানালা দিয়ে পোড়ো মাঠের ওধারে বাঁধের সড়ক এবং তার পেছনে ভরা গঙ্গা দেখা যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ হলুদ জলের ওপর রোদ্দুর। মহাজনী নৌকোর পালে হাওয়া লেগেছে। হিমাদ্রি বলল, বিবি, চলো না বসন্তনিবাসে যাই একবার! ওদের ব্যাপারটা দেখে আসি।

 ইন্দুকাকাকে সকালে তোমার কথা বললাম। শুধু বললেন, তাই নাকি? বললেন না, নিয়ে এস ওকে।

হিমাদ্রি দুঃখিতভাবে হাসল। ও বাড়িতে অভিশাপ আছে। ওখানে যারাই থাকে, তারাই অ্যাবনর্মাল! ইন্দুকাকাকেও ওদের বাড়ির ভূতটা কীভাবে পেয়ে বসছিল, দেখেছি তো চোখের সামনে।

সুনেত্রা গম্ভীর মুখে বলল, আমার তা মনে হয় না! ওদের মধ্যে একমাত্র উনিই হোশিয়ার আদমি।

কেন একথা বলছ?

 বাঃ! ইন্দুকাকা না থাকলে খুকু-অপুর কী অবস্থা হত ভাবো একবার? জমিনগুলোও সব দখল করে ফেলত বাচ্চু সিংরা। রঘুয়ার কীর্তি তো তুমি জান না। সেও ভি নকশাল মুভমেন্টের ঘাঁটি করেছিল এরিয়ায়। ইন্দুকাকা রাছুজীর সঙ্গে ফয়শালা করে ওদের ভাগিয়ে দিয়েছিল, জান?

হিমাদ্রি জানালার পাশেই বসে ছিল। হঠাৎ বলল, বিবি! দেখ, দেখ। ওই মেয়েটা অপু না?

সুনেত্রা উঁকি মেরে দেখে একটু হাসল। হ্যাঁ। তুমি কেমন করে চিনলে? দেখেছ তো স্রিফ খোখি বয়সে!

হিমাদ্রিও হাসল। ঊর্মির মুখের সঙ্গে খুব মিল আছে মনে হল।

পোড়ো জমির ওপর দিয়ে অপালা হনহন করে আসছিল। বাড়ির নিচে। আসতেই সুনেত্রা ডাকল, অপু! এই অপু!

অপালা মুখ তুলল। নির্বিকার ঠাণ্ডা চাউনি।

আ যা! সুনেত্রা হাসতে হাসতে হাতে নেড়ে ডাকল। দেখকে যা কৌন আয়া!

অপালা একটু ইতস্তত করে বাড়ি ঢুকল। হিমাদ্রি বলল, অপু কি বাংলা বলে না নাকি?

কেন বলবে না? আমি ইচ্ছে করেই ওর সঙ্গে হিন্দুস্থানী বলি।

নিচে সুনেত্রার মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলে অপালা ওপরে এল। দরজার পর্দা তুলে হিমাদ্রিকে দেখে থমকে দাঁড়াল। সুনেত্রা বলল, ক্যা রী? নেহি পছনতি?

অপালা বলল, ভ্যাট! খালি এইসব। যাচ্ছি।

সুনেত্রা ওকে টেনে এনে হিমাদ্রির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলল, কী দারুণ মেয়ে হয়েছে দেখতে পাচ্ছ? একেবারে দেহাতী খোট্টামার্কা। তাই না? বলে সে অপালার পাঁজরে খুঁচিয়ে দিল। হাঁ করে কী দেখছিস তুই? বল্ তো এ কে?

অপালা হিমাদ্রিকে ফের ঠাণ্ডা নিষ্পলক চোখে দেখে নিয়ে মাথা দোলাল। চিনতে পারছি না।

হিমুদা রে! খিলখিল করে হেসে উঠল সুনেত্রা। গঙ্গায় ডোবা থেকে তোকে কে বাঁচিয়েছিল মনে নেই? তখন তো তুই খোখি ছিলি না, অপু!

অপালা চুপ করে থাকল। হিমাদ্রি বলল, দশটা বছর খুব কম নয়। তাছাড়া আমরা ছিলাম ওদের শত্রু। রুদ্রজ্যাঠা আমাকে গুলি করতে এসেছিলেন। এখন–

সুনেত্রা ধমকাল। শাট আপ! ওসব কথা ওকে ভী বলছ?

সরি। হিমাদ্রি একটু হাসল। অপু, কিছু মনে কোরো না। তোমার বড়দি কেমন আছে বলো।

অপালা আস্তে বলল, ভাল।

 সেই অসুখটা সারেনি এখনও শুনলাম?

অপালা কিছু বলল না। সুনেত্রা বলল, খুকুদির সঙ্গে পরশু দেখা হয়েছিল। একা মন্দিরের ওখানে বসে ছিল। বললাম, এখানে কী করছ-বাড়ি এস। জবাব দিল না। হাত ধরলাম তো ছাড়িয়ে নিয়ে এমন চোখ কটমট করে তাকাল যে ভয় পেয়ে ভেগে এলাম। হ্যাঁ রে অপু, ও কী করছে? বাড়িতে আছে, না মন্দিরতলায় গিয়ে বসে আছে?

অপালা বলল, শুয়ে ছিল দেখেছি।

বস্ অপু! চা খেয়ে যাবি। বলে আসি। ততক্ষণ তুই হিমুদার সঙ্গে গপসপ কর।

সুনেত্রা চলে গেলে হিমাদ্রি ডাকল, অপু!

উঁ?

তুমি বুঝি বেশি কথা বলো না মেজদির মতো?

অপালা এতক্ষণে ঠোঁটের কোনায় একটু হাসল। না বলার কী আছে?

আমার কথা তোমার মনে পড়া উচিত, অপু।

 মনে পড়বে না কেন?

আচ্ছা! হিমাদ্রি সিগারেট ধরাল। একটু পরে আস্তে বলল, মেজদির খবর পেয়ে তোমরা কেউ যাওনি কলকাতা?

মামাবাবু এসে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে।

 ও। তাহলে বডি দেখতে পাওনি?

 অপালা আস্তে মাথাটা দোলাল।

 শুনেছি তোমার বাবাও তো একইভাবে

অপালা মুখ নামিয়ে বলল, ওসব কথা থাক। তারপর একটু পরে মুখ তুলে ফের বলল, আপনি কলকাতায় থাকেন? মামাবাবু বলছিলেন।

থাকি। এবার কলকাতা গেলে দেখা কোরো যেন তোমার মামা ঠিকানা জানেন। যাবে তো?

গেলে যাব।

হিমাদ্রি ওর হাবভাব দেখে একটু অস্বস্তিতে পড়েছে। কী কথা বলবে ওর সঙ্গে, খুঁজে পাচ্ছে না। ধোঁয়ার রিং পাকিয়ে বলল, বিবির কাছে শুনলাম, কলেজে ঢুকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছ। ঠিক করোনি। আজকাল মেয়েদের একটা ডিগ্রি থাকা ভাল। নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। তাছাড়া ধরো, এই বাজে পরিবেশ। এখানে পচে মরার কোনো মানে হয় না। তুমি মামার কাছে থেকে ফের পড়াশোনা শুরু করো, অপু! কী?

অপালা কপাল থেকে রুক্ষ চুলের গোছা সরিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে বলল, কী হবে?

হাসল হিমাদ্রি। এই লাইফ তোমার পছন্দ?

 আমার খারাপ লাগে না।

আসলে সবই অভ্যাস। তুমি এই লাইফে অভ্যস্ত হয়ে গেছ। হিমাদ্রি কথা বলার জন্য কথা বলছিল। আমার কথাই ধরো। আমার বেলা শাপে বর হয়েছিল। আমিও ভাবতাম, সেতাপগঞ্জ ছেড়ে কোথাও গিয়ে একবেলা থাকতে পারব না। শেষে যখন বাধ্য হয়ে চলে যেতে হল, তখন দেখলাম কী ওয়ার্সট প্রিমিটিভ পরিবেশে পচে মরছিলাম!

সবাই আপনার মতো নয়।

তা নয় ঠিকই। তবু তুমি তো এখন সাবালিকা–বয়স কত তোমার? আই থিঙ্ক টোয়েন্টি–বা কাছাকাছি। সামনে অগাধ লাইফ পড়ে আছে।

হিমাদ্রি হঠাৎ চুপ করে গেল। ওকে কি সে সিডিউস করছে, যেমন করত দিনের পর দিন ওর মেজদিকে? কিন্তু ঊর্মির সঙ্গে চেহারা আর এই স্মিতভাষিতায় যেটুকু সামান্য মিল, বাকি সবটাই বিপরীত মনে হচ্ছে। রুক্ষ দেহাতী আদিম একটা যৌবনের সামনে বসে আছে সে। কমিউনিকেট করা হয়তো অসম্ভব। আর ঊর্মি ছিল স্মার্ট, ছিমছাম, এবং তার ব্যক্তিত্বে সারাক্ষণ মেঘের ভেতর। থেকে বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিত সেক্স। বড় নিষ্ঠুর সেক্সি মেয়ে ছিল ঊর্মি!

অপালা নোখ খুঁটছিল। কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করল, কিন্তু বলল না। সুনেত্রা ট্রে সাজিয়ে চা আর স্ন্যাকস নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, কথা বলাতে পারলে। কাঠপুতলিকে?

হিমাদ্রি হাসল। যৎকিঞ্চিৎ! ওর মেজদির মতোই। অবশ্য ঊর্মির কথা বলার স্বভাব ছিল চোখে।

সুনেত্রা পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলল, বন্যেরা বনে সুন্দর। ওকে দেহাতে ওদের ফার্মে গিয়ে ছেড়ে দাও, দেখবে অন্য মূর্তি। সেবার বাবার সঙ্গে চৌথিয়া ঝিলে হাঁস মেরে ফিরে আসছি–আমি না, বাবা দুটো হাঁস মেরেছিলেন, তো আসার পথে ওদের ফার্ম হয়ে এলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা। দেখি কী, একদঙ্গ ল মেয়ে গেঁহু বাছাই করছে আর মধ্যিখানে বসে অপু তাদের সঙ্গে মৈথিলী। চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেখেই সরম বাজল। কী রে? মিথ্যা বলছি?

অপালা স্ন্যাকসের প্লেট তুলে নিয়ে নির্বিকার মুখে চিবুচ্ছে। হিমাদ্রি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ওর খাওয়ার মধ্যেও কেমন যেন আদিমতা। একটু পরে সুনেত্রার চোখে পড়ল যেন। একটু হেসে বলল, আমার প্লেটটাও খাবি কিন্তু অপু। বিকেলে কিছু খেলেই আমার কেমন গা-বমি করে। কী? দেব?

অপালা একটু হাসল। ক্ষিদে পেয়েছিল।

দুপুরে খাসনি বুঝি?

না। মাঠে গিয়েছিলাম। এখন ফিরছি।

 একা গিয়েছিলি?

না। ইন্দুকাকার সঙ্গে।

উনি ফেরেননি?

 মাঠ থেকে আসছি বলে কেঁওডিহি গেল। আমি চলে এলাম।

তাই তোকে অমন শুখা-রুখা দেখাচ্ছে। মরবি ছোঁকড়ি! ভদ্রলোকের মেয়ে কে বলবে রে তোকে? অমনি করে দিনভর ক্ষেতি করে বেড়াচ্ছিস! ইন্দুকাকা তোর মাথাটা খাবে।

অপালা চুপচাপ খাচ্ছিল। তেমনি নির্বিকার মুখ। শ্বাস ছেড়ে সুনেত্রা ফের বলল, কী অবস্থা বুঝতে পারছ হিমুদা?

হিমাদ্রি একটু হাসল শুধু। এতক্ষণে তার চোখে পড়ছিল অপালার রুক্ষ চুলে একচিলতে শুকনো কাদা, ব্লাউসের কাঁধের কাছে একটু ফাটা অংশ, যেমন তেমন একটা ধূসর রঙের প্রিন্টেড শাড়ি, এবং খালি পা! চোখের তলায় ক্ষীণ কালো ছোপ আর নাকের ডগা, গলায় নুনের কণা। জুলাই মাসের কড়া রোদে মাঠ-ঘাটে ঘুরে আসা এক যুবতীর শরীরে প্রকৃতির নোখের আঁচড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

হিমাদ্রি বলল, বৃষ্টির সময় কোথায় ছিলে?

অপালা বলল, ফার্মে।

সুনেত্রা বলল, ফার্ম না কিছু! দুখানা কুঁড়ে ঘর ক্যানেলের ধারে। গভমেন্ট থেকে ফেসিলিটি পাওয়া যায় ক্ষেতিতে। তাই ইন্দুকাকা ফার্ম-টার্ম করে। শোন অপু কাল থেকে ও সব ছেড়ে দে। এত বড় মেয়ে হয়েছিস, কত বড় বংশের মেয়ে তুই, সরম বাজে না?

হিমাদ্রি মন্তব্য করল, বেঙ্গলে থাকলে এ সব পারত না। মেন্টালিটিই বদলে যেত। আসলে বিহারের অ্যাটমসফিয়ারই অন্যরকম–বিশেষ করে এ সব ছোটখাট গঞ্জে। ঊর্মির ব্যাপারটা দেখ না! ও এটা কাটাতে পেরেছিল বলেই

অপালা ফোঁস করে উঠল হঠাৎ। সে জন্যেই খুন হয়ে গেল মেজদি!

সুনেত্রা খিলখিল করে হেসে উঠল। কাকে কী বলা হচ্ছে? ডাকুরানী অপু, তুই রঘুয়ার দলে ভিড়ে যা। ফুলনদেবী হয়ে যা।

অপালা এতক্ষণে চায়ের কাপ তুলল। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঢকঢক করে গিলে আঁচলে ঠোঁট মুছে একটু হাসল। বাড়ি ফিরে আর খাচ্ছিনে এবেলা–চলি বিবিদি!

বস্। গল্প করি। অনেকদিন আসিস নি।

অপালা উঠে দাঁড়াল। উঁহু। ইন্দুকা এতক্ষণে এসে গেলে বকবে। আমি যাই।

সে দরজার কাছে গিয়ে ঘুরল। হিমুদাকে নিয়ে যেও। বড়দিকে বলছি গিয়ে। বলে বেরিয়ে গেল হাল্কা পায়ে।

সুনেত্রা তাকাল হিমাদ্রির দিকে। কী বুঝলে?

 তুমি যা বলছিলে–মানে, ফুলনদেবীর আগের স্টেজ।

 ভ্যাট! সুনেত্রা জানালায় গিয়ে নিচে অপালাকে দেখতে দেখতে বলল, ওর একটা আশ্চর্য স্বভাব–কিছুতেই রাগ করে না। একেবারে পান্থরকা মাফিক। ওর জন্য কষ্ট হয়, জানেনা হিমুদা?

হিমাদ্রি অন্য কথা ভাবছিল। ডাকল, বিবি?

কী?

শ্রাবন্তীদি–মানে খুকুদির কথা বলছি। সে অপুকে শাসন-টাসন করে না?

 তাকেই কে শাসন করে ঠিক নেই। তাছাড়া শাসন করার কী আছে? অপু আর যাই হোক, ওর স্বভাবচরিত্র ভাল। টুকুর সঙ্গে আকাশপাতাল ফারাক। মুখ টিপে হাসল সুনেত্রা। টুকুকে তো তুমি ভাল চিনতে। তোমার ছোটবেলার প্রেমিকা।

হিমাদ্রি ঠাট্টায় কান করল না। গলার ভেতর বলল, আমার ভয় হয়–

কিসের ভয়?

অপুর জন্য।

অপুর জন্য তোমার ভয়-ডর মাথাব্যথা–কিছু করতে হবে না। নিজের কথা ভাবো।

হিমাদ্রি যেন দেয়ালকে শুনিয়ে বলল, ঊর্মির একটা কথা মাথা থেকে যাচ্ছে না। বরং

সুনেত্রা ভুরু কুঁচকে তাকাল। কী কথা?

 ওর বড়দি সম্পর্কে।

সুনেত্রা বিরক্ত হয়ে বলল, আমার দিকে তাকিয়ে বলবে না কি? পরিষ্কার করে বলো!

হিমাদ্রি গলা চেপে বলল, কথাটা এমন অবিশ্বাস্য লেগেছিল। অথচ এখন মনে হচ্ছে, ঊর্মি হয়তো ঠিকই আঁচ করেছিল। কাউকে বোলো না যেন মাকেও না।

সুনেত্রা অধৈর্য হয়ে রেগে গেল। ছোড় দো জী! মাৎ বোলো।

বিবি, গত মাসে ঊর্মির সঙ্গে একখানে কিছুক্ষণ কাটিয়েছিলাম। কথায় কথায় হঠাৎ ঊর্মি বলল, ওর বরের সঙ্গে এখানে এসেছিল বাবাকে প্রণাম করতে। তখন ওর বাবা ওকে চুপিচুপি সাবধান করে দিয়েছিলেন ওর বড়দি সম্পর্কে।

সে কী?

 হ্যাঁ। শ্রাবন্তীদি নাকি একদিন দুপুর রাতে ওর বাবার দরজায় নক করেছিল। তখনও রুদ্রজ্যাঠার প্যারালেসিস হয়নি। দরজা খুলেই দেখেন, শ্রাবন্তীদি একটা ড্যাগার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে চাচামেচি করেছিলেন। তারপর অপালা পাশের ঘর থেকে এসে শ্রাবন্তীদিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। অজ্ঞান হয়ে যায় শ্রাবন্তীদি। তারপর–ঊর্মি বলছিল, ওর ভর ওঠে। ভরের সময় বলে, কাউকে রাখবে না। সক্কলের গলা কাটবে।

টুকু বলেছিল এ সব কথা?

হিমাদ্রি চুপ করে থাকল। সুনেত্রা ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আমি বিশ্বাস করি না। অ্যাবসার্ড! তুমি কি ভাবছ, তুমি যখন টুকুর সঙ্গে আসনাই করছিলে, তখন খুকুদি গিয়ে দরজায় নক করেছিল? ইমপসিবল! ইয়ে কভি নেহি হো সকতা। দুবলা শরীরে সেই কলকাতা গিয়ে বোনকে খুন করেছে সে? টোটালি ইমপসিবল!

হিমাদ্রি উঠে দাঁড়াল। মাথা ঝিমঝিম করছে। একটু বেরোই।

 অপুদের বাড়ি যাবে তো চলো।

 তাই চলো।..

.

সুব্রতর আবির্ভাব

আজ সব কাগজে ওয়ান্টেড শিরোনামে হিমাদ্রির ছবিসহ বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার সন্ধান দিয়ে ধরতে সাহায্য করলে। কর্নেল ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্লডে ধুলোমাখা হাতে কয়েকটা খবরের কাগজ উল্টেপাল্টে বিজ্ঞাপনটা দেখছিলেন। এমন সময় ষষ্ঠী এসে খবর দিল, ফোং।

অরিজিতের ফোন হলে সে করাসরি ঘোষণা করত নালবাজারের নাহিড়িসায়েব। কর্নেল ফোন তুলতেই গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদারের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনলেন। দেখেছেন স্যার পুলিশের কাণ্ডটা? মিনিস্টারের ভাগ্নের ট্র্যাপে কেমন করে পা দিয়ে বসল! এখন আর কী করব বলুন?

কর্নেল শান্তভাবে বললেন, তাহলে আর সেতাপগঞ্জ যাচ্ছেন না?

টিকিট–মানে বার্থ রিজার্ভেশান করে রেখেছিলাম আজ সন্ধ্যার ট্রেনে। এখন ক্যান্সেল করা ছাড়া উপায় কী বলুন স্যার? কৃতান্তবাবুর কণ্ঠস্বরে এবার হতাশা ফুটে উঠল।

পুলিশ নিশ্চয় কোনো ডেফিনিট ক্লু পেয়েছে।

 হাতি! হাতি!

 সম্ভবত হাতি নয় মিঃ হালদার, একটা সিগারেট লাইটার।

 খি খি খি!

মিঃ হালদার, আপনি সেতাপগঞ্জ চলে যান।

অ্যাঁ?

 টিকিট ক্যান্সেল করবেন না। চলে যান।

 গিয়ে আর লাভ কী!

 আছে। আপনি কি ভূতপ্রেত পিশাচ তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করেন মিঃ হালদার?

 অ্যাঁ?

বসন্তনিবাসে–মৃগাঙ্কবাবুর শ্বশুরবাড়ির বাগানে একটা পাথরের মূর্তি আছে। রাতে সেটা জ্যান্ত হয়ে চলাফেরা করে। হাতে ড্যাগার থাকে।

খি খি খি! যাঃ!

সিরিয়াসলি বলছি, মিঃ হালদার। মৃগাঙ্কবাবুর বড় শালীর শরীরে দেবীর ভর হয়। ভরের সময় অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলে। তার ভেতর অনেক ক্লু পেতে পারেন।

আর ক্লুর কী দরকার? পুলিশ তো কেসের বারোটা বাজিয়ে দিল স্যার!

 আপনি কলকাতা পুলিশের বারোটা বাজান।

 প্রব্লেমটা বুঝতে পারছেন না স্যার? মিনিস্টারের

বিহার পুলিশের হাতে ক্লু তুলে দিয়ে কলকাতা পুলিশের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ুন আপনি!

খি খি খি! স্টেট ভার্সেস স্টেট!

একজ্যাক্টলি।

একমিনিট স্যার! নোট করে নিই। কী যেন বলছিলেন বসন্ত নিবাসে পাথরের মূর্তি-টুর্তি?

কর্নেল রিপিট করলেন।

একটু পরে ফোন রেখে কর্নেল হাসতে হাসতে ছাদের সিঁড়ির দিকে পা। বাড়ালেন। সেই সময় ষষ্ঠী পিছু ডেকে বলল, বাবামশাই, এক ভদ্রলোককে বসিয়ে রেখেছি সিটিং রুমে।

কর্নেল ঘুরলেন। কে ভদ্রলোক?

 রোগা করে ফর্সা করে। এটুখানি দাড়ি আছে। গায়ে নাল গেঞ্জি পরনে—

 লেজ নেই?

ষষ্ঠী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, তা তো দেখিনি! বলেই জিভ কাটল। ও! ন্যাজ বললেন। হি হি হি!

হতভাগা, তোকে হাজারবার বলেছি–আগে নামটা জেনে নিবি।

আজ্ঞে, ভুল হয়েছে। জেনে আসছি।

তার কাধ ধরে আটকে কর্নেল বললেন, কফি নিয়ে আয়। তারপর ড্রইং রুমের বাইরের দিকের দরজার পর্দা তুলে উঁকি মারলেন, আসুন সুব্রতবাবু!

সুব্রত সিংহরায় উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। কিন্তু কোনো কথা না বলে নমস্কার করে সে ড্রইংরুমে ঢুকল।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, বসুন সুব্রতবাবু!

 আপনি আমাকে চেনেন?

 আপনার ছবি দেখেছি। যাই হোক, বলুন।

সুব্রত একটু ইতস্তত করে বলল, মৃগাঙ্ক আমার বন্ধু। মৃগাঙ্কের কাছে কৌশলে আপনার ঠিকানা পেয়েছি। তার পরামর্শেই আপনার কাছে চলে এলাম। বলবেন, সরাসরি পুলিশের কাছে যাইনি কেন–যাইনি, তার কারণ পুলিশের ওপর আমার আস্থা নেই।

হু–বলুন।

হিমাদ্রির ছবি বেরিয়েছে আজকের কাগজে। কাজেই মৃগাঙ্কের বউকে হিমাদ্রিই খুন করেছে বসে সাব্যস্ত করেছে পুলিশ। কিন্তু আমার ধারণা, খামোকা ও বেচারাকে জড়ানো হয়েছে।

কেন এ ধারণা, সুব্রতবাবু?

এগারো জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ আমি মৃগাঙ্কের ফ্ল্যাটে যাচ্ছিলাম। লেকভিলার সামনে পৌঁছে দেখি, লোডশেডিং। সিঁড়ি ভেঙে ওঠা আমার পক্ষে ডিফিকাল্ট। তাই গাড়িতে বসে ভাবছি কী করব। হঠাৎ

এক মিনিট। আপনি জানতেন মৃগাঙ্কবাবু কলকাতায় নেই ওই দিন?

সুব্রত অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, জানতাম।

 বেশ। বলুন।

তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। গাড়িতে বসে আছি। হঠাৎ আমার গাড়ির পেছনে একটা গাড়ি এসে থামল। নিছক খেয়ালে ঘুরে দেখি, সেই গাড়ি থেকে হিমাদ্রি বেরুচ্ছে। ফ্র্যাংকলি বলছি কর্নেল, আমি খুব খাপ্পা হয়েছিলাম বিশেষ করে ঊর্মির ওপর। ঊর্মিই ফোনে ডেকেছিল আমাকে। ভাবলাম, যেভাবে হোক কষ্ট করে সিঁড়ি বেয়ে সাততলায় উঠে ঊর্মির সঙ্গে একটা ভালরকম বোঝাপড়া করব। হিমাদ্রিও জানবে, ঊর্মি আসলে একটা প্রস। এ পার্ভাটেড অ্যানিম্যাল। সুব্রত সংযত হল। ক্ষমা করবেন।

তারপর কী হল বলুন?

কিন্তু আমার হার্টের অবস্থা ভাল নয়। শেষ পর্যন্ত রিস্ক আর নিলাম না। হিমাদ্রির ফেরার অপেক্ষায় থাকলাম। ভাবলাম ও ফিরে এলে ওকে ঊর্মির লীলাখেলার কথা ফাঁস করে দেব।

আপনি অপেক্ষা করলেন?

হ্যাঁ। তারপর জাস্ট আধঘণ্টা পরে–একটু বেশিও হতে পারে, আমি ঘড়ি দেখিনি–মনের অবস্থা সাংঘাতিক ছিল তখন হঠাৎ দেখলাম একটা লোক জোরে বেরিয়ে আসছে গেটের দিকে। অন্ধকারে ওকে প্রথমে হিমাদ্রি বলেই মনে করলাম। কারণ সে হিমাদ্রির গাড়ির সামনে এল। একটানে বনেট খুলেই আবার নামিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ বাড়িয়ে ডাকলাম, হিমাদ্রি! আশ্চর্য, লোকটা থমকে দাঁড়াল। তারপর হনহন করে চলে গেল রাস্তা পেরিয়ে। তখন বৃষ্টিটা বেশ জোরে পড়ছে। আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, কেনই বা হিমাদ্রি গাড়ির

হুঁ–তারপর?

 পনের-কুড়ি মিনিট পরে আগের লোকটার মতোই আরেকটা লোক গেট পেরিয়ে এল। সে হিমাদ্রি। গাড়িতে ঢুকলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেটুকু আলো জ্বলল, তাতে অস্পষ্টভাবে ওকে চিনতে পারলাম। বৃষ্টির জন্য আমার গাড়ির কাঁচ ওঠানো ছিল। তবু হিমাদ্রিরই গাড়ি ওটা–তাছাড়া তার ফিজিক্যাল আউটলাইন আমার চেনা। আমি কাঁচ নামিয়ে ওকে ডাকলাম, কিন্তু শুনতে পেল না। ওর গাড়িটা জোরে বেরিয়ে গেল আমার গাড়ির পাশ দিয়ে। মাথায় জেদ চাপল তখন। ওর গাড়ি ফলো করলাম। কিন্তু বড় রাস্তায় পৌঁছে জ্যামে আটকে। ওকে মিস করলাম। বাড়ি পৌঁছে ওকে ফোন করেছিলাম। লাইন পেলাম না।

বেশ। আপনার বক্তব্য কী তাহলে?

মৃগাঙ্কের অফিসে গিয়েছিলাম কাল। ওর কাছে শুনলাম, পুলিশ হিমাদ্রির গাড়িতে ইঞ্জিনের কাছে রক্তমাখা ড্যাগার পেয়েছে। কথায়-কথায় মৃগাঙ্ক বলল, হিমাদ্রির বাঁচার উপায় নেই। একজন খুব নামকরা ডিটেকটিভ নেমেছেন পুলিশের সঙ্গে। জিগ্যেস করে আপনার কথা জানলাম। আমার কারখানায় লেবার-ট্রাবল চলেছে। সেই ব্যাপারে কিছু ইনফরমেশন দরকার। মৃগাঙ্ক তাই শুনে প্রথমে কে এক কে কে হালদারের কথা বলল–গণেশ এভেনিউতে অফিস। আমি ওর কাছে আপনার ঠিকানা চাইলাম। বললাম, হালদার-টালদার দিয়ে হবে না। আরও ঝানু লোক চাই। তখন আপনার ঠিকানা দিল।

কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেল। বললেন, নিন সুব্রতবাবু।

সুব্রত কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, সেই লোকটাই মার্ডারার। তাকেই আমি হিমাদ্রির গাড়ির ভেতর মার্ডার উইপন রাখতে দেখেছিলাম।

তাকে চিনতে পারেননি তো?

না। ওর পরনে রেনকোট ছিল। ফিজিক্যাল আউটলাইনও অন্ধকারে আঁচ করতে পারিনি। তাতে বৃষ্টি। লোডশেডিংয়ে সারা এলাকা অন্ধকার। আশেপাশে দোকানপাট থাকলে আলো থাকত। দেখেছেন তো রাস্তাটা কেমন নির্জন–আর। বস্তি-টক্তিও আছে।

মৃগাঙ্কবাবু নন তো?

সুব্রত একটু চমকে উঠল। তারপর একটু হাসল। ও খুব কোল্ডব্লাডেড লোক। বউকে খুন করা ওর পক্ষে অসম্ভব হয়তো নয়। কিন্তু ও সে দিন বোম্বেতে ছিল। আমি জানি, আবুধাবিতে মাল পাঠানোর জন্য কার্গো বুক করে রেখেছিল। কন্ট্রাক্টের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছিল। বন্দর ধর্মঘটের জন্য কার্গো পাচ্ছিল না। প্রায় তিন লক্ষ টাকার ডিল। কাজেই ওর মতো অর্থলোভী লোকের পক্ষে ওই প্রব্লেম ছেড়ে বউয়ের জন্য কলকাতায় পড়ে থাকা সম্ভব ছিল না।

আপনি ওঁর অফিসের লোকেদের চেনেন?

 কাউকে কাউকে চিনি।

 হেমন্ত নামে কাউকে?

চিনি। মৃগাঙ্কের খুব বিশ্বাসী লোক। ওর কনসার্নের রিপ্রেজেন্টেটিভ। কেন বলুন তো?

হেমন্তবাবুকে তো মৃগাঙ্কবাবু নানা জায়গায় পাঠান?

 হ্যাঁ। ওর ওটাই কাজ।

সুব্রতের মুখে প্রশ্নচিহ্ন রয়ে গেল। কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। আপনি আপাতত পুলিশকে কিছু বলবেন না। অন্য কাউকে তো নয়ই। দরকার হলে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

সুব্রত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, পুলিশের ওপর আমার আস্থা নেই। অথচ হিমাদ্রি বেচারাকে বাঁচানো কর্তব্য। তাই আপনার কাছেই এসেছিলাম। বেশ বুঝতে পেরেছি, বোকা পেয়ে ওকে ট্র্যাপ করা হয়েছে।

কর্নেল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে বললেন, হিমাদ্রিবাবু কোথায় এখন?

হাসল সুব্রত। বিশ্বাস করুন, জানি না। ভয় পেয়ে একেবারে গা ঢাকা দিয়েছে।…

সুব্রত সিংহরায় চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরে এলেন ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী। তখন কর্নেল সবে ব্রেকফাস্ট সেরে চুরুট ধরিয়ে এদিনকার কাগজে চোখ বুলোচ্ছেন। হিমাদ্রির ছবিতে চোখ আটকে গেছে।

অরিজিৎ বসেই হাসতে হাসতে বললেন, ভাবতে পারিনি আপনিও শেষে রাম গোয়েন্দার পাল্লায় পড়বেন!

রাম নামে কোনো গোয়েন্দার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই ডার্লিং!

কে কে হালদারকে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের লোকেরা রাম গোয়েন্দা বলে।

কর্নেল হাসলেন। আহা, ওর পেছনে তোমরা লেগো না! লোকটি বড় ভালো। অনেস্ট, সিনসিয়ার। বুদ্ধিসুদ্ধিও আছে। তুমি জানো? মাকড়দহের ফার্মে একটা রহস্যময় মার্ডার কেসে

ওঃ! সে গল্প হালদার মশাই ইতিমধ্যে তিনশোবার শুনিয়েছেন। অবশ্য আপনার ভার্সান তার বিপরীত হবেই। অরিজিৎ অ্যাটাচি খুললেন। কিন্তু হাতে সময় কম। এই নিন আপনার সেই টেলিগ্রাম। পোস্ট অফিসের লোকেরাও দেখলাম রাম গোয়েন্দার কথা বলে হাসাহাসি করছে। ওদের খুব ভুগিয়েছেন কে কে হালদার। আপনিও যে কেন ওঁর পাল্লায় পড়তে গেলেন! দেখবেন আপনার কী অবস্থা করে ছাড়ে।

টেলিগ্রামের কপিটা নিয়ে চোখ রাখলেন কর্নেল। REACHED TIMELY (.) CARGO NOT AVAILABLE (.) ADVISE (.) HEMANTA HOTEL DELIGHT BOMBAY (.) স্থানীয় পোস্ট অফিসে পৌঁছুনোর তারিখ দেখে কর্নেল অবাক হলেন। এগারো জুলাই রাত নটা। ডেলিভারি হয়েছে পরদিন সকালে। সম্ভবত অফিস খোলার পর। বোম্বের পোস্ট অফিসে টেলিগ্রামটা দেওয়া হয়েছে এগারো জুলাই তারিখেই। জরুরি টেলিগ্রাম। আর সে দিনই সন্ধ্যায় খুন হয়েছে ঊর্মি।

কর্নেল মুখ তুললেন। চোখে চোখ পড়লে অরিজিৎ একটু হেসে বললেন, গোলমেলে মনে হচ্ছে তো? আমারও হয়েছিল। হেমন্ত বোসকে মৃগাঙ্কবাবু বোম্বে পাঠিয়ে কার্গোর জন্য তদ্বির করতে বলেছিলেন। হেমন্তবাবু যান ন তারিখে। দুদিন অপেক্ষা করার পর পোর্টস্ট্রাইকের ঝামেলায় কার্গোর ব্যবস্থা না করতে পেরে এই টেলিগ্রাটা করেন। এদিকে মৃগাঙ্কবাবু অধৈর্য হয়ে টেলিগ্রাম পাবার আগেই এগারো তারিখ রওনা হন। তাই এই গণ্ডগোল।

মৃগাঙ্কবাবুর ভার্সান?

 দুজনেরই–মানে, হেমন্তবাবুরও।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ট্রাঙ্ককল করেননি হেমন্তবাবু! টেলিগ্রাম কেন?

লাইন পাননি। ন থেকে বারো–এই চারদিন বোম্বে ক্যালকাটা লাইন ডিসটার্বড় ছিল। আমরা হটলাইনে মৃগাঙ্কবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম।

ডিলাইটে হোটেলে?

হোটেল ডিলাইটে।

অরিজিৎ মুখ টিপে হাসছিলেন। ষষ্ঠী কফি রেখে গেল যথারীতি। কর্নেল কফির পেয়ালা ওঁর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, হেমন্তবাবু বোম্বে থেকে কবে ফিরেছিলেন?

বারো জুলাই, মৃগাঙ্কবাবুর সঙ্গে।

 মৃগাঙ্কবাবুর প্লেনের টিকিট তো দেখেছ বলছিলে। যাওয়া এবং ফিরে আসার।

 হ্যাঁ। আমার কাছে এখনও রয়ে গেছে। দেখবেন নাকি?

 নেব।

অরিজিৎ তেমনি মুখ টিপে হেসে অ্যাটাচি থেকে টিকিট দুটো বের করে দিলেন। তারপর বললেন, অবশ্য হেমন্তবাবুর টিকিট পাইনি। পাওয়ার কথাও না। ও সব কে রেখে দেয়?

 কিন্তু মৃগাঙ্কবাবু রেখে দিয়েছিলেন!

খুব স্বাভাবিক। ওঁর অ্যালিবাই দরকার ছিল। বুদ্ধিমান লোক। অরিজিৎ ঘন ঘন চুমুক দিয়ে কফি শেষ করে ফের বললেন, কর্নেল আপনাকে পরামর্শ দেওয়া ধৃষ্টতা। কিন্তু প্লিজ আপনি হালদার মশাইকে ছাড়ুন। আমার ধারণা, উনি এস্টাব্লিন্ড অ্যান্ড সেট একটা কেসকে ঘুলিয়ে দেওয়ার তালে আছেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিকে সে জন্যই লাইসেন্স দিতে আজকাল ভীষণ কড়াকড়ি করা হয়। কে বলতে পারে, হালদার মশাই আসামীর কাছে টাকা খেয়ে কাজে নেমেছেন কি না? আমি তো স্পষ্ট দেখছি, ভদ্রলোক আপনাকে মিসগাইড করার চেষ্টা করছেন।..

অরিজিৎ চলে গেলে টেলিগ্রামের কপিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন কর্নেল। একটু পরে হলদে কাগজে ফুটে উঠল একটা দশতলা বাড়ি। গেটে লেখা আছে লেকভিলা। অন্ধকার সন্ধ্যাবেলায় ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। সুব্রত সিংহরায় নিয়ে গাড়িতে বসে আছে। তারপর এল হিমাদ্রির গাড়ি।

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন কর্নেল। সাততলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটের বেডরুমে হিমাদ্রি সিগারেট টানতে টানতে প্রেমালাপ করছে ঊর্মির সঙ্গে। ঘরে একটা মোম জ্বলছে। নিশ্চিন্ত নিরাপদ সময়। মৃগাঙ্ক বোম্বেতে।

ওদের প্রেমের খেলা শেষ। বর্ষাতিপরা আততায়ী দরজায় নক করল। পাশের ফ্ল্যাটে কুকুরটা গরগর করছে। আঁচড় কাটছে দরজায়। জন্তুরা সহজাত বোধেই কি সব টের পায়?

কিন্তু ঊর্মি কেন দরজা খুলতে গেল? তার হাতে মোমবাতিটা দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয় চেনা লোক দরজায় নক করছে। দরজা খুলতেই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় আততায়ী তার মুখ চেপে ধরে মুহূর্তেই শ্বাসনালী কেটে দিল। তারপর বেরিয়ে গেল। নিচের ফুটপাতে তাকে দেখতে পেয়েছে সুব্রত সিংহরায়। আততায়ী হিমাদ্রির গাড়ির বনেট খুলে ছুরিটা রেখে দিল। রক্তাক্ত হাতটা ঘসে দিয়ে চলে গেল রাস্তা পেরিয়ে।

হিমাদ্রির চোখের সামনে ঘটেছে ওই অতর্কিত ঘটনা। আতঙ্কে সে লাইটারটার কথা ভুলে গেছে। পালিয়ে আসছে দিশেহারা হয়ে। সুব্রত সিংহরায়ের ডাক শোনার মতো কান তার নেই তখন। বৃষ্টিও ঝমঝম করে পড়ছে। হুঁ..হিমাদ্রিকে অনুসরণ করে এসেছিল আততায়ী। কিন্তু কে সে?

কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোনের ডায়াল করতে থাকলেন। … মৃগাঙ্ক ব্যানার্জিকে চাইছি।

মহিলা অপারেটার বলল, উনি বাইরে গেছেন।

 তাহলে মিঃ হেমন্ত বোসকে দিন।

 উনিও বাইরে।…।