সীমান্ত কাহিনী
এই পাহাড়ের আড়ালেই একটা অন্যদেশ
সে কথা কি ঐ পাহাড় জানে?
জঙ্গল ছিড়ে খুঁড়ে নেমে এসেছে এক পাগলা ঝোরা
সমতলে গিয়ে সে নদী হবে
তারও ঠিক মাঝখান দিয়ে ভাগ হয়ে গেছে
দুদেশের সীমানা
পাগলা নদীটি তা কিছুই জানে না
গাছগুলি পরস্পরের প্রতি স্পর্ধা করে উঠে যায় আকাশের দিকে
তারা মাধ্যাকর্ষণ মানে না
তারা সীমান্তরক্ষীদেরও চেনে না
একটা অন্ধকার খেলা করে আলোর মধ্যে
আর অন্ধকারকে ধরে রাখে এক বিন্দু আলো
একটা বাতাস পাখিদের নিয়ে যায়
একটা পাখি ঝড়কে সঙ্গে করে আনে…
নদীতে ভাসে তৃণখণ্ড, ডালপালা, কাঁটা ঝোপের ফুল
পাশ দিয়ে হেঁটে আসে মানুষ
রোগা মানুষ, ন্যুজ মানুষ, শিশু মানুষ, শিশুর জন্মদাত্রী মানুষ
হাঁটু ভাঙা মানুষ, চামড়ায় শ্যাওলা জমা মানুষ
নীরব, সন্ত্রস্ত, উদরে খিদের মশাল-জ্বলা মানুষ
তাদের মাথার ওপরে ইতিহাসের বাতাস
তাদের পায়ে পায়ে প্রাগৈতিহাসিক যাযাবরদের
পথভ্রান্ত ভুলছন্দ
তারা পিছনে তাকায়, তারা সামনে দেখতে পায় না
তাদের অতীত ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে
তাদের ভবিষ্যৎ নেই
বৃক্ষগুলি স্থির, বাতাস এখন বন্ধ,
মাটিতে কোনো আভা নেই, আকাশে নেই দ্যুতি
এরই মধ্যে দিয়ে আসছে কালো কালো রেখা ও বিন্দুর মতন মানুষ
মানুষের কাছে পরাজিত মানুষ
পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে ছন্নছাড়ার দল
এক সময় তারা অবসন্ন হয়ে থামে
ত্যাড়াবেঁকা পুতুলের মতন ঘুমিয়ে পড়ে…
যেখানে শুন্যতা ছিল, সেখানে গড়ে ওঠে বসতি
সেখানে রাত্রিগুলি দিন হয়, দিন থেকে রাত
সেখানে জন্ম-মৃত্যু ছেলেমানুষের মতো
হঠাৎ হঠাৎ আসে যায়
সেখানে হাসির মধ্যে খেলে যায় কান্নার বাতাস
কান্নার মধ্যে মিশে যায় হাসির জলপ্রপাত
সেখানে খুদকুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় পরমান্ন
সেখানে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে শিশু মহানন্দে পান করে
শুন্যের বদলে ধুলো মাখানো স্নেহ
তারই মধ্যে এক একদিন কন কাঁপিয়ে আসে বনের রাজা
কুঠার হাতে আসে কাঠ ব্যবসায়ীরা
রাইফেল হাতে নিয়ে আসে মানুষ শিকারি দল
ট্রাক বোঝাই করে কেউ কেউ নিতে আসে যাবতীয় মূল্যবোধ
বিদ্যুৎ তরঙ্গে কথা চালাচালি হয় এদেশ থেকে ওদেশে
প্রকৃতি বিশেষজ্ঞদের মাথাব্যথার কাহিনী ছাপা হয়
সচিত্র, নানা রকম ভাষার খবরের কাগজে
রাজনীতির রঙ্গকর্মীরা উচ্চাসনে উঠে গলা ফাটান
কেউ কেউ সন্ধের দিকে চুপি চুপি আসেন
গণতন্ত্রকে আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কাগজের বেলুন বানাবার জন্য
আবার এইসব কাগজপত্র ছিঁড়ে খুঁড়ে কিছু কিছু নারী
চলে যায় মরুভূমির দেশে
একাধিক রাজধানীতে দাবি ও প্রতিবাদ লোফালুফি হয়
হঠাৎ ছুটে আসে ঘূর্ণিঝড় কিংবা বন্যার ঢল
শকুনের মতন মাথার ওপর ঘুরতে থাকে আকাল
কিংবা সবার অজান্তে এসে পড়ে বুনো হাতির পাল
তাদের সারল্যমাখা মুখে কোনো হিংসে নেই
তাদের বাৎসরিক পথ খুঁজে নেওয়া পায়ে কোনো ধ্বংসসাধ নেই
তবু সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে তারা দূরান্তে মিশে যায়…
নদীর ধারে পড়ে আছে দুএকটা ছেড়া কাঁথা ভাঙা
শানকি, তোবড়ানো টিনের গেলাস, খুঁটি বাঁধার দড়ি
আর কেউ নেই
শুন্যতাকে গ্রাস করেছে শূন্যতা, ঝিমঝিম করছে স্তব্ধতা
গাছ থেকে খসে পড়ে পাতা, শিকড়গুলি নামে আরও গভীরে
অরণ্য জেগে আছে অরণ্যের নিয়মে
পাগলা ঝোরার জলে শুধু প্রতিবিম্বিত হয়ে আছে
একটা আলো, একটা অলৌকিক আগুনের ছায়া
মানুষের উদরের খিদের মশাল…