।। আট।।
ঘটাং ঘট। জোর শব্দ করে দরজা খুলে গেল।
জন পাঁচ-ছয় কথা বলতে বলতে ভিতরে ঢুকল। মেঘা আছে, সঙ্গে একজন কালো বেঁটে চেহারার লোক, বোধহয় সেই লোকটাই সর্দার। ঘুম-চোখে মোহন তাদের দেখল।
ভোরের দিকে সে স্বপ্ন দেখছিল, তাকে সাপে কামড়েছে। আর বেঁচে নেই।
সেই সর্দার গোছের লোকটা বলল, আমরা যে সময় দিয়েছিলাম, সেটা তিন দিন হল পার হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে ছেলেটার বাপের টাকা দেবার কোনও ইচ্ছা নেই। সেই টিকটিকিটা বোধহয় বুঝিয়েছে যে, টাকা দেবার দরকার নেই। আমাদের শায়েস্তা করে দেবে। ব্যাস, আর আমাদের অপেক্ষা করার দরকার নেই। সেই টিকটিকিটা আমাদের কম হয়রানি করেনি। দুবার আমাদের আস্তানা বদল করিয়েছে।
সর্দার একটু থামতেই মেঘা বলল, শয়তান ছেলেটা কাল রাতে আমার মায়ের গলা টিপে অজ্ঞান করে দিয়ে পালিয়েছিল। কিন্তু আমাদের হাত থেকে যাবে কোথায়? ধরে আনা হয়েছে।
সর্দার রক্তচক্ষু মেলে মোহনের দিকে একবার দেখল। তারপর বলল, হুঁ, একেবারে বিচ্ছু। ওখানেও একবার দারোয়ানের মাথায় লোহার ডান্ডা মেরে পালাবার চেষ্টা করেছিল। যাক, আর পালাতে হবে না।
আজই তাহলে সব ঠিক করে ফেলবে?
মেঘার কথার উত্তরে সর্দার বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর ফেলে রাখছি না। তুই সব ঠিক করে রাখ। দুপুরের দিকে আমরা কাজ শেষ করব।
বাইরে গোটাকয়েক কাক ডেকে উঠল। ভোর হয়ে আসছে।
এখানকার দলের আর সবাইকে জড়ো হতে বলেছিস?
হ্যাঁ সর্দার। সবাই আসবে।
ঠিক আছে। সর্দার বেরিয়ে যেতে গিয়েই হঠাৎ থেমে গেল।
জয় মা চণ্ডেশ্বরী, মা মা মা! বাইরে অদূরে বিকট কণ্ঠস্বর। আশপাশের গাছপালা পর্যন্ত যেন কেঁপে উঠল।
সর্দার জিজ্ঞেস করল, ও কে?
কী জানি, বুঝতে পারছি না।
অদূরে ঝোপের ভিতর একটা ভাঙা মন্দির প্রায় ঢাকা অবস্থায় পড়ে আছে। ভিতরে শুধু একটা মূর্তি দেখা যায়, কালীমূর্তিই হবে, তবে রংটা কালো নয়, হলুদ।
এ মন্দিরে অনেকদিন কেউ আসে না। সাপখোপের আস্তানা হয়েছে।
মূর্তির ঠিক সামনে লাল রঙের কাপড়-পরা এক সন্ন্যাসী। মাথায় সাদা ধবধবে চুল জটার আকারে পিঠে নেমেছে। বুক পর্যন্ত বকের পালকের মতন সাদা দাড়ি। দুটো হাত কোলের ওপর। চোখ বোজা। মুখে অবিরাম ডাক—মা মা মা!
সর্দারকে নিয়ে মেঘা আর তার সঙ্গীরা একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।
সর্দার প্রশ্ন করল, এ আবার কে?
মেঘা উত্তর দিল, কী জানি, আগে তো কোনওদিন সাধুসন্ন্যাসী এ মন্দিরে দেখিনি। বহুদিন এ মন্দির জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে।
বেশ জবরদস্ত সন্ন্যাসী। কিন্তু দেখলে ভক্তি হয়। চল, গিয়ে বসি।
সবাই এগিয়ে গিয়ে মন্দিরের চাতালে বসল।
সর্দার ঢিপ করে প্রণাম করে বলল, পেন্নাম হই সাধুবাবা।
সন্ন্যাসী চোখ খুলল। মুখ ঘুরিয়ে এদের দিকে দেখে বলল, কল্যাণ হোক বাবা তোমাদের। কাজে জয়লাভ হোক। সব বাধা দূরে সরে যাক।
সর্দারের দেখাদেখি বাকি সবাই সোজা হয়ে শুয়ে প্রণাম করল।
একটা ভিক্ষে আছে বাবা! সর্দার হাত জোড় করে বলল।
কী বলো? আমি হিমালয়ে তপস্যা করছিলাম। হঠাৎ বাঘছাল কেঁপে উঠল। বার বার তিনবার। তখনই বুঝতে পারলাম কারো বিপদ হয়েছে। আমাকে নেমে আসতে হবে। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ এই মন্দির আমার খুব ভালো লাগল। চণ্ডেশ্বরীর মন্দির। বহু বছরের পুরোনো, একেবারে জাগ্রত দেবী। কিন্তু অনেক দিনের অযত্নে মায়ের এই অবস্থা। এই চণ্ডেশ্বরী মায়ের পা ছুঁয়ে বিশে ডাকাত, নিমে ডাকাত রোজ ডাকাতি করতে যেত। তাদের গায়ে কোনওদিন পুলিশের গুলি লাগত না।
সর্দার বলল, আপনি আমাদের জন্যও মায়ের পুজোর আয়োজন করুন বাবা। যা দরকার হয় এনে দেব।
ঠিক আছে, আয়োজন করো। আমি বেলা দশটা থেকে পুজোয় বসব।
সবাই উঠে দাঁড়াল। সর্দারের কথামতো এক-একজন এক-একদিকে ছুটল।
সন্ন্যাসী আসন ছাড়ল না। মাঝে মাঝে শুধু সিংহের মতো গর্জন করতে লাগল। মা চণ্ডেশ্বরী, এতদিন ঘুমিয়ে আছিস। এবার জাগ মা!
ন-টা বাজতে-না বাজতে মন্দিরের চাতাল লোকে ভরে গেল। নানা রকমের ফল এল, ফুল এল, বেলপাতা এল। লোকেরা পুজোর ফল কাটতে বসল।
উঠোনে কুচকুচে কালো একটা ছাগলের বাচ্চা এনে বাঁধা হল।
ওদিকে মোহন ঘরে একলা বন্দি। সবাই ব্যস্ত থাকায় তাকে খেতে দেবার কথা বোধহয় কারো মনে নেই। কিংবা তার শাস্তি হিসাবেই হয়তো খাওয়া বন্ধ। সে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।
বিষের জ্বালা তো আছেই, তা ছাড়া সমস্ত শরীর ফুলে ফুলে উঠেছে। কাঁটাগাছগুলো বোধহয় বিষাক্ত ছিল। অনেক জায়গা পেকে উঠেছে।
মাঝে মাঝে কানে সন্ন্যাসীর হুংকার আসছে। বাইরে অনেকগুলো লোকের গলার শব্দ, পায়ের আওয়াজ। কিন্তু দেখবার কোনও উপায় নেই।
মোহন পায়চারি থামিয়ে আবার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল।
প্রায় দশটা নাগাদ সন্ন্যাসী ইশারায় সর্দারকে ডাকল।
সর্দার কাছেই ছিল, একেবারে সন্ন্যাসীর পাশে গিয়ে বসল।
সন্ন্যাসী বলল, তোকে একটা কথা তখন বলতে ভুলে গিয়েছি।
বলুন বাবা!
কথাটা একটু গোপনীয়।
আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।
বলির জন্য তো ওই পাঁঠা এনেছিস?
হ্যাঁ বাবা। মায়ের পুজোয় কালো পাঁঠাই তো লাগে।
সেসব ঠিক আছে, কিন্তু মায়ের একটা আদেশ হয়েছে।
মায়ের আদেশ?
হ্যাঁ, ধ্যানে বসে সেই আদেশ পেলাম।
কী বলুন!
অনেকদিন মায়ের তেষ্টা মেটেনি। পাঁঠায় হবে না।
তাহলে কাল মোষ নিয়ে আসব।
উঁহু। সন্ন্যাসী মাথা নাড়ল।
তবে?
মায়ের মানুষের রক্ত প্রয়োজন।
মানুষের রক্ত?
এবার সর্দার একটু পিছিয়ে গেল। মানুষ জোগাড় করার হাঙ্গামা অনেক। তা ছাড়া হাতে তো বেশি সময়ও নেই।
আরও কথা আছে। সন্ন্যাসী আবার মাথাটা সর্দারের দিকে হেলিয়ে দিল। এমন ছোকরা জোগাড় করতে হবে যার বয়স পনেরোর বেশি নয়।
তার মানে, কচি ছেলে?
হ্যাঁ।
সর্দার বলল, আমার দলের সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি।
সর্দার নেমে এসে দলের মধ্যে দাঁড়াল। বাছা বাছা কয়েকজনকে কাছে ডাকল। সবাই চুপচাপ।
একজন বলল, এত অল্প সময়ের মধ্যে ছেলে জোগাড় করা মুশকিল।
ছেলে তো অনেক রয়েছে সর্দার, কিন্তু সব তো কানা, খোঁড়া কিংবা নুলো। মায়ের পুজোয় তো এসব লাগবে না।
ডঁzহু, ওসব চলবে না। তা ছাড়া, এত অল্প সময়ে ওদের পাচ্ছিস কোথায়?
মেঘা কাছেই ছিল। সে এসে বলল, সর্দার, হয়ে গেছে।
সবাই চমকে উঠল।
সর্দার খিঁচিয়ে উঠল, কী আবার হয়ে গেল?
ছেলের খোঁজ মিলেছে।
মিলেছে? কোথায় পেলি?
কেন, ঘরের মধ্যে যে ছোকরা বন্দি রয়েছে!
সর্দার মেঘার পিঠে একটা হাত রেখে বলল, শাবাশ মেঘা, কথাটা আমার একেবারেই মনে ছিল না। ও আপদ খতম হয়ে যাওয়াই ভালো। আমাদের অনেক ভুগিয়েছে। দাঁড়া, বাবাকে বলে আসি।
সর্দার সন্ন্যাসীর কাছে ফিরে এসে বলল, বাবা, পাওয়া গেছে।
আনন্দে সন্ন্যাসী উৎফুল্ল হয়ে উঠল, সবই মায়ের ইচ্ছা। কোথায় পাওয়া গেল?
কাছেপিঠেই ছিল।
অক্ষত দেহ তো? কানা-খোঁড়া নয়?
আজ্ঞে না।
জয় মা চণ্ডেশ্বরী। মা মা মা! সন্ন্যাসী লম্বা হয়ে শুয়ে প্রণাম করল। দেখাদেখি আর সবাই।
এবার যে একটা কাজ করতে হবে! সন্ন্যাসী আবার সর্দারের দিকে ফিরল।
বলুন বাবা!
ছেলেটাকে স্নান করিয়ে নিয়ে আয় এখানে।
সর্দার মেঘাকে আদেশ দিল।
মিনিট কুড়ির মধ্যে মেঘা মোহনকে পানাপুকুরে চুবিয়ে নিয়ে এল। মোহন শীতে নয়, ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।
সন্ন্যাসী আড়চোখে একবার মোহনের দিকে দেখে বলল, ওরে এটাকে মুছিয়ে দে। এসব খুলে একটা কাপড় পরিয়ে নিয়ে আয়।
মেঘা মোহনকে মুছিয়ে একটা ধুতি পরিয়ে নিয়ে এল।
বসিয়ে দে আমার পাশে।
মোহনকে সন্ন্যাসীর পাশে বসানো হল। আর-একপাশে সর্দার। মোহনের আশপাশে সবাই ঘিরে বসল। অবশ্য এত লোকের মাঝখান দিয়ে পালানো সম্ভব নয়, তবু সাবধানের মার নেই।
মোহনের কপালে সন্ন্যাসী সিঁদুরের টিপ দিল। গলায় জবা ফুলের মালা।
সব কালীপূজা রাত্রে হয়, চণ্ডেশ্বরীপূজা হয় দিনে। তাই বুঝি দেবীর গায়ের রং কালো নয়।
স্নান করিয়ে নিয়ে আসবার সময় মোহন উঠানে হাড়িকাঠ দেখতে পেয়েছিল।
সামনে দেবীমূর্তি। সন্ন্যাসী পূজা করছে। তাকে এভাবে স্নান করিয়ে আনা হল, এসবের মানে বুঝতে তার একটুও দেরি হল না। আর নিস্তার নেই। আজই সব শেষ। মোহন ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল।
সর্দার ধমক দিল, চুপ কর। পুজোর সময় যত ঝামেলা বাধাচ্ছে।
সন্ন্যাসী বাধা দিয়ে বলল, আরে কাঁদুক কাঁদুক, এই তো শেষ কান্না। কেঁদে নিক।
দশটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পুজো আরম্ভ হল। সন্ন্যাসী আসনের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করতে আরম্ভ করল। কিছুক্ষণ পর মূর্তির দিকে জবা ফুল ছুড়ে দিল। তারপর আসনে বসে মোহনকে জিজ্ঞেস করল, কী রে, কী নাম তোর?
মোহন তখনও ফোঁপাচ্ছে। সন্ন্যাসী চেঁচিয়ে উঠল, কান্না থামা। নাম কী বল?
ফোঁপাতে ফোঁপাতে মোহন বলল, মোহন সরকার।
বাপের নাম?
অভয় সরকার।
কত বয়স?
তেরো।
ঠিক আছে।
আবার মন্ত্র পড়া শুরু হল।
সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে উঠে বলল, তাহলে বলিটা সেরে ফেলা যাক।
সর্দার এগিয়ে মোহনের কাছে এসে দাঁড়াল।
সন্ন্যাসী বলল, দাঁড়া, আগে ওকে পিছমোড়া করে বাঁধ।
একজন ছুটে গিয়ে জঙ্গল থেকে শক্ত লতা নিয়ে এসে মোহনের দুটো হাত বাঁধল।
মোহনের আর কাঁদবারও শক্তি নেই যেন। তার সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘটিতে জল নিয়ে সন্ন্যাসী হাড়িকাঠের কাছে নেমে এল।
হাড়িকাঠের ওপর জলের ফোঁটা ছিটিয়ে আবার মন্ত্রপাঠ শুরু হল।
হাড়িকাঠের কাছে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে চকচকে প্রকাণ্ড খাঁড়া।
ওরে, কেউ এটাকে বেল গাছটার সঙ্গে বাঁধ। বহুদিন বলি হয়নি, আগে হাড়িকাঠটা শোধন করে নিই। তোরা সব এগিয়ে আয়।
আশপাশের সবাই হাড়িকাঠ ঘিরে গোল হয়ে বসল।
সন্ন্যাসী একবার চারদিকে চেয়ে দেখল।
তারপর হাতের ঘটিটা হাড়িকাঠের পাশে নামিয়ে রেখে সূর্যের দিকে চোখ তুলে প্রণাম করল। প্রণাম শেষ হতে চাদরের ভিতর থেকে একটা বিউগল বের করল। সূর্যের দিকে মুখ তুলে বিউগলে ফুঁ দিল। ঠিক যুদ্ধের সময় যেমন বাজনা হয়, সেইরকম। বিউগলের শব্দে রক্ত গরম হয়ে ওঠে। তালে তালে সবাই দুলতে লাগল।
উৎসব-আনন্দে সকলে এত মেতে আছে যে ধুলো উড়িয়ে দূর থেকে বিদ্যুৎগতিতে যে কয়েকটা জিপ আসছে, সেটা কারো খেয়ালই নেই।
খেয়াল যখন হল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সমস্ত দলটাকে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। তাদের হাতে পিস্তল আর বন্দুক। সন্ন্যাসীর হাতেও একটা পিস্তল দেখা গেল। পালাবার কোনও পথ নেই।
খাঁড়া হাতে লোকটা পালাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বন্দুকের গুলি এসে তার কবজিতে লাগতেই সে চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়েছিল।
সন্ন্যাসী পরিধানের লাল কাপড় সরিয়ে ফেলল। খুলে ফেলল চুল-দাড়ি আর রুদ্রাক্ষের মালার গোছা। এবার পারিজাত বক্সীকে পরিষ্কার চেনা গেল।
একটা জিপ থেকে মোহনের বাবা নেমে এল। ততক্ষণে একজন পুলিশ মোহনের লতার বাঁধন খুলে দিয়েছে।
মোহন, আমার মোহন রে! ইস, এ কী চেহারা হয়েছে রে তোর? মোহনের বাবা ছেলেকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরল।
মোহনও কেঁদে উঠল, বাবা, বাবা! আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। আর কোনওদিন আমি এমন করে পালাব না।
.
তারপর ওই ছেলেধরা দলটার কী শাস্তি হল, অন্যান্য কানা, খোঁড়া আর নুলো ছেলেদের উদ্ধার করে কীভাবে আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটা তো তোমরা খবরের কাগজেই পড়েছ।
***