।। ছয়।।
মোহনের বাবাকে চেনা যায় না। এই ক-মাসে যেন তার বয়স বেশ কয়েক বছর বেড়ে গেছে। মুখে হিজিবিজি আঁচড়। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। কাজে তার মন নেই। কোনওরকমে দোকান খুলে বসে।
পারিজাত বক্সী সবই লক্ষ করলেন। তাঁর সামনের চেয়ারে মোহনের বাবা চুপচাপ বসে ছিল।
পারিজাত বক্সী বললেন, অভয়বাবু, আপনি অমন দমে যাবেন না। আমি বলছি, আপনার ছেলেকে ওরা মেরে ফেলেনি।
মোহনের বাবা আস্তে আস্তে মুখ তুলে করুণ গলায় বলল, প্রাণে হয়তো মারবে না, কিন্তু পঙ্গু করে দিয়েছে হয়তো। কিংবা যদি অন্ধ করে দিয়ে থাকে, তাহলেও আমার ছেলের অবস্থা ভেবে দেখুন।
কথাগুলো বলবার সময় মোহনের বাবার দু-চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ল। পারিজাত বক্সী উঠে গিয়ে মোহনের বাবার পিঠে একটা হাত রাখলেন, আপনি ওভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমি যা বলছি, তা-ই করুন।
কী বলুন? আপনি একটা চিঠি লিখে তিন মাস সময় নিন—সাত হাজার টাকা জোগাড় করতে কিছু সময় নেবে। অত টাকা হাতে নেই।
বেশ, তা-ই করব।
তা-ই করব নয়—এখনই করুন। আমি কাগজ এনে দিচ্ছি।
কাগজ-কলম এল। পারিজাত বক্সী যেমন বললেন, মোহনের বাবা ঠিক তেমনই লিখলেন। লেখা শেষ হতে পারিজাত বক্সী আবার বললেন, আপনি চলে যান হাওড়া স্টেশনে। ন-নম্বর প্ল্যাটফর্মে চিঠিটা ঘড়ির নীচে রাখবার কথা, তা-ই না?
মোহনের বাবা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
মোহনের বাবা বেরিয়ে যাবার মিনিট কুড়ি-পঁচিশ পরে এ বাড়ি থেকে একজন চীনা ভদ্রলোক বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়াল।
মাথায় টুপি। সামনের দুটো দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। পরনে টাইট কোট-প্যান্ট।
একটু পরে হাওড়া স্টেশনে ন-নম্বর প্ল্যাটফর্মের গেটের কাছে চীনা ভদ্রলোককে দেখা গেল। একটা খবরের কাগজ খুলে চোখের সামনে ধরা।
মোহনের বাবা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে পকেট থেকে চিঠিটা বের করে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আর সেখানে দাঁড়াল না।
কিছুক্ষণ কাটল।
একটা কুলি চিঠিটা তুলে নিয়ে চীনা ভদ্রলোকের সামনে দিয়ে স্টেশনের বাইরে গেল।
খবরের কাগজের আড়াল দিয়ে চীনা ভদ্রলোক তীক্ষ্ন দৃষ্টি মেলে সব দেখল।
বাইরে একটা ফেরিওয়ালা বসে ছিল। তার ডালায় বাদামভাজা।
কুলি চিঠিটা বাদামের ডালায় রেখে আবার স্টেশনের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
মিনিট পনেরো ফেরিওয়ালা চুপচাপ বসে রইল, তারপর উঠে দাঁড়াল।
এইবার চীনা ভদ্রলোক চলতে আরম্ভ করল। হাওড়া স্টেশনের বাইরে মোটর সাইকেলের ওপর একটি ছোকরা বসে ছিল। সে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়েই মোটর সাইকেল চালিয়ে দিল।
রাস্তার একপাশে কালো রঙের একটা মোটর দাঁড়িয়ে ছিল। চীনা ভদ্রলোক মোটরে উঠে মোটর চালু করল।
হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে মোটর সাইকেল ছুটল। পিছন পিছন মোটর।
এ গলি-সে গলি পেরিয়ে শহর ছাড়িয়ে শহরতলির এক পুরোনো ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে মোটর সাইকেল থামল।
আরোহী নেমে কিছুক্ষণ একটা বিরাট অশ্বত্থ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কী করল, তারপর পকেট থেকে চিঠিটা বের করে গাছের কোটরে রেখে দিল। তারপর লোকটা আবার মোটর সাইকেলে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।
চীনা ভদ্রলোক মোটর থেকে নেমে এদিক-ওদিক দেখল। তারপর এগিয়ে এসে এক ফাঁকে চিঠিটা তুলে নিল।
এটা মোহনের বাবার চিঠি, কিন্তু এ চিঠি নিতে তো কেউ আসছে না। খুব সম্ভব দিনের বেলা কেউ আসবে না। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলে এই ভাঙা বাড়ির মধ্য থেকে লোক বেরিয়ে চিঠিটা নেবে। তাহলে ততক্ষণ তাকে কাছাকাছি অপেক্ষা করতে হবে!
চীনা ভদ্রলোক ভাঁজ করা চিঠিটা খুলেই চমকে উঠল। না, এটা তো মোহনের বাবার লেখা নয়। একই রঙের কাগজ; কিন্তু লেখা আছে—টিকটিকি সাবধান। পিছু ধাওয়া করে কোনও লাভ হবে না।
আশ্চর্য, এ চিঠি কখন লিখল লোকটা?
তা ছাড়া ছদ্মবেশ ধরার ব্যাপারে পারিজাত বক্সীর খুব নাম ছিল, কিন্তু এ দলের চোখে ধুলো দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, কী লজ্জার কথা!
মোটরে উঠতে গিয়েই পারিজাত বক্সী থেমে গেলেন। গাছের নীচে সাদা রঙের কী একটা পড়ে রয়েছে।
এগিয়ে গিয়ে পারিজাত বক্সী সেটা তুলে নিলেন। রুমাল। চারধারে সবুজ বর্ডার।
সঙ্গে পুলিশের কুকুর থাকলে এই রুমালের গন্ধ শুঁকিয়ে লোকটার অনুসরণ করানো যেত। অবশ্য লোকটা এখন বহু দূর সরে পড়েছে।
রুমালটা নিয়ে পারিজাত বক্সী মোটরে উঠলেন। বড়োরাস্তায় পাশাপাশি দুটো লন্ড্রি। মোটর সামনে রেখে পারিজাত বক্সী নামলেন।
লন্ড্রির মালিক ভিতরে ছিল। পারিজাত বক্সী তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
মালিক ভ্রূ কোঁচকাল।
আমার সঙ্গে? আমার সঙ্গে কী কথা?
পারিজাত বক্সী পকেট থেকে তাঁর নাম-লেখা কার্ড বের করে মালিককে দেখালেন।
মালিক উঠে দাঁড়াল।
কী ব্যাপার স্যার, আমার দোকানে আপনি কেন? আমি তো সাদাসিধে লোক। কোনও গোলমালে থাকি না।
পারিজাত বক্সী রুমালটা বের করে মালিকের টেবিলের ওপর রাখলেন। বললেন, কোণের দাগটা দেখে বলুন তো এটা পাড়ার কোন বাড়ির রুমাল!
মালিক রুমাল তুলে নিয়ে ভালো করে দেখল। কোণে গুণ চিহ্নের মতো দাগ। একটু দেখে নিয়ে সে বলল, এ দাগ আমাদের দোকানের নয়। আপনি পাশের দোকানে খোঁজ করুন।
রুমাল তুলে নিয়ে পারিজাত বক্সী পাশের দোকানের দিকে এগোলেন। দোকানের নাম পূর্ণিমা লন্ড্রি।
একটি প্রৌঢ় বাইরে বসে আছে।
সেখানে গিয়েও নিজের নাম-লেখা কার্ড দেখিয়ে পারিজাত বক্সী রুমালটা বের করলেন।— দেখুন তো এটা কোন বাড়ির হতে পারে?
একবার চোখ বুলিয়েই প্রৌঢ় লোকটি বলল, আরে, এ তো সদাশিববাবুর বাড়ির রুমাল।
কে সদাশিববাবু?
সদাশিব পাল। চব্বিশ নম্বর বাড়ি।
আপনি চেনেন তাঁকে?
সে কী মশাই, আমার দশ বছরের খদ্দের। আমি চিনব না?
কী করেন তিনি?
ব্যাবসা আছে। তেঁতুলের ব্যবসা।
পারিজাত বক্সী আর দাঁড়ালেন না। রাস্তায় নেমে এলেন।
যেটুকু খবর পেয়েছেন লন্ড্রি থেকে, এর বেশি কিছু জোগাড় করা সম্ভব নয়।
হনহন করে এগিয়ে পারিজাত বক্সী চব্বিশ নম্বর বাড়ির সামনে পৌঁছালেন।
টিমটিম করে জ্বলছে ইলেকট্রিকের আলো। তার নীচে একটি প্রৌঢ় বিরাট খাতা খুলে কী সব হিসাবপত্র করছে।
পারিজাত বক্সীকে ঢুকতে দেখে প্রৌঢ় মুখ তুলল। কে? কী চাই আপনার?
আপনি কি সদাশিববাবু?
হ্যাঁ।
দেখুন তো এ রুমালটা কি আপনার?
আপনার মাথা খারাপ! ওইরকম বর্ডার দেওয়া রুমাল এ বয়সে আমি ব্যবহার করব? তা ছাড়া আমি রুমাল ব্যবহারই করি না।
এখানে আর কে থাকে?
কে থাকবে! আমি আর তেঁতুলের বস্তা থাকি।
আমি এ গুদামঘর সার্চ করব।
আপনি কে মশাই সার্চ করবার? আপনাকে আমি সার্চ করতে দেবই বা কেন?
ঠিক আছে। যাতে দেন সে ব্যবস্থা করছি। কথাটা বলেই, পারিজাত বক্সী সমস্যায় পড়লেন। যদি এখন তিনি সার্চের ব্যবস্থা করতে থানায় যান, তাহলে সদাশিববাবু হয়তো সেই ফাঁকে কাজ গুছিয়ে রাখবে। কিন্তু ওয়ারেন্ট ছাড়া সার্চ করাও সম্ভব নয়।
হঠাৎ পারিজাত বক্সীর খেয়াল হল। তাঁর মোটরের মধ্যে তো সব বন্দোবস্ত রয়েছে। সেখান থেকে কাছের থানায় সবকিছু জানাতে পারবেন। তা-ই হল।
আধ ঘণ্টার মধ্যে থানার দারোগা দুজন পুলিশ নিয়ে হাজির। সঙ্গে সার্চ ওয়ারেন্ট।
প্রথমে একতলাটা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। তেঁতুলের বস্তা, দাঁড়িপাল্লা, হিসাবের খাতাপত্র ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই।
সকলে ওপরে উঠল। দোতলায় সারি সারি ঘর।
কোনও ঘরে কিছু নেই, শুধু শেষের দিকের একটা ঘরে একটা ছোটো ছেলের নীল প্যান্ট। পাশে একটা চাবুক।
পারিজাত বক্সী প্যান্ট আর চাবুক দুটোই তুলে নিলেন। প্যান্টে অল্প অল্প রক্তের দাগ।
এ প্যান্ট কার?
কী করে জানব বলুন? এখন বাজার খুবই খারাপ। ওপরতলায় তেঁতুলের বস্তা রাখার আর দরকার হয় না। আমি দোতলায় আসিই না।
কিন্তু এসব কামরা দেখে তো মনেই হচ্ছে না যে, কোনওদিন এখানে তেঁতুলের বস্তা রাখা হত।
এবার সদাশিববাবু রেগে উঠল। আপনার মনে না হলে আর কী করতে পারি বলুন! আমার হিসাবের খাতা দেখলেই বুঝতে পারবেন।
পারিজাত বক্সী আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত সদাশিববাবু। কিছু মনে করবেন না। আমাদেরই ভুল হয়েছিল।
পারিজাত বক্সী বেরিয়ে গেলেন।
.
রাত নেমে এলে গলিটা যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, তখন একটি ছায়ামূর্তি খুব আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে এল।
ঝাঁকড়া একটা অশ্বত্থ গাছ। চোখ ফিরিয়ে এদিক-ওদিক দেখে ছায়ামূর্তি তরতর করে ওপরে উঠে গেল। এক ডাল থেকে অন্য ডালে।
মোটা একটা ডাল দোতলার জানলা পর্যন্ত এসেছে। মূর্তিটা ডাল আঁকড়ে চুপচাপ পাতার আড়ালে লুকিয়ে বসে রইল।
পাশের বাড়ি অন্ধকার। কোথাও আলো-টালো নেই। চারদিকে ঝিঁঝি ডাকছে। দূরে দূরে পথের কুকুরের চিৎকার। জনমানবের সাড়াশব্দ নেই।
হঠাৎ টুং টুং করে আওয়াজ।
রাত কত বোঝবার উপায় নেই। মূর্তি ঝুঁকে পড়ে দেখল।
এঁকেবেঁকে একটা সাইকেল এসে গাছের নীচে দাঁড়াল।
আরোহী ওপরদিকে চোখ ফেরাতেই দোতলার একটা জানলা থেকে একটা টর্চের আলো দপদপ করে দুবার জ্বলেই নিভে গেল। বোঝা গেল, কোনওরকম সংকেত।
তারপর সাইকেল নিয়ে আরোহী ভিতরে ঢুকে পড়ল।
দোতলার একটা ঘরে অল্প জোরালো একটা বাতি জ্বলে উঠল।
ছায়ামূর্তি আরও সরে এসে জানলার ধারে বসল।
কামরার মধ্যে সদাশিব আর মোটর সাইকেল আরোহী। এই লোকটাই প্ল্যাটফর্ম থেকে চিঠি নিয়ে এসেছিল।
সদাশিব লোকটাকে খিঁচিয়ে উঠল, তুই কি দিন দিন ছেলেমানুষ হচ্ছিস বিনোদ?
কেন, কী হল?
কী হল? পকেট থেকে রুমালটা রাস্তার ওপর ফেলে গেছিস। সেই রুমালের মার্কা ধরে টিকটিকি এসে হাজির।
বিনোদ একটু ঘাবড়ে গেল। তারপর কী হল?
হবে আবার কী! বাড়ি তো খালি। সব তো সর্দার সরিয়ে দিয়েছে।
হুঁ, আমিও টিকটিকিকে খুব ধোঁকা দিয়েছি। আমি জানতাম, ওই ছেলেটার বাপ সব কাজ টিকটিকিকে জানিয়ে করছে। টিকটিকি ঠিক আমার পিছু নেবে। তাই আমি চিঠি তৈরি করে পকেটে নিয়ে রেখেছিলাম। সুযোগ বুঝে অশ্বত্থ গাছের তলায় সেটা রেখে দিয়েছিলাম।
যাক, সর্দার কী বলে?
সর্দারের ইচ্ছা, অপেক্ষাই করা যাক।
কী জানি, তার চেয়ে ছেলেটাকে অন্ধ করে দিয়ে কিংবা পা দুটো খোঁড়া করে দিয়ে আয় বাড়াতে পারলেই ভালো হত।
সর্দারের ধারণা, ছেলেটার বাপ ইচ্ছে করলে টাকা দিতে পারে। গাঁয়ের লোকের কাছে খবর পেয়েছে, বাপ ছেলেকে ভালোবাসে। কাজেই একটু দেরি হতে পারে, কিন্তু দেবে টাকাটা ঠিক। অবশ্য টাকাটা পেলেই যে ছেলেকে ছাড়া হবে এমন কোনও কথা নেই।
ছায়ামূর্তি বসে বসে ভাবল। এই সময় আস্তে আস্তে নেমে গিয়ে পুলিশে খবর দিয়ে এই দুজন লোককে সহজেই গ্রেপ্তার করা চলে, কিন্তু তাতে আসল কাজ হবে না। তা ছাড়া এদের বিরুদ্ধে প্রমাণই বা কী!
সব ব্যাপারটাই এরা বেমালুম অস্বীকার করে বসবে। তবে এই সদাশিব লোকটাকে চোখে চোখে রাখতে হবে। তেঁতুলের কারবার যে তার স্রেফ বাইরের সাজানো ব্যাপার, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
একটু পরেই লোকটা উঠে দাঁড়াল। সাইকেল চড়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
তার বেশ কিছুক্ষণ পর ছায়ামূর্তি নামল। এদিক-ওদিক দেখে, খুব সাবধানে। কিন্তু একটু এগিয়েই মুশকিলে পড়ল।
একটা কুকুর ঘুমোচ্ছিল। তার পা গিয়ে পড়ল একেবারে ঘুমন্ত কুকুরের ওপর।
ভাগ্য ভালো, কুকুরটা কামড়ায়নি কিন্তু বিকট শব্দে চিৎকার শুরু করল।
কান পাতা দায়। সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে বেঁটে-মোটা একটা লাঠি এসে পড়ল ছায়ামূর্তির পায়ে। ছায়ামূর্তি পথের ওপর লুটিয়ে পড়ল।
একবার মনে হল, একটা হাঁটুর হাড় বুঝি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আর জীবনে উঠে দাঁড়াতেই পারবে না।
একসময় অনেক কষ্টে ছায়ামূর্তি উঠে দাঁড়াল। টলতে টলতে কয়েক পা যেতেই আবার বিপদ। পিছন থেকে কে একজন তাকে সজোরে জাপটে ধরল। আর-একজন রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে একেবারে কাঁধের ওপর তুলে নিল।
কিছু দূরেই একটা মোটর দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে ছায়ামূর্তিকে পিছনের সিটে ছুড়ে দিল।
চিৎকার করার সুযোগ নেই। শুধু দুটো হাত খোলা। দুটো পা-ই শক্ত করে বাঁধা।
খোলা হাত দিয়ে ছায়ামূর্তির কিছু করার নেই।
তার পায়ের কাছে একজন বসে রয়েছে। মনে হচ্ছে তার হাতে কালো মোটা একটা লাঠি। এটা ছুড়েই বোধহয় ছায়ামূর্তির পা জখম করেছিল। একটু বেচাল দেখলে হয়তো লাঠি দিয়ে সোজা মাথাতেই আঘাত করে বসবে।
ছায়ামূর্তি চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইল। বুঝতে পারল, মোটর তিরবেগে ছুটে চলেছে।
অনেকক্ষণ। অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছে। ছায়ামূর্তি মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখে নিচ্ছিল।
একসময়ে মোটর থামল। দুজন লোক ধরাধরি করে ছায়ামূর্তিকে নামিয়ে আনল। একটা খাটিয়ার ওপর তাকে শুইয়ে লোক দুজন চৌকাঠের বাইরে বসল।
এখন বেশ আলো ফুটেছে। কোথাও কোনও অন্ধকার নেই।
এবার ছায়ামূর্তিকে চেনা গেল। ছায়ামূর্তি পারিজাত বক্সী স্বয়ং।
পারিজাত বক্সী অজ্ঞান হয়ে যাবার ভান করে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন। বাইরে থেকে লোক দুটোর কথাবার্তা তাঁর কানে ভেসে এল।
তুই তাহলে থাক এখানে। লোকটাকে পাহারা দে। আমি চলি।
কোথায় যাবি তুই?
তারক গাড়ি নিয়ে শহরে গেছে, যদি সর্দারকে পায় ওখানে। আমি একবার মান্দারনপুর ঘুরে আসি মেঘার ওখানে। যদি সর্দার ওখানে গিয়ে থাকে। সেই ছেলেটাকে মেঘার কাছে রাখা হয়েছে কিনা।
কী করতে যে ছোকরাটাকে কই মাছের মতন জিইয়ে রেখেছে কে জানে? শেষ করে দিলেই আমাদের হয়রানি কমে।
যাক, ওসব উঁচুতলার ব্যাপার আমাদের ভেবে লাভ নেই।
তুই ভিতরে গিয়ে ওর অবস্থাটা দেখে আয়, তারপর বাজারে গিয়ে খেয়ে নিয়ে আবার পাহারায় বসবি।
লোকটার পায়ের শব্দ পাওয়ামাত্রই পারিজাত বক্সী চোখ বন্ধ করে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে নিশ্বাস বন্ধ।
লোকটা ঝুঁকে পড়ে একবার দেখল। নাকের তলায় হাত দিল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, না রে, এখনও দেখছি জ্ঞান ফেরেনি। এসব শহরের ফুলবাবু তো, ভয়েই বোধহয় সিঁটিয়ে গেছে।
আর-একজন বলল, এত ভয় তো এসব কাজে আসা কেন?
পয়সা ভাই, পয়সা। সবই পেটের জন্য। আমাদের কথাই ভাব-না। যাক চল, দরজা বন্ধ করে বের হয়ে পড়ি।
বাইরে দরজায় তালা দেওয়ার শব্দ হল।
তারপরও কিছুক্ষণ পারিজাত বক্সী চুপচাপ শুয়ে রইলেন। অনেকটা সময় কাটিয়ে খাটিয়ার ওপর উঠে বসলেন। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখলেন।
মাটির দেয়াল। টিনের চাল। একটি জানলা, একটি দরজা। দরজা-জানলা ঘরের তুলনায় বেশ মজবুত।
কোনওমতে খাটিয়াটা ঠেলে ঠেলে তিনি জানলার কাছে নিয়ে এলেন। হাত দুটোও এবার বেঁধেছে।
চারদিকে ধু ধু মাঠ। কোথাও বসতির চিহ্নমাত্র নেই।
পারিজাত বক্সী খাটিয়ায় শুয়ে দুটো পা জানলার মধ্যে গলিয়ে দিলেন। মরচে- পড়া গরাদ প্রায় লাল হয়ে রয়েছে। দড়ির বাঁধন সেই গরাদের গায়ে ঘষতে লাগলেন।
পা দুটো টনটন করছে। বেশ ব্যথা রয়েছে, কিন্তু সময় নষ্ট করা চলবে না।
ঘষতে ঘষতে একসময় বাঁধন ছিঁড়ে গেল। হাতের বাঁধনও একইভাবে খোলা হল। পারিজাত বক্সী উঠে দাঁড়ালেন। ঘুরে বেড়ালেন ঘরের মধ্যে। পায়ে ব্যথা রয়েছে বটে, কিন্তু এ নিয়ে চলাফেরা করতে পারবেন।
প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন, রিভলভারটি ঠিক ঠিক আছে। এটার অস্তিত্ব কেউ টের পায়নি। কাল এটা ব্যবহার করার বিশেষ সুযোগ ছিল না। পকেটে হাত দেবার চেষ্টা করলেই লোকগুলো হয়তো তাকে শেষ করে দিত।
পারিজাত বক্সী উঠে দরজার কাছে গেলেন। টেনে দেখলেন, মোটা একটা চেনের সঙ্গে বাঁধা।
এ দরজা দিয়ে বের হবার কোনও আশা নেই। পারিজাত বক্সী খাটিয়ায় ফিরে এলেন। চুপচাপ শুয়ে ভাবতে লাগলেন।
যেমন করেই হোক এ কেসটার একটা কিনারা করতেই হবে। দলটা বার বার তাঁর চোখে ধুলো দিয়ে পালাচ্ছে।
আর-একটা ব্যাপার, কেউ যেন চুপি চুপি তাঁর গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। প্রত্যেকবার তাঁর ছদ্মবেশ ধরা পড়ে যাচ্ছে।
দরজায় শব্দ হতেই পারিজাত বক্সী চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
তালা খুলল। কে একজন যেন ঢুকল। খাটিয়ার কাছ বরাবর এসে বলল, এ কী রে বাবা, লোকটা এখনও চুপচাপ পড়ে আছে! শেষ হয়ে গেল নাকি?
লোকটা পারিজাত বক্সীর গায়ে ঝুঁকে পড়তেই পারিজাত বক্সী প্রবল বেগে ঘুসি চালালেন লোকটার চোয়াল লক্ষ করে।
বাপস। বলে লোকটা ছিটকে দেয়ালের কোণে গিয়ে পড়ল।
পারিজাত বক্সী এক মুহূর্তও নষ্ট করলেন না। পকেট থেকে রিভলভার বের করে লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, খবরদার, একটু চেঁচালেই খুলি ফুটো করে দেব।
লোকটা চেঁচাবে কী, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে!
হাতের এত শক্তি তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। চোয়ালে ঘুসি খেয়ে তখনও সে চোখে সরষে ফুল দেখছে।
উঠে দাঁড়াও!
লোকটা দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। তার পরনে পাতলা একটা গেঞ্জি আর ফুলপ্যান্ট। প্যান্টের পিছনে পকেট।
দুটো হাত ওপরে তোলো।
লোকটা হাত তুলল।
পারিজাত বক্সী প্যান্টের পকেট দেখল। একটা চামড়ার মানিব্যাগ, তাতে চার টাকা ত্রিশ পয়সা। আর আধময়লা একটা বড়ো রুমাল।
ব্যাগটা আবার রেখে দিয়ে পারিজাত বক্সী বললেন, মেঘা কে?
লোকটা কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে বলল, আমাদের দলের একজন।
মোহন বলে একটা ছেলেকে ধরে এনে কোথায় রেখেছ?
ও নামে কাউকে জানি না।
মেঘার কাছে কে আছে তাহলে?
নতুন ছেলে একটা।
তার নাম কী?
জানি না।
এসব ছেলেদের নিয়ে কী করা হয়?
জানি না।
সোজা উত্তর না দিলে অদৃষ্টে দুঃখ আছে।
মা কালীর দিব্যি, জানি না। আমাদের কাজ শুধু টিকটিকি আগলানো। বলেই লোকটা জিভ কাটল।
পারিজাত বক্সী বুঝতে পারলেন, লোকটার কাছ থেকে এর বেশি আদায় করা যাবে না।
পিছন ফেরো।
লোকটা ঘুরে দাঁড়াল।
পারিজাত বক্সী পকেট থেকে নাইলনের দড়ি বের করে লোকটার দুটো হাত পিছমোড়া করে বাঁধলেন। তারপর তাকে টানতে টানতে খাটিয়ার ওপর শুইয়ে ফেললেন। তারপর পা দুটোও বাঁধলেন।
রুমাল বের করে তার মুখে এমনভাবে গুঁজে দিলেন, যাতে লোকটার দুটো চোখ ছানাবড়ার মতন বেরিয়ে এল।
পারিজাত বক্সী হেসে বললেন, এইভাবে শুয়ে থাকো। আমি চলি।
বাইরে বেরিয়ে চেনে তালা লাগিয়ে দিলেন। চাবি তালাতেই ঝুলছিল।
প্রথমে চলতে বেশ একটু কষ্ট হচ্ছিল। উঁচু-নিচু জমি, তারপর পায়ে-চলা পথ পাওয়া গেল।
চলতে চলতে পারিজাত বক্সী ভাবলেন, একটা ভুল হয়ে গেল। এখান থেকে বাইরে যাবার রাস্তাটা লোকটাকে জিজ্ঞাসা করে নিলে হত। কোনদিক দিয়ে গেলে সোজা হবে কে জানে!
তারপর আবার তাঁর মনে হল, কিছু বলা যায় না, জিজ্ঞাসা করলে হয়তো সে উলটো পথই বাতলে দিত। যাতে সারাক্ষণ কেবল মাঠে মাঠেই ঘুরতে হত। ইতিমধ্যে সঙ্গীরা এসে তাঁকে ধরবার চেষ্টা করত।
অনেকটা যাবার পর পারিজাত বক্সী দেখলেন, শাকসবজি মাথায় নিয়ে একটা লোক এগিয়ে আসছে।
ও কত্তা, একটা কথা শোনো।
লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল।
এখান থেকে রেল স্টেশন কোনদিকে?
লোকটা অবাক হয়ে গেল।
রেল স্টেশন? এদিকে ওসব নেই।
তাহলে বাইরের লোকেরা যাওয়া-আসা করে কীসে?
বাবুরা হাওয়াগাড়িতে আসে, আর সবাই আসে খেয়া পার হয়ে।
খেয়াঘাট এখানে কোথায়?
এখান থেকে দেড় ক্রোশ। ওই ওদিকে।
পারিজাত বক্সী এগিয়ে চললেন।
রোদ বাড়ছে। বেশ তাপ। চলতে কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে রাস্তার দু-পাশে বাবলা গাছ। তার তলায় মোটেই ছায়া নেই।
অনেকটা পথ গিয়ে খেয়াঘাট নজরে এল।
নদীর সারি সারি অনেকগুলো চালাঘর। দুটো চায়ের দোকান, একটা কবিরাজখানা আর একটা চুল কাটার সেলুনও আছে সেখানে।
পারিজাত বক্সী প্রথমে চায়ের দোকানে ঢুকলেন। খিদে তো পেয়েইছে, তার ওপর তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ।
পারিজাত বক্সী চা আর বিস্কুটের অর্ডার দিলেন। এ ছাড়া অবশ্য কেক ছিল, কিন্তু কেকের অবস্থা দেখে আর খাওয়ার ইচ্ছা হল না।
দু-কাপ চা আর গোটা আষ্টেক বিস্কুট খেয়ে পারিজাত বক্সী অনেকটা ধাতস্থ হলেন। তারপর গিয়ে ঢুকলেন কবিরাজের দোকানে।
একজন বুড়ো ভদ্রলোক বসে। মাথায় সাদা ধবধবে চুল, পাকা পাকা গোঁফ। তাকে পা দুটো দেখালেন।
কী করে হল? খুব ব্যথা কি? দাঁড়ান, ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।
সব বুড়ো মানুষের মতন কবিরাজ একটু বেশি কথা বলে, সেটা বোঝা গেল। ওষুধ লাগানো হতে পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, এ জায়গার নাম কী?
বাজে মল্লিকপুর।
মান্দারনপুর এখান থেকে কত দূর?
কবিরাজ ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন।
মান্দারনপুর বলে তো এদিকে কোনও জায়গা নেই। এক মান্দারনপুর আছে, খেয়া পার হয়ে রেলে করে যেতে হয়। যেখানে চণ্ডেশ্বরীর মন্দির আছে! বাবার কাছে শুনেছিলাম, অনেক আগে খুব ধুমধাম করে পুজো হত। মেলা হত। এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে। কেন, সেখানে আপনার কী দরকার?
আমার কিছু পৈতৃক জমি ছিল। সেগুলো দেখাশুনো করতে যাব।
অ। কবিরাজ টেবিলের ওপর রাখা একটা খবরের কাগজে মন দিল।
আচ্ছা, খেয়া নৌকা কখন আসবে?
কবিরাজ মুখ তুলে দেখে বলল, ওই তো আসছে।
মাঝনদীতে একটা নৌকা। যাত্রী-বোঝাই। এদিকেই আসছে।
পারিজাত বক্সী সাবধানে নেমে খেয়াঘাটে গিয়ে দাঁড়ালেন।
আরও কয়েকজন যাত্রী মোটঘাট নিয়ে বসে আছে। সবাই প্রায় চাষাভুসো শ্রেণির।
এ নৌকা যেখানেই যাক, এ জায়গা পারিজাত বক্সীকে ছাড়তেই হবে। শয়তানের দল হয়তো তার সন্ধানে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এবার ধরলে আর এত সহজে উদ্ধার পাওয়া যাবে না।
নৌকা পারে এসে লাগল।