।। পাঁচ।।
অন্ধকার ঘর। আশপাশে অনেকগুলো তেলের খালি পিপে। তার মধ্যে মোহন বসে আছে। দুটো হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। দুটো পায়ে শিকল। সামনে একটা টুলের ওপর সেই বেঁটে লোকটা।
আমাদের আর দোষ নেই। তোর বাবাকে টাকাটা দিয়ে দেবার অনেক সুযোগ দিলাম, কিন্তু আজ পর্যন্ত দেবার নাম নেই। এক টিকটিকির পাল্লায় পড়েছে বুঝতে পারছি, সে-ই মতলব দিচ্ছে।
মোহন কোনও উত্তর দিল না। দেবার মতন উত্তরও তার কিছু নেই। সে জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছে। আর তার বাবা সাহায্যের জন্য আসবে না, সেটুকু বুঝতে পেরেছে। অভিমানে তার বুক ভরে গেল। ধারণা ছিল, নতুন মা যেমন তাকে দু-চোখে দেখতে পারে না, তেমনই বাবা কিন্তু খুব ভালোবাসে। কিন্তু কই, টাকা নিয়ে তো বাবা এগিয়ে আসছে না। এদিকে দিন দিন এরা নানারকম নির্যাতন শুরু করেছে। প্রায়ই খাওয়া বন্ধ করে দেয়। হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে।
যাক, তোর বাপকে শেষ চিঠি দিয়েছি। আর কিছুদিন দেখব, তারপর আমাদের মনে যা আছে তা-ই করব। গালাগাল দিতে দিতে লোকটা বেরিয়ে গেল।
বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগানোর শব্দ এল।
আগের বাড়িটা তবু ভালো ছিল, কিন্তু হঠাৎ এক সকালে দুটো লোক মোহনের চোখ-মুখ বেঁধে একটা থলির মধ্যে পুরে কাঁধে তুলে নিল। তারপর এইখানে এনে ফেলল।
তেলের একটা বিশ্রী গন্ধ। অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে। কাঠের দেওয়াল, কাঠের মেঝে। দিনের বেলাও ঘুটঘুটে অন্ধকার।
বোঝাই যখন যাচ্ছে, বাবা টাকা দিয়ে উদ্ধার করতে আসবে না, তখন নিজের উপায় নিজেকেই করতে হবে। যেমন করে হোক পালাতে হবে এখান থেকে। তা না হলে, কিছুই বলা যায় না, এরা হয়তো জোর করে অন্ধ কিংবা খোঁড়া করে দেবে। আজীবনের মতন পঙ্গু।
পায়ে শিকল বাঁধা থাকলেও বসে বসে চলতে মোহনের কোনও অসুবিধা হল না। একেবারে কোণের দিকে খালি ড্রামের পিছন থেকে মোহন একটা ভাঙা পাইপের টুকরো কুড়িয়ে পেল। দেড় ফুট লম্বা, বেশ ভারী। অস্ত্র হিসাবে চমৎকার।
মোহন সেটাকে বেশ সতর্কতার সঙ্গে লুকিয়ে রাখল। যা হবার হোক, মোহন একেবার মরিয়া।
পরের দিন ভোরবেলা দারোয়ান রোজকার মতন দরজা খুলল। ভিতরে ঢুকে মোহনের হাত-পায়ের বাঁধনও খুলে দিল। এ সময় মোহনের কলঘরে যাবার কথা, তাই এ ব্যবস্থা।
মোহন কলঘরে গিয়ে দরজাটা সজোরে বন্ধ করল বটে, কিন্তু কলঘরের ভিতরে গেল না।
ড্রামের মধ্যে থেকে ভাঙা পাইপটা তুলে নিয়ে পা টিপে টিপে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
দারোয়ান চৌকির ওপর বসে সুর করে দুলে দুলে কী গাইছে। দরজার দিকে পিছন ফিরে। মোহন ভাঙা পাইপটা তুলে প্রাণপণ শক্তিতে দারোয়ানের মাথায় আঘাত হানল। অস্ফুট আর্তনাদ করেই দারোয়ান লুটিয়ে পড়ল।
মোহন আর তিলমাত্র দেরি করল না। পাইপের টুকরোটা ফেলে দিয়ে তিরবেগে ছুটতে আরম্ভ করল।
কিছুটা এগিয়েই নীচে নামার সিঁড়ি। মোহন বুঝতে পারল, সিঁড়ি দিয়ে নামা উচিত হবে না। দলের লোকেরা নিশ্চয় নীচে আছে। সে উলটোদিকে ছুটল।
বারান্দার কোণে ছোটো একটা জানলা। তার ফাঁক দিয়ে একটা অশ্বত্থ গাছ দেখা গেল।
বহু কষ্টে মোহন নিজের শরীরটা সেই ছোটো জানলার মধ্য দিয়ে গলিয়ে দিল।
এদিকে-ওদিকে ভোরের ঝাপসা কুয়াশা। একটু দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। জানলা থেকে লাফ দিয়ে মোহন গাছের একটা ডাল ধরল। পাড়াগাঁয়ের ছেলে। গাছে চড়া খুব অভ্যাস আছে। তরতর করে ডাল বেয়ে নীচে নেমে এল সে।
ছোটো ছোটো আগাছার ঝোপ। ঝোপের আড়ালে বসে একবার বাড়িটার দিকে দেখল। না, কোথাও কোনও চাঞ্চল্য নেই। মনে হয় কেউ এখনও জাগেনি। মোহনের পালিয়ে যাবার কথা কেউ জানতে পারেনি।
গুঁড়ি দিয়ে মোহন এগিয়ে গেল। সামনের ইটের স্তূপ দেখে মনে হল, এখানে একসময় বাড়ির ভিটে ছিল। বাড়িও থাকতে পারে। হয়তো পুরোনো হয়ে ভেঙে পড়ে গেছে, কিংবা আদৌ বাড়ি তৈরিই হয়নি। ভিত পর্যন্ত গাঁথা হয়েছিল।
মোহনের ভয় হল, দিনের আলোয় চলাফেরা করলে কারো চোখে পড়ে যাবে। বদমাশদের দল খুঁজতে খুঁজতে নিশ্চয় এদিকে আসবে। তার চেয়ে ঝোপের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকাই ভালো। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। লম্বা লম্বা ঘাসের মধ্যে মোহন ঢুকে পড়ল।
ঘাস খুব নরম। যেন বিছানা।
দুপুর কাটিয়ে বিকাল হলেই মোহন উঠে পড়বে। শীতকালে তাড়াতাড়ি অন্ধকার নামে। অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে পালাবার খুব সুবিধা। একবার রাস্তায় পৌঁছাতে পারলে, লোককে জিজ্ঞাসা করে করে ঠিক হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যাবে। তারপর টিকিট চেকারবাবুদের হাতে-পায়ে ধরে দেবীগড় যেতে খুব অসুবিধা হবে না।
তীক্ষ্ন একটা হাসির শব্দে মোহনের ঘুম ভেঙে গেল। সব ব্যাপারটা বুঝতে তার বেশ একটু সময় নিল। চোখ খুলে দেখল, সামনে ঘাসের ওপর বেঁটে-মোটা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। একে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না মোহন। লাল চোখ, নাক প্রায় নেই বললেই হয়, সারা মুখে বসন্তের দাগ, হলদে ছোপ-লাগা দাঁত। লোকটা বলল, কী রে, খুব চালাক হয়েছিস? এবার তো ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে।
মোহনের গলা থেকে স্বর বের হল না। আস্তে আস্তে বলল, ফাঁসিকাঠে?
আলবত। লোহার ডান্ডা দিয়ে দারোয়ানকে খতম করে পার পেয়ে যাবি ভেবেছিস? ওঠ, পুলিশ তোকে খুঁজছে।
ঠিক বেড়াল যেমন ইঁদুরকে মুখে ঝুলিয়ে নেয়, ঠিক তেমনই লোকটা মোহনের শার্টের কলার ধরে তুলে নিল।
কথা বলা দূরে থাক, মোহনের কিছু চিন্তা করারও শক্তি নেই। সর্বনাশ, মানুষ মারার জন্য শেষকালে তার ফাঁসি হবে। কিন্তু এই লোকগুলো যে তাকে বন্দি করে রেখে নির্মম অত্যাচার করছিল, শুধু এদের হাত থেকে বাঁচবার জন্যই যে সে দারোয়ানকে মারতে বাধ্য হয়েছে, এ কথা পুলিশ শুনবে না?
লোকটা তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলল।
গাছ থেকে নামবার সময় দু-এক জায়গা ছড়ে গিয়েছিল, এবারের টানাহ্যাঁচড়ানিতে অনেক জায়গা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল।
দোতলায় নিয়ে গিয়ে মোহনকে আছড়ে ফেলল লোকটা।
মোহন উঠে বসেই অবাক। দারোয়ানের শুধু মাথায় ব্যান্ডেজ। সে দিব্যি বহাল তবিয়তে রয়েছে। সামনে কোমরে হাত দিয়ে বদমাশের দলের সর্দার দাঁড়িয়ে। তার হাতে একটা চাবুক। সে বলল, উঠে দাঁড়া। তোকে কী করে শায়েস্তা করতে হয় আমি জানি।
কাঁপতে কাঁপতে মোহন উঠে দাঁড়াল।
সর্দার চাবুকটা উঁচুতে তুলে নামিয়ে আনার মুহূর্তেই থেমে গেল। একটা লোক ছুটতে ছুটতে আসছে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, কোমরে লাল গামছা বাঁধা। জোয়ান চেহারা। কাছে এসে সে ইশারায় সর্দারকে ডাকল।
চাবুক গুটিয়ে সর্দার তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
দুজনে ফিসফিস করে কী কথা হল। মনে হল, সর্দারের চোখ-মুখে যেন চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। লোকটা আবার দৌড়াতে দৌড়াতে চলে গেল।
সর্দার মোহনের কাছে এসে তাকে একটা লাথি মারল। মোহন ছিটকে গিয়ে কামরার মধ্যে পড়ল। তারপর বাইরে থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
মোহনের মনে হল, তার কোমরটা বুঝি ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। সে বুঝি আর উঠে দাঁড়াতেই পারবে না।
একসময় আস্তে আস্তে দেয়াল ধরে মোহন উঠে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করল।
নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে, তা না হলে লোকটার কথায় সর্দার অত চিন্তিত হয়ে উঠল কেন? তাহলে কি পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে? মোহন এগিয়ে এসে দরজায় কান পাতল। না, কোনও শব্দ নেই। সব চুপচাপ।
মোহন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। মেঝের ওপর বসে পড়ল। বসে বসে ভাবতে লাগল, সে ভুল করেছে। ওভাবে ঘাসবনের মধ্যে বসে না থেকে আরও দূরে চলে যেতে পারত। এদের নাগালের বাইরে।
.
সন্ধ্যার পর দরজা খুলে গেল। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। পরিশ্রান্ত দেহ।
মোহন ভাবল, কেউ নিশ্চয় খাবার নিয়ে এসেছে, কিন্তু না। যে লোকটা মোহনকে ধরে নিয়ে এসেছিল, সে এসে ঢুকল, তার হাতে কালো কাপড়ের একটা বান্ডিল। সে বলল, নে এটা পরে নে। লোকটা কাপড়ের বান্ডিলটা মোহনের দিকে ছুড়ে দিল।
মোহন জানে, এদের কথা অমান্য করলে আবার শাস্তি পেতে হবে। কাপড়টা তুলে দেখল, একটা বোরখা। বলল, এটা পরব? এটা তো মেয়েদের।
লোকটা খিঁচিয়ে উঠল। বেশি কথা বলিসনি। যা বলছি, তা-ই কর।
মোহন বোরখাটা পরে নিল। চোখের সামনে জাল দেওয়া। সামনের পথ দেখবার জন্য।
দেখি তোর হাত দুটো।
মোহন দুটো হাত বাড়িয়ে দিল।
লোকটা মোহনের হাতের চেটোয় কী মাখিয়ে দিল।
মোহন নিজের দুটো হাত চোখের সামনে এনে দেখল। মেহেদি বাটা। চেটো দুটো হলদে হয়ে গিয়েছে।
নে চল। রাস্তায় যদি একটা কথা বলবি তো গর্দান থেকে ধড় আলাদা করে দেব।
এভাবে বলা মুশকিল। ঠোক্কর খেতে খেতে মোহন এগিয়ে চলল। বুঝতে পারল, লোকটা সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে।
বেশি দূর নয়। কিছুটা গিয়েই মোহনকে থামতে হল।
সঙ্গের লোকটা কর্কশকণ্ঠে বলল, দাঁড়া এইখানে।
মোহন দাঁড়াল।
একটা মোটরের শব্দ। মনে হল, মোটরটা সামনে এসে থামল।
লোকটা মোহনের হাত ধরে মোটরে উঠল।
মোটর নক্ষত্রবেগে ছুটে চলল।
জালি-কাটা নকশা দিয়ে মোহন দেখল, মোটর সরু গলি ছাড়িয়ে চৌরাস্তায় এসে পৌঁছাল। চারদিকে ট্রাম-বাস, অগণিত লোকজন।
এত ভিড়ের মধ্যেও মোহন কত অসহায়। চিৎকার করে উঠতে সাহস হল না। লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার আগেই সঙ্গের লোকটা হয়তো গলা টিপে তাকে শেষ করে দেবে। এদের অসাধ্য কোনও কাজ নেই। অনেকটা চলার পর মোহনের মনে হল, মোটরটা যেন এবার থামল। মনে হল, একটা রেল স্টেশন।
মোটর থামতেই আর-একটা লোক এসে চাপা গলায় বলল, সব ঠিক আছে।
সে কথায় উত্তর না দিয়ে সঙ্গের লোকটা বলল, কত দেরি?
মিনিট দশেক।
মোহনকে ধরে রাস্তায় নামিয়ে লোকটা আবার সাবধান করে দিল, একটি কথা যেন মুখ থেকে না বের হয়।
তিনজনে স্টেশনে এসে ঢুকল। একটু পরেই ইঞ্জিনের গর্জন। ঝমঝম শব্দ করতে করতে ট্রেন এসে দাঁড়াল।
যাত্রীদের হইচই। ফেরিওয়ালাদের শোরগোল। তারই মধ্যে দুজন দু-ধার থেকে মোহনের হাত ধরে ট্রেনে তুলল। একেবারে কোণের বেঞ্চে—মাঝখানে মোহন, দু-পাশে দুজন তার দেহের সঙ্গে চেপে বসল।
একসময় ট্রেন ছাড়ল।
মোহনের মনে হল, তাহলে কি এরা তাকে নিজের গাঁয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? দেবীগড়ে?
হয়তো বাবার সঙ্গে কোনও কথা হয়েছে। যে টাকা এরা চেয়েছিল সেটা পেয়ে গেছে। মনে খুবই আনন্দ হল মোহনের। কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে সাহস হল না।
ট্রেনের কামরায় অন্য যাত্রীও রয়েছে। তাদের মুখগুলো মোহন অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল।
একটু পরেই মোহনের চাপা আনন্দ বিষাদে পরিণত হল।
সামনের বেঞ্চে বসা একটি লোক প্রশ্ন করল, মিঞা সায়েব কতদূর যাবেন?
মোহনের ডান পাশের লোকটি বলল, আর বলেন কেন ভাই। বোনের এই মেয়েটাকে নিয়ে নাজেহাল হয়ে গেলাম। ডাক্তার, বদ্যি, হেকিম কিছু করতে পারল না। এখন দৈব ভরসা।
অসুখটা কী?
মাথায় রোগ। এলোমেলো বকে। তাই পাণ্ডুয়ার পিরসাহেবের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। শুনেছি, তাঁর ফুল পড়ায় খুব কাজ হয়।
মোহন কথা বলতে গিয়েই সহসা উঃ করে থেমে গেল। পাশের লোকটা সজোরে চিমটি কেটেছে পাঁজরার নীচে। বোধহয় সে আন্দাজ করেছিল যে, মোহন প্রতিবাদ করে উঠবে।
অন্য লোকটি ব্যাকুলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, কী হল মরিয়ম, আবার শরীর খারাপ বোধ হচ্ছে। শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো।
একরকম জোর করেই তারা মোহনকে শুইয়ে দিল।
মোহনের চিন্তার শেষ নেই। তাকে এরা কোথায় নিয়ে চলেছে? তাহলে সম্ভবত তার বাবা এদের টাকা দেয়নি। সেইজন্য এরা মোহনকে মেরে ফেলবে। মরার পরে মোহনের দেহ নিয়ে এরা যা ইচ্ছা করুক, তাতে মোহনের কিছু যায় আসে না। কিন্তু এক কামরা লোক সঙ্গে চলেছে। এরা কি কেউ মোহনকে একটু সাহায্য করতে পারে না? মোহন যদি চিৎকার করে ওঠে! বোরখা খুলে ফেলে বলে, আমি মরিয়ম নই, মোহন। তোমরা আমাকে বাঁচাও। এরা আমাকে মেরে ফেলতে নিয়ে চলেছে। তাহলে কি কেউ সাহায্য করবে না? এমন সুযোগ হয়তো জীবনে আর আসবে না।
কিন্তু একটা লোক তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার আসল উদ্দেশ্য অন্য। যদি মোহন কোনোরকম বেয়াদবি করে কিংবা চেঁচামেচি করার চেষ্টা করে, তাহলে তার মুখ চেপে ধরবে। গলা টিপে ধরাও বিচিত্র নয়। তার চেয়ে চুপ করে থাকাই ভালো। যা হবার তা-ই হবে।
মোহন জানে, বাবার জমিজমা আছে। অত বড়ো কাপড়ের দোকানের মালিক। আসল কথা, ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার মন বাবার নেই। থাকলে বাবা টাকাটা নিশ্চয় দিয়ে দিত। মোহন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল, একটা হাত তার গলার ওপর চেপে বসল।
ট্রেন থামতে মোহনকে নিয়ে দুজনে উঠে পড়ল। অন্ধকার স্টেশন। টিমটিম করছে আলো। জালি-কাটা নকশার ফাঁক দিয়ে মোহন চেয়ে চেয়ে দেখল।
স্টেশনের এলাকা পার হয়ে সবাই রাস্তায় নামল। তারপর হাঁটা বেশ অনেকটা পথ।
এক জায়গায় এসে সঙ্গের একজন বলল, দাঁড়া।
মোহন দাঁড়াল। ওর বোরখা টেনে খুলে দিল সে লোকটা।
মোহন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
চারদিকে জঙ্গল। দূরে দূরে আলোর আভাস। অজ পাড়াগাঁ বলেই মনে হচ্ছে। মোহনের ভয় হল। নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে এরা বোধহয় মোহনকে শেষ করে দেবে। কেউ জানতেও পারবে না।
চলতে চলতে মোহন জিজ্ঞাসা করল, তোমরা আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
কোনও উত্তর নেই। আবার সাহস করে মোহন জিজ্ঞাসা করে ফেলল, তোমরা কি আমাকে মেরে ফেলবে?
এবার সঙ্গের একজন কর্কশকণ্ঠে বলল, ফেলব বই কী। আবার পালাবার চেষ্টা করলে একদম খতম। তোর জন্যে আমাদের কম হয়রানি কি! বিচ্ছু কোথাকার।
সামনে ভাঙা একটা মন্দির। অনেক পুরোনো। এত পুরোনো যে, ফাটলে ফাটলে বুনো গাছ গজিয়েছে। তার পাশে একতলা একটা বাড়ি। তারও জরাজীর্ণ অবস্থা।
এখন অন্ধকার অনেকটা কম। আকাশে চাঁদ উঠেছে। ম্লান আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
মোহনকে দাঁড় করিয়ে একজন মেঠোরাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। বাড়িটার সামনে গিয়ে চেঁচাল, মেঘা, মেঘা!
বারকয়েক ডাকবার পর যে বেরিয়ে এল, তাকে দেখে মোহন আঁতকে উঠল। কালো কুচকুচে রং। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। জবা ফুলের মতন টকটকে রাঙা চোখ। খালি গা। বাঁ হাতে তাবিজ বাঁধা।
মেঘা, এই ছেলেটাকে তোর কাছে রাখতে হবে। এক নম্বরের শয়তান। একবার পালাবার চেষ্টা করেছিল। খুব চোখে চোখে রাখবি।
মেঘার দুটো চোখ যেন জ্বলে উঠল। হা হা করে এমনভাবে সে হেসে উঠল যে, কাছে গাছের ডালে বসে-থাকা গোটাকয়েক পাখি ঝটপট করে উড়ে গেল। হাসতে হাসতেই সে বলল, পালাবে আমার কাছ থেকে! একেবারে চণ্ডেশ্বরীর মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দেব না! হুঁ।
মেরে ফেলার ভয় মোহনকে বদমাশ দলের অনেকেই দেখিয়েছে, কিন্তু এই লোকটার কথা শুনে মোহনের বুকটা গুরগুর করে উঠল। মনে হল, কিছুই যেন এর অসাধ্য নয়।
বইতে আগের যুগের যেসব ডাকাতের কাহিনি মোহন পড়েছিল—বিশে ডাকাত, নিধিরাম সর্দার—তাদের সঙ্গে লোকটার মিল আছে। কে জানে, লোকটা হয়তো ডাকাতও হতে পারে।
নে আয়। মেঘা বজ্রমুষ্টিতে মোহনের হাত ধরে টানল।
আর-একটু হলে মোহন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেত মাটির ওপর।
তাহলে আমরা চলি মেঘা। সর্দারকে গিয়ে বলব, ছোকরাকে তোর জিম্মায় দিয়ে গেলাম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, কোনও চিন্তা নেই। আমি ঠিক শায়েস্তা করে রাখব।
ছোটো একটা ঘর। দেয়ালগুলো ফেটে গেছে। মেঝেও চৌচির। সেখানে নিয়ে গিয়ে মেঘা একটা চাটাই নিয়ে ছুড়ে দিয়ে বলল, নে তোর বিছানা। জিরিয়ে নে।
মোহনকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে মেঘা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করল।
বাড়িটা জরাজীর্ণ কিন্তু মজবুত শাল কাঠের দরজা। বড়ো বড়ো লোহার হুড়কো।
রাতের ফিকে আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে। পরিশ্রান্ত মোহন কোনওরকমে টলতে টলতে চাটাইয়ের ওপর গিয়ে শুয়ে পড়ল। সকাল থেকে পেটে একবিন্দু খাবার পড়েনি। তেষ্টায় বুকটা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে।
আসতে আসতে পথে একটা ডোবা দেখেছিল। একবার যদি কিছুক্ষণের জন্যও ছাড়া পেত, তাহলে মোহন ছুটে গিয়ে আঁচল ভরে সেই ডোবার জল খেয়ে আসত।
কতক্ষণ যে এভাবে কেটে গেছে মোহনের খেয়াল নেই। হঠাৎ দরজায় শব্দ হতেই সে চমকে উঠে বসল। ঘর অন্ধকার, চাঁদ সরে গেছে। কে যেন দরজা খোলার চেষ্টা করছে।
দরজা খুলে যেতে ঘরের মধ্যে আলোর রেখা এসে পড়ল। কেরোসিনের কুপি হাতে নিয়ে কে একজন ঢুকল। কাছে আসতে মোহন ভালো করে দেখতে পেল। কালো কুৎসিত চেহারা। শণের নুড়ির মতন চুল। সামনের গোটা তিনেক দাঁত বীভৎসভাবে বেরিয়ে আছে। এক হাতে তেলের কুপি, অন্য হাতে একটা মাটির সরা। সরাটা মোহনের সামনে নামিয়ে রেখে বুড়ি খনখনে গলায় বলল, নে গিলে নে। আমি সরাটা নিয়ে যাব।
মোহন সোৎসাহে এগিয়ে এসেই হতাশ হল। পান্তা ভাত। বিশ্রী একটা গন্ধ বের হচ্ছে। পাশে শাকের তরকারি।
কিন্তু তার পেটে তখন আগুন জ্বলছে। খাবারের বাছবিচার করার সময় তার নেই। সে কোনওরকমে পান্তা ভাত শেষ করে ফেলে বলল, একটু জল।
বুড়ি খিঁচিয়ে উঠল। নবাবপুত্তুরের কিছু ত্রুটি হবার জো নেই।
বেরিয়ে গিয়ে মাটির গেলাসে জল এনে রাখল। তারপর মোহনের খাওয়া শেষ হলে সরা-গেলাস তুলে নিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
তেলের কুপিটা জ্বলছে। কতটুকুই বা আলো। মোহনের দীর্ঘ ছায়া দেয়ালের ওপর কাঁপছে। একটু পরে মোহন চাটাইয়ের ওপর শুয়ে পড়ল।
রাত কত হল খেয়াল নেই, হঠাৎ হাতের ওপর ঠান্ডা একটা স্পর্শ পেয়ে মোহন চিৎকার করে জেগে উঠল। বিশ্রী একটা স্বপ্ন দেখছিল মোহন। কতকগুলো ষণ্ডামার্কা লোক তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। সামনে চণ্ডেশ্বরীর মূর্তি। কালীমূর্তিরই মতন। লাল টকটকে জিভ। দু-চোখে যেন আগুন ছুটছে। তার সামনে হাড়িকাঠ। মূর্তির সামনে এক পুরোহিত বসে পূজা করছে।
তার চেহারাও ভয়াবহ।
সবাই মিলে মোহনকে ধরে হাড়িকাঠে ফেলল। গলাটা আটকে দিল। সেই মুহূর্তে মোহনের চোখের সামনে বাবার চেহারা ভেসে উঠল। বিড়বিড় করে মোহন বলল, তুমি আমার জন্য কিছু করলে না বাবা। দেখো, এরা আমায় শেষ করে দিচ্ছে। আর জীবনে কোনওদিন আমাকে দেখতে পাবে না।
তারপর একটা লোক বিরাট একটা খাঁড়া নিয়ে মোহনের ঘাড়ে স্পর্শ করাল। কনকনে ঠান্ডা স্পর্শ। মোহন জেগে উঠল।
তেলের কুপির আলোটা কমে এসেছে। সেই আবছা আলোয় মোহন সভয়ে দেখল, বিরাট কালো রঙের একটা সাপ মোহনের হাতের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে দেয়ালের দিকে এগিয়ে চলেছে। সাপের মাথায় খড়মের মতো চিহ্ন আঁকা।
মোহন গাঁয়ের ছেলে। অনেকরকম সাপ দেখেছে। সাপও চেনে। এটা গোখরো সাপ। দারুণ বিষধর। এক ছোবলেই শেষ।
কেউটের মতন এরা সহজে তেড়ে আসে না। কিন্তু মোহন এর আস্তানায় হানা দিয়েছে, কাজেই রাগ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যদি তেড়ে আসে, তাহলে মোহনের পালাবার কোনও পথ নেই। জানলা নেই। ঘুলঘুলি। তাও অনেক ওপরে।
তাহলে এদের উদ্দেশ্য বোধহয় মোহনকে এইভাবে মেরে ফেলা। নিজের হাতে কিছু করবে না। তাতে অনেক হাঙ্গামা। সাপের কামড়ে মারা গেলে বলবার কিছু নেই।
সাপটা আস্তে আস্তে একটা ফাটলের মধ্যে ঢুকে গেল।
সারাটা রাত মোহন আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শুতে আর সাহস হল না। কী জানি, সাপটা যদি আবার বেরিয়ে পড়ে। তা ছাড়া চারদিকে অজস্র ফাটল। সাপের থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা। আরও কত সাপ আছে বলা যায়!
সকালে যখন দরজা খুলল তখন মোহন ঘুমিয়ে পড়েছে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে কখন মোহন দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে। তারপর একসময়ে চাটাইয়ের ওপর ঢলে পড়েছে।
আরে এই, ওঠ ওঠ।— বাজখাঁই গলার আওয়াজে মোহনের ঘুম ভেঙে গেল। সে ধড়মড় করে উঠে বসল। চোখ মুছে দেখল, সামনে মেঘা দাঁড়িয়ে।
মেঘা বলল, নে বাইরে চল।
মোহন উঠে দাঁড়াল। তাহলে কি তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে? মেঘার পিছন পিছন মোহন বেরিয়ে এল।
বিরাট মাঠ। মাঝে মাঝে আকন্দ, বনতুলসী আর কেয়া গাছের ঝোপ। পাশে একটা ডোবা। শ্যাওলার জল সবুজ হয়ে আছে।
নে, মুখ-হাত ধুয়ে নে।
মোহন ডোবার জলে মুখ ধুতে লাগল।
বিশ্রী পাঁকের গন্ধ জলে। মুখে দিলেই বমি হয়ে যাবে যেন। কিন্তু উপায় নেই।
মুখ ধুয়ে মোহন আবার ঘরে ফিরে এল। আশ্চর্য হয়ে দেখল, এবার আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হল না। দরজা খোলাই রইল।
কী ব্যাপার? মোহন একটু পরেই তা বুঝতে পারল।
খোলা দরজা দিয়ে বুড়ি ঢুকল। হাতে মাটির সরা। সরাতে দুখানা আধপোড়া রুটি আর একটু গুড়। সরাটা নামিয়ে বুড়ি যখন ফিরে যাচ্ছে, তখন সাহস করে মোহন ডাকল, দিদিমা।
বুড়ি ভ্রূ কুঁচকে থমকে দাঁড়াল।
দিদিমা! এ আবার কী ডাক? কে তুই সাতপুরুষের কুটুম? আমার কেউ কোথাও নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।
একটা কথা দিদিমা! মোহন কাতরকণ্ঠে বলল।
কী বলবি বল। তখন থেকে দিদিমা-দিদিমা করছিস।
এ ঘরে থাকতে বড়ো ভয় করছে।
ভয়? কীসের ভয়?
সাপের। কাল রাত্তিরে আমার হাতের ওপর দিয়ে একটা সাপ গিয়েছে।
বুড়ি কথাটা শুনে হাসতে শুরু করল। হাসির চোটে চোখ দুটো বুজে গেল। সব ক-টা দাঁত বেরিয়ে পড়ল—অ মা, ও সাপে ভয় কী? ওরা তো বাস্তুসাপ। ওরা কিচ্ছু করে না। এখানে একজোড়া আছে। প্রতি মঙ্গলবার আমি ওদের দুধ-কলা খাওয়াই।
একটা নয়, একজোড়া? সর্বনাশ! মোহন রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল।
এই ঘরে জোড়া সাপের সঙ্গে থাকতে হবে! ঘুমিয়ে থাকার সময় কখন তাদের গায়ে হাত-পা গিয়ে পড়বে। ব্যাস, অমনি ছোবল। অবশ্য বাঁচবার মোহনের আর ইচ্ছা নেই। বাবাই যখন আর তাকে চায় না তখন তার কী হবে বেঁচে!
দেবীগড়ে গিয়েই বা কী হবে? কিন্তু এভাবে সাপের ছোবলে নির্জন জঙ্গলে মরতে হবে! কেউ টেরও পাবে না! নতুন মা-র কাছে, বাবার কাছে খবরও পৌঁছাবে না?
মোহন আর কিছু বলল না। বুঝতে পারল, বলেও কোনও লাভ নেই। অন্য কোনও ঘরে পাঠিয়ে দেবার ক্ষমতা খুব সম্ভব বুড়িরও নেই।
সে রুটি-গুড় খাওয়া শেষ করে দেখল, দরজার গোড়ায় বসে বুড়ি চাল বাচছে। বোধহয় চোখে ভালো দেখতে পায় না, তাই চালের ওপর খুব ঝুঁকে পড়েছে।
মোহন ডাকল, দিদিমা, অ দিদিমা!
না, ছেলেটা জ্বালালে দেখছি! বুড়ি জিজ্ঞেস করল, কী বলবি বল?
আমি তোমার চাল বেছে দেব দিদিমা?
তুই কী করে বাছবি? ঘরের মধ্যে তো অন্ধকার।
তোমার মতন দরজার গোড়ায় বসে!
দরজার গোড়ায় বসে? না বাছা, মেঘা দেখলে রাগ করবে।
কোথায় পালাব দিদিমা, চারদিকে তো জঙ্গল। তা ছাড়া কাছে তো তুমি বসেই রয়েছ।
বুড়িটা কিছুক্ষণ কী ভাবল, তারপর বলল, তাহলে আয় এখানে, চালগুলো বেছে দে। পালাবার চেষ্টা করলে খবরদার, একেবারে তোকে খতম করে দেবে। চারদিকে আমাদের লোক রয়েছে।
এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মোহন বুড়ির পাশে গিয়ে বসল। বলল, সরো দিদিমা, আমি বাছছি।
বুড়ি খুব একটা সরে বসল না। ছেলেটাকে হাতের নাগালের মধ্যে রাখাই ঠিক। কার কী মতিগতি হয় বলা যায়! অবশ্য পালিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। সে আশা দুরাশা। বাড়িতে শাঁখ আছে। সেই শাঁখে বুড়ি একবার ফুঁ দিলেই লোকেরা জঙ্গল ঘিরে ফেলবে। মাছিটির পর্যন্ত পালাবার পথ থাকবে না। সে কথা বুড়ি জানিয়ে রাখল।
চাল বাছতে মোহনের বেশি সময় লাগল না। নতুন মা-র কল্যাণে এসব কাজ তার জানা।
বুড়ি খুব খুশি। একগাল হেসে বলল, বা, খাসা হয়েছে। মেঘা আবার ভাতে একটু কাঁকর থাকলে খেতে পারে না। আমাকে গালাগালি করে। আমার কি আর সে চোখ আছে?
মোহন বলল, তুমি রোজ আমাকে চাল বাছতে দিয়ো দিদিমা, আমি বেছে দেব।
বুড়ি এ কথায় সোজাসুজি কোনও উত্তর দিল না, কিন্তু চোখ দেখে মনে হল, খুশিই হয়েছে। একটু চুপ করে থেকে সে বলল, হ্যাঁ রে ছেলে, তোর বাড়িতে কে আছে?
বাবা আছে। সৎমা আছে!
সৎমা? তোকে ভালোবাসে? আদরযত্ন করে?
ছাই করে!
আহা-হা খুব কষ্ট দেয় বুঝি?
মোহন কোনও উত্তর দিল না। সে তখন অন্য কথা ভাবছে।
বুড়ি পাশে বসে। আচমকা যদি দু-হাতে বুড়ির গলাটা চেপে ধরে! মারবে না। অজ্ঞান করে ফেলবে। তারপরই সে অনেক দূরে ওই যে একটা রাখাল ছেলে গোরুর পাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ছুটে তার কাছে চলে যাবে। গিয়ে বলবে, ভাই, আমাকে বাঁচাও। এই জঙ্গল থেকে বাইরে যাবার রাস্তাটা একটু দেখিয়ে দাও।
বুড়ি তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবে। শাঁখে ফুঁ দেবে কী করে? শাঁখের আওয়াজ না পেলে মোহনের পালাবার খবর মেঘার লোকেরা পাবে কী করে?
হঠাৎ বুড়ির কথায় মোহনের চমক ভাঙল, নে ওঠ, ঘরের মধ্যে যা। মেঘার আসার সময় হয়েছে।
মোহন উঠে পড়ল। সে ঘরের মধ্যে ঢুকতেই বাইরে থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
মোহন বসে বসে ভাবতে লাগল, এভাবে তাকে আটকে রেখে এদের কী লাভ! কতদিন এভাবে রাখবে?
এবারে এরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, মোহনের বাবা আর টাকা দেবে না। মোহনকে উদ্ধার করার কোনও ইচ্ছে তার নেই। কাজেই খাইয়েদাইয়ে মোহনকে কেন এরা বাঁচিয়ে রাখবে! এইবার একদিন খতম করে দেবে।
মোহন অপেক্ষা করতে লাগল।
যেমন করেই হোক পালাবার চেষ্টা করবে। কেউ তাকে সাহায্য করবে না। যা করার তাকে নিজেই করতে হবে।
যদি ধরা পড়ে, এরা তাহলে হয়তো মেরে ফেলবে। তার জন্য মোহন প্রস্তুত।