উপন্যাস
গল্প

সীমানা ছাড়িয়ে – ৪

।। চার।।

চার দিন কামাইয়ের পর সন্ধ্যাবেলা যামিনীর মা এল। তবু মোহন যামিনীর সঙ্গে দু-একটা কথা বলত, যদিও যামিনী হ্যাঁ বা না ছাড়া কোনও উত্তরই দিত না। এই বাড়ি বা বাড়ির লোকদের সম্বন্ধে যামিনী একটি কথাও বলত না।

সন্ধ্যার সময় মোহনকে খেয়ে নিতে হত। তার খাওয়া হলে দারোয়ান তালা দিয়ে চলে যেত।

সেদিন খাবারের ব্যবস্থা দেখে মোহন অবাক হয়ে গেল। আধপোড়া রুটি নয়, ভালো ভালো চারখানা রুটি। সঙ্গে বেশ বড়ো সাইজের দুখানা মাছ। আবার পেঁয়াজ কুচি।

মোহন বুঝতে পেরেছিল, তার বাবা আর তাকে উদ্ধার করতে আসবে না। পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারলেও নতুন মা সেটা দিতে দেবে না। মোহন ফিরে যাক এটা নতুন মা-র ইচ্ছা নয়।

যা চেষ্টা করার, মোহনকে নিজেই করতে হবে।

খাওয়া হতে মোহন বাথরুমে ঢুকল। সঙ্গে নিল মাছের বেশ বড়ো একটা কাঁটা আর কাগজের টুকরো। এই কাগজের টুকরোটা টুলের ওপর পেতে তার ওপর খাবারের পাত্র রাখা হত।

বিকাল থেকে গানবাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। বাড়ির লোকেরা কোনও কারণে হয়তো ফুর্তি করছে। সেইজন্য আজ খাবারদাবারের এমন সুব্যবস্থা।

বাথরুমে ঢুকে মোহন মাছের কাঁটাটা নিজের বুড়ো আঙুলে ফুটিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল।

বাথরুমে রাখা দাঁতন সেই রক্তে মাখিয়ে মোহন সাবধানে কাগজের ওপর লিখল: বড়ো বিপদ। আমাকে বাঁচান—মোহন।

হাত ধুয়ে বেরিয়ে এসে দেখল, রোজকার মতন যামিনীর মা বসে বসে ঢুলছে। অবশ্য বাইরে দারোয়ান সজাগ। মোহনের পালাবার কোনও সুযোগ নেই।

পা টিপে টিপে যামিনীর মা-র পিছনে গিয়ে মোহন কাগজটা কাঁটা দিয়ে তার থান কাপড়ে আটকে দিল, তারপর তাকে মৃদু ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দিল।

যামিনীর মা উঠে বাসন নিয়ে বেরিয়ে গেল।

যদি এই কাগজ এ বাড়ির কোনও লোকের চোখে পড়ে, তাহলে মোহনের অদৃষ্টে দারুণ নির্যাতন আছে, কিন্তু মোহন মরিয়া। যা হবার হবে, এভাবে বন্দি থাকার চেয়ে মরণও ভালো।

যামিনীর মা এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুটো গলি পার হয়ে আর-এক বাড়ি কাজ করতে গেল। ভাগ্য ভালো মোহনের, এ বাড়ির কেউ টের পায়নি। সবাই গানবাজনায় মত্ত।

অন্য যে বাড়িতে যামিনীর মা কাজ করতে ঢুকল, সেখানে লোক মাত্র দুজন। মা আর ছেলে। ছেলে কলেজে পড়ায়।

যামিনীর মা যখন বাসন মাজছে, তখন ছেলেটি কাগজের ওই টুকরোটি হঠাৎ দেখতে পেল। যামিনীর মা-র সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। সে কিছু শুনতেও পায় না। আস্তে আস্তে গিয়ে কাগজটা খুলে নিল।

কী ব্যাপার! কেউ যেন খুব বিপদে পড়েছে আর বাইরের লোকদের সেটা জানিয়ে দিতে চায়।

ছেলেটি আর অপেক্ষা করল না। কাগজটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

থানা কাছেই। দারোগা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিল। সামনে একজন পুলিশ। কাগজটা পেয়েই দারোগা সোজা হয়ে বসল। বলল, এটা পেলেন কোথায়?

কোথায় পেয়েছে, ছেলেটি বলল।

রক্ত দিয়ে লেখা বলেই মনে হচ্ছে। তলায় নাম লেখা—মোহন।

মোহন নামটা পড়েই দারোগা ভ্রূ কোঁচকাল। আরে মশাই, পারিজাত বক্সী তো এই মোহন নামের একটি ছেলেকে খুঁজছিলেন। লালবাজার থেকে আমরা এইরকম নির্দেশ পেয়েছিলাম। দাঁড়ান, দাঁড়ান।

দারোগা ফোন তুলে কার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর বলল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, পারিজাত বক্সী এখনই আসছেন।

পারিজাত বক্সী এলেন প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে। সাধারণ পোশাক। এসেই প্রথমে কাগজটা নেড়েচেড়ে দেখলেন, তারপর ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের এ ঝি কোথায় থাকে জানেন?

ছেলেটি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ জানি। একটু দূরে একটা বস্তিতে থাকে। কাজে না এলে আমাকেই মাঝেমধ্যে খোঁজ করতে যেতে হয়। ও বোবা, কানেও শোনে না, তবে কাজকর্ম ভালো করে।

চলুন, এখনই একবার তার বস্তিতে যাব। তাকে একবার আমার দেখা দরকার।

পারিজাত বক্সী আর ছেলেটি যখন বস্তিতে এসে পৌঁছাল, তখন বেশ রাত হয়েছে, কিন্তু তখনও লোকেরা জেগে। কেউ খাটিয়ার ওপর, কেউ দাওয়ায় বসে গল্প করছে।

যামিনীও বসে ছিল। ছেলেটি তাকে ডাকল, তোমার মা কোথায়?

শুয়ে পড়েছে।

একবার ডেকে দিতে পারো?

যামিনী মা-কে ডেকে দিল। যামিনীর মা ঘুমোয়নি। ঘুমোবার আয়োজন করছিল।

ছেলেটি তখন যামিনীকে বলল, তোমার মা-কে বলো, কাল ভোরবেলা যেন আগে আমাদের বাড়ি যায়। মা কালীঘাটে যাবে। আমাদের বাড়ির কাজ শেষ করে তবে অন্য জায়গায় যাবে।

যামিনী মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে, হাতের বিচিত্র ভঙ্গি করে মা-কে বুঝিয়ে দিল। যামিনীর মা ঘাড় নাড়ল, বুঝেছে।

পারিজাত বক্সী ছেলেটির সঙ্গে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে বলল, এবার চলুন, আপনার বাসাটা একবার দেখে আসি।

ছেলেটি তাকে নিয়ে এসে তার বাসাটা দেখিয়ে দিল।

পারিজাত বলল, ঠিক আছে, কাল ভোরে আবার আমি আসব। আপনার আর বের হবার দরকার নেই। যা করার আমিই করব।

পরের দিন খুব ভোরে ছেলেটির বাড়ির সামনের ফুটপাতে আধময়লা গেঞ্জি আর হাঁটুর ওপর কাপড়-পরা একটি লোককে দেখা গেল। চেহারা দেখে চাকরশ্রেণির বলেই মনে হল।

একটু পরে যামিনীর মা ঢুকল। লোকটি আড়চোখে লক্ষ করল। প্রায় আধ ঘণ্টা পর যামিনীর মা যখন বের হল তখন বেশ একটু দূরে থেকে লোকটি তাকে অনুসরণ করল।

কাল ছেলেটির কাছে খবর সংগ্রহ করেছে যে, যামিনীর মা শুধু দু-জায়গায় কাজ করে। ছেলেটির বাড়ি আর সম্ভবত বদমাশদের আড্ডায়।

যামিনীর মা একটা পানের দোকানে থামল। পান আর দোক্তা কিনে মুখে দিল, তারপর আবার চলতে শুরু করল।

সরু গলি। কোনওরকমে একটা মোটর যেতে পারে।

একটা বাড়িতে লোহার গেটে একটা গুরখা দারোয়ান বসে। যামিনীর মা যেতেই সে গেট খুলে ভিতরে চলে গেল।

লোকটি বাড়িটাকে ভালো করে লক্ষ করল। কোনও জানলা নেই। সারি সারি ঘুলঘুলি। হঠাৎ দেখলে গুদামঘর বলেই মনে হয়।

মিনিট দশেক। তারপরই বিরাট একটা কালো ভ্যান এসে দাঁড়াল। পুলিশ বোঝাই।

ভ্যানটা থামতেই পুলিশগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল। হাতে রাইফেল।

সঙ্গে একজন সহকারী কমিশনার। উদ্যত রিভলভার নিয়ে লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এই বাড়িটাই তো?

তা-ই তো মনে হচ্ছে।

সহকারী কমিশনার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশদের নির্দেশ দিল। পুলিশরা সারা বাড়ি ঘিরে ফেলল।

ব্যাপার দেখে পথচারীর দল ভিড় করে দাঁড়াল।

সহকারী কমিশনার, ছদ্মবেশে পারিজাত বক্সী আর কয়েকজন পুলিশ মিলে গেটের মধ্যে দিয়ে ভিতরে ঢুকল।

একতলায় কেউ নেই। আলকাতরার অনেকগুলো পুরোনো ড্রাম পড়ে রয়েছে।

সকলে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অন্ধকার সিঁড়ি। একজন পুলিশ টর্চ জ্বালল। সবাই ওপরে উঠতে লাগল।

দোতলায় কার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পুলিশ নিজেদের অস্ত্র ঠিক করে ধরল।

সকলে ওপরে উঠে দেখল দোতলা ফাঁকা। শুধু যামিনীর মা দাঁড়িয়ে আছে। আর কেউ কোথাও নেই।

পারিজাত বক্সী অবাক হয়ে গেলেন। ছুটে এ ঘর-ও ঘর দেখলেন, কেউ নেই। এত অল্প সময়ের মধ্যে সব গেল কোথায়?

সহকারী কমিশনার যামিনীর মা-কে প্রশ্ন করল, এরা সব কোথায় পালাল? তুই নিশ্চয় জানিস, বল ঠিক করে। না হলে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যাব।

পারিজাত বক্সী ছুটে এলেন। বললেন, আরে ও বোবা-কালা। ওকে কিছু বলে লাভ নেই। চলুন, ছাদে উঠে দেখা যাক।

সকলে ছোটো সরু সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠল।

ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি। দুটো বাড়ির মধ্যে কোনও ফাঁক নেই। সহজেই এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে যাওয়া যায়। একটা ছোটো ছেলেও পারে।

সহকারী কমিশনার বলল, আশপাশের দু-একটা বাড়ি দেখলে হয়।

পারিজাত বক্সী বললেন, দেখুন। তাঁর গলায় কোনও জোর নেই। এভাবে পাখি উড়ে যাবে সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। কী করে পুলিশ আসার খবর পেল, সেটাই আশ্চর্য।

ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর সহকারী কমিশনার পুলিশবাহিনী নিয়ে ফিরে গেল।

আশপাশের সব বাড়িগুলো গুদামঘর। তুলো আছে, সরষে আছে, কয়লা আছে। সব আছে, কেবল বদমাশগুলোই নেই।

পারিজাত বক্সী চলে এলেন। তিনি রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এভাবে বদমাশের দল চোখে ধুলো দিয়ে পালাবে, তাঁর পক্ষে এটা অত্যন্ত লজ্জার কথা।

দিন দুয়েক পরে হাওড়া পুলের পাশে যেখানে সার সার ভিখারি বসে থাকে— কানা, খোঁড়া, নুলো—সেখানে নতুন এক ভিখারির আমদানি হল। অন্ধ ভিখারি, পাকা চুল চোখের ওপর এসে পড়েছে। সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। পথচারীর দিকে হাত বাড়িয়ে কেঁদে কেঁদে পয়সা চায়।

রাত হলে আর-একটি লোক এসে অন্ধের পাশে দাঁড়ায়। তার কাঁধে ভর দিয়ে অন্ধ লোকটি বড়োবাজারের দিকে চলে যায়।

অন্ধ লোকটির ঠিক পাশেই বসে একটি নুলো ছেলে। দুটো হাত কনুই থেকে কাটা। সারাদিন রাস্তায় মাথা ঠুকে ভিক্ষা চায়।

.

কয়েকদিন পর অন্ধ লোকটি নুলো ছেলেটিকে বলল, শুনছি, সরকার থেকে আমাদের জন্য একটা আশ্রম তৈরি করে দেবে। এভাবে রোদে পুড়ে জলে ভিজে আমাদের আর ভিক্ষা করতে হবে না। তাও যদি ভিক্ষার সব ক-টা টাকা নিজে পেতাম তাহলেও কথা ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ টাকা তো অন্য লোকে ছিনিয়ে নেয়।

নুলো চুপচাপ বসে শুনল। কোনও উত্তর দিল না।

অন্ধ লোকটা আবার বলল, তোমার সব টাকা তুমি পাও?

নুলো এবার উত্তর দিল, কেন পাব না? আমার ভিক্ষা করা টাকা আবার কে পাবে! এই পয়সায় আমাকে গোটা সংসার চালাতে হয়।

অন্ধ লোকটি আর কিছু বলল না।

পরের দিন থেকে তাকে আর সে জায়গায় দেখা গেল না।

যে লোকটি অন্ধকে সকালে বসিয়ে যায় আর বিকেলে উঠিয়ে নিয়ে যায়, তাকে অন্ধ লোকটি বলল, এখানে সুবিধা হবে না। অন্য কোথাও আমাকে বসিয়ে দেবে।

কোথায় বসবেন বলুন?

মেয়ো রোডের ওপর অন্য ভিখারিদের পাশে বসিয়ে দাও, বরাত ঠুকে দেখি একবার।

সঙ্গের লোকটি বলল, মোহনের বাবা কদিন দেখা করতে এসে ফিরে যাচ্ছেন।

বেচারা মোহনের বাবা! সত্যি তাঁর কাছে আমার মুখ দেখাবার উপায় নেই। সেদিন এভাবে বদমাশগুলো হাওয়া হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি।

একটা কথা মনে হয় পারিজাতদা।

কী বলো?

ওই যে যামিনীর মা, ও কি সত্যি বোবা আর কালা? আমার তো সন্দেহ হয়। সম্ভবত সব খবর আগে থেকে ও-ই দিয়ে রেখেছিল। কেউ যে ওকে অনুসরণ করছে, সেটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল।

পারিজাত বক্সী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এইরকম একটা সন্দেহ আমারও হয়েছিল। বস্তিতে আমার একটা চর বসিয়ে রেখেছিলাম। সে রিপোর্ট দিল, যামিনীর মা সত্যিই বোবা এবং কালা। এ বস্তিতে যামিনীর মা বহু বছর আছে। সবাই এ কথা জানে।

তাহলে?

সেটাই বুঝতে পারছি না। এটুকু বুঝতে পারছি, ওদের দলের কেউ নিশ্চয় আমার গতিবিধির ওপর নজর রেখেছে। তুমি একটা কাজ করো।

কী বলুন?

তুমি মোহনের বাবাকে দিন সাতেক পরে দেখা করতে বলো।

কিন্তু ভদ্রলোক যে খুব উদবিগ্ন হয়ে উঠেছেন।

খুবই স্বাভাবিক। উদবিগ্ন আমিও হয়ে উঠেছি। মোহনকে শেষ হয়তো করবে না, কিন্তু তাকে অন্ধ বা খোঁড়া করে দিয়ে অন্য প্রদেশে চালান দেওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।

আপনার কথামতো পালা করে হাওড়া আর শেয়ালদা স্টেশনে আমি লোক বসিয়ে রেখেছি। সেরকম কিছু সন্দেহ হলেই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।

পারিজাত বক্সী ম্লান হাসলেন।

আরে, ওরা কি আর ছেলেটাকে ওভাবে নিয়ে যাবে? হয়তো বোরখা পরিয়ে মেয়েছেলে সাজিয়ে ট্রেনে তুলবে। তার চেয়ে একটা কাজ করো।

কী কাজ?

যেখানে যেখানে ভিখারিদের ঘাঁটি আছে, কাল সকাল থেকে তুমি আর আমি সেখানে ঘুরে বেড়াব। এ বেশে নয়, মোটরে ঘুরব। তাহলে অল্প সময়ে অনেকটা ঘোরা হবে। মোহনের ফোটো তো রয়েইছে আমার সঙ্গে। মিলিয়ে দেখব।

আপনার কি মনে হয়, এর ভিতর ওরা মোহনের সর্বনাশ করেছে?

কিছু বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে দলটা বেশ পাকা। যাহোক, মোহনের বাবার সঙ্গে দেখা করার আগে একবার ভিখারিদের জগৎটা দেখে নিতে চাই।

আমি আর-একটা কথা ভাবছিলাম।

কী?

ধরুন যদি মোহনের বাবা টাকাটা নিয়ে হাওড়া স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির নীচে দাঁড়ান, তাহলে নিশ্চয় কেউ টাকাটা নিতে এগিয়ে আসবে।

সম্ভবত।

তখন তাকে গ্রেপ্তার করা যায় না?

তাতে লাভ? গ্রেপ্তার করা হলে দেখবে, সে হয়তো স্টেশনের কুলি কিংবা কোনও ভিখারি। সে বলবে, এক বাবু তাকে প্যাকেটটা নিতে নির্দেশ দিয়েছিল। তারপর সারা শহর খুঁজেও সে বাবুকে তুমি পাবে না।

দুজনে আস্তে আস্তে গলির মধ্যে ঢুকে গেল।

সরু গলি। দু-পাশে উঁচু উঁচু বাড়ির সার। লোকজন বিশেষ নেই।

একধারে কালো রঙের ছোট্ট একটা মোটর। এদিক-ওদিক ভালো করে দেখে নিয়ে পারিজাত বক্সী মোটরের মধ্যে গিয়ে বসল। সঙ্গের লোকটি চালকের আসনে।

মোটরের দু-পাশের কাচে এমন রং করা যে, ভিতর থেকে দেখা যায়, কিন্তু বাইরে থেকে আরোহীদের লক্ষ করা যায় না। তা ছাড়া বন্দুকের গুলি এ কাচের কোনও ক্ষতি করতে পারে না।

মোহনের বাবাকে পারিজাত বক্সী দুপুরবেলা গঙ্গার ধারে দেখা করতে বলেছিলেন।

কথামতো একটা বট গাছের তলায় মোহনের বাবা দাঁড়িয়ে ছিল, পারিজাত বক্সীর মোটর সেখানে এসে দাঁড়াল।

শিগগির উঠে আসুন।

মোহনের বাবা উঠে বসল।

গঙ্গার তীর ধরে মোটর সোজা ছুটল। মেটিয়াবুরুজের কাছাকাছি এসে থামতে পারিজাত বক্সী বললেন, ইস, আপনার চেহারা তো বড্ড খারাপ হয়ে গিয়েছে।

সত্যিই মোহনের বাবার দেহ আধখানা হয়ে গিয়েছিল। কোটরাগত চোখ, গালের চোয়াল ঠেলে উঠেছে। মনে হল, রাতে বোধহয় একতিল ঘুমও হয় না।

মোহনের বাবা ক্লান্তকণ্ঠে বলল, আপনার কথা শুনে আমি খুব ভুল করেছি। আমার উচিত ছিল, চিঠিটা পেয়েই পাঁচ হাজার টাকা লোকটাকে দিয়ে দেওয়া। তাহলে আমার ছেলেটাকে ফিরে পেতাম।

তখনই পারিজাত বক্সী এ কথার কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। একটু ইতস্তত করে বললেন, আমি আপনার কাছে খুবই লজ্জিত। এতদিন কেটে গেল, আপনার ছেলের ব্যাপারে কোনও সুরাহা করতে পারছি না। বিশ্বাস করুন, আমি চেষ্টার ত্রুটি করছি না। আমি গত তিন দিন ধরে এ শহরে যেখানে যেখানে ভিখারি বসে, সেখানে ঘুরেছি কিন্তু আপনার ছেলের হদিশ পাইনি। আমার খুবই বিশ্বাস যে, বদমাশগুলো আপনার ছেলের চরম সর্বনাশ এখনও করেনি।

সে আমিও জানি।

পারিজাত বক্সী বিস্মিত হলেন। আপনিও জানেন? মানে?

মোহনের বাবা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। বলল, এই দেখুন, কাল আমি আর-একটা চিঠি পেয়েছি।

কাগজটা হাতে নিয়ে পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, চিঠিটা কীভাবে পেলেন?

সকালে দোকান খুলতে গিয়ে দেখি দরজার ওপর এটা আটকানো রয়েছে।

পারিজাত বক্সী চিঠিটা পড়তে লাগলেন— এই শেষবার আপনাকে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে। টিকটিকির সাহায্য নিয়ে কোনও ফল হবে না। দরকার হলে তাকেও আমরা খতম করব। আজ থেকে পনেরো দিন পর শনিবার কালীঘাট মন্দিরের দরজায় সন্ধ্যাবেলা নগদ টাকা পৌঁছে দিতে হবে। তবে এবার আর পাঁচ হাজার টাকায় হবে না। সাত হাজার টাকা চাই।

টাকা পেলে আপনার ছেলে পরের দিনই দেবীগড় রওনা হবে, কিন্তু যদি টাকা না পাওয়া যায় তাহলেও আপনার ছেলে দেবীগড় রওনা হবে, তবে সম্পূর্ণ দেহে নয়, শুধু তার মুন্ডুটি। এই শেষ চিঠি।

আগাগোড়া চিঠিটা লাল কালিতে লেখা। পারিজাত বক্সী চিঠিটা কোলের ওপর রেখে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন।

অল্প দিনেই এ লাইনে বেশ নাম করেছেন তিনি। অনেক জটিল কেসের রহস্য উদঘাটন করেছেন। পুলিশমহলের ওপরতলায় তাঁর দারুণ প্রতিপত্তি। কিন্তু সামান্য একটা ছেলে চুরির ব্যাপারে এমন অবস্থা হবে, তা তিনি ভাবতেই পারেননি। তাঁর মনে হল, হঠাৎ হয়তো মোহনের কিছু বিপদ হবে না। বদমাশের দল খোঁজ নিয়েছে মোহনের বাবা দোকানের মালিক, কাজেই বেশ কিছু পয়সার অধিকারী। তারা এটুকুও বুঝতে পেরেছে যে, পারিজাত বক্সীর চোখে ধুলো দিতে পারলে, মোহনের বাবা শীঘ্রই তার ওপর আস্থা হারাবে। বুঝতে পারবে, তার দ্বারা মোহনের উদ্ধার সম্ভব নয়, তখন হতাশ হয়ে ছেলে ফিরে পাবার আশায় টাকাটা দিয়ে দেবে।

পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি পনেরো দিন পর টাকাটা ওদের দিয়ে দিতে চান?

হ্যাঁ, সেই ইচ্ছাই আছে। পাঁচ হাজার টাকা আমি জোগাড় করেছি। বাকি দু-হাজার টাকা আমি জমি বিক্রি করে সংগ্রহ করব। এ ছাড়া আমার অন্য পথ নেই।

ঠিক আছে, আমাদের হাতে পনেরো দিন সময় আছে। দেখি এর মধ্যে কী করতে পারি।

মোহনের বাবার মুখ দেখে মনে হল, পারিজাত বক্সীর কথায় সে বিশেষ গুরুত্ব দিল না।

মোহনের বাবাকে হাওড়া স্টেশনের একটু দূরে নামিয়ে দিয়ে পারিজাত বক্সী লালবাজারে হাজির হলেন। একেবারে কমিশনার সাহেবের কামরায়।

কমিশনার চুরুট মুখে দিয়ে কতকগুলো ফোটো দেখছিলেন। মুখ তুলে বললেন, আরে কী খবর বক্সী, অনেকদিন তোমার খবর পাইনি।

পারিজাত বক্সী চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, আর খবর! একটা ব্যাপার নিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত।

কমিশনার হাসলেন, আরে, তোমরা তো ঝঞ্ঝাট নিয়ে থাকতেই ভালোবাসো। আমাদের চাকরিটাই ঝঞ্ঝাটের আর তোমরা শখ করে ঝামেলা মাথায় নাও। দাঁড়াও, এক কাপ কফি আনতে বলি।

কমিশনার কফির অর্ডার দিলেন।

পারিজাত বক্সী প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, এখন এ শহরে নামকরা ছেলেধরার দল ক-টা আছে?

কমিশনার হাসলেন, সব মহাপুরুষের নাম কি আর জানা যায়! তবে বড়ো দল ছিল গোটা চারেক। একটা দল অবশ্য পাঞ্জাবে চলে গেছে।

আস্তানার খোঁজ রাখেন?

এদের কি আর স্থায়ী আস্তানা থাকে? তোমার-আমার জ্বালায় অনবরত আস্তানা বদল করতে হয় ওদের। কেন হে, ছেলেধরার খোঁজ কেন?

পারিজাত বক্সী মোহনের কাহিনি সব বললেন।

কমিশনার খুব মন দিয়ে শুনে বললেন, ছেলেটাকে ইতিমধ্যে অন্ধ কিংবা খোঁড়া করে দেয়নি তো?

তা যদি করত তাহলে কি তার বাপের কাছে ওরকম চিঠি লিখত—টাকা দিলে ছেলে ফেরত দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে!

কিছু বলা যায় না। এরা সব পারে। টাকাটা পেলেই যে ছেলেটাকে বাপের কাছে ফেরত দেবে, তার গ্যারান্টি আছে?

পারিজাত বক্সী চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলেন।

অসৎ লোকের অসাধ্য কোনও কাজ নেই। মোহনকে হয়তো বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। যদি বাড়তি টাকা হাতে আসে, মন্দ কী!

আচ্ছা, এ দলের কোনও লোকের ফোটো আপনাদের কাছে আছে?

কয়েকজন বছর তিনেক আগে ধরা পড়েছিল, তাদের ফোটো থাকা সম্ভব। তুমি বোসো, আমি দেখছি।

কমিশনার বোতাম টিপলেন। একজন কনস্টেবল এসে দাঁড়াতে তিনি বললেন, চৌধুরী সাব।

পুলিশ বেরিয়ে গেল। একটু পরেই একজন ছোকরা পুলিশ অফিসার এসে ঢুকল। বলল, ডেকেছেন স্যার?

এঁকে চেনো তো?

হ্যাঁ, চিনি বই কী। বিখ্যাত লোক। অনেক গোলমেলে কেসের সমাধান করে দিয়েছেন।

আচ্ছা, ছেলেধরাদের যে অ্যালবামটা আছে, এঁকে দেখতে দাও।

মিনিট পনেরোর মধ্যে একটা অ্যালবাম এনে পারিজাত বক্সীর হাতে দিল অফিসারটি।

পারিজাত বক্সী পাতা উলটে ফোটোগুলো দেখতে লাগলেন। প্রায় আটজন লোকের বিভিন্ন দিক থেকে তোলা অনেকগুলো ফোটো।

পারিজাত বক্সী লক্ষ করেছেন, একটু রাত হলে অন্ধ-খোঁড়া ভিখারিদের নিয়ে যাবার জন্য লোক এসে দাঁড়ায়। কাউকে চলতে সাহায্য করে, আবার কারো জন্য কাঠের গাড়ি আসে, তাতে বসিয়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য তারা দলের কেউ নয়। চাঁইদের নির্দেশে কাজ করে। বলতে গেলে মাইনে-করা চাকর। তাদের ফোটো এ অ্যালবামে থাকা সম্ভব নয়।

তবু পারিজাত বক্সী মন দিয়ে ফোটোগুলো দেখলেন, তারপর অ্যালবামটা টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালেন।

কমিশনার বললেন, যাচ্ছ! যদি পুলিশের সাহায্যের দরকার হয় তো জানাবে।

হ্যাঁ, নিশ্চয় জানাব।

লালবাজার থেকে বেরিয়ে পারিজাত বক্সী ফুটপাতে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। এদিক ওদিক দেখলেন। তাঁর ওপর কারো নজর রাখা কিছু বিচিত্র নয়। সাবধানে তিনি নিজের মোটরে গিয়ে উঠলেন।