উপন্যাস
গল্প

সীমানা ছাড়িয়ে – ৩

।। তিন।।

চিঠি নিয়ে মোহনের বাবা উঠে পড়ল। মনে মনে ঠিক করে নিল, লীলাকে একটি কথাও বলবে না। মেয়েদের পেটে কথা থাকে না। কোথা থেকে কার কানে উঠে যাবে, তারপর বিপদ ঘটবে।

লীলাকে বলল যে, মাসে একবার যেমন কলকাতায় কাপড়ের গাঁট কিনতে যায়, তেমনই যাচ্ছে।

হাওড়া থেকে সোজা শ্যামবাজারের বাসে চড়ল। যথাস্থানে পৌঁছে পারিজাত বক্সীর বাড়ি খুঁজে নিতেও মোটেই অসুবিধা হল না।

একটি চাকর তাকে বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে ভিতরে খবর দিতে গেল।

একটু পরেই ভিতর থেকে এক থুড়থুড়ে বুড়ো এসে দাঁড়ালেন। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছেন। একটা চোখ কালো কাচে ঢাকা। বোধহয় ছানির জন্য সবে চোখ কাটানো হয়েছে। বুক পর্যন্ত ধবধবে সাদা দাড়ি। পরনে চীনে কোট আর ধুতি। বললেন, কী চান বলুন, আমিই পারিজাত বক্সী।

মোহনের বাবা হতাশ হল। সর্বনাশ, এ তো বুড়ো লোক, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না, সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। এত বয়সের লোক বদমাশদের কবল থেকে মোহনকে উদ্ধার করে আনবে, তাও কি সম্ভব?

মোহনের বাবা পকেট থেকে দুখানা চিঠি—একখানা মেজোবাবুর, আর-একখানা মোহনের, পারিজাত বক্সীর হাতে তুলে দিল।

অনেকটা সময় নিয়ে তিনি চিঠি দুটো পড়লেন, বিশেষ করে মোহনের লেখা চিঠি। তারপর মোহনের বাবার দিকে ফিরে বললেন, এটা আপনার ছেলের হাতের লেখা তো ঠিক?

মোহনের বাবা ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

চিঠিটা থাক আমার কাছে। আপনার বন্ধুকে বলবেন যে, কেসটা আমি হাত নিলাম। এ চিঠিটা আপনি পেলেন কার কাছ থেকে?

এক ভিখারি দোকানে দিয়ে গেল। সে বলল, খেয়াঘাটে এক বুড়ো নাকি তার হাতে দিয়ে গেছে। আমি আর খোঁজ করিনি।

ভালোই করেছেন। খোঁজ করলে হয়তো শুনতেন, বুড়োকে এক মাঝি দিয়েছে, মাঝিকে দিয়েছে এক কারখানার মজুর। মজুরকে দিয়েছে হাটের ডিমওয়ালা। এ চক্রের শেষ পেতেন না।

মোহনের বাবা উঠে দাঁড়াল। যাবার মুখে প্রশ্ন করল, মোহনকে আবার ফিরে পাব তো?

আশা তো করছি, তবে জোর করে কিছু বলতে পারছি না। কাল থেকেই আমি কাজে লাগব। আপনি দিন দশেক পরে মঙ্গলবার একবার খবর নেবেন। এ বাড়িতে নয়, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে সন্ধ্যা সাতটার সময়।

মোহনের বাবা বেরিয়ে এল।

পকেটের মধ্যে হাজার পাঁচেক টাকা এনেছিল। হাওড়া স্টেশনে নেমে অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক দেখছিল। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঘড়ির নীচে বিশেষ করে। তার ধারণা, মোহনের হাত ধরে কেউ হয়তো সামনে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু সেরকম কেউ এগিয়ে আসেনি।

গাঁয়ে ফিরে মোহনের বাবা মেজোবাবুকে সব জানাল। তার সন্দেহের কথাও। পারিজাত বক্সী অত বুড়ো লোক, তাঁর দ্বারা কিছু কাজ হবে, এমন সম্ভাবনা কম।

মেজোবাবু হেসে উঠল, পারিজাত বক্সী বুড়ো হতে যাবে কেন? একেবারে জোয়ান। বুড়োর ছদ্মবেশ ধরেছিল, তাই বুঝতে পারোনি। তাঁর বয়স বছর ত্রিশের বেশি নয়।

মোহনের বাবা অবাক। অমন নিখুঁত ছদ্মবেশ ধরা কি সম্ভব!

যা-ই হোক, মোহনের বাবা দোকানে বসে বটে, কিন্তু খুব অন্যমনস্ক। বিক্রির দিকে একেবারে মন নেই। কেবল মোহনের কথা ভাবে। ছেলেধরাদের কথা কিছু বলা যায়! হয়তো মোহনকে মেরেই ফেলবে। মেরে ফেলে মোহনের বাবাকে মোহনের মাথাটা পার্সেল করে পাঠাবে, গোয়েন্দা কাহিনিতে যেমন পড়া যায়।

.

দশ দিন কাটতেই এক মঙ্গলবার মোহনের বাবা কলকাতায় এসে হাজির হল। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে যখন পৌঁছাল, তখন সাতটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি।

অনেক লোক ময়দানে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পারিজাত বক্সীকে দেখা গেল না।

মোহনের বাবা মনে মনে বিরক্ত হয়ে গেল। যার কথার ঠিক নেই, এত বড়ো কাজের ভার তার ওপর দেওয়াই উচিত হয়নি।

সাতটা কুড়ি। মোহনের বাবা কী করবে যখন ভাবছে, তখন রাস্তা পার হয়ে একজন কাবুলি সামনে এসে দাঁড়াল। পরিষ্কার বাংলায় বলল, কিছু মনে করবেন না। আমার একটু দেরি হয়ে গেল।

আপনি?

কাবুলি হাসল, যার এখানে অপেক্ষা করার কথা ছিল, আমি সেই পারিজাত বক্সী। চলুন, ওদিকটা একটু নির্জন আছে। ওই গির্জার বাগানে বসে কথাবার্তা বলি।

দুজনে গির্জার বাগানে গিয়ে বসল।

পারিজাত বক্সী বললেন, আমার একটু ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে মোহনের একটা ফোটো আনতে বললে ভালো হত, তাকে চেনবার পক্ষে আমার সুবিধা হত।

মোহনের বাবা পারিজাত বক্সীর দুটো হাত আঁকড়ে ধরল। আমার বড়ো ভয় হচ্ছে। মোহনকে হয়তো মেরেই ফেলবে। দশ দিন কেটে গেছে, আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি।

অবশ্য এদের অসাধ্য কোনও কাজ নেই। তবে আমার মনে হচ্ছে, আপনার ছেলেকে মেরে ফেলে ওদের বিশেষ লাভ হবে না, যা করবে তা হয়তো মেরে ফেলার চেয়েও সাংঘাতিক।

সে কী?

এ শহরে গোটাকয়েক দল আছে যারা ছোটো ছেলেদের ভুলিয়ে নিয়ে এসে অন্ধ, খোঁড়া কিংবা অন্য কোনওরকমভাবে বিকলাঙ্গ করে দেয়। তারপর তাদের দিয়ে পয়সা রোজগার করে। অবশ্য ওরা যথেষ্ট চালাক। এক প্রদেশের ছেলেকে অন্য প্রদেশে চালান দেয়। আপনার ছেলেকে হয়তো কানপুর কিংবা কাশীতে পাঠিয়ে দেবে, যাতে চট করে ধরা না পড়তে পারে।

তাহলে উপায়?

আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি এরকম গোটা তিনেক দলের ওপর নজর রেখেছি। পুলিশ স্টেশনেও খবর দেওয়া আছে। আপনি শুধু মোহনের একটা ফোটো আমায় পাঠিয়ে দেবেন।

কোথায় পাঠাব বলুন?

আপনি হাওড়া রেলওয়ে পুলিশের কাছে আমার নাম লিখে জমা করে দেবেন, তাহলেই আমি পেয়ে যাব।

মোহনের বাবা উঠে পড়ল। ট্রেনে বসে ভাবতে লাগল, সব যেন ধীরগতিতে চলেছে। মোহনকে ফিরে পাবার আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। মানুষ এত নির্মম হতে পারে, ভাবাই যায় না। একটা জলজ্যান্ত ছেলের দুটো চোখ কী করে নষ্ট করে দেয়, কিংবা হাত-পা ভেঙে তাকে বিকলাঙ্গ করে ফেলে, মোহনের বাবা ভেবেই উঠতে পারল না। এইসব বদমাশদের কি নিজেদের ছেলেপুলে নেই?

ট্রেন একটা স্টেশনে থামতে একটা নুলো ছেলে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। একটা পয়সা দিন বড়োবাবু। সকাল থেকে না খেয়ে আছি।

অন্যদিন হলে মোহনের বাবা মুখ ফিরিয়ে নিত। কিন্তু এবার ভালো করে ছেলেটাকে দেখল। কিছু বলা যায় না, এ হয়তো আর-এক মোহন। বদমাশ লোকেরা ধরে নিয়ে গিয়ে এভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে।

পকেট থেকে পঞ্চাশ পয়সা বের করে ছেলেটার হাতে দিল মোহনের বাবা।

তারপর গ্রামে ফিরে বাড়ির কাছ বরাবর গিয়েই তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল।

জ্যোৎস্না রাত। চারদিক দিনের আলোর মতন পরিষ্কার।

বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা বট গাছ। তার নিচু ডালে সাদামতন কী একটা বাতাসে দুলছে। মোহনের বাবা কাগজটা খুলে নিল। তাতে লেখা: সাবধান। পারিজাত বক্সীর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনছ।

এদিক-ওদিক দেখে মোহনের বাবা কাগজটা পকেটের মধ্যে রেখে দিল।

বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই লীলার সঙ্গে দেখা।

মোহনের বাবা বলল, আচ্ছা, আমাদের বাড়ি কেউ এসেছিল?

হ্যাঁ, একজন এই কাগজটা দিয়ে গেছে।

মোহনের বাবা চমকে উঠল। আবার কীসের কাগজ? একটা কাগজ তো গাছের ডালে আটকে দিয়ে গেছে। সে বলল, কী কাগজ দেখি!

লীলা বলল, পলাশডাঙার মাঠে যাত্রা হবে—তারই কাগজ। পরে দেখবে, এখন রাত হয়েছে, খেয়ে নাও।

সেরাত্রে মোহনের বাবা ঘুমোতে পারল না। এপাশ-ওপাশ করল।

পারিজাত বক্সীর কাছে যাওয়া-আসা করছে, সে খবরও বদমাশদের কাছে পৌঁছে গেছে। তার মানে, এরা সাধারণ দল নয়। মোহনের বাবার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে।

পরের দিন মোহনের বাবা আলমারি খুলে একটা কাগজের ব্যাগ বের করল। এর মধ্যে অনেক পুরোনো ফোটো রাখা আছে। খুঁজতে খুঁজতে মোহনের একটা ফোটো পাওয়া গেল। স্কুলে প্রাইজের সময় অন্য কয়েকজন ছেলের সঙ্গে তোলা। মোহনের বাবা কাঁচি দিয়ে মোহনের ছবিটা কেটে নিল। ভাগ্য ভালো, এই সময় লীলা সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকে। নইলে হাজার কৈফিয়ত দিতে হত।

একটা খামে ফোটো আর কাগজটা পুরে এবং সেইসঙ্গে নিজেও একটা চিঠি লিখে মোহনের বাবা খামের মুখটা ভালো করে আটকে নিল।

এর দিন দুই পরেই কলকাতা গিয়ে রেলওয়ে পুলিশের হাতে খামটা জমা দিল সে।

পুলিশ অফিসার বলল, আপনি একটু বসুন। পারিজাতবাবু আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। আমাকে বলেছেন, আপনি এলে তাঁকে ফোন করে দিতে।

মোহনের বাবা অপেক্ষা করল।

প্রায় আধ ঘণ্টা পর প্যান্ট-কোট-পরা একটি ভদ্রলোক পাশে এসে বলল, এনেছেন খামটা?

মোহনের বাবা ফিরে দেখল। টকটকে রং। কোঁকড়ানো চুল, মুখে পাইপ। এই কি পারিজাত বক্সীর আসল চেহারা!

পুলিশ অফিসার খামটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এই যে।

আসুন আমার সঙ্গে।

মোহনের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বাইরে দাঁড়ানো একটা দামি মোটরে গিয়ে উঠলেন। তারপর চিঠিটা পড়তে পড়তে তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।

মোহনের বাবা বলল, আপনার ছদ্মবেশ থাকা সত্ত্বেও ওরা আপনাকে চিনতে পেরেছে।

হুঁ, তা-ই দেখছি। তবে আমিও চিনে গেছি ওদের। আস্তানার সন্ধান পেয়ে গেছি। প্রথম দিন বাড়িতে আসাটাই আপনার ভুল হয়েছিল। আপনাকে যে অনুসরণ করেছিল সে খোঁজ পেয়ে গেছে। আপনার আর আসবার দরকার নেই। দরকার হলে আমিই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। মনে রাখবেন, সর্বদাই আপনার পিছনে লোক আছে।

তাহলে আজও তো আপনাকে ওরা দেখে ফেলেছে?

তা দেখতে পারে, তবে আমি পারিজাত বক্সী নই।

তবে কে আপনি? মোহনের বাবা আঁতকে উঠল। তার ভয় হল, বদমাশের দলের কেউ হয়তো ছলনা করে তাকে নিজের কবজায় এনেছে।

আমি পারিজাত বক্সীর শাগরেদ। নাম বললে চিনবেন না, কারণ আমি নামকরা লোক নই। পারিজাত বক্সী এই মুহূর্তে চন্দননগরে গঙ্গার ঘাটে বজরায়। সেখানে আপনার সঙ্গে দেখা করার কথা, বদমাশদের দলকে তা-ই বোঝানো হয়েছে। তাদের আস্তানার দরজায় ভুল করে একটা চিঠি ফেলে রাখা হয়েছিল। তাতেই তারা চন্দননগর দৌড়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সে আস্তানায় আপনার ছেলে নেই। সে হয়তো অন্য কোনও দলের পাল্লায় পড়েছে।