উপন্যাস
গল্প

সীমানা ছাড়িয়ে – ২

।। দুই।।

ঝি নারকেলপাতা চিরে চিরে ঝাঁটা তৈরি করছে, সৎমা লীলা দাওয়ায় বসে তারই তদারক করছিল।

আজ কদিন মোহন নিখোঁজ। জলজ্যান্ত ছেলেটা কোথায় গেল, এটাই আশ্চর্য। লীলার ধারণা ছিল, রাত হলেই ঠিক গুটগুট করে বাড়ি এসে পৌঁছাবে। কিন্তু কত রাত কেটে গেল, ছেলেটার দেখা নেই।

অবশ্য মোহনের জন্য লীলার মায়ামমতা মোটেই নেই। ইদানীং ছেলেটা বেশ বেয়াড়া হয়ে উঠেছিল। পাছে বাড়ির কাজ করতে হয়, তার জন্য স্কুল-ফেরত টো টো করে এদিক-ওদিক কাটিয়ে আসত।

কতদিন বাবা বলেছে, আহা, ওকে দিয়ে কাজ করাও কেন? স্কুলের পড়ুয়া, লেখাপড়া আছে। কাজ করার জন্য তোমার তো আলাদা লোক আছে।

লীলা তেড়ে উঠেছে। আদর দিয়ে ছেলেটাকে একেবারে মাথায় তুলেছ। কী এমন কাজ করাই। সবরকম কাজ শিখে রাখা দরকার। বলা যায় কি, মানুষের জীবনে কখন কীরকম সময় আসে!

মোহনের বাবা আর কথা বলেনি। চুপ করে থেকেছে।

এ কথা লীলা খুবই জানে, মনে মনে মোহনের বাবা মোহনকে খুবই ভালোবাসে।

তবে সেদিন সন্ধ্যায় মারের বহর দেখে লীলাও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। লীলা ভেবেছিল, বড়োজোর কানটা মলে দেবে, কিংবা পিঠে একটা চড়। কিন্তু মোহনের বাবা যে অমন নির্মমভাবে মারবে, তা ভাবতেও পারেনি।

অবশ্য কারণটা পরে বুঝতে পেরেছে। সেদিন দোকানে বেশ লোকসান হয়েছিল। একদল খদ্দের কীভাবে চোখে ধুলো দিয়ে খানকয়েক কাপড় সরিয়ে ফেলেছিল, কেউ বুঝতেও পারেনি। দোকান বন্ধ করার আগে হিসাব মেলাবার সময় লোকসান ধরা পড়েছিল। কাজেই মেজাজ খুব খারাপ হয়েই ছিল। তারপর বাড়িতে ঢুকতেই হলধর মালি আর লীলার অভিযোগ কানে যেতেই নিজেকে আর সামলাতে পারেনি। খেপে গিয়েছিল।

যা-ই হোক, পরের দিনই মোহনের বাবা খবর এনেছিল। আগের দিন অনেক রাত পর্যন্ত গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছিল। পরের দিন স্কুলে যেতেই পল্টু আর শিবে সব স্বীকার করেছিল।

মোহনের হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনে তারা মোহনের বাবার কাছে বলেছিল, মোহন তো মালিকে ঢিল ছুড়ে মারেনি, মেরেছে শিবু। মোহন দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। মালি মিথ্যা কথা বলেছে।

মোহনের বাবা হলধরের কাছেও গিয়েছিল। আমতা আমতা করে সে বলেছে, ঠিক বুঝতে পারিনি বাবু। দুজনের গায়েই সবুজ জামা ছিল। এখন মনে হচ্ছে, মোহনদাদাবাবু দূরে গাছের তলায় যেন দাঁড়িয়ে ছিল।

ছি, ছি, ছি, মোহনের বাবার কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করল। ভালো করে খোঁজখবর না নিয়ে ছেলেটাকে এভাবে মারা খুবই অন্যায় হয়েছে। ছেলেটা কি দুঃখে আত্মহত্যা করল? মা-মরা ছেলের অভিমান একটু বেশিই হয়।

কথাগুলো লীলাকে বলতে সে কিন্তু মানতে চাইল না। সে বলেছে, না হয় ঢিলই ছোড়েনি, কিন্তু ওসব খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশতেই বা গিয়েছিল কেন? তুমি অত ভাবছ কেন? কোথায় যাবে? দেখো গুটগুট করে ঠিক এসে হাজির হবে।

মোহনের বাবা কোনও উত্তর দেয়নি। গুম হয়ে বসে ছিল। লীলা আর কথা বাড়ায়নি। সে ঠিক জানত, কয়েকদিন এখানে-ওখানে কাটিয়ে মোহন বাড়িতে ফিরে আসবে।

লীলা দাওয়ায় বসে থেকেই হঠাৎ দেখল, উঠানের বাইরে গাঁয়ের পিয়োন দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই সে বলল, মা, চিঠি।

উঠোনে ঝাঁটার কাঠি ছড়ানো বলে পিয়োন আর এগোল না।

লীলা বলল, বিন্দুর মা, চিঠি নিয়ে এসো তো।

এ বাড়িতে কালেভদ্রে চিঠি আসে। যা আসে লীলার বাপের বাড়ি থেকেই।

লীলা হাত বাড়িয়ে খামটা নিয়ে খুলল। কয়েক লাইন পড়েই ভ্রূ কোঁচকাল। চিঠির কোণে মড়ার খুলির ছাপ। কোনও ঠিকানা নেই। তলায় কোনও নাম নয়।

চিঠিতে লেখা: আপনার ছেলে মোহন আমাদের আশ্রয়ে আছে। আপনি যদি তাকে ফেরত চান, তাহলে নগদ পাঁচ হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে হাওড়া স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির নীচে সামনের মঙ্গলবার বেলা দুটো থেকে চারটের মধ্যে আসবেন। ইতি—তলায় কোনও নাম নেই।

পাঁচ হাজার টাকা!

লীলার মনে হল, এ চিঠি মোহনই কাউকে দিয়ে লিখিয়েছে। বাবার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করার ফন্দি। বারো-তেরো বছরের ছেলের পেটে পেটে কী শয়তানি বুদ্ধি! কিন্তু ছেলেটা কলকাতায় গেলই বা কী করে? এখান থেকে কলকাতা যাবার ভাড়া পেল কোথা থেকে!

লীলার মুখ-চোখের ভঙ্গি দেখে বিন্দুর মা জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁ নতুন মা, বাপের বাড়ির খবর সব ভালো তো?

লীলা সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, মোটামুটি ভালোই আছে সব।

চিঠি হাতে করে লীলা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। তারপর তক্তপোশের ওপর বসে ভাবতে লাগল। এ চিঠিটা মোহনের বাবাকে দেওয়া উচিত হবে না। মানুষটার মতিগতির কোনও ঠিক নেই। হয়তো টাকাটা নিয়ে হাওড়া স্টেশনে গিয়েই হাজির হবে। পাঁচ হাজার বড়ো কম নয়! একটা বদমাশ ছেলের পিছনে এত টাকা ঢালার কোনও মানে হয় না।

লীলা চিঠিটা নিয়ে খিড়কি-পুকুরের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক দেখে চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে কচু গাছের মধ্যে ফেলে দিল। নিশ্চিন্ত, আর কোনও ভয় নেই। মোহনের বাবা কিছু জানতেও পারবে না।

রাত্রে মোহনের বাবা ফিরে হাতপাখা নিয়ে দাওয়ায় বসল। গুমোট গরম। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না।

লীলা পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, আজ ফিরতে যে এত রাত হল?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোহনের বাবা বলল, থানায় একবার খোঁজ নিয়ে এলাম। সেখানেও তো কোনও খবর নেই।

সেখানে আবার কী খবর পাবে?

যদি পুকুরেও ডুবে গিয়ে থাকে, তাহলে তো লাশ ভেসে উঠবে।

তুমিও যেমন! মোহন খুব ভালো সাঁতার জানে। খিড়কি-পুকুর কতবার এপার-ওপার করত। জলে ডুবতে পারে না।

যদি বাসের তলায় চাপা পড়ে থাকে। দুর্ঘটনার কথা কিছু বলা যায়! আমার মন বলছে, মোহন আর নেই। বলতে বলতে শেষদিকে মোহনের বাবার গলার স্বর ভেঙে গেল। কাপড়ে দু-চোখ মুছে বসে রইল চুপচাপ।

লীলা উঠে দাঁড়াল। ছেলের শোকে লোকটা মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। একবার যদি চিঠির কথা জানতে পারে, তাহলে এখনই পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে লাফাতে লাফাতে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে হাজির হবে। তার চেয়ে কদিন কেটে গেলে মোহন যখন বুঝতে পারবে যে, টাকা নিয়ে বাবা আসবে না, তখন সুড়সুড় করে ঘরের ছেলে ফিরে আসবে। ঠিক জব্দ হবে।

দিনকয়েক পর মোহনের বাবা দোকানে বসে ছিল, হঠাৎ একটা ভিখারি এসে দাঁড়াল। বাবা, একটা পয়সা দাও বাবা। দু-দিন কিছু খাইনি।

মোহনের বাবা কর্মচারীর দিকে ফিরে বলল, ওকে দশটা পয়সা দিয়ে দাও তো।

কর্মচারী দশটা পয়সা নিয়ে ভিখিরির দিকে এগিয়ে দিল। ভিখারি তখন একটা মুখ-আঁটা খাম কর্মচারীর হাতে দিয়ে বলল, এটা মালিককে দিয়ে দিন।

কর্মচারী অবাক। খামটা মোহনের বাবার সামনে ফেলে দিয়ে কর্মচারী বলল, আপনার চিঠি।

আমার? ক্ষিপ্রহাতে মোহনের বাবা খামটা খুলল। গভীর মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ল। পড়েই গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর চিঠিটা নিয়ে তাড়াতাড়ি মোহনের বাবা বের হয়ে গেল।

ভিখারিটা ততক্ষণে খালের ধারে বাবলা গাছের তলায় গিয়ে বসেছিল, মোহনের বাবা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, এ চিঠি তুমি কোথায় পেলে?

খেয়াঘাটে বসে ছিলাম, এক বুড়োবাবু হাতে দিয়ে বলল, এই চিঠিটা ওই দোকানের মালিককে দিয়ে এসো।

বুড়োবাবু? এ গাঁয়ের?

এ গাঁয়ে তো কখনো দেখিনি। বুড়োবাবু খেয়ানৌকায় উঠে চলে গেল।

হুঁ। মোহনের বাবা আবার দোকানে ফিরে এল।

সব ব্যাপারটা কেমন রহস্যজনক মনে হচ্ছে। মোহন তাহলে বদমাশ লোকের পাল্লায় পড়েছে। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে ধারধোর করে পাঁচ হাজার টাকা হয়তো জোগাড় করা যায়, কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা দিলেই যে মোহনকে ফিরে পাওয়া যাবে, তার কী স্থিরতা! লোভের কি শেষ আছে? আরও হয়তো টাকা চেয়ে বসবে। থানায় গিয়ে পুলিশকে চিঠিটা দেখালে হয়, কিন্তু তার ফল যে ভালো হবে না, সে কথা চিঠিতে লেখাই আছে।

মোহনের বাবা তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দিল। চিঠিতে কী লেখা আছে, কাউকে কিছু জানাল না। শুধু বলল যে শরীরটা খারাপ। পথে বেরিয়ে সে ভাবল, জমিদারবাড়ির মেজোবাবুর সঙ্গে একবার আলোচনা করে দেখলে হয়। ছেলেবেলায় একসঙ্গে তারা খেলাধুলা করেছে। সে কলকাতায় বড়ো চাকরি করে। খুব বুদ্ধিমান। গতকালও দোকানে আসবার সময় তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। নিজের আমবাগানে দাঁড়িয়ে গাছের তদারক করছিল। তখন বলেছিল যে, দিন পনেরো গাঁয়ে থাকবে।

মোহনের বাবা জমিদারবাড়ির দিকে সাইকেল ঘোরাল। ভাগ্য ভালো। মেজোবাবু বাড়িতেই ছিল। নীচের ঘরে বসে হ্যাজাকের আলোয় বই পড়ছিল। মোহনের বাবাকে দেখে বলল, মোহন তো ভারী ভালো ছেলে। হঠাৎ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার মতন তো নয়। কী ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছি না।

মোহনের সম্বন্ধেই তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছি।

তা-ই নাকি? বলো, কী পরামর্শ। মেজোবাবু সামনের দিকে ঝুঁকে বসল।

মোহনের বাবা দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, দরজাটা বন্ধ করে দাও। কথাটা খুবই গোপনীয়।

মেজোবাবু রীতিমতো আশ্চর্য হল। চেঁচিয়ে বলল, ওরে, এখানে কে আছিস, দরজাটা বন্ধ করে দে। কেউ এলে ঢুকতে দিসনি। অপেক্ষা করতে বলবি।

দরজা বন্ধ হল।

মোহনের বাবা পকেট থেকে চিঠিটা বের করে মেজোবাবুকে দিল, পড়ে দেখো।

একবার, দুবার, তিনবার পড়ল মেজোবাবু। তারপর বলল, খুব সাবধানে আমাদের এগোতে হবে। একটু ভুল হলেই মোহনকে তুমি আর জীবন্ত পাবে না। এদের কোনওরকম দয়ামায়া নেই।

মোহনের বাবা বলল, তাহলে উপায়?

এক উপায় আছে। পারিজাত বক্সীর কাছে একটা চিঠি দিতে পারি। ভদ্রলোক আমার বিশেষ পরিচিত। তাঁর সঙ্গে দেখা করো।

পারিজাত বক্সী। তিনি কে?

বিখ্যাত গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর নাম শুনেছ তো?

তোমার কাছেই তাঁর অনেক গল্প শুনেছি।

তিনি আর নেই। পারিজাত বক্সী তাঁরই ভাইপো। এর মধ্যেই ভদ্রলোক খুব নাম করেছেন। চিঠিটা নিয়ে তাঁকে দেখাও। তিনি যদি কেসটা হাতে নেন, তাহলে আর চিন্তার কিছু থাকবে না।

মোহনের বাবা বলল, কিন্তু এরা যে লিখেছে চিঠি পাবার পনেরো দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যদি দেরি হয়ে যায়?

মেজোবাবু মাথা নাড়ল, না না, এত তাড়াতাড়ি ওরা কিছু করবে না। এতগুলো টাকার ব্যাপার। নিশ্চয় বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করবে।

তাহলে তুমি চিঠিই একটা লিখে দাও, আমি গিয়ে দেখা করি। ভদ্রলোকের ফি কত?

কাজ শেষ হলে ফি। এখন কিছু দিতে হবে না।

মেজোবাবু দাঁড়িয়ে উঠে আলমারি থেকে চিঠির কাগজ আর কলম বের করল। চিঠি লিখে খামে এঁটে মোহনের বাবার হাতে দিয়ে বলল, শ্যামবাজারে রতন সিকদার লেন। বাঁ-হাতি লাল বাড়ি। চিনতে কোনও অসুবিধা হবে না। তিনি কী বলেন, এসে আমাকে জানিয়ো।