।। এক।।
বাঁদিকে তালপুকুর। তার পাশ দিয়ে সরু রাস্তা। কোনওরকমে একটা লোক পায়ে হেঁটে যেতে পারে।
মোহন সে রাস্তা দিয়ে গেল না। ওখান দিয়ে গেলে খুব তাড়াতাড়ি তাদের গাঁয়ে পৌঁছানো যাবে। হাতে অঢেল সময়। অত তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবার তার দরকার নেই। সত্যি কথা বলতে কী, বাড়িতে যেতেই তার ভালো লাগে না।
বাড়ি গেলেই ঠিক কোনও না কোনও কাজ তার ঘাড়ে পড়বে। সৎমা যেন তার জন্য কাজ নিয়ে তৈরি থাকে।
বাচ্চাটাকে ধর, কিংবা বাগানের বেড়াটা আলগা হয়ে গেছে। একটু শক্ত করে বেঁধে দে, না হয় সুপারিগুলো রোদে দিয়ে আয়।
অথচ বাড়িতে ঝি আছে, মালি আছে, কিন্তু মোহনকে দেখলেই সৎমার কাজ করাতে ইচ্ছা করে।
তাই মোহন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে না। সাত রাজ্যি ঘুরে বেড়ায়। কোনওদিন মাঠ পার হয়ে, সাঁকোর ওপর দিয়ে স্টেশনে গিয়ে বসে। ট্রেন দেখতে তার খুব ভালো লাগে। একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায় আর তার কামরাগুলো থেকে হুড়হুড় করে লোক নামে। কিছুক্ষণের জন্য হইচই।
গার্ডের সবুজ নিশান দোলানোর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন তার অজগর দেহটা দুলিয়ে তেপান্তরের দিকে পাড়ি দেয়।
স্টেশন আবার ফাঁকা। গোলমাল থেমে যায়।
কোনও কোনওদিন মোহন বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। এই সময় তার সঙ্গী বিশেষ কেউ থাকে না। সবাই স্কুল-ফেরত সোজা বাড়ি চলে যায়। বলে, না ভাই, না গেলে মা ভাববে।
মোহন তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে তার সৎমা চিন্তিত হয় না, বিরক্ত হয়। বলে, কাজের ভয়ে কোথায় টো টো করে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছিল এতক্ষণ? যেমন দেরি করে এসেছ, তেমনি তোমার খাওয়া বন্ধ। আর খাওয়া পাবে সেই রাত্রে।
মোহন কিছু বলে না। চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে। তারপর চাটাইয়ের ওপর বইখাতা ছড়িয়ে খিড়কি-পুকুরে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে আসে, একটু পরেই বিন্দুর মা এসে হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে রেখে যায়।
মোহন গামছা দিয়ে হাত-পা মোছা শেষ করার আগেই বিন্দুর মা আবার ঘরে ঢোকে। হাতে কলাইয়ের বাটি। তাতে তেল-নুন-মাখা মুড়ি। মাঝে মাঝে তাতে কড়াইশুঁটিও ছড়ানো থাকে। নাও, খেয়ে নাও।
গালাগাল-বকুনিতে মোহনের কষ্ট হয় না। এসব তার গা-সওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু নরম সুরের কথা শুনলেই মোহনের দুটো চোখ জলে ভরে আসে।
ঝি বিন্দুর মা মোহনের মায়ের আমলের লোক।
মায়ের কথা মোহনের খুব আবছা মনে আছে। অনেক আগের কোনও স্বপ্ন দেখার মতন। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, তার যে কোনওদিন মা ছিল, এটাই যেন স্বপ্ন।
মা মারা যাবার পর সৎমা এল বাড়িতে। কিন্তু তার এই নতুন মা ভালো না; বড়ো কষ্ট দেয় মোহনকে।
বাড়ির দিকে নজর দেবার সময় নেই বাবার। সকালবেলা চা-রুটি খেয়ে সাইকেলে চড়ে বের হয়ে যায়।
খালের ধারে কাপড়ের দোকান।
পাশাপাশি তিনটে কাপড়ের দোকান, তার মধ্যে মহামায়া বস্ত্রালয়ের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। এই মহামায়া মোহনের মায়ের নাম। পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও মোহন মায়ের সন্ধান পাবে না। ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলে যেমন আলোর শিখা হারিয়ে যায়, তেমনই মোহনের মা-ও হারিয়ে গেছে। শুধু ওই সাইনবোর্ডের ওপর জ্বলজ্বল করে মায়ের নামটা। স্কুল-ফেরত মোহন খালের ধারে এসে দাঁড়ায়। দূর থেকে মায়ের নামটার দিকে চেয়ে থাকে। বানান করে করে পড়ে। কাছে যাবার সাহস নেই, কী জানি যদি বাবার চোখে পড়ে যায়।
.
সেদিন এক কাণ্ড ঘটল। স্কুল-ফেরত মোহন সোজা মজুমদারদের বাগানে ঢুকল। একসময় সাজানো বাগান ছিল, ইদানীং আগাছায় ভরতি।
মজুমদাররা সবাই শহরে থাকে। কালেভদ্রে এখানে আসে। সবকিছু দেখে মালি। মোহন একলা নয়, সঙ্গে পল্টু আর শিবু। দুজনেই সমান ডানপিটে।
পল্টুর খবর, গাছে নাকি কামরাঙা পেকে লাল হয়ে আছে। বেশি উঁচুতে নয়, হাত বাড়িয়েই পাড়া যায়।
মোহন মোটেই কামরাঙার ভক্ত নয়। শুধু সময় কাটাবার জন্য সে এদের সঙ্গে এসেছে। সোজা বাড়ি যাবার তার একটুও ইচ্ছা নেই।
পল্টু আর শিবু যখন একমনে কামরাঙা পাড়ছিল, তখন হঠাৎ মালির আবির্ভাব। মালি গাছের আড়াল দিয়ে একেবারে সামনে এসে পড়েছে। সে বলল, এই যে, কামরাঙা—
কিন্তু সব কথাটা আর তার বলতে হল না। শিবের হাতের একটা ঢিল সবেগে এসে পড়ল মালির কপালে।
ওরে বাবা রে, বলে চিৎকার করে মালি মাটির ওপর বসে পড়ল।
পল্টু, শিবু আর মোহন তিনজনেই হাওয়া।
এদিক-ওদিক ঘুরে মোহন যখন বাড়ি ফিরল, তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে। কিন্তু উঠোনে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াতে হল।
মালি বসে হাউমাউ করে কাঁদছে, দেখে মনে হল, সে অনেক আগেই নালিশ করতে এসেছিল। যা কিছু বলার সবই বলা হয়ে গিয়েছিল। মোহনকে চোখের সামনে দেখে আবার তার শোক নতুন করে জেগে উঠল।
মালির সামনে নতুন মা দাঁড়িয়ে। হ্যারিকেনের অল্প আলোতেও দেখা গেল, তার চোখ দুটো যেন জ্বলছে। মোহনকে দেখেই নতুন মা চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে শয়তানটা এসেছে। হ্যাঁ রে হতচ্ছাড়া, হলধরকে অমনভাবে মেরেছিস কেন? আর একটু হলে যে চোখটা যেত।
মোহন জোর গলায় বলল, আমি মারিনি।
মারিসনি? হলধর মিথ্যা কথা বলছে? সর্বনেশে ডাকাত! নতুন মা ধরবার জন্য এগিয়ে আসতেই মোহন দ্রুত পিছু হটে এল। তারপরই উঃ বলে একটা আর্তনাদ করে উঠোনের ওপর বসে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হাতে কে তার চুলের মুঠি ধরে পিঠের ওপর আঘাতের পর আঘাত করতে আরম্ভ করেছে।
মোহনের মনে হল, মেরুদণ্ড বুঝি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।
পিছন ফিরেই মোহন দেখতে পেল, তার বাবা উগ্রমূর্তিতে দাঁড়িয়ে, হাতে সাইকেলের পাম্প। সাইকেলটা বেড়ার গায়ে হেলান দেওয়া।
বাবার হাতে মার খাওয়া মোহনের এই প্রথম।
হাতের বইখাতাগুলো আগেই উঠোনের ওপর ছিটকে পড়েছিল। এবার বাবা তেড়ে আসতেই মোহন পাশ কাটিয়ে তিরবেগে দৌড়াতে শুরু করল। রাস্তা ধরে নয়, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড়াল।
এই অন্ধকারে জঙ্গল মোটেই নিরাপদ নয়। সাপখোপের ভয় আছে। কিন্তু মোহন সেসব কিছু ভাবল না। তার বুক জুড়ে দুরন্ত অভিমান। বাবা কিছু খোঁজ না নিয়েই, কেবল নতুন মায়ের কথার ওপর নির্ভর করে এভাবে তাকে মারল!
মোহন ঢিল ছোড়েনি। কে ছুড়েছে, মালি হয়তো খেয়াল করেনি। মোহনকে দেখতে পেয়ে তার নামেই নালিশ করতে এসেছে। শিব আর পল্টু বেপাড়ার ছেলে। মালি তাদের নামও জানে না। তাই যাকে চেনে তার বাড়িতেই এসে হাজির হয়েছে।
চোখের জলে সামনের সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে গেছে মোহনের। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিয়ে মোহন আবার ছুটতে আরম্ভ করল।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আর বাড়িতে নয়। কোনওদিন আর সে এখানে ফিরবে না। তার নিজের মা থাকলে কখনো তাকে এভাবে মার খেতে হত না। মা-কে সব ঘটনা বুঝিয়ে বললে নিশ্চয় বিশ্বাস করত। মা জানত, মোহন মিথ্যে কথা বলে না।
হঠাৎ তীব্র একটা শব্দে মোহন চমকে উঠল। জঙ্গলের ওপাশ দিয়ে ট্রেন চলছে। সার্চলাইটের তীব্র আলোয় জঙ্গলের এক অংশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের গতি খুব জোর নয়। তার মানে স্টেশন কাছে।
মোহন মন ঠিক করে ফেলল। ট্রেনে চড়ে শহরে চলে যাবে। শহর কলকাতা। যে শহরে উঁচু উঁচু বাড়িগুলো হাত বাড়িয়ে আকাশ ছোঁবার চেষ্টা করে। গভীর রাত্রেও আলোর মায়ায় দিন বলে মনে হয়। মানুষগুলো হাঁটে না, ছোটে।
মোহন কখনো কলকাতা যায়নি। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে যারা দু-একজন গেছে, তাদের কাছে গল্প শুনেছে। চিড়িয়াখানা, লেক, মিউজিয়াম, সার্কাস আরও কত কী!
মোহনের বাবাও বেশ কয়েকবার কলকাতায় গেছে এবং এখনও যথারীতি যেতে হয় তাকে। হাওড়ায় বুঝি হাট হয়, সেখান থেকে কাপড় কিনে এনেছে দোকানের জন্য। ফিরে এসে নতুন মায়ের কাছে কলকাতার ঐশ্বর্যের কাহিনি বলেছে।
গাছের তলায় বসে মোহন একটু বিশ্রাম করল। একটানা ছুটে দুটো পা-ই টনটন করছে। খিদেও কম পায়নি। সেই ভোরবেলা ভাত খেয়ে স্কুলে গিয়েছিল। টিফিনের সময় একটা পেয়ারা আর গোটাকয়েক কুল খেয়েছে।
বেশিক্ষণ বসে থাকতে মোহনের সাহস হল না। ঘাসের মধ্যে সাপ কিংবা বিছা থাকতে পারে।
এতক্ষণ সে বাঁচা-মরার কথা ভাবেনি। বাড়ির লোকদের ওপর, পৃথিবীর ওপর তার বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল। কিন্তু ট্রেনটা চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁচবার ইচ্ছা মনে জাগল। আর জাগল শহরে যাবার ইচ্ছা।
.
স্টেশনে পৌঁছে মোহন একটা বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল।
কাছেই কেরোসিনের আলো। সেই আলোতে দেখল, দুটো হাতে কালশিটে পড়েছে। মার আটকাবার জন্য হাত তোলার সময় চোট হাতের ওপর পড়েছে।
দু-পায়ে রক্তের ধারা। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছোটবার সময় খেয়াল ছিল না, কাঁটাগাছের ওপর পা গিয়ে পড়েছিল।
মোহন আস্তে আস্তে উঠে টেপাকলে পা ধুয়ে নিল, মুখ-হাতও। তারপর বেঞ্চে ফিরে এসে পকেটে হাত দিয়ে দেখল, প্রায় চল্লিশ পয়সা রয়েছে। রোজ বাবার দেওয়া জলখাবারের পয়সা জমিয়ে রেখেছিল। ইচ্ছা ছিল সামনের বিশ্বকর্মাপূজার আগে ঘুড়ি আর সুতো কিনবে।
কিন্তু এখনই কিছু মুখে না দিলে মোহন দাঁড়াতেই পারবে না। মারের ব্যথা তো রয়েইছে, তার ওপর পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছে। খিদের যন্ত্রণায়।
স্টেশনের পাশেই দোকান। লুচি আছে, ডাল, তরকারি, কিছু মিষ্টি। মোহন লুচি আর তরকারি খেল কুড়ি পয়সার।
পয়সা দিয়ে স্টেশনে এসে খেয়াল হল, পকেটে আর মাত্র কুড়ি পয়সা আছে। সর্বনাশ, কলকাতা যাবার ভাড়া? মাত্র কুড়ি পয়সায় নিশ্চয় কলকাতা যাওয়া যায় না। অথচ বাড়ি ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়।
যেখানে টিকিট দেয়, মোহন পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। ভিতরে একজন লোক খুব মনোযোগ দিয়ে মোটা একটা বই পড়ছে। চোখে পুরু কাচের চশমা। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল।
মোহন জিজ্ঞেস করল, কলকাতার ট্রেন কখন আসবে?
লোকটা মুখ না তুলেই বলল, আটটা পঁচিশ।
মোহন নিচু হয়ে দেখল। লোকটার পিছনের দেয়ালে একটা বড়ো ঘড়ি। সেই ঘড়িতে সাড়ে সাতটা। এখনও ট্রেন আসতে প্রায় ঘণ্টাখানেক।
আবার মোহন স্টেশনের বেঞ্চে গিয়ে বসল।
দু-একজন করে লোক জমছে স্টেশনে। প্রায় সকলেরই কাঁধে গোটানো বিছানাপত্র, হাতে লাঠি।
একসময় ট্রেন এল। স্টেশন কাঁপিয়ে। ঝম-ঝম-ঝম।
ট্রেনের অবস্থা দেখে মোহনের চোখ কপালে উঠল। কামরায় লোক যেন উপচে পড়ছে। পাদানিতে পর্যন্ত লোক। কী করে মোহন ট্রেনে উঠবে? পা রাখবারও স্থান নেই।
এক জায়গায় গোটা চারেক লোক নামল। উঠল আরও বেশি। মোহনের যখন খেয়াল হল, দেখল লোকগুলোর ধাক্কায় সে কামরার মধ্যে ছিটকে পড়েছে—বিরাট এক বিছানার বান্ডিলের পিছনে।
ট্রেন ছাড়তে লোকগুলোর কথায় বুঝতে পারল, কয়েক স্টেশন পরেই বিরাট এক মেলা শুরু হয়েছে। জায়গাটার নাম শুকদেবপুর। সেই স্টেশনেই অনেক লোক নেমে যাবে।
চোখ ঘুরিয়ে মোহন এদিক-ওদিক দেখল। কাছের বেঞ্চে তার বয়সি একটি ছেলে বসে আছে। সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে।
মোহনের চোখ তার দৃষ্টির সঙ্গে মিলতেই সে প্রশ্ন করল, তোমার সারা গা এত কেটে গেল কী করে?
মোহন একটু ইতস্তত করল, তারপর বলল, সাইকেল থেকে পড়ে গেছি।
কোনও ওষুধ দাওনি?
মোহন মাথা নাড়ল, না।
ছেলেটি মাথার কাছে টাঙানো ঝোলা থেকে একটা মলমের কৌটো বের করে মোহনের হাতে দিয়ে বলল, এটা লাগিয়ে দাও। দেখবে ব্যথা অনেক কমে গেছে।
হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে কৌটোটা ছেলেটিকে ফেরত দেবার সময় মোহন জিজ্ঞাসা করল, কখন কলকাতায় পৌঁছাব?
রাত সাড়ে দশটা। আমরা অবশ্য তার আগেই নেমে যাব।
ছেলেটির কথা শুনে মোহন একটু চিন্তিত হল।
ভেবেছিল, ছেলেটি যদি কলকাতা পর্যন্ত যায় তাহলে তার সঙ্গে যাবার সুবিধা হবে। অজানা, অচেনা ওই বিরাট মহানগরীতে একলা একলা মোহন কী করবে? কোথায় যাবে?
তা ছাড়া ভিড় কমে গেলে টিকিট চেকার ট্রেনে উঠতে পারে।
মোহনের সামনে যদি টিকিটের জন্য হাত পেতে দাঁড়ায়, তাহলে মোহন কী করবে? তার সম্বল তো মাত্র কুড়িটা পয়সা। ছেলেটা থাকলে হয়তো কিছু সুরাহা হতে পারে। ট্রেনের কামরায় টিকিট চেকার ওঠার কথা মোহন তার বাবার কাছেই শুনেছে।
যারা টিকিট দেখাতে পারে না, তাদের চেকার নামিয়ে রেলের পুলিশের হাতে জমা দিয়ে দেয়। মোহনকেও কি তা-ই করবে!
ট্রেনের দোলানির সঙ্গে মোহনের ঝিমুনি এল। চোখ দুটো আর সে খোলা রাখতেই পারছে না। হেলান দিয়ে মোহন চোখ বন্ধ করল।
যখন চোখ খুলল তখন বেশ রাত। কামরায় ভিড় অনেক কম।
মোহন চোখ খুলেই সামনের বেঞ্চের ছেলেটিকে খুঁজল। সে নেই। তার সঙ্গে ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা বোধহয় তার বাবা-মা-ই হবেন, কেউ নেই। কামরা জুড়ে সব নতুন লোক।
চোখে ঘুমের ঘোর রয়েছে। মোহন বেশিক্ষণ চোখ মেলে থাকতে পারল না, আবার চোখ বন্ধ করল।…
এবার ঘুম ভাঙল হইচই-চিৎকারে।
কামরা খালি, ট্রেন আর চলছে না। দুজন ঝাড়ুদার মোহনের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে।
সব যাত্রী নেমে গেছে। ঝাড়ুদার কামরা পরিষ্কার করতে এসেছে।
উঠে বসতে গিয়ে মোহন টের পেল সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। গায়ে হাত রাখা যায় না এমন গরম। কাতর চোখে ঝাড়ুদারদের দিকে চেয়ে মোহন বলল, আমাকে একটু ধরবে, আমি উঠতে পারছি না।
একজন ঝাড়ুদার এগিয়ে এসে মোহনের হাত ধরল। ধরেই বলল, ইস, তোমার তো খুব বোখার হয়েছে। সঙ্গে কে আছে তোমার?
মোহন মাথা নাড়ল। কেউ নেই।
একজন ঝাড়ুদার সাবধানে মোহনকে ধরে নামিয়ে আনল। সারা প্ল্যাটফর্মে জল। একটু আগে ধুয়েছে। এখানে বসবার উপায় নেই।
ঝাড়ুদার বলল, চলো, তোমাকে ওদিকে বসিয়ে দিই। মোহনকে নিয়ে সে প্ল্যাটফর্মের এদিকে এসে দাঁড়াল।
দেয়ালের ধারে একগাদা ভিখারি শুয়ে-বসে রয়েছে। তার মধ্যে মোহনের বয়সি অনেক ছেলেও আছে। মোহনকে সেখানে বসিয়ে ঝাড়ুদার চলে গেল।
মোহনের বসে থাকার মতো শক্তি নেই। সে প্ল্যাটফর্মের ওপর শুয়ে পড়ল। তেষ্টায় গলার ভিতরটা পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছে। একটু জল পেলে হত।
ধারেকাছে যে ভিখারির ছেলেগুলো রয়েছে, তাদের বললে টিনের কৌটো করে একটু জল নিশ্চয় এনে দেবে। কিন্তু বলতে গিয়ে মোহনের গলা থেকে স্বর বের হল না। দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা গালের ওপর গড়িয়ে পড়ল। প্রথমে মনে হল, রাগের ঝোঁকে বাড়ি ছেড়ে এসে সে ভুলই করেছে। এর চেয়ে নতুন মায়ের গালাগাল, মার খাওয়া ভালো ছিল। বাবার বকুনিও।
এই খোকা, এই!
প্রথমে খুব অস্পষ্ট, তারপর মোহনের কানে গেল। চোখ খুলে দেখল ভোর হয়ে গেছে। সামনে একটি লোক দাঁড়িয়ে। পরনে গরদের ধুতি, গায়ে গরদের চাদর। এইমাত্র স্নান করে এসেছে। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা।
লোকটি বলল, কাদের ছেলে? এখানে শুয়ে আছ কেন?
অনেক কষ্টে মোহন উঠে বসে বলল, খুব জ্বর হয়েছে। উঠতে পারছি না।
তা তো দেখতেই পাচ্ছি। মুখ থমথম করছে। এখানে যাবে কোথায়? কে আছে তোমার শহরে?
মোহন মাথা নিচু করে রইল।
ওঠো বাবা, ওঠো। আমার সঙ্গে চলো। তোমাকে সারিয়ে-টারিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে তবে আমার শান্তি।
লোকটি নিচু হয়ে মোহনের একটা হাত ধরল। আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে আবার বলল, ছি বাবা, মা-বাবা হচ্ছেন গুরুজন। তাঁদের ওপর কি রাগ করতে আছে! একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে, তাঁদের চেয়ে আপনজন আর সংসারে কেউ নেই। তাঁরা বকেন, মারেন ভালোর জন্যেই।
স্টেশনের বাইরে এসে মোহন অবাক। এই বুঝি হাওড়ার পুল। লোহার ওপর লোহা সাজিয়ে কী বিরাট ব্যাপার, ভাবাই যায় না। ওপরদিকে দেখলে ঘাড় টনটন করে।
সামনের রাস্তা দিয়ে জনস্রোত চলেছে। কেবল মানুষ আর মানুষ। তা ছাড়া বাস, ট্যাক্সি আর ট্রাম। অগুনতি। জীবনে মোহন এই প্রথম ট্রাম দেখল।
বাস সে দেখেছে। আর-একবার জমিদারবাড়ির ছেলেরা শহর থেকে একটা ট্যাক্সি করে এসেছিল। মোহনদের স্কুলের সামনেই ট্যাক্সি থেমেছিল। স্কুলের ছেলেরা ভিড় করেছিল ট্যাক্সি দেখবার জন্যে।
পুলের তলায় ঘোলাটে জলের স্রোত। বহু লোক স্নান করছে। এই তাহলে গঙ্গা!
মোহন যখন গঙ্গা দেখতে ব্যস্ত, তখন তার পাশে নিঃশব্দে একটা ট্যাক্সি এসে থেমেছে, লক্ষই করেনি।
নাও বাবা, উঠে পড়ো।
মোহন দেখল, লোকটা এক হাতে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে।
মোহন জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাব?
গরিবের কুঁড়েঘর একটু বিশ্রাম করবে। অসুখটা সেরে গেলে তোমার বাবার হাতে তোমায় তুলে দিয়ে আসব। দেশ কোথায় তোমার?
দেবীগড়। অ, বর্ধমান জেলায়। আমি গেছি তোমাদের গাঁয়ে। নাও বাবা উঠে পড়ো, আর দেরি কোরো না।
মোহন উঠে পড়ল। লোকটি উঠে মোহনের পাশে বসল। বসে নিজের গায়ের গরদের চাদর খুলে মোহনের গায়ে জড়িয়ে দিল।
বিশ্রী হাওয়া দিচ্ছে। এটা জড়ানো থাক।
মোহন আড়চোখে চেয়ে দেখল, লোকটার গলায় ধবধবে সাদা পইতে। ডান হাতে সোনার তাবিজ।
প্রায় আধ ঘণ্টাখানেক। অনেক গলি, উপগলি পার হয়ে ট্যাক্সি একটা বাড়ির সামনে এসে থামল।
বিরাট বাড়ি, কিন্তু জরাজীর্ণ। কার্নিশে পায়রার ঝাঁক। বট-অশথের চারা বেরিয়েছে।
ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে লোকটি নামল। তারপর মোহনের হাত ধরে নামাল।
ট্যাক্সির শব্দ হতেই দারোয়ান গেট খুলে দাঁড়িয়েছিল।
লোকটি দারোয়ানের দিকে ফিরে বলল, দারোয়ানজি, এই ছেলেটিকে দোতলায় নিয়ে যাও তো। এর শরীর খারাপ। শোবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি নীচে বাবুর সঙ্গে দেখা করে যাই।
যাবার সময় লোকটি মোহনের গা থেকে গরদের চাদরটা খুলে নিয়ে বলল, যাই বাবা, আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে।
বাড়ির তুলনায় সিঁড়ি খুব সরু। সরু আর অন্ধকার। এত অন্ধকার যে দিনের বেলাতেও আলোর দরকার।
দারোয়ান মোহনের হাতটা শক্ত করে ধরে ওপরে উঠতে লাগল। প্রশস্ত দ্বিতল, কিন্তু জনশূন্য। পাশে সার সার কামরা। সামনের কামরার চাবি খুলে দারোয়ান মোহনকে তার মধ্যে ঢোকাল।
আশ্চর্য ঘর। একটাও জানলা নেই। অনেক উঁচুতে কেবল একটা ঘুলঘুলি। অন্ধকার চোখে সহ্য হয়ে যেতে মোহন দেখল, কোণের দিকে একটা খাটিয়া পাতা।
ওই খাটিয়ায় গিয়ে বোসো, আমি তোমার জন্য বিছানা নিয়ে আসছি।
মোহন খাটিয়ার ওপর বসলে দারোয়ান চলে গেল। যাবার সময় বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
মোহন খাটিয়ার ওপর বসে এদিক-ওদিক দেখল। কামরাটা যেন জেলখানার মতন। দরজা বন্ধ হলে আর বের হবার পথ নেই।
একটু পরেই দারোয়ান ফিরল। কাঁধে বিছানা আর কম্বল। মোহন উঠে দাঁড়াতে খাটিয়ার ওপর বিছানা পেতে দিল। কম্বলটা মোহনকে গায়ে জড়াতে বলল।
এবার একটি প্রৌঢ়া ঘরে ঢুকল।
ছোটো একটা টুলের ওপর থালায় করে রুটি, তরকারি এনে রাখল। গ্লাসে দুধ। সামনে খাবার দেখে মোহনের তেষ্টাটা আবার জেগে উঠল।
আমাকে একটু জল দাও।
দারোয়ান চৌকাঠের কাছ বরাবর চলে গিয়েছিল। মোহনের কথা শুনে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আরে ওকে অত আস্তে বললে শুনতেই পাবে না। ও বোবা আর কালা। যা বলবে খুব চেঁচিয়ে বলবে! আচ্ছা, আমিই বলছি।— যামিনীর মা, খোকাকে এক গ্লাস জল দাও।
প্রৌঢ়া হেসে বলল, ঝাল? তরকারি না খেয়ে ঝাল বুঝলে কী করে?
আরে কী মুশকিল, একেবারে বদ্ধকালা।
দারোয়ান প্রৌঢ়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব চেঁচিয়ে বলল, জল, জল, জল দাও এক গ্লাস।
এবার প্রৌঢ়া বুঝতে পারল, আনছি—বলে বেরিয়ে গেল।
একটু পরেই জল এনে রাখল।
মোহন খাওয়া শেষ করে খাটিয়ার ওপর শুয়ে পড়ল। এখনও শরীরে ব্যথা আছে। জ্বরটা একটু কম।
প্রৌঢ়া থালা-গ্লাস নিয়ে যেতেই দারোয়ান বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
ক্লান্তিতে মোহনের দু-চোখে ঘুম নেমে এল।
অনেকক্ষণ পরে দরজা খোলার শব্দে মোহন উঠে বসল।
ঘরের মধ্যে এত অন্ধকার, দিন কি রাত বোঝা মুশকিল। দেখল, বিরাট চেহারার একটা লোক ঘরে ঢুকছে। হাতে একটা ব্যাগ। খাটিয়ার একপাশে লোকটা বসে বলল, দেখি, জামাটা তোলো, বুক-পিঠ দেখব।
মোহন জামাটা তুলল।
হাতের টর্চ জ্বেলে লোকটা মোহনের পিঠের দিকে দেখেই বলল, ইস, অনেকগুলো কালশিটের দাগ যে। পেটালে কে?
খুব আস্তে মোহন উত্তর দিল, বাবা।
বাবা? কী করেছিলে? লোকটার কণ্ঠস্বর যেন বাজের মতন।
তারই টর্চের আলোয় দেখা গেল লোকটার রং কুচকুচে কালো। মুখ-চোখের চেহারা অনেকটা গোরিলার মতন। খোঁচা খোঁচা চুল। লোকটার কথায় মোহন কোনও উত্তর দিল না।
প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে লোকটা মোহনকে পরীক্ষা করল, তারপর ব্যাগ খুলে গোটা ছয়েক সবুজ রঙের বড়ি বের করে দিয়ে বলল, খাওয়ার পর আর শোবার আগে একটা করে বড়ি খাবে। আজ আর কাল। কাল এমনই সময়ে আবার আমি আসব। বলে ব্যাগ বন্ধ করে লোকটা উঠে পড়ল।
তারপর রাতের খাওয়া যামিনীর মা-ই নিয়ে এল। কলাইয়ের বাটিতে ভাত, ডাল আর আলুভাজা।
মোহন যখন খাচ্ছে, তখন যামিনীর মা ইশারায় দেখাল। পাশেই কলঘর আছে। দরকার হলে যেতে পারে।
যামিনীর মা চলে গেল।
বাথরুমে ঢুকে মোহন দেখল চৌবাচ্চায় জল রয়েছে। একটা মগ। কোনও কল নেই।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে মোহন ভাবল, কী আশ্চর্য, গরদ-পরা লোকটা, যে মোহনকে হাওড়া স্টেশন থেকে এখানে এনে তুলল, সে তো সারাদিনের মধ্যে একবারও দেখা করতে এল না।
এটা কাদের বাড়ি? খেতে দিচ্ছে, ডাক্তার আসছে, সবই হচ্ছে, কিন্তু আগাগোড়া ব্যাপারটা কেমন দয়ামায়াশূন্য। রুক্ষ ব্যবহার, কঠোর কণ্ঠস্বর। ডাক্তারেরও যেন মমতার বালাই নেই।
রাত্রিবেলা ঘুম ভেঙে গেল। ক-টা বেজেছে জানবার উপায় নেই। ঠিক পাশের ঘর থেকে একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। চাপা গলায় কে কাঁদছে। মাঝে মাঝে ভারী গলায় ধমকের আওয়াজ।
মোহন বিছানার ওপর উঠে বসল। দেয়ালে কান পেতে শুনল। যে কাঁদছে তার যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। যন্ত্রণার জন্য মুখ ফুটে ভালো করে কাঁদতেও পারছে না। মোহনের মনে হল, এটা কি হাসপাতাল! রোগের যন্ত্রণায় হয়তো কেউ চেঁচাচ্ছে। ডাক্তার ধমকে থামাবার চেষ্টা করছে।
পরের দিন সকালে দারোয়ান দরজা খুলে দিল। যামিনীর মা ঘরে ঢুকে এঁটো থালা তুলে নিতে এল।
যামিনীর মাকে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই, তাই মোহন দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, রাতে কে কাঁদছিল?
দারোয়ান ভ্রূ কোঁচকাল, কাঁদছিল, কোথায়?
পাশের ঘরে বলেই মনে হল।
দারোয়ান কিছুক্ষণ কী ভাবল, তারপর বলল, ওপাশের ঘরে একটা পাগল আছে। মাঝে মাঝে চিৎকার করে। উত্তর দিয়ে দারোয়ান আর দাঁড়াল না। দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
মোহন ঘরের মধ্যে এদিক-ওদিক ঘুরল। ছোটো সাইজের ঘর। কতদিন তাকে এভাবে থাকতে হবে কে জানে? বাড়িতে এতক্ষণে নিশ্চয় হুলস্থুল পড়ে গেছে। রাত্রেই বাবা বেরিয়ে পড়েছে গাঁয়ের চেনাজানা বাড়িতে। মোহনের বন্ধুদের বাড়ি। মোহনের খোঁজে। তারপর একসময় হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।
মোহনের ভাবনা বন্ধ হয়ে গেল।
আবার দরজা খুলে গেল। এবার দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল বেঁটে একটি লোক। মাথার চুল খুব ছোটো করে ছাঁটা। পরনে গেঞ্জি আর লুঙ্গি। শক্তসমর্থ চেহারা।
লোকটা বলল, কী নাম রে তোর ছোকরা? যেমন কথার ভঙ্গি, তেমনই কর্কশ কণ্ঠ।
মোহন ভয়ে ভয়ে বলল, মোহন সরকার।
বাপের নাম কী?
অভয় সরকার।
হুঁ, কী করে?
দোকান আছে। কাপড়ের দোকান।
কাপড়ের দোকানের মালিক? তাহলে দু-পয়সা আছে। তা বাড়ি থেকে পালিয়ে এলি কেন?
মোহন কেন পালিয়েছে তা বলল, সব শেষে কাতরকণ্ঠে অনুরোধ জানাল, গরদ-পরা লোকটি বলেছিল যে, আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। এখন আমি অনেকটা ভালো আছি, এবার আমাকে বাবার কাছে পাঠিয়ে দিন।
গরদ-পরা লোক? ঠাকুরমশাই? কথা শেষ করে লোকটি হো হো করে হেসে উঠল। তারপর একসময়ে হাসি থামিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, পাঠাব বই কী। এই বাজারে তোকে অমনি অমনি দিনের পর দিন পুষব নাকি! তোদের দেশের ঠিকানাটা কী?
মোহন ঠিকানা বলল।
লোকটা উঠে দাঁড়াল, ঠিক আছে, তোর বাবাকে চিঠি লিখে দিচ্ছি। এসে তোকে নিয়ে যাবে।
লোকটা বেরিয়ে যেতেই যামিনীর মা ঢুকল। একটা মগে চা আর থালায় দুখানা আধপোড়া রুটি।
মোহন যখন খাচ্ছে, তখনই যামিনীর মা ঘরটা পরিষ্কার করে নিল। তারপর খাওয়া হতেই মগ আর থালা নিয়ে চলে গেল।
মোহন আবার পায়চারি শুরু করল। পায়চারি করতে করতেই থেমে গেল। বাথরুমের মধ্যে ঢুকে এদিক-ওদিক দেখল। এপাশে একটা জানলা আছে, কিন্তু সে জানলা খোলবার উপায় নেই। পেরেক দিয়ে বন্ধ করা।
জানলার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলোর রেখা এসে বাথরুমে পড়েছে। মোহন বাথরুমের দরজা বন্ধ করে সেই ফাঁকে চোখ রাখল। উঠোনের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। এক জায়গায় সার দিয়ে অনেকে দাঁড়িয়েছে। প্রায় মোহনেরই বয়সি, কিন্তু কেউই পূর্ণাঙ্গ নয়— কেউ নুলো, কেউ খোঁড়া, কেউ অন্ধ, কারো কোমর ভাঙা, ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সকালের লুঙ্গি-পরা বেঁটে লোকটা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কী বলছে।
এতগুলো পঙ্গু ছেলে এখানে জড়ো হয়েছে কেন? সবাই কি এখানে থাকে? এটা তাদের আস্তানা! এখান থেকে সবাই ভিক্ষা করতে বের হয়? আসবার সময় স্টেশনে, গঙ্গার ধারে সামনে বাটি সাজিয়ে অনেক ছেলেকে ভিক্ষা করতে দেখেছে।
জানলা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মোহন চুপচাপ দাঁড়াল। সব ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে ঠেকছে।
দিন পাঁচ-ছয় একভাবে কাটল।
প্রত্যেকদিনই মোহন আশা করে, তার বাবা তাকে নিতে আসবে। দরজা খোলার শব্দ হলেই উৎসুক দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে। কিন্তু না, কেউ এল না।
পরনের শার্ট-প্যান্ট ময়লা হয়ে গিয়েছে। শার্টটা নিজেই কেচে নিয়েছিল। কিন্তু আবার নোংরা হয়েছে।
সাত দিন পর আবার সেই বেঁটে লোকটা এসে ঘরে ঢুকল। এবার উগ্রমূর্তি। দুটো চোখ লাল।
সে বলল, কী রে, বাবার নাম-ঠিকানা ঠিক দিয়েছিলি তো?
উত্তর দেবে কী, মোহন প্রশ্নটা বুঝতেই পারল না।
উত্তর দিচ্ছিস না যে? লোকটা ধমক দিয়ে উঠল।
কাঁদো কাঁদো গলায় মোহন বলল, মিথ্যা নাম-ঠিকানা দিতে যাব কেন? বাবার নাম কেউ মিথ্যা বলে?
তাহলে তোর বাবা উত্তর দিল না কেন? একেবারে যে চুপচাপ।
এ কথার মোহন কী উত্তর দেবে! সে মাথা নিচু করে রইল। তাহলে কি বাবার মোহনকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছা নেই?
তা যদি হয়, তাহলে কী করবে মোহন? এরা আর কতদিন খাওয়াবে? একদিন দরজা খুলে রাস্তায় বের করে দেবে নিশ্চয়ই। তখন মোহন কোথায় যাবে? পথে পথে ঘুরে বেড়াবে?
লিখতে জানিস? লোকটা আবার গর্জন করে উঠল।
মোহনের রীতিমতো অপমানবোধ হল। সে বলল, কেন জানব না? ইংরেজি-বাংলা দুইই লিখতে জানি। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। প্রত্যেক বছর ফার্স্ট হই।
বাবাকে ইংরেজিতে চিঠি লিখতে হবে না। বাংলাই যথেষ্ট। নে, যা বলছি লেখ। লোকটা একটা কাগজ এগিয়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে একটা ফাউন্টেন পেন।
মোহন ভাবল, এ একরকম ভালোই হল। নিজের কথা বাবাকে সে নিজেই লিখবে। তাহলে নিশ্চয় বাবার মন গলবে। কাগজ-কলম নিয়ে সে বলল, ঠিক আছে, আমি লিখে রাখছি।
লোকটা চোখ পাকিয়ে তেড়ে এল; ফাজলামি করিসনি। যা বলে দেব, ঠিক তা-ই লিখবি। একটু এদিক-ওদিক হলে এক থাপ্পড়ে মুন্ডু ঘুরিয়ে দেব।
মোহন আর কথা বলল না। কলম ধরে চুপচাপ বসল।
লোকটা বলল, বাবাকে কী বলিস? বাবা, না আজকালকার ঢঙে বাপি?
মোহন বলল, বাবা।
তবে লেখ।—
বাবা, পত্রপাঠমাত্র তুমি নগদ পাঁচ হাজার টাকা হাওড়া স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির নীচে দাঁড়ানো লোকটির হাতে দেবে, তা না হলে আমাকে জীবন্ত দেখতে পাবে না। এ চিঠির তারিখ থেকে পনেরো দিন পর্যন্ত এরা অপেক্ষা করবে, তারপর যা করার করবে। যদি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করো, তাহলে কী ফল হবে আশা করি বুঝতে পারবে। ইতি তোমার আদরের মোহন।
হাতটা থরথর করে কাঁপছে। ঢিপঢিপ করছে বুক। তবু থেমে থেমে মোহন সবটা লিখল।
সে ভাবল, ছেলেধরার খপ্পরে পড়েছে নিশ্চয়। গরদ-পরা লোকটা বোধহয় এদেরই চর।
লেখা শেষ হতে লোকটা কাগজটা ছিনিয়ে নিল—কী লিখেছিস দেখি। কাগজটা চোখের সামনে ধরে বলল, হাতের লেখাটা তো ভালোই দেখছি। আমার পেটে বোমা মারলেও একটি অক্ষর বের হবে না, কাজেই পড়বার চেষ্টা করে লাভ নেই। কালুবাবুকে দিয়ে পড়িয়ে নেব। যদি দেখি একটু এদিক-ওদিক লিখেছিস, তাহলে দেয়ালে মাথা ঠুকে একেবারে ঘিলু বের করে দেব। মনে থাকে যেন।
মোহন কোনও কথা বলল না। মাথা নিচু করে রইল। এতদিন বিশেষ ভয় পায়নি। ভেবেছিল, এরা সত্যিই হয়তো বাবার হাতে একদিন তুলে দেবে। এভাবে বাড়ি থেকে চলে আসার জন্য ধমক কিংবা দু-একটা চড়চাপড়, তার বেশি কিছু নয়। ঘরের ছেলে ঘরে চলে যেতে পারবে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াচ্ছে।
পাঁচ হাজার টাকা তো অনেক টাকা। অত টাকা বাবার আছে কি না মোহনের জানা নেই। থাকলেই যে মোহনের জন্য অত টাকা বের করে দেবে, এমন সম্ভাবনা কম।
যদি টাকা না আসে, তাহলে এরা মোহনকে খতম করে দেবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
লোকটা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই মোহন বিছানার ওপর উপুড় হয়ে পড়ল। কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
লোকটার কানে বোধহয় কান্নার আওয়াজ গিয়ে থাকবে। সে এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। সে বলল, কী রে, কান্না হচ্ছে কেন? দেব গলাটা টিপে, জন্মের শোধ কান্না বন্ধ করে?
মোহন থেমে গেল। তাড়াতাড়ি বিছানার ওপর উঠে বসে বলল, বড্ড পেটের যন্ত্রণা হচ্ছে।
হোক, শুয়ে থাক মুখ বুজে। নবাবপুত্তুরের একটা না একটা লেগেই আছে। যামিনীর মা-কে বলে দিচ্ছি রাত্রে কিছু খেতে না দেয়। উপোস করলেই সব অসুখ সেরে যাবে।
দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
মোহন বাথরুমের জানলায় আবার চোখ রাখল, উঠোন খালি। কেউ নেই। মোহন চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখল। না, কাছাকাছি কোনও গাছ নেই। অনেক কাহিনিতে মোহন পড়েছে, ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য অনেক ছেলে জানলা ভেঙে কাছাকাছি গাছের ওপর লাফিয়ে পড়েছে। তারপর ডাল ধরে ধরে নেমে—দে ছুট।
কিন্তু এখানে তা হবার উপায় নেই। গাছ তো নেইই, আবার জানলায় গরাদ। লোহার গরাদ ভাঙবার সাধ্য মোহনের নেই।
মোহন বিছানায় ফিরে এল।
আজ সমস্ত দিন খাওয়া বন্ধ। সেই একবার সকালে চা আর রুটি খেয়েছে। আর কিছু পাবে বলে মনে হয় না। তবু মোহন স্নান সেরে নিল। তারপর খালি গায়ে প্যান্ট পরে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে গেল। মোহনের চেয়ে একটু বড়ো একটা ছেলে ভাত, তরকারি নিয়ে ঘরে ঢুকল।
আনন্দে মোহন চেঁচাতে গিয়েও সামলে নিল। যাক, উপোস করে কাটাতে হবে না। লোকটা শুধু ভয় দেখাচ্ছিল।
টুলের ওপর থালাবাটি নামিয়ে রাখতে মোহন জিজ্ঞাসা করল, যামিনীর মায়ের কী হল?
মা-র অসুখ করেছে।
মা? তুমি তাহলে কে?
আমি যামিনী। নাও, খেয়ে নাও। তোমার সঙ্গে কথা বলছি দেখলে বাবুরা রাগ করবে। আমি পরে এসে বাসন নিয়ে যাব।
যামিনী সন্ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল।