সীজের ফুল

সীজের ফুল
রচনাকাল ১৬. ৬. ১৩৩২- ২৭. ১২. ১৩৪০

ভূমিকা

পাঠশালায় শিক্ষকতা করিবার সময় ছাত্রদের অনুরোধে তাহাদের নাম যোগ করিয়া টুকরা টুকরা কাগজে দুই-একটি কবিতা লিখিতাম এবং অবসর। মতো অন্যান্য বিষয়েও দুই-একটি কবিতা লিখিতাম। ১৩৪০ সনে ঐসকল কবিতা। একত্র করিয়া খাতায় লিখিয়া তাহার নাম রাখিয়াছিলাম ‘সীজের ফুল’।

স্থানীয় রহমান মৃধার ছেলে ফজলুর রহমান তখন বরিশাল কলেজের ছাত্র। সহপাঠী কোব্বাত আলী মিয়া (চঁদপুর নিবাসী আলরাদ্দি শরীফের পুত্র) আমার ‘সীজের ফুল বইখানা দেখিতে চাওয়ায় ফজলুর রহমান বইখানা নিয়া তাহাকে পড়িতে দেয়। তৎপর উভয়ে বি. এ. পাশ করিয়া ক্রমে চাকুরি গ্রহণ করে এবং স্থানান্তরে চলিয়া যায়। ঘটনাক্রমে অদ্যাবধি বইখানা ফেরত পাই নাই। দীর্ঘ তেইশ বৎসরে মূল কবিতার সেই টুকরা কাগজগুলি অনেক হারাইয়া গিয়াছে, যে কয়টি টুকরা পাওয়া গেল, তাহাই একত্র করিয়া এই বইখানা লিখিলাম এবং ইহারও নাম রাখিলাম ‘সীজের ফুল’।

‘সীজ’ একটি বৃক্ষের নাম, সাধারণত ইহাকে ‘সেউজ গাছ’ বলে। এই গাছে কখনও ফুল হয় না। সীজ গাছে ফুল হওয়া যেরূপ অসম্ভব, আমার পক্ষে (১৩২১ সনে পাঠশালায় ২য় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষিতের) কবিতা রচনাও সেইরূপ অসম্ভব। তাই কবিতাগুলির নাম রাখা হইল ‘সীজের ফুল’ অর্থাৎ মূর্খের কবিতা।

প্রত্যেক অধ্যায়ের কবিতাগুলি রচনার কালক্রম অনুসারে সাজানো হল এবং রচনার তারিখও উল্লেখ করা হইল। আর বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে কয়েকটি বই শব্দের অর্থ লিখিত হইল। ‘সীজের ফুল’-এ যে সকল ভুলত্রুটি থাকিয়া গেল, তাহার জন্য পাঠকদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি।

বিনীত
গ্রন্থকার
 ১৯ ভাদ্র ১৩৬৩।

.

.

সীজের ফুল ১ম অধ্যায় নীতিমূলক কবিতাবলী

শিশু

 স্বর্ণ কুটির, পর্ণ কুটির, সব কুটিরে অধিকার–
 রাজার রাজা, মহারাজা, সবের বুকে পাও তোমার।
 ধনী, মানী আর মহান সাধু, বিদ্যাবেত্তা, বুদ্ধিমান
হরষে মজে তোমায় ভজে, চুম্বন করে পা দু’খান।
পানভোজনে, ঘুমপাড়ানে সব সময়ে দাসী চাই,
শয্যা পেতে হেগে-মুতে সেবিকা বিহনে উপায় নাই।
 তোমার গমন হয় না কখন পা রাখিয়া ধূলিতে;
ফুলবাগানে মানুষযানে গমন তোমার শান্তিতে।
ভবের হাটে দোকানপাটে লাভ-ক্ষতিতে নাহি মন।
এহেন শান্তি, কোমল কান্তি দিয়েছে তোমায় যেই জন,
(তার) চরণতরী শরণ করি, ঐদিকে যেন থাকে মন;
শেষের দিনে অধমজনে পার করে যেন নিরঞ্জন।
[১৬. ৬, ১৩৩২]

*

মনের অস্থিরতা

প্রখর রবির তেজ সহিতে না পারি,
ছাতা মাথে, পাখা হাতে যত নর-নারী
 বার বার বলি, ‘বিভো, বরষা উত্তম,
 সহিতে না পারি মোরা এহেন গরম।‘
 আসিলে আষাঢ় মাস বরিষয় ধারা,
 চলিতে না পারি কেহ এপাড়া-ওপাড়া।
 দিবানিশি পড়ে বৃষ্টি, মাঠে মাঠে জল,
 তখন বিরক্ত হই আমরা সকল।
 ডোবা হয় জলে পূর্ণ, ডাঙ্গা হয় কাদা,
 সেইকালে ভালোবাসি শীত ও সারদা।
আসিলে প্রচণ্ড শীত তাহে তনু কাঁপে,
 সেইকালে মন চলে সূরুজের তাপে।
আবার আসেন রবি মনে হয়ে রোষ।
এবার বিরক্ত হলে কার হবে দোষ?
 নির্দোষ জগতপতি; জ্ঞানহীন লোক।
সংকল্পদোষেতে পায় পদে পদে শোক।
[৩.৮.১৩৩২]

*

বিফল কি?

 রোগশয্যা-পারিপাট্যে রোগীর কি সুখ,
রোগাসুর যে পর্যন্ত না ফিরায় মুখ?
চন্দনের ফাঁসিকাষ্ঠ, সুকোমল রশি,
রজত-কাঞ্চনময় ঘাতকের অসি,
ইহা হতে বধ্যজন কিবা লভে ফল,
খলের সুমিষ্ট ভাষা তদ্রুপ বিফল।
[৬.৮.১৩৩২]

*

মাতৃহারা

শৈশব সুখের হয় মাতার যতনে।
মাতৃহীনে কিবা সুখ আছে এ ভুবনে?
 যদিও যতন করে অপর রমণী,
 যদিও প্রদান করে দুগ্ধ-ক্ষীর-ননী,
যদিও কোমল শয্যা করিয়ে রচনা
করায় শয়ন, কভু না দেয় বেদনা,
যদিও মধুর স্বরে করে সম্ভাষণ,
হয় কি মধুর কভু মায়ের মতন?
মায়ের কর্কশবাক্য, শাক-ডাল-ভাত,
মায়ের কঠিন দণ্ড, মায়ের আঘাত
 সমুদয়ে মধু মাখা, মধুময় পাই।
জগত অসার যার মা-রতন নাই।
[১৬.৮.১৩৩২]

*

কাল

কালের বিচিত্র গতি   বিচিত্র তার তরঙ্গ।
চারি যুগ ব্যাপিয়া ধরায়
নিত্য নূতন রঙ্গ ধরায়,
কভু ধরা যায় না কাল    নিজে ধরে কি বঙ্গ।
[১৫. ৫. ১৩৩৮]

*

আত্মদোষ

জগত উজ্জ্বল করে আকাশের শশী,
উজ্জ্বল না হয় তার আপনার মসি।
প্রদীপ জ্বলিয়া করে সব দিক আলো,
হয় উজ্জ্বল তার সলিতার কালো।
জগতের যত স্বাদ রসনার বশ,
রসনা বোঝে না তার আপনার রস।
 এইমত লোক কত আছে ধরাতলে —
চুরি করে নিজে, লোকে সাধু হতে বলে।
আপনার দোষ যাহা দেখিতে না পায়,
কত শত মতে তাহা পরকে বুঝায়।
[২২. ৪. ১৩৩৯]

*

পীড়িত মন

 মরমে পীড়িত অতি হয় যেই জন,
কল্পনা করিতে সেই পারে কি কখন?
 কোকিলের স্বর তার কাছে কিলিবিলি,
সুবুদ্ধি-কুবদ্ধি তার এক হয় মিলি।

[১৩, ৮, ১৩৩৯]

*

কাজের সময়

 দীপ নিভিয়া গেলে আর ফল কি আছে তৈলদানে?
চোর পালিয়ে গেলে আর লাভ কি আছে সাবধানে?
চলে গেলে জীবনপাখি বৈদ্য ডেকে হয় কি ফল?
ফল কি রে বাঁধিলে আলি শুকাইলে ক্ষেতের জল?
 সময়মতো কর্ম কর, রেখ না কখন ফেলিয়া;
কর্ম বিফল হবে গেলে কাজের সময় চলিয়া।
[৭. ১. ১৩৪০]

*

অর্থ

অর্থের অভাবে লোকে কেহ নহে কার,
সুখের সংসার হয় দুঃখের সংসার।
মাতা করে নিন্দা আর পিতা হন রুষ্ট,
 দাস-দাসী ক্রুদ্ধ হয়, ভ্রাতা হয় দুষ্ট।
সন্তান অবাধ্য হয়, না লয় বচন;
প্রেয়সী রমণী নাহি করে আলিঙ্গন।
আত্মীয়-কটুম্বগণ কাছে নাহি যায়,
কেননা, নিকটে গেলে যদি কিছু চায়?
[৭.১.১৩৪০]

*

সৎ ও অসতের মান

দুগ্ধ পবিত্র অতি সর্বজাতি খায়,
 গো-চোনা মিশিলে তাহা নষ্ট হয়ে যায়।
মিশিলে গো-চোনা কভু ঘোলের সহিত–
কিছুমাত্র নাহি হয় তাহার অহিত।
অসতে করিলে শত নিন্দনীয় কাজ,
 তাহাতে না হয় তার কিছুমাত্র লাজ।
 সতের উপরে যদি পড়ে নিন্দাবাণী,
জানিবে তখনি তার হয় মানহানি।
[১০. ১. ১৩৪০]

*

বিরক্তি

অতীব বিরক্তিকর মূর্খপল্লী বাস।
বিরক্তিজনক জান অসতের দাস,
বিরক্তিজনক জান অখাদ্য ভোজন,
বিরক্তিজনক জান ক্রোধপরায়ণ;
অতীব বিরক্তি তার মূর্খ পুত্র যার।
আরজ বলিছে এর শান্তি কোথা আর?
[১১. ১. ১৩৪০]

*

অসীম দান

হে বিভো তব অপার দান
প্রকৃতিবক্ষে জীবের প্রাণ।
 বরিষণ করি করুণাসুধা
হরিছ জীবের তৃষা-ক্ষুধা।
সাগরে, নগরে, মরূদ্যানে,
শৈলশিখরে, বাগে-বাগানে,
 যেখানে যেই করিছে খোঁজ,
 সেখানে সেই পাইছে ভোজ।
 জগতে এরূপ নাহিক ঠাঁই,
যেখানে জীবের খাদ্য নাই।
[১০. ২. ১৩৪০]

*

অশেষ আশা

 রবির অস্ত, নিশার শেষ,      শশীর বৃদ্ধি-ক্ষয়,
কালো চুলের শাদা বেশ        ভবের ভাবে হয়।
জোয়ারে জলে ভাটার টান,     জনম শেষে কাল–
জানি বিধির এই বিধান        আছয় কালাকাল।
কিন্তু আশার নাহিক ইতি,     হ’লনা ইতি মোর।
আশার ইহা উল্টা রীতি        কেন হে বিধি তোর?
[২৬, ৪. ১৩৪০]

*

আশার ছলনা

আশার আবেগে মন আপনে আপনা
 পেতেছ দারুণ দুঃখ, দেখিয়া দেখ না।
সাগরে সঁতারো সদা, শুধু শ্রম সার,
মুকুতা মেলেনা মিছে কর হাহাকার।
 আশার কুহকে তুমি ভালোমন্দ ভুলে
 করিলে কতই কাজ কালি দিয়ে কুলে।
সরল সুখের সাধ সেবিতে সময়
হলো না, হবে না। হায়! ভব মোহময়।
[২৭. ৪. ১৩৪০]

*

ঈর্ষা

পরের ভালো দেখতে নার, আপন ভালো চাও।
 পরের যাহা সবই ভালো,
আপন জিনিষ দেখ কালো;
 মন কিরে তোর চক্ষু গেল,
(কেন) ভুল দেখিতে পাও?
পরের দেখ অধিক টাকা, পরের বেশি মাল।
 পরকে দেখ শকতিশালী,
কিসে আপন বল ফুরালি?
 হয় কেন তোর চিত্ত কালি
 (দেখে) পরের উঁচু চাল?
অভাব যত আপন ঘরে, পরের দেখ নাই।
পরকে দেখ অতীব সুখী,
 পরকামিনী কনকমুখী;
 পরের সুখে আপনি দুঃখী।
সতত চিন্ত তাই।
[২৮. ৪. ১৩৪০]

*

অক্ষম

সিংহের কি বল,
হাতীই কেবল
জানে, তাই না জানে খেঁকি।
বলীর শরীরে
কত বল, বীরে
জানে, দুরবলে জানে কি?
 মধুর বসন্ত,
 তার সুখ-অন্ত
পেয়ে হর্ষে কোকিল ডাকে,
 কিবা সুখ তার,
জানিবে কি আর
বুলবুলি ও ফিঙ্গে-কাকে?
 গুণীর কি গুণ,
বুঝিতে নিপুণ
সকলভাবে গুণবান,
 নিরগুণ জন
পায়না ওজন,
মানী জানে মানীর মান।
কি অমৃত ফুলে,
জানে অলিকুলে,
বোলতা কি তার জানে খাদ?
রসিক বিহনে,
অরসিক জনে
নাহি জানে রসের স্বাদ।
কবির কল্পনা
করিতে ভাবনা —
ভাবুক বিনে শক্তি কার?
চির অন্ধ জনে
 জানিবে কেমনে,
ফুলের গায়ে কি বাহার?
[৩০. ৪. ১৩৪০]

*

নূতন ও পুরাতন

 নূতন গল্প স্ফূৰ্তিজনক, পুরান গল্পে রগড় নাই।
পুরান ঘরে বৃষ্টি পড়ে, নূতন ঘরে শান্তি পাই।
নূতন তরী চালনা করি, সন্ধি ভালো, লয় না জল,
পুরান তরী চিন্তা ভারি, হয় কি জানি রসাতল!
 নূতন ছাতা মাথায় দিলে বর্ষাজল হয় নিবারণ,
নূতন বস্ত্রে মনটি খুশি, পুরান বস্ত্রে বিষাদমন।
 তাই বলিয়া সকলভাবে নূতন দিয়া হয়না ফল–
নূতন অন্নে রসের বৃদ্ধি, পুরান চাউলে বাড়ে বল;
নূতন দাসে কাজের ক্ষতি, পুরান চাকর মূল্যবান।
সব নূতনে যতন করে –জানিবে সে জন অজ্ঞান।
[২. ৫. ১৩৪০]

*

সুখী ও দুঃখী

অজ্ঞতার অন্ধকার হৃদাগার যার
করে গ্রাস –শক্তিহ্রাস, মহাত্রাস তার।
(তার) নাহি শান্তি, নাহি কান্তি, মহাভ্রান্তি ঘটে।
 (সে) নহে সুখী, স্লানমুখী, চিরদুঃখী বটে।
জ্ঞানীজন অনুক্ষণ হৃষ্টমন রয়,
(সে) নহে দুঃখী, হাস্যমুখী-চিরসুখী হয়।
[৭. ৫. ১৩৪০]

*

নদী

তরঙ্গিনী! তব অই প্রবল তরঙ্গে
কম্পন উদ্ভব হয় নাবিকের অঙ্গে।
লৌহময় তরী ভেঙে কর খণ্ড খণ্ড,
শৈলময় গিরি ভেঙে করে দাও মণ্ড,
দুই কূল ভেঙে বৃদ্ধি কর নিজ দেহ,
রুধিতে তোমার বেগ নাহি পারে কেহ।
তৃণলতা-গুল্ম-আদি বৃক্ষ ফলবান,
দরিদ্রের গৃহ কিংবা দ্বিতল দালান,
 সকল ভাঙ্গিয়া তুমি করে দাও ক্ষয়।
 তব যুদ্ধে কোন্ বীর না মানে পরাজয়?
 দিগ্বিজয়ী বলি কিন্তু না পাও গণনা,
যেহেতু ভাঙ্গিতে না’র তুচ্ছ বালুকণা।
[১৯.১২.১৩৪০]

*

বিধির বিধান

(কাহাকেও) বিধাতা করিল দীন,
অনশনে যায় দিন,
চিন্তার অনলে চিত্ত জ্বলে।
কেহ কড়ি দিয়া, করী।
 আনিয়া খরিদ করি,
তাহে আরোহণ করি চলে।
কেহ আরোহিয়া হয়,
অতীব কাতর হয়,
পালকে শুইয়া চাহে পাখা।
 কেহবা শিবিকা বহে —
শতধারে ঘাম বহে,
আপাদমস্তক ঘামে মাখা।
কেহ করে সৌধে বাস,
 কারো অঙ্গে ছিন্ন বাস —
পুরান কুটিরে নাহি চাল।
(সে) ভাসে দুঃখসিন্ধুনীরে,
 যথা পাখি বসি নীড়ে
বানের সময়ে যাপে কাল।
হে বিভো! তুমিই দেহ
কারে বা সুন্দর দেহ,
কা’রে বা করহ বিকলাঙ্গ।
কাহারো পুরাও আশা,
 কারো শুধু ভবে আসা,
নিমেষে কাহারো সুখ সাঙ্গ।
 দেখি এই চরাচরে
যেই জন পাপাচরে,
ভবসুখ তারি ভাগ্যে রয়।
 যে করে ধর্মের সেবা,
 যে তাহারি ভক্ত সে বা
কি কারণ চিরদুঃখী হয়?
[২৭, ১২, ১৩৪০]

*

বিশ্বাসঘাতক

পৃথিবীতে যতজন অতীব পাতক,
 তার মধ্যে এক জন বিশ্বাসঘাতক।
প্রণয়, সৌহার্দ আর বাক্যের মধুতা,
বিড়ালসদৃশ তার বাহ্যিক সাধুতা।
 মনে-মুখে-কাজে যার নাহি আছে ঐক্য,
এরূপ জনের সাথে না করিও সখ্য।

*

সম্পদ ও বিপদ

মহাতেজে যবে বন দহই অনল,
 পবন আসিয়া তার বৃদ্ধি করে বল।
সেই অগ্নি পুনঃ যবে হয় ক্ষীণপ্রাণ,
পবন আসিয়া তাহে করয় নির্বাণ।
 সম্পদকালেতে যেই পৃষ্ঠপোষক,
বিপদকালেতে সেই জীবননাশক।

*

জীবন পাখি

 নিশিযোগে শাখীশাখে পাখি নানা জাতি
করয় বসতি। গেলে পোহাইয়া রাতি
যে যায় যাহার কাজ আছয় যেখানে,
চাহে ফিরিয়া আর কেহ কা’র’ পানে।
সেরূপ জীবের আয়ু যেন এক নিশি —
পরমায়ু নিশিযোগে সবে মিলি-মিশি।
প্রভাত হইয়া গেলে আয়ুর রজনী,
 কেহ কা’র’ নহে– পিতা, পুত্র ও জননী।
 যা’র পথে সেই যায়, কারে নাহি ডাকে।
আপন আপন তবু বল তুমি কাকে?
সময় হইলে পূর্ণ সবে চলে যায়,
যে যায় সে কা’র’ তরে ফিরিয়া না চায়।

*

ত্যাগ

বংশের মঙ্গল হেতু কড়ি কর দান,
গ্রামের মঙ্গল হেতু দাও যশ-মান,
সর্বস্ব করিবে ত্যাগ দেশের কারণ,
জগতের জন্য কর মৃত্যুকে বরণ।

*

রূপ ও গুণ-১

 গুণের নিকটে নাই রূপের যতন।
হলদে পাখির রূপ সোনার মতন,
গাঢ় কালিময় রূপ ময়না পাখির,
তবু তারে সযতনে দাও ননী-ক্ষীর।
সুবর্ণের কান্তি হয় যে পাখির গায়,
তোমাদের কাছে সেই কি আদর পায়?

.

সীজের ফুল  ২য় অধ্যায় বিবিধ বিষয়ক কবিতাবলী

উপদেশ

প্রথম অক্ষরে ‘হাসমত আলি’ আ. হামেদ মোল্লার পুত্র।

হাতে, মুখে, কাজে যেন থাকে এক যোগ,
সহসা না হয় যেন কটুভাষী রোগ,
মন দিয়া লেখাপড়া করিও যতনে,
তৎপর থাকিও মাতাপিতার বচনে,
 আদরে তুষিও তব প্রিয় বন্ধুজনে।
 লিখিত বচনগুলি রেখ সদা মনে।
[১. ৬. ১৩৩৯]

*

আদেশ

 প্রথম অক্ষরে ‘নিলমন’ ও নবম অক্ষরে ‘আরজালি’।

নিরালা বসিয়া পড়   আপনার পড়া,
 লইয়া হিসাব কর   রতি-মাসা-কড়া।
মজিও না নদীকূলে   জাহাজ দেখিয়া।
নকল ইহার কর   লিপিতে লিখিয়া।
[৪.৬.১৩৩৯]

*

রূপ ও গুণ—২

 চতুর্থ অক্ষরে ‘শ্রীমনরঞ্জন’ হরচন্দ্র শীলের দৌহিত্র।

 মুখের শ্রী, চোখের শ্রী বৃথা অহঙ্কার,
 সে অধম-রূপবান, গুণ নাহি যার।
শত জন রূপবান, এক গুণবান–
 ছ’ হাজার তারা যেন এক গোটা চান।
পুঞ্জ পুঞ্জ তারকারা অন্ধকারে হাসে,
 কয়জন থাকে তার বিধু যদি আসে?
[৫. ৬. ১৩৩৯]

*

গুরুজনে ভক্তি

 ১ম অক্ষরে ‘সেই আরজ আলি মা’ ও নবম অক্ষরে ‘আবদুল মনাফ মৃ.’।

সেবা কর মাতাপিতা   আর গুরুজনে।
 ‘ইনি’ ‘তিনি’ ‘যিনি’ –ইহা   বলিও বচনে।
 ‘আপনি’ ‘আপনি’ বল,   দূর কর ‘তুমি,
 রহিলে দাঁড়ায়ে কাছে।   লক্ষ্য কর ভূমি।
জলের মতন থাক   মরমে নরম,
 আঁখিতে রেখনা কভু   ন্যায়েতে শরম।
লিপ্ত থাক গুরুবাক্যে   ফল হবে তাতে,
 মারিলেও গুরু, ডাক   মৃদু মৃদু বাতে।
[৫, ৬, ১৩৩৯]

*

সরস্বতী বন্দনা

২য় অক্ষরে ‘শ্রী দেবেন্দ্রনাথ’ ভগবান হালদারের পুত্র।

শ্রী শ্রী মা সরস্বতী! তব শ্রীপদধূলি
দেখে লইতে চাই শিরে তুলি তুলি।
হবে কি না হবে দয়া পুত্র বলে মোকে?
 চন্দ্রমা গগনে, কিন্তু পায় সর্বলোকে।
বীণা করে, তাই নাম বীণাপাণি শুনি।
পথহারা কালিদাস তব দানে গুণী।
[৫.৬.১৩৩৯]

*

আদর্শ লেখা

 দ্বিতীয় অক্ষরে ‘শ্রীমুকুন্দলাল’।

 বিশ্রী লিখিবার দোষ সারাও সকলে,
নমুনা দেখিয়া লও আদর্শ নকলে।
 খুকু সবে, বালকেরা লিখে ধীরে ধীরে,
মন্দ লিখা লিখে নাহি কাটে বারে বারে।
ফলা ও বানান হইতে করিয়া যতন,
ভালো লিখা লিখ যেন ছাপার মতন।
[৬. ৬, ১৩৩৯]

*

সদালাপ

 ৪র্থ অক্ষরে ‘শ্রী আবদুল রশীদ’ আ. হা. মোল্লার পুত্র।

 চিনি, মিশ্রী, মধু মিষ্ট আর মিষ্ট গুড়,
 সবের আসল মিষ্ট বাক্য সুমধুর।
লোক সব খায় যবে মধু-মিশ্রী আনি,
সুস্বাদ দূরেতে যায়, যদি খায় পানি।
 বচনলহরী-মধু যদি কেহ পিয়ে,
স্বাদ তার নাহি যায় ধুলে জল দিয়ে।
 লোক বশীভূত হয় কথামৃত পানে।
কি সম্পদ তার, যেই মিষ্ট কথা জানে?
[৬. ৬. ১৩৩৯]

*

ঈশ্বর

২য় অক্ষরে ‘সতীশ্চন্দ্র শীল’ অশ্বিনীকুমার শীলের পুত্র।

বাসনা পুরাও সদা বলি ‘হরি হরি’,
 অতীব মধুর নাম লও প্রাণ ভরি।
আশ্চর্য মহিমা তার কে বুঝিতে পারে?
 ইন্দ্ররাজা স্বর্গে থাকে, তবু পূজে তারে।
বশীভূত থাক সদা বিভুর চরণে।
বল কে সহায় তব জনমে-মরণে?
[৬. ৬. ১৩৩৯]

*

অকর্মা

 ২য় অক্ষরে ‘আবদুল্লতিফ’ আ. করিম মুন্সীর পুত্র।

 যে আশাতরুর মূলে ঢালে কর্মজল,
অবশ্য তাহার গাছে ফলে মিষ্ট ফল।
কি দুরাশা তার যেই কর্মে না দেয় হাত,
ফুল্ল কুসুম তাহার হবে কি সাক্ষাত?
বাতি জ্বালাইয়া যেই তৈল নাহি দিবে,
কি ফল হইবে তাহে, আলো কি পাইবে?
[১০. ৬. ১৩৩৯]

*

পরকাল

 ২য় অক্ষরে ‘সিরাজউদ্দীন’ মফেজদ্দির পুত্র।

 আসিয়া ভবের হাটে নাহি কর খেলা,
তাড়াতাড়ি কেন-বেচ অই যায় বেলা।
 রজনী আসিবে যবে ঘোর অন্ধকার,
 কি উপায় সে সময়ে হইবে তোমার?
উদ্দীপিত কর তুমি ঐ দিনের বাতি।
জান না দুর্গম পথ, অন্ধকার রাতি?
[১০. ৬, ১৩৩৯]

*

চিন্তা

১ম অক্ষরে ‘আজাহার আলি মেছেরদ্দির পুত্র, হবিনগর।

আগে ভাব, আগে চিন্ত, কাজ কর পাছে।
জাহির না কর আগে মনে যাহা আছে;
হাতে কাজ, মুখে কথা, মনে চিন্তা রাখ।
রজনী গভীর কালে খোল চিন্তা আঁখ —
আসিবে অনেক চিন্তা, কিন্তু এক রেখে,
 লিপিবদ্ধ কর মনে শব্দে শব্দে লিখে।
[১০.৬.১৩৩৯]

*

অনিত্য যৌবন

 ৩য় অক্ষরে ‘নজরালি’ ছলেমদ্দির পুত্র।

 যৌবন জোয়ারে-জল কলকল হাঁকে,
 ফিরোজ ফিরিতে কাল সমুদুর ডাকে।
ইশারা বুঝিয়া লোক নাহি চলে কেহ,
এ কেলি রাখিয়া কালে ডুবিবে এ দেহ।
[১১.৬.১৩৩৯]

*

জ্ঞান

১ম অক্ষরে ‘মো. এছমাইল’ উজীরদ্দি গোলদারের পুত্র।

 মোদের পিতা ও মাতা, দাদা ছিল চাষা,
এখনো থাকিব তাই মনে করি আশা।
ছড়াইব ক্ষেতে বীজ, জন্মাইব শস্য,
 মাঠে বেড়াইব গায়ে মেখে ধুলা-ভস্ম।
ইহা ব’লে বিদ্যা করতে আছে নাকি বাধা?
লইলে বিদ্যানে চাষ, জ্ঞানে (কি) লাগে কাদা?
[১.৬.১৩৩৯]

*

চরিত্র

১ম অক্ষরে ‘সাহাদত আঁলি’ মেলন খাঁয়ের পুত্র।

সাহিত্য, গণিত কিংবা অন্য পাঠ পড়,
হাদিস, তফসির পড়ে নসিহত কর।
 দরিদ্র যদিও হও, কিংবা ধনবান,
তথাপি জানিও তব অভাব প্রধান —
আপন চরিত্র যদি সৎ নাহি হবে,
লিখিয়া পড়িয়া মান বাড়াইবে কবে?
[১১. ৬, ১৩৩৯]

*

মো

মোহমদে মত্ত মূঢ় মন মধুকরে
বুঝালে বোঝেনা, বোকা বনে বনে চরে।
 সৌন্দর্য না আছে যেই কুসুমের গায়,
কেন অলি, কিসে ভুলি, সে প্রসূন চায়?
 জানিলাম ভ্রমরের ইহাই স্বভাব,
ফোঁটা ফুলে ভালোবাসা জাতিগত ভাব।
না ফুটেছে যেই ফুল, এখনো সে কলি,
তাহাতেও মত্ত হয় সে কেমন অলি?
 মদ, গাঁজা, অহিফেন, ভাং অথবা সিদ্ধি
খায় নাই, তবু কেন মত্ত তার বুদ্ধি?
বুঝেছি বুঝেছি, অলি মত্ত মোহমদে;
কিন্তু মোহ না সারা’লে পড়িবে বিপদে।
[১২.৬.১৩৩৯]

*

মাতৃবিয়োগ

(আমার) সংসার সাগর মাঝে সুখতরীতে
 (আমি) শান্তি মালে বোঝাই দিয়েছিলেম তাহাতে।
মহানন্দে পাল তুলিয়ে
 ঘুমে ছিলেম সব ভুলিয়ে?
শুনিলাম হঠাৎ মোরে
মাজী বলিছে, ‘ওরে,
(তুই) সজাগ হইয়া দ্যাখ না বাছা চোখেতে?’

 (বলে) ‘দ্যাখ এসে গেল ভেসে শান্তিভরা তোর’।
 (আমি)। ডাক শুনিয়া গেলাম কাছে হইয়া কাতর।
বলে, ‘আচম্বিতে আল ঝড়ি,
ধর বাছা তোর সুখের তরী।
 নিকটে যাইয়া মাথে
ধরিলাম ডাহিন হাতে।
 (বলে) ‘আজ ডুববে তরী কালশমনের বড় জোর’।

(আমার) সুখতরণী মা জননী ছিল চিরকাল,
শান্তি বোঝাই ছিল তাতে, আর ছিল পাল।
 (আমার) হাতের তরী হাতে ধরা,
দশ মিনিটে সাধের ভরা
ডুবিল শুকনা পাড়ে–
নদী না, বসতঘরে।
আরজ কয়, ‘উদ্ধারিও হে খোদা তার পরকাল’।
[২৪. ৮. ১৩৩৯]

*

অভিনন্দনপত্র

 লাখুটিয়ার জমিদার বাবু সুরেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরীর লামচরি আগমন উপলক্ষে।

কৃপাসিন্ধু, দয়ার সাগর, বিপত্তারণ এ ধরায়;
মহামহিম! মহিমার্ণব মহাত্মা বাবু এস. কে. রায়।

জয় ভগবান,     সর্বশক্তিমান,
জয় জয় ভবপতি।
এ বিশ্ব সংসার     রচনা তোমার,
তোমাতেই থাকে মতি।
 জয় সুরপতি,      অগতির গতি,
জয় ব্রহ্ম সনাতন।
জয় দেবরাজে,     গোলক সমাজে,
মা’র প্রজা দেবগণ।
জয় হৈমবতী,     দক্ষসুতা সতী।
 জয় জয় বীণাপাণি,
তব কৃপাছবি     কালিদাস কবি,
রাষ্ট্র চরাচরে জানি।
জয় লক্ষ্মী মাতা,     নরে রত্নদাতা।
জয় অন্নপূর্ণা মাতঃ।
জয় জগদ্ধাত্রী,    তুমি পূজাপাত্রী —
কিন্তু আমি নারি তা তো।
 আমি যে যবন,    না জানি পূজন,
নাহি মানি বেদবাণী।
কোরানে বারণ,    ত্যাগী সে কারণ।
কৃপা কর শূলপাণি।

যদিও যবন আমি দেবধর্ম অরি,
 তথাপি কতক দেবে সদা মান্য করি।
মাতা দেবী, পিতা দেব, দেব শিক্ষাগুরু;
 পূজি এ সকলে দিয়ে ভক্তির অগুরু।
পরম দেবতা যিনি রাজ্য অধিকারী–
 সর্বশাস্ত্রমতে তাঁর পূজা দিতে পারি।
 কিন্তু ভগবান মোর সদাই বিমুখ,
তাই আমি নাহি পাই রাজপূজা সুখ।
অর্থের অভাবে নারি করিতে অর্চনা,
 বিদ্যার অভাবে নারি করিতে বন্দনা।
হৃদয়ে বাসনা কিন্তু লক্ষ্মী মোর বাম,
 কোথায় পাইব আমি পূজা সরঞ্জাম?
 কোথায় পাইব আমি দুর্বা-চন্দন-ফল?
কোথায় পাইব আমি পূত গঙ্গাজল?
কোথায় পাইব পশু পদে দিতে বলি?
কোথায় পাইব আমি পূজা-ফুল-কলি?
কোথায় পাইব আমি পূজার ব্রাহ্মণ?
 আমাকে সৃজিল বিভু অস্পৃশ্য যবন।
অলক্ষ্যে দেবতা থাকে, লক্ষ্যেতে প্রতিমা–
সেই পূজা দিতে নাহি সরঞ্জামী সীমা;
সাক্ষাতে দেবতা হলে তার পূজা দিতে
মহজ্জন বিনে আর কে পারে মহীতে?
লঙ্কায় সাক্ষাত দিল দেবী দশভুজা,
নয়নকমল দিয়ে রাম দিল পূজা।
আপনিও আমাদের সাক্ষাত দেবতা,
তাই ভেবে হলো মোর জ্ঞানের জড়তা।
 কি দিয়ে পূজিব আমি ও হেমচরণ?
 কেমনে লইব আমি ওপদে শরণ?
কি দিব কি দিব বলে হয়ে হতজ্ঞান,
শ্রীচরণে করিলাম (মম) দেহপ্রাণ দান।

হেন লয় মতি
 (তব) কণ্ঠে সরস্বতী
করয় বসতি সদা খুশীতে।
বুঝি সে কারণে
উঁচু নিচু জনে
মধুর বচনে দেখি তুষিতে।
 মা লক্ষ্মী অলক্ষ্যে
আপনার কক্ষে
নিশিদিন রক্ষে ধনের গোলা,
তাই বিতরণে
দীন-দুঃখী জনে
ভিক্ষায় ভোজনে রয়েছে খোলা।
(তব) যশের সৌরভ,
কুলের গৌরব,
কাজের পৌরব সকল পূরা।
উঠেছে গগণে
ঠেকেছে সঘনে,
করমশৈলের কিরতীচূড়া।
ভুবনে মেলে না
(তব) রূপের তুলনা —
জিনে রূপা-সোনা অঙ্গের কান্তি।
দেব আশীর্বাদে
এড়িয়ে বিপদে
আছেন সম্পদে, হৃদয়ে শান্তি।
অতি গুণবান,
মহা ধনবান,
বিশিষ্ট ধীমান ধরায় ধরা।
রাখে নিরঞ্জনে
শান্তি নিকেতনে
পুত্র-কন্যাগণে সতত ভরা।

মদন দেবের সমান রূপ,   কুবের সমান ধন।
 ইন্দ্রের সম মোদের ভূপ,   ভীমের সমান পণ।
করমে বিশ্বকরমা যথা,   ধর্মে যেন যুধিষ্ঠির।
মধুর সম মুখের কথা,   সত্যবাদী, মতি ধীর।
বৃন্দাবনে রাখালরাজে   বাজাত মোহন বেণু,
শুনতে তাহা বনের মাঝে   হাজির হইত ধেনু;
মহারাজের মুখের বাণী   যেমন কালার বাঁশী,
ত্যাগ করিয়া অন-পানি   তাহাই শুনিতে আসি।
প্রজা পুত্র, রাজা পিতা,   তাই পরমাদ–
 পুত্র হইয়া কি দিব   পিত্রে আশীর্বাদ?
হৃদয় মন্দিরে কিন্তু   আবেগ নাকাড়া
আশীর্বাদ দিতে মোকে   দিচ্ছে তবু সাড়া।
 ‘সুর’ অর্থ স্বর্গপুরী,   ‘ইন্দ্র’ অর্থ রাজা,
মিলিয়ে উভয় শব্দ   তব নাম তাজা।
‘সুরেন্দ্র’ নামের অর্থ   হয় স্বর্গরাজ।
আশীর্বাদ করি রাজ্য   হোক স্বর্গমাঝ।
 ধরাধামে বিত্তবৃদ্ধি   হোক দিনে দিনে।
 রবি যেন স্থান না পায়  তব রাজ্য বিনে।
উন্নতি পতাকা তব   উঠুক আকাশে,
তারকা হইয়া থাক   তারকার পাশে।
ষড়রিপু পরাজিত   হোক মর্মদেশে,
 বাহ্যিক হিংসুকগণ   লয় হোক শেষে।
রোগাসুর যেন নাহি   যায় তব হর্মে,
দ্বারেতে দাঁড়িয়ে যেন   রক্ষা করে ধর্মে।
(তব গৃহে) না বহে শোকের ঝড়,   নিবারুক হরি,
গোকুলে রাখিল যথা   গোবর্ধন ধরি।
বিধাতার কৃপাবৃষ্টি  হইয়ে যথাকালে
আশাবৃক্ষে হোক ফল  প্রতি ডালে ডালে।
পবন বহিয়ে তব  যশের সুগন্ধ
দিগন্তে বিতরে যেন  নাহি রয় বন্ধ।
 ধনে, জনে, মানে গৃহ  হোক ভরপুর।
 মর্যাদা বাড়ক যথা   গৌরীশৃষ্ণচূড়।
চন্দ্রের সুকান্তি হোক,   রবির প্রতাপ,
দেহমন শুচি হোক,   ঐহিকে নিষ্পাপ।

উমার চিন্তায় মহেশ পাগল,
রতির চিন্তায় কাম,
সীতার চিন্তায় রাঘব পাগল,
রাধার চিন্তায় শ্যাম।
শ্যামের চিন্তায় পাগল হইয়ে
জয়দেব উদাসীন,
রামপ্রসাদও হইয়ে পাগল
কালীপদে হয় লীন।
মহৎ চিন্তায় পাগল হইল
বিবেকানন্দ স্বামী,
অন্নের চিন্তায় মগন হইয়া
পাগল হলেম আমি।
 অন্য চিন্তা নাই কিছুই আমার
অন্নের চিন্তাই সার,
 অন্নের ভাবনা ভাবিয়া ভাবিয়া
অস্থিচর্ম হই সার।
 দারিদ্র রাক্ষুসী আসিয়া ভবনে।
করিয়াছে গ্রাস মোকে।
বিধির হাতে সব নিধির তোড়া
(কেন) আমায় রাখিল শোকে?
কিসের ধরম, কিসের করম,
কিসের বা যত-যাগ?
চিন্তা দেবীর বাহন হইয়া
মাথায় হইল দাগ।
মাথা হইল মোর মজ্জাবিহীন,
তিকত হইল ভাষ।
 এ হেতু বলিয়া গিয়াছে অতীতে
মহাকবি কালিদাস —

“দরিদ্রস্যঃ গুণাঃ সর্বেঃ ভস্মাচ্ছাদিতঃ বহিবৎ,
অন্নঃ চিন্তাঃ চমৎকরাঃ কা তরেঃ কবিতা কুতঃ।”

শকতি সুবুদ্ধি সকল ফুরাল,
সম্বল মোটেই নাই,
 মহারাজের চরণতরী আমি
কি ল’য়ে দেখতে যাই?
 (টাকা) কোথায় পাইব? কোথায় যাইব?
সতত তাহাই ভাবি।
 কি দিয়ে এখন করিব পূরণ
বকেয়া করের দাবি?

মহারাজের চরণতলে এই মিনতি করি,
বিপদসিন্ধু উদ্ধারিবেন দিয়ে চরণতরী।

দাসানুদাস আপনার–
 আরজ আলী মাতব্বার।
চরবাড়িয়া লামচরি,
 পূর্ব পাড়ায় বসত করি।
তেরশ’ উনচল্লিশ সাল,
 ষোলই ফাগুণ বৈকাল।
[১৬. ১১. ১৩৩৯]

*

চরমোনাইতে অমাবস্যা

তেরশ চল্লিশ সাল, বৈশাখী সপ্তম।
দিবস অতীত, যবে রজনী আগম;
প্রহর অতীত হলো, ন’ ঘটিকা বাজে –
-আচম্বিতে হলো শোর চরমোনাই মাঝে।
‘পুণ্যশশী পল খসি’, হ’ল অন্ধকার,
শাহ সূফী মৌলবী আব্দুল জব্বার
ভেস্তে গেল, শান্তি পেল খোদার কৃপায়।
 ‘ইননালিল্লাহে’ বল মমিন সবায়।
[৯.১.১৩৪০]

*

অতীত বয়স

 সুখের শৈশব!
এখন কৈ সব
রতন সম যতন তোর?
সামান্য অভাবে
আদুরে স্বভাবে
করেছ কত রোদন শোর,
 জননী আসিয়া
বদন চুমিয়া।
করিত শান্ত তোমার মন;
 সুখেতে, দুঃখেতে
 লইয়া বুকেতে
করিত মা কত আলিঙ্গন।
তব ছেলেবেলা
 খেলিয়াছ খেলা
ডাংগুলি, হাডুডু, লুকোচুরি;
তুচ্ছ করি পাঠে,
 ঘুরি মাঠে মাঠে
অনাহারীতে উড়ায়েছ ঘুড়ি।
প্রিয়জন সাথে
সামান্য কথাতে
কতই করেছ বকাবকি,
 মারামরি কত
করেছ সতত,
জননী ডেকে বলেছে, “অ কি?”
ছেলেবেলা তুমি
 খুঁড়ি বনভূমি।
গড়িয়াছিলে জলের কল,
আজ কোথা তাই?
 দেখিতে না পাই,
কোথায় তব পুঁথির দল?
 শখের লহরী
বাঁশের বাঁশরি,
সারঙ্গ, বেহালা কোথা আজ?
 রজনী কি দিবা,
অনাহারী কিবা,
সতত আছিলে ফুর্তিবাজ।
 মাতার নিকট
মূরতি বিকট
ধরিতে অতীব ক্রোধভরে,
আজ কেন তাই
 হইয়াছে ছাই?
ঘৃণাটাও কি পুড়িয়া মরে?
[২৫. ৪. ১৩৪০]

*

নয়ার জন্ম

তেরশ চল্লিশ সাল, শুক্রবার গতে,
দোসরা অঘ্রান, শুভ শনিবার রাতে–
 বিশাখা নক্ষত্র আর প্রতিপদ তিথি,
 সুকর্মা যোগেতে এক আসিল অতিথি,
 বিপ্রবর্ণ, নরগণ আর বিছা রাশি।
 উজালা করিল গৃহ, দুঃখ তমঃ নাশি।