সিস্টেম এডিফাস

সিস্টেম এডিফাস

এটাকেই নিশ্চয়ই বলে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকা।

দুপুরবেলা আমাদের খানিকক্ষণের জন্যে কাজের বিরতি দেয়া হয়। আমি তখন আমার আকাশের কাছাকাছি অফিস থেকে নিচে নেমে আসি। ঠিক কী কারণ জানি না, মাটির কাছাকাছি এলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। পথের ধারের রবোষ্ট্যান্ড থেকে প্রোটিন এবং স্টার্চের একটা জুতসই মিশ্রণের ক্যাপসুল কিনে এনে আমি সাজিয়ে রাখা ভ্রাম্যমাণ বেঞ্চগুলিতে বসে পড়ি। বেঞ্চগুলি তার প্রোগ্রাম করা পথে ঘুরে বেড়ায়, আমি চুপচাপ বসে। থেকে পথেঘাটে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করা মানুষগুলিকে দেখি। আমার নিজেকে তখন অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হয়, আমি কল্পনা করি আমার সামনে যেন একটি আন্তঃমহাজাগতিক জানালা খুলে গেছে এবং আমি অন্য কোনো একটি গ্যালাক্সি থেকে পৃথিবীর বিচিত্র কিছু প্রাণীকে দেখছি। বসে বসে আমার তখন মানুষের মনের ভাব অনুমান করতে খুব ভালো লাগে।

আজকেও আমি তাই করছিলাম, বেঞ্চে বসে প্রোটিন এবং স্টার্চের ক্যাপসুলটা চুষতে চুষতে মানুষগুলির মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের ভাব অনুমান করার চেষ্টা করছিলাম। বয়স্ক একজন মানুষকে দেখে মনে হল কোনো কিছু নিয়ে তার ভিতরে খুব যন্ত্রণা–কে জানে হয়তো তার সর্বশেষ স্ত্রী ধনবান কোনো এক তরুণের সাথে পালিয়ে গেছে। হাস্যোজ্জ্বল একজন তরুণীকে দেখে মনে হল হয়তো তার ভালবাসার মানুষটি আজকে তাকে ভালবাসা। নিবেদন করেছে। কমবয়সী নিরাসক্ত ধরনের একজন তরুণকে দেখে মনে হল সে হয়তো নতুন কোনো একটি মাদকের সন্ধান পেয়েছে। পিছু থেকে ধীরপায়ে হেঁটে আসা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ দেখে মনে হল তার ভিতরে এক ধরনের শান্ত সমাহিত ভাব চলে এসেছে— পৃথিবীর তুচ্ছ কোনো ব্যাপারে তার আর কোনো আকর্ষণ নেই। তার নির্লিপ্ত চেহারার মাঝে এক ধরনের ঐশ্বরিক পবিত্রতার ছাপ। মানুষটির কাছেই একজন প্রৌঢ়া রমণী, তার পোশাক এবং চেহারায় বিচিত্র এক ধরনের কৃত্রিমতা দেখে মনে হয় কোনো এক ধরনের কুটিল চিন্তায় মগ্ন।

ঠিক এই সময় আমি রনোগানের তীক্ষ্ণ শব্দ শুনতে পেলাম। ঢিপঢিপ করে নিচু কয়েকটা শব্দ হল এবং আমি মানুষের আর্তনাদ শুনে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম, একটু আগে দেখা মধ্যবয়সী শান্ত সমাহিত মানুষটি তার মুখের সমস্ত পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রেখে দুই হাতে দুটি ভয়ংকরদর্শন রনোগান নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে যাচ্ছে। আমার সামনেই আরেকজন চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগল।

আমি হতবাক হয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক তখন আরো কয়েকজনকে ছোটাছুটি করতে দেলাম, আরো কিছু গোলাগুলি হল এবং হঠাৎ করে শান্ত সমাহিত চেহারার মানুষটি তার মুখের পবিত্র ভাব নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে আমার দিকে ছুটে এল, তার আগেই কেউ একজন তাকে গুলি করল এবং আমি কিছু বোঝার আগেই মানুষটা রক্তে মাখামাখি হয়ে আমার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

. আমি নিয়মিত ছায়াছবি দেখি এবং রগরগে ত্রিমাত্রিক রহস্য ছায়াছবিতে বহুবার গুলিবিদ্ধ চরিত্র আমাদের মতো দর্শকদের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, কিন্তু প্রকৃত এই ঘটনাটি ছায়াছবি থেকে একেবারেই ভিন্ন। গুলিবিদ্ধ মানুষটি ভয়ংকরভাবে ছটফট করতে লাগল এবং শরীরের বিভিন্ন ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। তার হাত থেকে রনোগানটি নিচে গড়িয়ে পড়ল এবং আমি কিছু না বুঝে সেটি হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করে নির্বোধের মতো চিৎকার করতে থাকলাম।

ঘটনার আকস্মিকতাটুকু কেটে যাবার পর আমি আবিষ্কার করলাম নিরাপত্তাবাহিনীর লোকেরা আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। কেন আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানতে চাওয়ার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত কাটখোট্টা মহিলাটি তার মুখে যেটুকু কমনীয়তা আনা সম্ভব সেটুকু এনে মিষ্টি করে বলল যে ব্যাপারটি তাদের সদরদপ্তরে নিষ্পত্তি করা হবে। ব্যাপারটি যে আসলেই একটি ভুল বোঝাবুঝি এবং সদরদপ্তরের কর্মকর্তাদের সেটা বুঝিয়ে দেয়ার পরই যে আমাকে তারা ছেড়ে দেবে সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।

কাউকে কোনো অপরাধের জন্যে গ্রেপ্তার করার পর নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের সাথে কী ধরনের ব্যবহার করে সেটা সম্পর্কে আমার খানিকটা কৌতূহল ছিল। সদরদপ্তরে এসে আবিষ্কার করলাম যে তাদের কোনো ধরনের ব্যবহারই করা হয় না। আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আসবাবপত্রহীন একটি নিরানন্দ ঘরে আটকে রাখা হল। অনেক কষ্টে আমি একজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, আমি এই ঘটনার সাথে কোনোভাবেই জড়িত নই, আমাকে তোমরা কেন গ্রেপ্তার করে এনেছ?

মানুষটি আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেবে আমি আশা করি নি; কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে সে তার তথ্যকেন্দ্রে উঁকি দিয়ে বলল, তোমার হাতে মানুষের বেআইনি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ ব্যবসায়ী মারা গেছে, তার অস্ত্র পাওয়া গেছে তোমার হাতে, কাজেই তুমি কোনোভাবে ব্যাপারটার সাথে জড়িত নও সেটা বিশ্বাস করা কঠিন।

আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নিরাপত্তাবাহিনীর লোকটির দিকে তাকালাম, শান্ত সমাহিত এবং পবিত্র চেহারার মানুষটি আসলে একজন বেআইনি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ ব্যবসায়ী, দুর্ধর্ষ খুনে আসামি সেটি এখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কাতর গলায় বললাম, তুমি বিশ্বাস কর, আমি কিছুই জানি না।

মানুষটি উদাস গলায় বলল, হতে পারে। কিন্তু তুমি ঘটনার সময়ে হাজির ছিলে। অপরাধীর দেহে তোমার শরীরের ছাপ আছে। তুমি একটা ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিলে, আমাদের কিছু করার নেই।

আমি একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই প্রথমবার ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকা কথাটির প্রকৃত অর্থ অনুভব করতে শুরু করলাম।

***

আসবাবপত্রহীন নিরানন্দ ঘরটিতে আমি দুই দিন কাটিয়ে দিলাম। সেখানে গায়ে দেয়ার জন্যে হালকা গোলাপি এক ধরনের পোশাক রাখা ছিল। খাবার বা স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। শুধু তাই নয়, বিনোদনের জন্যে যাবতীয় উপকরণ সাজিয়ে রাখা ছিল, কিন্তু আমি তার কিছুই ব্যবহার করতে পারলাম না। পুরো সময়টুকু এক ধরনের অস্বস্তিকর চাপা আতংক নিয়ে অপেক্ষা করে করে কাটিয়ে দিলাম। তৃতীয় দিনে কয়েকজন মানুষ এসে আমাকে এই নিরানন্দ ঘরটি থেকে বের করে নিয়ে গেল। আমি ততক্ষণে পুরোপুরি ভেঙে পড়া একজন দুর্বল মানুষে পরিণত হয়ে গেছি।

কয়েকটি কক্ষ এবং কয়েকটি করিডোর পার করে আমাকে মাঝারি একটি হলঘরে উপস্থিত করা হল, সেখানে একটি বড় টেবিলকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু মানুষ বসে ছিল। আমাকে দেখে একজন সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, সে কী! তোমার এ কী চেহারা হয়েছে?

আমি ভাঙা গলায় বললাম, তুমি কি সত্যিই অবাক হয়েছ?

না। খুব অবাক হই নি। তোমার অবস্থায় হলে সম্ভবত আমিও এভাবে ভেঙে পড়তাম।

আমি লোকটার কথায় কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম না। তার সামনে চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, আমাকে তোমরা কেন গ্রেপ্তার করে এনেছ? কেন এখনো ধরে রেখেছ?

সে কথাটাই তোমাকে বলার জন্যে ডেকে এনেছি।

আমি একটু আশা নিয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম। কিন্তু তার মাছের মতো নিস্পৃহ চোখের দৃষ্টি দেখে হঠাৎ এক ধরনের আতংকে আমার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। মানুষটি তার। চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান, একটি রাষ্ট্রের বিশাল শক্তি ব্যয় হয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অপরাধীদের ধরা এবং তাদের বিচার করার জন্যে।

মানুষটি ঠিক কী বলতে চাইছে আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আমি তবু যন্ত্রের মতো মাথা নাড়লাম। মানুষটি বলল, রাষ্ট্র এই খাতে অর্থব্যয় কমানোর জন্যে নূতন একটি সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে।

সিস্টেম?

হ্যাঁ। তার নাম দেয়া হয়েছে সিস্টেম এডিফাস।

এডিফাস?

হ্যাঁ। এই সিস্টেমের নিয়ম হল যখন কোনো অপরাধ ঘটবে তখন অপরাধের আশপাশে সবাইকে ধরে নিয়ে আসা হবে।

সবাইকে?

হ্যাঁ, কারণ এটাই সবচেয়ে সহজ। এটা করতে হলে কোনো অনুসন্ধান করতে হয়, কোনো তদন্ত করতে হয় না, ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তাভাবনা–গবেষণা করতে হয় না। সবাইকে যখন ধরে আনা হয় তখন সিস্টেম এডিফাস তাদের সবাইকে জেরা করে। জেরা। করে বের করে কে সত্যি বলছে কে মিথ্যা বলছে। সেখান থেকে অপরাধী খুঁজে বের করা হয়। শুধু তাই নয়, অপরাধের গুরুত্ব বের করা হয়।

মানুষটি নিশ্বাস নেবার জন্যে একটু অপেক্ষা করল, আমি কিছু না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

যখন অপরাধের গুরুত্ব বের করা হয় তখন তাকে শাস্তি দেয়া হয়। সিস্টেম এডিফাসের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তখন সে শাস্তি কার্যকর করতে পারে। কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক শোধন, স্মৃতি পরিবর্তন, কারাদণ্ড যাকে যেটা দেয়া প্রয়োজন সেটা দিয়ে দিতে পারে। বিশাল তথ্যকেন্দ্র থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বলতে পার সিস্টেম এডিফাস দিয়ে একটি দেশের নিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র দপ্তর এবং বিচার বিভাগকে অবলুপ্ত করে দেয়া হবে।

আমি হতবাক হয়ে কোনোভাবে বললাম, এই সিস্টেমটা ঠিকভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে? এটি নির্ভুলভাবে কাজ করে?

অবশ্যি কাজ করে। মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, গত দশ বছর থেকে হাজারখানেক বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার এটার পিছনে কাজ করছে। বিশাল রিসার্চ করে এটা দাঁড় করানো হয়েছে। মৃত্যুকূপের সাথে যে ইন্টারফেস

মৃত্যুকূপ?

হ্যাঁ। মানুষটি সোজা হয়ে বলল, যদি দেখা যায় কারো অপরাধের জন্যে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া দরকার সিস্টেম এডিফাস তখন মানুষটাকে মৃত্যুকূপে নিয়ে হত্যা করে।

আমি আতংকিত হয়ে বললাম, কীভাবে করে?

অনেক রকম উপায় রয়েছে। ইলেকট্রিক শক, হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস, বিষাক্ত ইনজেকশান, গুলিবর্ষণ, রক্তক্ষরণ, উচ্চচাপ কিংবা উচ্চতাপ–যার জন্যে যেটা প্রয়োজন। শুধু এই ইন্টারফেসটা তৈরি করতেই ছয় বছর সময় লেগেছে।

আমি রক্তশূন্য মুখে মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কবে থেকে এই সিস্টেম এডিফাস কাজ করছে?

মানুষটি সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, মাত্র কিছুদিন হল শুরু করা হয়েছে। বলতে পার এটা এখনো পরীক্ষামূলক। প্রথম কয়েক বছর তথ্য সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে দেখা

আমি বাধা দিয়ে বললাম, যেখানে মানুষের জীবন–মরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেটা একটা পরীক্ষামূলক সিস্টেম? আমাকে দিয়েও পরীক্ষা করা হবে?

হ্যাঁ। তোমার ব্যাপারটি বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তুমি দাবি করছ যে তুমি নিরপরাধ, অথচ আমাদের প্রাথমিক তথ্য বলছে তুমি অপরাধী। আমরা দেখতে চাই সিস্টেম এডিফাস কীভাবে এটার মীমাংসা করে।

আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, আমি একটা পরীক্ষার বিষয়বস্তু? আমি একটা গিনিপিগ? এক টুকরা তথ্য?

জিনিসটা এভাবে দেখার প্রয়োজন নেই। তবে

আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমি কোনো পরীক্ষার গিনিপিগ হতে চাই না।

মানুষটি হা হা করে হেসে বলল, তুমি না চাইলেই তো হবে না। এটা একটি দেশের সিদ্ধান্ত। একটা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত। একটা আইন

আমি এই আইন মানি না।

মানুষটি তার মাথা বাঁকা করে বলল, শুধুমাত্র এই কথাটি বলার জন্যেই দেশদ্রোহিতা আইনে তোমার সাজা হতে পারে।

আমি চিৎকার করে বললাম, হলে হোক। কিন্তু সেটা হতে হবে নিয়মের ভিতরে। আমি উজবুক কোনো সিস্টেমকে বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না।

মানুষটি হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা সুইচ টিপে বলল, সাত নম্বর সেলে নিয়ে যাও।

আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, আমি যাব না। কিছুতেই যাব না।

আমার কথা শেষ হবার আগেই দরজা খুলে বিশাল আকারের দুজন মানুষ এসে আমাকে দুপাশ থেকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিতে শুরু করল।

***

সাত নম্বর সেল নামক যে ঘরটিতে আমাকে আটকে রাখা হল সেটি আগের ঘরটির মতোই আসবাবপত্রহীন এবং নিরানন্দ একটি কুঠুরি। ঘরটির দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে দরজা জানালাহীন নিচ্ছিদ্র এই ঘরটিকে একটি বদ্ধ খাঁচার মতো এবং নিজেকে আক্ষরিক অর্থে খাঁচায় আটকেপড়া একটি ইঁদুরের মতো মনে হতে থাকে। আমি ঘরের ভিতরে কয়েকবার পায়চারি করে কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত এক কোনায় বসে নিজের হাঁটুর উপর মুখ রেখে সিস্টেম এডিফাসের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। আমার মনে হতে থাকে আমাকে কেউ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। অপেক্ষা করে করে আমি যখন অধৈর্য হয়ে উঠলাম ঠিক তখন শুনতে পেলাম ভারি গলায় কেউ একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, সিস্টেম এডিফাস তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

যে কারণেই হোক, আমার নিজেকে খুব আমন্ত্রিত মনে হল না বলে আমি চুপ করে রইলাম। সিস্টেম এডিফাস আবার বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান যে তোমাকে একটা খুনের মামলার সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে আনা হয়েছে।

আমার কথা বলার ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু চুপ করে থাকলে যদি পরোক্ষভাবে ঘটনাটির সত্যতা স্বীকার করা হয়ে যায় সেই ভয়ে আমি বললাম, আমি কিছুই করি নি, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।

তুমি সত্যিই কিছু কর নি কি না সেটা কিছুক্ষণের মাঝেই আমি বের করব।

কীভাবে বের করবে?

তুমি একটি ফ্যারাডে কেজে রয়েছ। অসংখ্য মনিটর তোমার নিশ্বাস, প্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, মস্তিষ্কের সবগুলি দীর্ঘ লয় এবং স্বল্প লয়, তরঙ্গ, তাপমাত্রা, ত্বকের জলীয় বাষ্প ইত্যাদি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখছে। তোমার মুখের প্রতিটি শব্দকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা হবে তুমি সত্যি কথা না মিথ্যা কথা বলছ।

আমি আশান্বিত হয়ে বললাম, আমি সত্যি কথা বললে তুমি বুঝতে পারবে?

অবশ্যি।

তাহলে শোন, আমি পুরোপুরি নির্দোষ।

আমার সাথে যে কণ্ঠস্বরটি কথোপকথন করছিল সেটি হঠাৎ করে পুরোপুরি নীরব হয়ে গেল। আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম, কী হল? তোমার যন্ত্রপাতি কী বলছে? আমি কি সত্যি কথা বলছি?

হ্যাঁ। আমার যন্ত্রপাতি বলছে তুমি সত্যি কথা বলছ। তবে—

তবে কী?

তুমি ঠিক কোন ব্যাপারে নির্দোষ সেটি পরিষ্কার হল না।

এই ব্যাপারে, যে ব্যাপারে আমাকে ধরে এনেছ।

সেটি কোন ব্যাপার?

আমি তো ভালো করে জানিও না। আমি বেঞ্চে বসে খাচ্ছিলাম

আমাকে বাধা দিয়ে সিস্টেম এডিফাস বলল, তুমি কি বলতে চাইছ ঘটনাটি তুমি ভালো করে জানই না?

না।

যে ঘটনাটি তুমি জানই না সেখানে তুমি দোষী নির্দোষ সেটি কেমন করে বলবে?

আমি সিস্টেম এডিফাসের কথায় হঠাৎ এক ধরনের আতংক অনুভব করলাম। একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষ পুরোপুরি অর্থহীন একটা ব্যাপারে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারে, কিন্তু একটি যন্ত্রের সাথে সেটি কি করা সম্ভব? যন্ত্র কি কোনো নিরীহ কথাকে ভুল বুঝতে পারে না? আমি কী বলব ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখন সিস্টেম এডিফাস ভারি গলায় বলল, আমাদের তথ্য অনুযায়ী তুমি এখন বিভ্রান্ত এবং কিছু একটা কৃত্রিম উত্তর তৈরি করার চেষ্টা করছ।

না, আমি কোনো কৃত্রিম উত্তর তৈরি করছি না। একটা যন্ত্রের সাথে কীভাবে অর্থপূর্ণ কথা বলা যায় সেটি ভেবে বের করার চেষ্টা করছি।

বেশ। আমরা তাহলে ঘটনাটি একটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। দেশের একজন অত্যন্ত কুখ্যাত মানবদেহের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ ব্যবসায়ী তোমার কোলে মৃত্যুবরণ করেছে। তার দেহে সাতটি রনোগানের ক্ষতচিহ্ন ছিল, তোমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তোমার। হাতেও ছিল একটা রনোগান। তোমার সাথে এই দুর্ধর্ষ খুনি মানুষের কত দিনের পরিচয়?

তার সাথে আমার কোনো পরিচয় নেই।

তাহলে এত মানুষ থাকতে সে কেন তোমার দিকে ছুটে এল?

এটি–এটি একটি কাকতালীয় ঘটনা! সে যে কোনো মানুষের দিকে ছুটে যেতে পারত।

সিস্টেম এডিফাস এক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল, আমি যখন তোমাকে এই দুর্ধর্ষ খুনিটি নিয়ে প্রশ্ন করেছি তখন তোমার রক্তচাপ বৃদ্ধি পেয়েছে, তোমার মস্তিষ্কে একটা মধ্যম লয়ের নিচু তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ কী? তুমি কি সত্য গোপন করেছ?

আমি চমকে উঠে বললাম, না, আমি কোনো সত্য গোপন করি নি।

এই ভয়ংকর অপরাধী সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?

আমার কোনো ধারণাই নেই। সত্যি কথা বলতে কী, আমি যখন প্রথম তাকে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে মানুষটির মাঝে একটি শান্ত সমাহিত ভাব আছে। আমি বুঝতেই পারি নি সে এত বড় অপরাধী।

বুঝতেই পার নি?

না।

তার সম্পর্কে তোমার একটা শ্রদ্ধার ভাব ছিল?

শ্রদ্ধা কি না জানি না, মানুষটাকে দেখে তার ভিতরে একটা পবিত্রতা ছিল বলে মনে হয়েছিল।

এতবড় একজন দুর্ধর্ষ খুনি কিন্তু তাকে দেখে তোমার মনে হল পবিত্র?

আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, মানুষের চেহারা সব সময় সত্যি কথা বলে না; এটি নূতন কিছু নয়। পৃথিবীতে অনেক সুদর্শন দুশ্চরিত্র মানুষ রয়েছে।

এতবড় একজন অপরাধী তোমার ভিতরে পবিত্র ভাব এনেছে সেজন্যে তোমার ভিতরে কি কোনো অপরাধবোধ আছে?

না, অপরাধবোধ নেই। কেন থাকবে?

আশ্চর্য!

কোন জিনিসটা আশ্চর্য?

তোমার মুখের প্রত্যেকটা উক্তির আমি সত্যতা যাচাই করে দেখেছি। তুমি মুখে যেটা বলেছ তার সাথে সত্যতার গরমিল রয়েছে। যেমন মনে কর পবিত্রতার কথা। পবিত্রতা জিনিসটি মূলত ধর্মসংক্রান্ত কাজে ব্যবহার করা হয়। আমার যে মূল তথ্যকেন্দ্র রয়েছে সেখানে পবিত্রতা কথাটির উনচল্লিশ ধরনের অর্থ রয়েছে।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমরা মানুষ। আমাদের মাঝে অসংখ্য জটিলতা থাকে। আমাদের কথাবার্তা, কাজকর্মকে তুমি এরকম হাস্যকর ছেলেমানুষি একটি সরল রূপ দিতে পার না।

সিস্টেম এডিফাস এভাবে আমাকে পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টা জেরা করল। এটি আমাকে খাওয়া, ঘুম বা বিশ্রামের জন্যেও সময় দিল না। তার জেরা শুনে মনে হল সে আমার সম্পর্কে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে, আমার সাথে কথা বলে শুধুমাত্র তার সিদ্ধান্তের সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে যাচ্ছে। আমার কোনো কথা অবিশ্বাস করার প্রয়োজন হলেই সে রক্তচাপ বা মস্তিষ্কের দ্রুত লয়ের কোনো একটি তরঙ্গের নাম বলে যেটি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। অর্থহীন কথায় বিরক্ত হয়ে আমি যদি একটি বেফাঁস উক্তি করে ফেলি তাহলে সেটি নিয়েই দীর্ঘ সময় আমার সাথে তর্ক করতে থাকে। আমি ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত হয়ে আবিষ্কার করি সে আমার মুখ দিয়েই তার পছন্দসই এক একটি উক্তি বের করে নিচ্ছে। সিস্টেম এডিফাস নামের এই যন্ত্রটির মানুষের নিজস্ব জটিলতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই, এটি বাড়াবাড়ি ধরনের নির্বোধ এবং একগুঁয়ে একটি যন্ত্র। কাজেই, আটচল্লিশ ঘণ্টার মাথায় যখন সিস্টেম এডিফাস মানবদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অবৈধ ব্যবসায়ীর কার্যক্রমে সহযোগিতা এবং পরবর্তীকালে তার হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দান করল আমি খুব বেশি অবাক হলাম না।

***

আমি সিস্টেম এডিফাসকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কখন আমাকে হত্যা করবে?

মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত হওয়ার এক সপ্তাহের মাঝে আমি সেটা কার্যকর করি।

এক সপ্তাহ? আমি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, মাত্র এক সপ্তাহ?

এক সপ্তাহ মাত্র নয়, এটি একটি দীর্ঘ সময়।

আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম। সমস্ত ব্যাপারটিকে এখনো আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়, এটি যেন একটি ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন, আমার শুধু মনে হতে থাকে যে এক্ষুনি আমার ঘুম ভেঙে যাবে আর আমি আবিষ্কার করব আমি আমার ঘরে আমার বিছানায় নিরাপদে শুয়ে আছি।

কিন্তু সেটি ঘটল না, আমি শুনতে পেলাম সিস্টেম এডিফাস বলল, যদিও তোমার অপরাধটি একটি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ কিন্তু তুমি অপরাধটি প্রত্যক্ষভাবে কর নি, শুধুমাত্র পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছ। সে কারণে তোমাকে কীভাবে হত্যা করব সে ব্যাপারে তোমার কোনো একটি সুপারিশ আমি গ্রহণ করতে রাজি আছি।

সুপারিশ? আমার সুপারিশ?

হ্যাঁ।

কী ধরনের সুপারিশ?

যেমন তুমি কীভাবে মৃত্যুবরণ করতে চাও। গুলিবর্ষণ, বৈদ্যুতিক প্রবাহ, বিষপ্রয়োগ, বিষাক্ত ইনজেকশান, বিষাক্ত গ্যাস, উচ্চচাপ, উচ্চতাপ ইত্যাদি।

আমি হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম, যে মানুষকে হত্যা করা হবে তার কাছে পদ্ধতিটির কোনো গুরুত্ব নেই। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললাম, আমি কি অন্যকিছু সুপারিশ করতে পারি?

সিষ্টেম এডিফাস কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, ঠিক আছে কর।

তুমি যেহেতু মানুষ নও তাই তুমি হয়তো জান না যে মৃত্যু কখনোই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

কিন্তু তবু তোমাদের গ্রহণ করতে হবে।

আমি সে ব্যাপারে তোমার একটু সহায্য চাইছি।

কী সাহায্য?

আমার মৃত্যুটি যেন হয় আকস্মিক। আমার অজান্তে সেটি যেন ঘটানো হয়।

অজান্তে?

হ্যাঁ। তাহলে সেটি আমার দিকে এগিয়ে আসছে, সেই ভয়াবহ অনুভূতির ভিতর দিয়ে আমাকে যেতে হবে না।

সিস্টেম এডিফাস কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু সেটি তো সম্ভব নয়। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের জন্যে একটা প্রস্তুতি নিতে হয়, সেই প্রস্তুতিটি তোমার অজান্তে করা সম্ভব নয়।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তাহলে অন্ততপক্ষে কবে আমাকে হত্যা করবে সেই দিনটি কি আমার কাছে গোপন রাখতে পারবে?

সেই দিনটি?

হ্যাঁ। সেই নির্দিষ্ট দিনটি?

সেটি করা যেতে পারে। সিস্টেম এডিফাস কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমি কবে তোমাকে হত্যা করব সেই দিনটি তোমার কাছে গোপন রাখব।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সিস্টেম এডিফাস।

একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষের জন্যে অন্তত এইটুকু করা আমি নিজের কর্তব্য বলে মনে করি।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, সিস্টেম এডিফাস।

বল।

তুমি যে আমাকে কথা দিয়েছ যে আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিনটি আমার কাছে। গোপন রাখবে সেটি কি একটি সত্যিকারের অঙ্গীকার?

হ্যাঁ। সেটি একটি সত্যিকারের অঙ্গীকার।

আমি একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, আমি যদি কোনোভাবে সেটা জেনে যাই?

তুমি জানবে না।

কিন্তু তবু যদি আমি কোনোভাবে জেনে যাই?

তুমি নিশ্চিত থাক তুমি কোনোভাবে জানবে না।

আমি হঠাৎ একটু বেপরোয়ার মতো বললাম, আমি কি দাবি করতে পারি যে আমি যদি দিনটি জেনে যাই তাহলে সেই দিনটিতে আমাকে হত্যা করতে পারবে না?

সিস্টেম এডিফাস এক ধরনের যান্ত্রিক হাসির মতো শব্দ করে বলল, তুমি অহেতুক উত্তেজিত হচ্ছ। কিন্তু যদি তুমি এই প্রতিশ্রুতি থেকে সান্ত্বনা পেতে চাও তাহলে আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে তুমি যদি কোনোভাবে তোমার মৃত্যুদণ্ড দেবার দিনটি আগে থেকে জেনে যাও তাহলে আমি সেইদিন তোমাকে হত্যা করব না।

কবে হত্যা করবে?

অন্য কোনো একদিন হত্যা করব।

তুমি কথা দিচ্ছ?

আমি কথা দিচ্ছি।

আমি একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বললাম, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল এরকম—আজ থেকে সাত দিনের ভিতরে তুমি আমাকে হত্যা করবে। কবে হত্যা করা হবে সেটি আমার কাছে গোপন রাখা হবে, কিন্তু আমি যদি দিনটি আগে থেকে জেনে যাই তাহলে সেই দিনটিতে তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না।

তুমি ঠিকই বলেছ।

এ ব্যাপারে তুমি অঙ্গীকারাবদ্ধ?

আমি অঙ্গীকারাবদ্ধ।

যদি তুমি তোমার অঙ্গীকার ভঙ্গ কর?

সিস্টেম এডিফাস যান্ত্রিক এক ধরনের হাসির মতো শব্দ করে বলল, আমার গঠন সম্পর্কে ধারণা নেই বলে তুমি এই কথা বলছ। আমার অঙ্গীকার প্রকৃতপক্ষে হার্ডওয়ারনির্ভর, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা আক্ষরিক অর্থে কয়েক হাজার প্রসেসরকে ধ্বংস করার সমান। অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এবং আত্মহত্যা আমার জন্যে সমান।

শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। তোমাকে ধন্যবাদ সিস্টেম এডিফাস।

ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই। আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। মানব সমাজের সেবা করাই আমার উদ্দেশ্য।

আমি বদ্ধঘরটিতে কয়েকবার পায়চারি করে মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে বললাম, সিস্টেম এডিফাস।

বল।

তুমি আমাকে হত্যা করার জন্যে সাত দিন সময় নিয়েছ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সময়টি ছয় দিন, তাই না?

ছয় দিন? কেন?

কারণ প্রথম ছয় দিন তুমি যদি আমাকে হত্যা না কর তাহলে আমি বুঝে যাব সপ্তম দিনেই তুমি আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু আমি যদি দিনটি জেনে যাই তাহলে তো তুমি আমাকে আর সেইদিন হত্যা করতে পারবে না। কাজেই আমাকে যদি সত্যি হত্যা করতে চাও তাহলে আমাকে প্রথম ছয় দিনের মাঝেই হত্যা করতে হবে। ঠিক কি না?

সিস্টেম এডিফাস কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। তোমাকে হত্যা করার জন্যে আমি সাত দিন অপেক্ষা করতে পারব না প্রথম ছয় দিনেই করতে হবে।

তাহলে কি আমরা ধরে নেব আগামী ছয় দিনের মাঝেই আমাকে হত্যা করা হবে?

হ্যাঁ ধরে নিতে পার।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, যদিও আমার সময় ছিল সাত দিন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটা হয়ে গেল ছয় দিন। আমার জীবনের শেষ কয়টা দিন থেকে আরো একটা দিন হারিয়ে গেল।

তুমি যেভাবে চেয়েছ তাতে আর কিছু করার নেই।

আমি খানিকক্ষণ ঘরে পায়চারি করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম, সিস্টেম এডিফাস।

বল। তুমি তো আসলে ষষ্ঠ দিনেও হত্যা করতে পারবে না।

কেন?

আমি জানি ছয় দিনের মাঝে তুমি আমাকে হত্যা করবে। কাজেই পাঁচ দিন পার হওয়ার পরই আমি বুঝতে পারব পরের দিন আমাকে হত্যা করবে। তাই না?

সিস্টেম এডিফাস এবার বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ব্যাপারটা তো তাই দাঁড়াল। আমি সপ্তম দিনে যেরকম তোমাকে হত্যা করতে পারব না, ষষ্ঠ দিনেও পারব না।

না পারবে না। আমি গভীর একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, ষষ্ঠ দিনেও যেহেতু পারবে না কাজেই আমাকে পাঁচ দিনের মাঝে মারতে হবে। আমার আয়ু মাত্র পাঁচ দিন।

সিস্টেম এডিফাস বিচিত্র এক ধরনের গলায় বলল, পরবর্তী পাঁচ দিনের মাঝে আমার তোমাকে হত্যা করতে হবে। সময়

আমি বাধা দিয়ে বললাম, কিন্তু

কিন্তু কী?

চার দিন পার হবার পর আমি কি জেনে যাব না যে পঞ্চম দিন এসে গেছে? আমার শেষ দিন এসে গেছে! আমি যদি জেনে যাই তাহলে তুমি আমাকে কীভাবে হত্যা করবে? তুমি অন্তত সেদিন হত্যা করতে পারবে না।

সিস্টেম এডিফাস এবারে কোনো কথা বলল না। আমি তাকে ডাকলাম, সিস্টেম এডিফাস।

বল।

তুমি কথা বলছ না কেন? পঞ্চম দিনেও তো তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না। তুমি অঙ্গীকার করেছ আমি যদি বুঝে যাই তুমি আমাকে হত্যা করবে না।

হ্যাঁ। কিন্তু

আমি বাধা দিয়ে বললাম, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল চার দিনে।

কিন্তু

কিন্তু কী?

চার দিনের বেলাতেও তো এই যুক্তি দেয়া যায়।

আমি মাথা নাড়লাম, ঠিকই বলেছ। তুমি চতুর্থ দিনেও আমাকে হত্যা করতে পারবে

সিষ্টেম এডিফাস ধীরে ধীরে বলল, চতুর্থ দিনেও তোমাকে হত্যা করতে পারব না। তাহলে প্রথম তিন দিনে

আমি গলায় উত্তেজনা ঢেলে বললাম, আসলে একই কারণে তিন দিনেও পারবে না, দ্বিতীয় দিনেও পারবে না। ভেবে দেখ তুমি প্রথম দিনেও পারবে না।

পারব না?

না। তার মানে তোমার আমাকে এখনই হত্যা করতে হবে।

এখনই?

হ্যাঁ। সিস্টেম এডিফাস। কিন্তু আমি জেনে গিয়েছি তুমি এখন আমাকে হত্যা করবে।

জেনে গিয়েছ?

হ্যাঁ। আমি জেনে গেলে তুমি আমাকে আর হত্যা করতে পারবে না!

আমি তোমাকে হত্যা করতে পারব না?

না, সিস্টেম এডিফাস। আমাকে যেতে দাও।

যেতে দেব?

আমি গলায় অনাবশ্যক জোর দিয়ে বললাম,হ্যাঁ। দরজাটা খুলে দাও সিস্টেম এডিফাস।

কয়েক সেকেন্ড পর সত্যি সত্যি ঘরঘর শব্দ করে দরজা খুলে গেল। আমি স্টেনলেস স্টিলের নিচ্ছিদ্র এই ঘর থেকে বের হয়ে একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বললাম, সিস্টেম এডিফাস, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ, পাচ্ছি।

তুমি কি জান যে তুমি একটা বিশাল গর্দভ? অকাট মূর্খ? জঞ্জালের ডিপো–নোংরা আবর্জনা? জান?

না, জানতাম না।

জেনে রাখ।

***

কয়েকদিন পর সংবাদ বুলেটিনে একটা ছোট তথ্য প্রকাশিত হল যেটি পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। সেই বুলেটিনে লেখা ছিল–অপরাধী নির্ণয়, বিচার করা এবং শাস্তি প্রদানের জন্যে প্রস্তুত করা সিস্টেম এডিফাস প্রজেক্টটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করতে সমস্যা হওয়ার কারণে পুরো প্রজেক্টটাই বাতিল করে দেয়া হয়েছে।