সমুদ্রের ধারে যেখানে ঢেউয়ের ভিতর থেকে পাহাড়গুলো দেয়ালের মতো খাড়া হয়ে বেরোয় আর সারা বছর তার সঙ্গে লড়াই করে সমুদ্রের জল ফেলিয়ে ওঠে, তারই উপরে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের চূড়ায় সিন্ধু ঈগলের বাসা। সেখানে আর কোন পাখি যেতে সাহস পায় না— তারা সবাই নীচে পাহাড়ের গায়ে ফাটলে ফোকরে বসবাস করে। পাহাড়ের উপরে কেবল সিন্ধু ঈগল— তারা স্বামী-স্ত্রীতে বাসা বেঁধে থাকে!
ঈগলবংশ রাজবংশ— পাখির মধ্যে সেরা। সিন্ধু ঈগলের চেহারাটি তার বংশেরই উপযুক্ত— মেজাজটিও রাজারই মতো। সিংহকে আমরা পশুরাজ বলি— সুতরাং ঈগলকেও পক্ষীরাজ বলা উচিত; কিন্তু তা আর বলবার যো নেই কারণ রূপকথার আজগুবি গল্পে লেখে, পক্ষীরাজ নাকি একরকম ঘোড়া! যাহোক— শুনতে পাই রাজারা নাকি মৃগয়া করতে ভালোবাসেন। তাহলে সে হিসাবেও সিন্ধু ঈগলের চালের কোন অভাব নেই। চিল কাক সাঁচান শকুন সবাই মরা মাংস খায়— কাজেই সেরকম খাওয়া যতক্ষণ জোটে ততক্ষণ তাদের আর শিকার করা দরকার হয় না। কিন্তু সিন্ধু ঈগলের স্বভাবটি ঠিক তার উল্টো— যতক্ষণ শিকার জোটে ততক্ষণ সে মরা জানোয়ার পেলেও তা ছোঁয় না। কিন্তু একটি তার বদভ্যাস আছে, সেটাকে ঠিক রাজার মতো বলা যায় না; সেটি হচ্ছে অন্যের শিকার কেড়ে খাওয়া!
সমুদ্রের ধারে ছোট বড় কতরকম পাখি— তারা সবাই মাছ ধরে খায়। নিতান্ত ছোট যারা তারা ধরে ছোট ছোট মাছ— সেসব মাছের উপর সিন্ধু ঈগলের কোন লোভ নাই। কিন্তু বড় বড় গাংচিল আর মেছো চিলগুলো যেসব বড় বড় মাছ জল থেকে টেনে তোলে তার দু-চারটা যে মাঝে মাঝে সিন্ধু ঈগলের পেটে যায় না, এমন নয়। সমুদ্রের ধারে শিকারের অভাব কি? মাছ খেয়ে যদি অরুচি ধরে, তবে একটা-আধটা পাখি মেরে নিলেই হয়। তাছাড়া একটু ডাঙার দিকে ইঁদুর খরগোস এমনকি ছাগলছানাটা পর্যন্ত মিলতে পারে। কিন্তু তবু সে অন্যের শিকারে জবরদখল জাহির করতে ছাড়ে না। এই যে ডাকাতি করে কেড়ে খাওয়া, এ বিদ্যায় সিন্ধু ঈগলের বেশ একটু কেরামতি আছে। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে ডাকাতি করে। সারাদিন তারা আকাশে উড়ে উড়ে বেড়ায়। উড়তে উড়তে কোথায় গিয়ে ওঠে, মনে হয় যেন সে মেঘের রাজ্যে চলে গিয়েছে, পৃথিবীর উপর বুঝি তার কোন দৃষ্টি নেই। কিন্তু ঈগলের চোখ বড় ভয়ানক চোখ। ঐ উঁচুতে থেকেই সে সমস্ত দেখছে— কিছুই তার চোখ এড়াবার যো নেই। ঐ যে কত পাখি জলের ধারে খেলছে আর মাছ ধরছে, তার মধ্যে একটা মেছো-চিল ঘুরে ঘুরে শিকার খুঁজছে— ঈগল পাখির চোখ রয়েছে তারই উপর।
জলের নীচে একটা মাছ বারবার উঠছে আর নামছে, চিল কেবল তাই দেখছে— মাথার উপরে যে ঈগলরাজ টহল ফিরছেন সেদিকে তার খেয়ালই নাই। একবার মাছটা যেই ভেসে উঠেছে, আর অমনি ছোঁ মেরে মেছো-চিল জলের উপর পড়েছে। তারপর মাছ শুদ্ধ টেনে তুলতে কতক্ষণ লাগে! চিল ভাবছে এখন একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে ভোজনে বসবে, এমন সময়, চিঁ হিঁ হিঁ হিঁ হীঁ— ভূতের হাসির মতো বিকট চিৎকার করে কি একটা প্রকাণ্ড ছায়া তার ঘাড়ের উপর ঝড়ের মতো তেড়ে নামল। সে আর কিছু নয়, সিন্ধু ঈগল; ঐ মাছটার উপর তার নিতান্তই লোভ পড়েছে। তাড়া খেয়ে চিলের বাছা পালাতে পারলে বাঁচে, কিন্তু পালাবে কোথায়? দুদিক থেকে দুইটা ঈগল ক্রমাগত তেড়ে তেড়ে ছোবল মারছে, তার একটি ছোবল গায়ে লাগলে হাড়ে মাংসে আলগা হয়ে যায়। তার উপর সেই বিকট আওয়াজ যখন কানের কাছ দিয়ে হেঁকে যায়, তখন বুদ্ধিশুদ্ধি আপনা হতেই ঘুলিয়ে আসে। কাজেই মেছো-চিলের মাছ খাওয়া এবারে আর হল না। সে বারকয়েক ঈগলের ঝাপ্টা এড়িয়ে তারপর প্রাণের ভয়ে মাছটাছ ফেলে পালাল।
সিন্ধু ঈগল অনেক সময় সমুদ্র ছেড়ে বড় বড় নদীর ধারে গাছের উপর বাসা বাঁধে। সে বাসাও একটি দেখবার মতো জিনিস। এক একটা বাসা ৫/৭ হাত চওড়া; বছরের পর বছর সেটাকে তারা ক্রমাগতই উঁচু করে একটা রীতিমত সিংহাসন বানিয়ে তোলে। এই বাসা বানানো ব্যাপারটা নাকি দেখতে ভারি মজার। একটা ঈগল অনেক কষ্ট করে কতগুলো ডাল সংগ্রহ করে আনল— আর একটা হয়ত সেগুলো পছন্দই করল না। এমনি করে যত ডালপালা জোগাড় হয় তার অধিকাংশই খামখা নেড়ে-চেড়ে ফেলে দেওয়া হয়। তখন তা নিয়ে তাদের মধ্যে ভারি একটা ঝগড়া লেগে যায়; তারা বাসা বানানো বন্ধ রেখে মুখ ভার করে বসে থাকে। আবার হঠাৎ খানিক বাদেই তারা আপসে ভাব করে বাসা বানাতে লেগে যাবে।
এরা সাধারণত মানুষকে কিছু বলে না— বরং তাড়া করলে বাসাটাসা ফেলে পালায়। তবে, বাসায় যদি ছানা থাকে, তাহলে তাড়াতে গেলে অনেক সময়ে উল্টে তেড়ে আসে। তখন দেখা যায় তাদের তেজ কেমন সাংঘাতিক। একবার এক সাহেবের চাকর তামাসা দেখবার জন্য গাছে উঠে ঈগলের বাসায় উঁকি মারতে গিয়েছিল। ততে ঈগলেরা তাকে তেড়ে এসে এমনি সাজা দিয়েছিল যে সাহেব বন্দুক নিয়ে ছুটে না আসলে সেদিন তার তামাসা দেখবার শখ একেবারে জন্মের মতো ঘুচে যেত।