সিনোরিতার শেষ শিকার
ছিপছিপে লম্বা, নিখুঁত মুখ-চোখ, কাকের পাখার মতো কালো কুচকুচে একমাথা চুল–এক কথায় যাকে বলে অপূর্ব সুন্দরী, একবার তাকালে চট করে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
কিন্তু রে বেনেট নামে যে-মানুষটি উত্তর আমেরিকার একটি পানাগারের মধ্যে গেলাসের তরল পদার্থে চুমুক দিচ্ছিল, সে মেয়েটির দিকে বিশেষ মনোযোগ দিল না–কারণ, সেই মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর চাইতেও একজন শক্তসমর্থ অভিজ্ঞ গাইড বা পথপ্রদর্শকের সাহায্য ছিল তার কাছে অনেক বেশি প্রয়োজনীয়।
রে বেনেটের সঙ্গে একই টেবিলে বসেছিল তার বন্ধু ফ্রেড ও মেক্সিকান অনুচর কালো। পূর্বোক্ত মেয়েটি পানাগারের দরজা খুলে একবার রে-র দিকে দৃষ্টিপাত করল, তারপর এগিয়ে গেল কার্লোর দিকে।
চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল কার্লো : সিনর! আপনাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সিনোরিতা জেসুসিতা লোপেজ!
সুন্দরী হাসল। অতঃপর উভয়পক্ষের করমর্দন, পরিচয়ের পালা শেষ। মেয়েটি এবার চেয়ারে বসে কার্লোর সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করল। কয়েক মিনিট পরেই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল রে কার্লো এবং জেসুসিতা যে-ভাষায় কথা বলছিল সেই স্প্যানিশ ভাষা ছিল দুই বন্ধুর কাছে দুর্বোধ্য। অবশেষে ধৈর্য হারিয়ে রে বলে উঠল, ওহে কার্লো, এবার কাজের কথা বলো। যে গাইডটির এখানে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল, তার কী হল?
কার্লো একটি মৃদু আদরের থাপ্পড় বসাল মেয়েটির কাঁধে : তার সঙ্গে আপনাদের দেখা হয়েছে, সিনর। এই অঞ্চলের সেরা গাইড হচ্ছে জেসুসিতা। পায়ের ছাপ ধরে যারা ভাল্লুকের সন্ধান বলে দিতে পারে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ওস্তাদ হল এই মেয়েটি।
কার্লোর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ফ্রেড এবং রে। দুজনেই বোকার মতো তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। জেসুসিতা এবার হেসে উঠল, তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে সকলের কাছে নিয়ে স্থান ত্যাগ করল।
দুই চোখে আগুন জ্বালিয়ে কার্লোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রে : কালো! তুমি কি ইয়ার্কি মারছ আমাদের সঙ্গে?
না সিনর, না, দ্রুতবেগে হাত নাড়তে নাড়তে কার্লো জবাব দিল, আমি সত্যি কথাই বলছি। ওই মেয়েটির বাবা ছিল মস্ত বড়ো শিকারি। আপনারা ভাল্লুক চাইছেন। ও ভাল্লুকের সন্ধান দিতে পারবে।
দেখ কার্লো, অনেক তোড়জোড় করে আমরা গ্রিজলি ভাল্লুক শিকার করতে এসেছি, রে তার মেক্সিকান অনুচরকে সাবধান করে দিল :যদি তুমি আমাদের সঙ্গে রসিকতার চেষ্টা কর, তাহলে
কার্লো জানাল সিনরদের সে ঠাট্টার পাত্র মনে করে না। মেয়ে বলে সিনররা হয়তো জেসুসিতাকে অবজ্ঞা করছেন, কিন্তু এই অঞ্চলের অধিবাসীরা জানে মেয়ে হলেও ভাল্লুক শিকারের পক্ষে জেসুসিতা হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত গাইড। বাপ ছিল মস্ত শিকারি। বাপের কাছেই শিকারের তালিম নিয়েছে মেয়ে।
জাগুয়ারের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে জেসুসিতার বাপ। বাবার মৃত্যুর পর শিকার এবং পথপ্রদর্শকের পেশা গ্রহণ করেছে জেসুসিতা। উপযুক্ত তথ্য পরিবেশন করে কালো জানাল ওই মেয়েটিকে নির্ভয়ে বিশ্বাস করা চলে, কোনোরকম গোলমাল বা ঝঞ্ঝাটের আশঙ্কা এক্ষেত্রে অমূলক। অনেক তর্কবিতর্কের পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই বন্ধু কালোর উপদেশ গ্রহণ করল, স্থির হল মেয়েটিকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারে।
পরের দিন শহর থেকে একটু দূরে একটা গোলাবাড়ির কাছ থেকে জেসুসিতাকে তুলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে সকলে যাত্রা করল গ্রিজলি ভাল্লুকের সন্ধানে। তাদের গন্তব্যস্থল ছিল টেমেচিক প্রদেশের পশ্চিম দিকে অবস্থিত পাপাগচিক নদীর সন্নিহিত অঞ্চল।
দিনটা ভারি সুন্দর, সিনর, ইংরেজিতে বলল জেসুসিতা।
তার মুখে স্পষ্ট ইংরেজি শুনে দুই বন্ধু চমকে গেল। জেসুসিতা সবসময়েই কথা বলেছে। স্প্যানিশ ভাষায়, এই প্রথম তার মুখে ইংরেজি শুনল দুই বন্ধু। জেসুসিতার ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিও দেখার মতো। চলন্ত ঘোড়ার পিঠের ওপর এমন সহজভাবে সে বসে রয়েছে যে, মনে হয় তার দেহ অশ্বপৃষ্ঠে সংলগ্ন জিনেরই একটা অংশ মাত্র। জিনের সঙ্গে লাগানো আছে একটা কারবাইন (এক ধরনের বন্দুক), কটিবন্ধে ঝুলছে ছোরা; পরনে পুরুষের মতো শার্ট আর প্যান্ট, মুখের হাসিতে বেপরোয়া ঔদ্ধত্যের আভাস–দুই বন্ধু মনে মনে স্বীকার করল, হা একটা মেয়ের মতো মেয়ে বটে!
গল্প করতে করতে তারা এগিয়ে চলল। জেসুসিতার কথায় জানা গেল বারো বছর বয়স থেকেই সে বাপের শিকার-সঙ্গিনী, এবং ওই সময়েই সে প্রথম জাগুয়ার শিকার করে। বাপই তাকে শিখিয়েছে পুমা, জাগুয়ার প্রভৃতি বিড়াল-জাতীয় পশু এবং ভাল্লুকের পদচিহ্ন ধরে কেমন করে অনুসরণ করতে হয়। গাছের গায়ে নখের আঁচড় দেখে নখীর স্বরূপ নির্ণয় করার শিক্ষাও। সে গ্রহণ করেছে বাপের কাছেই। তারপর হঠাৎ একদিন জাগুয়ারের কবলে প্রাণ দিল জেসুসিতার বাবা।
রে তার আফ্রিকার অরণ্যে অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করল। হাতি, গণ্ডার, সিংহ প্রভৃতি হিংস্র জন্তু শিকারের রোমাঞ্চকর কাহিনি সাগ্রহে শুনতে লাগল জেসুসিতা। একটি আহত সিংহকে অনুসরণ করার ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিল রে; গল্পটা যখন খুব জমে উঠেছে, ঠিক তখনই হল ছন্দপতন ধাঁ করে জিনের গায়ে লাগানো বন্দুকটা তুলে নিয়ে গুলি চালিয়ে দিল জেসুসিতা।
পেকারি, চেঁচিয়ে উঠল ফ্রেড।
না, সিনর, সাধারণ বুনো শুয়োর, সংশোধন করে দিল জেসুসিতা।
মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন জানাল কার্লো।
একটু জোরে ঘোড়া চালিয়ে এগিয়ে গিয়ে মৃত জন্তুটাকে কার্লো নিয়ে এল। মালবহনকারী ঘোড়াগুলির ভিতর একটির পিঠে শূকরের মৃতদেহ বেঁধে নিয়ে আবার এগিয়ে চলল শিকারির দল।
বন্দুকের শূন্য ঘরে একটা নতুন টোটা ভরে হাসল মেয়েটি, এবার বেশ মজা করে শুয়োরের মাংস খাওয়া যাবে, কি বলো?
রে অবাক হয়ে গিয়েছিল, বিস্মিত কণ্ঠে সে বললে, তোমার হাতের টিপ খুব ভালো।
না, টিপভালো নয়, তবে খুব তাড়াতাড়ি আমি গুলি চালাতে পারি, জেসুসিতাবলল, কোনো জানোয়ার কাছাকাছি থাকলে আমি বুঝতে পারি… আচ্ছা, এবার সেই সিংহের ব্যাপারটা বলো।
অসমাপ্ত কাহিনিটা এবার শেষ করার জন্য তাগাদা দিল সুন্দরী।
গল্পটা শেষ হতেই কার্লো জানাল মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়েছে।
…বিকালের দিকে পরস্পরের শিকারের অভিজ্ঞতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে তারা এগিয়ে চলল। মাঝে মাঝে গল্প থামিয়ে কার্লোকে পথের নির্দেশ দিচ্ছিল জেসুসিতা কোন পথে গেলে ভাল্লুকের সন্ধান পাওয়া যাবে সেটা জানিয়ে দেওয়াই তো তার আসল কাজ, ওইজন্যই তাকে নিযুক্ত করেছে রে বেনেট। দূরবর্তী পর্বতমালার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে তার বক্তব্য জানাচ্ছিল তরুণী গাইড।
সন্ধ্যার সময়ে একটা পাহাড়ের তলা দিয়ে ঘুরে যাওয়ার সময়ে হঠাৎ রে-র চোখ পড়ল ওপরের দিকে, মনে হল পাথরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে একটা চলন্ত ছায়ামূর্তির যেন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কাঁধের রাইফেল হাতে নামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, পাথরের আড়াল থেকে আবার দেখা দিল ছায়ামূর্তি, সঙ্গেসঙ্গে গর্জে উঠল রে-র হাতের রাইফেল। দূরত্ব ছিল প্রায় আড়াইশো গজের মতো, তবু লক্ষ্য ব্যর্থ হল না–ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে পাহাড়ের নীচে এসে পড়ল একটা পুমার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ।
গুলিটা চমৎকার চালিয়েছে, মন্তব্য করল জেসুসিতা।
সঙ্গিনীর সামনে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরে মনে মনে খুশি হয়ে উঠল রে। সঙ্গে সঙ্গে তার এ-কথাও মনে হল যে, লক্ষ্য ব্যর্থ হলে লজ্জার সীমা থাকত না।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দেখে শিকারির দল তাবু ফেলল। পরের দিন সকালে আবার যাত্রা শুরু। রাত্রের দিকে একটা পাহাড়ের নীচে এসে পড়ল সবাই। কার্লো জানাল এই জায়গাটা স্থায়ীভাবে তাঁবু খাটানোর পক্ষে অত্যন্ত উপযুক্ত। অতএব, সেখানেই তাঁবু পড়ল।
পরের দিন সকাল থেকেই শিকার অভিযান শুরু হল। শিকারের সঙ্গী হিসাবে ফ্রেড পছন্দ করল কার্লোর সান্নিধ্য, আর একদিকের জুটি হল মেক্সিকো-সুন্দরী জেসুসিতা লোপেজ এবং রে বেনেট। পর পর তিনদিন ধরে চলল শিকার-পর্ব। জেসুসিতা আর রে-র গুলিতে প্রাণ হারাল অনেকগুলি হরিণ আর পুমা, কিন্তু গ্রিজলি ভাল্লুকের দেখা পাওয়া গেল না। আরও দুটো দিন কাটল। ভাল্লুকদের মধ্যে কেউ শিকারিদের সঙ্গে দেখা করতে এল না। ফলে রে-র মেজাজ হয়ে উঠল উত্তপ্ত। মেজাজের দোষ নেই, গ্রিজলি ভাল্লুক শিকার করার জন্যই উত্তর আমেরিকার পার্বত্য অঞ্চলে হানা দিয়েছিল রে বেনেট। আফ্রিকার জঙ্গলে সিংহ শিকার করেও তৃপ্ত হয়নি সে, মাংসাশী পশুদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর জীব গ্রিজলি ভাল্লুকের সঙ্গে রাইফেল হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে চেয়েছিল শিকারি রে বেনেট। পর পর পাঁচদিন ঘুরেও ভাল্লুকের সাক্ষাৎ না-পেয়ে সে বিরক্ত হয়ে উঠল, মনে হল জেসুসিতা লোপেজ নামে মেয়েটিকে ভাল্লুক শিকারের গাইড হিসাবে নিযুক্ত করে সে ভুল করেছে। সে ভাবতে লাগল, সুন্দরীর বন্দুকের টিপ ভালো বটে, কিন্তু ভাল্লুকের সন্ধান বলে দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা তার নেই। কার্লোর কথায় মেয়েটির ওপর এতটা নির্ভর করা উচিত হয়নি।
জেসুসিতার মেজাজও ভালো ছিল না, কথায় কথায় হঠাৎ দুজনের মধ্যে তর্ক বাধল। ফলে তপ্ত বাক্যস্রোত ছুটল এবং পরের দিন যখন শিকারির অভিযান শুরু হল তখন দেখা গেল জুটি বদল হয়েছে কালোর সঙ্গে জুটেছে জেসুসিতা, ফ্রেডের সঙ্গী হয়েছে রে বেনেট।
এখানে গল্প বলা থামিয়ে গ্রিজলি ভাল্লুক সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলছি। ওই জন্তুটির স্বভাব-চরিত্র এবং দৈহিক-শক্তির বিষয়ে যেসব পাঠক অবহিত নন, তাদের পক্ষে পরবর্তী ঘটনার ভয়াবহতা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়–সেইজন্যই গল্প থামিয়ে বর্তমান প্রসঙ্গের অবতারণা।
গ্রিজলি ভাল্লুকের দেহের ওজন বাঘ অথবা সিংহের চাইতে অনেক বেশি। বাঘ-সিংহের মতো চটপটে না হলেও ক্ষিপ্রতার অভাব গ্রিজলি পুষিয়ে নিয়েছে প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি দিয়ে। ভারতীয় বাঘ এবং আফ্রিকার সিংহ কখনো দলবদ্ধ বন্য মহিষের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহস করে না, কিন্তু গ্রিজলি ভাল্লুক বাইসনের পালে হানা দিয়ে শিকার সংগ্রহ করেছে এমন ঘটনা খুব বিরল নয়। জীবতত্ত্ববিদের মতে গ্রিজলি ভাল্লুক হচ্ছে মাংসাশী পশুদের মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র, সবচেয়ে শক্তিশালী জীব। ভারতীয় ভাল্লুক কখনো কখনো মৃত পশুর মাংস ভক্ষণ করে বটে, কিন্তু জীবিত প্রাণী শিকার করে উদর পূরণের চেষ্টা সে করে না–ফলমূল, মধু প্রভৃতি নিরামিষ খাদ্যেই সে জীবনধারণ করতে অভ্যস্ত। নিরামিষে গ্রিজলির আপত্তি নেই, তবে শিকারের তপ্ত রক্তমাংসই তার প্রধান খাদ্য। পূর্বোক্ত ভয়ংকর জীবটিকে শিকার করার জন্যই ওই অঞ্চলে পদার্পণ করেছে রে আর ফ্রেড, বর্তমান কাহিনির জন্মও সেই কারণে।
হ্যাঁ, ফেলে-আসা গল্পটাকে এবার আমরা আবার শুরু করতে পারি। আগেই বলেছি মন-কষাকষির ফলে রে আর জেসুসিতার জুটি বদল হয়েছে শিকার অভিযানের ষষ্ঠ দিনে রে-র সঙ্গী ফ্রেড, মেক্সিকো-সুন্দরী জেসুসিতার সঙ্গ নিল কার্লো। সকলেই যাত্রা করেছিল অশ্বপৃষ্ঠে।
একটা পাহাড়ের ওপর নাটকীয় সাক্ষাৎকার! তলা থেকে পাহাড় বেয়ে উঠছে দুই বন্ধু, এমন সময়ে আচম্বিতে কোথা থেকে তাদের সামনে আবির্ভূত হল বিপুলবপু এক গ্রিজলি ভাল্লুক। মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়, পরক্ষণেই পাহাড়ের গায়ে সারি সারি গাছের ফাঁকে শ্বাপদের দ্রুত অন্তর্ধান।
বন্ধুকে তলা দিয়ে ঘোড়া চালাতে বলে পাহাড়ের উপরদিকে অশ্বপৃষ্ঠে অগ্রসর হল রে। এক মাইলের প্রায় এক চতুর্থাংশ যখন পার হয়ে এসেছে রে-র ঘোড়া, সেই সময় হঠাৎ রে শুনতে পেল রাইফেলের আওয়াজ।
আওয়াজটা এসেছে তলা থেকে, অতএব শব্দের উৎসস্থল যে বন্ধুবর ফ্রেডের রাইফেল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঘোড়ার লাগাম টেনে স্থির হয়ে দাঁড়াল রে, তারপর কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগল নূতন শব্দতরঙ্গের জন্য
শব্দ এল, রাইফেলের যান্ত্রিক কণ্ঠ নয়–মনুষ্যকণ্ঠে চিৎকার। ফ্রেডের কণ্ঠস্বর বুঝতে পারল রে, কিন্তু দূর থেকে বন্ধুর বক্তব্য বুঝতে পারল না সে। আহত ভাল্লুক যদি চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে, তবে নিশ্চয়ই আর একবার রাইফেলের আওয়াজ শোনা যাবে আর শ্বাপদ যদি নিহত হয়, তবে পর পর তিনবার শোনা যাবে রাইফেলের শব্দ, এই ব্যবস্থাই ছিল দুই বন্ধুর মধ্যে। এখন একবারের বেশি রাইফেলের আওয়াজ শোনা গেল না, তাই রে বুঝল গ্রিজলি ফ্রেডকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। রাইফেলের শব্দটা এসেছে বাঁ-দিক থেকে, অতএব সেই দিকেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল রে।
ঝোপজঙ্গলের বাধা ঠেলে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল রে-র ঘোড়া, সঙ্গেসঙ্গে ২৫ গজ দূরে আত্মপ্রকাশ করল পলাতক গ্রিজলি।
প্রকাণ্ড ভাল্লুকটাকে দেখে ঘাবড়ে গেল রে-র ঘোড়া, সে হঠাৎ পিছনের দুটি পায়ে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়াল। রাইফেল বাগিয়ে ধরার চেষ্টা করছিল রে, কিন্তু তার চতুষ্পদ বাহন আচম্বিতে দ্বিপদ জীবে পরিণত হওয়ার ফলে ভারসাম্য হারিয়ে রে লম্বমান হল মাটির উপর এবং উইনচেস্টার রাইফেলটাও ছিটকে পড়ল হস্তচ্যুত হয়ে।
মাটিতে শুয়েই সে ভাল্লুকটাকে দেখতে পেল। তার সামনে প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে রক্তাক্ত শ্বাপদ জন্তুটার পাঁজরের ওপর হাঁ করে রয়েছে একটা মস্ত ক্ষতচিহ্ন, আর সেখান থেকে ঝরঝর ঝরছে লাল রক্তের ধারা। রে বুঝল আজ তার রক্ষা নেই, ছিটকে পড়া রাইফেলটাকে উদ্ধার করার সময় আর পাওয়া যাবে না।
তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর জীবন্ত পরোয়ানা!
মুহূর্তের জন্য রে-র মানসপটে ভেসে উঠল জেসুসিতার মুখ, তারপরেই বুকের উপর গুরুভার বস্তুর প্রচণ্ড চাপে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার যাতনাদায়ক অনুভূতি, পরক্ষণেই তার চেতনাকে লুপ্ত করে নামল মূৰ্ছার অন্ধকার…
জ্ঞান ফিরে পেয়ে রে দেখল তার ভূপতিত দেহের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কালো আর ফ্রেড এবং তার বাঁ-হাত জড়িয়ে অবস্থান করছে ছেঁড়া কাপড়ের একটা রক্তাক্ত আবরণ। অনাবৃত ঊর্ধ্ব-অঙ্গের দিকে তাকিয়ে সে বুঝল তার শার্ট ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত, বাঁ-হাতটাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে তার দুই সঙ্গী।
তোমার হাতটা ভীষণ জখম হয়েছে, ফ্রেড বলল, তবে শরীরের অন্য কোথাও আঘাত লাগেনি।
তোমরা ঠিক সময়েই এসে পড়েছ, রে-র কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার আভাস।
সঙ্গীদের সাহায্যে ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল রে। এবার ভূপতিত গ্রিজলির মৃতদেহটা তার দৃষ্টিগোচর হল। রে দেখল ভাল্লুকের ঘাড়টা মুচড়ে প্রকাণ্ড মাথাটা বেঁকে গেছে একদিকে এবং তার কণ্ঠদেশ বিদীর্ণ করে জেগে উঠছে একটা সুদীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন। রে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল এমন অদ্ভুত ক্ষতরেখার উৎপত্তি হল কেমন করে–রাইফেলের বুলেট তো এমন অদ্ভুতভাবে গলা কেটে ফেলতে পারে না!
রে প্রশ্ন করল, জেসুসিতা কোথায়?
শোন সিনর, গভীর বিষণ্ণ কণ্ঠে কালো বলল, আমি আর জেসুসিতা একইসঙ্গে বেরিয়েছিলাম বটে, কিন্তু একটু পরেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটি তোমাকে অনুসরণ করেছিল। শিকারির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বোধ হয় আসন্ন বিপদের আভাস পেয়েছিল মেয়েটি আমার সঙ্গে যাত্রা করলেও একটু পরে আমাকে ছেড়ে সে তোমার পিছু নিয়েছিল। ভাল্লুক যখন তোমাকে আক্রমণ করে, সেই সময় সে বন্দুক ব্যবহার করতে সাহস পায়নি। কারণ তোমরা এত কাছাকাছি ছিলে যে গুলি চালালে তোমার প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল। বন্দুক ফেলে ছুরি হাতে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভাল্লুকের ওপর।
এইবার কার্লোর পাশে মাটির ওপর শায়িত প্রাণহীন দেহটাকে দেখতে পেল রে–ঘোড়ার জিন থেকে একটা কম্বল নিয়ে মৃতদেহের ওপর আবরণ টেনে দেওয়া হয়েছে, মরণঘুমে ঘুমিয়ে আছে মেক্সিকো-সুন্দরী সিনোরিতা জেসুসিতা লোপেজ।