নয়
সৌরভ ঘুম থেকে উঠেই ছাদে উঠে দু’চোখ মেলে দিল দূরের প্রকৃতির দিকে। কত নদী, কত নির্ঝরিণীর উৎস ওই পাহাড়গুলো। সেই অপূর্ব সুন্দরের দিকে তাকিয়ে মন যেন ভরে উঠল।
একটু পরেই খেয়ালি ও শিল্পাও উঠে এল ছাদে। মেয়ে তো নয়, যেন একই বৃত্তে দুটি ফুল।
শিল্পা বলল, সৌরভদা, কেমন দেখছ ময়ূরভঞ্জ?
খুব ভাল। এত ভাল যে চোখ আর ফেরাতে পারছি না।
এই ময়ূরভঞ্জের এমনই মোহ যে, এর মোহের কাজল একবার চোখে দিলে আর একে ভোলা যায় না।
তাই তো দেখছি। সুন্দর ছাড়া এখানে তো কিছুই নেই।
আছে। অসুন্দরও আছে। ওই যে দেখছ পাহাড় বনানী, মরণ ওখানে নিয়তির রূপ ধরে ওত পেতে আছে। হিংসা, মৃত্যু, আতঙ্ক কী নেই ওখানে? সৌরভ অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল।
শিল্পা বলল, ওই পাহাড়ের কোলে তোমাদের জন্য একটা জমি দেখে রেখেছেন বাবা। তোমার হয়তো খুবই পছন্দ হবে। তবে কিনা ওটা শুধু অবসর বিনোদনের জন্যই ভাল। বসবাসের জন্য যেটা, সেটা
খেয়ালি এতক্ষণে কথা বলল, ওই যে কৃষ্ণচূড়া
হ্যাঁ। ওরই সংলগ্ন পাঁচ কাঠা জমি।
ওই দেখা যায়। গাছ আছে যেটাতে?
ওখানে আমার যেন রাত্রিবাসের একটু কিছু থাকে।
সৌরভ বলল, এটাও কি তোমার খেয়াল?
মোটেই না। আমার অন্তর থেকেই বলছি।
শিল্পা বলল, কী মেয়ে তুমি? বাবা-মাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে কী কাণ্ডটাই না করলে বলো তো।
ঠিক করেছি। একটু বুঝুক ওরা। চোখ থাকতে যারা চোখের মর্ম বোঝে না, তাদের চোখে বালি একটু পড়ুক।
তা না হয় পড়ল। কিন্তু তোমার মন কাঁদছে না বাড়ির জন্য? মা-বাবা-দাদা এদের কথা মনে পড়ছে না?
খেয়ালি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ওই দূরের পাহাড়গুলোর দিকে কি আজ যাওয়া যাবে?
কেন যাওয়া যাবে না? একটু পরে চা-জলখাবার খেয়ে প্রথমেই আমরা জগন্নাথ দেবের মন্দিরে যাব। সেখান থেকে যাব সানঘাগরায়।
সৌরভ লাফিয়ে উঠল উল্লাসে, সানঘাগরায়? সানঘাগরার নাম আমি বাবার মুখে কতবার শুনেছি। ওইখানে নাকি বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে একবার চিতাবাঘের পাল্লায় পড়েছিলেন বাবা।
ভালুক, চিতা এখনও আছে। নেই শুধু হরিণ আর অসংখ্য ময়ূর। জঙ্গলের নির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে তারাও বিদায় নিয়েছে।
কীভাবে যাওয়া যাবে ওখানে?
অটো আছে, প্রাইভেট ট্যাক্সি আছে, বাস আছে। যাতে ইচ্ছে চলে যাও। তবে ইচ্ছেমতো ঘুরতে গেলে অটো কিংবা ট্যাক্সির বিকল্প নেই।
খেয়ালি বলল, ভুল বললে। তোমার চেনাজানার মধ্যে স্কুটার আছে কারও? অনেকেরই আছে। কিন্তু চালাবে কে? সৌরভদা? খেয়ালি হেসে গড়িয়ে পড়ল।
হাসলে যে?
তোমার কথা শুনে। তোমার সৌরভদা হচ্ছে রাঙা মুলো। দেখতেই লাল টুকটুকে। আসলে একটি মাকাল ফল।
তা হলে স্কুটারের খোঁজ করে লাভ কী? চালাবে কে, তুমি?
ধরো যদি আমিই চালাই।
তবে তো কথাই নেই। এসো নীচে এসো। মা বোধহয় এতক্ষণে চায়ের জল চড়িয়েছেন। চা-টা খেয়ে আমি পরেশদার স্কুটারটা পাওয়া যায় কি না দেখি। ওরা নীচে এল। তারপর বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ভোরের তাজা ফসলের মতো ডাইনিং টেবিলে এসে বসল।
অরবিন্দকাকু বললেন, শিল্পা বলছিল তোমরা নাকি আজই সানঘাগরায় যেতে চাও ?
হ্যাঁ।
কিন্তু তোমরা তিনজনে একটা স্কুটারে যেতে পারবে?
খেয়ালি বলল, এটা তো অভ্যাসের ব্যাপার কাকু। তা ছাড়া আপনাদের এখানে স্কুটার চালানোর অসুবিধে নেই। এমন সুন্দর পিচঢালা পাকা রাস্তা আমরা কোথায় পাব?
তা অবশ্য ঠিক। তবুও সাবধানে যেয়ো কিন্তু।
কাকিমা বললেন, অমনি ফেরার পথে জগন্নাথদর্শনও করে এসো।
অরবিন্দকাকু বললেন, এখানকার জগন্নাথদেবের মন্দির পুরীর মন্দিরের মতোই বড় সড়। অত বড় না হলেও তার কাছাকাছি। মন্দিরের সামনেই প্রশস্ত রাজপথের ওপর রাখা আছে বিশাল রথ। বহু দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসে এখানে।
প্রথমেই চা-বিস্কুট। তারপর লুচি-হালুয়া বেশ দমভোর খাওয়া হল।
শিল্পা বলল, আমি তা হলে দেখছি স্কুটারের কী ব্যবস্থা করতে পারি।
খেয়ালি বলল, না পাও চলে এসো। আমরা একটা জিপ অথবা প্রাইভেট ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে নেব।
সৌরভ বলল, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড তো বাজারের কাছেই। দেখি না কী বলে ওরা, কত টাকা নেয়।
অরবিন্দকাকু বললেন, বেশি নেবে না। খুব জোর আশি থেকে একশো টাকা নেবে। সেদিন কটক থেকে আমার এক বন্ধু পরিবার এসেছিল। ওদের একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিলাম তিনশো টাকায়। ওরা তেমনি গোনাসিকায় গিয়েছিল।
সৌরভ বলল, গোনাসিকা আবার কী?
গোনাসিকা হচ্ছে বৈতরণীর উৎস। পাহাড়ের এক উচ্চস্থানে সেখান থেকে বৈতরণী নেমে আসছে, সেই জায়গাটাকে ঠিক গো-নাসিকার মতো দেখতে। তাই এই নাম।
শিল্পা একটা চটি পায়ে দিয়ে খেয়ালিকে বলল, তুমি আর বসে থেকে কী করবে? এসো আমার সঙ্গে। তোমাকে দেখলে হয়তো পরেশদার মন গলে যাবে। না বলবে না।
খেয়ালি একটু হাসির ঝিলিক তুলে শিল্পার সঙ্গ নিল।
ওরা চলে গেলে সৌরভও পায়ে পায়ে নেমে এল রাস্তায়। তারপর এক-পা
এক-পা করে এগিয়ে চলল ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে।
কাছেই বাজার। ঝাঁকা ভরতি সবজি নিয়ে দেহাতিনী পসারিনিরা দলে দলে চলেছে বাজারের দিকে।
ও যখন বাজারের পাশ দিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছে ঠিক তখনই কে যেন একজন এসে ওর জামার কলার ধরল।
সৌরভ ভয় পেয়ে তাকাল তার দিকে।
গেল। সর্বনাশ! এই পাপটা এখানে কেন?
যে ধরেছিল সে বলল, আমাকে চিনতে পারছিস?
সৌরভ বলল, তা পারছি বইকী।
তোর সেই লালপরিটা কোথায়?
দেখামাত্রই বুকের রক্ত হিম হয়ে
কে লালপরি?
বলামাত্রই ঠাস করে একটা চড়।
এই নরম মিষ্টি রোদের সকালে অমন একটা চড় খেয়ে গালটা জ্বলে উঠল যেন।
পথে এখন লোকজন খুব একটা বেশি না হলেও যারা আছে তারা কেউ কিছুই বলল না। অনেকেই ভাবল হয়তো ব্যক্তিগত কোনও ব্যাপার, তাই।
কাল থেকে তোদের আমি হন্যে হয়ে খুঁজছিরে। বল সেটা কোথায়? যদি না বলি?
না বললে তোর জান আমি কয়লা করে দেব। বলে টেনেহিঁচড়ে ওকে একটা গলির ভেতর নিয়ে গেল।
সৌরভ বলল, বৃথাই মারধর করছ। আমার মুখ থেকে একটি কথাও বের করতে পারবে না তুমি।
আমার নাম জয়রাম পতি। সম্বলপুরের অরণ্য অঞ্চলের ছেলে আমি। আমি পারি না এমন কাজ নেই। বনের পশুও আমার চেয়ে হিংস্র নয়। ওই মেয়েটাকে আমার চাই। মেনোর চোখটায় কী অবস্থা করে দিয়ে এল কাল?
সে দোষ কি মেয়েটার? আগে বলো আমাদের পেছনে লেগেছিল কারা? আমরা তোমাদের কোন ক্ষতিটা করেছিলাম?
আমি কাউকে কৈফিয়ত দিই না।
তা হলে কী করে আশা করো যে আমি তোমার কথার উত্তর দেব?
মেনোর স্কুটারটা কোথায়?
সেটা রাস্তাতেই পড়ে আছে।
কোন জায়গায়?
এখানকার রাস্তাঘাটের নাম আমি জানি না।
জয়রাম ডাকল, বলাই !
একটি ছেলে মোটর মেকানিকের কাজ করছিল, জয়রামের ডাকে এগিয়ে এল।
এটাকে হাপিস করে দে।
সৌরভ দেখল ওদের সঙ্গে পরে উঠবে না। তাই খুব জোরে একবার চেঁচিয়ে উঠল। পরক্ষণেই মুখ চেপে ধরল ওরা।
সেই মেকানিক ছেলেটি কালিঝুলি মাখা হাত নিয়েই সৌরভকে পাশের একটি গ্যারেজঘরে নিয়ে গিয়ে ঢোকাল।
জয়রামও গেল সঙ্গে। সৌরভের কানের কাছে মুখ এনে সে বলল, আজ রাত্রে সানঘাগরার আতঙ্কর গ্রাস হবি তুই। একটা চিতা বড় বেশি জ্বালাচ্ছে আজ ক’দিন ধরে। পেলে তোকে আর ওই মেয়েটাকে একসঙ্গেই উপহার দেব তাকে। বাঘটা তোদের দু’জনকে খাবে আর আমি খাব বাঘটাকে। অর্থাৎ কিনা ওটাকে গুলি করে ওর চামড়াটা নিয়ে ট্যান করাতে দেব।
সৌরভ বলল, যাই করো না কেন, মেয়েটা কোথায় তা আমি বলব না।
বলবার দরকারও নেই। কান টানলেই যেমন মাথাটা আসে, তেমনি তোর খোঁজে বেরোলেই ওকে ধরব। ও এই কেওনঝোড়েই আছে। কাল রাত্রে কত খুঁজলুম তোদের কিন্তু পেলাম না। বলে সেই মেকানিক ছেলেটিকে বলল, একে শুধু আটকে রাখিস না। ভাল করে বেঁধে রাখ, না হলে পালাবে। মুখটাও বাঁধ শক্ত করে। মুখ না বাঁধলে চেঁচিয়ে লোকজন জড়ো করবে হয়তো।
জয়রাম চলে গেল।
ছেলেটি ওর কাজ শুরু করতেই নিজমূর্তি ধরল সৌরভ।
ওর মাথাটা দড়াম করে ঠুকে দিল ছেলেটার নাকের ওপর। প্রচণ্ড আঘাত। সেই আঘাতে গল গল করে রক্ত ছুটতে লাগল নাক দিয়ে। ছেলেটি বাবারে বলে বসে পড়ল।
সেই সুযোগটা নিতে ছাড়ল না সৌরভ। সে গ্যারেজ থেকে বেরিয়েই প্রাণপণে ছোটা শুরু করল।
ততক্ষণে জয়রাম আবার ছুটে এসেছে। এসেই ওপর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে কী বেদম প্রহার! একটু পরেই জয়রাম ওকে জোর করে একটা বস্তায় ঢুকিয়ে, বস্তার মুখ বেঁধে গ্যারেজ ঘরে ফেলে রাখল।
অনেক পরে সৌরভের মনে হল কোনও একটা দ্রুতগামী লরি অথবা অন্য কিছুতে করে ওরা ওকে পাচার করছে। কিন্তু কোথায়? ওর দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। এটুকু বুঝল আর এদের হাত থেকে মুক্তি নেই।
দুশ্চিন্তার কালো মেঘ একটা ঘনিয়ে এল অরবিন্দবাবুর বাড়িতে। আসবে না-ই বা কেন? ছেলেটা সেই গেল অথচ এখনও পর্যন্ত ফেরার নাম নেই।
শিল্পা খেয়ালিকে নিয়ে স্কুটার আনতে গিয়েছিল। স্কুটার নিয়ে ফিরে এসে ওর জন্য বসে থেকে থেকে হতাশ হল।
খেয়ালি বলল, আমার মনে হয় ওর একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার। ছোট্ট জায়গা, তাই খুঁজে বের করতে অসুবিধে হবে না। চলো আমরা বাজারের দিকেই যাই।
অরবিন্দবাবু বললেন, তোরা যদি দেখা না-পাস তা হলে আমাকে এসে বলবি। বেশি দেরি করলে থানাতেই যেতে হবে আমাকে।
শিল্পা আর খেয়ালি দু’জনেই পায়ে পায়ে বাজারের দিকে এল। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, সৌরভের কোনও খোঁজ তো পেলই না। উপরন্তু ওর ব্যাপারে বলতেও পারল না কেউ কিছু।
হঠাৎ কোথা থেকে একটা মারুতি ভ্যান যেন গোঁ গোঁ করে ছুটে এল ওদের চাপা দিতে।
ওরা দু’জনেই সভয়ে পিছু হটল। ওরা ভেবে পেল না ভ্যানটা কেন ধেয়ে এল ওদের দিকে। একটু পরেই ভ্যানের ভেতর থেকে যে নেমে এল তাকে দেখেই জ্বলে উঠল খেয়ালি। বলল, অত কাণ্ডর পরও শিক্ষা হয়নি তোমাদের, না? এখান পর্যন্ত ছুটে এসেছ শয়তান?
আমি তো তোরই খোঁজে এসেছি রে বাঘিনী। আয় আমার সঙ্গে। আজ একটা চিতার ক্ষুধা মেটাব তোকে দিয়ে।
খেয়ালি বলল, খুব সাবধান। এক পা-ও এগোবি তো দারুণ বিপদ ডেকে আনবি কিন্তু।
শিল্পা তখন চিৎকার করছে, পুলিশ। পুলিশ!
ওর চিৎকারে পুলিশ এবং পথচারি অনেকেই ছুটে এল। কিন্তু ছুটে যখন এল, মারুতি তখন হওয়া। সেই সঙ্গে জয়রামও।
সবাই জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে খুকি? অমন চেঁচাচ্ছ কেন?
ওরা তখন সব কথা খুলে বলল। এমনকী এও বলল সৌরভের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে ওই লোকটার হাত থাকতে পারে
বলে।