সানঘাগরার আতঙ্ক – ৮

আট

খাওয়াটা কিন্তু মন্দ হল না। পরিবেশের জলহাওয়ার গুণেই কি না কে জানে, গরিব লোকের মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে ভাত খেতে কী ভাল যে লাগল, তা ওরাই জানে। দোষের মধ্যে চালে একটু কাঁকর থাকায় খেতে অসুবিধে হয়েছিল খুব।

ভাত খেয়ে ওরা বড় রাস্তায় এল বাসের জন্য।

রোদ্দুরের তেজ আছে বেশ। তাই খেয়ালির ভিজে পোশাকগুলো উঠোনে মেলে দেওয়ায় চট করে শুকিয়ে গেল।

এবার বাস একটা হলেই হয়।

কিন্তু বাস আর আসে না। অনেক পরে বাসের বদলে একটি ট্রাক এল। একজন দোকানদার বলল, এই ট্রাক কেওনঝোড় হয়েই যাবে। তোমরা এতে চড়েই যেতে পারো।

সৌরভ বলল, কোনও অসুবিধে নেই। আমাদের যাওয়া নিয়ে কথা।

দোকানদার তখন হাত দেখিয়ে থামাল ট্রাকটাকে। তারপর ওদের দিকে দেখিয়ে কী যেন বলতেই রাজি হয়ে গেল ড্রাইভার।

সৌরভ আর খেয়ালি ট্রাকে উঠতে গেলে ড্রাইভার বলল, পঁচিশ টাকা করে পঞ্চাশ টাকা লাগবে দু’জনের।

সৌরভ বলল, পঁচিশ টাকা করে? কতদূর?

দূর আছে। যাবে তো চটপট উঠে পড়ো।

ওরা আর দেরি না করে ড্রাইভারের পাশেই গিয়ে বসল। ড্রাইভারের পাশে যে দু’জন হেলপার ছিল তারা গিয়ে বসল মাল বোঝাই ট্রাকের মাথার ওপর।

পথঘাট এখানকার খুব ভাল।

তাই ঝড়ের বেগে ট্রাক ছুটে চলল কেওনঝোড়ের দিকে। এ পথের দৃশ্য কী মনোরম। তেমনি মনোরম এই ট্রাকবাহন। গতিময় এবং নিরাপদ।

ড্রাইভার একজন সর্দারজি। স্টিয়ারিং ধরে দিব্যি মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে গাড়ি চালাতে লাগল। গাড়ির স্পিড যে কোন দিকে যাচ্ছে তার আর খেয়ালই রইল না। হঠাৎ একটি গোরুর গাড়িকে পাশ কাটাতে গিয়েই নেমে গেল পাশের খাদে।

যাঃ। ফেঁসে গেল গাড়িটা।

হেল্পার দুজনের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। তারা এমনভাবে ছিটকে পড়ল যে হাত-পা ভেঙে, মাথা ফেটে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। ভয়াবহ ব্যাপার! প্রাণহানি ঘটেনি যে, এই রক্ষে।

ড্রাইভারকেও লেগেছে খুব। দুটো আঙুল গেছে।

সৌরভ ও খেয়ালি দু’জনেই বুকেমুখে চোট পেয়েছে খুব। তাই ভয়ে হাত-পা কাঁপছে থর থর করে। রক্তপাত তেমন একটা ঘটেনি।

ড্রাইভার কাত হয়ে যাওয়া ট্রাকের ভেতর থেকে অতিকষ্টে নামল। তারপর ইশারায় ওদেরও নামতে বলল।

ওরা নেমে বড় রাস্তায় উঠে আসতেই দেখল অনেক লোকজন ছুটে আসছে ওদের দিকে। মোটর লরিও দু’-একটা থেমে পড়েছে রাস্তায়। সবাই উৎসাহ নিয়ে দুর্ঘটনা দেখতে এগিয়ে এল।

কটক থেকে এক ভদ্রলোক আসছিলেন গাড়ি নিয়ে। কেওনঝোড়ে তাঁর একটি হোটেল আছে। নাম ময়ূরী। তিনি তাঁর গাড়িতেই তুলে নিলেন দু’জনকে।

ওরাও লিফট পেয়ে বর্তে গেল।

ভদ্রলোক ওদের পরিচয় জেনে খুশি হলেন খুব। সৌরভকে বললেন, তোমার বাবা যদি সত্যিই বাড়ি করেন এখানে, তা হলে খুবই ভাল হয়। অরবিন্দকাকুকেও তিনি চেনেন। ,

খেয়ালি বলল, আমাদের যেতে কি সন্ধে হয়ে যাবে?

তা একটু হতে পারে। তারপর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, নাঃ।

মনে হচ্ছে সন্ধের আগেই পৌঁছে যাব।

খেয়ালি বলল, কপালটা কী জ্বালা জ্বালা করছে।

সৌরভ বলল, কই দেখি? কোনখানটা?

এই দেখো।

দেখেই শিউরে উঠল সৌরভ। বলল, এ রাম! তোমার কপাল তো কেটে গেছে। রক্তে ভিজে উঠেছে ওখানটা।

ভদ্রলোক বলেন, কোনও ভয় নেই। কেওনঝোড়ে গেলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। প্রাইভেট গাড়ি তো, তাই চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই এক-এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে লাগল।

অনেকদূর যাবার পর এক জায়গায় দেখল হই হই করছে লোকজন। সে কী অফুরন্ত মানুষের সমাগম সেখানে। চারদিকে লাল শালুর পতাকা উড়ছে। পথের দু’পাশে দোকান। রকমারি দোকান। নিশ্চয়ই কোনও দেবস্থান আছে এখানে। দোকানে দোকানে পূজা সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়াও আছে খেলনাপাতির দোকান। নানারকম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কচুরি, শিঙাড়া, জিলিপি ও তেলেভাজার দোকান। আর আছে অজস্র সস্তার হোটেল। আনন্দের বন্যা বইছে সর্বত্র।

গাড়ি এইখানে থামিয়ে ভদ্রলোক বললেন, শোনো, তোমরা এখানে জুতো রেখে চট করে মাকে দর্শন করে এসো।

কোন মা?

তারিণী। খুবই জাগ্রতা। এই পথে যাতায়াত করলে তারিণীকে দর্শন না করে কেউ যায় না।

ওরা ভদ্রলোকের কথামতো গাড়িতেই জুতো রেখে চলল মাতৃদর্শনে। ওড়িশার এই অঞ্চলে এই দেবীর মহিমা খুব। কত লোকের কত মনোবাঞ্ছা যে উনি পূরণ করেছেন, তার ঠিক নেই। দলে দলে নরনারী তাই চলেছেন মায়ের পুজো দিতে।

দেবীর কোনও মন্দির নেই এখানে। একেবারেই খোলা জায়গায় গাছতলায় দেবীর অধিষ্ঠান।

পূজারিরা ঘিরে রেখেছেন স্থানটিকে। যে যা পুজো দিচ্ছে তাই নিবেদন করছেন মাকে।

ওরা আর কী পুজো দেবে? একটা টাকা দেবীর দানপাত্রে দিয়ে চারদিক ঘুরে দেখতে লাগল।

এক জায়গায় কী বিশাল একটি ধর্মশালা। ছোটখাটো লজও দু’–একটি আছে। ওরা সব দেখেশুনে গাড়ির কাছে আসতেই ভদ্রলোক ওদের নিয়ে পাশের একটি ওষুধের দোকানে গেলেন। সেখানে খেয়ালির কপালের ওপরদিকে মাথার ঘন চুলের কাছে যেখানে চোট লেগে রক্ত চুঁইছিল সেখানটায় একটু ওষুধ দেওয়ালেন, তারপর ওদের নিয়ে একটি চায়ের দোকানের সামনে এসে চা আর বিস্কুট খেতে দিলেন ওদের।

ওরা চা-বিস্কুট খেয়ে গাড়িতে বসল।

ভদ্রলোকও এবার সিটে বসে স্টিয়ারিং-এ হাত দিলেন।

হর্ন বাজিয়ে শোঁ শোঁ করে এগিয়ে চলল গাড়িখানা। গাড়ির ভেতরে স্টিরিয়ো বক্স থেকে গান বাজছে। হিন্দি ছায়াছবির সুপার হিট গান। অথচ দেশটা কিন্তু ওড়িশা।

গান শুনতে শুনতে ওরা যত এগোতে লাগল ততই পাহাড় আর জঙ্গল ঘন হতে লাগল। এক সময় তো পাহাড়ের ওপরই উঠে পড়ল গাড়িটা। সে কী নয়নাভিরাম দৃশ্য। অনেক দেখেও যেন মন ভরে না।

তারপর প্রকৃতির লীলাভূমি দেখতে দেখতে একসময় ওরা কেওনঝোড়ে ঢুকে পড়ল। ছোট্টর ওপর বেশ সাজানো শহর। খুবই পরিচ্ছন্ন। ভারী মনোরম এর পরিবেশ! সুন্দর ঘর বাড়ি! চারদিকে দূরে অদূরে পাহাড়ের সারি। জমজমাট জায়গা।

ভদ্রলোক কেওনঝোড়ের রাজবাড়ির সামনে ওদের নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন।

দুর্ঘটনার পর থেকেই খেয়ালি যেন কেমন একটু মিইয়ে গেছে। ও খুব ভয় পেয়ে গেল নাকি? ও মেয়ে তো ভয় পাবার মেয়ে নয়। তা হলে? কী হল ওর? যাই হোক, ওরা সুন্দর সুন্দর পথঘাট পেরিয়ে সিনেমা হলের দিকে এগোল। হলের নাম তারিণী। এই অঞ্চলের দেবীর নামেই নাম। সর্বত্রই তারিণী দেবীর জয়জয়কার।

অরবিন্দকাকু এখানে খুবই পরিচিত। তাই তাঁর নাম বলতেই বাড়ি দেখিয়ে দিল লোকে।

অরবিন্দকাকুর একমাত্র মেয়ে শিল্পা তার কাজলকালো চোখদুটি মেলেই অবাক। শিল্পাও ওদের বয়সি। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। তা হোক, যেমনই মুখশ্রী, তেমনি সু-স্বাস্থ্যের অধিকারিণী। সর্বোপরি তার মাথার মেঘকালো চুল আর ভ্রমরের মতো চোখের জন্যই সে বেশি সুন্দর।

শিল্পা অবাক বিস্ময়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই নাকি সৌরভ! তা এই মেয়েটি কে?

কাকিমা দু’জনের হাত ধরে ঘরে ঢোকালেন।

অরবিন্দকাকু যে আনন্দের আবেগে কী করবেন কিছু ঠিক করতে পারলেন না।

সৌরভ ও খেয়ালি প্রণামপর্ব শেষ করল।

অরবিন্দকাকু এক মিনিটের মধ্যে ওদের সমস্ত খবরাখবর নিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, এ মেয়েটি কে? একে তো চিনলুম না! কে হয় তোমাদের? আমার সঙ্গে এসেছে।

সৌরভ বলল, ওর ব্যাপারে পরে বলব। ও

শিল্পা বলল, তোমার নাম কী বন্ধু?

লাজুক লাজুক মুখে খেয়ালি ওর নাম বলল।

শিল্পার চোখদুটি যেন উল্লসিত হয়ে উঠল। বলল, ও মা! কী সুন্দর নাম ! যাক ভালই হয়েছে। তোমাদের পেয়ে যে কী আনন্দ হচ্ছে তা বলবার নয়। সৌরভদা আসবে জানতাম, কিন্তু তুমি আসবে তা তো জানতাম না।

খেয়ালি বলল, আমারও ভাগ্য যে তোমার মতন এক বান্ধবীকে পেলাম। কাকিমা সৌরভকে বললেন, আমরা খুব আশা করেছিলাম তোমার বাবামা-ও আসবেন।

অরবিন্দকাকু বললেন, হ্যাঁ, ওঁরা এলেন না কেন?

এলেন না দুটি কারণে। এক, বাবার এক বন্ধু দেশপ্রিয় পার্কে মর্নিংওয়াক করবার সময় হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যান। দুই, ওনারা পরখ করে দেখতে চান, আমি একা ঘর ছেড়ে বেরোতে পারি কি না। তবে এখন না এলেও পরে আসবেন।

এই ব্যাপার! যাই হোক। পথে আসতে তোমাদের কোনও কষ্ট হয়নি তো?

কিছুমাত্র না। ভিড়ের জন্য বাসে উঠতে পারিনি বলে একটা ট্রাক ম্যানেজ করেছিলাম। সেটা আবার স্পিড বাড়াতে গিয়ে খাদে পড়ল। তারপর আপনাদেরই এখানকার ময়ূরী লজের মালিক তাঁর মোটরে চাপিয়ে নিয়ে এলেন আমাদের। পথে তারিণীদেবীকেও দর্শন করে এলাম।

খুব ভাল করেছ। মা আমাদের কল্যাণময়ী। মা’র চরণ ভরসা করেই তো আমরা বেঁচে আছি।

কাকিমা ততক্ষণে তাড়া দিয়ে ওদের মুখহাত ধোওয়ালেন।

ওরাও পোশাক পরিবর্তন করল।

শিল্পারই চুড়িদার পরে খেয়ালি এখন খুশিতে ঝলমল করছে। কী ভাল যে লাগছে ওকে!

শিল্পা বলল, এই তো সবে সন্ধে। তোমরা জলটল খাও। তারপর তোমাদের নিয়ে একটু বেড়াতে যাব।

কাকিমা প্রত্যেকের জন্য ভাল রকমের জলখাবার নিয়ে এলেন। সারাটা দিনের পর এই হচ্ছে পরিতৃপ্তির খাওয়া। দেহমন একই সঙ্গে ভরে উঠল যেন। খাওয়াদাওয়া যখন শেষ হল তখন সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। চারদিক আলোয় আলো।

আলোর জৌলুসের কারণও আছে। কয়েকদিন আগে কোজাগরি লক্ষ্মীপুজো গেছে তারই প্রতিমা রয়েছে এখানকার বিভিন্ন মণ্ডপে। দলে দলে লোক তাই প্রতিমাদর্শনে যাচ্ছে।

ওরা তিনজনেই চলল প্রতিমাদর্শনে। ঘর থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে আবার ওরা বড় রাস্তায় এল। তারপর এগিয়ে চলল মেইন রোডের দিকে। চমৎকার পথঘাট।

সৌরভ দেখল শিল্পার হাত ধরে কেমন মৃদুমন্দ গতিতে কথা বলতে বলতে চলেছে খেয়ালি। দেখে খুব ভাল লাগল ওর। বাড়ি পালানো একটি মেয়ের এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? সুস্থ সুন্দর নিরাপদ একটা আশ্রয়ের চেয়ে হিতকর আর কিছু কী আছে?

মেয়েটা যেমন খেয়ালি, তেমনই মিশুকে।

এই অল্পসময়ের মধ্যেই কী সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। এমনভাবে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে যেন কতদিনের পরিচয় ওদের। ভাব দেখে মনে হচ্ছে একটা অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের মধ্যেই যেন জড়িয়ে যাবে মেয়েটা। অর্থাৎ শুধু এমনই নয়, পরবর্তীকালেও সৌরভ যখন ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে কেওনঝোড়ে বসবাস করবে তখনও ও নিশ্চয়ই আসতে ছাড়বে না এখানে। শুধু সমস্যা এই, মেয়েটা যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হত, তা হলে কী ভালই না হত।

এক সময় ওরা রাজবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। শহরের এই জায়গাটা অত্যন্ত জনবহুল। অর্থাৎ কিনা এই ছোট্ট শহরটির ম্যাল বলা যেতে পারে জায়গাটাকে।

সৌরভ বলল, শিল্পা, তোমাদের এখান থেকে আমার বাড়িতে ফোনে যোগাযোগের কোনও ব্যবস্থা আছে?

কী যে বলো? কেওনঝোড়ের মতন শহরে দাঁড়িয়ে তুমি কিনা ফোনের জন্য চিন্তা করছ? ওই দেখো তোমার সামনেই টেলিফোন বুথ।

তা হলে তোমরা এক কাজ করো, দু’জনে পায়চারি করো এখানে। আমি ফোনে বাবা-মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।

খেয়ালি বলল, বেশ তো। আমরা ওই ওদিকের দোকানগুলোর দিকে একবার যাচ্ছি।

ওরা রাস্তা পার হয়ে ওপারে যেতেই সৌরভ বুথে গিয়ে ফোনের লাইন চাইল।

সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে গেল লাইনটা।

সৌরভ বলল, বাবা আমি সৌরভ বলছি।

ওদিক থেকে উত্তর এল, ঠিক মতো পৌঁছেছিস তো? কোনও অসুবিধে হয়নি?

না বাবা। কোনও অসুবিধে হয়নি। এবার থেকে আমি একা-একাই বেরোতে পারব। একা বেরনোর মজা অনেক। তবে অভিজ্ঞতা যা হয়েছে তা কী বলব…।

অরবিন্দর খবর কী আগে বল? আমরা যাইনি বলে কিছু বলেনি?

একটু দুঃখ করছিলেন অবশ্য। তবে আমি সব বুঝিয়ে বলেছি। এই তো একটু আগে এসে পৌঁছেছি আমরা।

আমরা! আমরা আবার কোত্থেকে হলি। বাড়ি থেকে তো একা গেলি তুই। তা ছাড়া তোর বেলা বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা।

সেই কথাই তোমাকে বলতে চাই। তার আগে বলি তোমার কি শৈলজাকাকুর কথা মনে আছে?

কেন মনে থাকবে না? একবার সানঘাগরায় গিয়ে চিতাবাঘের খপ্পরে পড়েছিলাম আমরা। উঃ! সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনও বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। তা হঠাৎ ওর কথা জানতে চাইছিস যে? ও কী এখনও আছে?

আছে মানে? যাজপুর কেওনঝোড় রোড রেল স্টেশনের সামনেই খাবারের বড় করে গুছিয়ে বসে আছেন। আমরা তো ওনার দোকানেই খেলাম। উনি আমাদের কাছ থেকে দাম পর্যন্ত নিলেন না। উনিই বললেন, এখানকার বিরজাদেবী নাকি জাগ্রতা। তাই মন্দির দর্শন করে যেতে বললেন।

ঠিকই বলেছে ও। তোরা গেছলি?

হ্যাঁ বাবা। প্রথমে আমরা বৈতরণীতে গিয়েছিলাম। তারপর ওপারের দ্বীপে গিয়ে বরাহনাথ দেখে এসেছি। বরাহনাথ দেখে ফেরবার সময় এমন একটা চক্রে পড়ে গেলাম যা ফোনে বলবার নয়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত বিরজাকে দর্শন না করেই চলে আসতে হল।

ওর জন্য কিছু ভাবিস না। আমরা তো ওই দেশেরই লোক হয়ে যাচ্ছি। তা তোর সঙ্গে আর কে আছে? তুই বার বার আমরা আমরা করছিস কেন?

সেই কথাই বলছি বাবা তোমাকে। আমি তিরুপতি এক্সপ্রেসে যে বার্থ পেয়েছিলাম সেই বার্থের মুখোমুখি বার্থে আমারই বয়সি একটি মেয়ে দেখি কোচ অ্যাটেনডেন্টকে ম্যানেজ করে শুয়ে আছে। কথাবার্তা বলার পর বুঝলাম মেয়েটা বাড়ি থেকে পালাচ্ছে। একটু রাগি, আর ছেলেমানুষিভাবও রয়েছে ওর। অসম্ভব চঞ্চল প্রকৃতির। তারপর একটু হেসে বলল, ছিটেলও আছে।

বলিস কী! তারপর?

মেয়েটি আমার সঙ্গ ছাড়তে চাইছে না কিছুতেই। দেখে বেশ ভাল এবং ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই সঙ্গে নিয়ে নিলাম।

বেশ করেছিস। খুব ভাল কাজ করেছিস বাবা। কী ভাল কাজ যে করেছিস তা কী বলব। এইভাবে কত ছেলেমেয়ে বিপথগামী হয়, রসাতলে যায় তার ঠিক নেই।

ওর নাম খেয়ালি মুখার্জি। বাড়ি বলছে কৈলাস বোস স্ট্রিটে। কোনওরকমে খোঁজখবর নিয়ে ওর বাড়িতে একটা খবর দিতে পার? না পারার কী আছে? ওর বাবার নাম জানিস? জিজ্ঞেস করিনি।

বাবার নাম আগে জিজ্ঞেস করবি তো।

আসলে কেন করিনি জান? বেশি কথা জিজ্ঞেস করলে যদি পালায় তাই। এখন কেমন বুঝছিস?

এখন মনে হচ্ছে ওর পালিয়ে বেড়ানোর ঝোঁকটা কেটে আসছে। তবে সিনেমায় নামার মোহ আছে খুব। এখন বলছে কলকাতা থেকে ভিডিয়ো ভাড়া করে এনে এইখানকার নৈসর্গিক দৃশ্যের ছবি তুলবে।

তাই নাকি? মনে হচ্ছে মেয়েটা যা তা মেয়ে নয়। ভাবালু। এই ধরনের ছেলেমেয়েরা এমনিতেই একটু আত্মভোলা প্রকৃতির হয়। যাই হোক, নজরে রাখ মেয়েটাকে। ওর নাম আর এলাকা যখন জানা গেছে তখন বাড়ি খুঁজে বের করতে একটুও অসুবিধে হবে না আমার। তুই নিশ্চিন্ত থাক। আমি ওর বাড়িতে খবর দিচ্ছি।

মাকে একবার দাও।

বিনতা পাশেই ছিলেন।

ভার্গব ফোনটা স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, ছেলে কথা বলবে তোমার সঙ্গে। বিনতা ফোনে অনেক কথা বললেন ছেলের সঙ্গে। সাবধানে থাকবার উপদেশ দিলেন।

কথা শেষ হলে টেলিফোনের চার্জ দিয়ে বুথ থেকে বেরিয়ে এল সৌরভ। তারপর রাস্তার ওপারে গিয়ে অপেক্ষমান শিল্পা ও খেয়ালির হাত ধরে ঘুরতে লাগল পথে পথে।

সেই রাতটা যে কী আনন্দে কাটল তা বলবার নয়। অনেক রাত পর্যন্ত ওদের অনেক পরিকল্পনা হল। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল সবাই।

ময়ূরভঞ্জের মায়াময় প্রকৃতির বুকে ভোর হল।

সে কী অপূর্ব সুন্দর ভোর, কাছেদূরে শুধু ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। তারই কোলে যে সবুজ বনানী, সেই বনানীর হৃদয় থেকে পাখির কলরব মুখর করে দিল চারদিক।