সাত
পথ নির্জন। মনে লাগে ভয়। কী জানি কী হয়। তবু এক দুরন্ত গতিতে ছুটে যাওয়া।
হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল ওরা। সরকারি পথনির্দেশ দেওয়াই আছে। একদিকের পথ চলে গেছে যাজপুর স্টেশন, একদিকের পথ কটক হয়ে বালাশোর। আর এক দিকের পথ গেছে কেওনঝোড় হয়ে রাউরকেলা।
রাউরকেলা ইস্পাতনগরী কতদূর? কে জানে তা?
সৌরভ বেশ শক্ত করে ধরেছিল খেয়ালিকে।
খেয়ালি বলল, ভাগ্যিস স্কুটার চালানোটা শিখেছিলাম। না হলে আজকের এই বিপদে কিছুতেই পার পেতাম না আমরা।
সৌরভ বলল, সত্যি, তোমাকে যত দেখছি ততই বিস্ময় লাগছে আমার। কেন স্কুটার চালাচ্ছি বলে?
অবশ্যই। আমি সাইকেল ছাড়া কিছুই চালাতে পারি না।
আসলে আমার মামার স্কুটার আছে তো, তাই এটা শিখে নিতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। আমি স্কুটার কেন, মারুতিও চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি। তুমি তো অসাধারণ।
কিছুই না। দু’দিন চেষ্টা করলে তুমিও পারবে।
ওরা স্কুটার থামিয়ে একবার একটু ভেবে নিল কোনদিকে যাবে। সৌরভ বলল, কী ভাবছ?
ভাবছি এখন আমরা যাবটা কোথায়? যাজপুরেই ফিরে যাব? না সোজা চলে যাব কেওনঝোড়ে?
আমার মতে যাজপুরে যাওয়াই ভাল। ওখানে সেই খাবারের দোকানে ঢুকে শৈলজাবাবুর সঙ্গে দেখা করে সব কথা বলে ওনার পরামর্শ নিয়েই যাওয়া উচিত।
আমার মনে হয় সেটা না করাই ভাল। বলেই হঠাৎ গতি বাড়িয়ে ঝড়ের বেগে উড়িয়ে নিয়ে চলল স্কুটারটাকে।
সৌরভ বলল, কী ব্যাপার! হঠাৎ এত জোরে এমন করে চালাচ্ছ যে? এখুনি একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে। আমার খুব ভয় করছে। একটু আস্তে চালাও। সম্ভব না। চেয়ে দ্যাখো পেছনে আমাদের কে আসছে। তার মানে?
একদম কথা বোলো না। শক্ত করে আমাকে ধরে থাকো।
সৌরভ ভয়ে ভয়ে তাই করল।
খেয়ালি আরও জোরে, ঝড়ের চেয়েও দ্রুতগতিতে উড়িয়ে নিয়ে চলল স্কুটারটাকে।
সৌরভ বলল, কারা আসছে বললে?
যম।
সৌরভ ঘুরে তাকিয়েই দেখল প্রায় আট-দশটা স্কুটার ভীষণ গতিতে ছুটে আসছে ওদের দিকে। সর্বনাশ। ওরা নিশ্চয়ই মেনোগুন্ডার লোক। কোনওরকমে খবর পেয়ে পিছু নিয়েছে ওদের। এমনই ভীষণ গতি তাদের, যে ওদের সঙ্গে দৌড়ের পাল্লায় কিছুতেই পেরে উঠবে না ওরা।
যা ভাবল তাই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা এসে হাজির হল ওদের কাছে। সাংঘাতিক চেহারা ওদের। দেখলে যমের বুকও কেঁপে উঠে বুঝি। কিন্তু আশ্চর্য! ওরা ওদের কাছাকাছি এসেও ওদের আক্রমণ করল না, বরং আরও আরও গতি বাড়িয়ে ওদের ফেলে রেখেই চলে গেল।
খেয়ালি বলল, আঃ বাঁচা গেল।
সৌরভ বলল, মনে হয় ওরা ওদের দলের নয়।
এরা তা হলে কারা?
দুধর্ষ কোনও ডাকাতের দল।
এইরকম চেহারার লোকেরাই ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে।
হয়তো তাই করতে যাচ্ছে কোথাও। কেন না যে অসম্ভব গতি ওদের তাতে সেইরকম মনে হয়। কিন্তু আমরা এদিকে কোথায় যাচ্ছি?
তা তো জানি না।
এখানে তো চারদিকেই পাহাড় দেখছি। শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। তারই মাঝখান দিয়ে পিচঢালা পথ।
কী সুন্দর, তাই না? আমার এখুনি একটা পাহাড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে। ওই— ওই দেখো একটা নদী কেমন এঁকে বেঁকে চলেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। কত গাছপালা। এখানেও আমাদের ভিডিয়ো শুটিং লাগালে হয়। কিন্তু এদিকে যে বিপদ আমাদের ঘনিয়ে আসছে।
কেন, কী হল আবার?
স্কুটার আর চালানো যাচ্ছে না।
সে কী! কী হল ওটার!
মনে হয়, যা তেল ছিল তা ফুরিয়ে গেছে।
সর্বনাশ! তা হলে কী হবে?
এক সময় সত্যি সত্যিই থেমে গেল স্কুটারটা। অনেক চেষ্টা করেও তাকে আর চালানো গেল না।
ওরা দু’জনেই স্কুটার থেকে নেমে তখন পথের ধারে বসে হাঁপাতে লাগল। কী যে করবে ওরা কিছুই ভেবে পেল না।
তবে বেশিক্ষণ নয় একটু পরেই ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল ওরা।
সৌরভ বলল, এবার তা হলে?
খেয়ালি বলল, চরৈবেতি।
তবে যাবার আগে স্কুটারটাকে পথের ধারে খাদের ভেতর নামিয়ে দিল। তারপর সামনের পথ ধরে নতুন উদ্যমে হেঁটে চলল ওরা।
খেয়ালি বলল, সত্যি, কথায় আছে না ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্য, আমাদেরও তাই হল।
কী রকম?
এই ধরো না কেন, আমি স্কুটার চালাতে না জানলে কিছুতেই যেমন ওদের খপ্পর থেকে রেহাই পেতাম না, তেমনি স্কুটারটা যদি এইখানে পথের মাঝখানে খারাপ না হত, তা হলে এই রমণীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার হাত থেকেও আমরা বঞ্চিত হতাম।
তোমার এই কথাটা অবশ্য মানতেই হবে।
খেয়ালি বলল, তবে রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরোবার সময় একটা ভুল আমি যা করেছি তা বলবার নয়।
বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে যে ভুল তুমি করেছ, তার চেয়ে বড় ভুল আর কী হতে পারে?
ওটাকে আমি ভুল বলে মনে করি না। মাঝে মধ্যে বাড়ি পালানো খুবই দরকার।
তা হলে এখন থেকে তোমাকে আর খেয়ালি নয়, পলাতকা বলেই ডাকি আমি?
যে নামেই ডাক, আমি কিন্তু আমিই থাকব।
বেশ তো, তোমার মধ্যেই তুমি থাকো। এখন বলো দেখি বাড়ি পালানোর দরকারটা কী ছিল?
এই যেমন ধরো একটা একঘেয়েমির হাত থেকে বাঁচা।
আর?
আর বাড়ির লোকও বুঝুক ছেলেমেয়ে চোখের আড়ালে গেলে জ্বালা কত। তারা একটু হায় হায় করুক, কান্নাকাটি করুক, তবে তো মনের জ্বালাটা জুড়োবে বন্ধু।
তাই যদি হয়, তা হলে ভুলটা তুমি কী করলে?
ভুল করেছি আমার রিস্ট ওয়াচটা সঙ্গে না এনে। অবশ্য এর জন্য মনে আমার খেদ নেই। কেন না হাত বাড়ালেই যে বন্ধু পাওয়া যায়, তা তো জানতাম না। তুমি আমার সেই বন্ধু। কাজেই ঘর ছেড়ে লাভ হয়েছে এই যে, তোমার মতো বন্ধু পেয়েছি।
তোমার মতো বান্ধবী পেয়ে আমার লাভও কী কম হয়েছে?
তোমার লাভক্ষতি কী হয়েছে আমি জানি না। তবে তুমি না থাকলে আমি মরতাম। এত সাহসও দেখাতে পারতাম না।
সৌরভ এবার অন্য প্রসঙ্গে গেল। বলল, আচ্ছা, এইবার একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোমায়, তোমার বাড়ি তো বললে কৈলাস বোস স্ট্রিটে। কিন্তু তোমার মামার বাড়ি কোথায় বললে না তো? যেখানে তুমি এমন চমৎকারভাবে স্কুটার চালানো শিখলে?
আমার মামার বাড়ি অনেক দূরে। গ্রামের দিকে।
কোথায় সেটা?
তুমি চাঁপাডাঙার নাম শুনছ?
বাব্বা! কে না শুনেছে?
সেই চাঁপাডাঙাতেই আমার মামার বাড়ি। সেখানেই দামোদরের বাঁধের ওপর খোলা জায়গায় স্কুটার চালানো শিখেছি প্রথমে। তারপর ফাঁকা মাঠে। চাঁপাডাঙায় তো মাঠের অভাব নেই। শুধু স্কুটার কেন মোটরও চালাতে পারি। মোটর চালিয়েছ কখনও?
নিশ্চয়ই। তবে কি না ভয় করে খুব।
কথা বলতে বলতেই ওরা সেই পাহাড়-জঙ্গলের দেশে একটু যেখানে লোকালয় সেইখানে পৌঁছল। এখানে কিছু ছোট ছোট দোকানপত্তর আছে। লোকজনের সংখ্যা কম বলে জমজমাটও নয়। জায়গাটাও ভারী সুন্দর।
ঘড়ি না থাকলেও রোদ্দুর দেখে বোঝা গেল বেলা অনেক হয়েছে। তাই খিদেয় চুঁই চুঁই করছে পেট। করলে কী হবে? একমাত্র মুড়ি তেলেভাজা, বোঁদে মিহিদানার লাড্ডু, আর ছানার গজা ছাড়া খাবার মতোও কিছু নেই।
খেয়ালি পায়ে পায়ে এগিয়ে একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, এই জায়গাটার নাম কী?
উত্তরে সে কী যে বলল কিছুই বোঝা গেল না। তবে এটুকু বোঝা গেল এখানকার মানুষজন খুবই উদার এবং অত্যন্ত সরল প্রকৃতির।
আসলে খুবই অনুন্নত জায়গা। মানুষজন যাঁরা আছেন তাঁরা সবাই গ্রাম্য লোক। দেহাতি যাকে বলে।
সৌরভ নিজে এবার দু’-একজনের সঙ্গে কথা বলে জানল এই পথ কেওনঝোড় হয়ে সোজা চলে গেছে রাউরকেল্লায়। এ পথে বাসও যায়। বাস যায় শুনে বুকে বল পেল একটু। খেয়ালিকে বলল, তা হলে আমাদের দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। যখন হোক একটা-না-একটা বাস পাবই। বলতে বলতেই দেখা গেল একটা বাস আসছে:
সৌরভ বলল, এই বাসেই উঠব আমরা।
খেয়ালি বলল, কখনও নয়। আগে পেটে কিছু দিই, তারপর। বাস রুট যখন, বাস তখন আরও আসবে। বলে একজনকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এখানে কোনও খানা-খানেকা হোটেল মিলেগা?
লোকটি ওর কথা বুঝল। তারপর কী যেন ভেবে বলল, না, এখানে হোটেল কোথায়? তবে খেতে চাইলে তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
সৌরভ খেয়ালি দু’জনেই বলল, হ্যাঁ। আমাদের সেই ব্যবস্থাই করে দিন।
লোকটি ওদের গ্রামে একজনদের বাড়িতে নিয়ে গেল। দেখে মনে হল খুবই নিম্নশ্রেণীর লোক এরা। বলল, ভাতের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ডিমের ঝোল-ডালভাত। দশ টাকা করে কুড়ি টাকা।
ওরা তো এক কথায় রাজি।
দুঃখ শুধু একটাই, পাহাড়ের কোলঘেঁষে এমন সুন্দর একটা নদী তির তির করে বয়ে যাচ্ছে, অথচ সেই নদীতে দু’জনের পক্ষে স্নান করা সম্ভব নয়, কেন না সৌরভের কিট ব্যাগে যা আছে তাতে ওর কোনও অসুবিধে নেই। এক্সট্রা প্যান্টশার্ট, গামছা, কি তোয়ালে সব কিছুই আছে। কিন্তু এই বাঁদরিটা কিছুই আনেনি।
সৌরভ বলল, তুমি যদি কিছু না মনে করো তা হলে আমি একটু স্নান করে নিই। আমি?
তুমি তো কিছুই আনোনি সঙ্গে, কী করে কী করবে তা হলে?
তোমারটাতেই চালিয়ে নেব। যদি তোমার প্যান্টশার্টগুলো আমাকে ধার দাও।
আমার প্যান্টশার্ট তুমি পরবে?
তাতে কী? মেয়েরা বুঝি ছেলেদের পোশাক পরে না?
তা কেন?
অতএব ওরা একজনের বাড়িতে উঠে পোশাক ছেড়ে তোয়ালে, গামছা ইত্যাদি নিয়ে নদীতে গেল স্নান করতে। পাহাড়িয়া নদী।
উচ্ছল। চঞ্চল। যেন নৃত্যের ভঙ্গিমায় স্রোতের নূপুর বাজিয়ে বয়ে চলেছে। যেখানে একটা বড় পাথর, সেখানে কল কল শব্দ তুলে লাফিয়ে নেচে কী কাণ্ডটাই না করছে। স্নিগ্ধ শীতল জল। কী মিষ্টি… কত মিষ্টি… আহা মিষ্টি…।
খেয়ালি আপন মনে গুন গুন করে একটা গানই গেয়ে উঠল। মন ভ্রমরার গান।
হঠাৎ সৌরভ চেঁচিয়ে উঠল, ময়ূর! ময়ূর! ওই দেখো, কী সুন্দর ময়ুর। কী মজা!
খেয়ালি বলল, কই, কোথায়?
ওই তো। দেখতে পাচ্ছ না, একেবারে চোখের সামনেই। ওই— ওই দেখো। কত— কত ময়ূর !
আরে সত্যিই তো। একটা-দুটো নয়। অনেক ময়ূর, ময়ূরগুলো এ গাছের ডাল থেকে উড়ে ওগাছে যাচ্ছে। এইরকম মুক্ত পরিবেশে ময়ূর দেখার আনন্দই আলাদা।
যাই হোক, ওরা ময়ূর দেখে নদীর জলে স্নান করে যখন গা মুছে পোশাক পরিবর্তন করল, তখন দেহমন বেশ সতেজ হয়ে উঠল ওদের। সৌরভের প্যান্টশার্টে খেয়ালিকে খুবই ভাল লাগল। ওকেও একটা ছেলে বলে মনে হল তখন। এরপর পেটভরে ভাত খেয়ে একটা বাসে উঠতে পারলেই নিশ্চিন্দি।