সানঘাগরার আতঙ্ক – ৬

ছয়

আমি কি কথা বলে দেখব?

খেয়ালি বলল, বলে দেখতে পারো। তবে কিনা কোনও লাভ নেই। এ ছবি রিলিজ করলেও আমি জানতে পারব না।

তবু একটু বলেই দেখি না। এই বলে সৌরভ এগিয়ে গেল কর্মকর্তাদের দিকে। তারপর এই ছবির যিনি পরিচালক তাঁর সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবটা রাখতেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে না করে দিলেন।

খেয়ালি তখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

ভদ্রলোক হঠাৎ কী ভেবে যেন খেয়ালির দিকে তাকিয়ে বললেন, এর হবে। হতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আমাদের এই ছবির আজকের দৃশ্যে তো নেওয়া যাবে না। কেন না খুবই ছেলেমানুষ। বলে পকেট থেকে একটি কার্ড বের করে বললেন, এতেই আমাদের ঠিকানা পত্তর সব দেওয়া আছে। কাল সকালে ভুবনেশ্বরে এই ঠিকানায় যেন দেখা করে। ওকে আমরা চান্স একটা দেবই।

খেয়ালি কার্ডটা হাত পেতে নিল বটে, তবে ওর মুখে খুব একটা আশার আলো ফুটল না।

সৌরভ বলল, তবে আর কী? তুমি তো জিতেই গেলে। আর তোমাকে পায় কে?

তারপর খানিকটা এসে বলল, খেয়ালি মৃদু হেসে টান দিল সৌরভকে। শোনো, এদের প্রস্তাবটা আমি মেনে নিচ্ছি না।

সৌরভ বলল, প্রস্তাব তো ওদের না, আমাদের। তা হোক। তবু ভুবনেশ্বরে আমি যাচ্ছি না।

কেন যাচ্ছ না?

ওখানে গেলে তো আমাকে একা যেতে হবে। এখন আমরা যাজপুর যাব। সেখান থেকে তুমি চলে যাবে কেওনঝোড়। আমি একা কী ভাবে যাব?

কেন? ওখান থেকেই তো ভুবনেশ্বরের বাস পেয়ে যাবে।

তা যাব। কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকব কোথায়? শুনেছি ওখানকার হোটেল চার্জ অনেক বেশি।

একদিনের তো মামলা। ওঁদের সঙ্গে দেখা করে ওঁদের ছবিতে ভিড়ে গেলে কোনও প্রবলেমই থাকবে না আর।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি চান্স না দেয়।

দেবেই। একান্ত না দিলে তুমি কেওনঝোড়ে চলে আসবে। আমি এখন কয়েকটা দিন ওখানে থাকব। গেলেই খা পেয়ে যাবে আমার।

ওরা কথা বলতে বলতে নদীর ঘাটে এল। তারপর একইভাবে নৌকোয় চেপে নদী পার হল।

কী ভাল যে লাগল নদী পার হতে। ঠিক যেন স্বপ্নের নদী।

ওপারে গিয়ে দু’জনেই একটু করে বৈতরণীর জল মাথায় ছেটাল প্রথমে। তারপরে ডাঙায় উঠে প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে লাগল।

খেয়ালি বলল, দেখো সৌরভ, আমি যখন রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছি তখন আমার মনের অবস্থা একরকম ছিল, এখন কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গেছে। এখন কোনও কিছুর মোহেই তোমার মতন বন্ধুকে আমি হাতছাড়া করতে পারব না।

তা হলে তো সিনেমায় নামাও হবে না তোমার।

না হোক, তাতে ক্ষতি নেই। তা ছাড়া এইসব ছবির ব্যাপারে উৎসাহও নেই আমার। তার চেয়ে আমরা দু’জনে মনে মনে যেরকম পরিকল্পনা করেছি, সেইরকম হওয়াই ভাল। হাজার পাঁচেক টাকা হলেই হয়ে যাবে। আমরাই আমাদের মনের মতন ছবি করতে পারব।

পাঁচ হাজার লাগবে কীসে?

বাঃ রে। দেড়-দু’হাজার টাকা তো ভিডিয়োওয়ালারাই নেবে। এরপর তাদের গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসা, পৌঁছে দেওয়া এসব বুঝি করতে হবে না? এসবের টাকা কোথা থেকে আসবে?

সত্যিই তো। একথা আমি তো একবারও ভাবিনি।

তাই বলি কী, আর দেরি না করে আমরা যা মন করেছি তাই করিগে চলো। এই পাঁচ হাজারটা কোথা থেকে আসবে তা হলে?

ফিফটি ফিফটি। আমার কাছে তো দু’ হাজার আছেই, বাকিটা বাবার কাছ থেকে চেয়ে নেব। তুমিও তোমার বাবার কাছ থেকে ম্যানেজ করবে হাফ টাকা, পারবে না?

তুমি যখন বাড়ি থেকে চলেই এসেছ, তখন বাবাকে তুমি পাচ্ছ কোথায়? আরে আমি কী বরাবরের জন্য এসেছি? রাগ পড়লেই আবার চলে যাব। তোমার বাড়ি কোথায়?

কৈলাস বোস স্ট্রিটে।

তার মানে কলকাতায়।

ওরা যখন নিজেদের মধ্যে এইভাবে কথা বলতে বলতে আসছে সেইসময় হঠাৎ একটি ছেলে বেপরোয়ার মতো স্কুটার চালিয়ে ওদের দিকে এল। এমনভাবে এল যে, আর একটু হলেই ধাক্কা লাগত ওদের।

. খেয়ালি বোধহয় একটু রাগি প্রকৃতির মেয়ে। তাই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, জাস্ট লাইক এ মাংকি।

আর যায় কোথা। ঘুরে তাকাল ছেলেটি।

তারপর স্কুটার নিয়ে সবেগে ওদের সামনে এসে ব্রেক সৌরভ আর খেয়ালি দু’জনেই তখন ভয় পেয়ে গেছে। অচেনা জায়গায়, অচেনা পরিবেশে এ কী বিপদ!

ছেলেটি ওদের চেয়ে বয়সেও অনেক বড়। তাকে যুবক বলা উচিত। চেহারা দেখে মনে হয় অত্যন্ত রাফ টাইপের। অর্থাৎ সোজা বাংলায় যাকে বাজে প্রকৃতির বলা হয় তাই।

যুবক স্কুটার থেকে নেমে এসে বলল, কী বললে খুকুমণি?

খেয়ালি বলল, যা বলেছি ঠিকই বলেছি।

আমি মাংকি? তুমি কি নিজেকে ডাকের সুন্দরী মনে করো? এখুনি তোমার ফেস কাটিং আমি চেঞ্জ করে দিচ্ছি। বলে কোমরের বেল্ট খুলে খেয়ালির মুখে, যেই না মারতে যাবে সৌরভ অমনি সজোরে একটা ধাক্কা দিল তাকে। যুবক সেই ধাক্কা সামলাতে না-পেরে বাঁধের ওপর থেকে গড়িয়ে একেবারে বৈতরণীর জলে।

চারদিক থেকে অনেক লোকজন তখন হই হই করে ছুটে এসেছে।

খেয়ালি বলল, সর্বনাশ! এ কী করলে তুমি? এখন যদি উঠে এসে তোমাকে মারে?

না হলে ও যে তোমাকে মারত। আর ওই মোটা বেল্টের আঘাত তুমি কি সহ্য করতে পারতে? তা ছাড়া মারলে ও তোমার মুখেই মারত।

জলে পড়া যুবক তখন সমানে চেঁচাচ্ছে, ওদের দু’জনকেই ধরে রাখ জয়। ওদের আমি ছাড়ব না।

কে জয় তা কে জানে?

অপর এক যুবক তখন ছুটে আসছে ওদের দিকে।

খেয়ালি বলল, সৌরভ পালাও। আমার যা হয় হোক। তুমি অন্তত বাঁচো। সৌরভ খেয়ালির একটা হাত ধরে টান দিয়েই তিরবেগে ছোটা শুরু করল। ওদের পেছনে তখন ধর ধর রবে ছুটে আসছে অনেকেই।

ব্যাপারটা এমনই হয়ে গেল যেন ওরাই দোষী, তাই ওদের ধরবার জন্য তেড়ে আসছে লোকগুলো।

সৌরভ বলল, আর বোধহয় বাঁচলাম না। এবার ধরা পড়লাম বলে।

খেয়ালি বলল, এত সোজ়া নাকি? সামনের ওই চায়ের দোকানের পাশে একটা সাইকেল রাখা আছে সেটা যারই হোক নিয়ে পালিয়ে এখনকার মতো বাঁচতে হবে। তুমি সাইকেল চালাতে পার তো? পারি।

ওরা কথা বলতে বলতেই আচমকা সাইকেলটা টেনে নিয়েই চেপে বসল তাতে। খেয়ালিকে সামনের রডে বসিয়ে নিয়ে ঝড়ের বেগে উধাও হয়ে গেল দু’জনে। তারপর বড় রাস্তার কাছাকাছি এসে সাইকেলটাকে এক জায়গায় রেখে একটা অটো দেখতে পেয়ে উঠে পড়ল তাতেই।

অটো চালক জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে তোমরা?

আপাতত বিরজা মন্দিরে। খুব তাড়াতাড়ি যাবেন কিন্তু।

অটো জোরেই চলতে লাগল।

চালক বলল, তোমরা এমন হাঁফাচ্ছ কেন ভাই? কী হয়েছে

তোমাদের?

মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। মন্দির দেখে ফেরবার সময় একজন বদ লোকের পাল্লায় পড়ে যাই। তার হাত থেকে বাঁচবার জন্যই এইভাবে ছুটে এসেছি।

সৌরভ বলল, আমরা বৈতরণীর ওপারে বরাহনাথের

তার কি চাপদাড়ি? স্কুটার ছিল সঙ্গে?

হ্যাঁ। সে একা নয়। মনে হয় দলবলও ছিল তার।

বুঝেছি, তোমরা মেনোগুন্ডার হাতে পড়েছিলে

মেনোগুল্ডা! চেহারা কিন্তু খুব একটা সাংঘাতিক নয় তো?

গুন্ডামি করতে গেলে কি চেহারার দরকার হয়? দুর্দান্ত সাহস থাকলেই যথেষ্ট।

খেয়ালি বলল, তবে একেবারে দুর্বলও নয়। আমরা ওর কাছে নেহাতই শিশু। বাপের অফুরন্ত টাকা। দু’-তিনটে কোল্ড স্টোরেজের মালিক। কটকে, ভুবনেশ্বরে ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে মোটা টাকা আয় করে ওর বাবা। তা ছাড়া আরও অনেক রকমের ধান্দাবাজি করে। ওর বাবার নাম শ্যাম বিশোয়াল। বিশাল ব্যাপার ওদের। কিন্তু ছেলেটা একেবারেই যা তা। ওর খপ্পর থেকে বেঁচেছ এই ঢের।

সৌরভ বলল, বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না, তবু বেঁচেছি।

এই এলাকার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত এখনও কিন্তু জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না।

খেয়ালি বলল, কী নাম যেন বললেন ওর? মেনোগুন্ডা? খুব অত্যাচার করে বুঝি?

করে মানে? তোমাদের বয়সি মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না ওর জন্যে। সে কী! প্রতিবাদ করে না কেউ?

কে করবে? তোমাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমরা বাঙালি। কলকাতার ছেলেমেয়ে। তোমাদের ওখানে কেউ প্রতিবাদ করে? আসলে যুগটা এখন এমনই, প্রতিবাদ করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছে লোকে। বলেই একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে বলল, তোমরা কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকা।

মনে হয় মেনোগুন্ডা তোমাদের পিছু ছাড়েনি।

খেয়ালি বলল, ওরা কী করে জানবে আমরা এদিকে এসেছি?

সৌরভ বলল, হয়তো কেউ বলে দিয়েছে। আমরা যেখানে সাইকেল রেখে অটোয় উঠেছি, সেখানেই কেউ বলে দিয়েছে আমাদের কথা। তাই পিছু নিয়েছে আমাদের।

অটোচালক বলল, মেনোটা একা নয়। সঙ্গে জয়রামও আছে।

জয়রামটা কে?

সে আর এক ধান্দাবাজ। বুধিরাম পতির ছেলে।

খেয়ালি বলল, শনির সঙ্গে রাহুর মিলন।

ঠিক তাই।

মেনোগুন্ডার স্কুটার ঝড়ের গতিতে এসে ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর হঠাৎই ওদের দেখতে পেয়ে সজোরে ব্রেক কষল অটোর সামনে এসে। ওর স্কুটারের চাকা অটোর সামনের চাকায় এমন ধাক্কা মারল যে অটোর সমস্ত ঘড়-ঘড়ানি স্তব্ধ হয়ে গেল।

মেনো আর জয় দু’জনেই নেমে এল স্কুটার থেকে। ওদের দু’জনেরই চোখেমুখে শয়তানের হাসি।

মেনো বলল, পালিয়ে যাবি কোথায়?

অটোচালক বলল, এই সমস্ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ওপর তোমাদের বীরত্বটা কী না দেখালেই নয়?

মেনো এক ধাক্কায় ফেলে দিল অটোচালককে। বলল, চোপ বে। একদম ফুটুর ফুটুর করবি না। এই বিচ্ছুদের চিনিস? অতলোকের সামনে আমার গায়ে হাত দেয়, আমার প্রেস্টিজ পাংচার করে দিয়েছে একেবারে।

জয় তখন শক্ত করে চেপে ধরেছে সৌরভকে।

আর মেনো একেবারে পাঁজাকোলা করে খেয়ালিকে তুলে নিয়ে বলল, জয় একটু দেখতরে এখানে রাস্তা তৈরির জন্যে যে গরম পিচের ড্রামটা ছিল সেটা কোন দিকে। ওকে আমি জানে মারব না, তবে গরম পিচে ওর মুখটা শুধু ডুবিয়ে দেব।

মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল অঘটন।

হঠাৎ একটা প্রাণান্তকর চিৎকার দিয়ে খেয়ালিকে নামিয়ে বসে পড়ল মেনো। ওর একটা চোখ বেয়ে ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে। খেয়ালি বোধহয় তৈরিই ছিল। তাই কোন ফাঁকে যে ছুরিটা বের করে গুঁজে দিয়েছে ওর চোখে, তা কে জানে?

আর এই রকম যখন অবস্থা, তখন সৌরভও একটা চান্স নিতে ছাড়ল না।

জয়ের হাতটা এত জোরে কামড়ে দিল যে চিংড়ির মতন লাফাতে লাগল জয়।

এই সুযোগে তাকেও কবজা করবার জন্য তার চোখেমুখে একরাশ ধুলো ছুড়ে দিতেই ভুবন যেন অন্ধকার।

খেয়ালি তখন আর সেই শান্ত ধীর কিশোরীটি নেই। সেও যেন মত্ত মাতঙ্গিনী। সে চকিতে মেনোর স্কুটারে চেপেই স্কুটারের মুখ ঘুরিয়ে সৌরভকে বলল, একটুও দেরি না করে বসে পড়ো। যত শিগগির সম্ভব আমাদের পালাতে হবে এখান থেকে।

হতচকিত অটোচালকের চোখের সামনে দিয়ে হাউই-এর মতো উড়ে গেল ওরা। যাবার সময় শুধু অটোচালককে হাত নেড়ে একটা মিষ্টি অভিনন্দন জানিয়ে গেল।