সানঘাগরার আতঙ্ক – ৫

পাঁচ

কত টাকা আছে তোমার?

দু’হাজার টাকা আছে।

এত টাকা কোথায় পেলে তুমি?

চুরি করেছি। তবে প্রতিবেশীর টাকা

নয়। বাবার টাকাই চুরি করেছি। তুমি দেখছি সব দিকেই এক্সপার্ট!

তুমিও বা কী কম যাও বাছাধন? দিব্যি তো বাপের সুপুত্তুরটি হয়ে যার্থে উঠে শুয়েছিলে। বলি আমার মতন পালিয়ে টালিয়ে আসছ না তো?

তা হলে কি আমার কাছে টিকিট থাকত?

দোকানের একজন কর্মচারী এলে সৌরভ তাকে গরম গরম কচুরি আর দুটো করে রাজভোগের অর্ডার দিল।

খেয়ালি বলল, এখন মন দিয়ে শোনো যা বলি। আমার বহুদিনের স্বপ্ন সিনেমায় আমি নামব। তেলেগু ভাষাটা জানি না, না হলে ওই ছবিতে নেমে দেখিয়ে দিতাম অভিনয় কাকে বলে। বম্বে তো অনেকদূর। তা ছাড়া হিন্দি ছবিতে কমপিটিশনও খুব। না হলে হিন্দিতে চান্স পেলে জয়াপ্রদা আর শ্রীদেবীর হাতে হাত আমি মেলাতামই।

তা যখন হচ্ছে না, তখন কী করবে ঠিক করলে?

সেইজন্যেই তো বেছে বেছে তোমাকেই গুরু করেছি ব্রাদার। তুমি সঙ্গে থাকলে আমি বম্বে কেন, গোয়াতেও যেতে রাজি আছি। যাবে? এখানে বেশটি করে পেট ঠুসে জলখাবার খেয়ে চলো আমরা বম্বের গাড়িতে চেপে বসি। রিজার্ভেশনের দরকার নেই, দু’জনে লেডিজ কম্পার্টমেন্টে ঢুকে বসে থাকব।

তারপর চেকার এসে যখন আমাকে ধরবে?

লেডিজ কম্পার্টমেন্টে চেকার খুব কম ওঠে। উঠলেও তুমি একটা বাঙ্কে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে। তা ছাড়া চেকাররা তোমার আমার মতন ছেলেমেয়েদের কিছু বলে না। ধরলে ধাড়িগুলোকেই ধরে।

সৌরভ বলল, তোমার যুক্তিটা মন্দ নয়। তবে কিনা এটা বম্বের লাইন নয়, আর আমারও সিনেমায় নামার ইচ্ছে নেই।

তুমি একটা ওয়ার্থলেশ। তা এই লাইনে কোথায় যাওয়া যায়?

মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর। কাছাকাছির মধ্যে বিশাখাপত্তনম, হায়দ্রাবাদ।

তাই চলো। ওইখানকার স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘুরে তেলেগু ফিল্মেই একটু চান্স নিই চলো। ওখানে নিশ্চয়ই সিনেমায় নামার জন্য বম্বের মতো অত খেয়োখেয়ি হবে না।

সৌরভ খাবার খেয়ে, জল খেয়ে বলল, আমি তো বললাম, সিনেমায় নামা টামার ব্যাপারে আমি নেই।

দোকানদার এতক্ষণ দূরে বসে ওদের কথাবার্তা সব শুনছিলেন। এবার ইশারায় সৌরভকে ডেকে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, মেয়েটি তোমার কে হয়? সৌরভ চাপা গলায় বলল, আমাদের কথাবার্তা কি আপনি শুনেছেন? সব শুনেছি।

তা হলে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে মেয়েটি। ট্রেনেই আলাপ। সেই থেকে সঙ্গ ছাড়ছে না।

দেখে কিন্তু বেশ ভালঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। তা কোথায় যাবে তোমরা?

আসলে আমি এসেছি কেওনঝোড় যাব বলে। ওখানে একটু পাহাড়-পর্বত দেখব, ঘুরব। শুনেছি ওখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য নাকি চমৎকার।

কোথায় উঠবে ওখানে?

আমার বাবার মামারবাড়ি ওখানে। তাঁরা এখন কেউ নেই। তবে বাবার এক বন্ধু আছেন, তাঁর বাড়িতেই উঠব। না হলে লজ তো আছেই।

তোমার বাবার বন্ধু? কী নাম বলো তো?

পুরো নাম তো জানি না। আমি তাঁকে অরবিন্দকাকু বলি।

তোমার বাবার নাম কী? তুমি ব্রিগেডিয়ার ভাগবের ছেলে?

সৌরভ চমকে উঠল। বলল, আপনি কী করে চিনলেন বাবাকে?

আরে আমার বাড়িও যে কেওনঝোড়ে। যেই বলেছ তোমার বাবার মামারবাড়ি ছিল ওখানে, আর অরবিন্দর নাম করেছ, তখনই বুঝেছি তুমি ভার্গবের ছেলে ছাড়া কেউ নও। অরবিন্দ, আমি, তোমার বাবা, সবাই আমরা পরস্পরের বন্ধু। আমার নাম শৈলজা।

সৌরভ তাড়াতাড়ি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। বলল, আরে! আপনার নামও তো বাবার মুখে অনেক শুনেছি।

দেখ কারবার। তা তোমার বাবা আছেন কেমন?

ভালই আছেন। এখন বলুন আমাদের বিল কত হল?

তুমি ভার্গবের ছেলে, আমার দোকানে খাবার খেয়ে দাম দেবে তুমি? সাহস তো কম নয়। তা শোনো, ওই মেয়েটির দেখছি সিনেমায় নামার খুব শখ। আজ একটা ওড়িয়া ছবির শুটিং হচ্ছে বৈতরণীর ওপারে ছোট্ট একটি দ্বীপে, বরাহনাথ মন্দিরের কাছে। ওকে বরং সেখানেই নিয়ে যাও। অমনি বিরজাদেবীর মন্দিরে গিয়ে একটা প্রণামও করে এসো। এখুনি তোমাদের যাবার তাড়া নেই তো। যাও, চলে যাও।

সৌরভ বলল, বিরজামন্দির কোথায়?

যাজপুরে গিয়ে যাকে জিজ্ঞেস করবে সেই দেখিয়ে দেবে।

এটা তা হলে কী? এইটাই তো যাজপুর।

এটা হচ্ছে যাজপুর কেওনঝোড় রোড। যাজপুর শহর এখান থেকে সাতাশ কিমি দূরে। ঘন ঘন ট্রেকার যাচ্ছে। যে কোনও একটাতে চেপে চলে যাও, চমৎকার বেড়ানো হবে। তারপর ফিরে এসে এখানেই যে কোনও হোটেলে খেয়েদেয়ে কেওনঝোড়ের বাসে চেপে বসো। সন্ধের আগেই পৌঁছে যাবে।

দোকানদারকে অভিনন্দন জানিয়ে ওরা দু’জনে রাজপথে এসে দাঁড়াল। খেয়ালি বলল, দেখলে তো আমি কীরকম লাকি। খাবার খেলুম অথচ এক পয়সাও খরচা করতে হল না। আসলে ওই যে বলেছি সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র।

এটা সুন্দর মুখের জন্য নয় ম্যাডাম। উনি আমার বাবার বন্ধু তাই। ছাড় তো ব্রাদার। আমাদের দু’জনকে প্যাঁচাপেঁচির মতন দেখতে হলে কোনও বন্ধুই দরদ দেখাত না। ঝেঁটিয়ে বিদেয় করত।

ওরা যেখানে এসে দাঁড়াল সেখানে তখন ট্রেকারগুলো একটানা এবং একঘেয়ে সুরে ‘যাজপুর যাজপুর’ করে মুখের ফ্যানা বের করে ফেলছে। সৌরভ ও খেয়ালি তারই একটিতে উঠে বসল।

কয়েকজন বাঙালি তীর্থযাত্রীও সেই ট্রেকারে ছিলেন। তাঁরাও যাচ্ছেন যাজপুর। বিরজামন্দিরে পুজো দিতে।

সৌরভ জিজ্ঞেস করল, আপনারা যে পুজো দিতে যাচ্ছেন ওই মন্দির কি খুবই প্রাচীন? পুজো দিয়েই ফিরে আসবেন, না থেকে যাবেন ওখানে? সঙ্গে অনেক মালপত্তর দেখছি।

যাত্রীদের মধ্যে একজন বয়স্কা মহিলা ছিলেন। উনি বললেন, তোমরা এই প্ৰথম আসছ বুঝি?

হ্যাঁ।

তা হলে শোনো, কাশীর যেমন অন্নপূর্ণা, কালীঘাটের যেমন কালী, যাজপুরের এই বিরজাও তেমনি প্রসিদ্ধ। একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম পীঠ এটি। বিরজাক্ষেত্র। বিরজা ঔড্রদেশে চ…। সেই বিরজা। দেবীর দুটো হাত এবং সিংহবাহিনী। বহু আগে যযাতি রাজার রাজত্ব ছিল এখানে। তাই যযাতিপুর থেকেই যাজপুর নাম হয়েছে। বৈতরণীর তীরে এক সুপ্রাচীন জনপদ এই যাজপুর।

সৌরভ বলল, ও। আমরা কিন্তু জানতাম না।

তোমাদের সঙ্গে কেউ নেই?

না। আমরা দু’জন। কেওনঝোড়ে যাচ্ছিলাম এক আত্মীয়ের বাড়ি। এখানে যাজপুর স্টেশনে আমাদের পরিচিত একজন বলে দিলেন এই মন্দিরে এসে বিগ্রহদর্শন করে যেতে।

বেশ করেছ বাবা। খুব ভাল কাজ করেছ। মা ভীষণ জাগ্রতা। তোমাদের মঙ্গল করবেন।

খেয়ালি বলল, আচ্ছা মাসিমা, বৈতরণী ওখান থেকে কতদূরে?

দূর আছে। আমরা যেখানে ট্রেকার থেকে নামব সেখান থেকে দুটো পথ দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে। একটা গেছে বিরজা মন্দিরের দিকে, আর একটা বৈতরণীতে। সেখানে অখণ্ডলেশ্বর, অঙ্গেশ্বর শিব আছে। অনেক শিবেরেই মন্দির আছে শহরময়। বহু পুরনো আমলের মন্দির। বৈতরণীর তীরে আছে বিখ্যাত জগন্নাথের মন্দির। ওই বৈতরণীর তীরেই যযাতি রাজা দশাশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। ওখানকার ত্রিলোচনেশ্বর শিবের মন্দিরও বিখ্যাত। অখণ্ডলেশ্বর মন্দিরের গায়ে দেখবে কী সুন্দর জৈন তীর্থংকর আদিনাথের মূর্তি খোদাই করা আছে। তা ছাড়াও দেখবে কালীমন্দির, গণপতি মন্দির। অষ্টমাতৃকা মন্দিরের মূর্তিগুলিও দেখবার। সঙ্গে তোমাদের মা থাকলে খুব ভাল হত। মা এলেন না কেন? আসলে আমার মা সচরাচর বাইরে কোথাও বেরোতে চান না।

কেওনঝোড়ে কে আছেন তোমাদের?

আমার বাবার বন্ধু ওখানে থাকেন। উনি প্রায়ই যেতে বলেন, কিন্তু যাওয়া আর হয় না। তাই এবারে যাব মন করেই বেরিয়ে পড়েছি।

বেশ করেছ। আমরা অবশ্য কখনও যাইনি কেওনঝোড়ে। তবে শুনেছি খুব নাকি ভাল জায়গা। অনেক পাহাড় আছে, জঙ্গল আছে। সেইসব পাহাড়ে-জঙ্গলে নাকি ময়ূর আছে খুব।

সৌরভ বলল, জানি না। আমরা তো প্রথম যাচ্ছি। তবে বাবার মুখে শুনেছি এককালে নাকি ময়ূর ছিল খুব।

সেইজন্যেই বুঝি ময়ূরভঞ্জ?

হবে। ঠিক জানি না আমরা।

তোমরা কোন গাড়িতে এলে?

আমরা এসেছি হাওড়া থেকে তিরুপতি এক্সপ্রেসে। আপনারা?

আমরা কাল সন্ধেবেলা ইস্ট কোস্টে এসেছি। রাত্রে একটা লজে ছিলাম। আজ পুজো দিতে যাচ্ছি। ওখানে ট্রাস্টির পান্থশালা আছে। সেখানে দু’দিন থেকে, তারপর আবার কলকাতায় ফিরে যাব।

ট্রেকার একসময়’যাজপুর শহরে পৌঁছল। স্টেশন থেকে এই বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ভাড়া ছ’টাকা। ওদের ভাড়া ভদ্রমহিলাই তাঁর পরিবারের লোকেদের সঙ্গে দিয়ে দিলেন।

খেয়ালি একচোখ টিপল সৌরভকে। তারপর চাপা গলায় বলল, দেখলে তো, কী বলেছিলাম? সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র।

সেই ভদ্রমহিলা তাঁর পরিবারের লোকেদের নিয়ে একটা জিপ ভাড়া করে পান্থনিবাসের দিকে চলে গেলেন। ওরা দু’জনে গল্প করতে করতে বৈতরণীর দিকে চলল।

সৌরভ বলল, ওখানে একটা দ্বীপের মধ্যে ওড়িয়া ছবির শুটিং হচ্ছে জান তো? বেল পাকলে কাকের কী?

এইবার দেখা যাবে সুন্দর মুখের জয়টা কীরকম হয়। আমি তো সোজা গিয়ে তাদের পরিচালককে বলব তোমাকে একটা চান্স পাইয়ে দেবার জন্য।

সৌরভের কথা শুনে লাফিয়ে উঠল খেয়ালি, রক্ষে করো বাবা। ওই ‘ঠাকুর দরশন পাইব কাঁই’ ছবিটবির মধ্যে আমি নাই। হিন্দি অথবা তেলেগু ছবি ছাড়া নামবই না আমি।

তারপর হঠাৎ কী ভেবে যেন লাফিয়ে উঠল খেয়ালি। বলল, দেখ, হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। ধরো কেউ যদি কোনও ছবিতে আমাদের চান্স না দেয়…।

এর মধ্যে আবার আমাদের আসছে কোত্থেকে?

আমি একটা কথার কথা বলছি। ধরো কেউ যদি চান্স না দেয় তা হলে আমরা নিজেরাও তো নিজেদের মনের মতো করে সুন্দর একটা ছবি করতে পারি। তা হলে ভাল ছবির নায়ক-নায়িকা হওয়ার জন্য আমাদের আর অপেক্ষা করতে হবে না।

সেটা কীভাবে হবে?

কথা বলতে বলতে ওরা বৈতরণীর ঘাটে চলে এল। নির্জন নদীতীর। দু’-একজন স্থানীয় লোক ছাড়া কোনও যাত্রী নেই। সেই ঘাটে এসে দু’জনে পাশাপাশি বসে চারদিকের সুন্দর দৃশ্য দেখতে লাগল।

খেয়ালি বলল, এবারে মন দিয়ে শোনো, আমি কী বলতে চাই। আমাদের ছবির গল্প আমরাই তৈরি করে নেব। সাসপেন্স থাকবে, ঢিসুম ঢুসুম থাকবে, পাণ্ডব গোয়েন্দার পঞ্চুর মতো একটা কুকুর থাকবে। আর থাকবে এক অনবদ্য প্রাকৃতিক পরিবেশ। পাহাড়ের মাথার ওপর থেকে ঝর ঝর করে ঝরনার ধারা গড়িয়ে পড়বে। ঘন অরণ্যের মধ্যে একটা পাতার ঘরে শুধু তুমি আর আমি থাকব। আমাদের বন্ধু কুকুরটা হবে বডিগার্ড। তুমি বনের ভেতর থেকে হরিণ অথবা ময়ূর অথবা যে কোনও পাখিটাখি শিকার করে আনবে, আর আমি রান্না চড়িয়ে অথবা সেইসবের মাংস আগুনে ঝলসে তোমাকে খেতে দেব। সে যা ছবি হবে না, ভাবতেও পারবে না। তোমার-আমার জুটি এমনটি হবে কোথায়? সেই ছবি দেখে তাক লেগে যাবে সকলের। সবাই আমাদের নিয়ে হই হই করবে।

আর যদি তুমি আর একটু বড় হয়ে আমাকে—। থাক ওসব চিন্তা পরে করব। এখন রাজি কি না বলো।

আগে বলো সেটা সম্ভব হবে কী করে?

হাঃ হাঃ। আমার প্রস্তাবটা মন দিয়ে শুনলে তুমি আমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারবে না। আজকাল বিয়েবাড়ি, পইতেবাড়ি, জন্মদিনে ভিডিয়োতে ছবি তোলা হয় দেখেছ? দেড় দু’হাজার টাকা খরচা করলেই তো কেল্লা ফতে। তা আমরা যদি আমাদের দু’জনের টাকা দিয়ে যৌথভাবে ওইরকম একটা ছবি করি, তা হলে কেমন হয়? এখন আমরা লোকেশানটা দেখে যাই, পরে টাকা-পয়সা জোগাড় করে ভিডিয়ো নিয়ে চলে আসব এখানে। এই বৈতরণী নদীটা কিন্তু থাকবে।

খেয়ালির প্রস্তাবটা মন্দ লাগল না সৌরভের। বলল, আরে! তুমি বেশ বলেছ তো? তোমাকে এতক্ষণ ধরে আমি একটা খামখেয়ালি মেয়ে ভাবছিলাম। কিন্তু এখন তো দেখছি তুমি তা নও। তুমি অনেক গভীরে অনেক কিছু চিন্তা করো। অথচ ছেলেমানুষ তুমি।

তুমিই বুঝি বুড়ো ধাড়ি? তুমিও তো ছেলেমানুষ।

সৌরভ এবার খুব আদর করে ডাকল, খেয়ালি!

বলো।

তুমি ভারী মিষ্টি। আমার দিকে খুব ভাল করে একবার তাকাও তো দেখি। সত্যি বলতে কী, তোমার মুখটা এতক্ষণ আমি ভাল করে দেখিওনি। খেয়ালি ওর মুখের দিকে ডাগর দুটি চোখ মেলে দিয়ে বলল, নাও দেখো। ভাল করে দেখো। দুষ্টু কোথাকার।

সৌরভ ওকে বেশটি করে খুঁটিয়ে দেখে বলল, নাঃ। সত্যিই তোমাকে দেখতে ভাল। কোথাও কোনও খুঁত নেই। তোমার সবচেয়ে বড় গুণ তোমার এই শিল্পচেতনা। তুমি নির্ঘাত বড় হয়ে একজন সত্যিকারের শিল্পী মেয়ে হবে। তোমার এই ভিডিয়ো নাটকের ব্যাপারে আমি কিন্তু এককথায় রাজি।

খেয়ালি আনন্দের উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরল সৌরভকে। বলল, আর দ্বিমত হবে না তো?

না। তা হলে শোনো, আমি এখানে কী জন্য এসেছি। আমার বাবা ব্রিগেডিয়ার ভার্গব। তিনি কেওনঝোড়ের অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে থেকে জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়ে দিতে চান। আমিও চাই কলকাতার বাইরে থেকে জীবনটাকে উপভোগ করতে। দুটো জমি দেখা হয়েছে আমাদের। পছন্দ হলে দুটোই আমরা কিনব। একটা শহরের মাঝখানে। সেখানে বাড়ি করে থাকব আমরা। আর একটা পাহাড়ের কোলে অরণ্যের হৃদয়ের কাছে। সেখানে একটা পাতার ঘর করে উইক এন্ড করব আমরা। তা এখন ভাবছি সেই ঘরই হবে তোমার-আমার এই স্বপ্নের ঘর। সব ঠিকঠাক করে, সুন্দর একটা গল্প ফেঁদে দারুণ একটা ভিডিয়োর ছবি তৈরি করে ফেলব আমরা। যে ছবিতে থাকব শুধু তুমি আর আমি। আর থাকবে, বনের হরিণ, ময়ূর, পাখপাখালি আর প্রকৃতির ভুবন ভোলানো রূপ। ঝরনা, জলপ্রপাত ইত্যাদি।

খেয়ালি লাফিয়ে উঠল, হাউ ফ্যানটাস্টিক। চলো, আর এখানে সময় নষ্ট না করে আমরা কেওনঝোড়েই চলে যাই।

সৌরভ বলল, সে কী! ওই দেখো, নদীর ওপারে কী সুন্দর সব দৃশ্য ! ওটা বৈতরণীর একটা দ্বীপ। ওই দ্বীপে এখন শুটিং চলছে। বরাহনাথের মন্দিরও দেখা যাচ্ছে। আমরা ওখানে যাই চলো। মনে হচ্ছে খুব নির্জন সুন্দর জায়গাটা। আমাদের ভিডিয়ো ক্যামেরায় ওই দ্বীপও আসতে পারে। বিশেষ করে ওইসব প্রাচীন মন্দিরগুলোকে ছবির দৃশ্যে ধরে রাখা একান্তই দরকার। যা তুমি বলবে।

ওরা বৈতরণীর বাঁধের ওপর দিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে খেয়াঘাটের দিকে এগিয়ে চলল। খেয়াঘাটে খেয়াতরী যা আছে, তাতে চেপে নদী পার হতে সত্যিই ভয় হয়। অনেকটা নৌকা বাইচ-এর সেই লম্বাটে ডোঙার মতন নৌকো। অনবরত টলমল করছে। একটু এদিক ওদিক হলেই উলটে যাবে বুঝি। যাই হোক ওরা তাতেই খেয়া পার হয়ে ওপারে গিয়ে পৌঁছল।

ওপারটা কী ভীষণ নির্জন!

ওরা হেঁটে বরাহনাথের মন্দিরের দিকে চলল। তারপর মন্দির দেখে একটু এদিক সেদিকে যখন ঘোরাফেরা করছে, তখনই এক জায়গায় গিয়ে দেখতে পেল একটি ছবির শুটিং-এর জন্য তোড়জোড় চলছে। ছবির নাম কালিয়া। ওড়িয়া ছবি। ওড়িয়াতে কালিয়া বলা হয় প্রভু শ্রীজগন্নাথকে। হয়তো কোনও পৌরাণিক ছবি। কয়েকজন ফুটফুটে মেয়েকে দেবদাসী সাজিয়ে নাচানো হচ্ছে। কী তাদের সাজপোশাক। দেখলে

লোভ হয়।

সৌরভ বলল, কী। তুমিও ওদের মতো নাচবে নাকি?

খেয়ালি বলল, আমি যে ও নাচ জানি না।

নাচ না জানলে বোম্বাই ছবিতে নাচবে কী করে?

খেয়ালি চুপ করে রইল। পরে বলল, এরা কি আমাকে এদের ছবিতে নেবে?