তিন
একা যাওয়া যে কত বড় ঝক্কির ব্যাপার সেটা এবার হাড়েহাড়ে টের পেল সৌরভ। চিরটা কাল বাবা-মায়ের সঙ্গেই ঘুরেছে। অবশ্য চিরটা কাল বললে একটু বাড়িয়ে বলা হবে। কেন না কতই বা বয়স ওর? চোদ্দো থেকে পনেরো। যাওয়ার মধ্যে বার তিনেক পুরী, একবার বেনারস, একবার রাজগির ও বুদ্ধগয়া। হ্যাঁ, আর একবার খুব ছোটবেলায় দেওঘরে গিয়ে নাকি একমাস ছিল। তখন ওর দু’বছর বয়স। কাজেই দেওঘরের স্মৃতি কিছুই ওর মনে নেই।
যাই হোক। রাত এগারোটার মধ্যেই সৌরভ হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছল।
বাবা-মা দু’জনেই সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সৌরভ তাতে রাজি হয়নি। যে ছেলেটি জীবনে প্রথম একা একা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোচ্ছে সে যদি বাবা-মা’র সাহায্য নিয়ে স্টেশনে এসে ট্রেনে উঠল তাতে তো গোড়ায় গলদ রয়েই গেল।
তাই সম্পূর্ণ একা ওর কিট ব্যাগটা নিয়ে ফাঁকা বাসে চেপে হাওড়া স্টেশনে এল।
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সমস্ত দূরপাল্লার গাড়িই এখন নিউ কমপ্লেক্স থেকে ছাড়ে। সেই মতো সে নিউ কমপ্লেক্সেই এসে হাজির হল। ভেবেছিল ট্রেন প্ল্যাটফর্মেই থাকবে। ও শুধু ওয়াটার বটলে জলটা ভরে নিয়েই উঠে পড়বে গাড়িতে। তারপর নিজের বার্থ খুঁজে নিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে আয়াশে একটা ঘুম দিলেই একঘুমে রাত কাবার।
কিন্তু স্টেশনে এসে দেখল ট্রেন তখনও প্ল্যাটফর্মে দেয়নি। না দিক, যখন দেবে তখন উঠবে। এখন জলটা তো ভরে নেওয়া যাক। মা একবাক্স সন্দেশ দিয়েছেন। সেটা খেয়ে জল খেয়েই শুয়ে পড়বে। যদিও বাড়িতে ভালমতোই খেয়ে এসেছে, তবুও ট্রেনে উঠে একটু মিষ্টিমুখ না করলে নয়।
এই ভেবে স্টেশনের কলে জল নিতে গিয়েই মুশকিলে পড়ল। অতগুলো কল, কিন্তু কোথাও এক ফোঁটা জল নেই।
জল আছে। তবে সেটা বোতলের জল। দশ টাকা দাম। কিনবে তো কেন, না-কিনলে তেষ্টায় ছাতি ফেটে মরো।
কী জ্বালা। জল ছাড়া কি খাওয়া যায়? যতই কেন এক রাতের জার্নি হোক, তবু জল যে জীবন।
মা অনেক করে বলেছিলেন হাওড়া স্টেশনের জল ভাল না। কোনও স্বাদ নেই। ঘর থেকে জল নিয়ে যেতে। কিন্তু সৌরভ শোনেনি। বলেছিল, খাব তো কত। তার জন্য বাড়ি থেকে জল বইবার দরকারটা কী?
এখন কী করা যায়?
ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছাড়লে হাতে মাত্র দশ মিনিট সময়।
কয়েকজন ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা আগের স্টেশনে, মানে বড় ঘড়িটা যেখানে আছে সেইখানে গেলেন জল নিতে।
সৌরভও তাঁদের সঙ্গ নিয়ে গেল।
জল নিয়ে যখন ফিরল তখন ট্রেন ছাড়ার একটু সময় বাকি।
আজকাল প্ল্যাটফর্মে এসে ট্রেনে ওঠার আগে চার্টে নাম মিলিয়ে বগি চিনতে হয় না। এখন সেসব ব্যাপারে খুব সুবিধে হয়ে গেছে। সৌরভের টিকিট ছিল, এস ফোর, সাতাশ।
তার মানে আপার বার্থ। একক যাত্রীর পক্ষে আপার বার্থে জার্নির চেয়ে আরামদায়ক আর কিছুতেই নেই। সৌরভ তাই ট্রেনে উঠেই বার্থের ওপর ওর কিট ব্যাগটা রেখে ওয়াটার বটলটা ঝুলিয়ে দিল লোহার আংটায়।
যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ল।
বেশ ভিড় আছে বগিতে। সৌরভের মনেই হল না ও একা যাচ্ছে। কত কত যাত্রী। বাঙালি যাত্রীও অনেক। বেশির ভাগ কটকের যাত্রী। একটি পরিবার ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠেছেন, তাঁরা যাবেন বহরমপুর গঞ্জাম। সেখান থেকে গোপালপুর অন সি।
সৌরভ ওর বার্থে উঠে প্রথমেই সন্দেশের প্যাকেটটা বের করে দু’-একটা সন্দেশ খেয়ে নিল। মা প্রায় দশ-বারোটা সন্দেশ দিয়েছেন। অত কী খাওয়া যায়? তারপর ঢক ঢক করে খানিকটা জল খেয়ে শোবার ব্যবস্থা করল।
ওর ওপাশের বার্থে একটি মেয়ে শুয়েছিল। কী মিষ্টি আর কোমল মুখখানা। কচি এবং লাবণ্যময়। কেমন যেন ঢল ঢল করছে। চোখদুটো এত ভাল যে, মনে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই চোখের দিকে চোখের পাতা না-ফেলে চেয়ে থাকে।
মেয়েটি বলল, এই, তোমার জল থেকে আমাকে একটু জল দেবে?
সৌরভ মেয়েটির হাতে ওয়াটার বটল দিয়ে বলল, তুমি জলের জায়গা আনতে ভুলে গেছ বুঝি?
হ্যাঁ।
সৌরভ বলল, আমার কাছে সন্দেশও আছে। তুমি খাবে?
আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।
সে তো আমিও। সন্দেশ যখন আছে, তখন শুধু জলটা কেন তোমার কম পড়বে না?
খাবে?
কম পড়বে কেন? দেখলে তো আমি কেমন গপাগপ করে খেলাম। তা ছাড়াও আছে। রাত্রে তো আর খাব না। সেই সকালে। সকালে যাজপুর কেওনঝোড়ে নেমে দোকানে গিয়ে ঢুকব।
মেয়েটি সন্দেশ আর জল খেয়ে বলল, তুমি যাজপুর যাচ্ছ? তুমি?
আমিও। তোমার সঙ্গে কেউ নেই?
না। তোমারও তো সঙ্গে কেউ নেই দেখছি।
মেয়েটি হাসল। বলল, ওইজন্যই বোধহয় মুখোমুখি সিট পড়েছে আমাদের। কিন্তু তুমি একা যাচ্ছ কেন?
আসলে আমার একা বেরনোর শখ খুব। তাই বাড়িতে বলেকয়ে একটুখানি সাহসে ভর করে বেরিয়ে পড়লাম।
তা বেশ করেছ। কিন্তু এত জায়গা থাকতে তুমি এই জায়গাটাই বেছে নিলে কেন? পুরী, ভুবনেশ্বর, গোপালপুর এইসব জায়গায় যেতে পারতে। পারতাম। কিন্তু হিলি এরিয়া আমাকে খুব আকর্ষণ করে।
তাই বলো, তার মানে তুমি একজন পর্বত-প্রেমিক?
কিন্তু তুমি একা কেন, তা তো বললে না?
আমি বাড়ি থেকে পালাচ্ছি।
পালাচ্ছ? যাবেটা কোথায়?
জানি না। ভাবছি তোমার সঙ্গে যাজপুরেই নামব। নেমে তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব।
সর্বনাশ। তোমার টিকিট কোথাকার?
আমার টিকিট নেই। ডব্ল-টি।
সৌরভ ভেবে পেল না বিনা টিকিটের একজন যাত্রী থ্রি-টায়ার শিপার কোচে জায়গা পায় কী করে? এখুনি যার বার্থ সে এসে যদি দাবি করে, তা হলে তো সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে দেবে মেয়েটাকে।
সৌরভ বলল, তা হলে তোমার রিজার্ভেশনও নেই।
মেয়েটি বলল, আছে বইকী। আমি প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে স্টেশনে এসেছি। তারপর গাড়ির কোচ অ্যাটেনডেন্টকে বলে এই বার্থটা ম্যানেজ করেছি। এবার উনি এলে ঠিক করব কোথায় যাব না যাব, সেইমতো টিকিট হবে! তা তোমার সঙ্গে দেখাটা যখন হয়ে গেল তখন ভাবছি তোমার সঙ্গেই ভিড়ে যাই। কেন না ছেলে হিসেবে তুমি খুব ভাল। তোমাকে দেখতেও সুন্দর। ব্যবহারও ভদ্র। তাই তোমাকে আমি ছাড়ছি না।
কিন্তু তুমি বাড়ি থেকে পালাচ্ছ কেন?
বাবা-মা দু’জনের ওপরই রাগ করে। আমি একটু মাথামোটা। তাই পড়াশুনায় ঠিকমতো মন বসাতে পারি না। এই নিয়ে দাদা আমাকে যখন তখন মারে। বাবা-মা আমাকে সান্ত্বনা তো দেনই না, উপরন্তু দাদাকেই সমর্থন করেন।
সেই রাগে বাড়ি ছেড়ে চলে এলে?
শুধু তাই নয়, একজন আমাকে সিনেমায় নামিয়ে দেবে বলেছিল। তার জন্য দশ হাজার টাকাও চেয়েছিল। বাবা সেটা দিতে রাজি নন। তাই ঠিক করলাম আর ও বাড়িতেই নয়। বনে-জঙ্গলে যেখানে হোক চলে যাব। তবে বোকার মতো আত্মহত্যা করব না। আত্মহত্যা করে বোকারা। রাম বুদ্বুরা।
তুমি যে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ তোমার বাবা-মা জানেন?
তুমি তো দেখছি আর এক বোকা। না জানলেও এতক্ষণে জেনেছেন। এখন রাত কত? তার ওপর আমি দুপুর থেকে বাড়ি নেই। অবশ্য আমার টেবিলের ওপর এই মর্মে একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছি যে, আমার খোঁজ কোরো না। আমি বরাবরের জন্যই যাচ্ছি। এর পরও কি জানতে বাকি থাকে?
সৌরভ কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, কাজটা কিন্তু তুমি ভাল করোনি।
খারাপও করিনি। জান তো সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। আমার ফেস কাটিং দেখেছ? দেখো ভাল করে, এই মুখ দেখলে ভগবানেরও ভুল হয়ে যাবে। এই তুমিই একটু ভেবে দেখ না, আমি চাইলাম জল, তুমি অমনি জল ছাড়াও সন্দেশ অফার করলে। তা হলেই বোঝো বনে গিয়েও অন্ন জুটবে আমার।
সৌরভ বুঝল মেয়েটি শুধু যে বাকপটিয়সী তা নয়, একটু ছিটগ্রস্তও। তা না হলে সামান্য একটা ব্যাপারে মাথাগরম করে কেউ কখনও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে? বিশেষ করে এই বয়সের মেয়ে! একেবারে টিন এজার যাকে বলে ও তো তাই।
এমন সময় কোচ অ্যাটেনডেন্ট টিকিট চেক করতে এলে, সৌরভ ওর টিকিট দেখাল।
মেয়েটি ওর ছোট্ট মানি ব্যাগ বার করে দুটো একশো টাকার নোট এগিয়ে দিল অ্যাটেনডেন্টের দিকে।
কোথায় যাবে যেন?
প্রথমে কিছু ঠিক করিনি। তবে এখন ভাবছি যাজপুর যাব।
অ্যাটেনডেন্ট মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, টাকাটা রাখো। ওটা তোমার কাজে লাগবে।
মেয়েটি দারুণ খুশি হয়ে টাকাটা যথাস্থানে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর কোচ অ্যাটেনডেন্ট চলে গেলে সৌরভকে বলল, দেখলে তো ম্যাজিক কাকে বলে? আমি তোমাকে বলেছিলাম না সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। ঠিক কি না?
সৌরভ বলল, ঠিক মানে? কাঁটায় কাঁটায় ঠিক। তা তোমার নামটি জানা যেতে পারে কি?
নিশ্চয়ই। আমার নাম খেয়ালি।
বাঃ ভারী সুন্দর নাম তো।
তোমার নাম কী?
আমার নাম সৌরভ।
তোমার নামও ভাল। দু’জনেরই তিন অক্ষর। তা যাক। আর কোনও গল্প নয়। এবার শুয়ে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো। কেন না সকাল হলেই নামতে হবে তো। আর শোনো, আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি, আমাকে তুমি ডেকে নিয়ো কিন্তু। আমি তোমার সঙ্গেই যাব।
সৌরভ বলল, আচ্ছা।
এরপর দু’জনেই চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল।
একটু একটু করে ঘুম নেমে আসছে সৌরভের চোখে। ট্রেনের দোলা লাগলে এমনিতেই ঘুম এসে যায় ওর। তার ওপর রাতও হয়েছে। তাই কিছু সময়ের মধ্যেই গভীর ঘুমে মগ্ন হল সে।
তিরুপতি এক্সপ্রেসকে লোকে বাজে গাড়ি বলে। কিন্তু এই গাড়িই ফাঁকা মাঠে পড়ে এমন গতি নিল যে, মনে হল লাইন থেকে ছিটকে যাবে বুঝি।
সকাল যখন হল ট্রেন তখন বালেশ্বরে।
সৌরভ ঘুম ভেঙে চোখ মেলেই দেখল পাখি ফুড়ত। অর্থাৎ পাশের বার্থে শুয়ে থাকা সেই খেয়ালি নামের মেয়েটি নেই। কোথায় গেল সে? ওর কোনও জিনিসপত্তর ছিল কি না তা ও জানে না। শুধু গায়ে চাপা
দেবার মতো একটা চাদর ছিল। সেটাও তো নেই।