সানঘাগরার আতঙ্ক – ২

দুই

ব্রিগেডিয়ার ভার্গব যখন নিউ কয়লাঘাটা বুকিং অফিস থেকে ফিরে এলেন তখন তাঁর চোখেমুখে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতার ছাপ। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে হঠাৎ করেই যেন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন তাঁর।

বিনতা স্বামীর ওইরকম অবস্থা দেখে বললেন, কী ব্যাপার! শরীর খারাপ নাকি?

সৌরভ ছাদে ছিল। বাবার উপস্থিতি টের পেয়েই ছুটে নেমে এসে বলল, টিকিট পেয়েছ বাবা?

পেয়েছি।

তা হলে কবে যাব আমরা?

আজই রাতের গাড়িতে যাবি তুই। আমি যাব?

হ্যাঁ। তুই একা যাবি।

একা কী করে যাব? তুমি যাবে না?

ভার্গব ঘাড় নেড়ে বললেন, না।

বিনতা বললেন, কারণটা কী? টিকিট ছিল না?

তা নয়।

তা হলে?

ভার্গব সোফায় দেহটা এলিয়ে দিয়ে বললেন, বেলা এখন কত হল? এগারোটা? আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াতে পারো?

এক কাপ কেন? দু’কাপ করে দিচ্ছি। কিন্তু হল কী তোমার?

ভার্গব বুকেমুখে, কপালে একবার হাত বুলিয়ে বললেন, ক্যাপ্টেন ঘোষকে তোমার মনে আছে?

তা আবার মনে নেই? কোথায় যেন থাকেন তিনি?

থাকেন নয়, থাকতেন। ল্যান্সডাউন টেরেসে। আমার এক পরিচিত বন্ধুর মুখেই খবরটা পেলাম ওর। আজ সকালে দেশপ্রিয় পার্কে মর্নিং ওয়াকের সময় হার্ট অ্যাটাক হয় তাঁর।

সে কী !

স্পট ডেড।

বিনতার মুখ দিয়ে আর কথা সরল না।

ভার্গব বললেন, শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মানুষের জীবনের অস্তিম পরিণতি এই। তবু আমরা বাঁচার জন্য কী না করি।

শুধু মানুষের কেন? সকল জীবেরই তো ওই একই পরিণতি।

আমার মনে হচ্ছে ওদের এই বিপদের দিনে এখুনি একবার ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।

এ তো খুবই ভাল কথা। তাই বলে তুমি নিজের টিকিট না-কেটে, শুধু ছেলের টিকিট কাটলে কেন?

কারণ আছে। ধরো এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমারও যদি ওই রকম হয়? তখন ওকে একাএকাই তো সব কিছু করতে হবে। করবে। কিন্তু তা যখন নয়, তখন হঠাৎ এইসব আবোল তাবোল চিন্তাগুলো তুমি কেন করছ?

তা জানি না। মৃত্যুভয় আমি কখনও করিনি তুমি তো জান? কিন্তু ক্যাপ্টেন ঘোষের এই অকালমৃত্যুর খবর শুনে আমি যেন কেমন ঘাবড়ে গেছি। আসলে ও আমি দু’জনেই সমবয়সি। ওরও একটিমাত্র ছেলে। সৌরভের বয়সি। পিতৃহীন হয়ে বেচারি এখন কী করবে বলো দেখি?

কী আবার করবে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে। দাঁড়াবার চেষ্টা করবে। তা ছাড়া ক্যাপ্টেন ঘোষের স্ত্রীও তো শুনেছি কোথাকার কোন স্কুলের যেন হেড মিসট্রেস? তা হবে। কিন্তু তবুও ছেলেটার কথাটা একবার ভেবে দেখো তো। সামনে দীর্ঘজীবন, অথচ এই সময়ে কী অবস্থা।

সৌরভ সব শুনে বলল, তোমার যখন মনের অবস্থা এই, তখন আমার টিকিটও না কাটলে পারতে। বিশেষ করে তোমাদের সঙ্গ ছাড়া একা আমি তো কখনও বাইরে বেরোইনি। তাই বলি কী, আমার টিকিট তুমি ক্যানসেল করিয়ে দাও।

সে কী।

আমি যাব না বাবা! এমনিতেই মাকে বাদ দিয়ে যাবার ইচ্ছে আমার ছিল না। তার ওপরে তুমি না গেলে যেতে আমার একদমই ভাল লাগবে না।

কেন ভাল লাগবে না?

একা একা আমার খুব ভয় করবে।

বিনতা বললেন, তার চেয়ে আমি বলি কী, চলো আমরা তিনজনেই যাই। তোমার মানসিক অবস্থা ভাল নয় যখন, তখন দু’চারদিনের জন্য তোমারই প্রিয় জায়গা থেকে একটু ঘুরে এলে তোমার পক্ষেও ভাল হবে।

আমার এখন কোথাও যাওয়া উচিত হবে না।

সৌরভ বলল, তা হলে আমিও যাচ্ছি না।

যেতে তোমাকে হবেই।

বিনতা বললেন, তোমার যখন জেদ ও তখন যাবেই। কেন না যেতে ওকে হবেই। অতএব আমি বাধা দিয়েও ওকে আটকাতে পারব না। কিন্তু তোমার এই জেদ বজায় রাখতে গিয়ে ছেলেটার বিপদ আপদের কথা একবারও ভেবে দেখলে না তুমি? তা ছাড়া ও নিজে যেখানে যেতে সাহস করছে না, সেখানে তুমি ওকে জোর করে যেতে বল কী করে?

আমি ওকে দিয়ে একটু এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই।

তা হলে ওর কোনও একজন বন্ধুকে অন্তত সঙ্গে দাও।

না। কোনও প্রয়োজন নেই তার। বন্ধুবান্ধবই যদি সঙ্গে থাকবে তা হলে আমার যেতে আপত্তি কী ছিল? আমি চাই ও এখন থেকেই একা একা ঘর ছেড়ে বেরোতে শিখুক। নিজে নিজেই সব কিছু দেখুক, শুনুক। জীবনের চরম অভিজ্ঞতাটা লাভ করুক। তবেই তো।

তা না হয় হল। হাজার হলেও ছেলেমানুষ তো?

এমন কিছু ছেলেমানুষ ও নয়। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। চালাকি নাকি? বলে সৌরভকে কাছে টেনে পাশে বসিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে! পারবি না একা একা যেতে?

সৌরভ মাথা হেঁট করে বলল, খুব পারব। কিন্তু বাবা…।

এর মধ্যে আর কোনও কিন্তু রাখিস না। ধর, ক্যাপ্টেন ঘোষের মতো হঠাৎ করে আজ যদি আমিও মরে যাই তা হলে কি ঘর থেকে বাইরে বেরোবি না? তা কেন?

তাই আমি বেঁচে থেকে দেখে যেতে চাই আমার সৌরভ দুগ্ধপোষ্য শিশু নয়। প্রয়োজনে সে সব পারে। সে লড়তে জানে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে জানে, সাহসে ভর করে বীরদর্পে এগিয়ে যেতে জানে।

বাবার কথায় বুক ফুলে উঠল সৌরভের। তার মনে হল সত্যিই তো, সে তো আর শিশুটি নেই। তার অনেক বন্ধু তো একা একা ছুটি কাটাতে দেশের বাড়িতে যায়। মামার বাড়ি যায়। আর সে কি না ময়ূরভঞ্জে যেতে পারবে না? তাই দারুশ উৎসাহিত হয়ে বলল, এই যদি হয়, তা হলে আমি দেখিয়ে দেব আমি কী পারি না-পারি।

সত্যি বলছিস?

তুমি আমার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারো বাবা।

ভেরি গুড।

কিন্তু বাবা, এইভাবে একা একা আমাকে কেওনঝোড় পাঠানোর মধ্যে তোমার উদ্দেশ্যটা কী বলো তো? শুধুই কি আমার সাহসের পরীক্ষা নেওয়া? না অন্য ব্যাপার?

বিনতা ততক্ষণে তিন কাপ কফি করে ফেলেছেন। তারপর সেটা তিনজনে ভাগ করে মুখোমুখি বসলেন একটা শান্তিনিকেতনি মোড়া নিয়ে।

ভার্গব বললেন, উদ্দেশ্য একটা নিশ্চয়ই আছে। সেটা হল আমি এসব করছি কার জন্য? আমার নিজের জন্য নিশ্চয়ই নয়। আমি চাই সুস্থসুন্দর একটা পরিবেশ। যে পরিবেশে আমি শান্তিতে চোখ বুজতে পারব। মরবার সময় আমার একটাই সান্ত্বনা থাকবে যে, আমার স্ত্রী-পুত্রের গায়ে কেউ আঁচড়টিও লাগাবে না এখানে। ময়ূরভঞ্জ হচ্ছে সেইরকমই একটি আদর্শ জায়গা, কাজেই তুমি সেখানে যাবে। অরবিন্দ যে জায়গা আমাদের জন্য দেখে রেখেছে সেই জায়গাটা ভাল করে দেখবে। সেখানে তোমার থাকতে অসুবিধে হবে কি না, মন বসবে কি না, সব কিছুই ভাল করে দেখবে। তারপর তুমি ফিরে এসে বললেই আমি জমি রেজিস্ট্রি করতে যাব। নচেত নয়।

সৌরভ লাফিয়ে উঠল আনন্দে। বলল, তবে তো আমার একটা বন্ধুকে সঙ্গে নিলে সময়টাও কাটত বেশ।

তাতে কি একা যাওয়ার মজাটা পাবে?

না তা অবশ্য পাব না।

অত বই কিনে দিয়েছি তোমাকে। সেসব কিছু সঙ্গে নাও। পাণ্ডব গোয়েন্দার সব ক’টা খণ্ডই তো তোমার আছে। সোনার গণপতি হিরের চোখ, চতুর গোয়েন্দ৷ চতুরভিযান, আরও অনেক বই তোমার আছে।

তা অবশ্য আছে। আমি তা হলে কীভাবে যাব?

প্রথমেই তোমাকে আমি হাওড়া স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব। রাত এগারোটা কুড়িতে ট্রেন। পৌঁছবে সকাল ছ’টা বাহান্ন মিনিটে। সারাটা রাত আরামে ঘুমিয়ে নিতে পারবে ট্রেনের ভেতর। তারপর সকালটি হলেই নেমে পড়া। মনে রাখবে স্টেশনের নাম যাজপুর কেওনঝোড় রোড। ওখানে ট্রেন থেকে নেমেই কোনও একটা ভাল দোকান দেখে বেশটি করে জলযোগটা সেরে নেবে। কেন না স্টেশন থেকে কেওনঝোড় পর্যন্ত বাসে সময় লাগবে প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টার মতো।

তা হলে তো অনেকদূর।

এইবার তুমি শুধু ওইখানে নেমে অরবিন্দর ঠিকানাটা খুঁজে বার করবে। পারবে না?

খুব পারব।

বিনতা কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, যদি না পারে?

অজস্র হোটেল লজ আছে। সেখানেই কোথাও উঠবে।

এর পরে আর কোনও কথাই নয়। রীতিমতো সাজ সাজ রব পড়ে গেল। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। তাই অল্প এবং হালকা ধরনের শীতবস্ত্রও নিল সঙ্গে।

একটি ব্যাগের মধ্যেই সব কিছু পুরে নিয়ে একটাই লাগেজ করল। আর রাখল একটা ছোট্ট ওয়াটার বটল। এটা না রাখলেই নয়। সেইসঙ্গে লুকিয়ে ধারাল একটা ছুরি। কেন না এখন যা দিনকাল, তাতে শুধু হাতে দূর পাল্লার ট্রেনজার্নি কখনওই নিরাপদ নয়।