বারো
পুলিশ কিন্তু চুপচাপ বসে ছিল না। অরবিন্দবাবুর কথা মতো সব কিছু ডায়েরিতে লিখে নিয়েই বলল, আপনি নিশ্চিন্তে ঘরে যান। আমরা আপনাদের ছেলেমেয়ে উদ্ধার করে পৌঁছে দিয়ে আসব বাড়িতে। তবে কিনা মুশকিল হয়েছে, আমরা গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি একটা দল ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে এখানে একটি ব্যাঙ্কে ডাকাতি করবার। আর সেইজন্যই খুব বেশি ফোর্স আমরা এই কাজে ব্যবহার করতে পারছি না। আগের দিন আমরা সানঘাগরা তোলপাড় করেছি। কিন্তু কোনও হদিসই পাইনি ডাকাত দলের। আজ ভোরেও একটা দল গিয়ে টহল দিয়ে এসেছে। তাই আমাদের মনে হচ্ছে, সানঘাগরায় নয়, ওরা ওকে গোনাসিকার দিকেই নিয়ে গেছে। কিন্তু সে জায়গাটা এত দূরে যে সেখানে ফোর্স পাঠালে কেওনঝোড় উইক হয়ে পড়বে। আর সেই সুযোগে ওরাও এখানে এসে অবাধে ডাকাতি করবার সুযোগ নেবে। সেই কারণেই এই চালটা চেলেছে ওরা। না হলে দিনদুপুরে কেউ প্রকাশ্য রাজপথ থেকে ছেলেটাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়? অরবিন্দবাবু বললেন, যাতে ভাল হয় তাই করুন স্যার। ঠিক আছে, আপনি যান। আমরা দেখছি।
পুলিশ ইনস্পেক্টর এবার কয়েকজন পুলিশকে পাঠিয়ে দিলেন খোঁজখবর নিতে।
সশস্ত্র পুলিশের ছোট্ট একটি বাহিনী এই কাজের দায়িত্ব নিয়ে রওনা হয়ে গেল। প্রথমে সানঘাগরায় এল তারা। কিন্তু না, কাউকেই পেল না এখানে। সানঘাগরার গেট সকাল ন’টার আগে খোলে না। তায় আজকে বে-বার। তাই লোকজনও নেই। এখানে গেট খোলবার যে লোক থাকে, কাছেই তার ঘর। সেও বলল সন্দেহজনক কাউকেই সে দেখেনি। এমনকী গত দু’দিনে এখানে বেড়াতেও আসেনি কেউ। তাই তারা জিপ নিয়ে গোনাসিকাতেই চলে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানেও কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে পুলিশ ফিরে আসছিল এই পথে।
এমন সময় দেখল গেটকিপার রাজু রাজপথে এসে গামছা নেড়ে নেড়ে গাড়ি থামাবার সংকেত দিচ্ছে।
পুলিশের গাড়ি থামতেই রাজু বলল, হুজুর, আপনারা চলে যাবার পরে আমি গেট খুলে রেখে একটা পাগলকে তাড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি একটা মেয়ে জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি তাকে ধরে আমার ঘরে আটকে রেখেছি।
পুলিশের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল সেই ঘরে।
খেয়ালি তখন ঘরের ভেতর থেকে ভীষণ চিৎকার করছে।
ইনস্পেক্টর শিকল খুলতেই বেরিয়ে এল সে। তারপর সামনে পুলিশ দেখেই চুপ করে গেল।
ইনস্পেক্টর বললেন, এ কী! চেঁচাচ্ছ কেন?
এই লোকটার খাকি ড্রেস দেখে আমরা পুলিশের লোক ভেবে ওর সাহায্য চাইতে আসছিলাম। তার জায়গায় লোকটিই এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। তাই আমি একে ডাকাতের লোক মনে করেছি।
ইনস্পেক্টর বললেন, মাই গড। তারপর গেট কিপারকে বললেন, তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি একদমই লোপ পেয়ে গেছে? কোনও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করেই এই নৃসিংহ অবতারের মতন চেহারাটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে ওর ওপর।
লোকটি বোকা বোকা মুখে বলল, কেন হুজুর! আপনি তো বলেইছিলেন কাউকে পেলেই আটকে রাখতে।
তোমার মুণ্ডু। তারপর খেয়ালিকে বললেন, তুমি কে মা! তোমার ব্যাপারটা
কী?
খেয়ালি তখন সকালের পর থেকে সেই ঘটনার কথা সমস্ত খুলে বলল পুলিশকে।
ইনস্পেক্টর তো লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, বলো কী! আরে! ওই দলটাকেই তো খুঁজছি। আমরা এদিকে সানঘাগরা আর গোনাসিকা করছি অথচ ওরা ছিল চোখের সামনেই ওই ভাঙা কেল্লার ভেতর? তা ওদের সেই প্রধান পাণ্ডা জয়রামের বাচ্চাটা কই?
জয়রামের বাচ্চা কেন? জয়রামই তো।
ওই হল। কোথায় সেটা।
বস্তাবন্দি করে রেখে এসেছি ওইদিকে।
চলো তো দেখি?
আগে আমার বন্ধুদের দেখবেন চলুন।
নিশ্চয়ই দেখব মা। কিন্তু সর্বাগ্রে ওই শয়তানটার হাতে হাতকড়া পরাতে চাই।
তারপর রাজুকে বললেন, পাগল তাড়াতে তুমি কোথায় গিয়েছিলে? ওই-ওইদিকে তাড়িয়ে দিয়েছি। পাগলটার অদ্ভুত একটা রোগ এই যে, সে ওই ওপর থেকে দাঁড়িয়ে বড় বড় পাথর নীচে ফেলে।
সর্বনাশ! কোনওদিন তো কোনও ট্যুরিস্টকেই মেরে বসবে।
শুধু তাই নয়। নিজেও এক একসময় লাফিয়ে পড়তে যায়। যেখানে সেখানে নোংরা করে।
খেয়ালি বলল, এইবার বুঝেছি এই পাথরের ঘায়েই মরেছে লোকটা। কী ভাগ্যিস শিল্পাকে লাগেনি।
যাই হোক, পুলিশ গিয়ে বস্তার ভেতর থেকে আহত এবং ক্ষতবিক্ষত সংজ্ঞাহীন জয়রামকে টেনে বের করল। তারপর ওই অবস্থাতেই তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে ফেলে রাখল গাড়ির ভেতর।
ইনস্পেক্টর দু’জন পুলিশকে বললেন, তোমরা বন্দুক নিয়ে রেডি থাকো। না হলে ওর দলের লোকেরা এসে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বলে বাকি দু’জনকে নিয়ে খেয়ালির সঙ্গে নীচে নামলেন।
কিন্তু কোথায় কে? কেউ তো নেই। তবে কী আবার ওরা শত্রুর কবলে পড়ে গেল? নাকি নিজেরাই চলে গেল এখান থেকে?
ইনস্পেক্টর কনস্টেবলদের বললেন, তোমরা খোঁজাখুঁজি করো। আমি ততক্ষণে হেড কোয়ার্টারে জানিয়ে দিই জয়রাম অ্যারেস্ট হয়েছে বলে। খেয়ালির দু’চোখ তখন জলে ভরে এল।
কনস্টেবলরা অনেক চেষ্টা করেও আর নীচে নামার কোনও পথই দেখতে পেল না।
এদিকে হয়েছে কী, সেই লোকগুলো শিল্পা ও সৌরভকে নিয়ে তাদের পথ ধরে আরও নীচে নামল। আসলে কয়েক ধাপ পাথরে পা নিয়ে নেমে একটু লাফিয়ে পড়তে হবে জঙ্গলের দিকে। এবার খুব ঢালু পথ বেয়ে একটু নামতে হবে নীচে। নামার কোনও পথ নেই। কিন্তু উপায় আছে। জঙ্গলের পাহাড়িরা এ পথ জানে, তবে পুলিশ বা অন্যান্য বহিরাগতদের এ পথ যাতায়াতের অসাধ্য।
ওদের নিয়ে নীচে নামতে দুষ্কৃতীরা একটুও বেগ পেল না। তার কারণ সৌরভ বা শিল্পা শান্ত-সুবোধ শিশুটির মতন ওদের বাধ্য হয়ে রইল। কেউ কোনওরকম বাধা দিল না।
সৌরভ ছটফট করছে না বা বাধা দিচ্ছে না দেখে, শিল্পাও নিথর হয়ে রইল। এইরকম থাকার একটাই কারণ এই যে এই অবস্থায় ছটফট করলে একেবারে খাদে গিয়ে পড়তে হবে। ফলে মরতে হবে দু’পক্ষকেই। তা ছাড়া ওদের সঙ্গে গেলে আস্তানাটাও চেনা হয়ে যাবে।
নীচে নামতে নামতে ওরা এমন একটা জায়গায় এসে পড়ল একসময় যেখানে
সানঘাগরার জলধারা একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কী ভীষণ ব্যাপার সেখানে! পাশেই একটি গুহামুখ। সেটাকে দেখে মনে হল গুহাটা প্রকৃতির দান হলেও এটিকে ব্যবহারের প্রয়োজনে একটু ঘিরে ঘুরে কলেবর বৃদ্ধি করা হয়েছে। সামনেই ঘন ঝোপঝাড়। তাই বাইরে থেকে দেখলে কেউ বুঝবেও না গুহার প্রকৃত অবস্থান কী এবং তার মুখটা কোনদিকে।
ওরা ওদের দু’জনকে নামিয়ে রেখে বলল, তোদের মতো ছেলেমেয়ের মায়ের কোল কী করে শূন্য করতে হয় এবার দেখ। এখানেই একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পেট্রল ঢেলে একটা দেশলাই কাঠি ধরিয়ে দেব শুধু। তোরা পুড়ে মরবি। আমরা দেখব।
শিল্পা ডুকরে কেঁদে উঠল এবার। বলল, কেন গো আমরা তোমাদের কোন ক্ষতিটা করেছি?
তোরা আমাদের বিরাট একটা পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছিস। তা ছাড়া তোদের বাঁচিয়ে রাখলেও বিপদ আছে, কেন না তোরা চিনে ফেলেছিস আমাদের।
পাঁচজনের দু’জন রইল ওদের কাছে।
দু’জনেই শক্ত করে ওদের দুটো হাত ধরে রইল।
সৌরভ দেখল পালাবার কোনও পথ নেই এখান থেকে। কিন্তু এইভাবে মৃত্যুকেও তো বরণ করে নেওয়া যায় না।
এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে একদল বাঁদর সে কী ভীষণ দাপাদাপি শুরু করে দিল সেখানে।
লোকদুটো ওদের ছেড়ে যেই না বাঁদরগুলোকে তেড়ে গেল, অমনি তাদের যত রাগ গিয়ে পড়ল ওই লোকগুলোর ওপর।
ততক্ষণে গুহার ভেতর থেকে বাকি তিনজন বেরিয়ে এসেছে হইচই শুনে।
যার হাতে পেট্রলের টিন ছিল, তার হাত থেকে সেই টিন উলটে গিয়ে কী কেলেঙ্কারি। চারদিকে ছড়িয়ে গেল পেট্রল। এদিকে বাঁদরের আঁচড় কামড়ে অবস্থা এমনই শোচনীয় হল তাদের, যে ধূলোয় পড়ে সেই পেট্রল গায়ে মাখামাখি হয়ে একাকার হয়ে গেল।
সৌরভ বলল, এমন সুযোগ আর হবে না শিল্পা। তুমি পালাও। আমি দেখছি কী করা যায়।
পালাবে কী? মেয়েটা তখন সভয়ে জাপটে ধরেছে সৌরভকে।
সৌরভ বলল, এ কী করছ? ছাড়ো ছাড়ো। ভয় পেলে কী করে হবে? আমাকে শুধু একটা কাজই করতে দাও এখন। সেই কাজ সম্পন্ন হলেই সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত হব আমরা। সানঘাগরায় কোনও আতঙ্ক আর থাকবে না।
শিল্পা ছেড়ে দিল সৌরভকে।
সৌরভ ওর একটা হাত ধরে বলল, তোমার যদি খুব ভয় করে তবে আমার সঙ্গে এসো। বলেই পেট্রল বাঁচিয়ে গুহার দিকে এগোল ওরা।
শিল্পা বলল, তোমার কী মাথাখারাপ হয়েছে? এই শত্রুপুরীতে কেউ ঢোকে না? এখন এখানেই ঢুকতে হবে। তারপর দেখোই না কী করি।
সৌরভ শিল্পাকে গুহার মধ্যে রেখে এদিক সেদিক হাতড়াতেই একটা দেশলাই পেয়ে গেল। তারপর সেই কাঠিটা ছড়িয়ে থাকা পেট্রলে ধরিয়ে দিতেই মহা কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপারে যাকে বলে।
বাঁদরগুলো তো লাফিয়ে লুফিয়ে পালালো। শুধু পালাল নয়, একেবারে উধাও হয়ে গেল এই অঞ্চল থেকে। কেন না আগুনে ওদের বড় ভয়। আর সেই পঞ্চতস্কর?
ছড়িয়ে পড়া আগুনের হাত থেকে তারা কেউই রক্ষা পেল না। লেলিহান অগ্নিশিখা তাদের শরীর স্পর্শ করে জ্বালিয়ে মারতে লাগল তাদের, কিন্তু সেই আগুনকে অতিক্রম করে সৌরভ ও শিল্পাও পালাতে পারল না গুহার ভেতর থেকে। কী আগুন! কী আগুন!
শুকনো লতাপাতায় আগুন ধরে ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেল একটা।
ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে গেল চারদিক। সেই ধোঁয়ায় দম যেন বন্ধ হয়ে এল। শিল্পা আবার শক্ত করে চেপে ধরল সৌরভকে। ওরা ক্রমশ গুহার শেষ পর্যন্ত গিয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগল। বাইরের বাতাস ভেতরে না আসায় নিস্তেজ হয়ে পড়ল ওরা। একসময় দু’জনেই লুটিয়ে পড়ল সেখানে।
বাঁদরের দাপাদাপি, লোকগুলোর চিৎকার আর এই লেলিহান অগ্নিশিখাই পথ চিনিয়ে পুলিশবাহিনীকে নামিয়ে আনল সেখানে।
জয়রামের গ্রেফতার হওয়ার খবর পেয়েই ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ সেখানে এসে হাজির।
শিল্পা আর সৌরভকে গুহার ভেতর থেকে বের করে যখন ওপরে ওঠানো হল তখন চোখ মেলেই অবাক হয়ে গেল সৌরভ, এ কী! বাবা, মা! তোমরা? খেয়ালি উল্লসিত হয়ে বলল, আমার মা-বাবাও এসেছেন। কী সাংঘাতিক ছেলে তুমি। ভেতরে ভেতরে তোমার বাবাকে দিয়ে আমাদের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছ, একথা একবারও বলোনি তো আমাকে?
ভার্গব বললেন, ভাগ্যিস একা পাঠিয়েছিলুম, তাই কত বড় একটা অ্যাডভেঞ্চার করতে পারলি বল তো?
বিনতা বললেন, থাক। খুব হয়েছে। আর একটু হলেই মরে যেত ছেলেমেয়েগুলো।
খেয়ালির বাবা-মাও সৌরভকে অনেক আদর করলেন। করবেন নাই বা কেন? মেয়েটার জন্য কী দুর্ভাবনাই না হয়েছিল তাঁদের।
অরবিন্দকাকুও শিল্পাকে টেনে নিলেন বুকে।
ভার্গব বললেন, কাল রাতে তোর ফোন পেয়ে খেয়ালিদের বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা-মায়ের কাছে খবর দিয়ে আজ ভোরেই একটা গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছি আমরা। এসেই শুনি এই কাণ্ড।
শিল্পা বলল, বাবা, পরেশকাকুর স্কুটারটা কিন্তু কেল্লার ওখানে রয়ে গেছে। ইনস্পেক্টর বললেন, ওর জন্য কোনও চিন্তা নেই। ওটা তোমাদের বাড়িতেই পৌঁছে যাবে একসময়। ,
তাবড় তাবড় পুলিশ অফিসাররা তখন ওদের দিকে অভিনন্দনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।