সানঘাগরার আতঙ্ক – ১১

এগারো

খেয়ালি চেয়ে রইল সৌরভের দিকে। সৌরভ খেয়ালির দিকে। এমন প্রকাশ্য দিবালোকে এ কী অঘটন! এও কি সম্ভব?

সৌরভ বলল, শিল্পাকে না নিয়ে বাড়ি ফিরছি না

কিন্তু।

খেয়ালি বলল, তাই কি ফেরা যায়? এর চেয়ে ওরা যদি আমাকে নিয়ে যেত তা হলে দুঃখের কারণ ছিল না কিছু। কিন্তু আমরা যে বেনোজল। একটি শান্তসুন্দর পরিবেশে এসে এ কী বিপর্যয় ঘটালাম এক সুখী পরিবারের মধ্যে। সৌরভ দু’হাতে কপাল চেপে ধরে বলল, ওরা ওকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে?

সানঘাগরার জঙ্গল ছাড়া এখানে আর লুকনোর জায়গা

তবে সেখানেই যাই চলো।

কোথায়?

খেয়ালি বলল, চলো তবে। বলেই স্কুটারে গিয়ে উঠল।

সৌরভ বলল, আমরা চলে গেলে এই শয়তানটার কী হবে?

ওর জন্যই তো এই বিপদ। দাঁড়াও এখন ওর ব্যবস্থাও করছি। গাড়ির ভেতরে দেখো তো, আর কোনও দড়িটড়ি আছে কি না, যদি থাকে তো নিয়ে এসো।

সৌরভ মারুতি ভ্যানের এদিক সেদিক হাতড়ে অনেক দড়ি পেল।

সেই দড়ি নিয়ে এলে খেয়ালি বস্তার মুখটা দড়ি দিয়ে বেঁধে সেটাকে স্কুটারের পেছনদিকে বাঁধল, তারপর স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে খানিকটা নিয়ে এসে বলল, এভাবে নিয়ে গেলে মরে যাবে কিন্তু। সানঘাগরা তো বেশি দূর নয়। ওকে স্কুটারেই তোলো। তারপর তুমি আমার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়াও। দেখি এইভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি কি না।

কিন্তু না, বৃথা চেষ্টা। কিছুতেই ব্যালান্স রাখা গেল না।

খেয়ালি বলল, এক কাজ করি। একবার চেষ্টা করেই দেখি মারুতিটাকে আনতে পারি কি না। গাড়িটা ধাক্কা লেগেছে ঠিক, কিন্তু আর সব তো ঠিক আছে। বলে

একটু পিছিয়ে গিয়ে গাড়িটাতে স্টার্ট দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আনল সেটাকে তারপর ধরাধরি করে বস্তাবন্দি জয়রামকে ভেতরে ঢুকিয়ে জোরে স্টার্ট দিল গাড়িতে।

গাড়ি স্পিড নিতেই ভয় পেয়ে গেল খেয়ালি। বলল, কেলেঙ্কারি হয়েছে। ব্রেক ধরছে না যে।

কী হবে তা হলে?

ঠিক চালিয়ে নিয়ে যাব। তবে সাবধান! সানঘাগরার কাছাকাছি গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দেব কিন্তু।

তা আর করতে হল না। পাহাড়ে ওঠার মুখেই গাড়িটা টার্ন নিতে গিয়ে আপনিই থেমে গেল।

খেয়ালি বলল, শিল্পা বলেছিল এই পাহাড়ের ঘাটগুলো পেরিয়ে ওপরে উঠলেই সানঘাগরা। তা যদি হয় তা হলে এই আধমরাটাকে টানতে টানতে ওখানেই নিয়ে যাই চলো।

ওরা বহু কষ্টে সেই বস্তাটাকে টেনে টেনে নিয়ে চলল সানঘাগরায়।

বস্তার ভেতর থেকে তখন চাপা একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। ঘর্ষণে ঘর্ষণে জয়রাম তখন রাম রাম করছে।

সৌরভ বলল, খুব লাগছে নাকি দাদা? আহা। মরে যাইরে। এখন একটু কষ্ট করো, এরপরে মরণঘুমে এমন ঘুমোবে যে সে চোখ আর মেলবে না।

একসময় সানঘাগরায় পৌঁছে গেল ওরা। জায়গাটা যে সানঘাগরাই সেটা আর বলে দিতে হল না কাউকে। কেন না একটা ফলকে ইংরেজিতে লেখাই আছে জায়গাটার নাম।

ভারী মনোরম! কিন্তু নির্জন! এমনই নির্জন যে ভয় হয়। কী জানি কী হয়!

সৌরভ বলল, এটাকে এখন রাখি কোথায়?

কোথাও রাখারাখির দরকার নেই। টেনে নিয়েই চলো।

তাই চলল ওরা। যতটা যাওয়া যায়।

একসময় এক বিস্তীর্ণ তৃণভূমির মধ্যে এসে পৌঁছল ওরা। পাহাড়ের মাথার ওরা সেখানেই ছোট্ট একটা গুহার জঠরে ঢুকিয়ে রাখল বস্তাটাকে। খেয়ালি বলল, একদম নড়া চড়া করছে না যে। মরে গেল নাকি? মরুক। কিন্তু এই যদি সানঘাগরা হয় তা, হলে সেরকম তো ভয়াবহ কিছু নয়।

ওপরে সে এক অনবদ্য প্রকৃতির রূপ। তৃণভূমির চারপাশে বৃত্তাকারে গাছের সারি। আশপাশে শুধু পাহাড়— আর পাহাড়চূড়া। ছোট ছোট অনেক গুহাও আছে। কিন্তু এইসব গুহায় লুকিয়ে থাকার মতো কোনও জায়গা নেই।

এমন সময় ওরা একটা জলপ্রপাতের শব্দ শুনে সেইদিকে এগোল। একটা পাহাড়িয়া নদী জঙ্গলের ভেতর থেকে এঁকেবেঁকে এসে একটি মনোরম জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে এখানে।

কয়েকজন আদিবাসী মেয়েপুরুষ সেই নদীর জলে কাপড় কাচছে। ওরা ফিরেও তাকাল না ওদের দিকে।

খেয়ালি তাদের জিজ্ঞেস করল, এইটাই সানঘাগরা তো?

তারা খুব গম্ভীর। তবু বলল, হ।

এখানে একটু আগে কাউকে দেখেছ?

ওরা নিজেদের মধ্যে একবার চোখ চাওয়াচাওয়ি করে ইশারায় ওদের নীচের দিকে যেতে বলল। বলেই কেমন যেন ভয় পেয়ে কেটে পড়ল ওরা।

সৌরভ বলল, কীরকম হল?

জানি না। তবে এটুকু বুঝছি সানঘাগরা সত্যিই আতঙ্কময়।

সৌরভ তখন জল যেখান থেকে নীচে পড়ছিল সেইখানে গিয়ে উঁকি মেরেই বলল, খেয়ালি! শিগগির এসো! ওই দেখ।

ওর কথা শুনে খেয়ালিও এসে ঝুঁকে দেখল নীচের দিকে। দেখে বলল, উঃ ভগবান।

ওরা দেখল নীচে একটা পাথরের ওপর অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে শিল্পা। ওর চারপাশে চাপ চাপ রক্ত। ও কি এখান থেকে পড়ে গেছে? না ফেলে দেওয়া হয়েছে ওকে? বেঁচে আছে তো?

কিন্তু শিল্পা এখানে কীভাবে এল? ওরা কীসে করে নিয়ে এল ওকে? হঠাৎই পাহাড়ের খাঁজে এক জায়গায় চার-পাঁচটা মোটর বাইক চোখে পড়ল ওদের।

ওরা আর কোনওদিকে না তাকিয়ে পথ খুঁজতে লাগল কীভাবে ওখানে নামা যায়? একটা পথ সরু হয়ে এক জায়গায় বেঁকে গেছে দেখে ওরা সেইদিকে চলল। কিন্তু খানিক গিয়েই বুঝল পথ এটা নয়। এখানে শুধুই খাদ।

খেয়ালি বলল, পথ নিশ্চয়ই আছে। না হলে ওখানে ও গেল কী করে?

ওপর থেকে ফেলে দেয়নি তো?

অসম্ভব কিছু নয়। না হলে অত রক্ত ওখানে কী করে এল? সবচেয়ে আশ্চর্য! অরবিন্দকাকু থানায় গেলেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত পুলিশের পাত্তা নেই!

হয়তো এসে ঘুরে গেছে। আর সেইজন্যে জনপ্রাণীও নেই এখানে। তাই বোধহয় আদিবাসীরা আমাদের কথা শুনে ভয়ে পালাল।

হবেও বা।

হঠাৎ এক জয়গায় এসে ওরা নীচে নামার পথ পেয়ে গেল।

সৌরভ বলল, এই তো পেয়ে গেছি।

আমরা ভুল করে ওপরের অংশে গিয়ে পড়েছিলাম। এখানে উচিত ছিল ট্যুরিস্টদের জন্য একটু পথনির্দেশ দিয়ে দেওয়া।

ট্যুরিস্ট এখানে আসে বলে মনে হয় না।

কেন আসে না বলো তো? এমন সুন্দর জায়গা!

কী করে আসবে? কোনও গাইডবুকেই তো এর উল্লেখ নেই। অথচ কী সুন্দর একটা বেড়াবার জায়গা।

আমরা যদি ভিডিয়ো নিয়ে এখানে আসি, তা হলে এই সানঘাগরাই হবে আমাদের আসল স্পট। কিন্তু সৌরভ, এ যা জায়গা, এখানে তোমরা বসবাস করতে পারবে বলে তো মনে হয় না। থাকার জন্য সুন্দর প্রকৃতি হলেই হল না, জায়গাটাও নিরাপদ হওয়া চাই।

জায়গার দোষ কী? এখন আমাদের ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটল এ সবই তো বহিরাগতদের ব্যাপার। যাই হোক, পুলিশ আসুক-না- আসুক আমরা এদের ঘাঁটিটা কিন্তু চিনে যাব।

ওরা ধীরে ধীরে যেখানে নেমে এল, ওপরের জল সেখানে ভয়ংকর গর্জনে চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ছে। অজস্র জলকণায় ধোঁয়ার মতো দেখাচ্ছে জায়গাটা। কিন্তু ওদের এখন সেইসব দেখার সময় নেই। ওরা দু’জনেই ছুটে গেল শিল্পার কাছে। তারপর ওকে চিৎ করে শুইয়ে ওর চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগল। কী ঠান্ডা বরফের মতো জল! কিন্তু এত রক্ত কীসের? দেখে মনে হল ওর তো চোটই লাগেনি কোথাও।

অনেক পরে একটু একটু করে চোখ মেলল শিল্পা। চোখ মেলে ওদের দেখেই বলল, এ কী তোমরা! উঃ কী ভয়ানক।

কেন? কী হয়েছে? তুমি এখানে এলে কী করে?

তোমরা যখন জয়রামের সঙ্গে লড়ছ, ঠিক তখনই একটা বড় গাছের আড়াল থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে শক্ত হাতে মুখ চেপে ধরল আমার। তারপর?

এমনভাবে চেপে ধরল যে আমি চেঁচাতেও পারলাম না। লোকটা আমাকে ওই অবস্থায় পিছু হেঁটে কেল্লার পেছন দিকে নিয়ে গেল। সেখানেই মোটর বাইকগুলো রাখা ছিল ওদের। তারই একটা নিয়ে চলে এল এখানে।

তারপরে কী হল? ওরা কি ওপর থেকে ফেলে দিল তোমাকে? কিন্তু সেরকম বলে তো মনে হচ্ছে না।

না ওরা যখন আমাকে এখানে নিয়ে এল, তখন দেখি না ওদের দলের সেই সব পালিয়ে যাওয়া লোকেরা এখানে বসে বসে নেশা করছে।

তাই নাকি?

তারপর ওরা খুব আজে বাজে আলোচনা করতে লাগল আমাকে নিয়ে। এমন সময়…।

এমন সময় হঠাৎ বড় একটা পাথর এসে পড়ল ওদের একজনের ওপর। লোকটা ধড়ফড়িয়ে মরে গেল।

লাশ কই তার?

বাকি লোকগুলো তাকে আরও নীচে জঙ্গলের দিকে নামিয়ে নিয়ে গেছে। সেই ভয়াবহ দৃশ্য আর রক্ত দেখেই আমি জ্ঞান হারালাম।

তা না হয় হল। কিন্তু পাথর ছুড়ে ওদের মারল কে?

জানি না। তবে আর এখানে নয়, এক্ষুনি পালিয়ে চলো এখান থেকে। এমন সময় হঠাৎ একটা ছায়া দেখা গেল। ওপর থেকে নীচে।

সৌরভ একটু পিছিয়ে এসে দেখেই বলল, নির্ঘাত পুলিশের লোক, খাঁকি পোশাক। তারপর খেয়ালিকে বলল, তুমি ছুটে ওপরে উঠে গিয়ে পুলিশকে ডেকে নিয়ে এসো। আমি এর কাছেই আছি।

শিল্পা বলল, আমি যেতে পারব। কাউকেই ডাকতে হবে না আর। এক সঙ্গেই যাই চলো।

তা হোক, পুলিশকে আসতে দাও। ওরা আসুক, দেখুক। তুমি সব কথা বলো। নীচের লোকগুলো ফিরে এলেই যাতে ওদের অ্যারেস্ট করা হয়, সেই ব্যবস্থা করে তবেই আমরা ওপরে যাব।

খেয়ালি দ্রুত উঠে গেল ওপরে।

সৌরভ শিল্পাকে বলল, কী অনবদ্য প্রকৃতি এখানে। অথচ দুঃখের ব্যাপার এই, আমরা এমন জালে জড়ালাম যে কিছুই অনুভব করতে পারলাম না এর। তাতে কী? আবার আসব আমরা।

হঠাৎ খেয়ালির আর্তস্বর ভেসে এল ওপর থেকে, বাঁচাও— ও– 3-1 বাঁচাও— ও—। সৌরভ…।

কী হল। কী হল খেয়ালির?

ততক্ষণে চার পাঁচজন দুর্ধর্ষ শয়তান এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের ওপর। এরা তারাই। কিন্তু খেয়ালি অমন চেঁচাল কেন? কী হল তার? সেও কি এদেরই কারও হাতে পড়েছে? হয়তো বা। ওরা তখন ওদের দু’জনকে পাঁজাকোলা করে পাহাড়ি পথ ধরে ক্রমশ নীচের দিকে নামতে লাগল।