সানঘাগরার আতঙ্ক – ১০

দশ

এদিকে সেই মেকানিক ছেলেটি দূরে দাঁড়িয়ে এদের কাণ্ড-কারখানা দেখছিল সব। শিল্পাকে সে চিনত। চিনত, কেন না সে হচ্ছে এখানকারই স্থানীয় ছেলে। তার ওপর কয়েক বছর আগে ওর মা ওদের বাড়িতে কাজ করত। তাই ব্যাপারটা বুঝে নিয়েই সে চুপি চুপি এগিয়ে এসে শিল্পাকে বলল, কী হয়েছে তোমাদের? কাকে খুঁজে পাচ্ছ না?

শিল্পা ওকে সৌরভের ব্যাপারে সব কথা বলে চেহারার বর্ণনা দিতেই ছেলেটি বলল, জয়দা তো ওই ছেলেটাকে মেরে ধুনে দিয়েছে। তারপর একটা বস্তায় পুরে বস্তার মুখ বেঁধে রেখে দিয়েছিল আমাদের গ্যারেজঘরে।

তোর এমন অবস্থা কী করে হল?

আমিই যে ওকে বাঁধতে গিয়েছিলুম। ও তখন মাথা দিয়ে আমার এই নাকের ওপর এমন একটা গোঁত্তা মারল যে আমার এখন এই হল।

শিল্পা ওর পায়ের চটি খুলে মারতে গেল ছেলেটাকে। বলল, আজকাল বুঝি এইসব কাজ করছিস? বলতে লজ্জা করছে না?

আমি কী করে জানব ও তোমাদের কেউ?

যাদেরই হোক, এইরকম কাজ করবি কেন?

আমি তো এটাকে খারাপ কাজ বলে ভাবতে পারিনি। জয়দা মাঝেমাঝে এদিকে আসে। আজও এসেছিল। ওই ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল ও নাকি কার একটা স্কুটার চুরি করে পালিয়েছে। কিন্তু মালটা কোথায় রেখেছে তা কিছুতেই বলতে চাইছে না। সেইজন্য আমাকে বলল, তোদের গ্যারেজে বেঁধে ফেলে রাখ ব্যাটাকে। যতক্ষণ না সত্যিকথা বলে ততক্ষণ ছাড়া হবে না ওকে। আমি তাই মজা পেয়ে ওই কাজ করেছিলাম।

ছেলেটা এখন কোথায়?

ওকে বেদম পিটিয়ে বস্তাবন্দি করে সাতশো আটে তুলে দিয়েছে।

সাতশো আট? সেটা আবার কী?

একটা লরির নম্বর।

লরিটা কোনদিকে গেছে বলতে পারবি?

এই তো এই রোড ধরে গেছে।

শিল্পা বলল, তা হলে হয় গোনাসিকা অথবা সানঘাগরার অরণ্যেই নিয়ে

গেছে ওকে।

খেয়ালি বলল, জয়রাম কোনদিকে গেল দেখেছিস?

না। ওকে তো দেখিনি।

ঠিক আছে। এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিস না।

শিল্পা বলল, আমাদের উচিত এখুনি বাড়ি গিয়ে বাবাকে সব কথা বলে থানায় যাওয়া।

খেয়ালি বলল, অবশ্যই। তবে আমার ব্যাপারটা কিন্তু সম্পূর্ণ চেপে যেতে হবে এখন।

তোমার কোন ব্যাপারটা?

জয়রামের বন্ধু মেনোগুন্ডার চোখে ছুরি মেরেছি কাল। ওদের স্কুটার নিয়ে পালিয়েছি। এসব জানাজানি হলে পুলিশ কিন্তু আগে আমাকেই অ্যারেস্ট করবে। আর এখনই যদি আমি ধরা পড়ে যাই, তা হলে সৌরভকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে অসুবিধে হয়ে যাবে খুব।

শিল্পা বিস্মিত হয়ে বলল, তুমি খুঁজে বের করবে?

আমি একা তো নয়! তুমিও থাকবে সঙ্গে। আমরা সশস্ত্র সানঘাগরা অথবা গোনাসিকায় চলে যাব। এই দুটো জায়গার একটাতে অন্তত সে থাকবে। আমার মনে হয় সানঘাগরাতেই ওকে নিয়ে গেছে ওরা।

ওরা যখন নিজেদের মধ্যে এইসব আলোচনা করছে তেমন সময় সন্ত্রীক অরবিন্দবাবুই এসে হাজির হলেন সেখানে। বললেন, ব্যাপার কীরে! কোনও সন্ধান পেলি?

শিল্পা বলল, তুমি এখুনি থানায় যাও বাবা। ওর খুব বিপদ। মেনোগুন্ডার সাগরেদরা সম্ভবত ওকে সানঘাগরার দিকেই নিয়ে গেছে।

সে কী! কার মুখের খবর এটা?

যারই মুখের খবর হোক, তুমি আর দেরি কোরো না। সাতশো আট নম্বর প্লেটের লরিতে করে ওকে নিয়ে গেছে ওরা।

বলিস কীরে! আমার যে হাত-পা কাঁপছে। এ কী হল? ওর বাবা-মা এলে তাদের কী কৈফিয়ত দেব আমি?

খেয়ালি বলল, সে চিন্তা পরে করবেন। এখন একদম সময় নষ্ট করবেন না। আপনি যান। আমরা কাকিমাকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছি।

অরবিন্দবাবু একটুও দেরি না করে থানায় গেলেন।

ওরাও ঘরে ফিরল।

অরবিন্দবাবুর স্ত্রী মা তারিণীকে ডাকতে লাগলেন।

খেয়ালি শিল্পাকে বলল, পুলিশের কাজ পুলিশ করুক। আমরা আমাদের কাজ করি। তুমি কি আমাকে সানঘাগরার পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? হ্যাঁ পারব। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম সেই পথটাই সোজা চলে গেছে সানঘাগরার দিকে।

তা হলে আর দেরি না করে এখুনি আমাদের পৌঁছতে হবে। চেষ্টা করতে হবে পুলিশের আগেই যাতে আমরা পৌঁছে যাই।

বাড়িতে কী বলব?

কিছুই বলবে না।

শিল্পা বলল, দাঁড়াও তা হলে, আমি ড্রেসটা একটু চেঞ্জ করে নিই।

আর শোনো, পারলে আত্মরক্ষার জন্য একটা ছুরিটুরি কিছু নিয়ো। একেবারে শুধু হাতে যাওয়াটা ঠিক নয়।

বাবার স্প্রিং-দেওয়া ছুরিটা নিচ্ছি। তোমার কিছু লাগবে?

প্রয়োজন নেই। আমার যা আছে এই যথেষ্ট।

ওরা আর দেরি না করে বাড়িতে একটু আসছি বলে স্কুটার নিয়ে বেরোল।

হাই স্পিডে স্কুটার চালিয়ে ওরা রাজপথ ধরে বনপথের দিকে এগিয়ে চলল। খেয়ালি বলল, তোমার ভয় করছে না তো?

না।

ভয় একদম করবে না। ভয় করলেই বিপদ। ভয় জয় করো, দেখবে বিপদ একসময় দূরে সরে গেছে।

শিল্পা খেয়ালিকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি, কী থেকে কী হয়ে গেল দেখো। সৌরভদার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

কেন যে বেরোতে গেল ঘর থেকে।

আমরা স্কুটার না পেয়ে ফিরে এলে তারপর তো একসঙ্গেই যেতাম।

আসলে কী জানো তো, সৌরভ ছেলেটা খুব সহজ সরল। তবে একটা দিকে খুব ভাল হয়েছে। আমরা স্কুটার নিয়ে বেরনোর পর যদি ওদের খপ্পরে পড়তাম তা হলে কিন্তু কেউ কারও জন্যই কিছু করতে পারতাম না। পুলিশেও খবর যেত না। এখন ভয় শুধু একটাই, সৌরভকে ওরা মেরে না ফেলে। কেন না যা করে এসেছি কাল, তাতে আমাদের ওপর ওরা খার হয়ে গেছে।

ব্যাপারটা কী হয়েছিল আমাকে বলো তো? কাল তোমরা অত কথা বললে, কিন্তু আসলটাই চেপে গিয়েছিলে কেন?

খেয়ালি তখন এক এক করে সমস্ত কথাই বলতে লাগল। এমনকী ওদের ভিডিয়ো শুটিং-এর পরিকল্পনার কথাও বলল।

শিল্পা বলল, ওর জন্য কলকাতা থেকে লোক আনবার দরকার কী? সেটা এখানেও হতে পারে। ভাল লোক আছে এখানে। কটক-ভুবনেশ্বর থেকে পাওয়া যেতে পারে।

সেই একই তো ব্যাপার হল। কলকাতার াক হলে হয় কী, আমাদের মুঠোর মধ্যে ধরা থাকে।

আমিও থাকব তো তোমাদের ছবিতে?

অবশ্যই। তুমি তো থাকবেই। তুমি না থাকলে আমাদের এমন স্পট চিনিয়ে দেবে কে? তবে একটা ব্যাপারে তোমাকে আমি হিংসা করছি খুব। কোন ব্যাপারে?

সৌরভের বাবা-মা যদি বরাবরের জন্য এখানে চলে আসেন তা হলে তুমি ওকে সব সময়ের জন্যই কাছে পাবে। মাঝখান থেকে আমিই দূরে থাকব।

এই যে বললে তোমার জন্যও একটা ঘর করে দিতে, তুমি এখানে থাকবে

না?

ওটা তো কথার কথা। ওর বাবা-মা যদি রাজি না হন? বিশেষ করে আমি একটা বাড়ি পালানো বাজে মেয়ে।

যাঃ। কী যা তা বলছ? তুমি বাজে মেয়ে কেন হবে? তুমি তো অভিমান করে ঘর ছেড়ে চলে এসেছ! তা ঠিক আছে। তুমি যদি সত্যিই থাকতে চাও, তা হলে আমাদের বাড়িতেও থাকতে পারো। এখানে থেকেই পড়াশোনা করবে। দু’ বন্ধুতে একসঙ্গে স্কুলে যাব আমরা।

ঠিক! তোমার বাবা-মা আপত্তি করবেন না?

তোমার মা-বাবা যদি আপত্তি না করেন।

খেয়ালি স্কুটারের গতি এবার একটু একটু করে কমিয়ে আনল। তারপর এক জায়গায় স্কুটার থামিয়ে বলল, পথটা তো এখানে দু’ভাগ হয়ে গেছে দেখছি। আমরা এখন যাব কোন পথে?

কেন, সোজা। ওই যে পাহাড়টা দেখছ, ওই পাহাড়ের মাথার ওপর সানঘাগরা।

এই পথটা তা হলে কোন দিকে গেছে?

কেল্লার পাশ দিয়ে জগন্নাথ মন্দিরে।

খেয়ালি কী যেন ভাবল। তারপর বলল, বহুদিনের পুরনো ভাঙা কেল্লা দেখছি। সৌরভকে নিয়ে গিয়ে এখনকার মতো ওখানেই তো রাখতে পারে ওরা?

সানঘাগরা ছাড়া কোথাও যাবে না।

ঠিক বলছ তুমি ?

বলাইও তাই বলল।

ওই মেকানিক ছেলেটা?

মেকানিক না ছাই। কাজ শিখছে।

তবু আমার মন বলছে এইখানটা একবার দেখে যাওয়াই ভাল। কথায় আছে যেখানে দেখবে ছাই…।

ওরা আবার স্কুটার নিয়ে এগিয়ে চলল সেই কেল্লাটার দিকে। চারদিকে গাছপালা আর ঘন জঙ্গল। পাশেই বড় একটি পাহাড়। সেই পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়েই সানঘাগরার পথ। কেওনঝোড়ের একটি পিকনিক স্পট। কিন্তু আজ কোনও ছুটির দিন নয়। তাই এই পিকনিক করতেও কেউ আসবে না। একসময় কেল্লার কাছে গিয়ে পৌঁছল ওরা।

কী ভীষণ জঙ্গল চারদিকে। আগাছায় ভরা।

ওরা এক জায়গায় ঝোপের আড়ালে স্কুটার রেখে একটা গাছের দুটো ডাল ভেঙে লাঠি করে আগাছা ঠেলতে ঠেলতে কেল্লার ভেতরে ঢুকল। খণ্ডহর।

চারদিকেই কেল্লার ধ্বংসাবশেষ। অতীতের স্থাপত্য। বর্তমানের স্মৃতি। ভাঙা

কেল্লার ফাটল দিয়ে বট-অশ্বত্থের মাথাচাড়া।

হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল ওরা।

খেয়ালি বলল, ওই দেখো।

শিল্পা দু’চোখ মেলে দেখল এক জায়গায় পাতাচাপা দেওয়া বোমা রাখা আছে কতকগুলো।

আর এক জায়গায় দেখল চার-পাঁচটা মেশিনগান।

শিল্পা বলল, এ কোথায় এসে পড়লাম আমরা?

খেয়ালি হঠাৎ হিস্ করে থামতে বলল ওকে। দেখল দূরে এক জায়গায় কয়েকজন ভয়ংকর চেহারার লোক গোল হয়ে বসে কী যেন ফিস ফিস করছে নিজেদের মধ্যে।

খেয়ালি চাপাগলা বলল, এই লোকগুলোকে আমি চিনি। কাল যখন স্কুটার নিয়ে আসছিলাম, তখন দেখি না এরা দুর্দান্ত বেগে স্কুটার চালিয়ে আসছে। কিন্তু স্কুটারগুলো কই?

হয়তো ভেতরেই কোথাও রাখা আছে।

এরা এই জঙ্গলের মধ্যে কেন?

নিশ্চয়ই কোথাও ডাকাতি করতে যাবার পরিকল্পনা করছে এরা।

এই সময়ে পুলিশে একটা খবর দিতে পারলে ঠিক হয়। কিন্তু এ যা জায়গা এখানে ফোন পাব কোথায়?

এখন একটা কাজ করা যাক। এদের এই মেশিনগানগুলো অন্য কোথাও সরিয়ে রাখি এসো। যাতে ওরা প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে না পায়। বলামাত্রই কাজ।

দু’জনে চটপট আগ্নেয়াস্ত্রগুলো হাতে নিয়ে কেল্লার পেছনদিকে একটা গর্তের ভেতরে ফেলতে গিয়েই দেখল সেখানেই এক জায়গায় একটি মারুতি ভ্যান রাখা আছে।

শিল্পা বলল, ওই দেখো। সেই ভ্যানটা না? যেটা আমাদের চাপা দিতে আসছিল। এটা তো জয়রামের।

হ্যাঁ, তাই তো। তার মানে রীতিমতো গোলমেলে ব্যাপার। নির্ঘাত ডাকাতির ষড়যন্ত্র।

আসলে জয়রামের সঙ্গে এই দলটার পুরোপুরি যোগসাজশ আছে। হয়তো জয়রামেরই পোষা গুন্ডা এরা। সম্ভবত কাল যখন আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওদের, তখন হয়তো আমাদের ব্যাপারটা ওরা জানত না।

ওরা আর দেরি না করে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো এত কাছাকাছি না রেখে, জঙ্গলের ভেতরে একটা গাছের ডালে এমনভাবে ঝুলিয়ে রাখল যাতে কারও চোখে না পড়ে।

খেয়ালি ওর ছুরিটা দিয়ে সেই গাছের গুঁড়িতে একটা ক্রুশ চিহ্ন দিল। তারপর বলল, যেভাবেই হোক ভ্যানটাকে অকেজো করতে হবে। এই ছুরির ফলা দিয়েই সব চাকার হাওয়া খুলে দেব এখুনি।

ওরা সেই মতলবে যখন মারুতির কাছে এল, তখনই আর এক বিস্ময়। দেখল ভ্যানের মধ্যে বস্তাবন্দি কী যেন।

খেয়ালি বলল, নির্ঘাত সৌরভ। সে ছাড়া আর কেউ নয়।

ওরা আস্তে করে লক খুলে ভেতরে ঢুকে ছুরি দিয়ে বস্তার মুখ খুলতেই পেয়ে গেল সৌরভকে।

সত্যি! কী মারটাই না মেরেছে ছেলেটাকে। ওর চোখেমুখে কালসিটে পড়ে গেছে।

মুক্তি পেয়েই সৌরভ বলল, আমি কোথায়?

কেল্লা পাহাড়ে।

কেল্লা পাহাড়!

শিল্পা বলল, হ্যাঁ। সানঘাগরার নিম্নাচল। ওই পাহাড়ের মাথায় উঠলে তবেই যাওয়া যাবে সানঘাগরায়।

খেয়ালি বলল, তুমি এখানে কী করে এলে? তুমি যে গুম হয়েছ সে খবর আমরা এসেছি।

কিন্তু আমি এখানে আছি তোমরা জানলে কী করে?

আন্দাজে ভর করেই এসেছি এদিকে। তবে গ্যারেজের ছেলেটা আমাদের সবই বলেছে। ওরা তোমাকে একটা লরিতে তুলেছিল না?

হ্যা। পরে লরি থেকে নামিয়ে এই মারুতিতে। এটা হচ্ছে ওই শয়তান জয়রামের।

খেয়ালি বলল, মনে হচ্ছে শয়তানটা কাছাকাছিই আছে।

শিল্পা বলল, ওই লোকগুলোর দলেই হয়তো আছে। আমরা দূর থেকে দেখেছি। কাছে গেলে হয়তো দেখতে পেতাম।

এখন তা হলে করণীয়?

সর্বাগ্রে এখান থেকে কেটে পড়া।

তার আগে মারুতির চাকাগুলোর হাওয়া তো খুলে দিই। তোমরা কীভাবে এলে?

আমরা স্কুটার নিয়ে এসেছি। সেটা বাইরে একটা ঝোপের আড়ালে রাখা আছে।

সৌরভ বলল, খেয়ালি, তুমি না বলেছিলে তুমি মোটরগাড়িও চালাতে পার? তা যদি হয় তা হলে আমরা এটা নিয়েই তো পালাতে পারি।

শিল্পা বলল, পরেশদার স্কুটারের কী হবে?

যেমন আছে তেমনি থাকবে? আর খারাপ কিছু যদি হয় তখন দেখা যাবে।

খেয়ালি বলল, তোমার যুক্তিটা মন্দ নয়। তবে কি না মোটর চালানোয় আমার দক্ষতা খুব একটা নেই। অ্যাকসিডেন্ট হবার ভয়। অবশ্য এখান থেকে ওটাকে আমি বের করে নিয়ে যেতে পারব।

সৌরভ বলল, তা হলেই হবে। এখন দেখো গাড়ির চাবিটা লাগানো আছে কি না। যদি চাবি দেওয়া থাকে, তা হলে চাকার হাওয়া খুলে দিতে হবে। আর তা যদি না থাকে তা হলেই গাড়ি নিয়ে সটকান।

খেয়ালি এক-পা এক-পা করে এগিয়ে গেল মারুতিটার দিকে। গিয়ে দেখে বলল, এই, আছে আছে। চাবিটা লাগানোই আছে। তারপর বলল, তবে আমার মনে হয় আমাদের স্কুটার নিয়েই পালানোই ভাল। তার কারণ ওটা আমার দারুণ কনট্রোলে।

সৌরভ বলল, আসলে কেন আমি মারুতিটা নিয়ে পালাতে চাইছি জানো? আমার মনে হচ্ছে মারুতিটাকে রাস্তায় বের করে এক জায়গায় রেখে কোনওরকমে যদি এদের মৌচাকে একটা ঢিল মারতে পারি, আর ওই শয়তানটাকে যদি বাগে পাই তা হলে ওকেই এই বস্তায় পুরে রেখে আসব সানঘাগরায়।

খেয়ালি আনন্দের উচ্ছ্বাসে নেচে উঠল, ঠিক বলেছ তুমি। বেস্ট আইডিয়া। আ— পারে রাম — পাম, পাম পাম।

ওরা সেই পরিকল্পনা করে যেই না ঢুকে বসেছে গাড়িতে, অমনি দূর থেকে জয়রামের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ওরা, এই! এখানে এই স্কুটার কোত্থেকে এল রে? কে রাখল এখানে?

কেল্লার ভেতরে যে লোকগুলো ছিল তারাও সতর্ক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে এল দেখতে।

বাইরে এসে স্কুটার দেখেই বলল, সর্বনাশ! কোনও স্পাই লেগে যায়নি তো? অসম্ভব কিছু নয়। ওরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে থানা-পুলিশ করেছে। তা ছাড়া মেয়েটার চেঁচানিতে আর একটু হলেই ধরা পড়তাম পুলিশের হাতে। তুমি যা করলে রাগের মথায় দিনদুপুরে, ওইরকম কেউ করে?

আসলে কী জানিস, মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। মেনোর চোখে ছুরি মেরে মেয়েটা যা করেছে না, বরাবরের জন্য চোখটাই নষ্ট হয়ে গেল ওর। এখন তা হলে কী করব বলো?

যন্তর নিয়ে রেডি হয়ে যা। কেমন যেন বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।

কেল্লার ভেতর থেকে তখন কে যেন একজন চেঁচিয়ে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে জয়দা। সমস্ত যন্তর হাপিস।

বলিস কীরে !

একটাও কিছু নেই।

মারুতির ভেতর থেকে সৌরভ চেঁচিয়ে বলল, হল্ট। যে যেখানে আছ সে সেইখানেই থাকো। একদম নড়বে না।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাজিক। লোকগুলো যে যেদিকে পারল দৌড়ল। দু’–একজন বোধ হয় লুকিয়েও পড়ল গাছের আড়ালে।

চারদিকে অসীম নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল তখন। যেন হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

কয়েকটি নিস্তব্ধ মুহূর্ত। খেয়ালি গাড়ি স্টার্ট দিতেই, জয়রামের মনে পড়ল গাড়ির কথা। আর তখনই মনে হল, পুলিশের লোক হলে তো আত্মপ্রকাশ না করে, এইভাবে গাড়ি নিয়ে পালাবে না। তাই সে নিজমূর্তি ধরল এবার।

নিজেরই গুপ্তস্থান থেকে রিভলভারটা বের করে ছুটে এল গাড়ির দিকে। খেয়ালি ততক্ষণে মারুতিটাকে বের করে এনেছে জঙ্গলের ভেতর থেকে। সেই না দেখেই তো ফেটে পড়ল জয়রাম। মারুতিটা লক্ষ করেই ট্রিগার টিপল ঢিসুম।

গুলিটা ওদের না লেগে গাড়ির বড়িতে লাগল।

খেয়ালি তখন কী ভেবে যেন বেগে গাড়িটা চালিয়ে দিল জয়রামের দিকে।

জয়রামেরও এবার পালানোর পালা।

কিন্তু ততক্ষণে বিপদ যা ঘটবার তা ঘটে গেছে। অনভ্যস্ত হাতে গাড়ি চালাতে

গিয়ে গাড়িটা একটা শাল গাছের গুঁড়িতে গিয়ে জোরে ধাক্কা দিল।

এবার যে অবস্থাটা কী হবে তা ওরা জানে।

জয়রামের হাতে তখন উদ্যত রিভলভার।

সৌরভ বিপদ বুঝেই এক পাশের দরজা খুলে লাফিয়ে নামল গাড়ি থেকে।

নেমেই অব্যর্থ একটা পাথরের টিপ শয়তানের মুখে।

জয়রাম হায় রাম বা রামে রাম বলল না বটে, তবে কিছু একটা বলল। বলেই বসে পড়ল ঘাসের ওপর।

ওরা সবাই তখন ছুটে গিয়ে চেপে ধরল ওকে।

খেয়ালি তো প্রথমেই ওর হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নিল। নিয়েই মুখের ওপর জুতোসুদ্ধ এক লাথি।

মেয়েদের লাথিও ঠিক জায়গা মতো পড়লে সুস্বাদু লাগে না। তাই লাথি খেয়েই গাঁক করে উঠল জয়রাম।

সৌরভ বলল, কেমন লাগল দাদা? এটা হল পাটিসাপটা। এবার আসকে পিঠে বা ইডলি কেমন লাগে দেখো। বলেই বলল, আবছা একটু নলেন গুড় মাখিয়ে দিই। সকালে তুমি অনেক খানা খাইয়েছিলে, এখন তোমাকেও অনেক— অনেক খাওয়াব। এই কথা বলেই খানিকটা পিছিয়ে এসে সৌরভ জোড়া পায়ে লাফিয়ে পড়ল ওর গায়ের ওপর।

জয়রাম হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ল, সহ্য করতে না পেরে।

খেয়ালি তখন ওর চুলের মুঠি ধরে তুলে বসাল।

সৌরভ বলল, তুমি শোলে দেখছ দাদা?

জয়রাম বলল, হিন্দি সিনেমা আমি দেখি না।

তা হলে এই সমস্ত ফিল্মি টেকনিক তুমি কোত্থেকে শিখলে গুরু? যাক। এবার তোমাকে একটু রাধাবল্লভি খাওয়াই। তার সঙ্গে কষা মাংস। বলেই তার মাথাটা ধরে দুম দুম করে ঠুকতে লাগল একটা গাছের গুঁড়িতে।

এতক্ষণ মাতৃভাষা ফুটে বেরোল মুখ দিয়ে, মরি জীব রে।

সকালে আমাকে যখন মেরেছিলে আমিও তখন মরে গিয়েছিলাম। এখন মরে ভূত হয়ে ভূতের নাচ নাচছি। তুমিও ভূত হয়ে নাচবে।

খেয়ালি সৌরভকে বলল, অনেক হয়েছে। এখন দেব ব্যাটাকে একটা গুলিতে শেষ করে?

জয়রাম সঙ্গে সঙ্গে না না করে উঠল।

সৌরভ বলল, না না মারবে কী? ওর বন্ধু চিতাটা বড়ই ক্ষুধার্ত। ওকে ওই বস্তাতে পুরেই নিয়ে চলো সানঘাগরায়। যেভাবে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেইভাবে।

খেয়ালি হাঁক দিল, শিল্পা! বস্তাটা নিয়ে এসো তো, শিগগির। দেরি কোরো না একদম।

কিন্তু কোথায় শিল্পা? তার কোনও সাড়াশব্দই নেই, এমন কি চিহ্নও নেই কোথাও।

সৌরভ চেঁচাল, শিল্পা-~। তুমি কোথায়?

খেয়ালি বলল, তুমি যেখানেই থাকো, চলে এসো শিগগির। জয়রাম তখন পালাতে যাচ্ছে।

সৌরভ চকিতে একটা পা গলিয়ে দিল ওর পায়ে। যেই না দেওয়া অমনি মুখ থুবড়ে পড়ল সে।

পড়া মানে মোক্ষম পড়া যাকে বলে। একেবারে নাকমুখ থেঁতো হয়ে গেল। একটা দাঁতও মজবুত হয়ে গেল বোধহয়।

যাই হোক! মারুতির ভেতর থেকে বস্তাটা বের করে ওরা বহু কষ্টে জয়রামকে ঢুকিয়ে দিল তার ভেতর। তারপর বস্তার মুখ বেঁধে বলল, আমাদের উচিত ছিল তোমার হাত পাও বেঁধে দেওয়া। কিন্তু অত দড়ি তো নেই। তবে হাতে লাঠি আছে। ছটফট করলেই কিন্তু তুলো ধুনব।

সৌরভের হাতে লাঠি।

খেয়ালির হাতে রিভলভার। যদিও চালায়নি কখনও, তবুও ধরে রইল এমনভাবে যা দেখলে মনে হবে দিল বুঝি।

ওরা তন্ন তন্ন করে শিল্পাকে খুঁজতে লাগল চারদিকে। কিন্তু কোথায় সে? কতবার নাম ধরে ডাকল। কিন্তু এই নির্জনে ওদের ডাক প্রতিধ্বনিই হয়ে ফিরল। কোনও প্রত্যুত্তর এল না।

সৌরভ হঠাৎ এক পাশে শিল্পার এক পাটি চটি পড়ে থাকতে দেখল। দেখেই বলল, কিডন্যাপড!

তার মানে?

নিশ্চয়ই কেউ লুকিয়েছিল ধারেকাছে। আমাদের অসতর্কতার মাঝেই নিয়ে পালিয়েছে ওকে।

এই দারুণ বিপদে কী যে করবে ওরা কিছুই ভেবে পেল না। যাদের আশ্রয়ে এসে ওঠা ওদের জন্য তাদেরই যদি ক্ষতি হয় তো, এর চেয়ে লজ্জার আর কী আছে? কিন্তু কখন কীভাবে নিয়ে গেল ওকে? ওদের চোখের সামনে দিয়ে?

এই নির্জন প্রান্তরে ওরা তাই অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল।