সাধে কি বলে গাধা
বললে গাধা মনের দুঃখে অনেকখানি ভেবে——
“বয়েস গেল খাটতে খাটতে, বৃদ্ধ হলাম এবে
কেউ করে না তোয়াজ তবু, সংসারের কী রীতি!
ইচ্ছে করে এক্ষুনি দিই কাজেকর্মে ইতি।
কোথাকার ঐ নোংরা কুকুর, আদর যে তার কত—
যখন তখন ঘুমোচ্ছে সে লাটসাহেবের মতো!
ল্যাজ নেড়ে যেই ঘেউ ঘেউ ঘেউ, লাফিয়ে দাঁড়ায় কোলে,
মনিব আমার বোকচন্দর, আহ্লাদে যান গলে।
আমিও যদি সেয়না হতুম, আরামে চোখ মুদে
রোজ মনিবের মন ভোলাতুম অমনি নেচে কুঁদে!
ঠ্যাং নাচাতুম, ল্যাজ দোলাতুম, গান শোনাতুম সাধা—
এ বুদ্ধিটা হয় নি আমার—সাধে কি বলে গাধা!”
বুদ্ধি এঁটে বসল গাধা আহ্লাদে ল্যাজ নেড়ে।
নাচল কত, গাইল কত, প্রাণের মায়া ছেড়ে।
তার পরেতে শেষটা ক্রমে সফতি এল প্রাণে
চলল গাধা খোদ মনিবের ড্রইংরুমের পানে।
মনিবসাহেব ঝিমুচ্ছিলেন চেয়ারখানি জুড়ে,
গাধার গলার শব্দে হঠাৎ তন্দ্রা গেল উড়ে।
চমকে উঠে গাধার নাচন যেমনি দেখেন চেয়ে,
হাসির চোটে সাহেব বুঝি মরেন বিষম খেয়ে!
ভাবল গাধা—এই তো মনিব জল হয়েছেন হেসে
এইবারে যাই আদর নিতে কোলের কাছে ঘেঁষে।
এই-না ভেবে এক্কেবারে আহ্লাদেতে ক্ষেপে
চড়ল সে তার হাঁটুর ওপর দুই-পা তুলে চেপে।
সাহেব ডাকেন জাহি ‘ত্রাহি’ গাধাও ডাকে ‘ঘ্যাঁকো’
( অর্থাৎ কিনা ‘কোলে চড়েছি, এখন আমায় দ্যাখো।’)
ডাক শুনে সব দৌড়ে এল ব্যস্ত হয়ে ছুটে,
দৌড়ে এল চাকর-বাকর মিস্ত্রি মজুর মুটে।
দৌড়ে এল পাড়ার লোকে, দৌড়ে এল মালি—
কারুর হাতে ডাণ্ডা লাঠি, কারু-বা হাত খালি।
ব্যাপার দেখে অবাক সবাই, চক্ষু ছানাবড়া—
সাহেব বললে, “উচিত মতন শাসনটি চাই কড়া।”
‘হাঁ হাঁ’ বলে ভীষণরকম উঠল সবাই চটে,
দে দমাদম্ মারের চোটে গাধার চমক ছোটে।
ছুটল গাধা প্রাণের ভয়ে গানের তালিম ছেড়ে,
ছুটল পিছে একশো লোকে হুড় মুড়িয়ে তেড়ে
তিন-পা যেতে দশ ঘা পড়ে, রক্ত ওঠে মুখে—
কষ্টে শেষে রক্ষা পেল কাঁটার ঝোপে ঢুকে।
কাঁটার ঘায়ে চামড়া গেল, সার হল তার কাঁদা,
ব্যাপার শুনে বললে সবাই, “সাধে কি বলে গাধা।”
সন্দেশ—ফাল্গুন ১৩২৭