এক
বাবাকে বারান্দায় আসতে দেখে নুযহাত বলল, ‘বাবা, সুপ্রভাত।’
‘সুপ্রভাত, মা,’ মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন রফিক সাদি।
‘কখন উঠেছিস তুই?’
‘অনেক আগে, ভোরে।’
‘ভোরে ওঠা তো তোর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, ভাল।’
‘তুমিও আগে অনেক ভোরে উঠতে। আমাকে কতবার বলেছ, সকালের প্রথম আলো শরীরে মাখলে দূর হয় সব অমঙ্গল।’
‘ঘুম ভেঙে যায় আগেই। কিন্তু বিছানা থেকে আর উঠতে ইচ্ছা করে না।’
‘বাবা, আম্মু মারা যাওয়ার পর অনেক বদলে গেছ তুমি। স্ত্রী মারা গেলে এত কষ্ট পায় পুরুষমানুষ, তোমাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। ‘
‘তোর মাকে হারিয়ে আমার মধ্যে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনও কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়,’ দূরে তাকিয়ে বললেন রফিক সাদি। —কিছু কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না।’
‘কষ্ট কি আমি কম পেয়েছি, বাবা? কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে স্বাভাবিক হতে হয়। প্রায়ই আড়াল থেকে দেখি, মায়ের ছবি বের করে তুমি কাঁদছ।’ নরম সুরে বলল নুযহাত, ‘তুমি অফিসে ঠিকমত যাও না। আগে টেনিস খেলতে যেতে, তা-ও ছেড়েছ। আগের মত তোমাকে বই পড়তেও দেখি না। সারাদিন মুখ গম্ভীর করে বসে থাকো।’
‘কিছু ভাল লাগে না রে,’ অপরাধীর মত বললেন রফিক সাদি। আমাকে আরও একটু সময় দে, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কচু ঠিক হবে,’ বলল নুযহাত, ‘গত এক বছরে যখন ঠিক হয়নি, তখন হবেই না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, কাল থেকেই নিয়মিত অফিসে যাব।’
‘হুঁ, মনে থাকে যেন।’
‘তুই তো দিন-দিন আমার মায়ের মত হয়ে যাচ্ছিস। কোথায় তোকে সান্ত্বনা দেব, উল্টো তুই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস।’
‘বাবা, তোমার কালো মুখ দেখলে আমার কষ্ট হয়।’
‘আচ্ছা, মা। আর মুখ কালো করে রাখব না। শুধু হাসব।’
‘গুড বয়।’ বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল নুযহাত। ‘বাবা, তোমাকে কিছু বলতে চাই।’
‘অনুমতি নিচ্ছিস কেন? সরাসরি বলে ফেল।’
‘আমার বয়স গত ফেব্রুয়ারিতে ছাব্বিশ হয়েছে,’ নুযহাতের মাথা নিচু ‘হ্যাঁ। তা তো আমি জানিই।
‘সব বাবার উচিত সঠিক সময়ে সঠিক পাত্রের হাতে মেয়েকে পাত্রস্থ করা।’ বাবার দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে ওর।
রফিক সাদি কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর হো-হো করে হেসে উঠলেন। মেয়ের কান ধরে বললেন, ‘এমন কথা শিখেছিস কোথা থেকে?
‘বাবা, হেসো না। আমার লজ্জা লাগছে।’
‘আমি তো বেশ কিছুদিন ধরেই তোর বিয়ে নিয়ে ভাবছি। তোর কথায় আরও একটু জোর পেলাম। তোর কোনও পছন্দ আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ, আছে।’
‘কী করে ছেলে? নাম কী?’
‘আমাদের সাথেই মাস্টার্সে পড়ছে। নাম জয়।’
‘ওহ্। চাকরি করছে না?’
‘বাবা, ওর আসলে চাকরি না করলেও চলবে। ওদের প্রচুর জায়গা-জমি। নানা ধরনের ব্যবসাও আছে।’
‘তবু ছেলে চাকরি না করলে, কেমন যেন দেখায় না ব্যাপারটা?’
‘চাকরি একসময় নিশ্চয় করবে। আপাতত ওর বাসা থেকে বিয়ে নিয়ে খুব তাগাদা দিচ্ছে।‘
‘ও, আচ্ছা, ঠিক আছে। ছেলেটাকে নিয়ে আয় একদিন।’
‘কালই আনি, বাবা?’
‘হ্যাঁ। দুপুরে আমার অফিসে আসতে বলিস।’
‘অফিসে কেন?’ নুযহাতের জিজ্ঞাসা।
‘ওর সাথে একটু সিরিয়াস বিষয়ে কথা বলতে চাই।’
‘ঠিক আছে, বাবা। ওকে অফিসেই যেতে বলব।’ চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেলল নুযহাত। ‘বাবা, চা খাবে?’
‘হ্যাঁ, দে।’
নুযহাত চা আনতে গেল। চোখে-মুখে খেলা করছে আনন্দ।
রফিক সাদির একটু বিষণ্ণ লাগছে। আসলে এত তাড়াতাড়ি তিনি মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবছিলেন না। মেয়েটার বিয়ে হলে বড্ড একা হয়ে যাবেন। কিন্তু সবারই একটা নিজস্ব জীবন আছে। নুযহাতেরও অবশ্যই অধিকার আছে নিজের মত করে জীবনটাকে সাজিয়ে নেয়ার।
আবারও চোখে পানি এল তাঁর। দ্রুত চোখের পানি মুছলেন।
মেয়েকে চোখের পানি দেখাতে চান না রফিক সাদি।
দুই
ছেলেটির বসার ভঙ্গিটা বেশ অদ্ভুত। একদম সটানভাবে চেয়ারে বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন সবে মাত্র আর্মির ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছে। গায়ের রং শুধু কালো বললে ভুল হবে, পাতিলের তলাও তার চেয়ে উজ্জ্বল। চোখে কোনও প্রশ্ন বা উত্তেজনার ছাপ নেই। তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। পেশিবহুল হাতদুটো রেখেছে টেবিলের উপর। নিশ্চয়ই নিয়মিত ব্যায়াম করে। এমন শরীর বানানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। রফিক সাদির দৃষ্টি জয়ের শরীরে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
হাসিমুখে বলল জয়, ‘আপনি আমাকে আজ দেখা করতে বলেছিলেন।’
‘তুমি জয়?’
‘হ্যাঁ।’ কোনও সামাজিক সম্ভাষণের মধ্যে যায়নি জয়। তার কথাবার্তা একদম সরাসরি।
রফিক সাদির কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। ভেবেছিলেন জয় ছেলেটা নার্ভাস থাকবে, উল্টো তাঁর নিজেরই নার্ভাস লাগছে। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বললেন, ‘তোমার বাবা কী করেন?’
জয়ের চোখ কিছুটা সরু হয়ে এল। ‘বাবার নানা ধরনের ব্যবসা আছে।’
‘ও। তোমাদের বাসা কোথায়?’
‘ময়মনসিংহের কাছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এলেমদারি নামে একটা ছোট বন আছে।’
‘এলেমদারি বনের নাম শুনেছি।’
‘এলেমদারি বনের মধ্য দিয়ে আধা পাকা রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে ১৫-২০ মিনিট হাঁটলেই হাতের ডান পাশে আমাদের বাড়ি দেখতে পাবেন।’
‘বনের মধ্যে বাড়ি?’
‘বন এখন আর আগের মত ঘন নেই,’ আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল জয়। ‘আমার দাদা ইংরেজদের কাছ থেকে নিলামে এই বনের জায়গাটা কিনে নেন, তারপর সেখানে বাড়ি তৈরি করেন। গত সত্তর বছর ধরে আমরা ওখানে আছি।’
‘কিন্তু একদম একা-একা বনের মধ্যে থাকো, কোনও সমস্যা হয় না?’
‘একা কোথায়? আমাদের ওখানে আরও অনেকগুলো বাড়ি উঠেছে। বাবা বেশ খানিক জায়গা ইতিমধ্যে বিক্রিও করে দিয়েছেন। তবে সমস্যা একটা আছে।’
‘কী সমস্যা?’
‘বনবিভাগ এলেমদারি বনের বেশিরভাগ জায়গা নিজেদের বলে দাবি করছে। এজন্য আদালতে মামলা চলছে। তবে আশা করি আমরাই জিতব।’
জয়ের আত্মবিশ্বাসটা চোখ এড়াল না রফিক সাদির। ‘তো একদিন তোমার বাবা-মাকে আমাদের বাসায় আসতে বলো।’
‘আমার মা-বাবা তেমন একটা বাইরে বেরুতে চান না। তার চেয়ে আপনি একদিন আসুন আমাদের বাসায়। জায়গাটা আপনার ভাল লাগবে।’
জয়ের বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল। রফিক সাদির মনে হলো, আসলেই সেখানে যাওয়া দরকার।
‘আমি তা হলে আজ উঠি।’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। তোমার বাবার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে যাও।’
‘আমাদের ওখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কে সমস্যা আছে। তাই সবসময় মোবাইলে পাওয়া যায় না। এই নিন বাবার নাম্বার।’
জয় পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দিল।
তবে কি আগেভাগেই মোবাইল নাম্বার লিখে এনেছে?
ভাল বুদ্ধি তো ছেলেটার!
জয় চলে যাওয়ার পর রফিক সাদি কাগজটার দিকে তাকালেন। জয় যে মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে গেছে তাতে দুটো ডিজিট কম।
কয়েক মুহূর্ত পর রফিক সাদির মুখে ফুটে উঠল চিন্তার ছাপ।
তিন
‘বাবা, তুমি এলেমদারি কবে যাবে?’
‘কবে যাব এখনও ঠিক করিনি। আগে জয়ের বাবা-মা’র সাথে কথা বলি।’
‘ইয়ে…মানে, বাবা, বিয়ের কথা একটু দ্রুত এগুলে ভাল হত।’
রফিক সাদি কিছুটা বিরক্ত হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। ‘ঠিক আছে, মা। দ্রুতই করব। জয়কে বল, তার মা-বাবাকে দিয়ে আমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে। ছেলেপক্ষ বিয়ের প্রস্তাব না পাঠালে, কথাবার্তা এগোবে কীভাবে?’
কঠিন গলায় নুযহাত বলল, ‘বাবা, ওঁরা কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন না। তোমাকেই ওঁদের বাসায় যেতে হবে।’
‘আমি প্রস্তাব নিয়ে যাব!’
‘হ্যাঁ। সেকালের ধারণা নিয়ে বসে থাকলে তো মুশকিল, বাবা। ছেলেপক্ষকেই সবসময় প্রস্তাব পাঠাতে হবে, এমন কোনও লিখিত নিয়ম আছে?’
‘তুই এত রেগে-রেগে কথা বলছিস কেন?’
‘আমি মোটেই রেগে কথা বলছি না,’ চেঁচিয়ে বলল নুযহাত। ‘তোমার স্বার্থপরতায় অবাক হচ্ছি শুধু!’
‘স্বার্থপরতা?’ বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন রফিক সাদি।
‘হ্যাঁ। তুমি মনে করো, আমার বিয়ে হলে তুমি একা হয়ে যাবে। তাই এ ব্যাপারে তোমার কোনও আগ্রহ নেই।’
নুযহাতের কথায় খুব কষ্ট পেলেন রফিক সাদি। বললেন, ‘মা রে, তুই হয়তো ঠিকই বলেছিস, তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি একা হয়ে যাব। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি খুব দ্রুতই জয়ের সাথে তোর বিয়ে দেব।’
নুযহাত বাবার দিকে না তাকিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল। রফিক সাদি লক্ষ করলেন, তার হাতে বেশ কয়েকটা তাবিজ সদৃশ জিনিস বাঁধা। তিনি সেগুলো তেমন গ্রাহ্য করলেন না। নিশ্চয়ই নতুন ফ্যাশন। কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ এত খেপে গেল কেন? সে কি কোনও সমস্যায় পড়েছে? হঠাৎ করেই নিজের স্ত্রীর কথা মনে হলো রফিক সাদির।
.
রাত কত হয়েছে জানেন না রফিক সাদি। ইজিচেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কেন জানি হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেছে। মনে হলো ঘরের ভিতর কোনও ঝামেলা হয়েছে। ঝামেলাটা কী তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। মনের ভিতর কেমন যেন এক ধরনের অস্বস্তি। তিনি ধীর পায়ে নুযহাতের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। রুমে বাতি জ্বলছে। নিচু গলায় নুযহাত কারও সাথে মোবাইলে কথা বলছে। লুকিয়ে মেয়ের কথা শোনা এক ধরনের অপরাধ, তবু তিনি কৌতূহল দমাতে পারলেন না।
নুযহাত বলছে, ‘আমি বাবাকে বলেছি। বাবা দুই-একদিনের মধ্যেই তোমাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাবেন।
ওপাশ থেকে কিছু বলা হলো।
নুযহাত করুণ গলায় বলল, ‘বুঝতে চেষ্টা করো, আমাদের বিয়ে হওয়াটা জরুরি। না, না, আমার বাবা কখনোই অমন মানুষ নন।’
আবার ওপাশ থেকে কিছু বলা হলো।
নুযহাত উত্তেজিত গলায় বলল, ‘কী? বাবা তোমার সাথে খারাপ আচরণ করেছেন? এ কথা আগে বলোনি কেন? ঠিক আছে, আমি বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করব না…’
কথোপকথন চলতে লাগল।
রফিক সাদির মনে হলো তিনি ভুল শুনেছেন। তিনি তো জয়ের সাথে কোনও খারাপ ব্যবহার করেননি। তা হলে এসব কথার মানে কী? একটু পরে তিনি নুযহাতের কান্নার শব্দ শুনলেন। নিচু স্বরে কাঁদছে মেয়েটা। রফিক সাদির মনের ভিতর ওলট-পালট হতে থাকল। ইচ্ছা হচ্ছে দরজা নক করে মেয়ের সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু মেয়েটা হয়তো এসব ভালভাবে নেবে না। তাই তিনি নিজ রুমে ফিরে গেলেন। কিন্তু বাকি রাত তাঁর ঘুম হলো না।
চার
সকালে রফিক সাদি বাসার সামনে ছোট বাগানে পায়চারি করছেন। ড্রাইভার মহসিন এসে পিছন থেকে সালাম দিল। ‘বড় ভাই, আসসালামুলাইকুম।’
পঁচিশ বছর ধরে মহসিন এই বাসায় আছে। রফিক সাদি নীচতলার দু’রুম মহসিনের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। মহসিন তার স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেখানে থাকে। বাড়ির ড্রাইভার হলেও রফিক সাদির সাথে তার এক ধরনের বন্ধুত্ব আছে। রফিক সাদিকে সে বড় ভাই বলে ডাকে।
‘অলাইকুম আসসালাম,’ বললেন রফিক সাদি।
‘কিছু নিয়ে ভাবছেন?’
অন্য কেউ হলে রফিক সাদি এড়িয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেন। কিন্তু মহসিনকে তিনি ছোট ভাইয়ের মতই মনে করেন।
‘কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছি। তোমাকে সময় করে বলব।’
‘বুঝতে পারছি মামণিকে নিয়ে চিন্তা করছেন।’
‘মেয়ে বড় হলে বাবার চিন্তা তো বাড়েই, আর মা-মরা হলে তো বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।’
‘ভাই, আজ কি অফিসে যাবেন?’
‘মনে হয় না। অফিসের কাজে মন দিতে পারি না। ম্যানেজারই এখন সব দেখাশোনা করছে। তবে আজ বাইরে বের হব।’
‘কোথায় যাবেন?’
‘কিছুক্ষণ পরে বলছি।’
মহসিন লক্ষ করল, নুযহাত আসছে। এজন্যই হয়তো রফিক সাদি চুপ করে গেলেন। তিনি চোখের ইশারায় মহসিনকে চলে যেতে বললেন।
এক রাতেই নুযহাতের চেহারায় কেমন যেন একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে চোখগুলো, এলোমেলো হয়ে আছে মাথার চুল, কয়েকটা ব্রণও উঠেছে মুখে। মনে হচ্ছে রাতে একটুও ঘুম হয়নি।
রফিক সাদি মেয়েকে দেখে ভিতরে-ভিতরে চমকে উঠলেও স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘মা, ঘুম ভাঙল?’
নুযহাত বাবার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মনে হলো বাবার কথা শুনতে পাচ্ছে না।
রফিক সাদি নিজেই আবারও বললেন, ‘আজই জয়দের বাসায় যাব ভাবছি। কিন্তু জয়ের বাবার মোবাইল নাম্বারটা আমার কাছে নেই। তুই জয়ের নাম্বারটা আমাকে দিস।’
‘জয়ের নাম্বার আমার কাছে নেই।’
‘কী? নাম্বার নেই!’ নিজের বিস্ময়টুকু লুকাতে পারলেন না তিনি।
‘হ্যাঁ। জয় মোবাইল ব্যবহার করে না।’
‘কাল রাতে না তুই জয়ের সাথে মোবাইলে কথা বলছিলি?’ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘তুমি কী করে জানলে?’ ভুরু কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করল নুযহাত।
‘পানি খেতে ডাইনিং রুমে গিয়েছিলাম, তখনই মনে হলো তুই কারও সাথে কথা বলছিস।’
‘আমার মোবাইল কাল রাতে ড্রইংরুমে চার্জে দেয়া ছিল, আমি কাল রাতে কারও সাথে মোবাইলে কথা বলিনি,’ ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল নুযহাত।
‘ও, আচ্ছা। তা হলে হয়তো ভুল শুনেছি।’
‘তুমি আজই জয়দের বাসায় যাও। ওর সাথে আমার কথা হয়েছে, ওর বাবা- মা আজই তোমাকে যেতে বলেছেন। ‘
নুযহাতের কথা কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে রফিক সাদির। একটু আগেই বলল, জয়ের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ হয় না, আবার বলছে, জয়ের সাথে কথা হয়েছে।
‘ঠিক আছে, যাব, মা।’
‘ঠিকানা জানো?’
‘হ্যাঁ, জয় বলেছিল, আমি খুঁজে নেব। চিন্তা করিস না।’
‘বাবা, এমনভাবে কথাবার্তা ঠিক করবে, যেন এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। কোনও অনুষ্ঠানের দরকার নেই।’
‘তুই আমার একমাত্র মেয়ে, তোর বিয়েতে কোনও অনুষ্ঠান হবে না? আর এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ে হতে হবে কেন?’
‘আমি এত কিছুর ব্যাখ্যা তোমাকে দিতে পারব না।’
‘আচ্ছা, আমি আজই যাব। এক সপ্তাহ না, তার আগেই তোর বিয়ে দেব।’ রাগটা সামলানোর চেষ্টা করেন রফিক সাদি।
‘এলেমদারি বনে ঢুকলেই বেশ কিছু বাড়ি-ঘর দেখতে পাবে,’ বাবার ভ্রূক্ষেপে পাত্তা না দিয়ে বলল নুযহাত। ‘জঙ্গলের কিছু জায়গা সাফ করে গোটা দশেক পরিবার সেখানে বসবাস করছে। তাদের যে-কারও কাছে জিজ্ঞেস করলেই ঝমঝম কুঠি দেখিয়ে দেবে।’
‘ঝমঝম কুঠি?’
‘ওটাই জয়দের বাড়ি।’ কথা শেষ করেই ঘুরে হাঁটতে শুরু করল নুযহাত। রফিক সাদি লক্ষ করলেন পা টলছে মেয়েটার। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না।