উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

সাত । কালোদেড়ের নতুন বউ

সাত । কালোদেড়ের নতুন বউ

এক জাহাজের অধ্যক্ষকে বলে ‘কাপ্তেন’ এবং একাধিক জাহাজের অধ্যক্ষ ‘কমোডোর’ নামে পরিচিত। কালোদেড়ে গ্রহণ করলে উচ্চতর ‘কমোডোর’ উপাধি।

সে বললে, ‘আহা, আজ আমার মা বেঁচে থাকলে পুত্রের গৌরবে হতেন গৌরবিনি!’

কিন্তু মা পরলোকে গেলেও ইহলোকে বসে এতটা গৌরব চুপচাপ ধাতস্থ করাও যায় না। অতএব সে নির্দেশ দিলে—’উৎসব কর!’

কালোদেড়ের বোম্বেটে-শাস্ত্রে উৎসবের অর্থ হচ্ছে নারকীয় কাণ্ড। সাগরের দিকে দিকে তার নৌবহরের গোলন্দাজরা সমস্ত কামান থেকে ক্রমাগত অগ্নিবৃষ্টি করে দেখাতে লাগল বিরাট ও ভয়ংকর আগ্নেয় দৃশ্য!

দৈবগতিকে ও দুর্ভাগ্যক্রমে যারা তথাকথিত উৎসবের সেই অগ্ন্যুৎপাতের মধ্যে এসে পড়ল, তারা যে কেউ ধনেপ্রাণে রক্ষা পেলে না, সেকথা বলাই বাহুল্য। একে একে জলে ডুব মারলে চার-চারখানা লুণ্ঠিত জাহাজ।

তারপর নামে উৎসব শেষ হল বটে, কিন্তু জলপথে ছুটোছুটি করে জাহাজের পর জাহাজের উপরে হানা দিয়ে লুঠতরাজ, রক্তপাত ও নরহত্যা প্রভৃতি পৈশাচিক কাণ্ড চলল অবিশ্রান্ত।

কালোদেড়ে ধনী যাত্রীদের কিন্তু প্রাণে মারত না, বন্দি করত। বন্দরে পৌঁছে আত্মীয়দের কাছে খবর পাঠিয়ে প্রচুর টাকা মুক্তিমূল্য আদায় না করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হত না। বলা বাহুল্য, ইতিমধ্যে ধনী বন্দিদের জড়োয়া গহনা ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস লুণ্ঠিত হয়ে উঠত গিয়ে কালোদেড়ের প্রশস্ত ভাণ্ডারে। এইভাবেও সে প্রভূত ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিল।

ওই অঞ্চলে সমুদ্রের চারিদিকে আছে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ। সেইসব নামহীন দ্বীপে কোনও মানুষ বাস করে না, তাদের কোথায় কী আছে তাও কেউ জানে না। প্রবাদ, এমনই কোনও অজানা দ্বীপে কালোদেড়ে এডওয়ার্ড টিচ তার বিপুল ঐশ্বর্য লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সেই গুপ্তধনের ঠিকানা কেউ আদায় করতে পারেনি।

কালোদেড়ে বলত, ‘আমি আর শয়তান ছাড়া আমার গুপ্তধনের ঠিকানা আর কারুর জানা নেই।’

তার বসনভূষণও এখন জাহির করে প্রচুর জাঁকজমক। তার হাতের প্রত্যেক আঙুলে শোভা পায় হিরা-পান্না বসানো আংটি। তার গলায় দোলে অনেকগুলো সোনার হারের লহর। তার বুকের বন্ধনীতে ঝোলে এখন নতুন যে তিনজোড়া পিস্তল, তাদের নলচেগুলো রুপো দিয়ে গড়া এবং তাদের কুঁদোগুলো মূল্যবান প্রস্তর দিয়ে অলংকৃত।

কালোদেড়ের এক প্রধান সহকারী ও প্রিয়পাত্র ছিল ইস্রায়েল হ্যান্ডস। একদিন তাকে ডেকে সে চুপিচুপি বললে, ‘আমাদের দল কি অতিরিক্ত ভারী হয়ে পড়েনি?’

‘নিশ্চয়! এত লোককে লাভের অংশ দিতে দিতে আমাদের নিজেদের আয়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।’

‘ঠিক ধরেছ হ্যান্ডস। তাহলে কৌশলে অংশীদারের দল হালকা করে ফেলা যাক!’

বিভিন্ন ওজর দেখিয়ে দুইবারে দুইদল লোককে বিভিন্ন বিজন দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে বাছা বাছা লোক নিয়ে কালোদেড়ে দূর সমুদ্রে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল—একবারও ভেবে দেখলে না যে, এতদিন বিশ্বস্ত ভাবে যারা তার হুকুম মেনে এসেছে, জনহীন অজানা দ্বীপে পরিত্যক্ত হয়ে তাদের দুরবস্থা উঠবে কতখানি চরমে! পরে সে কেবল এইটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে হালকা দল নিয়ে কাজ করলে পকেট বেশি ভারী হয় বটে, কিন্তু আত্মরক্ষার দিক দিয়ে সৃষ্টি হয় গুরুতর সমস্যা!

বৎসরকালব্যাপী লুঠতরাজ ও নরমেধযজ্ঞের পর আটলান্টিক মহাসাগর ও তার তীরবর্তী দেশগুলো যখন হয়ে উঠেছে প্রায় অরাজক ও হত্যা-হাহাকারে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত এবং সবাই যখন দুঃখে-শোকে-ক্রোধে একান্ত মরিয়া হয়ে কালোদেড়ের বিরুদ্ধে একবাক্যে করেছে বিদ্রোহ ঘোষণা, তখন সে একদিন অম্লানবদনে বললে, ‘হ্যান্ডস, চলো নর্থ ক্যারোলিনার দিকে। দিন-রাত খালি জল আর জল দেখতে আমার আর ভালো লাগছে না!’

‘জল দেখা ছাড়া আর উপায় কী? স্থলে নামলেই তো আমাদের ধরা পড়ে ফাঁসিকাঠের দোলনায় দুলতে হবে!’

‘কুছ পরোয়া নেই। আমরা ফাঁসির দোলনায় দুলব না,—রাজার কাছে মার্জনা ভিক্ষা করব।’

হ্যান্ডস সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘বলেন কী, কর্তা? মার্জনা ভিক্ষা? কে আমাদের মার্জনা করবে?’

‘গভর্নর চার্লস ইডেন আমাদের হাসিমুখে মার্জনা করবেন।’

‘বলেন কী, হাসিমুখে?’

‘হ্যাঁ। গভর্নর ইডেন বড় ভালো লোক হে। যুক্তি মানেন। আমার যুক্তি কী জানো ভায়া? উৎকোচ! ঘুষখোরকে বশ করা মোটেই কঠিন নয়।

নর্থ ক্যারোলিনা হচ্ছে আমেরিকার আটলান্টিক সাগরতীরের একটি প্রদেশ। সেই প্রদেশের বাথ নগরে বাস করেন ইংল্যান্ডের রাজপ্রতিনিধি চার্লস ইডেন। কালোদেড়ের জাহাজ গিয়ে নোঙর ফেললে সেইখানেই।

মানুষ চিনতে ভুল করেনি কালোদেড়ে। গভর্নর ইডেন তার যুক্তি অকাট্য বলেই মেনে নিলেন। উচিতমতো উৎকোচ হজম করে তিনি কালোদেড়ের সমস্ত অপরাধ কেবল রাজার নামে ক্ষমাই করলেন না, উপরন্তু তার সঙ্গে জমে উঠল তাঁর দস্তুরমতো দোস্তি—যাকে বলে দহরম-মহরম আর কী! সবাই অবাক! হতভম্ব!

বাথ শহরের একটি মেয়েকে দেখে কালোদেড়ের ভারি পছন্দ হল। তৎক্ষণাৎ সে করলে বিবাহের প্রস্তাব। কন্যাও নারাজ নয়। তখন সদাশয় গভর্নর বললেন, ‘আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই শুভকার্য সম্পন্ন করব।’

এটি কালোদেড়ের ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ বিবাহ তা ঠিক করে বলা যায় না। বিবাহে নিতবরের আসন গ্রহণ করলে গভর্নরের সেক্রেটারি টোরিয়াস নাইট। খুব ঘটা করে শুভকার্য সম্পন্ন হল বটে, তবে শহরের বনিয়াদি বংশের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ আমন্ত্রিত হয়েও উৎসবে যোগদান করলেন না।

কিন্তু কালোদেড়ে তাঁদের উপরেও নিলে একহাত! খুব জমকালো সাজপোশাক পরে সে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে একে একে বিখ্যাত সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় আর দারোয়ান ও খানসামাদের ডেকে বলে, ‘তোমাদের মনিবকে গিয়ে খবর দাও, স্বয়ং শ্রীমতী টিচ দ্বারদেশে অপেক্ষা করছেন।’

দারোয়ান ও খানসামাদের ইতস্তত করতে দেখলেই কালোদেড়ে তার রত্নখচিত ও রুপোয় বাঁধানো পিস্তলগুলো গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ছুড়তে শুরু করে দেয়, দিকে দিকে বোঁ-বোঁ করে ছুটতে থাকে গরমাগরম বুলেট এবং দারোয়ান ও খানসামারা হয় ভয়ে থরহরি কম্পমান। তারপরেই দরজা খুলতে ও গৃহস্বামীর আতিথ্যলাভ করতে বিলম্ব হয় না। কালোদেড়ে বারবার এইভাবে প্রমাণিত করলে সেই পুরাতন সত্যকথাটাই—জোর যার, মুল্লুক তার!

এখানে এসেও কিন্তু কালোদেড়ে নদীপথে বোম্বেটেগিরি ছাড়ল না—বহু জাহাজ থেকে মালপত্তর ও ধনরত্ন লুণ্ঠিত হতে লাগল এবং বলা বাহুল্য যে, গোপনে তার লাভের অংশ থেকে বঞ্চিত হলেন না স্বয়ং গভর্নরও!

জাহাজের মালিকদের কাছ থেকে অভিযোগ এলে গভর্নর ইডেন মুখে যথেষ্ট সহানুভূতি প্রকাশ করলেও কাজে কিছুই করেন না। জাহাজের মালিকরা শেষটা এখানে হতাশ হয়ে পার্শ্ববর্তী প্রদেশ ভার্জিনিয়ার গভর্নর স্পটসউডের কাছে গিয়ে নিজেদের জরুরি নালিশ জানালেন।

ফল পাওয়া গেল হাতে হাতে। গভর্নর স্পটসউড তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করে দিলেন যে কালোদেড়েকে গ্রেপ্তার বা বধ করতে পারবে, তাকেই হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ডের নৌবহরের দক্ষ যোদ্ধা লেফটেনান্ট রবার্ট মেনার্ডের উপরে হুকুম জারি হল, তিনি যেন অবিলম্বে কালোদেড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন।

গভর্নর ইডেনের সেক্রেটারি টোরিয়াসও কালোদেড়ের কাছ থেকে অল্পবিস্তর ঘুষ খেয়ে তার ভক্ত হয়ে পড়েছিল। ইংরেজ নৌসেনাদের এই যুদ্ধ-প্রস্তুতির কথা শুনেই সে প্রমাদ গুনে বোম্বেটের কাছে তাড়াতাড়ি খবর পাঠিয়ে দিলে।