উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

সাত । অধঃপতনের পূর্বাভাস

সাত । অধঃপতনের পূর্বাভাস

নেপোলিয়নের সূর্য এখন মধ্য গগনে। ইউরোপে শত্রুর অভাব নেই, কিন্তু কেউ আর তাঁর সুমুখে দাঁড়াতে ভরসা করে না। অস্টারলিটজের ফলাফল দেখে সকলে স্তম্ভিত।

নেপোলিয়ন তাঁর দাদা জোসেফকে বসিয়ে দিলেন নেপলসের সিংহাসনে। আর এক ভাই লুইকে পরালেন হল্যান্ডের রাজমুকুট।

ফ্রান্সের সীমান্তে তখন একমাত্র যথার্থ স্বাধীন রাজ্য ছিল প্রুশিয়া। তার নিয়মিত সৈন্য-সংখ্যা দেড় লক্ষ। গত বৎসরে সে সম্মিলিত শক্তিদের সঙ্গে যোগদান করেনি বটে, কিন্তু এখন তার মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল।

প্রুশিয়ার আশপাশের ক্ষুদ্রতর জার্মান রাজ্যগুলি প্রুশিয়ার সম্রাটকে নিজেদের মধ্যে প্রধান বলে মেনে চলত। কিন্তু নেপোলিয়ন তাদের এক নতুন মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ করলেন—যার ফলে এবার থেকে তাঁকেই তারা অধিরাজ বলে স্বীকার করবে।

প্রুশিয়ার রাজা তৃতীয় ফ্রেডারিক উইলিয়ম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন, তার উপরে রুশিয়ার জার আলেকজান্ডার তাঁকে আরও উত্তেজিত করে বললেন, ‘আপনি যুদ্ধ ঘোষণা করুন, আমিও আপনাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করব।’

প্রুশিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করলে। প্রুশিয়া তখনও নেপোলিয়নকে চেনেনি। তার সৈন্যরা সগর্বে ফ্রান্সের দিকে অগ্রসর হল।

তারা কিছু জানতে পারবার আগেই নেপোলিয়ন সসৈন্যে বিদ্যুদবেগে এগিয়ে তাদের পিছনে গিয়ে পড়লেন—ফলে দেশ থেকে প্রুশিয়ানদের নতুন সৈন্য ও রসদ আসবার পথ বন্ধ হয়ে গেল। তাদের একদিকে ফরাসি দেশ, আর একদিকে ফরাসি সৈন্য!

প্রুশিয়ানদের তখন প্রধান লক্ষ্য হল, স্বদেশে ফেরবার পথে সাফ করা। তারপর একদিনেই জেনা ও অয়েরস্টাডট নামক দুই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রুশিয়ার দুই বাহিনীর সঙ্গে নেপোলিয়নের দুই ফৌজের শক্তি পরীক্ষা হল (১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে)।

পরীক্ষার ফল? চমকপ্রদ! সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়ে প্রুশিয়ানরা পলায়ন করলে। এবং তার তেরোদিন পরে বিজয়ী নেপোলিয়ন প্রবেশ করলেন প্রুশিয়ার রাজধানী বার্লিন শহরে। সমস্ত প্রুশিয়া রাজ্য ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতন।

বার্লিন শহরে বসে নেপোলিয়ন দিকে দিকে আদেশবাণী পাঠালেন, ‘আজ থেকে ইউরোপের আর কোনও দেশ ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্য বা অন্য কোন-কিছুর সম্পর্ক রাখতে পারবে না। যে-কোনও দেশে ইংরেজ নামলেই বন্দি হবে। যে-কোনও বন্দরে ইংরেজ জাহাজ এলেই বাজেয়াপ্ত হবে।’

এইবার রুশিয়া এল নেপোলিয়নকে আক্রমণ করতে। ইলাউ প্রান্তরে সম্মিলিত রুশ ও প্রুশিয়ান সৈন্যদের সঙ্গে ফরাসিদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে রুশ আর প্রুশিয়ানদের আঠারো হাজার ও ফরাসিদের পনেরো হাজার লোকক্ষয় হয়। সারাদিন মরিয়ার মতন লড়ে দুই পক্ষই শেষটা হাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে ক্ষান্তি দেয় এবং দুই পক্ষই বলে—’জয়লাভ করেছি আমরা’ (১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে)!

তারপরেই ফ্রেডল্যান্ড ক্ষেত্রে দুই পক্ষের আবার দেখা হল। সকাল দশটা থেকে বৈকাল চার-পাঁচটা পর্যন্ত সামনে লড়াই চলল। অবশেষে নেপোলিয়ন নিজে সমস্ত সৈন্য নিয়ে শত্রুদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, রুশ ও প্রুশিয়ানরা সে আক্রমণ সহ্য করতে পারলে না। যুদ্ধক্ষেত্রে পূর্ণ বারো হাজার মৃতদেহ ফেলে বাকি সৈন্য নিয়ে রুশ জেনারেল বেনিগসেন বেগে পলায়ন করলেন।

রুশিয়ার জার ও প্রুশিয়ার রাজা তখন সন্ধি করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখলেন না, এই সন্ধির নাম টিলসিটের সন্ধি (১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে)। এই বছরেই নেপোলিয়ন তাঁর ছোট ভাই জেরোম বোনাপার্টকে প্রুশিয়ার অন্যতম প্রদেশ ওয়েস্টফালিয়ার সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন।

বিজয়পতাকা উড়িয়ে নেপোলিয়ন ফিরে এলেন আবার স্বদেশে। ইউরোপে তিনি হলেন সকল রাজার মাথার মণি—মহারাজাধিরাজ!

তারপর নেপোলিয়নের প্রধান কর্তব্য হল, ইউরোপের সমুদ্র তীরবর্তী সকল দেশ থেকে ইংল্যান্ডের প্রভুত্ব লুপ্ত করা। তাঁর শক্তি তখন অসীম, তাঁর মুখের একটি মাত্র কথায় ইউরোপের সর্বত্র রাজ্যের নাম বদলে যায়, রাজার মুকুট খসে পড়ে। তিনি ভয় দেখিয়ে সুইডেন ও পর্তুগালকে বাধ্য করলেন এবং গোপনে স্পেনের সম্মতি নিয়ে করলেন পর্তুগালের অঙ্গচ্ছেদ। তারপর ফরাসি সৈন্যরা একে একে স্পেনের দরকারি জায়গাগুলি দখল করে সর্বশেষে তার রাজধানী মাদ্রিদও অধিকার করলে। অন্যায় ও চতুর কৌশলের দ্বারা স্পেনের বুর্বন-বংশীয় রাজাদের তাড়িয়ে সিংহাসনে বসানো হল জোসেফ বোনাপার্টকে (১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে)। এবং জোসেফের পরিত্যক্ত নেপলসের সিংহাসন লাভ করলেন তাঁর ভগ্নীপতি মুরাট। ওদিকে রোমের পোপের অধিকৃত প্রদেশের উপরেও ভাগ বসানো হল। পোপ ক্রুদ্ধ হয়ে নেপোলিয়নকে ধর্মসমাজচ্যুত করলেন (১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে)।

সমস্ত ইউরোপকে স্ববশে আনবার চেষ্টা করার মধ্যে নেপোলিয়নের মহত্ব প্রকাশ পায়নি। তাঁর পক্ষে খুব একটা বড় যুক্তি ছিল নিশ্চয়ই এবং সে যুক্তি হচ্ছে, ইংল্যান্ডের গর্ব খর্ব করা। আটঘাট বেঁধে বাণিজ্যজীবী ইংল্যান্ডকে জব্দ করতে পারলে নেপোলিয়নের আর কোনও ভাবনা থাকবে না। আজকের হিটলারও এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন।

কিন্তু স্পেনের স্বাধীনতাপ্রিয় জনসাধারণ ফরাসিদের প্রভুত্ব মাথা পেতে গ্রহণ করলে না। তারা বিদ্রোহী হল এবং সুযোগ বুঝে ইংল্যান্ডও তাদের সাহায্যের জন্যে সৈন্য পাঠিয়ে দিলে। তার ফলে, ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে সুদীর্ঘ পাঁচ বৎসর পর্যন্ত নেপোলিয়নকে স্পেন দেশে প্রায় আড়াই লক্ষ সৈন্য মোতায়েন রাখতে হল। এইখানেই ইংরেজ সেনাপতি ডিউক অফ ওয়েলিংটন প্রথম নাম কেনেন। ফরাসি সেনাপতিরা ছোট ছোট যুদ্ধে তাঁর কাছে হেরেও যান। ব্যাপার দেখে শেষটা নেপোলিয়নও স্পেনে গিয়ে হাজির হন। অল্পদিনের ভিতরেই তিনি স্পেনের উত্তর থেকে দক্ষিণ দিক পর্যন্ত সমস্ত জায়গায় আবার ফরাসিদের বিজয়পতাকা উড়িয়ে স্বদেশে ফিরে গেলেন, অন্যান্য সেনাপতিদের হাতে কর্তব্যভার অর্পণ করে। কিন্তু নেপোলিয়নের অবর্তমানে ফরাসিরা আবার কাহিল হয়ে পড়ে। ক্রমাগত যুদ্ধ চলতে থাকে—কিন্তু কোনওটাই খুব বড় যুদ্ধ নয়। কখনও জেতে ফরাসিরা, কখনও ইংরেজরা।

নেপোলিয়ন স্পেনের যুদ্ধ ও বিদ্রোহ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে পারেননি, কারণ তার চেয়েও ঢের বড় বড় হাঙ্গামা নিয়ে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল।

টিলসিটের যুদ্ধের পর কিছুকাল কাটল বেশ ভালোয় ভালোয়। কিন্তু ধীরে ধীরে আকাশে আবার মেঘ হতে লাগল পুঞ্জীভূত। অস্ট্রিয়া আবার শান্তিভঙ্গের চেষ্টা আরম্ভ করলে। কিন্তু জাতে এক হলেও প্রুশিয়া আপাতত অস্ট্রিয়ার দলে ভিড়তে রাজি হল না, তাঁর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।

নেপোলিয়ন স্পেন নিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন দেখে অস্ট্রিয়ার সাহস বাড়ল এবং সে যুদ্ধ না করে ছাড়বে না দেখে নেপোলিয়ন তাড়াতাড়ি স্পেন থেকে চলে এলেন; কারণ আর্ক ডিউক চার্লস প্রায় দুইলক্ষ সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন।

এবারে নেপোলিয়নের সঙ্গে ফরাসি সৈন্য ছিল না বললেই চলে। তাঁকে যুদ্ধযাত্রা করতে হল মিত্র জার্মান রাজাদের সেনাদল নিয়ে। এবারকার অভিযানে তিনি প্রমাণিত করলেন, যুদ্ধজয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে, সেনাপতির নিজস্ব প্রতিভা!

এক হপ্তার মধ্যে কয়েকটি ছোট ছোট যুদ্ধের পরই খবর পাওয়া গেল যে, নেপোলিয়ন শত্রুদের কাছ থেকে আদায় করেছেন একশোটা কামান ও চল্লিশটা পতাকা ও বন্দি করেছেন পঞ্চাশ হাজার সৈন্য! ফ্রান্সের যুদ্ধ জিতছে জার্মানরা! এই সময়ে নেপোলিয়ন জীবনে দ্বিতীয় ও শেষবার শত্রুর গুলিতে সামান্য ভাবে আহত হন।

তারপর এসলিং ক্ষেত্রে নেপোলিয়ন বহুকাল পরে প্রথমবার পরাজিত হলেন। অস্ট্রিয়ানরা জিতেছিল সংখ্যাধিক্যের জন্যে। এই যুদ্ধে তাঁর মহাবীর ও বিশ্বস্ত সেনাপতি লেনস সাংঘাতিকরূপে আহত হয়ে মারা পড়লেন। তাঁর মৃত্যুভয় ছিল না, কিন্তু নেপোলিয়নের সঙ্গে থেকে আর সে গৌরব অর্জন করতে পারবেন না তাই নিয়েই বারংবার হাহাকার করতে লাগলেন।

অন্যান্য সেনাপতিরা নেপোলিয়নকে পলায়ন করবার পরামর্শ দিলেন।

নেপোলিয়ন দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘না! এখন থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাই হবে আমার রাজধানী—আমার আশ্রয়স্থল। আমি তাকে ছাড়বও না, নিজেও পিছু হটব না!’

দেখতে দেখতে সাম্রাজ্যের চারিদিক থেকে দলে দলে ফরাসি সৈন্য ছুটে এল নেপোলিয়নকে সাহায্য করতে। প্রায় দেড়লক্ষ সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হয়ে তিনি বিখ্যাত ওয়াগ্রাম যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ট্রিয়ানদের এমনভাবে পরাজিত করলেন যে, শত্রুরা আর সেখানে দাঁড়াল না (১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে)।

নেপোলিয়ন আবার ভিয়েনায়! সন্ধি হয়ে গেল।

নেপোলিয়ন ফ্রান্সে ফিরে এলেন। তারপরের প্রধান ঘটনা হচ্ছে জোসেফাইনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ-বন্ধনচ্ছেদ।

সবাই বলতে লাগল এবং তিনি নিজেও বুঝলেন যে, উত্তরাধিকারী না থাকলে তাঁর মৃত্যুর পরে ফ্রান্সের সিংহাসন নিয়ে অনেক বিভ্রাট ঘটবার সম্ভাবনা। রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে অস্ট্রিয়ার সম্রাট-দুহিতা মেরিয়া লুইসাকে তিনি দ্বিতীয় পত্নীরূপে গ্রহণ করলেন (১৮১০ খ্রিস্টাব্দে)। এবং পরের বছরেই তিনি লাভ করলেন একটি পুত্রসন্তান। সারা দেশে পড়ে গেল সমারোহের সাড়া! আপাতত নবপুত্রের উপাধি হল ‘রোমের রাজা’। রোমে তখন পোপ ছিলেন না। কারণ ইতিমধ্যেই তাঁকে ধর্মসমাজচ্যুত করেছিলেন বলে নেপোলিয়নের হুকুমে পোপ হয়েছেন নির্বাসিত ও সিংহাসনচ্যুত!

কিছুকাল সুখ-শান্তিতে কাল কাটাবার পর নেপোলিয়ন আবার শুনতে পেলেন রুশ-ভল্লুকের গর্জন!

সত্য সত্যই নেপোলিয়নের আর অস্ত্র ধরবার সাধ ছিল না। মানব জীবনের যা-কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, সমস্তই সফল হয়েছে তাঁর জীবনে—এমন সফলতা পৃথিবী আর কখনও দেখেনি। এমনকী প্রৌঢ় বয়সে তাঁর পুত্র কামনাও বিফল হয়নি। সমস্ত ইউরোপ তাঁর পদতলে—একমাত্র ইংল্যান্ড ছাড়া। এবং ইংল্যান্ডের সঙ্গেও তিনি সন্ধি স্থাপনের জন্যে চেষ্টা করছিলেন। ভেবেছিলেন বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন শান্তির স্বপ্ন দেখে।

কিন্তু বিধাতার লিখন অন্যরকম। পৃথিবীকে তিনি বোধহয় দেখাতে চান, মানুষ কত উঁচুতে উঠতে ও কত নীচুতে পড়তে পারে!

অতি সৌভাগ্যে মহামানবরাও হয়তো অন্ধ হন। নেপোলিয়নের প্রথম ভ্রম হয়েছিল, স্পেন নিয়ে অনর্থক গোলমাল করা। তাঁর দ্বিতীয় এবং প্রধান ভ্রম, রুশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান। রুশিয়াকে হারালে তাঁর গৌরববৃদ্ধির কোনও সম্ভাবনাই নেই, কিন্তু রুশিয়ার কাছে হারলে তাঁরই সর্বনাশ!

রুশিয়ায় যুদ্ধযাত্রা করবার আগে নেপোলিয়ন ড্রেসডেন শহরে রাজা-রাজড়াদের নিয়ে এক দরবারের আয়োজন করলেন। এমন অপূর্ব রাজ-সম্মিলন দেখবার সুযোগ ইউরোপের আর কখনও হয়নি। সম্রাট নেপোলিয়নের সামনে এসে দাঁড়ালেন অস্ট্রিয়ার সম্রাট ও প্রুশিয়ার অধিপতি—অনুগ্রহপ্রার্থী সামন্তরাজের মতন। ছোট-বড়-মাঝারি আরও কত অভিজাত বংশীয় রাজা, গ্র্যান্ড ডিউক ও ডিউকের দল এলেন কালকের ভুঁইফোঁড় সম্রাট প্রথম নেপোলিয়নকে অভিনন্দিত করতে ও তাঁর মুখের দুটো মিষ্টি কথা শুনতে! সেদিন নেপোলিয়নের মনে ভাব হয়েছিল কেমন, সে কথা কেউ জানে না—আমরা অনুমান করতে পারি মাত্র! নেপোলিয়নের ভাগ্যলক্ষ্মীই বিদায় নেওয়ার আগে বোধহয় এই শেষ মেলা বসিয়ে গেলেন!

১৮১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে নেপোলিয়ন প্রবেশ করলেন রুশিয়ার মধ্যে—সঙ্গে ছিল তাঁর পাঁচলক্ষ সৈন্য।

কিন্তু তারপর যে-ব্যাপার আরম্ভ হল সেটা আর বিস্তৃতভাবে বলবার দরকার নেই, স্থানও নেই।

নেপোলিয়ন যত অগ্রসর হন, রুশরা তত পিছিয়ে যায়! তারা সামনাসামনি লড়াই করে না, কেবল পিছিয়ে যায়! পথে যে-সব গ্রাম পড়ে সেগুলো মরুভূমির মতন জনশূন্য, খাদ্যশূন্য। মাঝে মাঝে আশেপাশে পিছনে শত্রুদল হঠাৎ যেন আকাশ থেকে সদ্য পতিতের মতন আবির্ভূত হয়, খানিক হানাহানি লুঠতরাজ করে অদৃশ্য হয় আবার স্বপ্নের মতন! এই মরুপ্রদেশে, দেশ থেকে এত দূরে এসে এমন বৃহৎ বাহিনীর খোরাক জোগান দেওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে, ফরাসিরা অনাহরে মারা পড়তে লাগল!

স্মোলেনসক শহরে ফরাসিরা বাধা পেলে রুশ সৈনিকদের কাছে। ফরাসিদের মতন রণচতুর না হলেও রুশরা মরিয়া হয়ে লড়তে লাগল। কিছুতেই তারা হটতে চায় না! প্রায় ছয় হাজার ফরাসি সৈন্য বধ করে রাত্রে সারা শহরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে রুশরা আবার কোথায় চলে গেল।

তারপর বোরোডিনো গ্রামের কাছে হল এক বড় যুদ্ধের আয়োজন। নেপোলিয়নের সৈন্যসংখ্যা একলক্ষ বিশ হাজার, রুশদের সংখ্যা আরও বেশি। দীর্ঘকালব্যাপী ভয়াবহ যুদ্ধের পর রুশরা হেরে পালিয়ে গেল। এই যুদ্ধে পঞ্চাশ হাজার রুশ ও তিরিশহাজার ফরাসি সৈন্য মারা পড়ল। একটি মাত্র যুদ্ধে নেপোলিয়ন আর কখনও এত লোক হারাননি। বোরোডিনোয় অসীম বীরত্ব ও রণকৌশল দেখিয়ে সেনাপতি নে ‘প্রিন্স’ উপাধি লাভ করেছিলেন (১৮১২ খ্রিস্টাব্দে)।

ফরাসিদের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যিকার যুদ্ধ করা যে কী মারাত্মক ব্যাপার, বেরোডিনোর ক্ষেত্রেই রুশরা তা বুঝে আর সম্মুখ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হল না। নেপোলিয়ন বিনা বাধায় জনশূন্য মস্কো নগরে প্রবেশ করে আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এতদিন পরে আশ্রয় পাওয়া গেল। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই রুশরা আগুন লাগিয়ে সারা শহর পুড়িয়ে দিলে!

এমন অসম্ভব শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করাও অসম্ভব! নেপোলিয়ন আবার স্বদেশের দিকে প্রত্যাগমন করতে লাগলেন। কিন্তু প্রত্যাগমনের পথ হল আরও ভয়ানক! রুশিয়ার বিখ্যাত শীত এসে আক্রমণ করলে ফরাসিদের! পথ, প্রান্তর, অরণ্য—তুষারে-তুষারে সব সাদা ধপ-ধপ করছে, নদীর জল জমে বরফ! শূন্য থেকে ঝরঝর করে ঝরছে তুষারের ঝরনা! এবং ঝোড়ো বাতাস সর্বাঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তুষারেরও চেয়ে কনকনে হয়ে! প্রতিদিন নিয়মিতভাবে হাজার হাজার তুষারার্ত সৈনিক মারা পড়তে লাগল। তার উপরে যখন-তখন এপাশে-ওপাশে শত্রু সৈন্যেরা এসে আক্রমণ করতে ছাড়ে না।

এই ভীষণ অভিযান শেষ হলে পর জানা গেল, রুশিয়ার কবলগত হয়ে মারা পড়েছে বা বন্দি হয়েছে তিনলক্ষ ফরাসি সৈন্য! অথচ সমগ্র অভিযানে নেপোলিয়নের বাহিনী একবারও পরাজয়ের গ্লানি মাখেনি। তাদের মৃত্যুর কারণ—শীত ও অনাহার!