পূর্ববঙ্গবাসী কোন বর, কলিকাতানিবাসী একটি কন্যা বিবাহ করিয়া গৃহে লইয়া যান। কন্যাটি পরমাসুন্দরী, বুদ্ধিমতী, বিদ্যাবতী, কর্মিষ্ঠা এবং সুশীলা। তাঁহার পিতা মহা ধনী, নানা রত্নে ভূষিতা করিয়া কন্যাকে শ্বশুরগৃহে পাঠাইলেন। মনে ভাবিলেন, আমার মেয়ের কোন দোষ কেহ বাহির করিতে পারিবে না। সঙ্গের লোক ফিরিয়া আসিলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন হে, বাঙ্গালেরা মেয়ের কোন দোষ বাহির করিতে পারিয়াছে?” সঙ্গের লোক বলিল, “আজ্ঞা হাঁ—দোষ লইয়া বড় গণ্ডগোল গিয়াছে।” বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন—“সে কি? কি দোষ?” ভৃত্য বলিল, “বাঙ্গালেরা বড় নিন্দা করিয়াছে, মেয়ের কপালে উল্কি নাই।” আমরা এই বঙ্গদর্শনে, কখন সর্ জর্জ কাম্বেল সাহেব সম্বন্ধে কোন কথা বলি নাই। যাঁহার নিন্দা তিন বৎসরকাল বাঙ্গালাপত্রের জীবনস্বরূপ ছিল, তাঁহার কোন উল্লেখ না থাকাতে, আমাদের ভয় করে যে পাছে কেহ বলে যে, বঙ্গদর্শনের উল্কি নাই। আমরা অদ্য বঙ্গদর্শনকে উল্কি পরাইতে প্রবৃত্ত হইলাম।
তবে এই উল্কি বড় সামান্য নহে। যে পত্র বা পত্রিকা (কোন্গুলি পত্র আর কোন্গুলি পত্রিকা তাহা আমরা ঠিক জানি না—কি করিলে পত্র পত্রিকা হইয়া যায়, তাহাও অবগত নহি) একবার কপালে এই উল্কি পরিয়াছে, তিনি বঙ্গদেশে মোহিয়াছেন, মুগ্ধ হইয়া বঙ্গীয় পাঠকগণ তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিয়াছে—এবং সাম্বৎসরিক অগ্রিম মূল্যে বরণ করিয়া তাঁহাকে ঘরে তুলিয়াছে। যে এই উল্কি পরে, তাহার অনেক সুখ।
এক্ষণে সর্ জর্জ কাম্বেল এতদ্দেশ ত্যাগ করিয়া গিয়াছেন—ইহাতে সকলেই দুঃখিত। এ পৃথিবীতে পরনিন্দা প্রধান সুখ—বিশেষ যদি নিন্দিত ব্যক্তি উচ্চশ্রেণীস্থ এবং গুণবান্ হয় তবে আরও সুখ। সর্ জর্জ কাম্বেল গুণবান্ হউন বা না হউন উচ্চশ্রেণীস্থ বটে। তাঁহার নিন্দায় যে সুখ, তাহাতে এক্ষণে বঙ্গদেশের লোক বঞ্চিত হইল। ইহার অপেক্ষায়, আর গুরুতর দুর্ঘটনা কি হইতে পারে? এই যে গুরুতর দুর্ভিক্ষবহ্নিতে দেশ দগ্ধ হইতেছিল—তাহাতেও আমরা কোন মতে প্রাণ ধারণ করিতেছিলাম—খবরের কাগজ চলিতেছিল, বাঙ্গালি বাবু গল্পের মজলিশে অশ্লীল গল্প ছাড়িয়া সর্ জর্জের নিন্দা করিয়া বোতল শেষ করিতেছিলেন। কিন্তু এক্ষণে? হায়! এক্ষণে কি হইবে!
এইরূপ সর্বজননিন্দার্হ হওয়া সচরাচর দেখা যায় না। অনেকে বলিবেন, সর্ জর্জ কাম্বেলের অসাধারণ দোষ ছিল, এই জন্যই তিনি এইরূপ অসাধারণ নিন্দনীয় হইয়াছিলেন। আমাদিগের বিশ্বাস আছে যে এইরূপ সর্বজননিন্দনীয় হয়, যাহার নিন্দায় সকলের তুষ্টি জন্মে, সে হয় অসাধারণ দোষে দোষী বা অসাধারণ গুণে গুণবান্—নয়ত দুই। জিজ্ঞাস্য, সর্ জর্জ কাম্বেল, অসাধারণ দোষে দোষী, না অসাধারণ গুণে গুণবান্ বলিয়া তাঁহার এই নিন্দাতিশয্য হইয়াছিল?
তাঁহার পূর্বগামী শাসনকর্তা সর্ উইলিয়ম গ্রে। সর্ উইলিয়ম গ্রের ন্যায় কোন লেঃ গবর্ণর প্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত হয়েন নাই। সর্ জর্জ কাম্বেল ও সর্ উইলিয়ম গ্রের এই ভাগ্যতারতম্য কোন্ দোষে বা কোন্ গুণে? কোন্ গুণে সর্ উইলিয়ম সকলের প্রিয়, কোন্ দোষে সর্ জর্জ সকলের অপ্রিয়?
যাঁহারা এই কথার মীমাংসা করিতে ইচ্ছুক তাঁহাদিগকে একটা কথা বুঝাইতে হয়। এই ব্রিটিশ ভারতীয় শাসনপ্রণালী দূর হইতে দেখিতে বড় জাঁক, শুনিতে ভয়ানক, বুঝিতে বড় গোল—ইহার প্রকৃতি কি প্রকার? এক লেঃ গবর্ণর কর্তৃক যে এই বৃহৎ রাজ্য শাসিত হয় সে কোন্ রীতি অবলম্বন করিয়া?
সে রীতি দুই প্রকার। একটি রীতি, একটি সামান্য উদাহরণের দ্বারা বুঝাইব। মনে কর, বাঁধের কথা উপস্থিত। কমিশ্যনরের রিপোর্টে হউক, বোর্ডের রিপোর্টে হউক, ইঞ্জিনিয়রদিগের রিপোর্টে হউক, সংবাদপত্রে হউক, লেঃ গবর্ণর জানিলেন যে নদীতীরস্থ প্রাচীন বাঁধ সকল রক্ষিত হইতেছে না—তাহার উপায় করা কর্তব্য। তখন লেঃ গবর্ণরের হুকুম হইল যে, রিপোর্ট তলব কর। এই হুকুমে যদি কোন বিশেষ গুণশালিত্ব বা যোগ্যতা থাকে, তবে সে গুণশালিত্ব বা যোগ্যতা লেঃ গবর্ণরের। সেক্রেটরি সাহেব হুকুম পাইয়া, বোর্ডে চিঠি লিখিলেন—তাঁহার চিঠিতে কথাটা একটু বিস্তৃতি পাইল—তিনি বলিলেন ইহার বিশেষ অবস্থা জানিবে—অধীনস্থ কর্মচারীদিগের অভিপ্রায় কি তাহা লিখিবে, ইহার কিরূপ উপায় হইতে পারে তাহা লিখিবে। বোর্ড, ঐ পত্রখানির একাদশ খণ্ড অতি পরিষ্কার অনুলিপি প্রস্তুত করিয়া, একাদশ কমিশ্যনরের নিকট পাঠাইলেন। একাদশ কমিশ্যনর, অনুলিপি প্রাপ্ত হইয়া তাহার কোণে পেন্সিলে প্রাপ্তির তারিখ লিখিয়া বাক্সে ফেলিলেন, তাঁহার গুরুতর কর্তব্য কার্য সমাপ্ত হইল। বাক্স প্রাচীন প্রথানুসারে যথাসময়ে চাপরাশির স্কন্ধে আরোহণ করিয়া, কেরাণীর নিকট পৌঁছিল। কেরাণী তাহার আর এক খণ্ড পরিষ্কার অনুলিপি প্রস্তুত করিয়া সাত দিনের মিয়াদ লিখিয়া দিয়া, কালেক্টরদিগের নিকট পাঠাইলেন। যে পথে মহাজন যায় সেই পথ,—দোর্দণ্ড প্রচণ্ড প্রতাপান্বিত শ্রীল শ্রীযুক্ত কালেক্টর বাহাদুর, চুরুট খাইতে খাইতে চিঠির কোণে লিখিলেন, “সাব্ডিবিজন ও ডেপুটিগণ বরাবর।” চিঠি এইরূপে বড় ডাকঘর হইতে মেজো ডাকঘরে, মেজো ডাকঘর হইতে ছোট ডাকঘরে, এবং তথা হইতে শেষে আটচালা নিবাসী বোতামশূন্য চাপকানধারী কালকোল নাদুস নুদুস ডিপুটি বাহাদুরের ছিন্ন পাদুকামণ্ডিত শ্রীপাদপদ্মযুগলে মধুলুব্ধ ভ্রমরের ন্যায় আসিয়া পড়িল। ডিপুটি বাহাদুরেরা প্রায় উদরস্থ মহাত্মাদিগের অনুকরণ করিয়া, ইংরেজি চিঠির বাঙ্গালা পরওয়ানা করিয়া সব-ইনস্পেক্টরগণের নিকট ফেলফোর রিপোর্ট তলব করিলেন—সব-ইনস্পেক্টর পরওয়ানা কনষ্টেবলের হাওয়ালা করিল—কনষ্টেবল যে গ্রামে বাঁধ সেইখানে, কাল কোর্তা কাল দাড়ি এবং মোটা রুল লইয়া, দর্শন দিয়া এক অন্নাভাবে শীর্ণ ক্লিষ্ট চৌকিদারকে ধরিল। ধরিয়াই জিজ্ঞাসা করিল যে, “তোদের গাঁয়ের বাঁধ থাকে না কেন রে?” চৌকিদার ভীত হইয়া বলিল, “আজ্ঞা, জমীদারে মেরামত করে না, আমি গরিব মানুষ কি করিব?” কনষ্টেবল তখন জমীদারী কাছারিতে পদরেণু অর্পণ করিয়া গোমস্তাকে কিছু তম্বী করিলেন। গোমস্তা জমীদারী খাতায় পাঁচ টাকা খরচ লিখিয়া কনষ্টেবল বাবুকে দেড় টাকা পারিতোষিক দিয়া বিদায় করিলেন। কনষ্টেবল আসিয়া সব-ইনস্পেক্টর সমক্ষে রিপোর্ট করিলেন “বাঁধ সব বেমেরামত-জমীদার মেরামত করে না—জমীদার মেরামত করিলেই মেরামত হইতে পারে।” ডিপুটি বাহাদুর লিখিলেন “বাঁধ সব বেমেরামত-জমীদারেরা মেরামত করে না—তাহারা মেরামত করিলেই হয়।” কালেক্টর বাহাদুর সেই সকল কথা লিখিলেন, অধিকন্তু “এক্ষণে জমীদারদিগকে বাঁধ মেরামত করিলে বাধ্য করা উচিত।” কমিশ্যনর, সেই সকল কথা লিখিয়া বোর্ডে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এক্ষণে কি প্রকারে জমীদার বাঁধ মেরামত করিতে বাধ্য করিতে বাধ্য হইতে পারে?” বোর্ড তত্তদুক্তি পুনরুক্ত করিয়া, একটা যাহা হয় উপায় নির্দিষ্ট করিলেন। সেক্রেটরি সাহেব সেই সকল কথা সাজাইয়া লিখিয়া এক রিজলিউশনের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করিয়া পাঠাইলেন, লেঃ গবর্ণর সাহেব সম্মত হইয়া তাহাতে দস্তখত করিয়া দিলেন। আজ্ঞা দেশে প্রচারিত হইল; লেঃ গবর্ণর বাহাদুরের যশ দেশে বিদেশে ঘোষিল। যাহারা মিত্রপক্ষ তাহারা গবর্ণর বাহাদুরের প্রশংসা করিতে লাগিল—শত্রুপক্ষ নানা জাতীয় ইংরেজি বাঙ্গালায় তাঁহাকে গালি পাড়িতে লাগিল। নষ্টের গোড়া চৌকিদার নির্বিঘ্নে স্বদেশে কোদালি পাড়িতে লাগিল।
বাস্তবিক যে এইরূপ কোন প্রকৃত ঘটনা ঘটিয়াছে, এমন নহে। একটি কল্পিত ঘটনা অবলম্বন করিয়াই এ সকল কথা লিখিলাম। এইরূপ যে সচরাচরই ঘটিয়া থাকে, এমত নহে। কিন্তু অনেক সময়ে ঘটে। সৌভাগ্যক্রমে যাঁহারা সুযোগ্য শাসনকর্তা, তাঁহারা এ প্রথা অবলম্বন করেন না, অযোগ্যেরা করিয়া থাকেন, এইরূপ কার্যপ্রণালীকে “কলে শাসন” বলা যাইতে পারে। ধর্মের কলের ন্যায় শাসনের কলও বাতাসে নড়িয়া থাকে; কোন দিক্ হইতে কোন কর্মচারীর রিপোর্টের বাতাস, বা অন্য প্রকার ফাঁপি উঠিয়া কলে লাগিলে, কল চলিতে আরম্ভ করে ; তদন্তের হুকুম হইতে কলের দম আরম্ভ হইয়া বোর্ড কমিশ্যনর প্রভৃতি অধোধঃ পর্যায়ক্রমে ঘুরিয়া আবার লেঃ গবর্ণর পর্যন্ত আসিয়া সহি মোহরের মঞ্জুরি মুদ্রিত করিয়া দিয়া বন্ধ হয়। যেমন কলের ধুতি, কলের সূতা প্রভৃতি সামগ্রী আছে, তেমনি কলে তৈয়ারি রাজাজ্ঞাও আছে।
যে লেঃ গবর্ণর এইরূপ কলে শাসন করেন, তিনি সুমানুষ হইলে হইতে পারেন; তদ্ভিন্ন তাঁহার বুদ্ধিমত্তা, যোগ্যতা বা অন্য কোন গুণের প্রশংসার কারণ দেখা যায় না। তিনি কখন আপন বুদ্ধির চালনা করেন না, কোন বিষয়ের সদ্বিবেচনা করিবার জন্য তাঁহাকে নিজে কষ্ট পাইতে হয় না। তিনি পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কখন কোন নূতন বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়েন না ; পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কোন বিষয়ের যাথার্থ্য স্বয়ং মীমাংসা করেন না। তিনি শাসনযন্ত্রের একটি অংশ মাত্র—যখন রাজ্যের কল বাতাসে নড়িল, তখন তিনিও নড়িলেন, কলে চালিত হইয়া মঞ্জুরি লিপি সমেত সহিমোহর করিয়া দিয়া কলে থামিলেন। সেইরূপ ঘণ্টা পূর্ণ হইলে, ঘড়ির মুরদ, বাহির হইয়া, ঠংঠং করিয়া ঘণ্টা বাজাইয়া, আবার কলে মিশিয়া যায়।
সর্ উইলিয়ম গ্রে ও সর্ জর্জ কাম্বেলে প্রধান প্রভেদ এই যে, সর্ উইলিয়ম গ্রে কলে শাসন করিতেন, সর্ জর্জ কাম্বেল তাহা করিতেন না।
কলে শাসনের অনেক গুণ আছে। তাহার ফল ভাল হউক, মন্দ হউক, লোকের অসন্তোষের সম্ভাবনা অতি অল্প। যাহা পূর্বাপর চলিয়া আসিতেছে, তাহা নিতান্ত অনিষ্টকর হইলেও লোকে তাহাতে সন্তুষ্ট; পূর্বপ্রচলিত রীতি অত্যন্ত অনিষ্টকারী হইলেও লোকে তাহার সংশোধনে অসন্তুষ্ট। পুরাতনের মন্দও ভাল, নূতনের ভালও মন্দ। কলের শাসন, শাসনই নহে ; যিনি কলে শাসন করেন, তিনি কিছু করেন না বলিলেই হয়। অতএব কলের শাসনে পুরাতনের কিঞ্চিন্মাত্র সংস্করণ ভিন্ন নূতন কখন ঘটে না ; যাহা আছে, তাহাই প্রায় বজায় থাকে; যাহা নাই, অথচ আবশ্যক, প্রায় তাহা ঘটিয়া উঠে না। এজন্য লোকেরও অসন্তোষ জন্মে না; বিশেষ এদেশীয় লোক পুরাতনের অত্যন্ত অনুরাগী, নূতনে অত্যন্ত বিরক্ত।
সর্ উইলিয়ম গ্রে, কলে শাসন করিতেন না, সুতরাং লোকের বড় প্রিয় ছিলেন। সর্ জর্জ কাম্বেল, কলে শাসন করিতেন না, এজন্য লোকেরা বড় অপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিলেন। রাজ্যশাসন উভয়েরই উদ্দেশ্য; কিন্তু সর্ উইলিয়ম গ্রের উদ্দেশ্য ছিল কেবল শাসনের কল চালান; সর্ জর্জ কাম্বেল উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিয়াছিলেন। তাঁহার শাসনে সুফল ফলিয়াছে, সর্ উইলিয়ম গ্রের শাসনে কুফল ফলিয়াছে, এ কথা বলাও আমাদের অভিপ্রায় নহে। কেবল বলিতে চাই যে, সর্ জর্জ কাম্বেল আপন বুদ্ধিতে চলিতেন; এ বৃহৎ রাজ্যশাসন জন্য চিন্তা করিতেন; উদ্দেশ্যগুলি স্থির করিয়া, তাঁহার সাধনে প্রাণপণে যত্ন করিতেন; যে কার্য কর্তব্য এবং সাধ্য বলিয়া বুঝিতেন, কিছুতেই তাহা হইতে বিরত হইতেন না। সর্ উইলিয়ম গ্রে এ সকল কিছুই করিতেন না। যাহা হয় আপনি হউক, কেহ কল টিপিয়া দেয় ত কল চলুক—আমি কিছুর মধ্যে থাকিব না। নিজের বুদ্ধি, গ্রে সাহেব প্রায় খরচ করিতেন না; জমার অঙ্কে কিছু মিল ছিল কি না বলা যায় না। নিজের যত্ন প্রায় তাঁহার কোন বিষয়ে ছিল না। তাঁহার দ্বারা যে কিছু সৎকার্য সিদ্ধ হইয়াছে—তাহা কলে; তাঁহার দ্বারা যে কিছু অনিষ্ট ঘটিয়াছে, তাহা কলে। তিনি উচ্চ শিক্ষার পোষক ছিলেন বলিয়া বাঙ্গালি মহলে বড় প্রশংসিত; কিন্তু বাঙ্গালি বাবুদিগের মত, আসল কথাটা কি তাহা বুঝেন নাই; কেবল আট্কিন্সন সাহেব কল টিপিয়া দিয়াছিলেন, বলিয়া কলের পুত্তলী সর্ উইলিয়ম গ্রে উচ্চ শিক্ষার পোষকতা করিয়াছিলেন, ঘড়ির মুরদ ঘড়ি টিপিয়া দিয়া কলে লুকাইয়াছিলেন।
এমন নহে যে, সর্ জর্জ কাম্বেলের সময় কলে শাসন একেবারে ছিল না। শাসনের কল চিরকাল বজায় আছে; যিনি ইচ্ছা তিনি শাসনকর্তা হউন, সে কল মধ্যে মধ্যে বাতাসে নড়িবে; সকল শাসনকর্তাকেই শাসনের কল চালাইয়া কতকগুলি কার্য সম্পন্ন করিতে হইবে। তবে সর্ জর্জ কাম্বেল কলে সিদ্ধ তত্ত্বগুলি অবশ্যগ্রাহ্য মনে করিতেন না; ইচ্ছানুসারে তাহা ত্যাগ করিতেন; ইচ্ছানুসারে তত্তৎস্থানে নূতন সিদ্ধান্ত আদিষ্ট করিতেন। সর্ জর্জ কাম্বেল কল নিজে চালাইতেন, স্বয়ং কলের অংশ ছিলেন না।
সর্ উইলিয়ম গ্রে সকলের মন রাখিয়া কাজ করিতেন; গালিগালাজকে বড় ভয় করিতেন। সম্বাদপত্রের ভয়ে তটস্থ ছিলেন; ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান আসোসিয়েশনকে মুরুব্বি বলিয়া মানিতেন। সুখ্যাতির আশায় এবং গালির ভয়ে, তিনি সম্বাদপত্রের আজ্ঞাকারী ছিলেন। ব্রি. ই. আসোসিয়েশনের প্রধান মেম্বরদিগের কেনা বেচার মধ্যে ছিলেন। সর্ জর্জ কাম্বেল, কাহারও নিকট সুখ্যাতি খুঁজিতেন না; কাহারও অনুরোধ রাখিতেন না। সম্বাদপত্র সকলকে ঘৃণা করিতেন, ব্রিটিশ ইঃ আসোসিয়েশনকে ব্যঙ্গ করিতেন। অতএব একজন যে লোকের প্রিয়, আর একজন অপ্রিয় হইবেন ইহা সহজেই অনুমেয়।
সর্ উইলিয়ম গ্রে কিয়দংশ প্রিয়বাদী ছিলেন, সর্ জর্জ কাম্বেল বড় অপ্রিয়বাদী ছিলেন। সকলকে কটু বলায় সর্ জর্জ কাম্বেলের বিশেষ আমোদ ছিল। তাঁহার গুরুতর অহঙ্কারই এই অপ্রিয়বাদিত্বের একটি প্রধান কারণ। তিনি জানিতেন যে, পৃথিবীতে বুদ্ধিমান পণ্ডিত এবং বিজ্ঞ, একা সর্ জর্জ কাম্বেল; আর সকল মনুষ্যই মূর্খ, নির্বোধ, অসার, ভণ্ড এবং স্বার্থপর। তিরস্কারই তাহাদের প্রতি উপযুক্ত ব্যবহার। এইরূপ তমোভিভূত হইয়া সর্ জর্জ কাম্বেল কাহারও পরামর্শ গ্রাহ্য করিতেন না। নিজেও দেশের অবস্থা কিছুই জানিতেন না। অথচ সকল বিষয়েই আত্মবুদ্ধিমত মীমাংসা করিয়া হস্তক্ষেপ করিতেন। তাহাতে অনেক অনিষ্ট ঘটাইয়াছেন।
সর্ জর্জ কাম্বেল এদেশীয়গণকে বিশেষ ঘৃণা করিতেন। তিনি বিবেচনা করিতেন, ইহারা অকর্মণ্য—কোন গুরুতর ভাবের অযোগ্য। এই ঘৃণা তাঁহার শাসনকার্যের আর একটি ঘোরতর বিঘ্ন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। যাহার প্রতি ঘৃণা আছে তাহার সুখ দুঃখের ভাগী হওয়া যায় না, প্রজার সুখ দুঃখের ভাগী না হইলে, কখন প্রজার সুখ বৃদ্ধি, দুঃখ নিবারণ করা যায় না।
সর্ উইলিয়ম গ্রে ও জর্জ কাম্বেল উভয়েই স্বেচ্ছাচারী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। যিনি যাহা ধরিতেন, তিনি তাহা আর ছাড়িতে চাহিতেন না। দুই জনের “রোখ” বড় ভয়ানক ছিল—দণ্ড প্রণয়নের সাধ দুই জনেরই বড় গুরুতর ছিল। দুই জনেরই একটি নিতান্ত নিন্দনীয় দোষ ছিল যে, বিনাপরাধেও দণ্ডবিধান করিতেন। বিশেষ সর্ জর্জ কাম্বেলের ন্যায়নিষ্ঠতা কিছুই ছিল না।
স্থূল কথা এই যে, সর্ জর্জ কাম্বেল অত্যন্ত গর্বিত, আত্মাভিমানী, কৃষ্ণচর্মে ঘৃণাবিশিষ্ট, পরোপদেশে বিরক্ত, স্বেচ্ছাচারী, অপ্রিয়বাদী, অপ্রিয়কারী, অন্যায়পর, শাসনকর্তা ছিলেন। সর্ উইলিয়ম গ্রের এত দোষ ছিল না; তিনি কেবল স্থূলবুদ্ধি ছিলেন; কোনরূপে লোকের মন রাখিয়া, কলে শাসন করিয়া, নিন্দার হাত হইতে মুক্তিলাভ তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল।
গুণ পক্ষে, সর্ জর্জ কাম্বেল সাহেবের নিতান্ত অভাব ছিল না। তিনি বুদ্ধিমান্, সুপণ্ডিত, পরিশ্রমী, এবং অধ্যবসায়সম্পন্ন। দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে দেখা গিয়াছে, তিনি ক্ষিপ্রকারী এবং দূরদর্শী। তিনি সাম্যবাদী। প্রজার কোন মঙ্গল সিদ্ধ করিয়া থাকুন, বা না থাকুন, তিনি প্রজার হিতৈষী। সর্ উইলিয়ম গ্রের গুণের মধ্যে কেবল ইহাই আমাদের স্মরণ হইতেছে যে, তিনি অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ ছিলেন। সর্ জর্জ কাম্বেলের মত বহু গুণে গুণবান্ ও বহু দোষে দোষী শাসনকর্তা কেহই এদেশে আসেন নাই; সর্ উইলিয়ম গ্রের মত দোষশূন্য ও গুণশূন্য কেহ আসেন নাই। গুণবান্ ও দোষযুক্তের শত্রু অনেক, নির্দোষ ও নির্গুণের শত্রু থাকে না। সর্ জর্জ কাম্বেলের নিন্দা এবং সর্ উইলিয়ম গ্রের সুখ্যাতির কারণই এই।
কিন্তু কিছু বিবেচনা করিয়া দেখিলে, সে নিন্দা ও সুখ্যাতির সকল কারণ বজায় থাকে না। দুই একটা উদাহরণের দ্বারা এ কথা প্রতিপন্ন করিতেছি।
রোডশেষের আইন প্রচার করার জন্য সর্ জর্জ কাম্বেল বিশেষ নিন্দিত, কিন্তু এ বিষয়ে সর্ জর্জ কাম্বেলের দোষ কি? তিনি কেবল উপরিস্থ কর্মচারীর আজ্ঞা প্রতিপালন করিয়াছিলেন। রোডশেষের দায়ী ডিউক্ অব আর্গাইল; অধস্তন কর্মচারীর সাধ্য নাই উপরিস্থ কর্মচারীর আজ্ঞা লঙ্ঘন করেন। সর্ জর্জ কাম্বেল রোডশেষ বিধিবদ্ধ করিয়া অলঙ্ঘনীয় আজ্ঞাপালন করিয়াছেন মাত্র।
নূতন কার্যবিধি আইনের দুইটি নিয়মের জন্য জর্জ কাম্বেল নিন্দিত হইয়া থাকেন। প্রথম, জুরির বিচারের অলঙ্ঘনীয়তার উচ্ছেদ; দ্বিতীয় সরাসরি বিচারের প্রথা।
সরাসরি বিচার প্রথার আমরা অনুমোদন করি না। অনুমোদন করি না, তাহার কারণ এই যে, এ দেশীয় বিচারকগণ অনেকেই এই ক্ষমতার অযোগ্য। কিন্তু বিচারক অযোগ্য বলিয়া আইন অসম্পূর্ণ থাকিবে কেন? একটি কথা বিশেষ বিবেচনা করা আবশ্যক। যেরূপ লিখিত বিচারপ্রণালী প্রচলিত, তাহাতে একটি ফৌজদারী মোকদ্দমা করিতে অনেক বিলম্ব হয়। বিচারকেরা যে কয়েকটির বিচার করিতে পারেন, সেই কয়টির বিচার করিয়া অবশিষ্টের দিন ফিরাইয়া দেন। এইরূপ অনেক মোকদ্দমার দিন, পুনঃ পুনঃ ফিরিয়া যায়। অর্থী প্রত্যর্থী অনেকবার কষ্ট পাইয়া, রফা করিয়া চলিয়া যায়। না হয়, সাক্ষী পলায়; নয়, ধনী পক্ষ সময় পাইলে অর্থ ব্যয় করিয়া সাক্ষিগণকে বশীভূত করে। এইরূপে বিচারকের অনবকাশে অনেক মোকদ্দমার বিচার একেবারে হয় না। ইহার দুইটি মাত্র উপায় সম্ভবে; প্রথম, বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি; দ্বিতীয় বিচারকের অবকাশ বৃদ্ধি। প্রথম উপায়, অর্থব্যয়সাপেক্ষ; বিচারকসংখ্যা বৃদ্ধি করিতে গেলে, আবার নূতন টেক্স বসাইতে হয়। টেক্সের নামে লোকের যেরূপ ভয়, টেক্স বসিলে লোকের যেরূপ কষ্ট, টেক্সের জন্য গবর্ণমেণ্টের উপর প্রজার যেরূপ সন্তোষ তাহাতে আর টেক্স বসান সম্ভব নহে। সুতরাং বিচারকের সংখ্যা বাড়াইবার কোন উপায় নাই। অতএব বিচারকের অবসর বৃদ্ধি ভিন্ন এ অবিচার নিবারণের উপায়ান্তর নাই। বিচারকের অবসর বৃদ্ধির একমাত্র উপায় আছে। যাহাতে মোকদ্দমায় অল্প সময় লাগে, তাহা করিলেই অবসর বৃদ্ধি হইতে পারে। এই জন্য সরাসরি বিচারের সৃষ্টি। ইহার অন্য কোন উপায় নাই—কেবল কতকগুলি মোকদ্দমায় লেখাপড়ার অল্পতা করা একমাত্র উপায়। যদি বল, আপিল উঠিয়া গেল কেন? উত্তর, প্রমাণ লিপিবদ্ধ না থাকিলে কি দেখিয়া আপিল আদালত বিচার নিষ্পত্তি করিবেন।
জুরির বিষয়েও একটি বিশেষ কথা আছে। যদি হাঁড়ি গড়া, ঘটি গড়ায় নৈপুণ্য শিক্ষার অধীন, তবে বিচারকার্যেই শিক্ষার প্রয়োজন নাই, এ কথা নির্বোধ বা কুসংস্কারাবিষ্ট লোকেই বলিবে। বিচারকার্য শিক্ষিত জজের দ্বারা হওয়াই কর্তব্য—যে অনেক দিন ধরিয়া কোন একটি কাজ অভ্যাস করিয়াছে, তাহাকেই শিক্ষিত বলিতেছি। যদি কাঁসারীকে ঘটি গড়িতে না দিয়া, তাঁতিকে কাপড় বুনিতে না দিয়া, পাঁচজন মাটি কাটা মজুরকে দিয়া ঘটি গড়ান, বা বস্ত্র বুনান ভাল না হয়, তবে যে বিচারচার্য শিল্পকর্মাপেক্ষা শতগুণে কঠিন, তাহাতেই কি কেবল শিক্ষিতাপেক্ষা অশিক্ষিতের কার্য ভাল? অনেকে বলেন, এক জন বিচারকের উপর নির্ভর করিলে ভুলের সম্ভাবনা, অতএব এক জন জজের অপেক্ষা পাঁচ জন জুরির বিচার ভাল। ইহা বলিলে বলিতে হয় যে, একজন নিউটন অপেক্ষা পাঁচ জন পাঠশালার গুরু গণনায় ভাল, এক জন হক্সলী অপেক্ষা পাঁচটি নেটিব ডাক্তার শারীরতত্ত্বে ভাল, এক জন কালিদাস অপেক্ষা বাঙ্গালা সম্বাদপত্রের পাঁচ জন পত্রপ্রেরক কবিত্বে ভাল। আমাদিগের সংস্কার আছে যে, যাহা বিলাতী তাহাই ভাল, বিলাতে জুরির প্রথা প্রচলিত আছে, সুতরাং আমাদের দেশেও ঠিক সেই জুরির বিচার চালাইতে হইবে! এরূপ কুসংস্কারবিশিষ্ট লোকে জানেন না যে, ইংলণ্ডে যখন বিচারকেরা পক্ষপাতী ছিলেন, ধনীর বশীভূত হইয়া দীনের অন্যায় দণ্ড করিতেন, তখন দীনের রক্ষার্থ দীনের দ্বারা দীনের বিচার, ধনীর দ্বারা ধনীর বিচার, সমানের দ্বারা সমানের বিচার, এই প্রথা সৃষ্ট হইয়াছিল। এইক্ষণে ইংলণ্ডে সে অবস্থা নাই, কিন্তু ইংলণ্ডের ন্যায় দেশাচারপ্রিয় দেশে দেশাচার শীঘ্র লোপ পায় না বলিয়াই উহা অদ্যাপি চলিতেছে। এবং কতকগুলি অনুকরণভক্ত দেশেও গৃহীত হইয়াছে। এক্ষণে ইংলণ্ডীয় কৃতবিদ্য চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ জুরির বিচারের প্রথার বিরোধী হইয়া দাঁড়াইতেছেন। ভারতবর্ষ, বিশেষ প্রকারে জুরির বিচার প্রথার অযোগ্য। জুরির সৃষ্টি হইয়া অবধিই ভারতবর্ষে অবিচার হইতেছে—দোষী দোষ করিয়া, সেসন হইতে প্রায় খালাস পাইয়া আসিতেছে—হুগলীতে নবীনের বিচার, ইহার একটি জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ। এই ঘোর অবিচার নিবারণের জন্যই সর্ জর্জ কাম্বেল জুরির আইনের কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করাইয়াছেন। সে জন্য তাঁহার নিন্দা না করিয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ করিতে হয়। তিনি যে জুরির প্রথার একেবারে উচ্ছেদ করেন নাই, ইহাতেই আমরা দুঃখিত।
কার্যবিধি আইন সম্বন্ধে আর একটি কথা আমাদিগের বলিতে বাকি আছে। ব্রিটিশ-ভারতবর্ষীয় রাজ্যে সর্বাপেক্ষা তিমিরময় কলঙ্ক-দেশী বিদেশীতে বিচারাগারে বৈষম্য। দেশীর জন্য এক আইন আদালত-সাহেবের জন্য ভিন্ন আদালত। এই লজ্জাকর কলঙ্ক মেকলে হইতে লরেন্স পর্যন্ত অনেকে অপনীত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন—কেহ শক্ত হয়েন নাই। সর্ জর্জ কাম্বেল হইতে সেই কার্য কিয়দংশে সিদ্ধ হইতেছে। এ বিষয়ে তিনি দেশীয় লোকের পরম বন্ধুর কার্য করিয়াছিলেন । অন্য কেহ করিলে, এত দিন তাঁহার সুখ্যাতিতে দেশ পুরিয়া যাইত। সর্ জর্জ কাম্বেল এ কার্য করিয়াছেন বলিয়া সে কথার কোন উচ্চবাচ্য নাই।
উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ তাঁহার আর একটি নিন্দার কারণ। যিনি কোন প্রকার শিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ করেন, তিনি মনুষ্যজাতির শত্রুর মধ্যে গণ্য। তবে ইহা স্মরণ করিতে হইবে যে, সকল মনুষ্যেরই শিক্ষায় সমান অধিকার। শিক্ষায় ধনীর পুত্রের যে অধিকার, কৃষকপুত্রের সেই অধিকার। রাজকোষ হইতে ধনীদিগের শিক্ষার জন্য অধিক অর্থব্যয় হউক, নির্ধনদিগের শিক্ষায় অল্প ব্যয় হউক, ইহা ন্যায়বিগর্হিত কথা। বরং নির্ধনদিগের শিক্ষার্থ অধিক ব্যয় এবং ধনীদিগের শিক্ষার্থ অল্প ব্যয়ই ন্যায়সঙ্গত; কেন না, ধনীগণ আপন ব্যয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইতে পারে, কিন্তু নির্ধনগণ সংখ্যায় অধিক, এবং রাজকোষ ভিন্ন অনন্যগতি। কিন্তু ভারতবর্ষীয় ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট পূর্বাপর শিক্ষার্থে সে প্রণালীতে ব্যয় করিয়া আসিয়াছেন, তাহা ন্যায়ানুমোদিত নহে। ধনীর শিক্ষার্থই সে ব্যয় হইয়া আসিতেছে; দরিদ্রের শিক্ষার্থ প্রায় নহে। যখন ইণ্ডিয়ান গবর্ণমেণ্ট হইতে সে প্রথা পরিবর্তন করিয়া, ধনীর শিক্ষার ব্যয়ের লাঘব করিয়া, দরিদ্র শিক্ষার ব্যয় বাড়াইবার প্রস্তাব হইয়াছিল, তখন সর্ উইলিয়ম গ্রে “উচ্চশিক্ষা! উচ্চশিক্ষা!” করিয়া সে প্রস্তাবের প্রতিবাদ করিয়া, দেশের লোকের প্রিয় হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু দেশের মঙ্গল করেন নাই। যদি উচ্চশিক্ষার ব্যয় হইতে কিছু টাকা লইয়া তাহা দরিদ্রশিক্ষায় ব্যয় করিবার জন্য সর্ জর্জ কাম্বেল উচ্চশিক্ষার ব্যয় কমাইয়া থাকেন, তবে আমরা তাঁহার নিন্দা করিতে পারি না।
আরও কয়েকটি বিষয়ে সমালোচনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু স্থানাভাবে এ প্রস্তাবের আর সম্প্রসারণ করিতে পারিলাম না। উপসংহারে বক্তব্য যে, যদি কেহ আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করে যে, সর্ জর্জ কাম্বেলের কৃত এমন কি কার্য আছে যে তজ্জন্য সর্ জর্জের কিছু প্রশংসা করিতে পারি? আমরা তাহা হইলে বলিব যে, দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে তিনি উপকার করিয়াছেন, ব্রিটিশজাত প্রজাকে এতদ্দেশীয় আদালতের বিচারাধীন করিয়াছেন, প্রবিনসিয়াল আয় ব্যয়, তাঁহার হস্তে যেরূপ সুনিয়মবিশিষ্ট ছিল। পক্ষান্তরে যদি কাহাকে আমরা জিজ্ঞাসা করি যে, সর্ উইলিয়ম গ্রের কৃত এমন কোন কার্য আছে যে, তজ্জন্য আমরা তাঁহার নাম স্মরণ করি প্রশংসা করিতে পারি, তাহা হইলে তিনি কি উত্তর দিবেন? উচ্চশিক্ষার পক্ষ সমর্থন?
অনেকে এই প্রস্তাব পাঠ করিয়া লেখকের প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইবেন। এদেশীয় লোকের মধ্যে অনেকের বিশ্বাস আছে যে, সর্ জর্জ কাম্বেল, মনুষ্যাকারে পিশাচ ছিলেন। আমরা পিশাচ বলিয়া তাঁহাকে বর্ণিত করি নাই। তিনি বহু দোষযুক্ত ছিলেন, কিন্তু তাঁহার দোষের বর্ণনার অভাব নাই। যাহার অনেক দোষ, তাহার কোন গুণ আছে কি না, এ বিষয়ে সমালোচনার ফল আছে—যে এক চক্ষে দেখে সে অর্ধেক অন্ধ। এ প্রস্তাবের জন্য, যদি কেহ রাগ করেন, আমাদের আপত্তি নাই। কোন শ্রেণীর পাঠকের সন্তোষের কামনায় কোন প্রকার কথা এ পত্রে লিখিত হয় না; কোন শ্রেণীর পাঠকের অসন্তোষের আশঙ্কায় কোন কথা ব্যক্ত করিয়া বলিতে, এ পত্রের লেখকেরা সঙ্কুচিত নহেন। বর্তমান লেখক সর্ জর্জ কাম্বেল কর্তৃক কোন অংশে উপকৃত বা সর্ উইলিয়ম গ্রে কর্তৃক কোন অংশে অপকৃত নহেন ; যাহা লিখিত হইল, সত্যানুরোধেই লিখিত হইল। এদেশে অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাইতেছে ; ভ্রান্ত ভ্রান্তকে উপদেশ দিতেছে। যদি এই প্রবন্ধের সাহায্যে কেহ এ কথাটি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন, তাহা হইলেই এ প্রস্তাবের সার্থকতা হইল।
শ্রীভজরাম।—‘বঙ্গদর্শন’, জ্যৈষ্ঠ ১২৮১, পৃ. ৭৩-৮২।