৯
বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অদৃশ্য কিন্তু সন্ধানী অজস্র চোখ। তাকে স্পর্শ করার জন্য হাতড়ে বেড়াচ্ছে অদৃশ্য আঙুল। টের পাচ্ছে পাউচিই। রাত্রি নিশুত হওয়ার পর সে তার ঘর ছেড়ে ছাদে বেরিয়ে এল। উর্ধ্বমুখ হয়ে দেখল, আকাশ থেকে দিগন্ত, সর্বত্র ফুটে উঠেছে আলোর অজস্র নকশা। গোল, চৌকো, ত্রিভুজ, চাঁদের ফালির মতো। ওইসব চিহ্নকে সে গভীর ভাবে চেনে। এক জটিল অঙ্ক আস্তে-আস্তে তার অমোঘ সমাধানের দিকে এগিয়ে চলেছে। ধীরে-ধীরে উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে তার আড়াল। তার সংখ্যা ও সংকেত, তার প্রতীক ও পরিচয়ের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে লয়কারী অস্তিত্বের সংকট। সে, পাউচিই, আর কিছুই করতে পারে না। অপেক্ষা করা ছাড়া। গুপ্তিপাড়া থেকে বিদ্যাধরপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ লোকালয়ের বহু মানুষই এই অদ্ভুত দৃশ্যটা রাত জেগে দেখছে। সকলেই উধৰ্বমুখ, শঙ্কিত, বিস্মিত। তারা এর মানে বুঝতে পারছে না। কী হবে, তাও জানে না। এটা কোনও লেজার শো কিনা, তাও ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। যদি হয়ও, তা হলেও আকাশ জুড়ে তা হওয়ার কথা নয়। গোলোকবাবু তাঁর বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে রয়েছেন। শরীরের ভিতরে এক ভয়ের কাঁপুনি, উদ্বেগ। গলা শুকিয়ে কাঠ। অতিকায় সাহেব তাঁর আঙুল দিয়ে শূন্যে গোলোকবাবুর অঙ্কটা লিখে চলেছে। শূন্যে সাদা অক্ষরে ফুটে উঠছে অঙ্ক। গোলোকবাবু হাঁ করে দেখছেন। এ কি কোনও জাদুকরের খেলা ? এ কি ভৌতিক কিছু?
সাহেব আপনমনে তার ভাষায় কী যেন বলছে। গোলোকবাবু বুঝতে পারছেন। সাহেব বলছে, “কোথায় পালিয়ে থাকবে তুমি? অনেক ছুটিয়ে মেরেছ আমাদের। হয়রান করেছ। বিভ্রান্ত করেছ। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান নও। মেধার লড়াইয়ে তোমাকে হার মানতেই হবে, পাউচিই। সেন্সর তোমার স্পন্দন টের পাচ্ছে। তোমার গন্ধ পাচ্ছে। তোমার বিকিরণ ধরা পড়ছে। অতিমানব, এবার নত হও। হার স্বীকার করো এবং মর্যাদার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে নাও।”
অঙ্কটা ভেসে রইল শূন্যে। তারপর আচমকা অদৃশ্য হয়ে সেই জায়গায় একটা আলোর চৌখুপি দেখা দিল। যেন শূন্যে এটা মস্ত জানালা খুলে দিল কেউ। গোলোকবাবু বিস্ময়ে হা হয়ে দেখতে লাগলেন, সেই চৌখুপির ভিতর দিয়ে যেন দিনের আলোয় চরাচরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। জানালা যেন মাঠঘাট পার হয়ে ট্রেনের মতো দ্রুত দৌড়ে যাচ্ছে কোথায়। মুহুর্মুহু দৃশ্যপট পালটে যাচ্ছে। তারপর তার গতিবেগ ধীর হয়ে এল। হঠাৎ জানালায় তারাভরা আকাশের ছবি ফুটে উঠল।
সাহেব ভ্রুক কুঁচকে কাঁর দিকে চেয়ে বলল, “ভুল অঙ্ক!”
গোলোকবাবু চমকে উঠে বললেন, “ভুল! ভুল হবে কেন?”
সাহেব ধৈর্যহীন রাগে গর্জন করে ওঠে, “ভুল, ভুল, ভুল! সমাধান বদলে গিয়েছে। তুমি মূৰ্খ! বোকা! দায়িত্বজ্ঞানহীন।”
অপমানটা বড় অাঁতে লাগল গোলোকবাবুর। আর তাইতেই ভয়-ভয় ভাবটাও কেটে গেল। কান দুটো গরম। গোলোকবাবু বেশ ফুঁসে উঠেই বললেন, “আমি অঙ্ক সামান্যই জানি। কিন্তু যেটুকু জানি, তাতে ভুল করি না মশাই!”
সাহেব তাঁর দিকে ক্রুর চোখে চেয়ে বলল, “তুমি একজন শঠ, খল এবং মিথ্যেবাদী। তুমি আমাদের বিভ্রান্ত করেছ। ভুল পথে চালনা করেছ। একদম শেষ ধাপে এসে আমাদের সব পরিশ্রম ব্যর্থ হল। অথচ আমরা পাউচিইর খুব কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলাম। তার শ্বাসপ্রশ্বাসও শোনা যাচ্ছিল। মাত্র এক পরদা দূরে ছিল সেই অতিমানব। একটুর জন্য…”
‘পাউচিই কে?”
“জেনে কী করবে? জেনেও তোমার লাভ নেই। যে সীমাহীন মেধা তার মগজে রয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও ধারণ করার সাধ্য তোমার নেই। পাউচিই এক সম্রাট। মেধার রাজ্যের সম্রাট। আমরা তাকে স্থানচ্যুত করতে চাই, বুঝেছ?”
“আপনারা কারা?”
“আমরা? আমরাও মেধার কারবারি। আমাদের স্পন্দন আলাদা। আমাদের সংকেত আলাদা। পরিচয় আলাদা, তুমি কিছুই বুঝবে না।”
“আপনারা কোথাকার লোক?”
“আমাদের বিচরণক্ষেত্র বহু দূর ছড়ানো। সে এক অচিনপুর। তোমাদের মতো গ্রহবাসী নই আমরা।”
“আপনি এখন কী করতে চান?”
সাহেব ভ্রুকুটি করে বলে, “আমি খুব হতাশ। আমি বিরক্ত। আমি অবসাদ বোধ করছি। পাউচিইকে সম্পূর্ণ লয় করে দেওয়ার এমন এক সুবর্ণ সুযোগ আর আসবে না। তোমাদের এই সুন্দর আর নিরীহ জনপদটি ধ্বংস করার কোনও ইচ্ছেই ছিল না আমাদের। কিন্তু তুমি আমাদের সাহায্য করলে না। তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। ভুল অঙ্ক কষে আড়াল করেছ পাউচিইকে। তার ফল তোমাদের এই জনপদকেই ভোগ করতে হবে।”
গোলোকবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “কী হবে সাহেব?”
“বাতাস প্ররোচিত হবে, তারপর উত্তেজিত, তারপর উন্মাদ বাতাস বইবে হাজার মাইল গতিতে। তার ঘূর্ণাবেগে এই গর্ভগৃহে সব কিছুই বিলুপ্ত হওয়ার পর পাউচিই একা দাঁড়িয়ে থাকবে। এই পরিণতি দরকার ছিল না, যদি তুমি অঙ্কটায় ভুল না করতে।”
“আমি ভুল করিনি।”
“করেছ, এবং ইচ্ছে করেই করেছ।”
“না সাহেব, আমি শুধু তোমার হুকুম পালন করেছি। বিশ্বাস করো, আমি পাউচিইকে আড়াল করার চেষ্টা করিনি। আমাকে একটা বন্দুক লও, আমি নিজে পাউচিইকে খুন করব, যাতে আমাদের গ্রাম দুটো বাঁচে।”
“তুমি পাউচিইকে খুন করবে? তাও বন্দুক দিয়ে?”
“করব। সে তো আর অমর নয়।”
সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাঁর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বলল, “না, সে অমর নয়। আমরা কেউই নই। তবে বেঁচে থাকার নানা মাত্রা আছে। স্তরবিন্যাস আছে। বন্দুক আমাদের অস্ত্র নয়। দ্বিতীয় কথা, পাউচিই যে কে, তা তুমি বুঝবে কী করে? তার পরিচয় যে জটিল সংকেতের মধ্যে ডুবে আছে, তুমি তা ভেদ করতে পারনি।”
“বাতাস সংবরণ করো সাহেব। আমি তাকে খুঁজে বের করবই। শুধু একটা বন্দুক দাও আমাকে।”
“নির্বোধ! হীন মেধার মানুষই পশুশক্তির উপর নির্ভর করে। গায়ের জার বা আগ্নেয়াস্ত্র কোনও শক্তিই নয়। ক্ষুরধার মেধার কাছে তারা শিশুর খেলনা মাত্র।”
“আমরা মরতে চাই না সাহেব।”
“কেউই চায় না। নিজের মৃত্যুকে তুমিই অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছ। কৃতকর্মের ফল নতমস্তকে গ্রহণ করাই নিয়ম।”
সাহেব আস্তে-আস্তে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে দেখে আতঙ্কে গোলোকবাবু আর থাকতে না পেরে লাফিয়ে গিয়ে সাহেবের হাত চেপে ধরলেন। কিন্তু তার হাত খানিকটা শূন্যকে খামচে ফিরে এল। “সাহেব, সাহেব, ” বলে চিৎকার করতে লালেন গোলোকবাবু। আর ঠিক এই সময়েই তিনি বাতাসের মধ্যে একটা ফিসফাস শুনতে পেলেন। খুব মৃদু চাপা স্বরের মতো। শিস দেওয়ার মতো কী যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে। এটাই কি প্ররোচনা? কেউ কি বাতাসের কানে-কানে কিছু বলছে? মন্ত্র? নাকি অঙ্ক? বাতাসে শিস দেওয়ার শব্দটা ধীরে-ধীরে চৌদুনে উঠছে। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তার সামনে শূন্যে দ্রুত ফুটে উঠছে দুর্বোধ্য সব অঙ্কের সংকেত চিহ্ন। গোলোকবাবু হাত বাড়িয়ে অঙ্কগুলোকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন পাগলের মতো। কিন্তু কিছুই হল না। অঙ্কগুলো আস্তে-আস্তে শূন্যে উঠে যেতে লাগল। বাতাসে প্রথম ঢেউটা এল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। একটা ঢেউ কেটে গেলে আর-একটা তীব্রতর ঢেউ গোলোকবাবুকে ঠেলে ফেলে দিল শানের উপর। গোলোকবিহারী কোনওক্রমে উঠে দাঁড়ালেন এবং শুনতে পেলেন হাজারটা জেট প্লেন হঠাৎ ওই দুরের ঝিল পেরিয়ে যে জঙ্গল, সেখান থেকে গর্জন করে উঠল। সেই শব্দেই যেন ক্ষিপ্ত বাতাস আ-আ-আ করে এক অবিশ্বাস্য আর্তনাদে ধুলোটে খ্যাপা মারমুখো পাগলের মতো দিগন্ত ঢেকে ফেলল ধুলোর পরদায়। গোলোকবাবু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখলেন, যা তিনি দেখবেন বলে কখনও কল্পনাও করেননি। একটা ঝড় জঙ্গলের সব গাছ উপড়ে ঝিলের জলে জলস্তম্ভ তৈরি করে মারমার করে ছুটে আসছে। এক মহামন্থনে সব কিছু মিশিয়ে দেবে। শঙ্খ বাজল নাকি? সেই সঙ্গে এই সর্বনাশা সময় কে মাটির বেহালা বাজিয়ে যাচ্ছে। আর কালিমাখা কালো অন্ধকার কোথা থেকে উঠে এসে মুছে দিচ্ছে শূন্যের অঙ্কগুলোকে। বাতাসে কালান্তক ঢেউ উঠছিল, গোলোকবাবু তাতে বারবার ঝাপটা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। এ কি তাঁর অপরাধ? এইসব একমাত্র তাঁর অপরাধে তা হলে মৃত্যুই তাঁর পক্ষে শ্রেয়।
মাটির বেহালাটা এই অসময়ে কোন পাগল বাজিয়ে চলেছে? এ সময়ে কেউ বেহালা বাজায়? শাঁখই বা বাজায় কে? আর ওই আলকাতরার মতো অন্ধকারই বা কোথা থেকে উঠে আসছে?
খানিক ওলটপালট খেয়ে গোলোকবিহারী একসময়ে উঠে দাঁড়ালেন। আশ্চর্য! ওই কালান্তক ঝড়টা এখনও বিল পেরিয়ে বিশাল জলস্তম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গজরাচ্ছে। কিন্তু এগোচ্ছে না। একটা জায়গাতেই থমকে গিয়েছে। যেন কেউ ‘তিষ্ঠ’ বলে ঝড়কে সামলে রেখেছে। গোলোকবিহারী আতঙ্কিত চোখে হাঁ করে চেয়ে রইলেন। আস্তেআস্তে ঝড়টার রোষ কমে যাচ্ছে। ঝিমিয়ে পড়ছে। জলস্তম্ভ ভেঙে ঝিলের জল ফের ঝিলে ফিরে যেতে লাগল। জেট প্লেনের শব্দ ধীরেধীরে নেমে মিলিয়ে গেল। পিছন থেকে কে যেন বলল, “অঙ্কটা ভুল করেছিলেন বটে কর্তা। কিন্তু কাজটা ভুল করেননি।”
“কে?”
গোলোকবাবু অবাক হয়ে ফিরে দেখেন, ছাদের আধা অন্ধকারে ঝোলা কাঁধে একটা লোক দাঁড়িয়ে।
“কে হে তুমি?”
“সেই যে পুরনো জিনিসপত্র কিনতে এসেছিলুম!”
“ওঃ! কী বললে? আমার অঙ্কে ভুল হয়েছিল? তুমি অঙ্কের কী জানো হে ?”
“অঙ্কের জানি লবডঙ্কা। আমাদের কাছে অঙ্কের চেয়ে একটা কাঁচালঙ্কার কদর অনেক বেশি। পান্তাভাত চটকে খেতে যেন অমৃত।”
চিন্তিতমুখে গোলোকবাবু বললেন, “অঙ্কটা মোটেই ভুল হয়নি। সাহেব আবার এলে বুঝিয়ে দেব।”
“সাহেব আর আসবে না কর্তা।”
“আসবে না? কী করে জানলে?”
“সাহেব হেরে গিয়েছে। আর হেরে গেলে ওরা নেই হয়ে যায়। আপনার বড্ড ধকল গিয়েছে কর্তা। রাতও আর বেশি নেই। গিয়ে একটু গড়িয়ে নিন।”
গোলোকবাবু বড়ই আলাভোলা মানুষ। ছাদের উপর মাঝরাতে একটা উটকো লোক কী করে এল, এ প্রশ্নটা তাঁর মাথাতেই এল না। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তাই যাচ্ছি।”
নিশুত রাত যখন ভোরের দিকে একটু ঢলে পড়েছে, তখন গুপ্তিপাড়া ছেড়ে দক্ষিণের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল তিনজন মানুষ।
সামনের জন রোগামতো বুড়োমানুষ। তার কাঁধে ঝোলা। পরের জন মাঝবয়সি। তার এককাঁধে মিশমিশে কালো বিড়াল। অন্য কাঁধে একটা কাক। শেষের জন পাঁচু। কারও মুখে কোনও কথা নেই। নীরবে তারা খানিকদূর হাঁটল। তারপর ডানদিকের একটা মেটে রাস্তা ধরে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। অন্ধকার। জোনাকি জ্বলছে।
সামনের জন এক জায়গায় থমকে নেমে গিয়ে শুধু বলল, “এখানে।”
সামনে বাতাসের মধ্যেই যেন একটা অদৃশ্য দরজা খুলে গেল তাদের জন্য। একে-একে তারা সেই অদৃশ্য দরজার ভিতরে মিলিয়ে গেল।
(সমাপ্ত)