সর্বনেশে ভুল অঙ্ক – ৮

“তুমি কী যে সুন্দর বেহালা বাজাও বাবা! মাটির বেহালায় যে এত সুর আছে তাই তো জানতুম না! এত সুন্দর সুর তুমি কোথায় পেলে?”

“আমি পায়ে হাঁটা মানুষ মা। ঘুরে-ঘুরে বেড়াই। বাশবনে বাতাস বয়, নদীর জলে ঢেউ ভাঙে, পাখি ডাকে, মন্দিরে শাখ বাজে, আরতির ঘণ্টাধ্বনি হয়, মোয়াজ্জিনের আযান শোনা যায় এই সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে আমার সুর হয় মা।”

“তোমার বাড়ি কোথায়?”

“সে অনেক দূর অজান দেশ।”

“অত দূর থেকে মাটির বেহালা ফিরি করতে এসেছ! কটা পয়সাই বা হয় তোমার ?”

“পয়সা। না মা, পয়সা আর কোথায় হয়। তবে এই যে তোমার ভাল লাগল, এটাই আমার রোজগার।”

“কতটুকু খেলে তুমি? আর দু’টি ভাত নিয়ে আসি?”

“নামা, পেটপুরে খেয়েছি।”

ঘটি তুলে রোগা বুড়োটা অনেকটা জল খেল। ভেজা করুণ চোখে দৃশ্যটা দেখল মাধবী। ঘুরে-ঘুরে অনেকক্ষণ ধরে মাটির বেহালা বাজিয়ে ক্লান্ত হয়ে তাদের বাড়ির সুমুখেই হাছে ঠেস দিয়ে ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল লোকটা। বড় মায়া হয়েছিল মাধবীর। আহা রে, বোধ হয় খিদে পেটেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ডেকে দু’টি ভাত খাওয়ার কথা বলতে গিয়েছিল মাধবী। গিয়ে দেখে, কী আশ্চর্য দৃশ্য, ঘুমন্ত লোকটার গায়ে উড়ে-উড়ে বসছে কয়েকটা প্রজাপতি। মাথার উপরে গুনগুন শব্দ করে ঘুরপাক খাচ্ছে মৌমাছি। কোলের উপর এসে ঝটাপটি করছে চড়ুইপাখি। ভাত খাওয়ার কথা বলতে একগাল হেসে রাজি। তারপর দাওয়ায় বসে কলাপাতায় বেড়ে দেওয়া ডালভাত আর একটু ব্যঞ্জন কত যত্ন করে খেল!

“আমাকে তোমার বাজনা শিখিয়ে দেবে বুড়ো বাবা?”

“বেহালা সুরে বাধা আছে মা, ছড়টায় একটু টান দাও।”

“আমি কি পারব?”

“টেনেই দ্যাখো।”

মাধবী খুব লজ্জায়-লজ্জায় মাটির বেহালাটা হাতে নিয়ে ধনুকের মতো কঞ্চির ছড়টা একটু টান দিল। ও মা! কী সুন্দর একটা সুরেলা শব্দ বেরিয়ে এল।

“বাঃ, বডড ভাল তো!”

“রেখে দাও মা, ইচ্ছে হলেই বাজাবে, আর যখন ঝড়টা উঠবে, তখন ছড় টেনে দেখো বেহালা থেকে শাখের আওয়াজ বেরিয়ে আসবে।”

“ও মা! তাই! কিন্তু ঝড় হবে কেন?”

“ঝড়-তুফান কি হয় না মা?”

“তা হয় বটে।”

“শঙ্খধ্বনি ভগবান শুনতে পান।”

“একটু বোসো বুড়োবাবা, বেহালাটার দাম এনে দিচ্ছি।”

বুড়োটা ঘাড় নাড়ল। কিন্তু পয়সা নিয়ে এসে মাধবী আর বুড়োটাকে কোথাও দেখতে পেল না। মনটা খারাপ হয়ে গেল মাধবীর। বোধ হয় ভাত খেয়েছে বলেই লজ্জায় আর দামটা নিতে পারেনি।

অনেক উপর থেকে কাকটা তীক্ষ চোখে নীচের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিল। রোদে ভরা সবুজ মাঠ, জঙ্গল, পুকুর, বাড়িঘর। অনেকটা উড়ে সে আবার চক্রাকারে ঘুরে বারবার গোটা জায়গাটার তল্লাশ নিচ্ছে। পোকামাকড়, ইঁদুর বা শস্যের দানা নয়। অন্য কিছু। সে ঘুরছে আর ঘুরছে। রোদের আলোয় কারও চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু সে দেখতে পেল দক্ষিণের দিক থেকে প্রায় অদৃশ্য সাদা নকশাগুলো ভেসে আসছে। চৌকোনো, ত্রিভুজ, চন্দ্রবিন্দু, ষড়ভুজ। একটা চাপা ক্রুদ্ধ “ক্কা’ ডাক ছেড়ে সে তিরের মতো উড়ে গেল নকশাগুলোর দিকে। তারপর ডানার ঝাপটায় তীক্ষ ঠোঁটে, নখের অাঁচড়ে ভেঙে টুকরো করে দিতে লাগল সব কিছু। ওলটপালট খেয়ে নানা বিভঙ্গে উড়তে-উড়তে সে ভেঙে লন্ডভন্ড করে দিতে-দিতে মাঝে-মাঝে উল্লাসে চিৎকার করে উঠছে, ‘কা! কা!’

টেবিলের উপর সমাধিত অঙ্কটার দিকে ধ্যানস্থ চোখে চেয়ে বসেছিলেন গোলোকবাবু। অঙ্কটা কি ঠিক হল? তিনি বুঝতে পারছেন না। একটা অচেনা গলার স্বর কয়েকদিন আগে তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। কেন করেছিল তিনি জানেন না। শুধু জানেন, অঙ্কটা ভুল পদ্ধতিতে করলে একটা ভয়ঙ্কর বিপদ হবে। তিনি তাই বারবার অঙ্কটার প্রতিটি ধাপ ফের অতিপাতি করে দেখলেন। মনে হল, তিনি ভুল করেননি। অঙ্কটা তার নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌছেছে। তিনি আর কী করতে পারেন? একজন অঙ্কবিদের সাধ্য আর কতটুকু। জাগতিক সব ঘটনার রাশ তো তার হাতে নেই! টেবিলের ওপাশে খোলা জানালা। তার পাল্লার উপর একটা কাক এসে বসেছে। ঘাড় নামিয়ে খুব তীক্ষ চোখে দেখছে তাকে। চোখে চোখ পড়তে বলল, “কা! উলটো দিকের বাড়ির কার্নিসে সন্তৰ্পণে হাঁটছে একটা কালো মিশমিশে বিড়াল। ফসফরাসের মতো চোখে সে হঠাৎ তাকাল গোলোকবাবুর দিকে। বাইরের দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার একটা শব্দ পেলেন তিনি।

“কে?”

“বাবু, পুরনো জিনিসপত্র বিক্রি আছে কি?”

“না হে বাপু।”

“ভাঙা বাসন, অচল ঘড়ি, বাতিল চশমা, পুরনো বই, খারাপ রেডিয়ো, ছেঁড়া জুতো কিছু নেই বাবু?”

“কিছুই নেই হে বাপু। বিরক্ত কোরো না। আমি এখন ব্যস্ত রয়েছি।”

“খালি শিশি বোতল, জং ধরা সাইকেল, ভুল অঙ্ক, কিছু নেই বাবু?”

গোলোকবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “না হে বাপু, কিছু নেই। এবার দয়া করে কেটে পড়ো, ” বলেই গোলোকবাবু থমকালেন। শেষ কথাটা কী বলল লোকটা? ভুল অঙ্ক না! গোলোকবাবু এক ধাক্কায় চেয়ারটা ছিটকে ফেলে লাফিয়ে উঠলেন।

তারপর দৌড়ে গিযে দরজাটা দড়াম করে খুলে চেঁচিযে উঠলেন, “কে, কে হে তুমি বেয়াদপ?”

দরজার বাইরে যে লোকটা দাড়িয়ে আছে তার পরনে ময়লা ধুতি তাও আবার হাঁটু ছাড়ায়নি, গায়ে একটা কোঁচকানো জামা, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, রুখু চুল। ভিজে বিড়ালের মতো নিরীহ চেহারা। তবে চোখ দুটোয় বোধ হয় ধূর্মামি রয়েছে।

গোলোকবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, “এইমাত্র কী বললে যেন তুমি? ভুল অঙ্ক? আমি অঙ্কে ভুল করি? অ্যা!”

লোকটা আকাশ থেকে পড়ে বলল, “তাই কি বললুম নাকি কর্তা?”

“আলবাত বলেছ!”

লোকটা মাথা-টাথা চুলকে লজ্জায় মরে গিয়ে বলল, “ইস ছিছি, একটা ভুল কথাই বলে ফেলেছি বোধ হয়। মুখ্যু মানুষদের ওইটাই তো দোষ। কী কথা কইতে কী কয়ে ফেলে। কথাটা ধরবেন না কর্তা। এবারকার মতো মাপ করে দিন।”

“ওহে বাপু, ও সব চালাকি করে লাভ নেই। তুমি আমার কাজ ভন্ডুল করে দেওয়ার মতলবে এসেছ। এ আমি বেশ বুঝতে পারছি। এই দিনতিনেক আগে কে যেন আড়াল থেকে ভুলভাল পরামর্শ দিয়ে মাথা গুলিয়ে দিচ্ছিল। এখন বুঝতে পারছি, সে তবে তুমিই।”

লোকটা হাঁ করে চেয়ে থেকে তারপর কপাত করে একদলা বাতাস গিলে ফেলে বলল, “আমি। কর্তা কইছেন কী? গুপ্তিপাড়ায় যে বাপের জন্মে আসিনি। আজই প্রথম।”

“শোনো বাপু, মিছেকথাগুলো আর বোলো না। আমার অঙ্ক যদি ভুলই হয়ে থাকে, তা হলে অঙ্কটা তুমি কষে দেখাও না!”

লোকটা ভারী কাচুমাচু হয়ে বলল, “আমি? কর্তা কি গেরিবের সঙ্গে মশকরা করতে লাগলেন? পেটে ডুবুরি নামালেও যে অঙ্কের অাঁশটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের অঙ্কের বিদ্যে হাতের কর গুনতেই শেষ।”

“ওসব আমি শুনছি না। আমার কষা অঙ্ককে যখন ভুল বলেছ, তখন তোমার ছাড় নেই। এসো, অঙ্কে কোথায় ভুল আছে, বের করো দেখি খুঁজে।”

লোকটা কাঁদো-কাঁদো হয়ে টালুমালু করে চারদিকে চাইছিল। বোধ হয় পালানোর ফিকির। ঠিক এই সময় গোলোকবাবুর স্ত্রী ঘুমচোখে উঠে এসে বললেন, “ও পুরনো জিনিসওয়ালা, ভাঙা বাসন, শিশি-বোতল কিনবে?”

“কিনতেই আসা, মা।”

“তবে ভিতরের বারান্দায় এসো বাছা। অনেক জমে আছে।”

ব্যাপারটা গোলোকবাবুর মোটেই মনঃপূত হল না। কিন্তু একটু মৃদু গাইগুই করা ছাড়া আর কিছু করারও নেই তাঁর। স্ত্রীকে রীতিমতো সমঝে চলেন গোলোকবাবু। কারণ, তিনি ভুলো মনের মানুষ। স্ত্রীর বুদ্ধি-বিবেচনার উপর নির্ভর করেই তাঁকে চলতে হয়। তাই নিজে চেয়ারখানায় বসে একা-একা ফুঁসতে লাগলেন তিনি। অঙ্কটা বারকয়েক তুলে পরীক্ষা করলেন। কিছু ভুল হয়েছে বলে তার মনে হল না। বেশ কিছুক্ষণ পরে লোকটা ব্যাগবোঝাই করে বিস্তর বাসন আর শিশি-বোতল কিনে গোলোকবাবুর সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভারী ভালমানুষের মতো ঘাড় নুইয়ে হাত জোড় করে একটা নমস্কার করে বলল, “আজ্ঞে, আজ তা হলে আসি কর্তা।”

গোলোকবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “আসবে মানে? এলেই হল? খুব যে ভুল অঙ্ক বলে আওয়াজ দিলে! এবার করে দেখাও দেখি কোথায় ভুল! এই যে দ্যাখো, ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে ভুল ধরো তো বাপু!”

গোলোকবাবু অঙ্ককষা কাগজখানা লোকটার নাকের ডগায় নাচিয়ে বললেন, “কই হে কোথায় ভুল? বাক্যি যে হরে গেল!”

লোকটা একগাল হেসে বলল, “এই হিজিবিজি অঙ্ক আমাদের কাছে সোজা করে ধরলেও যা, উলটো করে ধরলেও তা। তবে কিনা কর্তা, কত বড়-বড় মানুষেরও ছোটখাট ভুলভাল কত সময়ে হয়ে যায়। আমাদের সাপুইতলার হরপণ্ডিত একবার গদাধর লিখতে গাধাধর লিখে ফেলেছিলেন। ফটিকবাবুর কথাই ধরুন না কেন, ক্লাসে রোলকল করতে গিয়ে ফর্টি এইট, ফর্টি নাইনের পর কোন আক্কেলে ফর্টি টেন বলে বললেন বলুন তো কর্তা? রসময়বাবুর কথা শুনবেন? উনপঞ্চাশের সঙ্গে তেরো যোগ করতে গিয়ে তিনবার ভুল করলেন।”

গোলোকবাবু ধমকে উঠে বললেন, “তুমি কি বলতে চাইছ, এই অঙ্কটাতেও ভুল আছে?”

লোকটা খুব নিরীক্ষণ করে বলে, “না কর্তা, এ তো বেশ গোছানো জিনিস বলেই মনে হচ্ছে। উপরদিকটা সরু মতো, তারপর দিব্যি চওড়া হয়ে আবার সরু হয়ে নেমেছে। না কর্তা, অঙ্কটা তো বেশ ভালই দেখাচ্ছে। কোথাও কাটাকুটিও নেই।” বলে লোকটা কাগজটা হাতে নিয়ে ভারী খুশি হয়ে বলে, “না, কাগজটা ভারী ভাল। মোলায়েম কাগজ।”

গোলোকবাবু ভ্রুকুটি করে লোকটিকে দেখছিলেন, “বাপু হে, অঙ্কের তুমি কিছু জানো?”

“তা আর জানি না! হাড়ে-হাড়ে জানি। অঙ্ক বেজায় কঠিন জিনিস।” গোলোকবাবু খপ করে লোকটির হাত থেকে কাগজটা টেনে নিয়ে বললেন, “তা হলে ভবিষ্যতে আর অঙ্ক নিয়ে ফুট কাটতে এসো না বুঝলে?”

লোকটা গদগদ হয়ে “যে আজ্ঞে, ” বলে জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে খুব ভক্তিভরে গোলোকবাবুকে নমস্কার করে চলে গেল। গোলোকবাবু ফের অঙ্কটা ভাল করে দেখতে লাগলেন। দেখতে-দেখতে তাঁর হঠাৎ মনে হল, অঙ্কটা কি একটু বদলে গিয়েছে কোথাও? যেভাবে কষেছিলেন, ঠিক সেরকম যেন মনে হচ্ছে না। কোথাও কি ক্যালকুলেশনে কোনও ধাপে একটা কিছু বাদ রয়ে যাচ্ছে? জটিল অঙ্কের ক্ষেত্রে ছোটখাটো বিচ্যুতি হয়ে যেতেই পারে। তিনি আবার অঙ্কটা নতুন একটা কাগজে কষতে বসে গেলেন। আর বাহ্যজ্ঞান রইল না।

রাঘববাবু ফুটবলের পোকা। নিজে একসময় বড় ক্লাবে খেলেছেন। আর পেলে-গ্যারিঞ্চ থেকে হালফিলের সব খেলুড়েদেরই খেলা দেখেছেন। কিন্তু গদাধর লিগের ফিরতি ম্যাচে বিদ্যাধরপুরের সঙ্গে গুপ্তিপাড়ার খেলা দেখতে বসে তিনি যা দেখেছিলেন, তা তাঁর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। আর সেটা হল, গুপ্তিপাড়ার লিকলিকে রোগা পাঁচুর খেলা। ফুটবল খেলোয়াড়দের কয়েকটা জাত আছে। কারও খেলায় হিংস্র আগ্রাসন থাকে। কারও খেলায় থাকে চটুল শিল্পকর্ম, কারও খেলায় থাকে উজ্জ্বল উল্লাস। পাঁচুকে কোনওটাতেই ধরা যাচ্ছে না। ডান ও বাঁ, তার দুটো পায়েই বল বারবার এসে চুম্বকের টানে আটকে যাচ্ছে আর সে যেন কখনও দুর্মর আলস্যে, কখনও ছুটির মেজাজে ইচ্ছেমতো ঘুরছে-ফিরছে। শুনেছিলেন, পাঁচু ভীষণ জোরে দৌড়য়। সেটা ঠিক। কিন্তু দাঁত-মুখ খিচিয়ে দমবন্ধ করে দৌড় নয়। ওর দৌড় ঢেউয়ের মতো। নর্তকের মতো। হরিণের মতো। ছেলেটার খেলা কি বিষাদে জড়ানো? ঠিক বুঝতে পারলেন না রাঘব। কিন্তু তাঁর কেমন যেন মনে হচ্ছিল, দু’টি পা অসম্ভব ভাল খেলছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে কোনও লক্ষ্যের অভিমুখ নেই। বারবার প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে বিদ্যাধরপুরের গোলের মুখে পৌছে যাচ্ছিল সে। কিন্তু গোলে শট নিচ্ছে না। একে-ওকে-তাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বল, আর তারা ধ্যাড়াচ্ছে। হাফ টাইমের আগেই অন্তত পাঁচ-ছটা গোল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যেন গোলে মারতে বড়ই অনিচ্ছুক ছেলেটা। দলের খেলোয়াড়দের বলে দেওয়া ছিল মেরে খেলতে। পাঁচুকে মাঠের বাইরে না পাঠাতে পারলে বিদ্যাধরপুরের জেতার আশা নেই। ছেলেরা উপদেশ অক্ষরে-অক্ষরে মেনেছে। কত বার পাঁচুকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া হল, তার হিসেব নেই। রোগা ছেলেটা প্রতিবার ল্যাং খেয়ে পড়ে যায়, তারপর উঠে একটু খোঁড়ায়। তারপর আবার ঠিক আগের মতোই তার ভূতুড়ে খেলা খেলে যেতে থাকে। ল্যাং খেয়ে উঠে কাউকে ল্যাং মারে না। ভাল কিছু দেখলেই রাঘববাবুর আবেগে চোখে জল আসে। আজও এল। তাঁর মনে হল, ছেলেটা ফুটবল খেলছে না। দুটো পায়ে যেন কবিতা লিখে যাচ্ছে। খেলা শেষের একটু আগে গুপ্তিপাড়া একটা গোল দিল দয়া করে। দশ গোল দিতে পারত। তাঁদের আগের অবস্থা থাকলে রাঘববাবু আজ পাঁচুকে সোনার মেডেল দিতেন। খেলা শেষে প্লেয়াররা যখন মাঠের বাইরে বেরিয়ে আসছে, তখনই গন্ডগোলটা লাগল। চার-পাঁচটা ছেলে দৌড়ে গিয়ে পাঁচুকে ঘিরে ফেলল। ধাক্কা দিতে-দিতে মাঠের অন্য প্রান্তে ঝিলটার দিকে নিয়ে যেতে লাগল। বেধড়ক চড়-থাপ্পড় মেরেছিল তারা। এ কী অন্যায়। রাঘবের রক্ত গরম হয়ে গেল। একটা বজ্ৰগম্ভীর হকি ছাড়লেন, “খবরদার!” তারপর দৌড়ে গিয়ে ছেলেগুলোকে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে পাঁচুকে আড়াল করে দাঁড়ালেন।

“এটা কী হচ্ছে?”

ছেলেগুলো রুখে উঠে বলল, “ও হিপনোটিজম জানে, রাঘববাবু ও আসার পর গুপ্তিপাড়ায় অনেক ভূতুড়ে ঘটনাও ঘটেছে। সকলে বলে, সনাতন সিদ্ধাই ওর মধ্যে ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছে।”

আর-একটা ছেলে বলল, “অত লিকলিকে রোগা হয়েও এই মস্ত একটা গাছের গুড়ি দুহাতে তুলে দশ ফুট দূরে নিয়ে ফেলেছিল। মানুষ হলে পারত?”

ভয়ে চুপসে গিয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাঁচু। মুখচোখ সাদা, শরীর থরথর করে কাঁপছে।

রাঘববাবু বজ্ৰগম্ভীর গলায় বললেন, “আমি ওসব গালগল্পে বিশ্বাস করি না। আমি ফুটবল খেলাটা বুঝি। পাঁচু একজন ভীষণ ভাল প্লেয়ার। তোমাদের লজ্জা থাকলে ওর গায়ে হাত তুলো না, বরং পিঠ চাপড়ে দাও। গুণীকে সম্মান জানানোই মহৎ কাজ।”

ছেলেগুলো জানে, মরা হাতি লাখ টাকা। রাঘবের সেই প্রতাপ নেই বটে, কিন্তু তেজটা আছে। তাই তারা পিছু হটল। রাঘব পাঁচুর দিকে ফিরে বলল, “কিছু মনে কোরো না বাবা। তুমি বড্ড গুণী ছেলে। একদিন খুব নাম হবে তোমার।”

পাঁচু ম্লান একটু হাসল। রাঘববাবু লক্ষ করলেন, ছেলেটার চোখের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় আর গভীর বিষাদ। কপালে হাত ঠেকিয়ে বোধ হয় কৃতজ্ঞতাই জানাল তাঁকে পাঁচু। তারপর দৌড়ে গিয়ে নিজের দলের সঙ্গে মিশে গেল।

সকালবেলাতেই দুলালখ্যাপা এসে হাজির। “বুঝলেন রাঘববাবু, কাল গণনা করে দেখেছিলাম, বিদ্যাধরপুর ম্যাচটা দশ গোলে হারবে। সকাল থেকেই যোগে বসে গিয়েছিলাম।”

“তাতে কী হল?”

“বাণ মেরে দশটা গোল আটকে তো দিয়েছি।”

“তারপরে কি বাণ ফুরিয়ে গিয়েছিল?”

“আজ্ঞে না। বাণটা মারতে যাব, এমন সময় একটা ডাঁশ এসে বগলে এমন কামড় বসাল যে, বাণ ফসকে গেল।”