৭
দুপুরবেলায় মাটির বেহালা বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল রোগা, ছন্নছাড়া একজন ফেরিওয়ালা। বড় মাদক সুর, যেন সম্মোহন ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে। ঝিমধরা দুপুরে যেন এক রূপকথার কুহক বয়ে আনল লোকটা। লোকে কাজ ফেলে শুনছে, আনমনা হয়ে যাচ্ছে। কোনও চেনা-চটুল গান নয়, সুরে যেন এক বহুদূরের ডাক। বেহালার সুর শুনতে পেল কালো একটা বিড়াল। জঙ্গলের গভীরে হঠাৎ সে তার ফসফরাস দু’টি চোখ মেলে তাকাল, যেন সে তার সংকেতধ্বনি শুনতে পেয়েছে। তার ডাক এসেছে। সে উঠে দাঁড়াল। এবার তাকে যেতে হবে। সময় হয়েছে। কিন্তু তার সামনেই একটা বাধা। মস্ত একটা কেউটে সাপ ফণা তুলে পথ আটকে দাঁড়াল। দু’টি পুতির মতো চোখ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জানতে চেষ্টা করছে, বন্ধু না শক্র। সরু জিভ বারবার লেহন করছে বাতাসে। সঙ্গে ক্রুদ্ধ শ্বাস। বিড়ালটাও তার ফসফরাস চোখে স্থির হয়ে দেখল সাপটকে। তারপর সামনে এক পা বাড়াল। আমনি বিদ্যুতের মতো ছোবল মারল সাপটা। বাড়ানো পা-টা তুলে বিড়াল চতুর থাবায় হঠাৎ উলটে দিল সাপটকে। তারপর চিত হয়ে যাওয়া সাপটার গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে সাপের মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর আচমকা থাবাটা সরিয়ে নিয়ে সতর্ক চোখে চেয়ে রইল। ছাড়া পেয়ে সাপটা প্রাণভয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে হিলহিল করে পালিয়ে গেল। গাছের উপর থেকে একটা কাক হঠাৎ ডেকে উঠল, কা। বিড়ালটা একবার উপরের দিকে তাকাল। তারপর তার নরম, শব্দহীন পায়ে দ্রুত জঙ্গলটা পেরিয়ে গেল। একটা পুকুরধার ঘেঁষে দ্রুত পায়ে পুকুর ছাড়িয়ে লোকালয়ে ঢুকতেই তেড়ে এল একপাল নেড়ি কুকুর। ঘাউ-ঘাউ-ঘাউ। বিড়ালটা কুকুরদের দিকে হঠাৎ ফিরে তার তীব্র চোখে চেয়ে হঠাৎ শরীরটা ফুলিয়ে ফ্যাঁস করে একটা রাগের আওয়াজ করল। নেড়ি কুকুরেরা স্বভাবতই কাপুরুষ। কেউ রুখে দাঁড়ালে তারা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। আরও কয়েকবার ঘেউঘেউ করে তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে ল্যাংল্যাং করে পাততাড়ি গোটাল। গাছের উপর থেকে কাকটা ডেকে উঠল, কা।
যেন কোথায় যেতে হবে, তা সে জানে এমনভাবেই বিড়ালটা জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ের ভিতর ছুটতে লাগল। মাটির বেহালার সুরে ডাক এসে গিয়েছে। আর সময় নেই। রোদে ভরা একটা সবুজ মাঠ পেরচ্ছিল সে। নীচে ছায়া ফেলে মাথার উপর দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে উড়ে চলেছে কাকটাও।
আজ মাটির বেহালার শব্দে নাজেহাল হচ্ছেন গোলোকবাবু। কে যে বাজাচ্ছে, কে জানে! কিন্তু অঙ্ক কষতে-কষতে বারবার উতলা হয়ে যাচ্ছেন। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে চিন্তার সূত্র। একবার ভাবলেন, বেহালাওয়ালাকে ডেকে কিছু পয়সা দিয়ে বাজনা বন্ধ করতে বলবেন, কিন্তু বাজনাটা বড় ভালও লাগছে তাঁর। বুকজড়ানো একটা সুর। অনেক পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে যেন!
কাজে মন দিতে পারছেন না গোলোকবাবু। অথচ হাতে তাঁর গুরুতর কাজ। সামনে সেই বিটকেল বইটার একটা পাতা খোলা। দুটো পাতাতেই একই অঙ্ক। অথচ দুটোর ফল আলাদা। অঙ্ক দুটো দু’ভাবে করা হয়েছে। দুটো পদ্ধতিই নির্ভুল। অথচ তিনি নিজে আলাদা ভাবে কষে দেখেছেন, ফল আলাদা হচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব?
কে যেন বলে উঠল, “সম্ভব।”
কে বলল, তা খেয়াল করলেন না গোলোকবাবু। তিনি সর্বদাই একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন, “কীভাবে?”
“মুক্ত অঙ্কে সেটা সম্ভব।”
“মুক্ত অঙ্ক! সেটা আবার কী জিনিস?”
“মানুষ সীমাবদ্ধ মগজওয়ালা জীব। তাদের কাছে সংখ্যা একটা সীমাবদ্ধ ধারণা। কিন্তু সংখ্যা যখন তার সীমাকে অতিক্রম করে, তখন মানুষ তা ধারণা করতে পারে না।”
“কথাটা বোঝা যাচ্ছে না।”
“অসীমকে তুমি ধারণা করতে পার কি?”
“না, সেটা সম্ভব নয়।”
“ইনফিনিটির ভিতরেও অঙ্কের প্রবাহ বয়ে চলেছে। সেখানে সংখ্যাও মুক্ত, ভেরিয়েবল।”
“আরও নির্দিষ্ট করে বলুন।”
“একটা গাছে বারোটা গোলাপ ফুটে আছে। এই বারোটা গোলাপ একই অঙ্কের ফল, অথচ গুনে দ্যাখো, সব গোলাপের পাপড়ির সংখ্যা সমান নয়।”
“আমি বুঝতে পারছি না।”
“তোমার মগজ সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম না করলে কী করেই বা বুঝবে ওই দুটো অঙ্কই নির্ভুল।”
“তবে আমি এতকাল ধরে যা শিখে এসেছি, সবই কি ভুল?”
“না, তবে সেগুলো আপেক্ষিক। স্থান-কাল-পাত্র ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার মধ্যে সেগুলোও ভুল নয়।”
“তা হলে আমি এই দুটো অঙ্কের কোনটাকে মানব?”
“ভাল করে লক্ষ করো। বর্ণ দিকের পাতাটা হল পজেটিভ। ডান দিকেরটা নেগেটিভ। তুমি ডান দিকের পদ্ধতিটা মনে রাখবে।”
“তা হলে কী হবে ?”
“ভাল হবে।”
“আমার মাথাটা আজ গুলিয়ে যাচ্ছে। ওই বেহালার শব্দই তার জন্য দায়ী।”
“না, তবে সুরটা খুব অদ্ভুত।”
“মাটির বেহালা তোমাকে কিছু বলতে চাইছে।”
“ভাল করে শোনো, বুঝতে পারবে।”
গোলোকবাবু বেহালাটা শুনতে লাগলেন। তাঁর চারদিকে সুরটা যেন একটা স্বপ্নলোক রচনা করে তুলছে। জেগে আছেন কিনা বুঝতে পারছেন না। গভীর রাতে গোলোকবিহারী হঠাৎ সচকিত হয়ে দ্যাখেন, তিনি তাঁর বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে মলিন জ্যোৎস্নার আলো। আর রেলিংয়ে ভর দিয়ে পিছু ফিরে সেই পাদ্রির মতো পোশাকের সাহেব। সাহেব ধীরে-ধীরে তাঁর দিকে ফিরল। নীল জ্বলজ্বলে চোখ। “তোমার পরিশ্রম সফল। আমাদের সেন্সরে সেই ফেরারি অপরাধীর অবস্থানের সংকেত আসতে শুরু করেছে। আর দুটো ধাপ পেরতে পারলেই আমরা তাকে নাগালে পেয়ে যাব।”
গোলোকবাবু শুকনো গলায় বললেন, “আমিও চাই, সে ধরা পড়ুক। আমি আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।”
সাহেব তাঁর দিকে চেয়ে বলল, “যন্ত্রণা? যন্ত্রণা কীরকম হতে পারে, তার কোনও ধারণাই নেই তোমার। তাকে যদি আমরা শেষ পর্যন্ত ধরতে না পারি, তা হলে কী হবে জান?”
“না।”
“আমরা বাতাসের প্রক্রিয়া জানি। বাতাসকে প্রথমে প্ররোচিত করা হবে, তারপর উত্তেজিত করা হবে আর তারপর উন্মাদ করে তোলা হবে। পাঁচশো মাইল বেগে বাতাস বইলে কী হয়, জান?”
“সাঙঘাতিক ঝড়!”
“বৃহস্পতি কিংবা শনি গ্রহে এরকম ঝড় হয়। কিন্তু আমরা যখন বাতাসকে উন্মাদ করে দেব, তখন এই কুড়ি মাইল বৃত্তের মধ্যে বাতাস ঘুরবে হাজার মাইল বেগে। বাতাসের সেই গর্ভগৃহে ঘুটন-যন্ত্রের মতো কেন্দ্রাভিগ টানে যত বাড়িঘর, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষ সব ভেঙে গুড়িয়ে একাকার হয়ে যাবে। সমস্ত জায়গাটায় শুধু পড়ে থাকবে থকথকে কাদার মতো একটা জিনিস।”
আতঙ্কিত গোলকবাবু বললেন, “একজনকে মারার জন্য আপনারা সবাইকে মেরে ফেলবেন?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “না, শুধু ওই একজন কিন্তু মরবে না। ওই আসুরিক ঝড়েরও সাধ্য নেই তাকে ধ্বংস করার। সবকিছু ঘেঁটে কাথ হয়ে যাওয়ার পরও সে একা বেঁচে থাকবে। তখন তাকে চিহ্নিত করা সহজ হয়ে যাবে। আমরা সেই পরিণতি চাইছি না। তোমাকে আজ যে অঙ্কটা দিয়ে যাচ্ছি, হয়তো বা সেটাই আমাদের শেষ অঙ্ক। ঠিক পদ্ধতিতে অঙ্কটা সমাধান হলে আমরা তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারব।”
“আমি কি পারব?”
“পারবে, পারতেই হবে। মনে রেখো এই যুদ্ধে অঙ্কই আমাদের একমাত্র অস্ত্র।”