সর্বনেশে ভুল অঙ্ক – ৬

“ঠাকুরমশাই কি জাগ্রত অবস্থায় আছেন?”

“আছি হে।”

“এই একটু পেন্নাম জানাতে এলাম।”

“দেবদ্বিজে তো অচলা ভক্তি দেখছি হে বেচারাম।”

“আজ্ঞে, ব্রাহ্মণের আশীৰ্বাদ ছাড়া আমাদের আর সম্বল কী বলুন!”

“দিনকাল পালটে গিয়েছে হে বেচারাম। বামুনের আর সেই মহিমাও নেই, কদরও নেই, বুঝলে?”

“যে আজ্ঞে, বড় মোক্ষম কথা বলেছেন ঠাকুরমশাই। তাই বসে-বসে ভাবি, চালডালের দাম বাড়ল, তেল মশলার দাম বাড়ল, পটল বেগুনের দাম বাড়ল, শুধু বামুনের দামটাই কেন পড়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারি না। লক্ষণটা কি ভাল বুঝছেন পণ্ডিতমশাই?”

“যুগধর্ম কি আর অস্বীকার করা যায় হে?”

“আপনারা উচ্চকোটির মানুষ, উঁচু থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পান। আমরা নীচে থেকে বুঝছি, গতিক বড় সুবিধের নয়। ব্রাহ্মণের মহিমা না থাকলে যে বড় অরাজক অবস্থা হবে, পণ্ডিতমশাই।”

“তা আর কী করা যাবে বলো?”

“তা পণ্ডিতমশাই…”

“বলো।”

“উঁচু থেকে অবস্থাটা কেমন বুঝছেন? যুদ্ধটুদ্ধ লাগবে বলে কি মনে হয়?” .

“যুদ্ধ? না হে বাপু, যুদ্ধটুদ্ধর খবর জানি না। পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছি।”

“সে তো বটেই। একটা কথা জিজ্ঞেস করব ঠাকুরমশাই?”

“বলে ফেলো।”

“আগেকার দিনে ঢাল-তরোয়াল আর তির-ধনুকে যুদ্ধ হত, ঠিক কিনা? তারপর বোমা-বন্দুক এল। ঠিক বলছি তো?”

“ঠিকই বলছ হে৷”

“তা এখন যুদ্ধ লাগলে আস্তর কী হবে ঠাকুরমশাই?”

“কেন হে বাপু, বোমা-বন্দুক কি সেকেলে হয়ে গিয়েছে?”

“আজ্ঞে জানতে চাইছিলাম, বোমা-বন্দুক ছাড়া মানুষ আর কোন অন্ত্র বের করেনি?”

“আর কোনও অস্ত্রের খবর তো জানি না বাপু।”

“এই যেমন ধরুন, অঙ্ক দিয়ে যদি যুদ্ধ হয়?”

“দুর! তাই কখনও হয় নাকি?”

“তা হলে বোধ হয় ভুলই শুনেছি আজ্ঞে।”

“কার কাছে কী শুনেছ, সেটা বলবে তো।”

“ওই মাথা পাগলা গোলোকবাবু, তার সঙ্গেই কাল বাজারে দেখা। দেখলুম ভারী ব্যস্ত। তাড়াহুড়ো করে কানা বেগুন, পচা আলু কিনে থলিতে ভরছে। তাই গিয়ে বললুম, “মাস্টারমশাই অত হুড়োহুড়ি করে বাজার করতে নেই। উনি খাপ্পা হয়ে বললেন, “আমার কি সময় আছে? এখনই গিয়ে অঙ্ক নিয়ে বসতে হবে। নইলে যুদ্ধ লেগে যাবে যে!”

“বলল বুঝি?”

“যে আজ্ঞে। তারপর বললেন, যুদ্ধটা হবে নাকি অঙ্কের সঙ্গে অঙ্কের ”

“নাঃ, গোলোকের মাথাটাই গিয়েছে দেখছি।”

“তা ঠাকুরমশাই, অঙ্কের সঙ্গে অঙ্কের যুদ্ধ লাগলে কি আমাদের ভয়ের কিছু আছে?”

“অমন বিটকেল যুদ্ধের কথা জীবনে শুনিনি বাপু ভয়ের বদলে তো হাসি পাওয়ার কথা।”

“বাঁচালেন ঠাকুরমশাই। যুদ্ধর কথা শুনে বড় ভয় ধরেছিল। রাজায়রাজায় যুদ্ধ হয় আর প্রাণসংশয় হয় উলুখাগড়ার, কী বলেন?”

“তা তো ঠিকই। তবে যেদিন আমাদের গন্ধ-গজাল গিরীশ বাপুলি বাতাস শুকে বলেছিল যে, সে নাকি চারিদিকে যুদ্ধ-যুদ্ধ গন্ধ পাচ্ছে।”

“সে আবার কে হে?”

“আজ্ঞে, কানুনগোদের গুদোমঘরের পাহারাদার।”

“তা তাঁর অমন বিটকেল নাম কেন?”

“বাতাস শুকে অনেক কিছু বলে দিতে পারেন কিনা! গন্ধ-গজাল বলে ডাকে। তা বলতে নেই, গিরীশ বাপুলি গন্ধও পায় বটে। বটেশ্বরের বাড়িতে শনিপূজোর নেমন্তন্নে গিয়ে বলল, ‘ওরে বড্ড পুরনো ঘিয়ের গন্ধ পাচ্ছি, উঠোনের এই জায়গাটা খুঁড়ে দেখিস তো।’ তা সত্যি উঠোন খুঁড়ে তিনহাত মাটির তলা থেকে একটা মেটে কলসি পাওয়া গেল। তাতে প্রায় একশো বছরের পুরনো ঘি। বটেশ্বর সেই ঘি কোবরেজমশাইকে সাতশো টাকায় বিক্রি করে কয়েকদিন খুব বাবুগিরি করল। এই গত চৈত্রমাসের ঠা-ঠা রোদ্দুরে এক দুপুরবেলায় গিরীশ বলল, ‘ওরে বাবা, বড্ড ঝড়-তুফানের গন্ধ পাচ্ছি যে। আজ না প্রলয়কাণ্ড হয়ে যায়। তা হলও ঠাকুরমশাই, ঝড়-জলে একেবারে লন্ডভন্ড কাণ্ড। এই তো সেদিন বলাই ময়রার মিষ্টির দোকানে জিলিপি খেতে গিয়ে গিরীশ বাপুলি বলল, ওহে, এখানটায় কি একটু আগে নবকৃষ্ণ খেয়ে গিয়েছে?’ বড্ড গুণি মানুষ আজ্ঞে। তবে আপনি যখন বলছেন, যুদ্ধ হবে না, তখন আর গিরীশ বাপুলির কথাটা ধরছি না। তা হলে আমি আসব?”

“এসো গিয়ে।”

আজ রাত্তিরে সনাতন সিদ্ধাইয়ের বড় বিপদ হল। সন্ধে পেরতেই চারদিকটা এমন বিদঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল যে সনাতন হা। যে ভূতুড়ে নকশাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল, সেগুলো কে যেন আলকাতরায় চোবানো ন্যাকড়া দিয়ে লেপেপুছে দিয়েছে। তার চেয়েও বিপদ হয়েছে, দেশলাই জ্বলছে না। হ্যারিকেন ধরানো যাচ্ছে না, ধরালেই নিভে যাচ্ছে। কালী আর বটু দু’জনেই আলো জ্বালাবার জন্য বিস্তর মেহনত করে জাল ছেড়ে দিয়েছে। শেষে কালী বলেই ফেলল, “বাবাঠাকুর, আজ কি নতুন লীলার খেল দেখাবেন? আজ যে জোনাকি পোকারাও জ্বলছে না, বাবাঠাকুর। আমরা তিনজনেই একসঙ্গে কানা হয়ে যাইনি তো?”

সনাতনের সেই ভয়টাও হয়েছিল একবার। একটু-আধটু ফাঁকফোকর থাকেই। আজকের মতো এমন নিরেট আর জম্পেশ অন্ধকার তিনি জীবনে দ্যাখেননি। ব

টু বলল, “বাবাঠাকুর, সন্ধের মুখেই আমি একটা হাড়গিলে চেহারার লোককে ঝোলা কাঁধে আসতে দেখেছি। চারদিকে খুব ঠাহর করে কী যেন দেখছিল। তারপর ওই বটগাছতলায় ঝোলা থেকে কী যেন একটা বের করে ছেড়ে দিয়ে গেল।”

“আজ্ঞে, তখন আমি হ্যারিকেনের সলতেটা সমান করে কাটছিলাম।

তাই ভাল করে দেখিনি। তবে আড়চোখে দেখে মনে হয়েছিল, যেন একটা কালো বিড়ালকে ছেড়ে দিয়ে গেল জঙ্গলে।”

“দুর বোকা! কালো বিড়াল ছাড়ল তো কী হল? বিড়ালের সঙ্গে অন্ধকারের সম্পর্ক কী?”

জবাবটা বটুর কাছ থেকে এল না। অন্যদিক থেকে এল। সনাতনের বাঁ ধারে খুব কাছ থেকে কে যেন একজন চাপা গলায় বলল, “কালো বিড়াল বড় সামান্য জিনিস নয় বাবাঠাকুর। সব আলো চেটেপুটে খেয়ে নিতে পারে।”

সনাতন ভড়কে গিয়ে বললেন, “কে রে?”

“আমাকে চিনবেন না। তা অন্ধকারটা কেমন লাগছে বাবাঠাকুর? বেশ নিকষ্যি অন্ধকার, না?”

সনাতন কেঁপেঝেঁপে মরেন আর কী! কোনওরকমে বললেন, “এ যে বড্ড অন্ধকার“”

“বটেই তো। ওই যে পাজি অঙ্কগুলো চারদিক ঘিরে ফেলেছে, সেগুলো লেপেপুছে গিয়েছে। যদি অন্ধকারের দরকার হয় তো বলবেন। যত চাই, দেব। অন্ধকার দিয়ে কত কাজ হয়, মশাই।”

“কীসের কাজ?”

“বাবাঠাকুর, কাজের কি শেষ আছে? অনেক কাজেই অন্ধকারেরও দরকার হয়। অন্ধকার একটা ভারী ভাল অস্ত্র।”

“তুমি সত্যিকারের কে বলো তো বাপু!”

“একজন ফেরিওয়ালা বললে কি বুঝতে পারবেন?”

“কীসের ফেরিওয়ালা বাপু তুমি?”

“তার কি কিছু ঠিক আছে মশাই? যখন যা পাই, তাই ফেরি করে বেচি। এখন অন্ধকার ফেরি করছি।”

“তা বাপু, আমার ভূতগুলো কোথায় গেল?”

“ওসব আপনার ভূত নয়, বাবাঠাকুর ও একটা ফাঁদ।”

“এই ফাঁদ হল একটা বেড়াজালের মতো জিনিস। গোটা তল্লাট ছেকে রুই-কাতলা-পুটি-খলসে সব তুলবে।”

“আমি যে বুঝতে পারছি না বাপু!”

“অত বুঝবার দরকার কী আপনার? যত বুঝবেন, তত সমস্যা বাড়বে। জপতপ নিয়ে থাকুন না চোখ-কান বুজে।”

“কিন্তু আমার যে ভয় করছে!”

“ভয় পাওয়া খুব ভাল মশাই ভয় দেখানোর জন্যই তো মশাই কাজকারবার লাটে তুলে এই এত দুর ছুটে আসতে হয়েছে।”

“বলো কী বাপুঃ শুধু আমাকে ভয় দেখাতে ছুটে এসেছ? তাতে কী লাভ?”

“দু মশাই! আমাকে কি ভীমরতিতে ধরেছে যে, আপনার মতো একজন জ্যান্তেমরাকে ভয় দেখানোর জন্য এত মেহনত আর সময় খরচ করব? যাকে ভয় দেখাতে আসা, সে বেশ শক্তপোক্ত আর মজবুত লোক মশাই। তাকে ভয় খাওয়ানো সহজ কাজ নয়।”

“সে কি আমার সাধনপীঠেই লুকিয়ে আছে?”

“কোন দুঃখে? তার কি আর মরার জায়গা নেই যে, আপনার ইঁদুরের গর্তে এসে ঢুকবে?”

“তবে যে বাপু তুমি আমার ঠেকে চড়াও হয়েছ?”

“যখন সংসারআশ্রমে ছিলাম, তখন জানা ছিল।”

“রাজাকে ধরে ফেললে কী হয়?”

“কিস্তিমাত!”

“এই তো বুঝেছেন। কিন্তু কিস্তিমাত হওয়ার আগেই যত জটিল আর কুটিল চাল দিয়ে রাজাকে আড়াল করতে হয়, ঠিক কিনা?”

“তা তো ঠিকই।”

“এটাও ধরুন, সেরকম খেলা চলছে। নানা জটিল আর কুটিল চাল। আমরা রাজা বাঁচানোর চেষ্টা করছি আর ওই লোকটা আমাদের রাজাকে তার আড়াল ভেঙে বের করতে চাইছে। কিছু বুঝলেন?”

“কিছু না বাবা।”

“যত কম বুঝবেন ততই মঙ্গল।”

“আর এই অন্ধকারটা ?”

“অন্ধকারের যা কাজ ছিল, তা হয়ে গিয়েছে। এবার অন্ধকার কেটে যাবে বাবাজি। সেই সঙ্গে আমিও।”

লোকটা কি চলে গেল? একটু গলাখাকারি দিয়ে আস্তে করে বললেন, “আছ নাকি হে?”

না, সাড়া নেই। অন্ধকারটাকেও হঠাৎ থিয়েটারের পরদার মতো কে যেন খ্যাঁচ করে টেনে সরিয়ে নিল। বটু চট করে হ্যারিকেন ধরিয়েও জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল, “জয় বাবাঠাকুরের জয়!”

কালী এসে বলল, “কারও সঙ্গে কি অন্ধকারে কথা কইছিলেন নাকি বাবাঠাকুর ?”

সনাতন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ওরে বড় তৃষিত আত্মাই তো তাদের জ্বালাযন্ত্রণার কথা আমার কাছে বলতে আসে। আর যাবেই বা কার কাছে, বল?”

“আজ্ঞে, সে তো ঠিকই। আর সেই জন্যই বোধ হয় আজ অন্ধকারটাকে এত ঘন করে তুলেছিলেন বাবাঠাকুর। ওঃ, আপনার লীলা যত দেখছি, ততই আমার ভক্তি বেড়ে যাচ্ছে মশাই।”