সর্বনেশে ভুল অঙ্ক – ৫

নাঃ, সময়টা বড়ই খারাপ যাচ্ছে দুলালখ্যাপার। বিমর্ষ মুখে বসে প্রাতঃকালে চা খাচ্ছিলেন। সকালে দু’বার কড়া লিকার চা খাওয়ার অভ্যাস। আজ চার গেলাস হয়ে গিয়েছে, তবু মনের বিমর্ষ ভাবটা কাটছে না। আজ সকালেই বাউরি-বউ এসে পাড়ার জানান দিয়ে কী হেনস্থাটাই করে গেল, “বলি ও খ্যাপাঠাকুর, গত চোত মাসে কানের মাকড়ি বাধা দিয়ে আড়াইশো টাকা গচ্চা দিয়ে বলে গেলুম, ঠাকুর, আমার শাউড়ির ওলাউঠো হোক। তা কোথায় কী? শাউড়ির বদলে ওলাউঠো হল আমার খুড়শ্বশুরের। বলি, বাণটানগুলো একটু টিপ করে মারতে পার না? ভালয়-ভালয় টাকাগুলো ফেরত দিও বাপু, নইলে কুরুক্ষেত্র হবে।”

ন্যাপা উঠোন ঝ্যাঁটাচ্ছিল আর আড়ে-আড়ে দেখছিল। মুখে কি একটু খুশির হাসি? সকাল থেকেই ন্যাপা ঘ্যানঘান করছে, “ওঃ, কাল সনাতনবাবার আখড়ায় কী জিনিসই দেখে এলুম। চোখ সার্থক, জীবন সার্থক। চারদিক ভূতে-ভূতে ছয়লাপ। গোল ভূত, তেকোনা ভূত, লম্বা ভূত, বেঁটে ভূত। বাতাসে কিলিবিলি করে ভেসে বেড়াচ্ছে। আহা, সনাতন সিদ্ধাইয়ের মতো গুরু পেলে আর পায় কে।”

দুলালখ্যাপা এসব শুনে প্রমাদ গুনছেন। তার চেলা আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই। যে চারজন ছিল, তাদের তিনজনই সনাতন হাওলাদারের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে। একা পড়ে আছে ন্যাপা। দুলালখ্যাপা দু-একবার বলেছেন, “ওরে গুরুত্যাগ করতে নেই। গুরুত্যাগ মহাপাপ।”

“আহা, ত্যাগের কথা উঠছে কেন। বলি, গত দু’বছর তো মাটি কামড়ে পড়ে আছি। এবার একটু বিভূতি-টিভূতি দেখান। সনাতন সিদ্ধাইয়ের সাধনপীঠে গিয়ে দেখে আসুন, সন্ধের পর যেমন কাতারে-কাতারে লোক ভিড় করছে।”

“ওরে ভূত দেখতে চাস? সে তো আমি এক লহমাতেই দেখাতে পারি। কিন্তু ওসব হচ্ছে নিচুস্তরের ব্যাপার।”

“সে তো বুঝলুম, কিন্তু একটু বিভূতি-টিভূতি না দেখালে যে মোটেই গা গরম হচ্ছে না মশাই!” এজন্যই সকাল থেকে মনটা বড় বিমর্ষ। চার নম্বর গেলাসের চা-টা খেয়েও যেন মনটা চাগাড় দিয়ে উঠছে না।

ন্যাপা উঠোন ঝেঁটিয়ে কুটোকাটা সব জড়ো করতে-করতে বলল, “এই যে বাউরি-বউ সকালে এসে বলে গেল, আপনার বাণে কাজ হয় না, এতে তো আমাদেরও বেশ অপমান হচ্ছে মশাই!”

দুলালখ্যাপা মিটমিট করে চেয়ে বলেন, “কাজ হয় না কে বলল? শুনলি না বাণটা একটু হড়কে ওর খুড়শ্বশুরের উপর পড়েছে। তা বানের অমন একটু আধটু এদিক ওদিক হয়। বাণ বৃথা যায়নি রে, ক্রিয়া হয়েছে ঠিকই।”

“বৃন্দাবনবাবুর পিত্তশূলের জন্য যে মাদুলি আর জলপড়া দিলেন, তাতে তো কাজই হল না। তারা এখন বড় ডাক্তার দেখাচ্ছে।”

দুলাল বুঝতে পারছেন, ন্যাপাকে আর বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না। নাঃ, এই ফটফটে দিনের আলোতেও দুলালখ্যাপা যেন চোরা অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন। ওই তো জাম গাছের মোটা ডাল থেকে মৌচাকের মতো অন্ধকার ঝুলে আছে। তা থেকে টুপটাপ করে ফোঁটা ফোঁটা অন্ধকার ঝরে পড়ছে নীচে। বটতলার ছায়ায় অন্ধকার দোলনায় দোল খাচ্ছে গাছপালার ফাঁকে-ফাঁকে গুড়ি মেরে, গা ঢাকা দিয়ে অন্ধকার যে এগিয়ে আসছে, তা দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন তিনি।

দুলালখ্যাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু চোখ বুজলেন। তারপর চোখ খুলতেই দেখলেন, তার নাকের ডগায় বাতাসে কালো বিড়ালের লেজের মতো একটা প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে আছে। তাজ্জব হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। চোখের ভুলই হবে ভেবে হাত দিয়ে একটা ঝাপটাও মারলেন। কিন্তু চিহ্নটা একটু দোল খেয়ে ফের স্থির হল। দুলালখ্যাপা ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ন্যাপা…”

হুট করে ভোজবাজির মতো বাতাস ফুড়ে একটা লোক তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। রোগাটে, লম্বা চেহারা, রুখু চুল, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, কোটরগত চোখ, গায়ে একটা ময়লা ডোরাকাটা পিরান আর পরনে লুঙ্গি। লোকটা খপ করে প্রশ্নচিহ্নটাকে ধরে তার কাঁধের ঝোলায় পুরে ফেলে এক গাল হেসে বলল, “কিনবেন নাকি বাবা?”

“কিনব! কী কিনব হে?”

“এই অন্ধকারের কথাই বলছিলাম। বডড খাটি আর সরেস জিনিস ছিল। একদম নিরেট, নিকষ্যি কালো, নিখুঁত অন্ধকার।”

“অন্ধকার। অন্ধকার কি বিকিকিনি হয়?”

“খুব হয়। বিপদে আপদে অন্ধকার খুব কাজে লেগে যায় বাবা। পাইকারি দরেই দিচ্ছি।”

স্বপ্ন দেখছেন কিনা বুঝতে পারছেন না। তাই ফের চোখ কচলে ভাল করে লোকটার দিকে তাকালেন। লোকটা দিব্যি জুলজুল করে তাঁর দিকে চেয়ে আছে।

“অণ্দকার দিয়ে কী হয়?”

“আজ্ঞে অনেক কিছু হয়। অন্ধকারে অনেক জিনিস লোপাট করে দেওয়া যায়। শক্রর চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়। গা ঢাকা দেওয়ারও ভারী সুবিধে হয়ে যায় বাবা। নমুনা হিসেবে আপনার ওই জাম গাছে অন্ধকারের একটা চাক লাগিয়ে রেখেছি বাবা। পরখ করে দেখবেন, খুব খাটি জিনিস। কোনও ভেজাল নেই।” বড় ঘাবড়ে গিয়েছেন দুলালখ্যাপা। কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললেন, “ওরে বাবা রে! এসব কী শুনছি!”

লোকটা যেন ভরসা দিয়েই বলল, “ঘাবড়ানোর কিছু নেই বাবা। এখন যুদ্ধে নানারকম অস্ত্রের দরকার হয়। আগেকার মতো বন্দুক, বোমায় তেমন কাজ হয় না কিনা। আজকাল যুদ্ধে অন্ধকার খুব কাজের জিনিস।”

দুলালখ্যাপা আর থাকতে না পেরে আর্তস্বরে “ন্যাপা!” বলে প্রাণপণে চেঁচালেন। ন্যাপা পুকুরে গিয়েছিল। ডাক শুনে ছুটে এসে বলল, “কী হয়েছে বাবাঠাকুর ? সাপে কেটেছে নাকি?”

বিদ্যাধরপুরের বিখ্যাত জমিদার চৌধুরীদের সুদিন যে চুপি-চুপি, কাউকে কিছু না বলে, জানান না দিয়ে নীরবে বিদায় নিয়েছে এবং দুদিন যে দেতো হাসি হাসতে-হাসতে ফস করে ঢুকে দিব্যি গ্যাট হয়ে বসে পড়েছে এটা রাঘববাবু বুঝেও ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। কিন্তু পৃথিবীর নির্মম সত্যগুলো কোনও না কোনও সুযোগে ঠিকই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। সত্যটা রাঘববাবু টের পেলেন যখন বছর দুই আগে একদিন দুপুরবেলা তার হঠাৎ খিদে পেল। খিদে জিনিসটার সঙ্গে তার কোনও পূর্বপরিচয় ছিল না। খিদে আসলে কী ও কেমন তাও জানতেন না তিনি। তাই খুবই বিস্মিত হলেন এবং ভয় পেয়ে ডাক্তারকে ডেকে পাঠালেন। ডাক্তার বৈদ্যনাথ বিশ্বাস এসে ভাল করে পরীক্ষা করার পর রায় দিলেন, “এটা খিদের লক্ষণ।” শুনে রাঘববাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তার যে কোনওদিন খিদে পেতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা তার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। চৌধুরীবাড়ির পুরুষদের খিদে বলে কোনও বস্তুই কখনও ছিল না। ঘুম থেকে উঠতেই রুপোর গেলাসে গরম দুধ, দুধের পিছু-পিছু আসত লুচি আর মোহনভোগ, একটু দম নিতে না-নিতেই এক থালা ফল, সেটা ভাল করে তল হওয়ার আগেই ষোলোটা বাটিতে ঘেরা থালায় মিহি চালের গরম ভাত। এভাবেই ঘণ্টায়-ঘণ্টায় তারা খেতেন। ভরা পেটেই খেতে হত তাদের। খেয়েই যেতে হত। যতক্ষণ না রাতে ঘুমিয়ে পড়ছেন। তাই যেদিন রাঘববাবুর খিদে পেল, সেদিনই তিনি বুঝতে পারলেন, চৌধুরীদের সুদিন আর নেই।

একশো বাষট্টি জোড়া জুতো ছিল রাঘববাবুর। এখন তিন জোড়ায় এসে ঠেকেছে। তার মধ্যে এক জোড়া আবার হাওয়াই চটি৷ পাঞ্জাবিটিতে সোনার বদলে প্লাস্টিকের বোতাম। জুড়িগাড়ির জায়গায় সাইকেল।

সকাল থেকেই আজ মনটা খারাপ। গদাধর লিগে গতকালও বিদ্যাধরপুর ফরাসগঞ্জের কাছে দু’ গোলে হেরেছে। কাল বাজার থেকে যে তরমুজটা এনেছিলেন, আজ সকালে সেটা কাটতে গিয়ে দেখা গিয়েছে সেটা পচে গোবর। খালধারের জমিটা নিয়ে নন্দ সাহার সঙ্গে যে মামলা চলছিল, গতকাল তার রায় বেরিয়েছে। রাঘববাবু হেরে গিয়েছেন।

ঠাকুরদা বিষ্ণুপ্রতাপ গুণের সমঝদার ছিলেন খুব। তিনি বিদ্যাধরপুরের গৌরববৃদ্ধির জন্য কুস্তিগির রামু পালোয়ান, ওস্তাদ কালোয়াত নরেন গোঁসাই আর জাদুকর পঞ্চানন গুইকে এখানে এনে বসত করিয়েছিলেন। নিষ্কর জমি দেওয়া হয়েছিল, মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল। গতকালই রামু পালোয়ান দেখা করতে এসেছিল। ভাঙাচোরা দড়ি পাকানো চেহারা। বহুকাল মাসোহারা বন্ধ বলে কত কষ্টে আছে, সেই সবই দুঃখ করে বলছিল। কয়েকদিন আগে পঞ্চানন গুইকে দেখতে গিয়েছিলেন রাঘব। শয্যাশায়ী। বাড়িতে হাড়ির হাল। আর আজ সকালে নরেন গোঁসাই নাতির হাত ধরে লাঠিতে ভর করে এসে বাজার খরচের জন্য কুড়িটা টাকা একরকম ভিক্ষে নিয়ে গেল।

সকাল থেকে তাই মনটা বড় খারাপ রাঘববাবু রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁটের জলখাবারটা পর্যন্ত স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয়নি। জঙ্গল আর আগাছা ভরা বাগানে এসে ভাঙা ফোয়ারার ধারে বাধানো চাতালে পিপুল গাছের ছায়ায় বসে আছেন। মাঝে-মাঝে বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। চোখেও ভিজে-ভিজে ভাব। একটু কাঁদতে পারলে বোধ হয় বুকটা হালকা হত। কিন্তু পুরুষসিংহের তো কাঁদতে নেই! অনেক দূর থেকে একটা মাটির বেহালার আওয়াজ আসছিল। ভারী মিঠে আওয়াজ। ছেলেবেলায় বিস্তর শুনেছেন এই আওয়াজ। কিন্তু বেহালা কিনে বাজাতে গিয়ে দেখেছেন ফেরিওয়ালার মতো হয় না। আজকের আওয়াজটা শুনে ভারী ভাল লাগছিল।

বাজনদার ফেরিওয়ালাটা আস্তে-আস্তে এগিয়ে আসছিল। তারপর বাড়ির সামনেই এসে বাজাতে লাগল। কান পেতে শুনছিলেন রাঘববাবু। বড্ড ভাল বাজায় তো! মাটির বেহালায় এত সুন্দর আওয়াজ হয়, এ তার জানাই ছিল না। মনটা আস্তে-আস্তে ভাল হয়ে যাচ্ছিল। চোখ বুজে বিভোর হয়ে বেহালার সুর শুনতে-শুনতে বোধ হয় বাহ্যজ্ঞান ছিল না। হঠাৎ খুব কাছ থেকে কে যেন বলল, “বেহালা নেবেন নাকি বাবু?” চোখ চেয়ে দেখেন সামনে বুড়ো মতো একটা লোক দাঁড়িয়ে। পরনে একটা ময়লা চেককাটা লুঙ্গি, গায়ে খয়েরি রঙের ফতুয়া, রুখু দাড়ি আর বাকড়া চুল। রাঘববাবু মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু, বেহালা দিয়ে আমি কী করব? তবে তুমি বড় ভাল বাজাও।” “বেহালা একটা রেখে দিন বাবু, কোন সময় কোন কাজে লেগে যায় তার ঠিক কী?”

“ও বেহালা তোমার হাতে যেমন বাজে, আমার হাতে তো তেমন বাজবে না আমি জানি। আমার কোন কাজে লাগবে?”

“শব্দ বড় কাজের জিনিস বাবু শব্দ দিয়ে কত কী হয়, সে ভেবে শেষ করা যায় না। শব্দে প্রলয় ডেকে আনা যায়, শব্দ দিয়ে প্রলয়কে ঠেকানোও যায়। কত হারানো জন, কত হারানো জিনিসের সন্ধান বয়ে আনে শব্দ। কত বিপদআপদে শব্দ এসে রক্ষা করে। ঠিকঠাক শব্দ হল বীজমন্ত্রর মতো।”

রাঘববাবু অবাক হয়ে বললেন, “তাই নাকি?”

গোঁফ-দাড়ির ফাঁকে এক ঝিলিক হেসে লোকটা বলে, “আমি পাগল নই বাবা, প্রলাপ বকছি না। এই বেহালা বাজিয়ে আমিও তো একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

ভ্র কুঁচকে রাঘব বলেন, “সে আবার কেমন খোঁজা হে?”

“কী করি বাবা, শব্দ ছাড়া যে কিছুতেই তার নাগাল পাওয়ার উপায় নেই। কত কিছু আড়াল করে রেখেছে তাকে। কত হিসেবনিকেশ কত স্পন্দন, কত গন্ধ, কত রূপের আবডালে সে লুকিয়ে রয়েছে। শব্দের রশি ধরে-ধরে তার কাছে এগোতে হয়।”

রাঘববাবুর সন্দেহ হল, লোকটার মাথার দোষ। বললেন, “কাকে খুঁজছ বাপুঃ তোমার নাতিপুতি নাকি?”

“আজ্ঞে ওই রকমই। খবর পেয়েছি, তার বড় বিপদ।”

“বাপু হে, বেহালা বাজিয়ে তাকে খোঁজার চেয়ে পুলিশের কাছে যাও না কেন?”

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খানিকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তারপর বলল, “বেহালাটা রেখে দিন বাবু, কাজে লাগবে।”

“রেখে কী লাভ বলো? বাজাবে কে?”

“যেদিন দরকার হবে, সেদিন বেহালা আপনিই বাজবে।”

“ধুর পাগল! বেহালা নিজে কখনও বাজে?”

লোকটা ফের তার ঝিলিক দেওয়া হাসিটা হেসে বলল, “বড় ঠিক কথা বাবু। বেহালা, বীণা, বাঁশি কেউই বাজনদার ছাড়া বাজে না। বাদ্যযন্ত্র নিজের আওয়াজ শুনতে পায় না। রসও পায় না। কিন্তু এই বেহালাটা তেমন নয়। এর ভিতরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা আছে। এ চারিদিকটাকে টের পায়, যখন সময় হবে, তখন দেখবেন বেহালা কেমন আপনা-আপনি মোহনসুরে বেজে উঠবে।”

রাঘববাবু হাসলেন। পাগল আর কাকে বলে, তবে তর্ক তুললেন না। বললেন, “তুমি গুণী মানুষ। তোমাকে বরং দশটা টাকা নজরানা দিচ্ছি। ও বেহালা আমি কিনব না বাপু।”

“আজ্ঞে কিনতে হবে না। যন্ত্র ঘরে রেখে দিলেই হবে। আমি কাঙাল ফকির মানুষ বটে, তবে আমি নজরানা নিই না।”

লোকটা একরকম জোর করেই বেহালাটা তাকে গছিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। রাঘববাবু বেহালাটা ভাল করে দেখলেন। মাটির বেহালা যেমনটা হয়, তেমনটাই। কোনও আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই। তবে জিনিসটা অনেকদিনের পুরনো বলে মনে হচ্ছে।

বেহালাটা কোলে নিয়ে আরও কিছুক্ষণ বাগানে বসে রইলেন রাঘববাবু। সকাল থেকে মনটা বড় ভার হয়ে ছিল। পাগল বাজনাদারটা এসে এমন ভাল বাজনা শোনাল যে, এখন আর মনের ভার একটুও নেই। বরং ভারী ফুরফুরে লাগছে। বেহালাটার গায়ে একটু ভালবাসার হাত বুলিয়ে আদর করলেন রাঘব।

গোলোকবিহারীর বাড়িতে জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা শেষ, বাক্স-টাক্সও গোছানো হয়ে গিয়েছে। আগামীকালই গোলোকবাবু বাঁকুড়ার এক গ্রামে তার পিসির বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। এই গুপ্তিপাড়ায় আর কোনওদিন ফিরে আসবেন কিনা তা পরে ভাববেন, আপাতত স্থানত্যাগ না করলে তার সমূহ বিপদ গাঁয়ের মাতব্বররা এসে হাতেপায়ে ধরে তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছেন। ছাত্ররা এসে কান্নাকাটি করেছে। মনসারাম দু’বেলা এসে তাকে পইপই করে বোঝাচ্ছেন, কিন্তু গোলোকবিহারী কারও কথাই শুনতে রাজি নন। আজও সকালে তিনি টেবিলে এক তা কাগজ পেয়েছেন, তাতে ফের নতুন একটা ইকোয়েশন। রাতবিরেতে যখন তখন সেই পাদ্রিসাহেব এসে হাজির হচ্ছেন। স্বপ্ন না মতিভ্ৰম না ভূত দেখছেন, তা বলতে পারবেন না গোলোকবাবু। তবে তার খাওয়া কমে গিয়েছে। ঘুম হচ্ছে না। পেটে বায়ু, গলায় অম্বল আর বুকে ধড়ফড়ানি এত বেড়েছে যে, যে-কোনও সময় হার্টফেল হয়ে যাবে! ডাক্তার বলেছে তার প্রেশারও খুব বেশি, গুপ্তিপাড়া না ছাড়লে তার প্রাণসংশয়, আর প্রাণে যদি বেঁচেও থাকেন, তা হলেও পাগল হয়ে যাবেন। হতে আর বিশেষ বাকিও নেই।

মনসাপণ্ডিত আজ সকালে এসেও তাঁকে বুঝিয়েছেন, “তুমি অঙ্কের লোক হয়েও কি আজগুবিতে বিশ্বাস কর? যা কিছু হচ্ছে তা তোমারই মনের প্রোজেকশন, অঙ্ক নিয়ে বড্ড বেশি মজে থাক বলে ওরকম হতেই পারে। দু দিন অঙ্ক থেকে ছুটি নিয়ে একটু ঘুরেটুরে এসো, ঠিক আছে। তা বলে গুপ্তিপাড়া চিরতরে ত্যাগ করবে কেন?”

গোলোকবাবু অত্যন্ত তেতো মুখে বললেন, “গুপ্তিপাড়া অত্যন্ত খারাপ জায়গা।”

“বলো কী হে! গুপ্তিপাড়ার গৌরবের দিকটা কি ভুলে গেলে? এখানকার মাটিতেই মন্তাজ আলি আঠেরো কেজি ওজনের কুমড়ো ফলিয়েছিল। এ গাঁয়ের হরেকৃষ্ণ সরখেল সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করেছিল। এই গুপ্তিপাড়ার বলাই ময়রার খাজা যে বিলেত আমেরিকাতেও চালান যায়।”

“তুমি তোমার গুপ্তিপাড়ার গৌরব নিয়েই থাকো ভাই। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আর তোমার ফাঁদে পা দিচ্ছি না।”

গোলোকবাবুর গোঁ দেখে মনসারাম পিছু হটলেন।

কাল সকালেই ভ্যানগাড়ি এসে পড়বে। ট্রেনের টিকিটও কেটে রেখেছেন গোলোকবাবু। সকালে দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়ারই যা অপেক্ষা। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে গোলোকবাবু একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলেন। এমন সময় বাইরে থেকে কে যেন খুব ভিরু গলায় ডাকল, “গোলোকস্যার কি আছেন? গোলোকস্যার!”

গোলোকবাবু উঠে দরজা খুলে দেখেন একটি কুড়ি-একুশ বছর বয়সি ছেলে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা বই।

“কী চাও বাপু? অঙ্ক বুঝতে এসেছ নাকি? ও আমি পারব না।”

“না স্যার, অঙ্ক বুঝতে নয়। আপনি তো চলে যাচ্ছেন, তাই আপনাকে একটা প্রণাম করতে এলাম।”

“তুমি কি এই গাঁয়ের ছেলে? তোমায় তো চিনতে পারছি না!”

“না স্যার, আমি এ গাঁয়ের ছেলে নই, তবে আপনাকে চিনি।”

“কীভাবে চেন?”

“তা আপনার অঙ্কের ভিতর দিয়েই চিনি।”

“সে আবার কেমন কথা?”

ছেলেটা যেন একটু ঘাবড়ে গেল। কাচুমাচু মুখ করে বলল, “আমার বাবা অঙ্কের পণ্ডিত ছিলেন তো, তার কাছে শুনেছি আপনার কথা।”

“ও, বুঝলাম, আর কিছু বলবে?”

“আমার বাবার কালেকশনে অনেক অঙ্কের বই ছিল, কিন্তু আমরা কেউ অঙ্ক বিশারদ হইনি। বইগুলো পড়ে-পড়ে নষ্ট হচ্ছে। বাবা অনেক কষ্টে সব সংগ্রহ করেছিলেন। সেইসব বই থেকে একটা বই আপনাকে বিদায়ী উপহার হিসেবে দিতে এসেছি। দয়া করে যদি নেন!”

“না বাপু, অঙ্কে আমার আর আগ্রহ নেই।”

“রেখে দিন না স্যার। না পড়লেও চলবে। কখনও ইচ্ছে হলে একটু উলটেপালটে দেখবেন। রেয়ার বই স্যার।”

গোলোকবাবু ঘোর অনিচ্ছে সত্ত্বেও বইটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বললেন, “কষ্ট করে যখন এনেছ তখন দাও। রেখে দিই।”

ছেলেটা ভারী খুশি হয়ে তাকে প্রণাম করে চলে গেল। গোলোকবাবু দরজা বন্ধ করে আড়চোখে বইটা একবার দেখলেন। কুচকুচে কালো মলাটের উপর সোনালি অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা। এ গাইড টু মেগা ম্যাথমেটিক্স। বই হাতে পেলেই মানুষের স্বভাব হল পৃষ্ঠা উলটে একটু দেখা। গোলোকবাবুও দেখলেন। আর দেখেই তার মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শুধু নানা রকম অচেনা দুর্বোধ্য চিহ্ন। প্রায় কোনও চিহ্নই সংখ্যার দ্যোতক নয়। তা হলে এগুলো কী? ঘুম মাথায় উঠে গেল। তিনি বইটা খুলে নিবিষ্টভাবে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। মনে হল, এগুলো আসলে অঙ্কই, তবে অচেনা কোনও পদ্ধতি বা ভাষায় লেখা। এ বই কোন কাজে লাগবে?

হঠাৎ দেখতে পেলেন, মোটা বইটার একটা পাতার ফাঁকে একটা চিরকুট গোঁজা রয়েছে। চিরকুটটা একটা সাদা, লম্বা প্লাস্টিকের মতো জিনিস। প্লাস্টিকের টুকরোটা তুলে আলোয় ধরতেই দেখতে পেলেন, সংখ্যাগুলিকে চেনার সংকেত দেওয়া আছে। গোলোকবাবু তাড়াতাড়ি কাগজ-কলম নিয়ে বসে খোলা পৃষ্ঠা থেকে একটা অঙ্ক টুকে তাকে চেনা সংখ্যায় নিয়ে এলেন। কাল্পনিক সংখ্যা যেমন, এক্স, ওয়াই, জেড চিনে নিতেও তেমন কিছু অসুবিধে হল না। কিন্তু ছেলেটা এই অদ্ভুত বইটা তাঁকে দিয়ে গেল কেন, তা গোলোকবাবুর বোধগম্য হল না। গোলোকবাবু কী ভেবে বইটা প্রকাশ্যে রাখলেন না। বিছানায় তোশকের নীচে গুজে রেখে দিলেন। চট করে যাতে কারও চোখে না পড়ে। রাতে খেয়েদেয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত মনেই শুতে গেলেন গোলোকবাবু। একটা রাত মোটে। সকালেই এই গন্ডগোলের জায়গা ছেড়ে পগারপার হবেন বলে মনটা ভালই লাগছিল তার। রাতটা ভালয়ভালয় কাটলে হয়।

কিন্তু কাটল না। পয়লা প্রগরে শেয়ালের ডাক শেষ হতে না-হতেই গোলোকবাবুর ঘুম ভেঙে গেল প্রচণ্ড শীতে। শরৎকাল, এরকম ঠান্ডা পড়ার কথা নয়। ধড়মড় করে উঠতে গিয়ে দেখলেন তিনি শূন্যে ভাসমান অবস্থায় রয়েছেন, ঠিক আগের মতোই। সামনে টেবিলের মতো কিছু ওপাশে সেই প্রকাণ্ড সাহেব। সাহেব তার তীব্র নীল দুই চোখে গোলোকবাবুকে যেন ছ্যাদা করে দিচ্ছিল। সম্পূর্ণ অচেনা এক ভাষায় সাহেব কিছু একটা বলল। আশ্চর্যের বিষয় গোলোকবাবু ভাষাটা বুঝলেন না। কিন্তু অর্থটা পরিষ্কার বুঝলেন। সাহেব বলছে, “তুমি কি অঙ্কের হাত থেকে পালাতে চাও?’

“হ্যাঁ সাহেব, আমি অঙ্ক সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ, ক্লান্ত। আমি রেহাই চাই।”

“অঙ্ক তুমি আর কতটুকু জান? ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে দাখো, ওই মহাশূন্য, ওই নক্ষত্রমণ্ডলী ওই সব কিছুই চলেছে অঙ্কের নিয়মে। প্রকৃতির ভিতরে চলেছে এক অন্তহীন জটিল অঙ্কের স্রোত। অঙ্ক ছাড়া কিছুই হয় না। এই যে তুমি জন্মেছ, একটা কেঁচো, একটা ব্যাঙ, একটা জীবাণু, একটা ইঁদুর যে জন্মায়, তার পিছনেও রয়েছে অন্তহীন হিসেবনিকেশ। বিশ্বজগতে আকস্মিক বলে কিছু নেই। আজ যে ফুলটা ফুটল, তাদের যে অঙ্কুর বেরোল, ভেবে দ্যাখো, তাও সম্ভব হচ্ছে নানা জটিল হিসেবনিকেশের ফলে। কোন উপাদান কতটা সন্নিবেশিত হলে একটা টিকটিকির জন্ম হয়, সেটাও কি অঙ্কেরই বিষয় নয়? এই যে বিশাল বটগাছ, তার ছোট্ট বীজটির মধ্যে পোরা থাকে তার প্রোগ্রাম। অঙ্ক ছাড়া কি তা সম্ভব? গোলাপফুল তোমার ভাল লাগে না? পাপড়ি মেলে যখন ফোটে, সুগন্ধ ছড়ায়, সে কি এমনি? ওই গোলাপ ফোটানোর জন্য কত হিসেবনিকেশ রয়েছে তা কি জানো? তুমি তো সামান্য অঙ্কবিদ। আমি তোমাকে যেসব অঙ্ক কষতে দিয়েছি, তা আমাদের অঙ্কশাস্ত্রের ধারেকাছেও নয়। ওগুলো সহায়ক অঙ্কমাত্র। আমরা যে সব অঙ্কের ভিতর দিয়ে আমাদের পথ তৈরি করছি, তা বোঝার সাধ্যও তোমার নেই। তুমি মুখ, তাই জান না, অঙ্কের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব।”

“ঠিক কথা, আমি সামান্যই অঙ্ক জানি। কিন্তু আপনি আমাকে দিয়ে অঙ্ক কষাচ্ছেন কেন?”

“আমরা একজনের সন্ধান করছি তুমি জান, সে অপরাধী এবং ফেরারি। তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। তুমি আমাদের সেই কাজে সাহায্য করছ।”

“সে কোথায় আছে?”

“আমাদের অনুমান কুড়ি মাইল বৃত্তের মধ্যেই সে রয়েছে।”

“সে কি আমাদের মতোই মানুষ?”

“হ্যাঁ এবং না, সে একজন শরীরী কিন্তু সংকেতময়।”

“তার মানে কী?”

“এটা বোঝার মতো মস্তিষ্কবান মানুষ তুমি নও, শুধু এটুকু জেনে রাখো, সেও একটা সূক্ষ্ম জটিল অঙ্কের ফলিত রূপ। তার কাছে পৌছতে গেলে আমাদেরও অনেক জটিল সংকেতময় পথ ধরে যেতে হবে। তাকে চোখে দেখে চেনা সম্ভব নয় কারণ, নিজের চেহারা সে অনায়াসে বদল করতে পারে।”

“শরীর মনের অনুগামী হলে অনায়াসে সম্ভব। এই যে আমি তোমার সামনে বসে আছি, তুমি দেখতে পাচ্ছ? আবার আমি যে হঠাৎ নেই হয়ে যাই, সেটা কীভাবে সম্ভব?”

“আপনার কি রক্তমাংসের শরীর আছে?”

“ঠিক রক্তমাংসের নয়, অন্য উপাদান, অনেক উন্নত উপাদান।”

“আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”

“না, স্বপ্ন দেখছ না।”

“*তা হলে এটা কি বাস্তব?”

“ঠিক বাস্তবও নয়, বলতে পার কাল্পনিক সত্য।”

“হিপনোটিজম নয় তো!”

“না, হিপনোটিজম হলে তুমি প্রশ্ন করতে না, শুধু আদেশ পালন করতে।”

“আমি কি আপনার হাতের ক্রীড়ানক?”

“প্রকৃতির নিয়মেই শক্তিমানরা আধিপত্য করে।”

“আমার কাছে আপনি আর কী চান?”

“তোমার সাহায্যে আমরা তার কাছে পৌছতে চাই। তোমাদের গ্রহবাসীদের একটা ঠিকানা থাকে, চেহারার বৈশিষ্ট থাকে, পরিচয় থাকে, তাদের চিহ্নিত করা বা খুঁজে পাওয়া সহজ। কিন্তু যারা মহাকাশে বিচরণ করে তাদের ঠিকানা নেই, চেহারা নেই, শুধু সংকেত আছে। ওই সংকেত ভেদ করার জন্য আমাদের তোমাকে দরকার। সব কিছু নির্ভর করছে অঙ্কের ফলাফলের উপর।”

“যদি তাকে পাওয়া না যায়?”

“সে ভয়াবহ পরিণতি যেন তোমাকে দেখতে না হয়।”

“সব যুদ্ধেরই কিছু আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি আছে।”

“হ্যাঁ, তাই অঙ্কটা খুব জরুরি, আমরা সেই ফেরারিটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারলেই তোমার ছুটি। তোমার পালানোর কোনও পথ নেই, মনে রেখো।”

ফের যেন চটকা ভেঙে বিছানায় উঠে বসলেন গোলোকবিহারী। ঢকঢক করে জল খেলেন। তারপর বিস্ফারিত চোখে অন্ধকার ঘরের দিকে চেয়ে রইলেন। সকালে যখন ভ্যানওয়ালা স্টেশনে জিনিসপত্র পৌছে দিতে এল, তখন গোলোকবিহারী নিবিষ্ট ভাবে তার চেয়ার টেবিলে অঙ্ক কষছেন। বিভোর অবস্থা, বাহ্যজ্ঞান নেই। স্ত্রী এসে বললেন, “কী গো, আজ যে আমরা রওনা হব। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

গোলোকবিহারী অবাক চোখ তুলে বললেন, “কোথায় যাব?”

“বাঁকুড়ায় যেতে হবে না!”

“বাঁকুড়া! বাঁকুড়াটা আবার কোথায়?”

স্ত্রী মৃন্ময়ী গোলোকবিহারীকে হাড়ে-হাড়ে চেনেন। এই লক্ষণও তার অজানা নয়। তিনি ভ্যানওয়ালাকে পয়সা দিয়ে বিদায় করে দিলেন। তারপর বাক্সপ্যাটরা খুলে গোছানো জিনিস বের করতে লাগলেন।