৪
লোকে তার সম্পর্কে উলটোপালটা নানা কথা কয় বটে, কিন্তু বিশ্বেশ্বর জানে, তার প্রাণে মায়াদয়া আছে। সে সকালে কাককে বাসি রুটি খাওয়ায়, দুপুরে পাতের ভাত নেড়ি কুকুরদের দেয়, কাঙাল ভিখিরিদেরও ফেরায় না। জমিজমার মামলায় হাজিরা দিতে এক সকালে মোটরবাইকে চেপে সদরে যাচ্ছিল বিশ্বেশ্বর। তখনই বড় ঝিলের ধারে একটা শিমূল গাছের তলায় ভারী রোগা চেহারার ল্যংব্যাগে ছেলেটাকে দেখতে পায় সে। চুপ করে বুকে হাঁটু জড়ো করে বসে আছে। মুখ দেখলেই বোঝা যায় পেটে দানাপানি নেই। তাড়া ছিল বলে বিশ্বেশ্বর আর দাঁড়ায়নি। কাছারি সারতে বেলা গড়িয়ে গেল। ফেরার সময় সন্ধে হয়-হয়। তখনও দেখে সেই ছোকরা একইরকম ভাবে বসে আছে। এক চুল নড়েনি। পরনে একটা সাদা খোলের মতো বেঢপ পোশাক। জামাপ্যান্ট জোটেনি বলেই বোধ হয় বালিশের খোলই গায়ে চাপিয়ে লজ্জা নিবারণ করেছে। বিশ্বেশ্বর বাইক থামিয়ে হাতছানি দিয়ে ছোকরাকে ডাকল। ছেলেটা কেমন যেন একটু টাল খেয়ে উঠে দাঁড়াল। বয়স ষোলো-সতেরোর বেশি হবে না। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গায়ের রংটা ফরসার দিকে। ল্যাকপ্যাক করতে-করতে এগিয়ে এল। কাছে এসে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিল।
“নাম কী তোর?”
ছেলেটা যেন প্রশ্নটা বুঝতেই পারল না। আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ কী যেন একটা বলল। শোনাল অনেকটা যেন, “পাউচিই।”
“কোথায় বাড়ি তোর? এখানেই বা বসে আছিস কেন?”
ছেলেটা কাহিল মুখে ভারী গোলমেলে একটা ভাষায় খানিকক্ষণ কী যেন বলে গেল, তার এক বিন্দুও বুঝল না বিশ্বেশ্বর। অনুমান করল, ছোকরা বাঙালি নয়। কেরল বা তামিলনাডুর হবে। তার বাড়িতে কাজের লোকের অভাব আছে। এই ছোকরাকে নিয়ে গেলে সুবিধে হতে পারে। ছেলেটাকে বাইকের পিছনে বসিয়ে নিয়ে এল বিশ্বেশ্বর। দেখা গেল, ভারী শান্ত আর ভীষণ ভিতু ছেলে। চোখে সর্বদা ভয়-ভয় ভাব। বাইরের চেয়ে ঘরের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে। কোনও জোরালো শব্দ শুনলে চমকে ওঠে। কেউ তাকে ডাকলে কেমন যেন থতমত খায়। চেহারাটা দুর্বল আর রোগা বলে বিশ্বেশ্বরের বাড়ির লোকেরা তাকে শক্ত কাজকর্ম দিত না। ফাইফরমায়েশ খাটত। কিন্তু ভাষা বুঝতে পারত না বলে বাটা আনতে বললে বালতি এনে হাজির করত।
চৈত্র মাসের ঝড়ে উঠোনের পাশেই একটা বড় জাম গাছ উপড়ে পড়েছিল। গাছটা কেটে সরিয়ে নেওয়া হলেও গাছের মস্ত গুড়িটা যাতায়াতের পথটা খানিক আটকে রেখেছিল। সেদিন বিশ্বেশ্বরের মেজো ভাই তাড়াহুড়োয় গুড়িটায় পা আটকে পড়ে হাত ভাঙল। হইচই শুনে চাকরদের ঘর থেকে বেরিয়ে এল পাঁচু। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা নীরবে দেখল। তারপর হঠাৎ ল্যাকপ্যাক ভঙ্গিতেই এগিয়ে এসে তার রোগা দু’খানা হাতে বিশাল গাছের গুড়িটা ধরল এবং বিনা কসরতে, একটুও কষ্ট না করেই ধাঁ করে কয়েক মণ ওজনের গুড়িটা তুলে নিয়ে বাগানের বেড়ার ধারে রেখে এল। বাড়ির মেয়েপুরুষ সবাই হা করে বাক্যহারা হয়ে দৃশ্যটা দেখল! বিশ্বেশ্বরের মা আতঙ্কিত গলায় বললেন, “ও বাবা বিশু, এ তো মনিষ্যি নয়! কোন অপদেবতাকে ঘরে নিয়ে এলি বাবা?”
পরের কাণ্ডটা ঘটল মাসখানেক বাদে। বিশ্বেশ্বরের সেজো ভাই কাশীশ্বরের ছেলের অন্নপ্রাশনের দিন ঠিক করতে ঠাকুরমশাই হরপ্রসন্ন চক্রবর্তী এসেছিলেন। তিনি বিদায় নেওয়ার পর দেখা গেল, ছাতাখানা ভুল করে ফেলে গিয়েছেন। কাশীশ্বরের বউ মাধবী তাড়াতাড়ি ছাতাখানি পাঁচুকে দিয়ে বলল, “যা ভাই পাঁচু, ওই যে ঠাকুরমশাই মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছেন, দৌড়ে গিয়ে ছাতাখানা দিয়ে আয়।”
দৃশ্যটা জীবনে কখনও ভুলবে না মাধবী। ঠাকুরমশাইকে অন্তত সিকি কিলোমিটার দূরে দেখা যাচ্ছিল। মাধবী বোধ হয় দু কী বড় জোর তিনবার চোখের পলক ফেলেছে, দেখতে পেল পাঁচু ঠাকুরমশাইয়ের ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে ঠিক ফের দুই কি তিন পলকের মধ্যে ফিরে এ বাড়িতে। মাধবী পাঁচুর হাতটা ছুয়ে বলল, “হ্যাঁ রে, তুই সত্যিই মানুষ তো! বেহ্মদত্যি নোস তো ভাই?”
রোজই বিকেলে পাশের মাঠে ফুটবল খেলা হয়। ওই সময়ে পাঁচু গিয়ে খুব কৌতুহলেল সঙ্গে প্রায়ই খেলা দেখে। দিনদশেক বাদে একদিন একটা ছেলে তাকে বলল, “খেলবি?”
পাঁচু এক গাল হেসে রাজি। কিন্তু সে মাঠে নামার পর সব কিছু যেন তছনছ হয়ে গেল। পাঁচুকে আটকানো দূরে থাক, তার দৌড়ের সামনে প্রতিপক্ষ খড়কুটোর মতো উড়ে যাচ্ছিল। শটের জোর এমনই সাঙঘাতিক যে, এ গোলকিপারের হাটু ভাঙল, গোলপোস্টে দেখা দিল চিড়। ম্যাচটায় একাই চার-চারটে গোল করল পাঁচু। সেই দিনই গুপ্তিপাড়ায় হইহই। ক্লাবঘরে মিটিং বসে গেল আর সেই মিটিংয়ে বিশ্বেশ্বরকে তলব করে নিয়ে যাওয়া হল, আগের দিনই গদাধর লিগের খেলায় কুঞ্জপুরের কাছে গুপ্তিপাড়া পাঁচ গোলে হেরে এসেছে। ফলে সকলেরই মন-মেজাজ খারাপ ছিল। মাতব্বরদের একজন গুপি সরকার বলল, “এমন একটা ট্যালেন্টকে কি লুকিয়ে রাখতে হয় হে?”
বিশ্বেশ্বর বলল, “আজ্ঞে লুকিয়ে তো রাখিনি! নতুন এসেছে, তার উপর বেজায় লাজুক।”
“তা একে পেলে কোথায়?”
বিশ্বেশ্বর বুদ্ধিমান লোক। পাঁচুর এলেম দেখে সে আগে থেকেই একটা সম্পর্ক এঁচে রেখেছিল। বলল, “পাব আর কোথায়! পাঁচু আমার ভাইপো।”
অনিল ঘোষ ভারী অবাক হয়ে বলল, “ভাইপো! বলো কী হে? তোমার ভাইপো হলে তামিল, তেলুগু ভাষায় কথা কয় কেন?”
“আজ্ঞে আমার মাসতুতো দাদার ছেলে। তামিলদেশেই মানুষ কিনা।”
কথাটা কারও তেমন বিশ্বাস হল বলে মনে হল না। তবে আর কথাও বাড়াল না কেউ।
গুপি সরকার গম্ভীর হয়ে বলল, “মুখের কথা দিয়ে কী হবে, পা কথা কইলেই হল। আমাদের প্লেয়ার দরকার, প্রোফেসর তো নয়।”
বাড়ির বুড়োকর্তা সনাতন হাওলাদার বহুকাল আগেই গৃহত্যাগ করেছে বটে, তবে খুব একটা বেশি দূর যেতে পারেনি। বাড়ির পিছনের দিকে বাঁশবন, সেটা পেরলেই পারিবারিক পুকুর আর পুকুরের ওধারেই সনাতন হাওলাদারের সাধনপীঠ। নিরিবিলি জায়গা। চারদিকে ঝোপঝাড়, বনবাদাড়। জপতপের পক্ষে আদর্শ জায়গা।
তেমনই আবার অনেকের বিশ্বাস, সনাতন স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল লয় করে দিতে পারে। সে শূন্যে ভেসে থাকে, জলের উপর হাঁটে, ভূতপ্রেত এসে তার চাকর খেটে যায়। মারণ-উচাটন-বশীকরণে নাকি সনাতন সিদ্ধাই সিদ্ধহস্ত। তা বলতে নেই, সনাতনের বেশ কিছু চেলাচামুণ্ডা আছে। আর কবচ, মাদুলি, জলপড়া, ধুলোপড়া, ভাগ্যবিচার এসবের জন্যও তার সাধনপীঠে বেশ ভিড় হয়। দোহাত্তা রোজগার। সবকিছু সামাল দেয় সনাতনের দুই চেলা কালী আর বটু।
সেদিন একটু রাতের দিকে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে সনাতন জপতপ করছিল। রোজই সনাতনের সঙ্গে প্রেতলোকের যোগাযোগ হয়। কাছেপিঠে যারা থাকে, তারা নাকি এসময়ে বাতাসে বোটকা গন্ধও পায়। জপ করতে-করতে সনাতনের হঠাৎ সেদিন কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। চারদিকে কেমন যেমন গুমোট থমথমে ভাব। জপ চালু রেখেই বা চোখটা সিকিভাগ খুলে সনাতন দেখতে পেল, অন্ধকারে সাদা মতো কী সব যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। ধোঁয়া বলেই মনে হল তার। সনাতন হেঁকে বলল, “কালী, গাঁজা খাচ্ছিস নাকি? ধোঁয়া কীসের?”
“আজ্ঞে না বাবা, গাঁজা বহুকাল ছেড়ে দিয়েছি। ধোঁয়া তো দেখতে পাচ্ছি না বাবা!”
সনাতন ফের চোখ বুজে জপ করতে-করতে সন্দেহবশত চোখ খুলে আঁতকে উঠে দেখল, সুমুখে বাতাসে একটা সাদা, ধোঁয়াটে ত্রিভুজ ভেসে আছে।
“বাপ রে!” বলে চেঁচিয়ে আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল সনাতন। দাওয়ায় কালী আর বটা শুয়ে ছিল। তারা ধড়ফড় করে উঠে বসে বলল, “কী হল বাবাঠাকুর?”
“ভূত। ভূত!”
ত্রিভুজটা বাতাসে একটু হেলদোল খেল, তারপর মিলিয়ে গেল। কালী আর বটা এসে তাকে ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল, “বাবাঠাকুরের বোধ হয় আজ জপতপ করতে-করতে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। স্বপ্নই দেখেছেন বোধ হয়।”
সনাতন খুব একটু প্রতিবাদ করল না। চার-পাঁচদিন পর সনাতন রাতের দিকে বসে একটা বগলামুখী কবচ তৈরি করছিল। শরৎকাল। বাতাসে একটু হিম ভাব আছে। চারদিকে গাছপালা আর পুকুর থাকায় একটু কুয়াশাও হয় জায়গায়। বেশ একটু গা ছমছমে ভাব। কোনওদিন করে না, কিন্তু আজ কেন যেন সনাতনের একটু গা ছমছম করছিল। হঠাৎ বাইরে কালীর চিৎকার শোনা গেল, “বাবাঠাকুর। শিগগির আসুন!”
সনাতন আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে এসে তাজ্জব হয়ে দেখল, উঠোনের অন্ধকারে নানা আকৃতির সাদা আঁকিবুকি ভেসে বেড়াচ্ছে। গোল, লম্বা, চৌকো, দড়ির মতো পাকানো, হিজিবিজি নকশা, চন্দ্রবিন্দু। সনাতন আতঙ্কে বাক্যহারা। চোখের পলক পড়ছে না।
কালী আর বটা সমস্বরে চেঁচেয়ে উঠল, “জয়, বাবাঠাকুরের জয়। আজ আপনার মহিমা টের পেলাম বাবা!” বলে কালী আর বটা সনাতনের পায়ের উপর ধড়াস ধড়াস করে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ল।
“ওঃ কী দৃশ্যই দেখালেন বাবাঠাকুর।”
নিজের মহিমা তেমন টের পাচ্ছিল না সনাতন। বরং ভয়ে তার গলা শুকনো, বুকে দুরদুরুনি। যদি তার জপতপের ফলেই এই অশৈলী কাণ্ড ঘটে থাকে, তা হলে কাল থেকেই জপতপ কমিয়ে দিতে হবে। খুব কমিয়ে দিতে হবে।
পাঁচু সম্পর্কে হাওলাদারদের বাড়ির লোকেদের নানারকম মনোভাব। বিশ্বেশ্বরের মা নবনীবালা পাঁচুকে নিজেদের ঘরদোরে ঢুকতে দেন না। পাঁচুর ছোঁয়া জিনিস খান না। বলেন, “ও বাবা, যদি গুণ-টুন করে দেয়? ওই রোগা ছেলের গায়ে অত জোর হয় কখনও, ঘাড়ে বেহ্মদত্যি না চাপলে? ওকে বরং শ্বশুরমশাইয়ের সাধনপীঠে পাঠিয়ে দাও। শুনেছি সেখানে ভূতপ্রেতের রাজত্ব।
বাড়ির ছোটদের কাছে পাঁচু একজন হিরো। সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানের মতোই কেউ। তারা পাঁচুর কাছে হিরো হওয়ার কায়দাকানুন শিখতেও চায়। কিন্তু পাঁচু বড্ড চুপচাপা। তার কথা তো বোঝবার উপায় নেই এবং সে কারও সঙ্গে বিশেষ মেলামেশাও করতে চায় না। ছাদের একখানা একটেরে ঘরে একা থাকে। কেউ ঘরে এলে বিশেষ খুশি হয় না পাঁচু ভয়ও পায়। সে যে বেজায় ভিতু ছেলে, এটা সবাই জেনে গিয়েছে। এই বাড়ির বউ মাধবীর সঙ্গেই পাঁচুর যা একটু ভাব। রোগা, ভিতু ছেলেটার উপর মাধবীর একটু মায়া পড়ে গিয়েছে। যখনই সে ছাদের ভেজা কাপড়জামা মেলতে আসে, তখনই পাঁচুর সঙ্গে একটু কথা কয়ে যায়।
“ও ভাই পাঁচু, সকালে পেট ভরে পান্তাভাত খেয়েছিস তো!”
পাঁচু কি বোঝে কে জানে, তার ভাষায় একটা জবাবও দেয়।
জবাবটা ‘হ্যা’ না ‘না’ তা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু মাধবী তাতে দমে যায় না। বলে, “হ্যাঁ রে পাঁচু, এ বাড়িতে তোর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো! হলে আমাকে বলিস।”
পাঁচু তার ভাষায় কিছু বলে। মাধবী তখন বলে, “হ্যাঁ রে, তোর গায়ে এত জোর। তুই এত ভাল ফুটবল খেলিস, তা হলে তুই এত ভিতু কেন বল তো! মেঘ চমকালে ডরাস, বাসনের শব্দ হলে ডরাস, কেউ চিৎকার করলে ভয় পেয়ে যাস! তোর কীসের এত ভয় বল তো বোকা ছেলে!”
এইভাবে কেউ কারও কথা না বুঝেও তাদের মধ্যে দিব্যি গল্পসল্প হয়। রোজ।
“বুঝলি পাঁচু, আমার দাদাশ্বশুর সনাতন হাওলাদার মস্ত সিদ্ধাই। ওই পশ্চিমধারে পুকুরের ওপাশে তার আখড়া। তা ক’দিন হল সেখানে নাকি রাতে খুব ভূতের উপদ্রব হচ্ছে। লোকজন সব দল বেঁধে দেখতে যাচ্ছে। আমরাও আজ যাব। তুই যাবি? তা হলে তোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ভূত দেখেছিস কখনও? আমি ভাই দেখিনি। কিন্তু খুব ভয় পাই।”
পাঁচু জবাবে কী সব যেন বলে যায়। এরকম কথাবার্তা হতে-হতে একদিন মাধবী বলল, “হ্যা রে পাঁচু, আমার কাছে বাংলা শিখবি? তোর সঙ্গে কথা কয়ে যে সুখ হচ্ছে না! ভাবছি, কাল থেকে তোকে বাংলা বলা শেখানো শুরু করব।
পাঁচু হঠাৎ বলল, “জানি তো!”
মাধবী উর্ধ্বমুখ হয়ে একটা ভেজা শাড়ি মেলছিল। জবাব শুনে অবাক হয়ে চারদিকে চেয়ে পাঁচুকে বলল, “কে কইল রে কথাটা?”
“আমি।”
মাধবী চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই। ওমা! তুই কী করে বাংলা শিখে গেলি?”
“শুনে শুনে।”
“এত অল্পদিনে। হ্যাঁ রে পাঁচু, তোর তো খুব বুদ্ধি। যাই, এক্ষুনি খবরটা সবাইকে বলে আসি।”
“না, কাউকে বোলো না। আমি কথা বলতে ভালবাসি না।”
“ওমা! কেন রে? আমি তো বাপু, কথা না বলে এক দণ্ড থাকতে পারি না।”
“তা হলে কি আমার সঙ্গেও আর কথা কইবি না ভাই?”
“শুধু তোমার সঙ্গে বলব। আর কারও সঙ্গে নয় কিন্তু।”
“ঠিক আছে, তাই হবে। এখন বল তো তোর পুরো নামটা কী?”
“আমার নাম কিন্তু পাঁচু নয়। পাউ চি ই৷”
“ওমা! ও আবার কেমনধারা নাম? তুই কি চিনেম্যান নাকি?”
“না। এটা ঠিক নাম নয়। একটা সংখ্যা, একটা পরিচয়, একটা ম্পন্দন।”
“ও বাবা! ওরকম শক্ত-শক্ত কথা বললে কি আমি বুঝতে পারি? সোজা করে বল না।” “
পা উ চি ই হল একটা সম্পূর্ণ পরিচয়। শুধু নাম নয়।”
“তা হ্যাঁ ভাই, তুই কি তামিল?”
“না। আমি একজন সাংখ্য। আমাদের চিহ্ন হল মাহা।”
“ও পাঁচু। আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
পাঁচু হাসল। বলল, “ঠিক আছে। তোমার কাছে আমি শুধু পাঁচু।”
“বাঁচালি ভাই, কী সব বলছিলি, আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। হ্যাঁ রে, তোর বাড়ি কোথায়, বাড়িতে কে-কে আছে, বলবি না?”
“না। বললে তোমার মাথা আরও ঝিমঝিম করবে।”
“তা হলে থাক। তুই বোধ হয় আমাদের মতো নোস।”
“না। আমি তোমাদের মতো নই।”
“হ্যাঁ রে, তুই সব সময়ে অত ভয়ে-ভয়ে থাকিস কেন? তুই কি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস?”
“না। আমাকে যারা খুঁজছে, তারা পুলিশের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।”
“ও বাবা! শুনেই যে আমার ভয় করছে। তা হলে কী হবে রে পাঁচু? তোকে ধরে নিয়ে যাবে?”
“ওইরকমই কিছু।”
“বডড হেঁয়ালিতে কথা বলিস তুই বুঝিয়ে বলবি তো!”
“তোমার দাদাশ্বশুরের আখড়ায় রাতে যা দেখা যায়, সেগুলো ভূত নয়।”
“তা হলে কী?”
ওটা হল এক ধরনের জাল। নম্বর, অঙ্ক, প্রতীক, চিহ্ন আর স্পন্দনের জাল। ওরকম জাল ওরা চারধারে ছড়িয়ে দিচ্ছে।”
“কীসের জাল বললি?”
“তুমি বুঝবে না। ওই অঙ্ক আর সঙ্কেত ছাড়া ওরা আমাকে খুঁজে পাবে না। শুধুমাত্র অঙ্কের ভিতর দিয়েই ওদের আমার নাগাল পেতে হবে। কিন্তু কাজটা অত সহজ নয়।”
“আর বলিস না ভাই। আমি এবার অজ্ঞান হয়ে যাব।”