৩
মনসা ভট্টাচার্য লোকটা ভাল না খারাপ, এটা নিয়ে মানুষের ধন্দ আছে। তবে মনসারাম যে অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি, তাতে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই। পুঁথিপত্র নিয়েই থাকেন বটে, কিন্তু চোখে ঈগলের মতো নজর। কান সর্বদা সজাগ। ঘ্ৰাণেন্দ্রিয় প্রখর। বিড়াল হেঁটে গেলেও শব্দ পান। লোকে বলে গুপ্তিপাড়ার কোন গাছে কটা পাতা আছে, তাও মনসারামের নখদর্পণে। গাঁয়ে একজন বিচক্ষণ মানুষ থাকলে লোকে তার বুদ্ধিপরামর্শ নিতে আসবেই। তাই মনসাপণ্ডিতের কাছে মানুষের যাতায়াতের অভাব নেই। এমনকী চোর-ছ্যাচড়রাও নাকি গোপনে শলাপরামর্শ করে যায়। মনসাপণ্ডিত কাউকে ফেরান না। সকলের জন্যই অবারিত দ্বার। সেদিন রাতের দিকে বসে মনসারাম একটা প্রাচীন পুঁথি থেকে পাঠ উদ্ধার করছিলেন, এমন সময় সামনের বন্ধ জানলার ওপাশে একটু মৃদু গলাখাকারির শব্দ হল।
মনসা বললেন, “কে রে?”
অতিশয় মোলায়েম গলায় কে যেন বলল, “পণ্ডিতমশাই কি জেগে আছেন?”
“আছি।”
“আজ্ঞে আমি বেচারাম প্রামাণিক।”
“তা কী মনে করে?”
“আজ্ঞে মুশকিলে পড়ে একটু সাহায্যের জন্য আসা।”
“সাহায্য? কী রকম সাহায্য বাপুঃ টাকাপয়সা নাকি?”
“ব্রাহ্মণেরটা নিলে অখণ্ড নরকবাস। আজ্ঞে না ঠাকুরমশাই। একটা জিজ্ঞাসা ছিল। আজকের তিথিটা কি জানা আছে ঠাকুরমশাই?”
“না জানার কী? আজ নবমী। কৃষ্ণপক্ষ।”
“তাই বলুন। তা ঠাকুরমশাই, কৃষ্ণনবমীতে কি আকাশে জ্যোৎস্না ফোটার কথা?”
“পাগল নাকি? কৃষ্ণনবমীতে জ্যোৎস্না ফুটবে কেন?”
“তা হলে তো বড় মুশকিল হল মশাই! কুলতলির মাঠ দিয়ে আসতে আমি যে স্পষ্ট দেখলুম, সামনের মাঠ জুড়ে এক বাটি পায়েসের মতো জ্যোৎস্না ফুটফুট করছে!”
“নেশাভাং করলে ওরকম কত কী দেখা যায়।”
“ছোট মানুষদের মুশকিল কী জানেন, তাদের কথায় কেউ আমল দিতে চায় না। তা ঠাকুরমশাই, আমি না হয় ভুল দেখেছি, কিন্তু পাদ্রিসাহেবের তো ভুল হওয়ার কথা নয়।”
“পাদ্রিটা আবার কে হে?”
“আজ্ঞে মস্ত মানুষ, মাথায় টাক, মাঠেঘাটে প্রায়ই দেখা যায়।”
“ওহে বেচারাম, আমি বলি কী, বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, নেশাটা তোমার মাথায় চড়ে গিয়েছে।”
“তাই যাচ্ছি ঠাকুরমশাই, তবে কিনা কথাটা বিশ্বাস করলেও পারতেন।”
বেচারাম প্রামাণিক নামে কাউকে চেনেন না মনসাপণ্ডিত। মোদো মাতাল হবে ভেবে তার কথাটা আর মনেও রাখেননি।
কয়েকদিন বাদে বিষয়কর্মে বেরিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে এক যজমানের বাড়িতে গিয়ে হাজির। যজমানের মেয়ের বিয়ে, তার দিন তারিখ ঠিক করতে হবে। কাজ সেরে ডাবের জল খেয়ে উঠতে গিয়ে খেয়াল হল, এ বাড়ির একরকম পাশেই কুলতলির মাঠ। জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে কৌতুহলের সঙ্গে বললেন, “ওটা কুলতলির মাঠ না?”
যজমান বলল, “আজ্ঞে বটেই তো বাবাঠাকুর। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন কেন?”
“না, এমনিই।”
“না বাবাঠাকুর, এমনি নয়। আপনি সাধক মানুষ। নিশ্চয়ই কিছু টের পেয়েছেন।”
“কী টের পাব?”
“ক’দিন আগে মাঝরাত্তিরে হঠাৎ কুলতলির মাঠে খুব আলো হল। সে এমন আলো যে, পুন্নিমেকে হার মানায়! আমরা তো ভয়ে জড়সড়।”
মনসারাম গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছু বললেন না। দিন দশ-বারো পর আবার এক রাতে জানালার ওপাশে খুক করে একটু গলাখাকারির শব্দ।
“কে রে?”
“ঠাকুরমশাই কি জেগে আছেন?”
“বেচারাম প্রমাণিক নাকি হে!”
“কী ভাগ্যি আমার, চিনতে পেরেছেন!”
“দাঁড়াও বাপু। দরজা খুলে দিচ্ছি। ভিতরে এসো।”
“দিনকাল ভাল নয়, ঠাকুরমশাই। যাকে তাকে হুট করে ঘরে ঢুকতে দেওয়া উচিত হবে না। তা ছাড়া আপনি শুদ্ধাচারী মানুষ, আমাদের মতো পাপী-তাপীদের হাওয়া-বাতাস আপনার গায়ে লাগা ঠিক নয়।”
“ও বাবা! তোমার যে জ্ঞানের নাড়ি টনটনে!”
“কী যে বলেন ঠাকুরমশাই। জ্ঞানের অভাবেই তো আমাদের যত দুৰ্গতি। তা ঠাকুরমশাই, অভয় দেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করি।”
“বলে ফ্যালো।”
“এই ধরুন সিদ্ধিদাতা হলেন গিয়ে গণেশ। লেখাপড়ার দেবতা হলে মা সরস্বতী। পয়সাকড়ির হলেন মা লক্ষ্মী। তা জানতে বড় ইচ্ছে করছে, চুরিবিদ্যের কি কোনও দেবতা নেই?”
“কেন হে বাপু তুমি কি চোর নাকি?”
“তা ধরুন যদি তাই হয়ে থাকি?”
“তা হলে তুমি চোরের সমাজের কুলাঙ্গার! চোর হয়ে চোরের দেবতার নাম জান না?”
“আজ্ঞে সেই পাপেই তো সুযোগ-সুবিধে করে উঠতে পারছি না ঠাকুরমশাই। সুযোগে হাতের মুঠোয় এসেও পাকাল মাছের মতো পিছলে যাচ্ছে।”
“কীরকম?”
“গেল হস্তায় খগেন গোঁসাই গোরু কিনবে বলে দশটি হাজার টাকা তুলে এনে আলমারিতে রেখেছে বলে পাকা খবর ছিল। রাত দেড়টা নাগাদ গিয়ে দেখি সেখানে শ্রদ্ধাস্পদ গিরিজা হাড়ি হাজির। নামডাকওয়ালা মানুষ। তার উপর গুরুজন বলে আমি পেন্নাম করতেই খুব অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “বাপু রে, তোদের উঠতি বয়স। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। আর আমাদের তো দিন শেষ হয়েই এল। চোখে ছানি পড়বে, হাঁটুতে বাত ধরবে, হাত কাঁপবে। বুঝলি কিনা, বড় মুশকিলে পড়েছি রে বাপু সামনের মাসেই আমার শালির বিয়ে। গিন্নি ধরেছে, বিয়েতে এক ছড়া হার দিতে হবে। তা কী আর করি বলুন, শত হলেও গুরুজন। তাই বললুম, এ আর বেশি কথা কী, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, অগ্রাধিকার আপনার। গত বুধবার শিবেন বৈরাগীর বাড়িতে বিরাট দাঁও ছিল মশাই। কিপটে শিবেন গত দশ বছর ধরে মেয়ের বিয়ের সোনাদানা কিনছে। তিরিশ-চল্লিশ ভরি হবে বোধ হয়। বুধবার বৈরাগীরা সব উদয়পুরে নেমস্তন্ন বাড়িতে গিয়েছে, বাড়িতে শুধু বুড়ি মা। সুবর্ণ সুযোগ আর কাকে বলে। ছাদের সিঁড়ির দরজা ফাঁক করে ঢুকে দেখি হাসি-হাসি মুখ করে ফটিক তাম্বুলি বেরিয়ে আসছে। আমাকে দেখে বলল, ‘তুই কী মনে করে? আমি তো সব চেছেপুছে নিয়ে এলুম। আগে যদি বলতিস, তা হলে না হয় খুদকুড়ো একটু পেসাদ বলে রেখে আসতুম। ভদ্রতা করেই বলতে হল, না-না খুড়ো, আপনাদের কোলেপিঠেই তো বড় হয়েছি।” বিদ্যাধরপুরের সতীশ বাশুই তো তিসির তেল বেচে মাসটাক আগে দেড় লাখ টাকা পেয়েছে। পায়ের কাছে সিন্দুকে রাখা। সুলুকসন্ধান সব জানা। রাত দুটোর সময় গিয়ে দেখি, পথ পরিষ্কার, কোথাও কোনও বাধা নেই। খিড়কির দোর সবে খসাতে যাব, ঠিক এই সময়ে পিছন থেকে ক্যাঁক করে ঘাড়টা কে যেন চেপে ধরে বলল, “এই, ঘরে ঢুকেছিস যে বড়! তুই কি ভূমিপুত্তুর? বড় রাগ হল মশাই। সকালেও দেখেছি বিদ্যাধরপুরের একটা কাক এসে গুপ্তিপাড়ার মরা ইঁদুর মুখে করে নিয়ে গেল। গুপ্তিপাড়ার কোকিল গিয়ে বিদ্যাধরপুরে গান শুনিয়ে আসে। পাশাপাশি ভাইবোনের মতো দুটি গ্রাম। খাড়াখাড়ি কীসের? তা জাম্বুবানটা কোনও কথাই কানে তুলল না। রাদ্দা দিয়ে বের করে দিল। তাই বলছিলাম আজ্ঞে, সময়টা ভাল যাচ্ছে না, একটু ঠাকুর-দেবতাকে ডেকে দেখি।”
“তা ডেকে দেখতে পার। চোরের দেবতা হল কার্তিক। একথা আনাড়ি চোরও জানে।”
“বড্ড উপকার করলেন কর্তা। দেবদ্বিজে ভক্তি না থাকলে কোন কাজটা হয় বলুন!”
“তা বটে।”
“আর একটা ধন্দে পড়েছি। সেইটে একটু নিবেদন করি?”
“স্বচ্ছন্দে।”
“প্রথমে পাশাপাশি দুটো ফুটকি। তারপর একটা চতুর্ভুজ, তারপর উপর নীচে তিনটে তারা, দুটো ঢ্যাঁড়া, বাঁকা চাঁদ… কেন্নার মতো পাক খাওয়া একটা গোল চিহ্ন, তারপর একটা তিরচিহ্ন, আর তারপরেই একটা ত্রিভুজ। ব্যাপারটা কিছু বুঝলেন?”
“না হে বাপু, মাথায় তো কিছুই সেঁধল না। এ জিনিস কোথায় পেলে?”
“সেইটেই তো ভাবনার কথা ঠাকুরমশাই। আচ্ছা, এটা কি কোনও অঙ্ক? নাকি কোনও সাংকেতিক ভাষা বলে মনে হচ্ছে?”
“ভেবে দেখতে হবে হে৷”
“একটু ভাবুন ঠাকুরমশাই। আজ তা হলে আসি।”
তা ভাবলেন মনসারাম। ভেবে আর-একবার মনে হল, বেচারাম লোকটা আসলে পাগল। কিন্তু আরও একটু ভাবতে গিয়ে মতটা পালটাতে হল। পাগল নয়, বেচারাম খুবই সেয়ানা। হেঁয়ালি জিনিসটা মনসারামের অপছন্দ নয়। একটা কাগজে তিনি হেঁয়ালিটা লিখেও ফেললেন। দুটো ফুটকি, একটা চতুর্ভুজ, তিনটে তারা, দুটো ঢ্যাঁড়া, বাঁকা চাঁদ, কেন্নোর মতো পাক খাওয়া বৃত্ত, তীরচিহ্ন, ত্রিভুজ। গুপ্তধনের সংকেত হওয়া বিচিত্র নয়। নয়তো লোককে বোকা বানানোর ফন্দি। ভ্রু কুঁচকে হেঁয়ালিটার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন মনসাপণ্ডিত।
আজ সকালে উঠে গোলকাবিহারী হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েছেন। আর হাঁটা বলতে বাবুয়ানি হাঁটা নয়। খানিকটা দৌড়, খানিকটা হাঁটা, আবার দৌড়। কুলতলির মাঠ পেরিয়ে, বনবাদাড় ঠেঙিয়ে, বিদ্যাধরপুর ছাড়িয়ে কোথায়-কোথায় যে চলেছেন, তা নিজেও বুঝে উঠতে পারছেন না। শুধু এটা বুঝতে পারছেন যে, তার পেটে বায়ু হচ্ছে। আর বায়ু থেকে উর্ধ্ববিকারে তার মাথা বিগড়ে যাচ্ছে। এবং ফলে তিনি ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন দেখছেন। আর এই সবের জন্য দায়ী হল অঙ্ক। অঙ্কের নেশা ছাড়তে না পারলে তিনি বোধ হয় পাগলই হয়ে যাবেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা অঙ্ক তাকে রেহাই দিচ্ছে কই? যেখানে চোখ পড়ছে সেখানেই ওয়ান, টু, থ্রি, এক্স, ওয়াই, জেড, আলফা, থিটা, গামা, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত, উপবৃত্ত দেখতে পাচ্ছেন। ঘাসে, মাটিতে, গাছের ডালে, পাতায়, আকাশে মেঘের আকৃতির মধ্যে। এমনকী, পাখির ডাক, বাতাসের শনশন বা জঙ্গলের মর্মধ্বনি তার মধ্যেও চোরা অঙ্কের ফিসফাস। পালানোর কি জায়গা নেই তার? অঙ্কের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলে যে তিনি মারা পড়বেন।
জীবনে এক লপ্তে এত হাটেননি গোলোকবাবু। আসলে অঙ্কের নেশায় তার প্রাতঃভ্রমণ বা সান্ধ্যভ্রমণ হয় না। নড়াচড়া করা তার বিশেষ পছন্দের ব্যাপার নয়। সারাদিন ঘাড় গুজে অঙ্কে ডুবে থাকাতেই তার যত আনন্দ। আর সেই জন্যই কি প্রকৃতি আজ প্রতিশোধ নিতে লেগেছে? হাঁটতে-হাঁটতে হাঁপিয়ে পড়েছেন গোলোকবাবু। ঘাসে জামা-গেঞ্জি ভিজে সপসপ করছে। শরীরের গাটে-গাটে ব্যথা, পায়ে ফোস্কা। তবু মাথা ঠান্ডা হচ্ছে না। তার আশপাশে হাওয়ায় যেন আঁশের মতো অঙ্ক ভেসে বেড়াচ্ছে, পায়ের ফাঁকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে খরগোশের মতো। কী জ্বালা!
নিতান্তই হেদিয়ে পড়ায় একটা গাছের তলার ছায়াতে বসে হ্যা হ্যা করে দম নিচ্ছিলেন গোলোকবাবু। হঠাৎ নজরে পড়ল সামনে ধুলোর উপর বিস্তর আঁকিবুকি। আর সর্বনেশে ওই সব আঁকিবুকির ভিতর থেকে লুকোনো অঙ্ক টুকি দিচ্ছে যেন। হ্যাঁ, ওই তো এক্স টু দ্য পাওয়ার থারটিন মাইনাস ওয়াই… তড়িঘড়ি উঠে আবার হাঁটা লাগালেন গোলোকবাবু। না, আর পেরে উঠছেন না তিনি। এই পরিণতি হবে জানলে তিনি জীবনে অঙ্কই শিখতেন না। অঙ্ককেই জীবনে সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে করতেন তিনি। সেই বন্ধুই যে ক্রমশ শক্র হয়ে দাঁড়াবে তা কে জানত! দুনিয়ায় কাউকেই বিশ্বাস নেই! যখন বেশ একটু বেলার দিকে বাড়িতে ফিরলেন, তখন বাড়ির লোক সবাই উদ্বেগে বাইরে এসে জড়ো হয়েছে। পাড়ার লোক বেরিয়ে পড়েছে তাকে খুঁজতে। তাকে দেখেই সবাই সমস্বরে প্রশ্ন ছুড়তে শুরু করল, “কোথায় গিয়েছিলে? কেন গিয়েছিলে? এত দেরি হল কেন?”
গোলোকবাবু কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারলেন না। শুধু হাঁপাতে-হাঁপাতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। দু’-তিন গ্লাস জল খেয়ে পাখার হাওয়ায় একটু ধাতস্থ হলেন। সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, “নাঃ, ভাবছিলাম, এখন থেকে একটু মর্নিং ওয়াক করা দরকার। তাই…”
জড়ো হওয়া লোকজনের ভিতর থেকে মনসারাম এগিয়ে এসে বললেন, “ওহে গোলোক, সকালে একটু দরকারে পড়েই তোমার কাছে এসেছিলাম। তা এসে দেখি, বাড়িতে প্রায় কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছে। পড়ারই কথা। আমাদেরও ভারী দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। জীবনে যে কখনও এক সঙ্গে দশ পা হাটনি, সে হঠাৎ হাঁটতে বেরিয়ে পড়ল কেন?”
গোলকবাবু একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, “আহা, দুশ্চিন্তা করার কী আছে!”
“আছে হে বাপু, আছে। হাতি ঘাড় ঘোরাতে পারে না বলে বুঝতে পারে না সে কত বড়। তোমারও সেই অবস্থা। সারাদিন লেখাপড়ায় বুদ হয়ে থাকো বলে টের পাওনা যে, তুমি একটা কত বড় প্রতিভা। তোমার মতো একজন জিনিয়াসকে কবজ করার সুযোগ পেলে কি কেউ ছাড়বে?”
এসব কথা শুনে গোলোকবাবু মোটেই খুশি হলেন না। যেন আরও শুকিয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
“অঙ্কের এমন মাথা দুনিয়ায় ক’টা লোকের আছে বলো তো।”
অঙ্ক শব্দটা শুনেই কানে হাতচাপা দিয়ে গোলোকবাবু ককিয়ে উঠলেন। বললেন, “না, না, ওসব আমি ভুলে গিয়েছি।”
“কী ভুলে গিয়েছ?”
গোলোকবাবু আর্তস্বরে বলে উঠলেন, “না ভাই, অঙ্ক বলে কিছু নেই। ছিলও না কখনও। ভবিষ্যতেও থাকবে না।”
“বল কী হে! আমরা তো জানি অঙ্কময় জগৎ।”
গোলোকবিহারী বললেন, “ভুল জান। অঙ্ক একটা ফক্কিকারি ছাড়া কিছু নয়। ও হল মরীচিকা, মায়াহরিণ, সোনার পাথরবাটি, ডোডোপাখি, রূপকথার গপ্পো, চাঁদের বুড়ি, হাওয়ার নাডু…”
মনসারাম কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর মাথা চুলকে বলেন, “তাই তো হে, মেধা নিষ্কাশনের কথা শুনেছিলুম বটে, এতদিনে প্রত্যয় হল। আমাদের আশঙ্কাই তো সত্য হয়ে দাঁড়াল দেখছি। তোমাকে কেউ ধরে নিয়ে গিয়ে কি আজ মেধা নিষ্কাশন করেছে? এ তো পরিষ্কার ব্রেনওয়াশ! ব্যাপারটা একটু খুলে বলো তো গোলোক। তোমার হয়েছেটা কী?”
গোলোকবাবু গুম হয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না। মনসারাম একটা ভাঁজ করা কাগজ খুলে গোলোকবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এটা একটু দ্যাখো তো গোলোক, মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পার কিনা। এটার জন্যই সকালে ছুটে এসেছিলাম।”
গোলোকবাবু কাগজটার দিকে তাকালেন না। দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে বললেন, “কী আছে ওই কাগজে?”
“বোধ হয় একটা হেঁয়ালিই হবে।”
“আমি আজকাল কাগজটাগজের দিকে তাকাতে ভয় পাই।”
“ভয় পাও? ভয়ের কী আছে?”
“কোথায় কোন অঙ্ক সাপের মতো লুকিয়ে আছে কে জানে বাবা!”
“অঙ্কের উপর তোমার হঠাৎ এত বিরাগের কারণটা কী?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোলোকবাবু বলেন, “অঙ্কের নেশায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি ভাই মনসা। আমার আজকাল হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। একজন সাহেব এসে আমাকে দিয়ে নানরকম অঙ্ক করিয়ে নিচ্ছে। আমার টেবিলে গিয়ে দেখতে পাবে, গত সাত দিনে আমাকে দিয়ে শ’ দেড়েক কঠিন অঙ্ক করানো হয়েছে। আসলে আমার মাথার বিকার হচ্ছে। আমি নিজেকে দিয়ে ওসব করাচ্ছি।”
“সাহেব। কীরকম সাহেব বলো তো! পাদ্রি? মাথায় টাক?”
গোলকবাবু ভঅরী অবাক হয়ে বললেন, “তুমি জানলে কী করে?”
মনসারাম চিন্তিত ভাবে বললেন, “দ্যাখো গোলোক, ওটা তোমার হ্যালুসিনেশন বলে আমার মনে হচ্ছে না। আর যদি হয়েও থাকে, তবে হ্যালুসিনেশন তোমার একার হয়নি। আরও একজনের হয়েছে।”
গোলোকবাবু চোখ বিস্ফারিত করে বললেন, “কে দেখেছে?”
“তাকে তুমি চিনবে না। তার নাম বেচারাম প্রামাণিক। সম্ভবত সে চোর। তবে মানুষ খুব সেয়ানা।”
“সত্যি বলছ ভাই? আমি ভুল দেখছি না?”
“সত্যি বলছি। পাদ্রিসাহেবকে বেচারাম দেখেছে।”
“কিন্তু সেটা তো আরও ভয়ের কথা হল। কারণ, সাহেব বারবারই আমার কাছে আসে। আমাকে দিয়ে অঙ্ক করিয়ে নেয়।”
“অঙ্ক করায় কেন?”
“ভগবান জানে। তবে সাহেব নাকি একজন ফেরারিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেই ফেরারি নাকি নানারকম জটিল অঙ্কের ভিতরে লুকিয়ে আছে। অঙ্ক দিয়েই তাকে ধরা সম্ভব। এ সব কি অত্যন্ত গোলমেলে কথা নয়?”
“হু। খুবই গোলমেলে। কিন্তু ভাই আমরা তো কিছুই বুঝতে পারি না। আমাদের মস্তিষ্কের বাইরেও জগতে অনেক কিছু আছে।”
“তা আছে। কিন্তু সাহেব নিজেই আমাকে বলেছে, সে সত্যিও নয়, মিথ্যেও নয়। এইসব শুনেই আমার মাথাটা বড় গুলিয়ে গিয়েছে।”
“অস্থির হয়ো না গোলোক। তোমার মাথার গন্ডগোল হয়নি। সাহেব হোক আর যে-ই হোক, কিছু একটা আছে। এখন এই কাগজটা একটু দ্যাখো, এটা কি কোনও হেঁয়ালি?”
গোলোক কাগজটার চিহ্নগুলো দেখলেন। তারপর একটু ভেবে বললেন, “কতগুলো চিহ্ন আছে, যা বিশ্বজনীন। এগুলো সংখ্যার বা অক্ষরের মধ্যে আবদ্ধ নয়। এই চিহ্নগুলি নানা উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে। এসব হয়তো সংখ্যা, হয়তো অক্ষর বা অর্থবাহী সংকেত। ডিকোড যারা করতে পারে, তারা হয়তো বুঝবে। এই ধাঁধা তোমায় কে দিল?”
“সে আছে একজন। তুমি স্নান করে, খেয়ে, বিশ্রাম নাও। নিশ্চিন্তে থাকো, তোমার মাথার কোনও বিকার হয়নি। আর অঙ্ক তোমার শক্ৰ নয়।”
কিন্তু গোলোকবিহারী ভরসা পেলেন বলে মনে হল না। জানালার পাশে পেয়ারা গাছটায় একটা মাকড়সা জাল বুনছে। সেদিকে তাকিয়ে গোলোক নির্ভুল দেখতে পেলেন, জালটায় ছোট-ছোট অঙ্কের পোকা আটকে রয়েছে। তিনি শিউরে উঠে চোখ বুজলেন।
রাতের দিকটায় আজও ফের জানালার বাইরে খুক করে একটু গলা খাকারির শব্দ হতেই মনসাপণ্ডিত বললেন, “বেচারাম নাকি হে?”
“যে আজ্ঞে পণ্ডিতমশাই। ওঃ, কী উপকারটাই যে করলেন, শতমুখে বলে শেষ করা যায় না।”
“উপকার! উপকার আবার কখন করলুম!”
“ওই যে, চোরের দেবতা যে কার্তিক ঠাকুর, সেটা ধরিয়ে দিলেন। তা কার্তিকবাবার পুজো করে খুব উপকার হচ্ছে মশাই! যেন চিচিং একদম ফাঁক হয়ে বসে আছে।”
“বটে!”
“তবে আর বলছি কী মশাই। রোজ রাতে সিঁদকাঠি নিয়ে বেরচ্ছি আর রোজই যেন কার্তিকবাবা মুঠো-মুঠো ঢেলে দিচ্ছেন।”
“তা হলে তোমার সময়টা ভালই যাচ্ছে, কী বলো?”
“তা আজ্ঞে, ব্রাহ্মণের আশীর্বাদে আর কার্তিকবাবার দয়ায় একটু খুদকুড়ো জুটছে।”
“বেচারাম, একটা কথা সত্যি করে বলবে?”
“যে আজ্ঞে!”
“ওই যে হেঁয়ালিটা আমাকে শুনিয়ে গেলে, সেটা কোথায় পেয়েছ?”
বেচারাম একটু চুপ করে থেকে বলল, “ঠাকুরমশাই, আপনার কি ভাইপো আছে?”
মনসারাম অবাক হয়ে বলেন, “ভাইপো! হঠাৎ ভাইপোর খবর চাইছ কে হে?”
“আজ্ঞে, আমার কোনও ভাইপো নেই কিনা, তাই। ভাইপো তো দূরের কথা, আমার ভাই-ই নেই। আর ভাই তো দূরস্থান, আমিই তো হচ্ছিলুম না। আমার মা-বাবা বিস্তর মানত, মাদুলি করে, জলপড়া খেয়ে যখন হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল, তখনই আমি হলুম।”
“অ। তা হলে বলি বাপু, আমার বেশ কয়েকটা ভাইপো আছে। তাতে কি তোমার কোনও সুবিধে হল?”
“তা হল। আসলে ভাইপো না থাকলে ভাইপোর মর্ম বোঝা যায় না কিনা।”
“হেয়ালির সঙ্গে ভাইপোর সম্পর্ক কী?”
“কিছু না ঠাকুরমশাই, কিছু না। ভাইপো সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে পরে আরও ভাল করে জেনে নেবখন। ভাইপো ব্যাপারটা যে হেঁয়ালি নয়, সেইটে ভাল করে বোঝা দরকার।”
“তুমি হেঁয়ালির কথাটা পাশ কাটাতে চাইছ নাকি বেচারাম?”
“আজ্ঞে না ঠাকুরমশাই। লুকোছাপার ব্যাপার নেই। মাসখানেক আগে হালুইপাড়ার শশী বাউরির বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো ছিল। তা সিন্নিটা যা হয়েছিল ঠাকুরমশাই, বলে বোঝাতে পারব না। ঘন দুধ, পাকা মর্তমান কলা, নারকেল দিয়ে সে এক জম্পেশ ব্যাপার। খাওয়ালও পেট ভরে। আমরা গরিব মানুষ, যাই পাই পেট পুরে খেয়ে নিই। তাতে রাতের খোরাকিটা বাঁচে, বুঝলেন কিনা।”
“বুঝেছি।”
“তা সিন্নি খেয়ে একটু রাত করেই ফিরছিলুম। হালুইপাড়া পেরিয়ে কুমোরপাড়ার পতিত জমিটার ধার দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি, খুব জ্যোৎস্না ফুটেছে। আর হঠাৎ দেখতে পেলুম জ্যোৎস্নায় সাদামতো কীসব যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। ঠাহর করে দেখলুম, বাতাসের গায়ে কেমন যেন আঁকিবুকি। যেন কেউ চকখড়ি দিয়ে শূন্যে কিছু লিখছে। তাজ্জব হয়ে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করছি, তখনই দেখলুম, জমির উলটো দিকটায় একটা ঝোপের ছায়ায় রোগামতো কে যেন দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে বাতাসে কীসব আঁকছে। আর সেগুলো দিব্যি বাতাসের গায়ে আঁকা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
“এরকম কি হয় বেচারাম ?”
“আজ্ঞে আমারও তো একই প্রশ্ন ঠাকুরমশাই। এরকম কি হয়? তাই আবডাল হয়ে ভাল করে ব্যাপারটা লক্ষ করলাম। আর হেঁয়ালিগুলো মনের মধ্যে টুকে নিলাম।”
“তোমার চোখ আর স্মৃতিশক্তি তো খুবই ভাল বলতে হবে।”
“আজ্ঞে, ওইটেই তো আমার দোষ। যা কানে শুনি আর যা চোখে দেখি, তা সব বড্ড মনে থাকে।”