সরাসরি আক্রমণ

সরাসরি আক্রমণ

 ট্যাক্সি থেকে কর্নেল যখন গে ক্লাবের কাছে নামলেন, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বাজে। জানুয়ারির দিনশেষে সাড়ে ছটা মানে রাত্রিই। কুয়াশা কিংবা ধোঁয়াশায় ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলি ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। কর্নেলের গায়ে ওভারকোট, মাথায় টুপি, হাতে একটা ছড়ি। সোজা গে ক্লাবে ঢুকে গেলেন।

লেকের কিনারা বরাবর রঙিন ছাতার নিচে মিটমিটে আলোয় একগুচ্ছ করে লোক। হাতে বিয়ার, হুইস্কি বা রাম ভর্তি গেলাস। কিছু মেয়েও আছে, হাতে শ্যাম্পেন অথবা স্রেফ সফ্ট ড্রিংক ভরা গেলাস। টেন্টের গড়ন মূল ক্লাবঘরের ভেতর জমাট ভিড়। শ্যামলকান্তিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। একজন পরিচারককে জিজ্ঞেস করলে সে বাইরে আঙুল তুলে বলল, মজুমদারসাব হুঁয়া–উও দেখিয়ে, পেড়কা নিচে।

গাছটার মাথা অন্ধকার আকাশে ঢুকে আছে। তার তলায় খুদে প্যাগোডা গড়ন এবং নিচে চারদিক ভোলা কাঠের ছত্র। তিনটে সরু কারুকার্যকরা কাঠের থাম। মেঝে মাটি থেকে ফুট তিনেক উঁচুতে এবং সেটা একটা গোলাকার বেদি বলা চলে। আবছা আলো গিয়ে ওখানে পড়েছে বলে তিনটি লোককে দেখা যাচ্ছিল।

কর্নেল গিয়ে বললেন, এক্সকিউজ মি—

 হ্যাল্লো কর্নেল! শ্যামলকান্তি হাত তুলে খুশ মেজাজে বললেন। জয়েন আস।

সুভদ্রের চোখ জ্বলে উঠেছে। সে মুখ নামিয়ে গেলাসে চুমুক দিল। তারপর কাঠের সরু থামে হেলান দিল। কর্নেল শ্যামলকান্তির কাছে পা ঝুলিয়ে বসলেন।

শ্যামলকান্তি বললেন, আলাপ করিয়ে দিই–সৌম্য চৌধুরি। সৌম্য, আই টোল্ড য়ু অ্যাবাউট দিস ওয়াইজম্যান–আ ন্যাচারালিস্ট অ্যান্ড ভেরি পিকিউলারলি আ প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

সৌম্য চৌধুরির বয়স পঁয়ত্রিশের কম নয়। শক্তসমর্থ গড়ন। আবছা আলোয় কর্নেল আঁচ করলেন, মুখে বিরক্তি ফুটে উঠেছে। শ্যামলকান্তি বললেন, একচুমুক হোক, স্যার!

কর্নেল বললেন, ধন্যবাদ।

আমরা হতভাগা বিমলের আত্মার শান্তিকামনায় একটু খাচ্ছিটাচ্ছি! শ্যামলকান্তি এই হাল্কা চালের বাক্যটি গাম্ভীর্যে উচ্চারণ করলেন। আফটার অল, উই ওয়্যার হিজ ফ্রেন্ডস। উই ক্যান্ট এনজয় হিজ স্যাড ডেথ। কী সৌম্য?

সৌম্য বললেন, কিন্তু এখানে ডিটেকটিভ কেন? হোয়াই?

আঃ সৌম্য! বলে না। শ্যামলকান্তি ভর্ৎসনার সুরে বললেন। হি ইজ নাও আওয়ার গেস্ট।

কর্নেল একটু হাসলেন।..ডিটেকটিভ আসার বদলে পুলিশ এলে কি সৌম্যবাবু খুশি হতেন?

শ্যামলকান্তি গেলাসে চুমুক দিয়ে খিকখিক করে হেসে উঠলেন। সৌম্য বললেন, হোয়াট?

সুভদ্র বলল, হি হ্যাজ কাম টু থ্রেট আস।

সৌম্য বাঁকা হাসলেন। …দেখুন মশাই, আর যাই দেখান, পুলিশ দেখাবেন না। আর একটা কথা, আমরা এখন অন্য মুডে আছি। উই হ্যাভ লস্ট আ ফ্রেন্ড।

শ্যামলকান্তি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, সৌম্য! ওঁর কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে জেনে নাও এবং জবাব দাও। ব্যস্! নো প্রব্লেম।

সৌম্য ঘুরে বসল কর্নেলের মুখোমুখি। …কী জানতে চান? কোন বিষয়ে জানতে চান?

কর্নেল শ্যামলকান্তির উদ্দেশে বললেন, মিঃ মজুমদার! আজ সকালে আমাকে টেলিফোনে কেউ শাসিয়েছে। সুশোভন এবং বাসুদেবের ব্যাপারে নাক গলালে আমাকে খতম করবে।

শ্যামলকান্তি হাসতে লাগলেন। …আপনি কি ভাবলেন আমরা কেউ?

কর্নেল সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, তার মানে আমি ঠিক পথে এগোচ্ছি।  

শ্যামলকান্তি একই হাল্কা চালে বললেন, আপনি জ্ঞানী মানুষ। কেন? এমনও তো হতে পারে, আপনি ভুলপথে এগোচ্ছেন এবং ভুলপথে আরও যাতে এগিয়ে যান, সেজন্য আপনাকে কেউ এভাবে প্ররোচিত করছে।

ভুল পথে এগোনোর প্রমাণ এখনও অন্তত পাইনি, মিঃ মজুমদার।

প্লিজ এক্সপ্লেন!

 বিমলবাবুর কাছে আমি না গেলে তার একটা ছবি চুরি যেত না।

ছবি চুরি? শ্যামলকান্তি গেলাস ঢকঢক করে শেষ করে সিগারেট ধরালেন। ছবি চুরির কথা বিমল আমাদের বলেনি। আপনাকে বলেছিল বুঝি?

হাঁ। বলেছিলেন।

সৌম্য গলার ভেতর বললেন, হি ওয়াজ আ জিনিয়াস, বাট অ্যাবসলিউটলি আ ম্যাড ফেলা। উন্মাদ।

শ্যামলকান্তি বললেন, কী ছবি, কর্নেল?

অতর্কিতে পিঠে ছুরিবিদ্ধ একটা মানুষের ছবি।

 ছবিটা কি আপনি দেখেছিলেন?

 দেখেছিলুম।

আপনি অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং দেখে বুঝতে পারেন? কী জানি মশাই! আমার মাথায় ওসব হাবিজাবি ঢোকে না। সৌম্য! সুভদ্র! তোমরা বিমলের ছবি দেখে। কিছু বুঝতে পারতে?

সৌম্য বললেন, ম্যাডনেস!

সুভদ্র বলল, ম্যাডনেস অফ কালার অ্যান্ড কম্পোজিশান, হুইচ মিস্ নাথিং!

শ্যামলকান্তি গেলাসে হুইস্কি ঢেলে সোডা ওয়াটার মিশিয়ে বললেন, যাই হোক–ছবি চুরি গেল এবং ছবিটার শোকে হতভাগা আত্মহত্যা করল।

না মিঃ মজুমদার! কর্নেল দ্রুত বললেন। বিমলবাবুকে খুন করা হয়েছে।

 তিনজনের হাতের গেলাস থেমে গেল। একটু পরে শ্যামলকান্তি বললেন, ঠিক আছে। তারপর?

মর্গের রিপোর্ট–তাছাড়া ফরেন্সিক এক্সপার্টদের মতে, বিমলবাবুর ডানহাতে এবং চোয়ালের দুধারে চাপের চিহ্ন আছে। কেউ বা কারা জোর করে ওঁর হাতে রিভলবার গুঁজে মুখ ফঁক করে ওঁরই আঙুলের চাপে ট্রিগার টেনেছিল। খুব সাবধানী খুনী বা খুনীরা। রুমালে রিভলবার হ্যান্ডেল ধরেছে। কাজেই ট্রিগারে বিমলবাবুর আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। তাছাড়া তখন বিমলবাবু প্রচণ্ড মাতাল অবস্থায় ছিলেন।

শ্যামলকান্তি গেলাসে চুমুক দিয়ে হাতের চেটোয় ঠোঁট মুছে বললেন, ওক্কে। পুলিশ আমাদের অ্যারেস্ট করুক।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আমার মনে হয়, পুলিশ আপনাদের বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না।

সরি, কর্নেল! তাহলে এসব কথা আলোচনার উদ্দেশ্য কী?

আমি বিমলবাবু সম্পর্কে আগ্রহী নই, মিঃ মজুমদার! কর্নেল আস্তে বললেন। পুলিশ তার কেস নিয়ে মাথা ঘামাক। আমি সুশোভন এবং বাসুদেব সম্পর্কে আগ্রহী।

কে তারা? শ্যামলকান্তি বললেন। আমি ওদের নাম শুনিনি। সৌম্য! সুভদ্র! তোমরা চেন?

দুজনে মাথা নাড়ল। কর্নেল বললেন, বাসুদেব ওরফে তপেশ বসাক মোতিগঞ্জে কাকে ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিল, মিঃ মজুমদার?

শ্যামলকান্তি শক্ত গলায় বললেন, বিমলের বাড়িতেও আপনার এ ধরনের প্রশ্ন শুনেছি। তখন যা জবাব দিয়েছি, এখনও তাই দেব, কর্নেল! প্লিজ, মুড নষ্ট করবেন না। আপনি দয়া করে এবার আসুন।

সুভদ্রের দিকে তাকিয়ে কর্নেল বললেন, হাথিয়াগড়ে বাসুদেব আপনাকে। ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিল। বাসুদেবের সঙ্গে ছিলেন মিঃ মজুমদার।

সুভদ্র শ্যামলকান্তির দিকে তাকাল। চোখে বিস্ময়নাকি কর্নেল ভুল। দেখলেন? আলো খুব আবছা। তাছাড়া সুভদ্র সিং-এর চোখদুটো সবসময় চিতা বাঘের মতো উজ্জ্বল।

শ্যামলকান্তি ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, সুভদ্র! হি ইজ ট্রাইং টু মিসলিড ইউ। ইউ নো, হায়াই আই ওয়েন্ট টু মিট ইউ।

সুভদ্র শ্বাস ছেড়ে মদে চুমুক দিল। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বললেন সৌম্যবাবু!

সৌম্য চৌধুরী হিংস্র মুখে বললেন, ডোন্ট টক। আর একটা কথা বললে দাঁতের পাটি খুলে নেব।

কর্নেল হাসলেন। চেষ্টা করতে পারেন!

সৌম্য উঠে দাঁড়ালেন। শ্যামলকান্তি ও সুভদ্র তাকে ধরে বসিয়ে দিল। কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলেন। সওয়া সাতটা বাজে। লেকভিউ রোড জনহীন। গাছের ঘনছায়া পড়েছে দুধারের ফুটপাতে। ট্যাক্সি চোখে পড়ছে না। ইনটুইশন! কেউ কি অনুসরণ করছে তাকে ছায়ার ভেতর? বাঁদিকের ফুটপাতে চলে গেলেন। সারবন্দি আধুনিক স্থাপত্য। বিত্তবানদের বাসভবন। একটা ব্লকের পর গলিরাস্তা। একটা প্রাইভেট কার চলে গেল। গাড়ির শব্দের ভেতুর পিস্তল বা রিভলবারের শব্দ। ট্রেইন্ড কান কর্নেলের। দ্রুত গলিটায় ঢুকে পড়লেন। আবার একটা গুলির শব্দ, খুব কাছে। জনহীন গলিতে কয়েকটা মোটরগাড়ি পার্ক করা আছে। একটা গাড়ির আড়ালে হুমড়ি খেয়ে বসলেন। রিভলবার বের। করলেন। কিন্তু লেকভিউ রোডের মোড়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। সম্ভবত আততায়ী ওপাশের ফুটপাতে গাঢ় ছায়ার ভেতর গাছের ছায়ার ভেতর গাছের আড়ালে আছে। গাড়ির পাশ দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চললেন। সামনে একটা মাঝারি রাস্তার মোড়। উজ্জ্বল আলো। দোকানপাট আছে কিছু। একটা খালি। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। বললেন, ইলিয়ট রোড। বখশিস মিলেগা। জলদি যানা, পড়েগা!

শিখ ড্রাইভার হাসল।…আইয়ে। আইয়ে!

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল ফোন করলেন ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীকে। অরিজিৎ সাড়া দিয়ে বললেন, নো ফাদার ডেভালাপমেন্ট। সরি, কর্নেল!

অরিজিৎ, একটা প্রশ্ন।

বলুন।

 বিমলবাবুর নামে কোনো রিভলবারের লাইসেন্স ছিল খোঁজ নিয়েছ?

অলরেডি। লাইসেন্সড উইপন। দুবছর আগে লাইসেন্স যোগাড় করেছিলেন ভদ্রলোক।

একজন নিরীহ চিত্রশিল্পীর কেন রিভলভার দরকার হয়, অরিজিৎ? ভেবে দেখেছ কি?

সরি, এই অ্যাঙ্গলটা আমরা ভেবে দেখিনি।

 উনি আক্রান্ত হবেন টের পেয়েছিলেন। কিন্তু মদই ওঁকে সে সুযোগ দিল না।

ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি রাইট, কর্নেল! ব্যাপারটা তাই দাঁড়াচ্ছে।

 ডার্লিং! আজ কিছুক্ষণ আগে আমিও আক্রান্ত হয়েছিলুম।

 সর্বনাশ! কী ব্যাপার?

 আততায়ী, দুবার গুলি ছুঁড়েছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।

কোথায়, কোথায়?

উত্তেজিত হয়ো না। এমন বহুবার ঘটেছে আমার জীবনে।

আহা, জায়গাটা কোথায়?

 লেকভিউ রোডে।

ওখানে কী করছিলেন?

 গে ক্লাব থেকে ফিরছিলুম–পায়ে হেঁটে।

গে ক্লাবে কেন?

শ্যামলকান্তি মজুমদারের কাছে গিয়েছিলুম। তার কথা আশা করি ভুলে যাওনি। তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড

এক মিনিস্টারের আত্মীয়। ইলেকট্রনিক গুডসের ব্যবসা করেন।

 পলিটিক্যাল ফাইল খুঁজতে বলেছিলুম, ডার্লিং!

কাজ চলছে। কিছু থাকলে আগামীকাল নাগাদ জানাতে পারব, আশা করি।

বিমলবাবুর কেসে কাউকে অ্যারেস্ট করার কথা কি ভাবছ তোমরা?

একটু পরে অরিজিৎ বললেন, চাপ আসছে। এটুকু বলতে পারি, খুব প্রভাবশালী মহলের চাপ। কেসটা নিয়ে প্রসিড করতে ভয় পাচ্ছেন অফিসাররা। আমি হেল্পলেস। 

কর্নেল হাসলেন। তুমি একা লড়াই দিতে পারবে না, অরিজিৎ?

পারি– কিন্তু একা কতটুকু করা যাবে? অন্যান্য অফিসাররা সহযোগিতা না করলে কিছু করা কি সম্ভব? ভেবে দেখুন। যেমন ফাইল থেকে তিনটে পাতা উধাও হওয়ার ব্যাপারটা ধরুন। বড়জোর একটা গতানুগতিক ডিপার্টমেন্টাল তদন্ত হবে। বাগচিবাবুর ট্রান্সফার হবে। আর কী হবে? প্রশাসনের অবস্থা তো জানেন।

ঠিক আছে। ছাড়ি ডার্লিং!

আমার মনে হয়—

 বলো!

ছেড়ে দিন। খামোকা কে কখন কোত্থেকে গুলি করবে, আত্মরক্ষার সুযোগই পাবেন না।

ছিঃ অরিজিৎ! এ কী বলছ তুমি?

সরি, কর্নেল! বলতে বাধ্য হলুম। আমারও এ চাকরি করতে আর ইচ্ছে করছে না।

হুঁ, বুঝতে পারছি। কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, গুডনাইট! ছাড়ছি।

ফোনে হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তাঁর ওপর যেমন, তেমনি অরিজিতের ওপরও অন্য আকারে হামলা ঘটেছে বোঝা গেল। প্রভাবশালী মহলের চাপ আসছে। তার মানে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি এই কেসের সঙ্গে জড়িত। শ্যামলকান্তির আত্মীয় একজন মিনিস্টার। কে তিনি? কোন মিনিস্টার? গোড়া থেকেই অরিজিতও শুধু ‘এক মিনিস্টার’ বলে আসছে। তিনি কে, তা বলছে না। নাকি অরিজিৎ-ও জানে না? শুধু তাকে বলা হয়েছে, শ্যামলবাবু। একজন মিনিস্টারের আত্মীয়।

কর্নেল জ্বলন্ত চুরুট দাঁতে কামড়ে চোখ বুজে হেলান দিলেন।…