সময়ের লালা

অনেক শতাব্দী চুপচাপ বসে আছি, মনে হয়।
অনেক শতাব্দী অস্তিত্বের শৈলাবাসে ফুলপাতা,
উদাস সুরভি, কিছু ওষুধের চাপা ঘ্রাণ নিয়ে,
পায়ে নিয়ে কম্বলের তাপ,
অনেক শতাব্দী মিশরের সুপ্রাচীন
প্রকোষ্ঠের মতো
মগজের ভেতরে কখনো
অমাবস্যা, কখনো ডাগর
পূণিমা, অদ্ভুত ফ্রেস্কো নিয়ে বসে আছি, মনে হয়।
স্পন্দন আছে কি নেই, বোঝা মুশকিল। অকস্মাৎ
কেমন খটকা লাগে, চোখের পাতা কি জমে যাবে
উত্তুরে হাওয়ায়?
চতুষ্পার্শ্বে কত কিছু খর জলধারার মতোন বয়ে গেছে,
ফেলে গেছে কোনো কোনো চিহ্ন-প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন, আড়ে
সেদিকে তাকিয়ে দেখি সময়ের লালা ঝরে হাসপাতালের
বারান্দায়, করিডোর, ব্যাঙ্ক কাউন্টারে, ভিখিরির
খুব সংকুচিত নগ্ন মধ্যাহ্ন ভোজনে,
মিশকালো আইবুড়ো মেয়েটির শুভ্র প্রার্থনায়,
সময়ের লালা ঝরে বেদেনীর নিতম্বে নিয়ত।

তিনখণ্ড গীতবিতানের ভালোবাসা খরাগ্রস্ত
সত্তাকে লালন করে নিশিদিন। ডাকঘর ডাকে
বেহালার সুরে আমি ছুটে যাই একা, পত্রগুচ্ছ
এখন আমার নামে এসেছে কি আসে নি, ভাবিনা এতটুকু।
তাহলে এ-ও সত্য কবিতা লাফিয়ে উঠে ব্যাপক আঁধারে
চুমু খায় পুলিশের শাদা দস্তানায়
অথবা লেহন করে গণিকার পাইকারী ঊরু?
কবিতা কি তপোজ্জ্বল ওষ্ঠ রাখে মৃতের অধরে?
নাকি বৈদেশিক দূতাবাসে এর ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে
গোলাপের মতো ঝরে যায়
পুরু গালিচায়?

কবিতা কখনো চুপিসাকে ক’ফোঁটা চোখের জল, কিছু ফুল
রেখে আসে মর্গে, পথে পথে ঘোরে, মিশে যায়
শহীদ বেদীর অর্ঘ্যে, মিশে যায় ফেরারীর পায়ের আওয়াজে।
কবিতা কখনো জিরাফের গলা বেয়ে ওঠে, কখনো সুদূর
নীলিমানিমগ্ন তীক্ষ্ম চিলের চোখের
ভেতরে প্রবেশ করে, কখনো বা জাহাজডুবির পরে দ্বীপে
শুয়ে-শুয়ে দ্যাখে শুধু চকচকে মাছের মতোন
জলধোয়া নিজের শরীর,
কখনো বা পিছুটান তার কাছ থেকে টেনে নেয়
কিছু দীর্ঘশ্বাস।

অনেক শতাব্দী ভারি মনোকষ্টে আছি, মনে হয়।
যখন সূর্যাস্ত রাঙা চেলীর মতোন
কোমল ছড়িয়ে পড়ে আকাশে, আড়াল ছিঁড়ে খুঁড়ে।
জ্বলজ্বলে
একটি মোরগ চায় তার প্রতি আমার কাছে, যেন
জেনে নিতে চায় তার প্রতি আমার প্রকৃত মনোভাব আর
অনেক শতাব্দী কাঁপে ঈষদুষ্ণ মোহন কিরীটে, মনোভূমে
ফিরে আসে হাঁস স্বপ্নছায়া নিয়ে মেঘার্দ্র ডানায়।
পারস্পর্যহীন সব বলে আমি দিনরাত্রি মনোকষ্টে থাকি।
অনেক শতাব্দী চুপচাপ বসে আছি, মনে হয়।
আমার ওপর অবিরল সময়ের লালা।
হঠাৎ কবিতা এসে বসে খুব কাছে, হাত ধরে বলে-চলো,
খানিক বেড়িয়ে আসি, যেখানে তোমার খুশি, ওঠো,
খামোকা কোরো না দেরী, খুঁজো না টিফিন ক্যারিয়ার
কিংবা ক্লাস্ক, স্যুটকেশ হোল্ডল ইত্যাদি থাক, বাস ছেড়ে দেবে।