সম্মান
সম্মান একটি সামাজিক রোগ। কোনো সমাজে ভালোবাসা কমে গেলে, এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। কেউ যখন দেখেন যে, তাকে ভালোবাসার কোনো কারণ মানুষের নেই, তখন তিনি সম্মান দাবি করেন। সম্মান হলো ভালোবাসার ঘাটতি পূরণের একটি আদিম কৌশলমাত্ৰ।
কৌশলটি বাস্তবায়নে মানুষ প্রথমেই আশ্রয় নেয় ক্ষমতার। ক্ষমতা কী? কাজ করার হারই ক্ষমতা, এরকম একটি সংজ্ঞা পদার্থবিজ্ঞানে পাওয়া গেলেও, সমাজে এ সংজ্ঞা ভিন্ন। সমাজের দিকে তাকালে টের পাই- মানুষকে ভয় দেখানোর সামর্থ্যই ক্ষমতা। যার ভয় দেখানোর সামর্থ্য যতো বেশি, সমাজে তার ক্ষমতাও ততো বেশি।
এ সামর্থ্য এক সময় নির্ভর করতো মানুষের হাতে থাকা অস্ত্রের ওপর। তবে এখন এটি নির্ভর করছে মানুষের পেশা ও পদ-পদবির ওপর। কোনো মানুষ ক্ষমতাবান কি না- তা তার পেশা ও অতীত কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি। লেনিনের রাশিয়াতে কেউ যদি এসে পরিচয় দিতো- আমি চেকা পুলিশ বা বলশেভিক পার্টির সদস্য, তখন তাকে সম্মান না জানিয়ে উপায় ছিলো না। তার পেশা ও সংঘপদবি শুনে মানুষ বুঝে যেতো- লোকটির ভয় দেখানোর ক্ষমতা অসীম। যেকোনো সময় সে কাউকে তুলে নিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারে লুবিয়াঙ্কায়।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে ভাল্লুক ও পেঙ্গুইন দেখলে মানুষের ভিড় লেগে যায়, এর কারণও সম্মান। লোকজন আতঙ্কে থাকেন, যদি ভাল্লুকটির চারপাশে জটলা পাকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করা না হয়, পেঙ্গুইনটিকে ঠিকমতো স্যার স্যার, ভাই ভাই বলে তোয়াজ দেখানো না হয়, তাহলে তিনি রুষ্ট হতে পারেন, এবং বন্ধ করে দিতে পারেন করুণাবৃষ্টি। কিন্তু বরিস জনসন রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে এমনটি ঘটে না। কারণ মানুষ জানে, তাঁর ভয় দেখানোর সামর্থ্য শূন্য। তাঁর অতীত কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তিনি কাউকে জেল খাটাতে পারেননি। যে-রাষ্ট্রপ্রধান মানুষকে জেলে ঢোকাতে পারেন না, তাঁর আবার ক্ষমতা কীসের? সম্মান তাঁর প্রাপ্য নয়। তিনি পেতে পারেন বড়জোর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
একজন কৃষককে কি আমরা সম্মান করি? করি না। তার নামের আগে কি মাননীয় বসাই? বসাই না। তাকে কি স্যার ডাকি? ডাকি না। কারণ- কৃষকদের যা ইতিহাস, তা ক্ষমতাহীনতার ইতিহাস। কোনো কৃষককে দেখে কেউ ভয় পেয়েছে, এরকমটি শোনা যায় না। কিন্তু কৃষক যদি তার কাঁচি ও কোদাল অন্য কাজে ব্যবহার করতেন, সংঘবদ্ধ হয়ে খুন-খারাবিতে লিপ্ত হতেন, বা উৎপাদিত ফসল বিক্রি না করে দেশে খাদ্যসংকট তৈরি করতেন, তাহলে পরিস্থিতি বদলে যেতো। তাকে সবাই ভয় পেতো, এবং প্রদর্শন করতো উপযুক্ত সম্মান।
কাউকে সম্মান প্রদর্শন করা, এর অর্থ হলো, তাকে যে আপনি ভয় পাচ্ছেন তা জানিয়ে দেয়া। আমরা যে পত্র লেখার সময় ‘যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বিনীত নিবেদন’ বাক্যটি ব্যবহার করি, তা ভয় থেকেই করি। এ ভয়টুকু প্রকাশ না করলে, পত্রলেখককে ভাবা হবে ‘বেয়াদব, এবং বেয়াদবের আবেদন এ দেশে মঞ্জুর হয় না। আমেরিকাতে যে প্রেসিডেন্টকে ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ নামে ডাকা হয়, এর কারণ- আমেরিকানরা তাদের প্রেসিডেন্টকে ভয় পায় না। তারা জানে, প্রেসিডেন্ট তাদের নির্বাচিত ভৃত্য।
সমাজে ক্ষমতা প্রদর্শনের অনেকগুলো উপায় আছে। এর একটি হলো ভাষা। ক্ষমতাবানরা প্রথমেই কিছু শব্দ দিয়ে দূষণ ঘটায় ভাষার। এমন অনেক শব্দ তারা উদ্ভাবন করে, যা ব্যবহার করতে পারবে কেবল ক্ষমতাধর ভাল্লুকেরা। এ শব্দগুলো সাধারণ মানুষদের মনে একধরনের কাল্পনিক ছবি আঁকতে পারে। ধরা যাক, মাইকে ঘোষণা করা হলো ‘মাননীয় অমুক’। এই ‘মাননীয়’ শব্দটি মুহূর্তেই নাগরিকদের মনে একটি ভয়ের ছবি এঁকে ফেলে, যা অনেকটা জর্জ অরওয়েলের বিগ ব্রাদারের ছবির মতো। ছবিটি যখন কারও মানসপটে ঝলমলিয়ে ওঠে, তখন মাননীয় অমুকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ছাড়া তার সামনে আর কোনো উপায় থাকে না। তিনি বুঝতে পারেন যে, মাননীয় অমুক একজন বিশেষ ব্যক্তি, যার কেশাগ্র কেউ ছুঁতে পারবে না। তবে উনি চাইলে কেশাগ্র তো বটেই, মানুষের ঘাড়ের বন্দোবস্তও করে ফেলতে পারেন।
এ জন্য কোথাও মাননীয়রা আসবে শুনলে, আমরা ফুলের মালা, রঙিন তোরণ, ও গরম পোস্টারযোগে জানাতে থাকি- হে সম্মানিত অতিথি, আমরা আপনাকে ভয় পাচ্ছি, আপনি ভীতিকর, আমাদের ভীতিটুকু গ্রহণ করুন। আপনাকে সম্মান জানাতে রোদে পুড়ছে এক হাজার ইশকুল শিশু
ম্যাকিয়াভেলি তাঁর প্রিন্সকে পরামর্শ দিয়েছিলেন- ভালোবাসা নয়, রাজার লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের ভয় অর্জন করা। রাজাকে করতে হবে এমন সব কাজ, যা দেখে মানুষ তাকে ভয় পাবে। ম্যাকিয়াভেলির চোখে যা ছিলো ‘ভয়’, আমার চোখে সেটি ‘সম্মান’। তবে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রে রাজা একজন থাকলেও, আধুনিক বদরাষ্ট্রে রাজা থাকে একাধিক। রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়াও এখানে রয়েছে হাজার হাজার দপ্তরপ্রধান। ফলে সম্মানের দাবিদার এখন অনেক। কেউ যখন বুঝতে পারেন যে, মানুষ তাকে আর রাজা হিশেবে স্বীকার করছে না, বা দিচ্ছে না রাজার প্রাপ্য সম্মান, তখন তিনি প্রদর্শন করেন ক্ষমতা। কয়েক দিন আগে ক্ষমতার এরকম একটি প্রদর্শনী ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে হয়ে গেছে। এতে অংশ নিয়েছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, ও পুলিশ। নানা জায়গায় নাগরিকদের কান ধরানোর যে- ঘটনাগুলো ঘটছে, বা বাধ্য করা হচ্ছে ‘স্যার’ ডাকতে, তা-ও এ প্রদর্শনীরই অংশ। সম্মানের সরবরাহ টিকিয়ে রাখতে এ প্রদর্শনীর প্রয়োজন আছে।
প্রশ্ন জাগতে পারে, মানুষ কেন সম্মানকে এতো উপভোগ করে? আমি আগেই বলেছি, সম্মান একটি রোগ, এবং রোগটি মানসিক। এর জন্ম হীনম্মন্যতা থেকে। মানুষ হীনম্মন্যতায় ভুগতে শেখে শৈশবে। কোনো শিশু যদি ভয়ের পরিবেশে বড়ো হয়, আর তার কর্মকাণ্ড ও সক্ষমতাকে যদি চারপাশের লোকজন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তাহলে সে ভেতরে ভেতরে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এ প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে জন্ম নেয় নিষ্ঠুরতা। বাংলাদেশের পরিবার ও ইশকুলগুলোতে শিশুরা প্রায়ই শিকার হয় শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনার। এ লাঞ্ছনা শিশুরা প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও একসময় বুঝে ফেলে। তাকে যে অপমান করা হচ্ছে, এটি সে ধরে ফেলে। তখন তাকে নিয়ে কেউ হাসি-ঠাট্টা করলে, বা তাকে আঘাত করতে চাইলে, সে তার ওপর ক্ষিপ্ত হওয়া শুরু করে। ক্ষিপ্ত হওয়ার এ অভ্যাস একধরনের আত্মরক্ষার কৌশল। এ কৌশলে শিশুটি তার আত্মসম্মান সুরক্ষিত রাখতে চায়। অনেকের ধারণা, শিশুদের কোনো আত্মসম্মানবোধ নেই। এটি ভুল ধারণা। শিশুদের আত্মসম্মানবোধ প্রবল, এবং বহু ক্ষেত্রেই তা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে বেশি।
যে-শিশু শৈশবে পীড়নের শিকার হয়, তার ভেতর কিছু সুপ্ত শত্রুতাবোধ জীবিত থাকে। এ বোধ তাকে পরবর্তীতে মানুষের সমীহ আদায় করতে প্ররোচিত করে। শত্রুকে পদানত করার যে-সুখ, তার কাছে অন্য সকল সুখ নস্যি- এ সত্য শিশুটি একসময় জেনে যায়, এবং উপায় খুঁজতে থাকে— কীভাবে আদায় করা যায় সম্মান। ক্ষমতাহীন অবস্থায় এ ইচ্ছা অচরিতার্থ থাকলেও, ক্ষমতার সান্নিধ্যে আসার পর শৈশবের সুপ্ত হীনম্মন্যতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এবং উপভোগ করতে শুরু করে সম্মান।
চারপাশে যে হট্টগোল দেখি, এর প্রধান কারণ- এ দেশের মানুষের শৈশব সুখে কাটে না। যার শৈশব সুখে কেটেছে, তার তো জানার কথা নয়— কীভাবে মানুষকে ভয় দেখাতে হয়। হিটলার, লেনিন, স্তালিন, মোবারক- তাদের কারও শৈশব সুখের ছিলো না। রবীন্দ্রনাথের শৈশব যদি লেনিনের শৈশবের মতো অসুখী হতো, তাহলে আমরা এতো সুন্দর ‘গীতাঞ্জলি’ পেতাম না। হিটলারের শৈশব যদি জে এস মিলের শৈশবের অনুরূপ হতো, তাহলে হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটি হতো না।