০৫.
স্নানাহারের পর অভ্যাসমতো ভাতঘুম দিতে শুয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎ সেই ঘুম ভেঙে গেল। দেখলুম, কখন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর কল্যাণ পটনায়ক এসেছেন। কর্নেলের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। দুজনের কথাবার্তা শোনার জন্য চোখ বুজে পড়ে রইলুম।
হ্যাঁ। অমল, রায় তা-ই বলছে। মিঃ পটনায়ক বলছিলেন। মহীতোষ বিশ্বাস প্রভাবশালী লোক। তার ভাগনে হচ্ছে এই অমল। তাই আমাদের একটু সংযত থাকতে হয়েছে।
কর্নেল বললেন, অমলের সহপাঠিনী ছিল শ্রাবন্তী। এটার প্রমাণও তো আপনারা পেয়েছেন।
তা অবশ্য পেয়েছি। মহীতোষবাবু আমাদের টেলিফোন পেয়ে অমলের কলেজের ডিগ্রি ইত্যাদি প্রমাণপত্র দিয়ে গেছেন।
ডঃ হাজরাও তো বলেছেন, শ্রাবন্তী প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের ছাত্রী, ছিল?
হ্যাঁ। টেলিফোনে বলেছেন। শ্রাবন্তীর জিনিসপত্রের মধ্যে অবশ্য ওর পড়াশুনোর ডিগ্রি সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্ট পাইনি।
যাই হোক, ভুবনেশ্বরের অমল কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। এর প্রমাণ পেয়ে গেছেন। কাজেই সহপাঠিনীর সঙ্গে অমলের, এমোশনাল সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
মিঃ পটনায়ক বললেন, কিন্তু অমল এই হোটেলে এসে থাকতে চেয়েছিল কেন, এই প্রশ্নের জবাব পাইনি। তার মামার বাড়ি তো নিউচন্দনপুরেই।
কর্নেল হাসলেন। যুবক-যুবতীদের মধ্যে এমোশনাল সম্পর্ক গড়ে উঠলে তারা কাছাকাছি থাকতে চাইবে।
আমার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা কর্নেল সরকার। অমলের চরিত্র সম্পর্কে যতটুকু খোঁজ পেয়েছি, সে অসচ্চরিত্র লম্পট প্রকৃতির যুবক। সিনেমায় একবার চান্স পাওয়ার পর সে নিজেই সিনেমার পরিচালক হতে চেয়েছে। কিন্তু ওটা তার একটা অছিলা। আসলে নিজের লাম্পট্য প্রবৃত্তি চরিতার্থ করাই তার উদ্দেশ্য।
এর সঙ্গে সহপাঠিনী বা ধরা যাক–প্রেমিকা শ্রাবন্তীকে সে… মিঃ পটনায়ক। হঠাৎ থেমে সিগারেট ধরালেন। চোখের ফাঁক দিয়ে দেখলুম, তিনি সিগারেটের ধোঁয়ার রিং তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।
কর্নেল বললেন, মিঃ পটনায়ক! তাহলে বলতে হয়, অমল যেন আগেই জানত যে শ্রাবন্তী তার কুপ্রস্তাবে রাজি হবে না, তাই সে সঙ্গে নাইলনের দড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল!
মিঃ পটনায়ক একটু পরে বললেন, হ্যাঁ। আমি তা ভেবে দেখেছি! তবে–
তার কথার ওপর কর্নেল বললেন, হোটেলের রিসেপশন স্টাফের সাক্ষ্যে দেখা যাচ্ছে, শ্রাবন্তী নিজেই অমলের জন্য একটা স্যুইট চেয়েছিল।
কোনো পুরনো প্রতিহিংসার ব্যাপার থাকতে পারে না কি কর্নেল সরকার? শ্রাবন্তী হয়তো মনে রাখেনি। কিন্তু অমল ভোলেনি।
কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন, জয়ন্ত! চোখ বুজে শুয়ে না থেকে উঠে পড়ো! আমরা মিঃ পটনায়ককে এবার ম্যাজিক দেখাব।
মিঃ পটনায়ক হাসলেন। কাগজের লোক, তাই নিজেই আড়িপাতা যন্ত্র সেজেছেন জয়ন্তবাবু! কিন্তু ম্যাজিকটা কী?
অগত্যা উঠে পড়লুম। কর্নেল তার কিটব্যাগ থেকে সেই হাত তিনেক নাইলনের দড়িটা বের করে বললেন, এই দেখুন ম্যাজিক।
ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ঝটপট দড়িটা হাতে নিয়ে বললেন, একই দড়ি মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ। খুনী লম্বা দড়ি কিনেছিল। কিন্তু এই অংশটা কেটে বাদ দিয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে কাটা। তাই এই প্রান্তটার বুননি খুলে ছেতরে গেছে। শেষ প্রান্তে গিট।
কী আশ্চর্য! শ্রাবন্তীর গলায় বাঁধা দড়িটার একপ্রান্তে গিট। অন্যপ্রান্ত ঠিক এইরকম কাটা। কোথায় পেলেন এটা?
কর্নেল সংক্ষেপে দড়ি উদ্ধার এবং পার্বতীর মন্দিরে ছুটে গিয়ে সেই শিখ ভদ্রলোককে খুঁজে বের করার ব্যর্থ চেষ্টার বিবরণ দিলেন। শেষে বললেন, জয়ন্তই প্রথমে লোকটাকে দেখতে পেয়েছিল!
মিঃ পটনায়ক কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকার পর বললেন, তা হলে অমলের একটা কথাকে এখন গুরুত্ব দেওয়া চলে।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কী কথা?
শ্রাবন্তী কাল সন্ধ্যার একটু আগে তাকে নাকি বলেছিল কথাটা। ডঃ কৌশল্যা বর্মনের সঙ্গে একই স্যুইটে তার থাকতে ভয় হচ্ছে। কারণ সে নাকি এইমাত্র একটা উড়ো চিঠি পেয়েছে। সেই চিঠিতে কেউ তাকে লিখেছে, মহিলাবিজ্ঞানীকে খুন করা হবে। তার সঙ্গে থাকলে তুমিও খুন হয়ে যাবে।
কর্নেল নিষ্পলক দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু শ্রাবন্তী কেন সে কথা কৌশল্যাকে বলেনি?
অমলও তাঁকে বলতে বলেছিল। ডঃ বর্মনকে জেরা করে তেমন কোনো কথা শ্রাবন্তী বলেছিল কি না জানবার জন্যই এ বেলা আমি এসেছি। এটা জরুরি ব্যাপার। তাই ডঃ বর্মনকে বলে রেখেছি, তার সঙ্গে আরো কথা বলতে চাই।
কৌশল্যা এমন কথা শুনে থাকলে সতর্ক হত এবং আমাকে অবশ্যই বলত। আমার মনে হচ্ছে, শ্রাবন্তী যে-কোনো কারণেই হোক, তাকে কথাটা বলেনি। সেই উড়ো চিঠিটা কি অমলকে দেখিয়েছিল শ্রাবন্তী?
না। অমল বলেছে, চিঠিটা শ্রাবন্তী ভয় পেয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল।
কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন, এটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে।
মিঃ পটনায়ক বললেন, হ্যাঁ। তবে অমল নাকি ওই কথা শুনেই তাকে রাত্রে গার্ড দেবার জন্য এই হোটেলে থাকতে চেয়েছিল। তাই শ্রাবন্তী তার হয়ে দোতলার খালি সিঙ্গল স্যুইটটা রিসেপশনে এসে বুক করতে চেয়েছিল। কিন্তু রিসেপশনের দাসবাবু এবং কমলাদেবী অমলকে চেনেন। তাই
কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, জানি। তারপর নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে তিনি ফের বললেন, ডঃ হাজরা শ্রাবন্তীর এমপ্লয়ার। শ্রাবন্তী তারই ল্যাব-অ্যাসিস্টান্ট। ওই সাংঘাতিক কথাটা শ্রাবন্তীর ডঃ হাজরাকে তো বলা উচিত ছিল?
ডাঃ হাজরা চেপে গেছেন সম্ভবত। তাকেও আবার জেরা করতে হবে।
তার আগে চলুন, আমরা কৌশল্যার ঘরে যাই। কর্নেল উঠলেন। জয়ন্ত! তুমি আর শুয়ে পড়ে না। তিনটে বাজে। তুমি ব্যালকনিতে বসে সমুদ্র দর্শন কর! আমি আসছি।
আমারও ওঁদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু না ডাকলে যাই কী করে? অগত্যা ব্যালকনিতে বসে সিগারেট টানতে থাকলুম।
কিছুক্ষণ পরে কেউ দরজায় নক করল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি ডঃ পরিমল হাজরা। তাঁকে একটু উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন, কর্নেল সায়েব কোথায়?
বললুম, উনি ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে বেরোলেন।
ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কোথায় গেলেন জানেন?
ইচ্ছে করেই বললুম, বলে যাননি। আপনি ভেতরে আসুন না!
ডঃ হাজরা অনিচ্ছার সঙ্গে ভেতরে এলেন। দরজাটা নিজেই বন্ধ করে দিলেন। তারপর চেয়ারে বসে বললেন, কর্নেল সায়েবের সঙ্গে একটা বিষয়ে পরামর্শ করতুম।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, শ্রাবন্তী আপনাকে একটা উড়োচিঠির কথা বলেছিল, সেই বিষয়ে?
ডঃ হাজরা চমকে উঠলেন। উড়োচিঠি? কিসের উড়োচিঠি?
আপনাকে শ্রাবন্তী কিছু বলেনি তা হলে?
না তো!
আমার মধ্যে যেন কর্নেল ভর করেছেন তখন। বললুম, শ্রাবন্তী আপনাকে কি বলেনি ডঃ কৌশল্যা বর্মনের সঙ্গে একই ঘরে থাকতে তার ভয় করছে?
ডঃ হাজরা মাথা নেড়ে বললেন, ভয় করার কথা বলেনি। তবে বলেছিল, ভদ্রমহিলা তাকে পাত্তা দেন না। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। তাই ওঁর সঙ্গে তার থাকতে ভালো লাগছে না। আমি বলেছিলুম, আর তো দুটো দিন কিংবা বড় জোর তিনটে দিন থাকছি। তার আগেই ডঃ বর্মন চলে যাবেন। একটু সহ্য করে থাকো। কিন্তু আপনি উড়ো চিঠিফিটির কথা বলছেন। কে বলেছে আপনাকে?
মাথায় বুদ্ধি ফিরে এল এবার। বললুম, গুজব শুনেছি।
ডঃ হাজরা বললেন, কত গুজব শোনা যাবে এখন। সব বাজে কথা! আমি কর্নেল সায়েবের সঙ্গে একটা বিষয়ে পরামর্শ করতে চাই।
একটু হেসে বললুম, আমাকে বলতে আপত্তি কিসের? কর্নেল আমাকে কোনো কথা গোপন করেন না। আমি বরং কর্নেলকে বলে রাখব আগে থেকে। তাতে উনি ভাবনা-চিন্তার সময় পাবেন। তারপর আপনি কথা বলবেন।
আমার ল্যাব-অসিস্ট্যান্ট শ্রাবন্তীর ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ সবই পুলিশ কাস্টডিতে আছে। শ্রাবন্তীর কাছে আমার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ পেপার রাখতে দিয়েছিলুম। সেগুলো আমার দরকার। কারণ ডঃ পাণ্ডে তো রাতের ট্রেনে পাটনা ফিরে যাবেন। তার আগে কর্নেল সায়েব যদি পুলিশকে বলে সেগুলো আমাকে ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, ভালো হয়।
শ্রাবন্তীর জিনিসপত্র পুলিশ আপনাকে দিতে চাইছে না নাকি?
সকালে ও সি এবং ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরকে কথাটা বলেছিলুম। কিন্তু ওঁরা বললেন, সব সার্চ করে দেখা হবে। তারপর শ্রাবন্তীর বাবা বা গার্জেন এলে তার জিনিসপত্র তার হাতে তুলে দেওয়া হবে। আপনি তার কাছে আপনার কী আছে-না-আছে, চেয়ে নেবেন। এটা পুলিশের বজ্জাতি নয়? বলুন।
শ্রাবন্তীর বাবা আছেন?
হ্যাঁ। খবর পাওয়ার পর তার আসতে দেরি হতে পারে। তারপর তো তাঁর মানসিক অবস্থা কী হবে বুঝতেই পারছেন। পুলিশ কাস্টডি থেকে জিনিসপত্র ডেলিভারি পাওয়া–ওদিকে শ্রাবন্তীর শেষকৃত্য কোথায় তার বাবা করবেন, এ সব নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকবেন। ওই অবস্থায় আমার রিসার্চ পেপার চাওয়া কি উচিত? বরং তিনি আসবার আগেই আমি আমার পেপারগুলো পেলে ভালো হয়।
শ্রাবন্তীর বাবা কী করেন?
শুনেছি রিটায়ার্ড সরকারি কর্মচারী। বয়স প্রায় ৬৫-৬৬ বছর। একবার নাকি স্ট্রোক হয়ে গেছে। এমন মানুষ এসে পৌঁছুতে দেরি হতেই পারে। তা ছাড়া ট্রেনের যা অবস্থা!
একটু অবাক হয়ে বললুম, খবর তো কাল রাতেই পুলিশ কলকাতার লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়েছে শুনেছি। এখনও এসে তিনি পৌঁছুতে পারলেন না?
তা হলেই বুঝুন!
শ্রাবন্তীর বাবার নাম কী?
মৃগাঙ্ক সেন। আমি তাকে অবশ্য দেখিনি। বলে ডঃ হাজরা ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালেন। দেখি, কর্নেল সায়েব নীচে লাউঞ্জে আছেন নাকি।
ডঃ হাজরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আণবিক জীববিজ্ঞানী পরিমল হাজরার মাথায় হঠাৎ তার রিসার্চ পেপারের চিন্তা এল কেন? গত চারদিনে ডঃ পাণ্ডের সঙ্গে তার অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। আজ ডঃ পাণ্ডে চলে যাবার দিন বিকেলে ডঃ হাজরা তাঁর সঙ্গে নিজের রিসার্চ বিষয়ে আলোচনা করতে চান।
ওটা কৌশল্যাদির চুরি যাওয়া সেই রিসার্চ পেপারটা নয় তো? এমন তো হতেই পারে, শ্রাবন্তীকে যে খুন করেছে, সে কৌশল্যাদির ফাইলটা চুরি করেনি অর্থাৎ শ্রাবন্তী খুন হয়েছে অন্য কোনো কারণে? আর কৌশল্যাদির রিসার্চ পেপারের ফাইল শ্রাবন্তীই ডঃ হাজরার নির্দেশে চুরি করেছিল?
কর্নেলকে এখনই বলা উচিত আমার এই থিয়োরিটা। কিন্তু এখনও হয়তো কর্নেল এবং মিঃ পটনায়ক কৌশল্যাদির স্যুইটে বসে কথা বলছেন। আমার এ সময় সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না।
ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম। তারপর চোখে পড়ল মজার দৃশ্য। দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের কাছে ডঃ পাণ্ডে হাত তুলে মারতে যাচ্ছেন পাগলাবাবুকে। পাগলাবাবু অমনি সরে গিয়ে তর্জনী তুলে তাকে কিছু বলছেন। বারকতক হাত তোলার পর ডঃ পাণ্ডে যেন খেপে গেলেন। একটা পাথর তুলে তাড়া করলেন পাগলাবাবুকে। অমনি পাগলাবাবু সবেগে নীচের কেয়াবনের ভেতর উধাও হয়ে গেলেন।
ডঃ পাণ্ডে রাশভারি মানুষ পাগলের পাগলামি তিনি বরদাস্ত না করতেই পারেন। তবে তার মতো সিরিয়াস লোককে পাগলের পাগলামিতে এত বেশি। খেপে যেতে দেখে কৌতুক অনুভব করলুম। তারপর একটু অস্বস্তিও হল। পাথরটা গায়ে লাগলে পাগলাবাবু নির্ঘাত মারা পড়তেন।
ডঃ পাণ্ডে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে নিচে নেমে গেলেন।
দরজায় কেউ নক করল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি নব চা এনেছে। চারটে বেজে গেল এর মধ্যে? বললুম, কর্নেল সায়েবকে দেখেছ?
নব বলল, আজ্ঞে, উনি আর সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসার একটু আগে ক্যান্টিনহলে গিয়ে কফি খাচ্ছেন।
কৌশল্যাদি–মানে ডঃ কৌশল্যা বর্মন ওঁদের সঙ্গে নীচে যাননি?
না। বর্মন দিদিমণিকে চা দিয়ে এলুম ওঁর ঘরে।
একা আছেন উনি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
হাজরা সায়েব আর তার মিসেসকে দেখেছ?
হাজরা সায়েবকে দেখিনি। ওঁর ওয়াইফ একা হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন দেখলুম।
আচ্ছা নব! এই এলাকায় কোনো শিখ ভদ্রলোককে তুমি আজ কোনো সময় দেখেছ?
নব গাল চুলকে বলল, এই হোটেলে তো দেখিনি!
হোটেলে নয়, রাস্তায়। অটোরিকশা চেপে যাচ্ছিলেন এমন কাউকে?
আমি তো বেরোই কম। লক্ষ্য করিনি স্যার!
ঠিক আছে।
নব চলে গেলে দরজা আটকে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম। চা জুড়িয়ে গেছে। প্রায়। এবার টের পেলুম আমাকে গোয়েন্দার ভূতে ধরেছে। নিজের ওপর খাপ্পা হয়ে চা শেষ করে সিগারেট ধরালুম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, আর ওইসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাব না। তবে কর্নেলকে শুধু ডঃ হাজরার ব্যাপারটা জানিয়ে দেব।
বিচের দিকে তাকিয়ে দেখলুম কালকের মতোই ডঃ পাণ্ডের সঙ্গ ধরেছেন। মিসেস মালবিকা হাজরা। তারপর বাঁ দিকে ঘুরতেই চোখে পড়ল একই দৃশ্য। গাধাটার পেছনে লেগেছেন পাগলাবাবু।
ঠাণ্ডা চা খেয়ে মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। প্যান্ট-শার্ট পরে ব্যালকনির দরজা এঁটে বেরিয়ে গেলুম। সুইটের দরজা আপনা-আপনি লক হয়ে গেল।
নীচে গিয়ে ক্যান্টিনে দেখি, আর কেউ নেই। শুধু কর্নেল আর মিঃ পটনায়ক বসে চাপাস্বরে কথা বলছেন। ডঃ হাজরা লাউঞ্জে চুপচাপ বসে আছেন। কর্নেল হাত তুলে আমাকে ডাকলেন।
কাছে গিয়ে বললুম, ঠাণ্ডা চা খেয়ে মেজাজ খারাপ। তাই গরম চা খেতে এলুম।
কর্নেল হাসলেন। নব তো প্রচণ্ড গরম চা দেয়। চা তাহলে তোমার নিজের দোষেই ঠাণ্ডা হয়েছে। কিছু দেখতে অন্যমনস্ক ছিলে কিংবা নবর সঙ্গে কথা বলছিলে!
ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পটনায়কও মুচকি হেসে বললেন, কাগজে লেখার মতো বিষয় চোখে পড়েছিল জয়ন্তবাবুর।
সঞ্জয় নামে তরুণ হোটেলবয় কর্নেলের ইশারায় ততক্ষণে হাজির হয়েছিল। তাকে আমার জন্য কফির অর্ডার দিয়ে কর্নেল বললেন, চুপ করে না থেকে বলো জয়ন্ত, কেন চা ঠাণ্ডা হল?
এবার আমিও হেসে ফেললুম। আপনি ঠিকই ধরেছেন। নবর সঙ্গে কথা বলছিলুম।
কিছু মিলল তার কাছে?
নাহ্। তবে তার আগে ডঃ হাজরা আপনার খোঁজে গিয়েছিলেন।
মিঃ পটনায়ক ঘড়ি দেখে বললেন, তা হলে উঠি কর্নেল সরকার। শ্রাবন্তীর জিনিসপত্রের মধ্যে ডঃ হাজরার কোনো পেপার থাকলে সেটা আমাদের লোক আগে আপনার মাধ্যমে কৌশল্যাদেবীকে গোপনে দেখাবে। তারপর আপনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রয়োজনে সঙ্গে সঙ্গে রিং করবেন আমাকে।
ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর চলে যাওয়ার পর বললুম, কৌশল্যাদির ফাইল চুরির কথা তা হলে শেষ পর্যন্ত বলেছেন পুলিশকে?
কর্নেল বললেন, আমি বলিনি। কৌশল্যাই হঠাৎ বলে ফেলল। আসলে ওকে দোষ দেওয়া উচিত হবে না। ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে ছিল বেচারি।
দড়িটা দিয়েছেন মিঃ পটনায়ককে?
হ্যাঁ। শিখ ভদ্রলোকের কথা বলেছি। মিঃ পটনায়ক বুদ্ধিমান। ওঁর মতে, খুনী শিখের ছদ্মবেশ ধরেছিল এবং পার্বতীর মন্দিরে কাকেও দেখা করতে গিয়েছিল। তারপর ওখানেই ঝোপঝাড়ের আড়ালে মাথার পাগড়ি মুখে গোঁফ দাড়ি, হাতের বালা ইত্যাদি খুলে ব্যাগে ভরে রাখে। তাই আমরা গিয়ে তাকে আর দেখতে পাইনি।
কিন্তু আপনার থিয়োরি কী?
একই। কর্নেলের চুরুট জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়েছিল। অ্যাশট্রেতে ঘষে নিভিয়ে বললেন, আসলে আমার থিয়োরি মিঃ পটনায়কের মুখ দিয়ে যাচাই করে নিয়েছি। একই অঙ্ক দুজনে আলাদাভাবে কষে একই ফল বেরিয়েছে।
কৌশল্যাদি কি বললেন যে, তাকে শ্রাবন্তীর উড়োচিঠির কথা বলেছিল, কিংবা কোনোভাবে তাকে সাবধান করে দিয়েছিল–অন্তত পরোক্ষভাবে?
নাহ্। তবে শুনলে অবাক হবে, শ্রাবন্তীর বিছানার ম্যাট্রেসের তলায় একটা ভ্রু-ড্রাইভার আর একটা ছোট্ট সাঁড়াশি উদ্ধার করেছেন ও সি মিঃ রণবীর জেনা।
কখন?
আজ বেলা সাড়ে এগারোটায় যখন তিনি এসে দ্বিতীয়বার ঘর সার্চ করেন, তখন ওই দুটো জিনিস পাওয়া গেছে। তখন আমরা ছিলুম না হোটেলে।
তা হলে শ্রাবন্তীই ফাইল চোর?
তা বলা কঠিন। খুনীই ওই জিনিস দুটো তার ম্যাট্রেসের তলায় রেখে তাকেই ফাইল চোর সাব্যস্ত করতে চেয়েছে–এমনও তো হতে পারে।
কিন্তু শ্রাবন্তীকে খুন না করে ভয় দেখিয়েও তো কেউ ফাইল চুরি করে পালাতে পারত?
ওহ্ জয়ন্ত! তুমি ভুলে গেছ আমার থিয়োরি। খুনী শ্রাবন্তীর চেনা। তাই তার মুখ চিরতরে বন্ধ করার জন্যই ফাইলচোর তাকে হত্যার প্ল্যান করেছিল। ইন্টারলকিং সিস্টেমের সমস্যা আছে। ১৭ নম্বর স্যুইটের লক ভাঙার ঝুঁকি প্রচুর। করিডরে যে-কোনো মুহূর্তে কেউ না কেউ এসে পড়বে। কাজেই ফাইলচোর ওত পেতে ছিল কখন শ্রাবন্তী একা স্যুইটে ঢুকবে। তার সঙ্গে কথা বলার ছলে সে ভেতরে যাবে।
যদি শ্রাবন্তীর না ঢুকে একা কৌশল্যাদি ঢুকতেন?
কৌশল্যারও হয়তো একই অবস্থা হত কি না বলা কঠিন। কারণ শ্রাবন্তী যে কোন সময় এসে পড়ত। তবে ফাইলচোর আগে কৌশল্যা কোথায় আছে সে বিষয়ে শিওর হয়েছিল। মনে করে দেখ, তখন কৌশল্যাই ছিল হোটেল দ্য শার্কে ডঃ আচারিয়ার কাছে। অতএব সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল ফাইলচোর।
কিন্তু শ্রাবন্তী উড়োচিঠি পেয়েও সতর্ক করেনি কেন কৌশল্যাদিকে–এটা অদ্ভুত মনে হয় না?
কর্নেল মাথা নাড়লেন। না, ব্যাপারটা টাইমিং ফ্যাক্টরের। অর্থাৎ সময়টা হিসেব করতে হবে। তা হলেই সমস্যার জট খুলে যাবে। অমলের স্টেটমেন্টও জট খোলার ব্যাপারে সাহায্য করেছে।
এতক্ষণে কফি আনল সঞ্জয়। বলল, স্যার! দেরি হয়ে গেল। পারকোলেটারে গণ্ডগোল হয়েছিল।
ঠিক আছে। বলে কর্নেল তাকে চলে যেতে ইশারা করলেন। সে চলে গেলে তিনি বললেন, বৃষ্টির আগে শ্রাবন্তীকে ডঃ হাজরা দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংস ভূপে গোপনে প্রেম নিবেদন করতে ডেকে নিয়ে যান। কৌশল্যা তাদের দেখেই ফিরে আসে। তার কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি শুরু হয়। ডঃ হাজরা ও শ্রাবন্তী মাথা বাঁচাতে ছুটে আসেন এবং ডঃ হাজরার স্ত্রীর ভয়ে একা হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই না?
ঠিক বলেছেন।
ঠিক এই সময় শ্রাবন্তী দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে ছুটে এসে রোডসাইড কাফের বিশাল ছাতার তলায় যদি আশ্রয় নেয়? এটাও তো স্বাভাবিক। সেখানে আরো অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই ভিড়ের মধ্যে কেউ তার হাতে একটা চিঠি যদি গুঁজে দেয়? এরপর চিঠিটা পড়ে সে অমলকে খুঁজে বের করতে পারে। তারপর অমল তাকে গার্ড দেবার জন্য এই হোটেলে একটা সুইট বুক করার প্রস্তাব দিতে পারে।
বললুম, দিতে পারে কী? দিয়েছিল। কিন্তু দাসবাবু আর কমলাদেবী না করে দেন।
কর্নেল বললেন, এরপর শ্রাবন্তী স্যুইটে ফিরে যায় এবং খুনীও তাকে ফলো করে।
হাসতে হাসতে বললুম, আপনার অঙ্কটা ঠিক আছে। তবে আকস্মিকতা বড্ড বেশি।
জয়ন্ত! সব হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্ল্যান থাকে। কিন্তু হত্যার ঘটনা আচম্বিতে। মওকা পেলেই ঘটে যায়।
.