পাঁচ
হিরু চাচা অবাক চোখে চেয়ে রইল মার্শালের দিকে।
‘আচ্ছা, তাই বলুন। আমি সফল না হলে কী হবে?’
‘প্রশ্নটা ওঠা উচিত নয়।’
‘আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস দেখে কৃতজ্ঞ বোধ করছি। আশা করি আমরা এখন আর বন্দি নই?’
‘আমার প্রিয় ডক্টর…’ চিন্তাটাকে হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলেন মার্শাল।
হার্ভে হন্তদন্ত হয়ে ওঁদের দিকে এগিয়ে এলেন।
‘আমরা ফ্লীটটা লোকেট করেছি, স্যর।’
‘তা হলে এখুনি আক্রমণের নির্দেশ দিন। আসুন, ডক্টর। আপনি নিজের চোখেই দেখবেন।’
মার্শাল হিরু চাচাকে মেইন স্পেস রাডার স্ক্রীনের কাছে নিয়ে গেলেন। ওটায় দেখা গেল দুই গুচ্ছ খুদে ব্লিপ।
‘দেখুন, ডক্টর, অ্যাট্রিয়সের শক্তিশালী ব্যাটল ফ্রীট, আর আমাদের যিয়ন শত্রুরা। যেসব অস্ত্র আপনি পাচ্ছেন ওগুলো দেখুন, কেননা আপনিই আমাদের বিজয়ের নতুন স্থপতি।’
‘এক ডজন শিপ? এই-ই কি অ্যাট্রিয়সের মহা শক্তিশালী ব্যাটল ফ্লীট?’
‘সত্যিটা জানলে আমার লোকেরা হতাশ হয়ে পড়বে, ডক্টর। আশা নিয়ে বেঁচে থাকে তারা। তাদের আর কোনও সম্বল নেই। আমাদের ফ্যাক্টরিগুলোর বেশিরভাগই পঙ্গু, প্রোডাকশন বন্ধ প্রায়। কিন্তু তারপরও আমরা লড়ে যাচ্ছি, এ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই।’
‘তাই! কেন?’
‘আমাদেরকে জিততেই হবে। যুদ্ধ একটা ব্যয়বহুল ব্যাপার কিন্তু এর দরকার আছে, আপনি নিজেই দেখবেন! আক্রমণের নির্দেশ দিন, হার্ভে!’
হার্ভে সামনে ঝুঁকলেন।
‘বেস টু ফ্লীট। আক্রমণ শুরু করুন!’
মার্শাল তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ যোগ করলেন।
‘আক্রমণ! আক্রমণ! আক্রমণ!’
.
মেইন বডি থেকে চারটি অ্যাট্রিয়ান রিপের একটি সারি বিচ্ছিন্ন হয়ে এঁকেবেঁকে যিয়ন ফ্লীটের উদ্দেশে চলে গেল।
হার্ভে একটি রিলে ফ্লিপ করলেন এবং সম্মিলিত বিভ্রান্ত কণ্ঠস্বর ভরিয়ে তুলল ওয়ার রুমটি।
‘ক্লোজিং…ক্লোজিং…রেঞ্জ ফোর থার্টি। হোল্ড অন সেভেন যিরো।’
‘রিপোর্ট আরডিএফ এবং অ্যাটিচুড ফোর থ্রি মেইনটেইন করুন। ক্লোজিং, আমাদের এখন সব সেক্টরে পূর্ণ যুদ্ধাবস্থা রয়েছে।’
অ্যাট্রিয়ান ফ্লীট থেকে আরও-আরও ব্লিপ ছিন্ন হলো। ওদের সঙ্গে মিলিত হতে তেড়ে আসছে যিয়ন ব্লিপ। শীঘ্রি প্রকাণ্ড স্ক্রীনটা ঘূর্ণায়মান বিন্দুতে ভরে উঠল। হঠাৎই দুটি ব্লিপ পরস্পর মিলিত হলো, আলোর বিস্ফোরণের পর একটি স্রেফ উবে গেল।
‘হিট করেছে, স্যর,’ চেঁচিয়ে উঠলেন হার্ভে। ‘হিট, কনফার্মড!’
আরেকটি যিয়ন ব্লিপ মুছে গেল।
‘আরেকটা!’ চিৎকার ছাড়লেন মার্শাল।
টেকনিশিয়ানরা উল্লাসে ফেটে পড়ল।
আরেকটি ব্লিপ অদৃশ্য হলো।
‘আমাদের একটা গেল, স্যর,’ বললেন হার্ভে।
আরেকটি বিস্ফোরণ।
‘ওটা?’ খেঁকিয়ে উঠলেন মার্শাল।
‘ওটাও আমাদের, স্যর।’
যুদ্ধ চলতে লাগল, এবং শীঘ্রি স্পষ্ট হলো অ্যাট্রিয়ান শিপগুলো যিয়নদের শিপগুলোর চাইতে দ্রুততর গতিতে অদৃশ্য হচ্ছে।
হার্ভে মার্শালের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে চাইলেন।
‘ফিরিয়ে আনব, স্যর?’
‘প্রশ্নই ওঠে না! আক্রমণ জোরদার করুন!’
তুমুল যুদ্ধ চলতে লাগল। একে-একে অ্যাট্রিয়ান শিপগুলো বিস্ফোরিত হচ্ছে পর্দা থেকে। হিরু চাচা দেখে যাচ্ছে, মুখের চেহারায় নিরানন্দ অভিব্যক্তি। এটা যেন এক ধরনের ইলেকট্রনিক গেম-কিন্তু সে জানে পর্দা থেকে আলোর যে বিন্দুটি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সেটি আসলে স্পেস ফাইটারের ক্রুর মৃত্যুর প্রতিনিধিত্ব করে, জীবন সত্যিকার অর্থে শুরু হওয়ার আগেই যুবকদের প্রাণ চলে যাচ্ছে অর্থহীন এক যুদ্ধে।
মার্শালের মুখের চেহারায় মেঘের ঘনঘটা।
‘ওদের কী হয়েছে, হার্ভে? ওরা হারছে কেন?
‘অনভিজ্ঞতা, স্যর। সাহস আছে, কিন্তু প্রপার ট্রেনিং নেই। অভিজ্ঞ ক্রুরা বহু আগেই মারা পড়েছে।’ মুহূর্তের নীরবতা।
‘ওদের ফিরিয়ে আনুন,’ আদেশ করলেন মার্শাল।
কমাণ্ড মাইকের উপর ঝুঁকে পড়লেন হার্ভে।
‘অল ইউনিটস, ডিসএনগেজ। অল ইউনিটস, ডিসএনগেজ।’
পর্দা ফাঁকা হয়ে গেল।
হিরু চাচার দিকে ঘুরে চাইলেন মার্শাল।
‘তিনটা শিপ থাকল, একসময়ের নামকরা ব্যাটল ফ্লীট থেকে। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই কেন আপনার সাহায্য আমাদের দরকার? আমাদের এমন এক অস্ত্র চাই যাতে হানাদারদের আকাশ থেকে চিরদিনের মত মুছে দেয়া যায়। আপনি কি পারবেন ওটা সাপ্লাই দিতে?’
‘মনে হয় পারব,’ শীতল কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। ‘অস্ত্রটার নাম কী?’
‘শান্তি।’
হেসে উঠলেন মার্শাল।
হাসালেন, ডক্টর। শান্তি! সেই মারণাস্ত্র হাতে না পেলে আমাদের শান্তি আসবে কীভাবে?’
‘অস্ত্রটা পেলে ওটা দিয়ে কী করবেন বলুন তো।’
‘ব্যবহার করব আবার কী? কাজ করে কি না দেখব।’
‘কংগ্রাচুলেশন্স, মার্শাল,’ বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। ‘আপনার সত্যিকারের মিলিটারি মাইণ্ড আছে।’ মুহূর্তের জন্য বিরতি নিল। ‘আমি কী করব বলি। আপনি আমাকে প্রিন্সেস ডায়ানাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করুন, আমি আপনাকে একটা ভয় দেখানোর জিনিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেব।’
মার্শাল তার দিকে সন্দেহের চোখে চাইলেন। এবার উজ্জ্বল হেসে এক বাহু দিয়ে হিরু চাচার কাঁধ জড়িয়ে ধরলেন।
‘আপনাকে আমি পছন্দ করি, ডক্টর, সত্যি বলছি। এই অস্ত্রটা কী ধরনের?’
‘ছাতার মত,’ অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। ‘এক ধরনের ফোর্স ফিল্ড, কোনও শিপ ওটা ভেদ করতে পারবে না।’
‘গুড! তার মানে আমরা আক্রমণ করব, কিন্তু ওরা পাল্টা মারতে পারবে না?’
‘ঠিক তা নয়। এটা দু’ভাবেই কাজ করে। ওরা ঢুকতে পারবে না, আর আপনারাও বেরোতে পারবেন না।’
‘তা হলে জিতব কীভাবে আমরা? আমাদের জিততেই হবে!’
‘বাধা সব সময়ই থাকে—তবে আমি ও ব্যাপারে কাজ করব। আমার রোকুকে দরকার হবে।’
মার্শাল সরাসরি তার দিকে চাইলেন।
‘রোকু?’
‘আমার মোবাইল কম্পিউটার। অনেকটা রোবট কুকুরের মত দেখতে।’
মার্শাল চরকির মত হার্ভের দিকে ঘুরলেন।
‘শুনেছেন তো।’
‘মনে হয় অনেক দেরি হয়ে গেছে, স্যর,’ মরিয়ার মত বললেন হার্ভে। ‘ওটা এতক্ষণে ফার্নেসের পথে রয়েছে!’
হিরু চাচা রীতিমত আতঙ্কিত।
‘ফার্নেস! কোন্ ফার্নেস!’
হার্ভে ঝটপট ব্যাখ্যা করলেন রোকুর ভাগ্যে কী ঘটেছে। ‘ওকে রিসাইক্লিঙের জন্যে পাঠানো হয়েছে। আমরা সব স্ক্র্যাপকে রিসাইকল করি।’
‘স্ক্র্যাপ!’ বুনো কণ্ঠে বলে উঠল হিরু চাচা। ‘এই ফার্নেসটা কোথায়?’
‘আমাদের ঠিক নীচের লেভেলে—কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে!’
হিরু চাচা হার্ভের দু’কাঁধ চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিল।
‘ওটা কোথায়? ওখানে কীভাবে যায় বলুন-এক্ষুনি!’
.
সিটি কমপ্লেক্সের বেশিরভাগের নীচ দিয়ে রিসাইক্লিং কনভেয়ার-বেল্ট চলে গেছে, এবং রোকুর কপাল ভাল ও সাইকলের গোড়ার দিকের এক পয়েন্টে যোগ দিয়েছিল।
বেল্টে চড়ে শহরের নীচে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়েছে সে। খানিক পরপরই ঘর-ঘর, ঠং-ঠং শব্দে বিভিন্ন শ্যুট থেকে বেল্টে আছড়ে পড়েছে স্ক্র্যাপ, এবং একবার তো ধাতব জঞ্জালে গোসলই সারতে হয়েছে রোকুকে।
এমুহূর্তে মনে হচ্ছে ওর ভাগ্য যেন আর সহায় হচ্ছে না। খানিকক্ষণ হলো তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, এবং অদূরেই এক টকটকে লাল আভা চোখে পড়ছে। কনভেয়ার-বেল্ট ধাতব দেয়াল ঘেরা এক কামরায় ঢুকেছে। ফার্নেসের কাছে পৌঁছে গেছে ও।
কনভেয়ার-বেল্টটি আড়াআড়িভাবে কামরা পেরিয়ে সোজা এক খোলা হ্যাচের ভিতরে ঢুকে গেছে, যার ওপাশে জ্বলন্ত তাপমাত্রার আলো ছাড়া আর কিছু নেই। চোখের কোণে দেখতে পেল রোকু, ভাঙাচোরা ধাতব জিনিসপত্র একে-একে ফার্নেসে পড়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে। ও প্রচণ্ড তাপ অনুভব করছে ওর কেসিঙে।
করার মত কাজ একটাই আছে।
‘বন্ধ হয়ে যাচ্ছে,’ ক্ষীণ স্বরে বলল রোকু। ‘সব সিস্টেম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
এ সময় ফার্নেস রূমের দরজা হাট হয়ে খুলে গেল এবং উদয় হলো হিরু চাচা।
মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল সে, তীব্র আলোর সামনে চোখ বুজে গেল।
রোকু এখন বেল্টের একদম শেষ প্রান্তে, হ্যাচের ক’ইঞ্চি দূরে।
মুখে স্কার্ফ পেঁচিয়ে, হাতে দস্তানা পরে ফার্নেস ঘিরে থাকা গনগনে আভা লক্ষ করে ঝাঁপ দিল হিরু চাচা। কষ্টেসৃষ্টে সামনে এগোল সে, প্রায় নিরেট এক তাপের দেয়াল ভেদ করে পথ করে নিল…
.
‘ওই ফার্নেসটা বন্ধ করে দিন,’ গর্জে উঠলেন মার্শাল।
হার্ভে এক কন্ট্রোল কনসোলে মহা ব্যস্ত।
‘করেছি, স্যর। কিন্তু ওটার ঠাণ্ডা হতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়…’
‘ডক্টরের মরা চলবে না, হার্ভে। এখনই নয়। এবং ওই রোকুটাকে যদি তার দরকার হয়…’
ব্যথিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন হার্ভে।
‘ওটা ফার্নেসে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে ধ্বংস হয়ে গেছে। সরি, স্যর।’
‘সরি!’ আর্তনাদ ছাড়লেন মার্শাল। ‘সরি?’
রাগে শ্বাসরুদ্ধ প্রায়, টিউনিকের কলার ঢিলে করার উদ্দেশ্যে টানতে লাগলেন।
কিশোর মার্শালকে সতর্ক চোখে লক্ষ করছে, ভাবছে হিরু চাচার বিপদের আশঙ্কায় তিনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন। মার্শাল কলার ধরে টানতেই, তাঁর গলায় কিছু একটা মুহূর্তের জন্য চোখে পড়ল ওর-ছোট, কালো এক সিলিণ্ডারের মত কী যেন।
ভাল মত দেখার চেষ্টা করছে, এ সময় দোরগোড়া থেকে পরিচিত এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
‘কীরে, কী খবর তোদের?
পাঁই করে ঘুরল ও, এবং হিরু চাচাকে দেখতে পেল, রোকুকে শিকলের মত স্কার্ফ পেঁচিয়ে পিছন-পিছন টেনে আনছে। স্কার্ফটার কিনারাগুলো পুড়ে গেছে, কিন্তু হিরু চাচা আর রোকু একদম অক্ষত।
‘হিরু চাচা!’ আনন্দচিত্তে বলে উঠল কিশোর। ‘তুমি ঠিক আছ? রোকুর কী খবর?’
রোকুর দিকে চোখ নামাল হিরু চাচা।
‘এখন ঠিক আছিস, তাই না রে?’
‘জি, প্রভু।’
‘তুই তো এমনকী সামান্য ছ্যাঁকাও খাসনি!’ বলল কিশোর।
‘বালির ফায়ার ওয়াকারদের কাছ থেকে ছোট্ট কৌশলটা শিখেছিলাম,’ বিনীত কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। ‘ওরা এ ধরনের কাজ সব সময় করে!’
মার্শাল দ্রুত এগিয়ে এসে তার হাত ঝাঁকিয়ে দিলেন।
‘আপনি আর আপনার…বন্ধু আমাকে ক্ষমা করবেন।’
‘ঠিক আছে। আমরা সবাই ভুল করি, তাই না রে, রোকু?’
‘জি না, প্রভু!’
ওর কথা উপেক্ষা করে হিরু চাচা বলে চলল, ‘মনে হচ্ছে আপনি টু-ওয়ে ফোর্সফিল্ডে রাজি নন, মার্শাল। বেশ, আপনি যদি জোর করেন আপনার ইচ্ছে মতই সব হতে হবে…’
‘করছি, ডক্টর।’
‘জানতাম করবেন। আমরা যদি ওয়ান-ওয়ে ফোর্সফিল্ড সেট আপ করি, যাতে করে যিয়নদের ঠেকানো যাবে কিন্তু আপনারা ওদেরকে আক্রমণ করতে পারবেন, তা হলে আগে আমাদের শত্রুদের চিনতে হবে।’
‘তার মানে?’
‘একটা মানসিক বাধা তৈরি করা যেতে পারে। সস্তা, দক্ষ, এনার্জি সেভ করবে, এবং ওটা যিয়নদের এখানে আসতে চাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেবে। অ্যাট্রোফোবিয়ার উপাদান ইন্ট্রোডিউস করা বলতে পারেন!’
কিশোর অবাক চোখে হিরু চাচার দিকে চাইল। ও যদ্দূর জানে, সে একেবারে ফালতু বকছে।
‘দারুণ আইডিয়া, হিরু চাচা,’ সমর্থন দিয়ে বলল ও।
হিরু চাচা বলে যাচ্ছে, ‘সেজন্যে একজন যিয়নের সাথে আমার দেখা করা দরকার। তাদের চিন্তা-ভাবনা, ব্রেন প্যাটার্ন এসব জানতে হবে আরকী। ঠিক না রে, ভাতিজা?’
‘সে আর বলতে। এ ছাড়া উপায় নেই।’
হিরু চাচা মার্শালের দিকে চাইল।
‘দেখলেন তো? কিশোর আমার কথায় সায় দিচ্ছে। আপনি এর ব্যবস্থা করতে পারবেন, মার্শাল?’
‘না, ডক্টর।’
‘যে-কোনও একজন হলেই হবে, বিশেষ কাউকে লাগবে না। বুদ্ধিমান লোকেরও দরকার নেই, যে-কোনও বুড়ো বন্দি হলেও চলবে।’
‘কোনও বন্দি নেই, ডক্টর। আমাদের মত যিয়নরাও শপথ নিয়েছে, ধরা দেবে না, আত্মহত্যা করবে। অসম্মানের আগে মৃত্যু!’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল হিরু চাচা।
‘কী আর করা। যিয়ন খুঁজে না পেলে অন্য কিছু ভাবতে হবে।’
মার্শাল তার দিকে হুঁশিয়ার করার দৃষ্টিতে চাইলেন।
‘সময় চলে যাচ্ছে, ডক্টর।’
‘সত্যিই,’ সায় দিল কিশোর। ‘প্রিন্সেস ডায়ানার কী অবস্থা-কোনও খবর পাওয়া গেল?’
‘গোয়েন্দা সংস্থা বলছে তাঁকে যিয়নরা কিডন্যাপ করেছে। তিনি যদি…’ হাত নেড়ে বিষয়টাকে উড়িয়ে দিলেন মার্শাল।
হার্ভে ছিলেন রাডার স্ক্রীনে।
‘মার্শাল, যিয়ন ফ্লীট। আবার হামলা করতে যাচ্ছে।’
মার্শাল হনহন করে স্ক্রীনের দিকে এগোলেন, এবং কিশোর হিরু চাচার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
‘তুমি রোকুর খোঁজে ফার্নেসে নামার পর মার্শাল প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল তুমি মারা পড়তে পারো।’
‘আহা, কত মায়া আমার জন্যে!’
‘বারবার বলছিল ডক্টরের মরা চলবে না-এখনই নয়। আর আমি তার গলায় একটা জিনিস দেখেছি, সিলিণ্ডারের মত।’
‘কন্ট্রোল ডিভাইস?’
‘মার্শাল যদি পুতুল হয় তবে সুতো ধরে টানছে কে?’
‘আয়নাটার পিছনে কী আছে কে জানে, চিন্তামগ্ন গলায় বলল হিরু চাচা। ‘লোকটার অসম্ভব ভক্তি ওই আয়নাটার প্রতি।’
ডিলাক এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিলেন, নিজের অবস্থান সম্পর্কে অনিশ্চিত। হিরু চাচা গুপ্তচর থেকে অ্যাট্রিয়সের ত্রাণকর্তায় উন্নীত হওয়ায় তার সঙ্গী হিসেবে ডিলাকও আপাতত নিৰ্দোষ। চুপচাপ থাকাই ভাল মনে করেছিলেন। কিন্তু এখন আর নীরব থাকা যাচ্ছে না।
‘এসবের অর্থ কী? প্রশ্নের পর প্রশ্ন, কোনও জবাব নেই। আমরা ডায়ানাকে খুঁজছি না, আবার আপনারা দু’জন যা খুঁজছেন তারও ধারেকাছে নেই-আপনিই বলুন, আছি?’
‘ডায়ানাকে খুঁজে পেতে হয়তো দেরি হবে না,’ রহস্যময় শোনাল হিরু চাচার গলা। ‘চিন্তার কারণ হচ্ছে, যেন চাওয়াই হচ্ছে আমরা তাঁকে খুঁজে বের করি।
‘ফাঁদ?’
মাথা ঝাঁকাল হিরু চাচা।
‘কে কাকে ধোঁকা দিচ্ছি! মার্শাল আমাদের, না আমরা মার্শালকে?’
‘দেখুন, আমাকে শুধু বলুন ডায়ানা কোথায় থাকতে পারে এবং আমাকে খুঁজতে দিন।’ মরিয়ার মত বললেন ডিলাক। ‘আপনারা যা খুঁজছেন খুঁজতে থাকুন।’
‘আমি পুরোপুরি নিশ্চিত প্রিন্সেস ডায়ানা যিয়সে আছেন, ধীর গলায় বলল হিরু চাচা। ‘এখন জানতে হবে-কেন?’
কিশোর বলল, ‘কিন্তু কেউ তো যিয়স খুঁজে পাচ্ছে না।’ বাঁকা হাসল হিরু চাচা।
‘যিয়স জায়গামতই আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
‘কেন পাচ্ছি না?’
হিরু চাচা কিশোরের চোখের সামনে একটা হাত ধরল। ‘আমাকে এখন দেখতে পাচ্ছিস?’
‘না, তোমার হাতের জন্যে।’
‘ঠিক!’
‘তোমার ধারণা আমাদের আর যিয়সের মাঝখানে কিছু একটা রয়েছে? তা হলে আমরা কেন ও জিনিসটাকে দেখতে পাচ্ছি না?’
‘ওটা হয়তো আলো আর এনার্জি শোষে। হয়তো ওটা ভালমত ক্যামোফ্লেজ করা। জিনিসটা খুব ছোট, কিংবা বিশাল বড় হতে পারে, কিন্তু যা-ই হোক, ওটা আছে!’
‘তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘ক্রিস্টোফার কলম্বাস নিশ্চিত ছিলেন কী করে? আমি জানি ওটা আছে, ব্যস।’
‘সেজন্যেই হয়তো যিয়স থেকে ডায়ানা কোনও সঙ্কেত পায়নি,’ বাতলে দিলেন ডিলাক। ‘আমাদের কিছু একটা করতে হবে, ডক্টর। কোত্থেকে শুরু করব আমরা?’
হিরু চাচা মার্শালের দেয়াল আয়নার দিকে ভ্রূ দেখাল।
‘ওটার পিছনে কী আছে জানার মধ্য দিয়ে। কোথাও নিশ্চয়ই কোনও এন্ট্রান্স থাকবে। আয়, রোকু, আমাদের কিছু অঙ্ক কষতে হবে।’
হিরু চাচা রোকুকে ওয়ার রূমের এক নির্জন কোণে নিয়ে গেল, এবং ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল।
ডিলাক আর কিশোর আলগোছে সরে পড়ল। বেরনোর পথে ঘরের কোণের এক মেইনটেন্যান্স লকার থেকে এক টুল-কিট তুলে নিলেন ডিলাক।
ছয়
বিশাল স্পেস রাডার স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে যিয়ন ব্যাটল ফ্লীট অ্যাট্রিয়সের দিকে অব্যাহত গতিতে ধেয়ে আসছে।
‘রিইনফোর্সমেন্টের ব্যবস্থা করুন, আদেশ করলেন মার্শাল।
‘নেই, স্যর,’ ভোঁতা গলায় বললেন হার্ভে। ‘আমাদের যা কিছু ছিল সব ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছি, কিন্তু তারপরও ওরা থামছে না।’
‘এটা হয়তো শেষ যুদ্ধ…’ মার্শাল চারধারে নজর বুলালেন। ‘ডক্টর কোথায়?’
হিরু চাচা আর রোকুকে কোনায় দেখতে পেয়ে গটগট করে সেখানে চলে গেলেন।
‘ডক্টর, আমার ওই ফোর্সফিল্ডটা চাই।’ দূরাগত বিস্ফোরণের গুড়- গুড় শব্দে কেঁপে উঠল ওয়ার রূম। ‘আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে, এবং আমাদের আর লড়ার মত কিছু নেই। আপনিই আমাদের শেষ ভরসা।’
‘এটা শক্তির সমস্যা,’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল হিরু চাচা।
‘আমি আপনাকে সমস্ত এনার্জি প্রায়োরিটি দেব, আপনার যা-যা লাগে সব পাবেন।’
‘আপনার কাছে তা থাকতে হবে তো। রোকু এইমাত্র ও ব্যাপারে জানতে পেরেছে, তাই না রে, রোকু?’
‘জি, প্রভু। গোটা গ্রহ রক্ষার মত ফোর্সফিল্ড তৈরি করতে যে এনার্জি লাগবে তাতে পুরো অ্যাট্রিয়স গিলে ফেলতে হবে।’
‘তাতে জিনিসটার পরাজয় হবে, নির্দেশ করল হিরু চাচা। ‘আপনাদের যেহেতু বাস করার জন্যে কোনও গ্রহ আর থাকবে না। একটা মানসিক বাধার কথা বলেছিলাম, মনে পড়ে? এমন এক ব্যারিয়ার যেটা যিয়নরা পেরোতে পারবে না?’
‘আপনি বলেছিলেন গবেষণার জন্যে যিয়ন বন্দি লাগবে -কিন্তু আমাদের এখানে কোনও যিয়ন বন্দি নেই।’
‘যিয়সে আছে।’
‘আপনি আসলে ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?’
‘যিয়সে গিয়ে একটা যিয়নকে তুলে নেয়া-এবং প্রিন্সেস ডায়ানাকে ফিরিয়ে আনা-যদি তিনি সেখানে থাকেন আরকী।’
হঠাৎই এক টেকনিশিয়ান চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমরা একটা ভিডিও ট্র্যান্সমিশন পিক আপ করেছি, স্যর। যিয়স থেকে!’
তাঁরা শশব্যস্তে এক মনিটরের কাছে গেলেন এবং পর্দায় প্রিন্সেসের চেহারা দেখতে পেলেন।
‘অ্যাট্রিয়সের জনগণ! আপনারা অস্ত্র নামিয়ে রাখুন! যিয়নরা আমাকে বন্দি করেছে এবং আপনারা এখুনি আত্মসমর্পণ না করলে অ্যাট্রিয়সকে ধ্বংস করে দেবে বলে শপথ নিয়েছে। ভাইয়েরা আমার, আপনারা আমাকে ভালবাসলে নিজেদের রক্ষা করুন। মার্শালকে যিয়নদের হাতে তুলে দিন এবং ‘
মার্শাল রীতিমত সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনিটরের সুইচ অফ করে দিলেন। হিরু চাচার দিকে চাইলেন তিনি, মুখের চেহারা ফ্যাকাসে।
‘আপনার মানসিক বাধাটা, ডক্টর-ওটা কি আমাদেরকে খানিকটা শ্বাস নেয়ার সময় দেবে?’
‘ওটা আপনার ঘাড় বাঁচাতে সাহায্য করবে।’
মার্শাল জ্বলন্ত চোখে তার দিকে চাইলেন, এবং তারপর নিজেকে সামলে নিলেন।
‘আপনি যিয়সে যেতে পারেন, ডক্টর। একটা পথ আছে…’
.
ডিলাক কিশোরকে পিছনে নিয়ে এক অন্ধকার, সরু সার্ভিস টানেল ধরে এগোচ্ছেন।
‘এখানেই কোথাও হবে, যদি না আমি ডিরেকশন ভুল করে থাকি।’ পকেট থেকে যন্ত্রপাতি বের করে দেয়ালের এক ধাতব প্যানেল খুলতে লাগলেন তিনি।
কিশোর অধৈর্য চোখে লক্ষ করছে; প্যানেলটা খুলে আসতেই ডিলাককে ওটা নামিয়ে রাখতে সাহায্য করল। ডিলাক ফাঁকটা দিয়ে শরীর গলিয়ে দিলেন, এবং কিশোর অনুসরণ করল।
ওরা নিজেদেরকে এক ধরনের গোপন চেম্বারে আবিষ্কার করল। ছোট্ট এক চিলতে জায়গা, দূর প্রান্তের জানালায় ক্ষীণ আলো দেখা গেল। কিশোর ওটা দিয়ে উঁকি দিতেই মার্শালকে দেখতে পেল। তাঁর পিছনে ওয়ার রূমের মহা ব্যস্ততা। মার্শালের টু-ওয়ে আয়নার অপর পাশে রয়েছে ওরা। কামরায় একটি মাত্র জিনিস, লম্বা এক পেডেস্টালের উপরে দাঁড়িয়ে আলোকিত এক ক্রিস্টালের খুলি। কিশোর শিউরে উঠল। ওর কেন যেন মনে হলো জিনিসটা অশুভ।
ডিলাক বিস্মিত দৃষ্টিতে খুলিটার দিকে চেয়ে রইলেন।
‘কী ওটা?’
শশশ!’ বলল কিশোর।
মার্শাল কথা বলছিলেন, কণ্ঠস্বর অনুচ্চ এবং তাতে জরুরি তাগিদ।
‘কাজটা হয়ে গেছে। টাইম লর্ডদের বন্ধু কিছু সন্দেহ করেনি। তাকে আমি কে ব্লকের ট্র্যান্সম্যাট পয়েন্টে পাঠিয়েছি, আপনার সেবকরা যেখানে অপেক্ষা করছে।’
কিশোর শ্বাস চাপল।
‘টাইম লর্ডদের বন্ধু!’ ভাবল ও। ‘লোকটা জানল কীভাবে হিরু চাচার সাথে টাইম লর্ডদের খাতির আছে?’
মার্শাল তখনও ফিসফিস করছেন।
‘প্রভু আমার, আপনি সময়ের গোমর জানার পর আমাকে জেতার সুযোগ দেবেন। আমি আপনার কাছে আকুল আবেদন করছি। আমি বহু দিন ধরে অপেক্ষা করেছি…..
কিশোর ইতোমধ্যে ফাঁকটা গলে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
‘আসুন, ডিলাক, হিরু চাচাকে খুঁজে বের করে সাবধান করতে হবে।’
.
পকেটে দু’হাত পুরে, হিরু চাচা কে ব্লকের অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডরগুলো ধরে গটগট করে হেঁটে চলেছে। তাকে পায়ে-পায়ে অনুসরণ করছে রোকু। হিরু চাচা গভীর চিন্তায় মগ্ন।
‘কেন জানি মনে হচ্ছে আমি কিছু একটা ধরতে পারছি না, রোকু মার্শাল, যে যিয়সের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতা, একমাত্র সে কেন শত্রু গ্রহের ট্র্যান্সম্যাট লিঙ্ক জানবে? আর জানলেই বা আমাকে বলবে কেন?’
হিরু চাচা যে দরজা দিয়ে প্রিন্সেস ডায়ানা উধাও হয়েছিলেন সেটির সামনে থেমে দাঁড়াল। দরজাটা তখনও খোলা।
‘আমাদের মধ্যে একজন বোকার হদ্দ, রোকু!
‘ঠিক, প্রভু!’
হিরু চাচা অন্ধকার কামরাটিতে প্রবেশ করল। আগের মতই ফাঁকা ওটা, নিঃশব্দ, পরিত্যক্ত, সব কিছু ধুলো ধূসরিত। দূরের দেয়ালের কাছে হেঁটে গেল সে এবং যেখানটিতে ডায়ানার ট্র্যাক মুছে গেছে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল।
সহসা দেয়ালের একটি অংশ হড়কে খুলে গেল। ওটার পিছনে স্বল্পালোকিত এক কম্পার্টমেণ্ট। চোখে পড়ল সুসজ্জিত, রুপোলী ধাতবের চকচকে দেয়াল। দেখতে অনেকটা অত্যাধুনিক লিফটের মত।
গভীর শ্বাস টানল হিরু চাচা।
‘চলি রে, রোকু। শীঘ্রি আবার দেখা হবে-আশা করি!’
ভিতরে পা রাখল সে।
ঠিক সে মুহূর্তে, কিশোর ধেয়ে এসে ঘরটায় ঢুকল।
‘না, হিরু চাচা, এটা একটা ফাঁদ!’
পরমুহূর্তে দেখতে পেল হুড পরা, কঙ্কাল-মুখো দুই মূর্তি কম্পার্টমেন্টটার কোনা থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল। হিরু চাচাকে মাটিতে পেড়ে ফেলল ওরা।
প্যানেলটা বন্ধ হয়ে গেল।
হিরু চাচা মুহূর্ত খানেক দস্তুর মত লড়ল। তার প্রতিপক্ষ দু’জন যেন জীবন্ত কঙ্কাল, কিন্তু তাদের দেহে অসুরের শক্তি!
সুঁইয়ের মতন তীক্ষ্ণ একটা কিছু তার গলায় খোঁচা দিল, এবং তারপর চারদিক আঁধার হয়ে গেল।
সাত
ডিলাক হন্তদন্ত হয়ে কামরায় ঢোকা মাত্র দেখতে পেলেন কী ঘটেছে।
‘ওরা ওখানে কী করছে?’
‘যিয়সে যাচ্ছে, আমার ধারণা।’
‘কীভাবে সম্ভব? এটা তো একটা রূম।’
মাথা নাড়ল কিশোর।
‘তা নয়। এটা একটা ট্র্যান্সম্যাট পয়েন্ট। সংক্ষেপে পার্টিক্ ম্যাটার ট্র্যান্সমিশন। হাতে যখন সপ্তাহ দুয়েক সময় থাকবে তখন ব্যাখ্যা করব।’
‘আমরা যে প্রাণীগুলোকে দেখলাম তারা যিয়ন?’
‘খুব সম্ভব। ওদের হাতে এখন ডায়ানা আর হিরু চাচা!’ দরজার দিকে এগোল কিশোর। ‘আপনারা দু’জন আসুন আমাদেরকে টাইম মেশিন ব্যবহার করতে হবে।’
ডিলাক আর রোকুকে পিছনে নিয়ে সেই জঞ্জালে বন্ধ করিডরটার দিকে চলল কিশোর, টাইম মেশিনটাকে যেখানে ছেড়ে এসেছিল।
‘এই জঞ্জালের পিছনে কোথাও আছে ওটা। রোকু, তুই ব্লাস্ট করে পথ তৈরি করতে পারবি?’
স্তূপটা নিরীখ করল রোকু, কিন্তু ফায়ার করার কোনও চেষ্টা করল না।
‘জলদি কর, রোকু। কী ব্যাপার?’
‘তাড়াহুড়োর দরকার নেই, মাস্টার। সেন্সর বলছে টাইম মেশিন এখানে নেই।’
‘নেই?’
‘না।’
কিশোর হতাশ চোখে ওর দিকে চেয়ে রইল।
.
মার্শাল তখনও কালো আয়নায় কথা বলছেন।
‘আপনি কথা দিয়েছিলেন, প্রভু। আপনি আমাকে বিজয়ী করবেন বলেছিলেন।’
আয়নার পিছনে গুপ্ত কামরাটায় ক্রিস্টালের খুলিটা জ্বলজ্বল করে উঠল। একটা কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এল ওটা থেকে। কর্কশ, প্রতিধ্বনি তোলা কণ্ঠটা ব্যঙ্গাত্মক আনন্দে ভরা।
‘যুদ্ধের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। তুমিও তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। আমি যেহেতু হিরন পাশাকে পেয়ে গেছি, যিয়স থেকে আর কোনও হামলা আসবে না। তুমি এর থেকে ফায়দা হাসিল করো, মার্শাল।’ খুলির আভা ম্লান হয়ে এল এবং কণ্ঠস্বরটা মিলিয়ে গেল।
মার্শাল যা শুনতে চান শুধু তাই-ই শুনতে পেয়েছেন।
‘আর কোনও হামলা নয়…তারপরও আমি জিততে পারি! আমি মস্ত বড় এক বিজয় অর্জন করতে পারি, ব্যক্তিগত বিজয়। আমি নিজে হামলায় নেতৃত্ব দেব…’
রাডার স্ক্রীনের টেকনিশিয়ানদের কাছ থেকে বিস্ময়ের বিড়বিড়ানি ভেসে এল। হার্ভে শশব্যস্তে ওদিকে গেলেন।
‘মার্শাল, যিয়ন ফ্লীট-ওটা চলে গেছে! আমাদেরকে বাগে পেয়েও উধাও হয়ে গেছে!’
মার্শালের মুখে বিজয়ের স্মিত হাসি।
‘আমরা ওদেরকে শেষ করে দিয়েছি, হার্ভে। আমি নিজে আক্রমণে নেতৃত্ব দেব।’
.
আঁধারে জ্ঞান ফিরল হিরু চাচার। তার চারপাশ ঘিরে আছে হুড পরা কঙ্কাল-মুখো মূর্তিদের একটি চক্র। গলার কাছে ধাতব কিছু একটার অস্তিত্ব টের পেল সে। তার সামনে চকচকে বারের তৈরি এক হীরা আকৃতির খাঁচা।
একটি কণ্ঠ বলল, ‘স্বাগতম, ডক্টর!’
হিরু চাচা চোখ তুলে চাইল। বক্তা অন্যদের চাইতে সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে। প্রথম দর্শনে তাকে আর সবার মতই লাগল। তার পরনেও কালো আলখিল্লা। মুখটা যেন জীবন্ত কঙ্কালের। তবে আলখিল্লাটা দামি মখমলে তৈরি, এবং গলায় শোভা পাচ্ছে রত্নখচিত এক কলার। কর্তৃত্বের এসব প্রতীক ছাড়াও বোঝা যায় এ হচ্ছে ভ__ দলটির নেতা। তার চাল-চলনে ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব ঝরে পড়ছে। আঁধারে যেন আলো বিকীর্ণ করছে সে, যার ফলে সে যেখানেই যাচ্ছে আলো ম্লান হয়ে আসছে।
কণ্ঠস্বরটা গভীর আর কর্কশ, তার সঙ্গে মিশে আছে বিদ্রূপাত্মক বিদ্বেষ। কণ্ঠটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যেন কোনও সমাধিমন্দিরের অতল থেকে উঠে আসছে।
‘আপনি জেনে রাখুন, ডক্টর, আপনি পুরোপুরি আমার ক্ষমতার অধীন।’
হিরু চাচা গলার কাছে ধাতব যন্ত্রটা অনুভব করছে। ওটা তার মনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সে বাধা দিল, এক টানে গলা থেকে খুলে আনল জিনিসটা।
‘তাই বুঝি? এটার জন্যে?’ ছোট্ট সিলিণ্ডারটা এক পাশে ছুঁড়ে মারল।
কঙ্কাল-মুখোর চেহারা ক্রোধে বিকৃত হয়ে গেল।
‘বন্দি করো ওকে!’
হুড পরা মূর্তিগুলো হিরু চাচাকে হীরাকৃতির খাঁচাটার মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল, আটকে দেয়া হলো লকিং বারগুলো।
মূর্তিটা আবারও কথা বলে উঠল।
‘আবার বলছি, ডক্টর, আপনি আমার নিয়ন্ত্রণে। শুনতে পাচ্ছেন?’
খাঁচার চারপাশে কড়কড় করে উঠল আলো এবং তীব্র যন্ত্রণায় হিরু চাচার গোটা দেহ কেঁপে উঠল। ব্যথা কমে এলে হিরু চাচা সভয়ে শ্বাস -নিল।
‘শুনতে পাচ্ছি। আপনি কে?’
‘আমি শ্যাডো, ডক্টর। আপনার প্রতিপক্ষ, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মন দিয়ে শুনুন, ডক্টর। মিথ্যে বললে আরও ব্যথা পাবেন। আপনি একটা চাবির খোঁজে এসেছেন, সময়ের চাবি, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনার হাতে এর মধ্যেই এই চাবিটার কয়েকটা টুকরো এসে গেছে, ঠিক?’
‘না।’
খাঁচার চারধারে স্ফুলিঙ্গ কড়কড়িয়ে উঠল এবং হিরু চাচা ব্যথায় চাপা আর্তনাদ ছাড়ল।
‘আপনাকে সাবধান করেছিলাম,’ বলল কণ্ঠটি। ‘এই টুকরোগুলো-কোথায় সেগুলো?’
‘হারিয়ে গেছে…’ আওড়াল হিরু চাচা।
‘চোখ খুলুন, ডক্টর।’
হিরু চাচা নির্দেশ পালন করল। কামরার দূর প্রান্তের আঁধার খানিকটা কেটে গেল, প্রকাশ পেল টাইম মেশিনের পরিচিত লাল, চৌকো আকৃতি।
ঘৃণাভরা কণ্ঠটি বলল, ‘ওগুলো কি ওখানে আছে, ডক্টর?’
আরও আলো, আরও যন্ত্রণা।
‘হ্যাঁ!’
‘আপনি খুলবেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওঁকে ছেড়ে দাও।’
খাঁচার বার খুলে দিল হুড পরা মূর্তিরা, এবং হিরু চাচা অচেতন হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
.
ট্র্যান্সম্যাট কিউবিকলের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর আর ডিলাক। রোকুকে তালা ঘিরে লেসার রশ্মি ঘুরাতে দেখছে।
কিশোর অধৈর্য গলায় বলল, ‘জলদি কর, রোকু।’
‘তালার কারিগরিটা জটিল, মাস্টার, আর আমি ট্র্যান্সম্যাটটার ক্ষতি করতে চাই না। সময় লাগবে।’
‘শোনো,’ হঠাৎ বলে উঠলেন ডিলাক। ‘বোমাবাজি মনে হয় থেমেছে। যিয়নরা নিশ্চয়ই জেনে গেছে আমরা শেষ। কেন ওরা বন্দি নেয়ার ঝামেলায় যাচ্ছে তাই ভাবছি। প্রথমে ডায়ানা, এখন ডক্টর।’
‘কারণ এর সঙ্গে গোটা যুদ্ধটা জড়িত।’ কিশোর সাধ্যমত ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করল। ‘হিরু চাচা আর আমি সময়ের চাবি নামে একটা জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছি। ওটা যার কাছে থাকবে সে স্পেস আর টাইমে শক্তির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করবে।’
ডিলাক অবিশ্বাসের চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলেন।
‘ওটা কেন চাও তোমরা? কী করবে ওটা দিয়ে?’
‘জানি না-কিন্তু এটা বলতে পারি ওটা আমরা নিজেদের জন্যে চাই না, এবং জিনিসটা কোনও খারাপ কাজে নয়, ভাল কাজে ব্যবহার হবে। চাবিটা ছয় টুকরো হয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নানা জায়গায় ছদ্মবেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমরা এ পর্যন্ত পাঁচটা টুকরো খুঁজে পেয়েছি।’
‘এর সাথে ডায়ানার কী সম্পর্ক?’
‘উনি ছ’নম্বর টুকরোটার সাথে কোনও না কোনওভাবে জড়িত। হয় উনি ওটা বহন করছেন, আর নয়তো জানেন ওটা কোথায় আছে।’ কিশোর ট্রেসারটা বের করল। ‘এটার সাথে সময়ের চাবির টুকরোগুলোর যোগসূত্র আছে, কিন্তু এটা ডায়ানার ক্ষেত্রেও সাড়া দেয়। কাজেই এটা বলতে পারবে উনি কোনদিকে গেছেন-এবং কতটা কাছে আছেন।’
হঠাৎই ট্র্যান্সম্যাটের দরজাটা হড়কে খুলে গেল।
‘রেডি, মাস্টার,’ সগর্বে বলল রোকু।
‘ওয়েল ডান, রোকু।’
আচমকা ডিলাক কিশোরের হাত থেকে ট্রেসারটা ছিনিয়ে নিলেন, তারপর ওকে ধাক্কা দিয়ে ট্র্যান্সম্যাট দরজা গলে লাফিয়ে পড়লেন।
‘সরি, কিশোর,’ চেঁচিয়ে বললেন-এবং দরজাটা লেগে গেল।
.
হিরু চাচা দ্বিতীয়বারের মত জ্ঞান ফিরে পেল এবং নিজেকে খুঁজে পেল টাইম মেশিনের বাইরে মেঝেতে চিত হয়ে শুয়ে-থাকা অবস্থায়। ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল সে, শ্যাডো এবং তার কালো আলখিল্লাধারী ভৃত্যদের উপেক্ষা করে টাইম মেশিনের গায়ে আদরের হাত বুলাল।
‘ভাল, ভাল, তুই এখানে কী করছিস?’ শ্যাডোর দিকে চাইল সে। ‘ভুল হলে শুধরে দেবেন, কিন্তু এটা যিয়স, তাই না?’
‘আমার সময় নষ্ট করবেন না, ডক্টর। টাইম মেশিন খুলে সময়ের চাবির টুকরোগুলো নিয়ে আসুন।’
হিরু চাচা বন্ধুসুলভ গলায় বলল, ‘টাইম পিসের ব্যাপারে আগ্রহী, তাই না? ক্রোনোস্ট্যাটিকস, হরোজেনেসিস, এধরনের জিনিসের প্রতি?’
‘আমাকে বোকা পাননি, ডক্টর!’
‘আমার তো তা-ই মনে হচ্ছে।’ হিরু চাচা টাইম মেশিনের লকের চারপাশটা নিরীখ করল। ‘আপনাকে হতাশ করার জন্যে দুঃখিত, ওল্ড চ্যাপ। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি আপনারা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে চেয়ে পারেননি। টাইম মেশিনটা এডিএম দিয়ে জোড়া-অটোমেটিক ডিফেন্স মেকানিজম।’
শ্যাডোর ইঙ্গিতে, তার সেবকরা তাদের আলখিল্লার আড়াল থেকে ব্লাস্টার বের করল।
‘আমাকে সময়ের চাবির প্রথম পাঁচটা টুকরো এনে দিন, ডক্টর, নইলে আপনাকে ধ্বংস করে দেব, এখুনি!’
‘করুন, তা হলে আর জীবনেও ঢুকতে পারবেন না,’ খোশমেজাজে বলল হিরু চাচা। ‘যাকগে, আমার মনে হচ্ছে আপনি জানেন ছ’নম্বর টুকরোটা কোথায় আছে।’
‘একে শেষ করে দাও,’ খেঁকিয়ে উঠল শ্যাডো।
আলখিল্লাধারীরা ব্লাস্টার তুলল।
হিরু চাচা পিছিয়ে গেল, দু’হাত তুলেছে।
‘এর নিশ্চয়ই কোনও সভ্য সমাধান আছে।’
‘আমাকে সময়ের চাবির টুকরো পাঁচটা দিন।’
‘আপনাকে সাহায্য করতে পারলে খুশি হতাম, ওল্ড চ্যাপ। টুকরোগুলো একটা লিম্বো সেফ-এ আছে, এবং ওটা খোলার একমাত্র উপায় হচ্ছে ছ’নম্বর টুকরোটা ব্যবহার করা। কাজেই আপনি যদি ওটা আমাকে দেন তা হলে আমি খুশি মনে টাইম মেশিনে ঢুকে টুকরোগুলো আপনাকে এনে দিতে পারি।’
হেসে উঠল শ্যাডো।
‘আপনার ধারণা আপনাকে আমি বিশ্বাস করব, ডক্টর?’
‘ঠিক তা নয়-এবং আমিও আপনাকে বিশ্বাস করি না। অচল অবস্থা, কী বলেন?’
শ্যাডো ফের কথা বলার আগে দীর্ঘ বিরতি।
‘আমি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি, ডক্টর, আরও হাজার বছর আমার কাছে কিছু না। কিন্তু আপনার জন্যে…আমি আপনাকে লক্ষ করেছি। আমি জানি আপনার স্বভাবে ধৈর্য নেই।’
‘আপনার কথাই হয়তো ঠিক। বোকারা তাড়াহুড়ো করে।’
‘ঠিক।’ শ্যাডো হাত নাড়ল এবং তার ভৃত্যরা আঁধারে মিলিয়ে গেল। ‘আমি আপনাকে ছেড়ে দেব, ডক্টর, আপনাকে ভুল করার সুযোগ দেব। এবং যখন আপনি ভুল করবেন-আমি অপেক্ষায় থাকব!’
সহসা কামরার বাতিগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হিরু চাচা চোখ পিটপিট করে চারধারে চাইল।
শ্যাডো এবং তার সেবকরা অদৃশ্য।
আট
হিরু চাচা তেমন একটা অবাক হয়নি। শ্যাডো ও তার অনুসারীদের মধ্যে অদ্ভুত, অচেনা কিছু একটা রয়েছে, ওরা যেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেউ নয়। ওরা বাস্তব, আবার একই সঙ্গে অবাস্তব। হিরু চাচার ধারণা, ওরা অন্য কোনও অন্ধকার ডাইমেনশন থেকে এসেছে। ব্ল্যাক গার্ডিয়ান তার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ডেকে এনেছে এই অশুভ প্রাণীগুলোকে।
টাইম মেশিন তখনও ওখানে রয়েছে, এবং হিরু চাচা প্রবৃত্তির বশে ওটার দিকে এগিয়ে গেল। এবার নিজেকে সামলে নিল সে।
‘না, না, এখনই নয়, আগে একটু ঘুরে ফিরে দেখি। ছ’নম্বর টুকরোটা পেয়ে যেতেও পারি!’
কামরা ত্যাগ করল সে, এবং নিজেকে আবিষ্কার করল লম্বা, সারি- সারি সাপোর্টিং পিলার বসানো উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত এক করিডরে। দেয়ালগুলো কমলারঙা মনোরম শেড দিয়ে নকশা করা, অ্যাট্রিয়সের একঘেয়ে কালো আর সবুজের চাইতে একদম আলাদা। বাতাস তরতাজা আর উষ্ণ। হিরু চাচা চারপাশে চোখ বুলাল। অন্যান্য করিডরগুলো ডানে-বাঁয়ে শাখার মত বিস্তার পেয়েছে। আল্লার নাম নিয়ে একটা ধরে হাঁটা দিল হিরু চাচা।
.
কাছেই, ট্র্যান্সম্যাট কিউবি থেকে টলমল পায়ে বেরিয়ে এসে একই ধরনের এক করিডরে নিজেকে খুঁজে পেলেন ডিলাক। ট্রেসার তুলে ধরলেন তিনি, কিন্তু কোনও সঙ্কেত এল না। কণ্ঠস্বর চড়ালেন ডিলাক।
‘ডায়ানা! শুনতে পাচ্ছ? ডায়ানা, আমি ডিলাক বলছি!’ পরিত্যক্ত করিডরগুলোতে ভুতুড়ে প্রতিধ্বনি তুলল তাঁর কণ্ঠ। একটা করিডর বেছে নিয়ে তাঁর প্রিন্সেসের খোঁজে চললেন ডিলাক। কালো অ্যাস্টেরয়েডটা অ্যাট্রিয়স আর যিয়সের মাঝখানে ঝুলে আছে, সরু চূড়া আর শৃঙ্গ নিয়ে তৈরি অতিকায় এবড়োখেবড়ো পাথরটিকে মহাশূন্যে এক অসাধারণ দুর্গের মতন দেখাচ্ছে।
অ্যাস্টেরয়েডটির গভীরে, এক কারাপ্রকোষ্ঠের দেয়ালে শিকলবন্দি করে রাখা হয়েছে প্রিন্সেস ডায়ানাকে। প্রকোষ্ঠটা নিরেট পাথর কুঁদে বানানো হয়েছে। তাঁর কাপড়-চোপড় ছেঁড়া, গালে কান্নার দাগ এবং তিনি যুগপৎ আতঙ্কিত আর ক্লান্ত।
তাঁর উপর ঝুঁকে দাঁড়ানো শ্যাডো, তার হুড পরা ভৃত্যরা তার গা ঘেঁষে রয়েছে।
‘বলুন,’ হিসিয়ে উঠল সে, ‘ছ’নম্বর টুকরোটা কোথায়? আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে। আপনি অ্যাট্রিয়সের রাজপরিবারের সন্তান।’
‘বিশ্বাস করুন আমি কখনও ওটার কথা শুনিনি!’
‘গোমরটা রাজপরিবারে বংশ পরম্পরায় চালু আছে। আপনি যেহেতু রাজপরিবারের একমাত্র জীবিত বংশধর, আপনার অবশ্যই জানা থাকবে। বলতে আপনাকে হবেই, নইলে মারা পড়বেন। বুঝতে পেরেছেন?’
‘হ্যাঁ…’ ফুঁপিয়ে উঠলেন ডায়ানা। ‘জানলে তো বলতামই—কিন্তু আমি জানি না!’
শ্যাডোর গলা কঠোরতর হলো।
‘আপনি জানেন এবং আমাকে বলবেনও। আপনার যেহেতু
নিজের জীবনের মায়া কম, দেখা যাক অন্যের জন্যে মায়া আছে কি না।’
শ্যাডো একটি হাত নাড়তেই জাদুবলে অপরদিকের দেয়ালে একটি ভিশন স্ক্রীন উদয় হলো। ওটায় ডিলাককে দেখা গেল, বিভ্রান্তের মতন যিয়সের কমলারঙা করিডরগুলো ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন।
‘ডায়ানা!’ গলা ছেড়ে ডাকলেন তিনি, ‘ডায়ানা, কোথায় তুমি?’
‘ডিলাক, আমি এখানে,’ পাল্টা চেঁচালেন ডায়ানা।
শ্যাডো শয়তানী হাসি হেসে উঠল।
‘বোকা কোথাকার! আপনার কি ধারণা আপনি এখনও যিয়সে আছেন? আপনি আপনার জানের ডিলাকের দশ লাখ মাইলের মধ্যেও নেই।’ আবারও হাত নাড়ল সে, এবং পর্দাটা নিমেষে উবে গেল।
ধপ করে পড়ে গেলেন শিকলবন্দি ডায়ানা।
‘যিয়সে না? তা হলে আমি কোথায়? এটা কোন জায়গা?’
শ্যাডো ঝুঁকে পড়ল তাঁর উপর, কঙ্কাল-মুখে চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে।
‘এটা, প্রিন্সেস, আমার রাজ্য-শয়তানের গ্রহ। আপনার যদি নিজের এবং ডিলাকের জানের মায়া থাকে তবে বলে দিন ছ’নম্বর টুকরোটা কোথায় পাব।’
‘পারব না,’ ফুঁপিয়ে উঠলেন ডায়ানা। ‘পারব না!’
শ্যাডো সটান সিধে হলো। ডায়ানা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, এতটাই ভয় পেয়েছেন, কোনও কিছু গোপন করতে পারলেন না। তিনি গড়গড় করে সত্যি কথা বলে চললেন।
.
কমাণ্ড চেয়ারে ধ্যানমগ্ন মার্শাল হঠাৎই উপলব্ধি করলেন, পরিচিত একজন অনুপস্থিত।
‘হার্ভে কোথায়?’
এক টেকনিশিয়ান শশব্যস্তে এগিয়ে এল।
‘মার্শাল, আমরা কে ব্লক থেকে আরেকজন অনুপ্রবেশকারীর রিপোর্ট পেয়েছি। মেজর হার্ভে তদন্ত করতে গেছেন।’
‘এই সময়? যখন আমি যিয়সে মরণ আঘাত করার প্ল্যান করছি? আমি চাই যতগুলো সম্ভব শিপ…’
‘একটা মাত্র শিপ অপারেশনাল, স্যর। আপনার পালানোর ঝটপট নিজেকে শুধরে নিল সে। ‘আপনার কমাণ্ড ভেসেল, স্যর।’
‘তা হলে ওটা রেডি করুন। আর মিসাইলগুলো অ্যাটমিক ওয়ার- হেড দিয়ে আর্ম করুন।
.
কিশোর দ্বিতীয়বারের মত রোকুকে ট্র্যান্সম্যাট লকটা খোলার চেষ্টা করতে দেখছে।
‘জলদি, রোকু!’
‘লকটা মনে হয় জ্যাম হয়ে গেছে, মাস্টার। ‘ ‘তা হলে উড়িয়ে দে।’
‘তাতে ট্র্যান্সম্যাট মেকানিজমের ক্ষতি হতে পারে।’
‘উড়িয়ে দে!’
রোকু ফায়ার করল এবং লকের জায়গায় এক ধোঁয়া-ওঠা গর্ত উদয় হলো। দরজাটা ঝট করে খুলে গেল।
‘ভেতরে যা, রোকু।’
রোকু কিউবিকলের ভিতরে ধীরেসুস্থে ঢুকল এবং কিশোর ওকে অনুসরণ করল। আলোর ঝলকানি, এবং ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল।
ক’মিনিট পরে, হার্ভে হন্তদন্ত হয়ে ঘরটিতে প্রবেশ করলেন। খোলা দরজাটার কাছে গেলেন তিনি, সাবধানে কিউবিকলের ভিতরে পা রাখলেন-এবং আলোর ঝলকের সঙ্গে উধাও হয়ে গেলেন।
কিশোর যিয়সের কমলারঙা অন্তহীন করিডরের এপ্রান্তে ওপ্রান্তে চোখ বুলাল।
‘আমরা বরং ভাগ হয়ে যাই, রোকু। তুই হিরু চাচার খোঁজে যা, আমি ডিলাককে খুঁজে বের করে ট্রেসারটা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করি।’
‘আচ্ছা, মাস্টার।’
দু’জনে ভিন্ন পথে রওনা হলো।
ওরা উধাও হওয়ার খানিক পরে, করিডরে উদয় হলেন ঘোরগ্রস্ত হার্ভে, টলছেন রীতিমত। তাঁর সঙ্গে কী হয়েছে নিশ্চিত নন, রিস্ট- কমিউনিকেটর তুললেন।
‘হার্ভে টু কন্ট্রোল, হার্ভে টু কন্ট্রোল।’ কোনও জবাব নেই-এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ কন্ট্রোল এখন কয়েক মিলিয়ন মাইল দূরে।
হতভম্ব হার্ভে নীরব কমিউনিকেটরের দিকে চেয়ে রইলেন। এ সময় আগুয়ান পদশব্দ শুনতে পেলেন তিনি। ব্লাস্টার বের করে, এক পিলারের পিছনে আড়াল নিলেন।
হিরু চাচা কোনা ঘুরে বেরিয়ে এসে ট্র্যান্সম্যাট কিউবিকলটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চিন্তামগ্ন।
‘এখন বুঝতে পারছি…
হার্ভে তার পিছনে বেরিয়ে এসে পিঠে ব্লাস্টার ঠেকালেন
‘আস্তে করে ঘুরে দাঁড়ান, ডক্টর, হাত তুলুন।’
হিরু চাচা আদেশ পালন করল।
‘আমার কাছে অস্ত্র নেই, হার্ভে।’
হার্ভে হিরু চাচার পকেটগুলো চটপট চাপড়ে নিয়ে পিছিয়ে গেলেন।
‘আমার কী হয়েছিল? আমি এখানে কীভাবে এলাম?’
হিরু চাচা কিউবিকলটার উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল।
‘ওই ট্র্যান্সম্যাটটার মাধ্যমে, আমার ধারণা।’
‘এটা অ্যাট্রিয়সের কোন্ এলাকা, আমি চিনতে পারছি না।’ অবাক হচ্ছি না, হার্ভে। আমরা যিয়সে। আপনি ম্যাটার ট্র্যান্সমিটারের মাধ্যমে এখানে এসেছেন।’
‘ফালতু কথা,’ কঠোর কণ্ঠে বলে উঠলেন হার্ভে। ‘আমরা যিয়সে আসব কীভাবে? এটা নিশ্চয়ই অ্যাট্রিয়সের কোনও নিষিদ্ধ এলাকা, আমি যা আগে কখনও দেখিনি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল হিরু চাচা।
‘স্বীকার করে নিন, ওল্ড চ্যাপ, এটা যিয়স!’
.
তখনও করিডরগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ট্রেসারে ক্ষীণ এক সঙ্কেত পেয়ে খুশি হয়ে উঠলেন ডিলাক। উৎস অভিমুখে সঙ্কেতটাকে অনুসরণ করলেন তিনি-ধুলোময় এক কোণে পড়ে রয়েছে সোনার ছোট্ট এক ব্রেসলেট।
‘ডায়ানা!’ ফিসফিস করে বলে ওটা তুলে নিলেন।
এ সময় পায়ের শব্দ পেয়ে এক পিলারের পিছনে গা ঢাকা দিলেন। ট্রেসারটাকে গদার মতন বাগিয়ে ধরেছেন।
কেউ একজন কোনা ঘুরে বেরিয়ে এল। ডিলাক আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে আঘাত করার জন্য ট্রেসারটা তুললেন, এবার কিশোরকে চিনতে পেরে নিজেকে সামলে নিলেন।
পাঁই করে ঘুরল কিশোর। ডিলাককে আঁকড়ে ধরে তাঁর একটি বাহু পিছনে মুচড়ে দিল, তিনি যাতে নড়াচড়া করতে না পারেন। লোকটিকে এক হাতে ধরে রেখে ট্রেসারটা ছিনিয়ে নিল।
‘আমার কথা শুনুন, ডিলাক, আপনার মত আমিও ডায়ানাকে খুঁজে পেতে চাই। আপনাকে যদি যেতে দিই, কথা দিতে হবে আমাকে আবার কোনও ঝামেলায় ফেলবেন না।’
ডিলাক মাথা ঝাঁকালেন, এবং কিশোর তাঁকে ছেড়ে দিল।
ডিলাক বাহু ডললেন।
‘আমি দুঃখিত, কিশোর। আমার আসলে ডায়ানাকে খুঁজে পেতেই হবে। আমি জানি ও এখন এখানে আছে। দেখো!’ ব্রেসলেটটা তুলে ধরলেন তিনি। ‘এটা ওর, আমি এটা ওকে দিয়েছিলাম। জিনিসটা ওখানে পড়ে পেয়েছি।’
কিশোর ট্রেসারের কাছে ধরল ব্রেসলেটটা। মৃদু ইলেকট্রনিক গুঞ্জন।
‘দেখলে?’ বিজয়ীর কণ্ঠে বললেন ডিলাক।
কিশোর চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। কোনও সন্দেহ নেই, ছ’নম্বর টুকরোটা আর নিখোঁজ প্রিন্সেস ডায়ানার মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে। কিন্তু কী সেটা?
‘আসুন, আমরা ওঁকে খুঁজি।’
হিরু চাচা তার অভিযান চালু রেখেছে, তাকে অনুসরণ করছেন অনিচ্ছুক হার্ভে-তর্ক করে চলেছেন তিনি।
‘এটা যদি যিয়স হয়, তবে যিয়নরা কোথায়?’
‘ওরা হয়তো এই এরিয়াটা ব্যবহার করে না।’
‘কেন করে না? এখানকার বাতাস ভাল, কোনও রেডিয়েশন নেই।’ কলারে র্যাড-স্ক্যানারটা ঠুকলেন হার্ভে। ‘কিন্তু জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছে বহু বছর কেউ এখানে আসেনি।’
হিরু চাচা আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পকেটগুলো চাপড়াল। সে নিশ্চিত, কিশোর আর রোকু তাকে অনুসরণ করে যিয়সে আসবে। রুপোলী হুইসলটা বের করে, ঠোঁটে ঠেকিয়ে জোরে ফুঁ দিল।
‘এটা আগেই ভাবা উচিত ছিল,’ বিড়বিড় করে বলল। ‘আচ্ছা, হার্ভে, আপনি কি কখনও কোনও যিয়নকে দেখেছেন?’
‘ছোটবেলার পর আর দেখিনি। আমরা ওদের সাথে ব্যবসা করতাম, যুদ্ধের আগে।’
‘ওরা নিশ্চয়ই কালো আলখিল্লা পরা জীব নয়, যারা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে?’
‘একেবারেই না। ওরা আমাদের মতই সাধারণ মানুষ। রেডিয়েশনের কারণে হয়তো ওদের পরিবর্তন হয়েছে।’
‘সে সম্ভাবনা কম-আপনাদের কোনও আক্রমণই তো সফল হয়নি!’
হার্ভে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে হিরু চাচার দিকে চাইলেন।
‘ওরা যিয়নই হবে। এ ছাড়া আর কী হতে পারে?’
হিরু চাচা জবাব দিতে পারার আগেই কোনা থেকে স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে এল রোকু।
ঝুঁকে পড়ে ওকে আদর করে দিল আনন্দিত হিরু চাচা।
‘এতক্ষণ কী করছিলি তুই?’
‘যিয়সের কমাণ্ডারের সাথে যোগাযোগ করছিলাম, প্রভু।’
‘পেয়েছিস তাঁকে? তুই আমাদেরকে তাঁর কাছে নিয়ে চল!’
‘এদিক দিয়ে, প্রভু।’
‘দাঁড়া, আগে কিশোর আর ডিলাককে খুঁজে বের করি। আমরা সবাই একসাথে গিয়ে কমাণ্ডারের সাথে দেখা করব।’
‘এদিক দিয়ে, প্রভু!’
রোকু তরতর করে চলতে শুরু করতেই হিরু চাচা অনুগমন করল। ‘তুই বেশ ভাল ফর্মে আছিস মনে হচ্ছে,’ বলল হিরু চাচা। ‘জি, প্রভু। সীমিত অর্গানিক ইন্টেলিজেন্সের কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি আমার। হয়েছে অন্য কারও সাথে।’
‘অন্য কারও সাথে?’
‘জি, প্রভু। আমি আমার নিজের মত একটা জিনিসের সাথে যোগাযোগ করেছি-যে যিয়সের কমাণ্ডার।’
.
মার্শাল ক’মিনিট আগে রেকর্ড করা তাঁর ভাষণের সম্প্রচার দেখছিলেন। এখন ওটা অ্যাট্রিয়সের জনগণের জন্য প্রচার করা হবে-অল্প যে ক’জন বেঁচে আছে আরকী।
‘প্রতিশোধের সময় এসে গেছে! আমি নিজে যিয়সের ওপর শেষ আঘাত হানব, এমন ব্যবস্থা নেব যাতে আর কোনওদিন ওরা আমাদেরকে আক্রমণ করার সাহস না পায়। বিজয় এবং মৃত্যু, ভাই- বোনেরা আমার। আমাদের জন্য বিজয়, এবং আমাদের শত্রুদের জন্য মৃত্যু!’
সামরিক বাজনা বেজে উঠল এবং পর্দা থেকে মুছে গেল মার্শালের ছবি, তার বদলে ফুটে উঠল অ্যাট্রিয়সের ঈগল ক্রেস্ট।
কমাণ্ড চেয়ারে বসে মার্শাল সন্তুষ্টির সঙ্গে মাথা ঝাঁকালেন। নিজের ভাষণ দেখতে সব সময়ই ভাল লাগে তাঁর।
এ সময় এক টেকনিশিয়ান এসে স্যালুট করল।
‘আপনার কমাণ্ড শিপ তৈরি, মার্শাল। মিসাইল লোড করা হয়েছে আর পাইলটকেও ব্রিফ করা হয়েছে।’
মার্শাল উঠে দাঁড়িয়ে গটগট করে ওয়ার রূম ত্যাগ করলেন।
খানিক বাদে, বাদে, তাঁর কমাণ্ড শিপ রওনা হলো যিয়সের পথে-গ্রহটাকে ধ্বংস করার জন্য পর্যাপ্ত অ্যাটোমিক মিসাইল সহ সশস্ত্র।
.
কিশোর আর ডিলাককে খুঁজে পেতে বেশিক্ষণ লাগল না রোকুর। ত্বরিত কুশল বিনিময় আর ব্যাখ্যার পরে তারা সবাই রওনা হলো রোকুর রহস্যময় কমাণ্ডারকে দেখতে।
ওরা করিডর ধরে রোকুকে অনুসরণ করছে, কিশোর হিরু চাচাকে সোনার ব্রেসলেটটা দেখাল।
‘এই জিনিসটা ট্রেসারে ক্ষীণ সিগন্যাল দেয়, হিরু চাচা। এটা অবশ্যই ছ’নম্বর টুকরোটা নয়, তবে কী এটা?’
‘মনে হয় সম্প্রতি টুকরোটার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল এমন কিছু এটা-তুই কী বলিস?’
‘রোকু কি ডায়ানার কথা বলেছে?’ প্রশ্ন করলেন ডিলাক। ‘ডায়ানা কি এই যিয়ন কমাণ্ডারের সাথে আছে?’
‘শীঘ্রি জানতে পারব,’ আশ্বস্ত করার সুরে বলল হিরু চাচা।
বিশাল এক খিলানাকৃতি দরজার সামনে থেমে দাঁড়িয়েছে রোকু।
‘চুপ করে এখানে অপেক্ষা করুন, প্লিজ।’
রোকু ইলেকট্রনিক ব্লিপের এক জটিল বাজনা দিল।
‘কী করছে ও?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করল কিশোর।
‘কে জানে,’ সহজ গলায় বলল হিরু চাচা। ‘ওকে আগে এটা করতে দেখিনি।
‘চুপ থাকুন, প্লিজ,’ তিরস্কারের সুরে বলল রোকু। ‘যোগাযোগ চলছে।’
আরেক দফা বাজনার ব্লিপ, এবং হঠাৎই দরজাটা হড়কে খুলে গেল।
‘এখানে দাঁড়ান, প্লিজ।’ রোকু সাবলীল ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
হিরু চাচার দিকে চাইল কিশোর।
‘ওটা মনে হয় কোনও আইডেন্টিফিকেশন রিচুয়াল ছিল-মৌমাছিদের নাচের মতন?’
রোকু ফের উদয় হলো দোরগোড়ায়, অনেকটা ইলেকট্রনিক খোনসামার মত।
‘কমাণ্ডার এখুনি আপনাদের সাথে দেখা করবেন।’
ওরা রোকুকে অনুসরণ করে দরজা দিয়ে ঢুকল, এবং নিজেদেরকে খুঁজে পেল দীর্ঘ, চমৎকারভাবে সমানুপাতিক এক কামরায়, যেখানে মৃদু আলোয় স্নান করছে কমলা দেয়ালগুলো। বাতাস উষ্ণ আর স্থির। অস্পষ্ট, দূরাগত এক গুঞ্জন শুধু অটুট নীরবতা ভাঙছে।
হলের দূর প্রান্তে উঁচু এক মঞ্চ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশাল এক রুপোর পিরামিড, ওটার পিছনে এক জটিল অটোমেটেড কনসোল। কনসোলটির মাঝখানে এক ডিজিটাল কাউন্টডাউন ঘড়ি।
রোকু তরতর করে পিরামিডটার পায়ের কাছে গিয়ে আবারও সুরেলা ব্লিপ দিল।
পিরামিডটা ক্ষীণ আভা ছড়াল, এবং জবাবে আরও ব্লিপ দিল। স্পষ্টতই কথোপকথন চলছে।
হিরু চাচা অন্যদেরকে পিছনে নিয়ে এগিয়ে গেল।
‘এটাই আপনাদের শত্রু, হার্ভে। আমার ধারণা, এটা সব কিছু চালায়-আক্রমণ, প্রতিরোধ, উৎপাদন, পাহারা। ওয়ার কম্পিউটার। আদর্শ নেতা, কোনও গর্ব নেই, বক্তৃতা নেই, মেডেল নেই…গোটা গ্রহটা স্বয়ংক্রিয়। যিয়সের এই অংশে কোনও যিয়ন নেই।’
‘তা হলে তারা কোথায়?’
‘গ্রহের অন্য পাশে, আমার ধারণা, কোথাও লুকিয়ে আছে। কিন্তু ওরা যাওয়ার আগে, এটাকে সেট করে গেছে। এবং এটা তারপর থেকে তাদের জন্যে রোবট যুদ্ধ করে চলেছে।’ হিরু চাচা পিরামিডটার দিকে চোখ তুলে চাইল। ‘মিনারেল আর ইলেকট্রনিক সার্কিটরির এক আবেগহীন পিণ্ড, ভয়ানক দক্ষ। অ্যাট্রিয়সকে এটা আচ্ছামতন মার দিয়েছে, সম্ভবত কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, অথচ বিন্দুমাত্র আবেগ জাগেনি। স্রেফ নিজের কাজ করে যাচ্ছে-এবং জিনিসটা সম্পূর্ণ অপরাজেয়।’
হার্ভে ব্লাস্টার বের করলেন।
‘দেখি আসলেই তাই কি না!’
তিনি অস্ত্র তুলতেই পিরামিডের পিছনের দেয়ালে বসানো এক সার নল থেকে রশ্মি ছিটকে এল। হার্ভে আর্তনাদ ছাড়লেন, এবং ব্লাস্টারটা তাঁর অসাড় হাত থেকে খসে পড়ল।
‘ওটার অটোমেটিক ডিফেন্স সিস্টেম আছে!’
ডিলাক বললেন, ‘ডক্টর, ডায়ানার ব্যাপারটা…’
মাথা ঝাঁকাল হিরু চাচা, ‘রোকু, তোর বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে দেখ তো প্রিন্সেস ডায়ানার নাম উঠলে বেল বাজে কি না।’
রোকু ব্লিপ দিল, এবং কম্পিউটারটা সাড়া দিল।
রোকু বলল, ‘প্রিন্সেস ডায়ানার ব্যাপারে কোনও তথ্য জানা যাচ্ছে না।’
কম্পিউটারটা আরও ব্লিপ দিল।
রোকু বলল, ‘মেন্টালিস আরও জানাচ্ছে যুদ্ধ শেষ। এবার নিশ্চিহ্ন করার পালা।’
‘নিশ্চিহ্ন?’ শঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠল হিরু চাচা। ‘কাকে?’ কম্পিউটার থেকে একটিমাত্র ব্লিপ এল।
রোকু অনুবাদ করল, ‘সব কিছুকে।’
.
মার্শালের শিপ যিয়সের উদ্দেশে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। কন্ট্রোল থেকে মুখ তুলে চাইলেন পাইলট।
‘টার্গেট চিহ্নিত করা হয়েছে, স্যর।’
কো-পাইলটের আসনে বসে-থাকা মার্শাল পরম আগ্রহে সামনে ঝুঁকে পড়লেন।
‘চমৎকার! আক্রমণের জন্যে তৈরি হোন!’
নয়
কিশোর আর ডিলাক সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে, হিরু চাচাকে মেণ্টালিসের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করতে দেখছে উদ্বিগ্ন চোখে। হিরু চাচা রোকুকে ব্যবহার করছে দোভাষী হিসেবে।
রিপের শেষ দফা ফুলঝুরির পর ঘুরে দাঁড়াল হিরু চাচা।
‘খামোকা। মেন্টালিস আমাদেরকে ডায়ানা সম্পর্কে কিছু বলবে না এবং তার মেমোরি ব্যাঙ্কে ঢুকতেও দেবে না। ওটা আমাকে অন্য একটা কথা বলেছে, যদিও ব্যাপারটা বেশ চিন্তার।’
‘কী সেটা?’ কিশোরের প্রশ্ন।
‘মেন্টালিসকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। যার মানে ওটা আর হামলা করতে পারবে না। কিন্তু হার্ভে বলছিলেন, মার্শাল যিয়সকে ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে শীঘ্রি রওনা দেবেন।’
ভ্রূ কুঁচকাল কিশোর।
‘মেণ্টালিস নিশ্চয়ই পাল্টা ব্যবস্থা নেবে।’
মাথা ঝাঁকাল হিরু চাচা।
‘হ্যাঁ, মেন্টালিস জানে সে অজেয়। পরাজয় মেনে নেয়ার জন্য প্রোগ্রাম করা হয়নি ওটাকে।’
‘তো কী করবে ওটা?’
‘অটোমেটেড মিসাইল ছুঁড়ে অ্যাট্রিয়সকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেবে, এবং তারপর নিজেকে ধ্বংস করবে। ওটা ‘নিশ্চিহ্ন’ শব্দটা ব্যবহার করেছে। কাজেই মার্শাল আক্রমণ করলে, প্রথমে অ্যাট্রিয়স ধ্বংস হবে, তারপর বিশাল এক বিস্ফোরণে উড়ে যাবে গোটা যিয়স যুদ্ধটা ড্র দিয়ে শেষ হবে। সামরিক মাথাগুলো এভাবেই কাজ করে। পরাজয়ের বদলে ধ্বংস। একে শেষ যুদ্ধ বলতে পারিস।’ উৎকণ্ঠিত মুখগুলোর উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বলে চলল সে, ‘আপনার কি কখনও মনে হয়েছে, হার্ভে, আপনি, মার্শাল, মেন্টালিস সবাই এই খেলাটা খেলছেন কোনও ভিনগ্রহী, শয়তান দর্শকের লাভের জন্যে?’
‘তোমার ধারণা তৃতীয় কোনও শক্তি এতে জড়িত, হিরু চাচা?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘হ্যাঁ, এবং আমার ধারণা তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। তার নাম শ্যাডো…’
.
দু’পাশে হুড পরা, নির্বাক গার্ডদের নিয়ে প্রিন্সেস ডায়ানার কারাপ্রকোষ্ঠের দরজায় উদয় হলো শ্যাডো।
ডায়ানার দিকে এগিয়ে গেল সে, এবং ডায়ানা আর্তচিৎকার ছেড়ে, বৃথাই শিকল টানাটানি করতে লাগলেন।
শ্যাডো আরও কাছিয়ে এল, আরও…কঙ্কাল-হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটির গলা লক্ষ্য করে… প্রিন্সেস ডায়ানা পিঠ বাঁকিয়ে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলেন-এবার হঠাৎই স্থির আর নীরব হয়ে গেলেন।
শ্যাডো যখন পিছিয়ে গেল, ডায়ানার গলায় তখন ছোট্ট, কালো এক সিলিণ্ডার।
কথা বলল শ্যাডো।
‘প্রিন্সেস ডায়ানা। শুনতে পাচ্ছেন?’
‘পাচ্ছি, প্রভু।’
‘ভাল। আপনার কিছু অবশ্য পালনীয় কর্তব্য আছে। আপনি আমার সন্ধান কাজে সাহায্য করবেন, বুঝতে পেরেছেন?’
‘জি, প্রভু।’
‘শীঘ্রি আপনার প্রেমিকের দেখা পাবেন। হাসুন!’
ডায়ানা মৃদু হাসলেন। হাসিটাকে দেখাল যেন ঠিক মরামানুষের ভেঙচির মতন।
.
হিরু চাচা তার পরিকল্পনা ছকে ফেলেছে এবং সঙ্গীদের তা জানাচ্ছে।
‘মেন্টালিসকে অক্ষম করার জন্যে আমাকে কোনও একটা পথ বের করতে হবে-এবং কাজটা করার সময় মার্শালের তরফ থেকেও কোনও আক্রমণ আসা চলবে না। ডিলাক, আপনি আর হার্ভে ট্র্যান্সম্যাট দিয়ে অ্যাট্রিয়সে ফিরে যাবেন। মার্শালকে বলবেন যুদ্ধ শেষ, তিনি জিতেছেন। তাঁকে সব কিছু বলবেন, কিন্তু যিয়সে আক্রমণ করতে দেবেন না!’
‘তিনি যদি না শোনেন?’ প্রশ্ন করলেন হার্ভে।
‘শুনতে হবে। মার্শাল আক্রমণ করলে মেন্টালিস আরমাগেডন সিকোয়েন্সের ট্রিগার টিপে দেবে। দুম! দুটো গ্রহই ধুলোকণা হয়ে কসমসে ভেসে বেড়াবে মার্শালও রেহাই পাবেন না। তাঁকে সেটা বলবেন্!’ অধৈর্য দৃষ্টিতে ওঁদের দিকে চাইল সে। ‘যান, দেরি করছেন কী জন্যে?’
‘ডায়ানার কী হবে?’ ডিলাক শুধালেন।
কিশোর তাঁর বাহুতে একটা হাত রাখল।
‘উনি এখানে থাকলে আমরা খুঁজে বের করব। অ্যাট্রিয়সে আপনার কাজটা অনেক বেশি জরুরি, মার্শালকে বোঝাতে হার্ভেকে সাহায্য করা।’
ডিলাক মাথা ঝাঁকিয়ে হার্ভের পিছু নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। হার্ভের নাগাল ধরতে যাবেন এ সময় একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন।
‘ডিলাক!’
ডিলাক থমকে দাঁড়িয়ে কান পাতলেন।
গলার স্বরটা আবারও শোনা গেল।
‘ডিলাক….ডিলাক…’ ডায়ানার কণ্ঠ।
.
ট্র্যান্সম্যাট কিউবিকলের দিকে যে জংশনটা গিয়েছে সেখানে থেমে দাঁড়ালেন হার্ভে।
‘কী করছেন, ডিলাক? চলে আসুন!’ কিউবিকলের দরজার উদ্দেশে শশব্যস্তে পা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ফেলে আসা পথের দিকে চাইলেন। ‘আসুন, ডিলাক, জলদি করুন!’
ডিলাককে কোথাও দেখা গেল না। পিছনে নড়াচড়ার শব্দ পেয়ে চরকির মতন ঘুরে দাঁড়ালেন হার্ভে।
করিডরের অপর প্রান্তে কালো হুড পরা, কঙ্কাল-মুখো এক মূর্তি তাঁর দিকে ব্লাস্টার তাক করেছে।
মূর্তিটা ফায়ার করতেই, লাফিয়ে এক পাশে সরে গেলেন হার্ভে, এবং এনার্জি-বোল্ট তাঁর কাঁধের মাংস ছিঁড়ে নিয়ে গেল।
পাল্টা বুনো শট করলেন হার্ভে, এবং টলতে-টলতে ট্র্যান্সম্যাট কিউবিকলে ঢুকে পড়লেন।
সাদা আলো ঝলসে উঠল, এবং তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
.
ওদিকে ডিলাক ডায়ানার ভুতুড়ে কণ্ঠস্বর অনুসরণ করছেন।
‘আমি ডিলাক, ডায়ানা,’ চেঁচিয়ে বললেন। ‘আমি ডিলাক!’
‘ডিলাক,’ ডাকল ভৌতিক কণ্ঠটা। ‘আমার কাছে এসো, ডিলাক।’ ডিলাক নিজেকে লম্বা, অন্ধকার এক করিডরে খুঁজে পেলেন। মনে হলো করিডরটার বুঝি শেষ নেই। দূরে ডায়ানাকে দেখতে পেলেন, দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর দিকে।
‘এসো, ডিলাক।’
ডিলাক দৌড়ে গেলেন। ক্রমেই দূরত্ব কমে আসছে, দু’বাহু প্রসারিত করলেন ডায়ানাকে জড়িয়ে ধরার জন্য।
তাঁর বাহু জোড়া মেয়েটির অশরীরী দেহ ভেদ করে চলে গেল, তাঁর পায়ের নীচে থেকে সরে গেল মাটি।
ফাঁকা করিডর ভরিয়ে তুলল শ্যাডোর বিদ্রূপাত্মক হা-হা অট্টহাসি।
.
দীপ্তিমান পিরামিডটার পাশ থেকে একটি প্যানেল সরাল হিরু চাচা, অস্বস্তির সঙ্গে চাউনি বুলাল অটোমেটেড ব্লাস্টারগুলোর দিকে।
‘কোনও সমস্যা হবে না তো, রোকু? তোর বন্ধু ভয় পেয়ে কিছু করে বসে যদি?’
‘করবে না, প্রভু। এগোন।’
সনিক স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে সার্কিট বিচ্ছিন্ন করতে লাগল হিরু চাচা। কিশোর লক্ষ করছে।
‘হিরু চাচা, তোমার কি ধারণা শ্যাডো এই কম্পিউটারটা বানিয়েছে?’
‘নিজে নয়, সম্ভবত। তবে আমার ধারণা এর পেছনে ওর হাত আছে।’
‘প্রিন্সেস কি এখন শ্যাডোর হাতে বন্দি?’
‘খুব সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায়?’
হিরু চাচার চোখের সামনে একটা হাত ধরল কিশোর
‘তুমি বলেছিলে অ্যাট্রিয়স আর যিয়সের মাঝখানে কিছু একটা থাকবে।’
চোখ তুলে চাইল হিরু চাচা।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই! সাবাস, ভাতিজা। ওর নিশ্চয়ই একটা বেস আছে, হয়তো নিজস্ব তৃতীয় কোনও গ্রহ।
‘তো আমাদের ওটা খুঁজে বের করতে হবে।
হিরু চাচা ফের কাজ শুরু করল।
‘এটা শেষ করার পর। যদি কাজটা করতে পারি আরকী…’
পিরামিডের ভিতর থেকে একটা সার্কিট সরাল হিরু চাচা, অ্যালার্মড ব্লিপের কোরাস শোনা গেল।
‘হিরু চাচা, ‘কী করেছ তুমি?’
মাথা চুলকাল হিরু চাচা।
‘জানি না। কী করেছি রে, রোকু?’
‘আপনি প্রাথমিক অ্যালার্ট ফাংশন চালু করেছেন। কম্পিউটারটা এখন নিজেকে ধ্বংস করবে, হামলা ঠেকানোর প্রয়োজন হলে।’
হিরু চাচা কাজ করে চলল।
‘আশা করি হার্ভে সময় মত মার্শালের কাছে পৌঁছবেন। তার আগ পর্যন্ত আমরা বিপদের মুখে থাকব।’
কম্পিউটার থেকে আরও ব্লিপ এল, এবারও নিশ্চিতভাবে অ্যালার্মের সুর বাজল।
‘শত্রু ক্র্যাফট এগিয়ে আসছে,’ ঘোষণা করল রোকু।
পিরামিডের পিছনে কনসোলে লাল বাতি ঝলসাতে লাগল। ‘এটা মার্শাল না হয়ে যায় না,’ গম্ভীর শোনাল হিরু চাচার কণ্ঠ ‘হার্ভে নিশ্চয়ই অনেক দেরি করে ফেলেছেন।’
শেষবারের মত উত্তেজিত ব্লিপ ক্রমশ চড়া সুরে বেজে উঠল।
‘মেণ্টালিস এখন আত্মবিধ্বংসী সিকোয়েন্সে ঢুকেছে,’ ঘোষণা করল রোকু।
ডিজিটাল ঘড়ি থেকে জোরাল টিক-টিক শব্দ ভেসে এল। ১০০০ থেকে কাউন্টডাউন শুরু করল ওটা। 999…998…99৭।
হিরু চাচা অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে কাজ করে চলেছে।
‘হামলা হলে এটা আমাদের সবাইকে সহ নিজেকে উড়িয়ে দেবে, যদি না আমি…’
‘হিরু চাচা, সাবধান!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
হিরু চাচা লাফিয়ে পিছে সরে আসতেই পিরামিডের অটোমেটিক ব্লাস্টারগুলো অগ্নিবর্ষণ করল। স্ফুলিঙ্গের ফোয়ারা তুলে বিস্ফোরিত হলো পিরামিডটা।
হিরু চাচা চোখ মেলল, বেঁচে আছে দেখে হাঁফ ছাড়ল।
‘অল্পের জন্যে বেঁচেছি!’
কিশোর তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল।
‘তোমাকে ওগুলো মিস করল কীভাবে?’
‘ব্লাস্টারগুলো আমাকে নয়, ওটার দিকে তাক করেছিল। হিরু চাচা চূর্ণ-বিচূর্ণ পিরামিডটার দিকে ভ্রূ দেখাল। ‘কাঁকড়াবিছে যেভাবে নিজেকে কামড়ে মারে। যখনই ওটা টের পেয়েছে আমি আরমাগেডন সিকোয়েন্স বন্ধ করতে চেষ্টা করছি, তখনই ওটা নিজের কন্ট্রোল সেণ্টার ধ্বংস করে দিয়েছে। ওটা এখন মাইণ্ডলেস।’
অবিরাম টিক-টিক শব্দটা হয়েই চলেছে। ৮২০, ৮১৯, ৮১৮…
‘চল বেরিয়ে যাই,’ বলল হিরু চাচা।
দরজার দিকে পা বাড়াল সে, তাকে অনুসরণ করল কিশোর আর রোকু।
অন্তহীন করিডর ধরে শশব্যস্তে হেঁটে চলল ওরা, যতক্ষণ পর্যন্ত না শ্যাডো হিরু চাচাকে জেরা করেছিল সেই কামরাটিতে পৌঁছল। টাইম মেশিন তখনও ওখানে আছে দেখে হিরু চাচা খুশি হয়ে উঠল, এবং ওরা ঝড়ের বেগে ভিতরে প্রবেশ করল।
কন্ট্রোল রূমে গিয়ে হিরু চাচা গোপন এক ওয়াল সেফের কাছে চলে এল। হাতের তালুর প্রিন্ট দিয়ে ওটা খুলে, জ্বলজ্বলে বড় এক টুকরো ক্রিস্টাল বের করল-ক্রিস্টালটার এক পাশে অনিয়মিত আকারের এক ফাঁক। হিরু চাচা ওটা তুলে ধরল।
‘দেখ। কী দেখতে পাচ্ছিস?’
কিশোর চাইল।
‘ছ’টা টুকরোর মধ্যে পাঁচটা একসঙ্গে করা হয়েছে, এতে কী লাভ হবে?’
‘হয়তো ছ’টার মধ্যে পাঁচটা টুকরো আমাদেরকে ছয় ভাগের পাঁচ ভাগ ক্ষমতা দেবে-গার্ডিয়ান টেকনোলজি যদি সেভাবে কাজ করে আরকী।’
‘আমাদের কাছে যদি ছ’নম্বর টুকরোটা থাকত…
কিংবা একটা নকল ছ’নম্বর টুকরো,’ আচমকা বলল হিরু চাচা। ‘আমরা ছ’নম্বর টুকরোটার আকৃতি দেখতে পেলে নিজেরা একটা বানিয়ে নিতে পারি!’
ক্রিস্টালটা আঁকড়ে ধরে, হিরু চাচা হন্তদন্ত হয়ে টাইম মেশিনের ওয়র্কশপের উদ্দেশে এগোল।
মার্শালের কমাণ্ড শিপে পাইলট বললেন, ‘যিয়স সামনে, স্যর।’
মার্শাল নীচের কুয়াশাঘেরা মানচিত্রটার দিকে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।
‘শেষ পর্যন্ত! আমি ওটাকে পচা ডিমের মত পিষব। ফায়ার করার জন্যে তৈরি হোন…’
পাইলট একটি কন্ট্রোল স্পর্শ করলেন, রকেট র্যাকগুলো হড়কে ফায়ারিং পজিশনে আসতেই শিপটা যন্ত্রপাতির মৃদু গুঞ্জনে কাঁপতে লাগল।
‘সবক’টা মিসাইল সশস্ত্র। লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, স্যর। শীঘ্রি আমরা রেঞ্জে চলে আসব।’
‘কাছে যান,’ মার্শাল আদেশ করলেন। ‘যতটা সম্ভব কাছে।’ কন্ট্রোল প্যানেল থেকে একটি কণ্ঠস্বর কড়কড় করে উঠল।
‘অ্যাট্রিয়ান কন্ট্রোল টু মার্শাল। আমি মেজর হার্ভে। মিশন বাতিল করুন। যুদ্ধ শেষ!’
‘ওটা বন্ধ করুন,’ গর্জে উঠলেন মার্শাল। ‘যত্তসব অপদার্থ আমলার দল, আমার মনোবল নষ্ট করতে চাইছে। আমি যুদ্ধটা শেষ করব। রকেট আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত হোন।’
লাল ফায়ারিং বাটনের দিকে এগিয়ে গেল পাইলটের হাত।
‘আদেশের জন্যে অপেক্ষা করুন,’ ঘাউ করে উঠলেন মার্শাল। ‘আমরা এখনও যথেষ্ট কাছে পৌঁছইনি…’
.
হিরু চাচা শশব্যস্তে টাইম মেশিনের কন্ট্রোল রূমে ফিরে এল। তার এক হাতে সময়ের অসম্পূর্ণ চাবিটা ধরা, অন্য হাতে অদ্ভুত আকৃতির এক ক্রিস্টাল খণ্ড। এটি চাবির অন্যান্য ক্রিস্টালের চাইতে ম্লান, গায়ে এক ধরনের হলদে ছোপ আছে।
‘এই যে, স্পেয়ার পার্টটা।’
কিশোর সন্দেহের দৃষ্টিতে ওটার দিকে চাইল। ‘কী ব্যবহার করেছ?’
‘ক্রোনোডাইন।’
‘মানানসই হবে তো?’
‘আশা তো করি।’
‘কম্পেটেবিলিটি রেশিও চুয়াত্তর শতাংশ,’ একঘেয়ে কণ্ঠে বলল রোকু। ‘কম্পোনেন্ট আনস্টেবল, এবং অবনতি হতে পারে।’
হিরু চাচা নকল ছ’নম্বর টুকরোটা যথাস্থানে বসাল।
‘থিয়োরি অনুযায়ী, এটা আমাদের পাওয়ার অভ ব্যালান্স দেবে। আমরা গোটা এলাকার ওপর একটা নিরপেক্ষ, সময়হীন অঞ্চল তৈরি করতে পারব—অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে…আমাকে ট্রেসারটা দে, কিশোর, ক্রোনোডাইনটা জায়গামত সিল করতে লাগবে ওটা। ক্রিস্টালটির ভিত্তিমূলে এক ধরনের সকেটে ট্রেসারটা ফিট করল সে।
.
মার্শাল ভিউয়িং পোর্ট দিয়ে নীচের দিকে চেয়ে রয়েছেন।
‘ফায়ার!’ চেঁচালেন তিনি।
পাইলটের আঙুল বাটনের দিকে এগোল…
‘ফায়ার!’ চেঁচালেন মার্শাল।
পাইলটের আঙুল বাটনের দিকে এগোল…
এবং বাটনের দিকে এগোল…
.
কম্পিউটার রূমে কাউন্টডাউন ঘড়িটা রিডিং দিচ্ছে ১০, ৯, ৮…১০, ৯, ৮…১০, ৯, ৮…
বারবার এরকম চলছে।
.
টাইম মেশিনের কনসোল থেকে মুখ তুলে চাইল কিশোর।
‘ওদেরকে পেয়েছি, হিরু চাচা!’
হিরু চাচা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল।
স্ক্যানারে দেখতে পেল মার্শালের শিপ এঁকেবেঁকে যিয়সের দিকে এগিয়ে আসছে…এবং এঁকেবেঁকে যিয়সের দিকে এগিয়ে আসছে…এবং এঁকেবেঁকে যিয়সের দিকে এগিয়ে আসছে…বারবার এরকমটা ঘটে চলেছে।
‘আমরা পেরেছি,’ আনন্দচিত্তে বলল হিরু চাচা। ‘নিরানব্বই পার্সেন্ট সফল।’
‘নিরানব্বই দশমিক পাঁচ চার,’ শুধরে দিল রোকু।
‘তারচেয়ে ভাল। আমরা ওদেরকে সময়ের ফাঁদে ফেলেছি! এক ঘণ্টার জন্যে আমরা রাজা…’
‘না,’ বাধা দিল রোকু। ‘সম্ভাব্য সময় তিন দশমিক দুই পাঁচ মিনিট। কারণ ক্রোনোডাইন ক্রিস্টালটার অবনতি ঘটছে।’
হিরু চাচা রীতিমত আতঙ্কিত।
‘সোয়া তিন মিনিট মাত্র?’ কিশোর আর রোকুর দিকে চাইল সে। ‘রাজার মত ক্ষমতা রাজার মতই ব্যবহার করা উচিত।’ চাবিটা তুলে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ‘আমি এই মর্মে আদেশ করছি…’ গলা খাঁকরে নিল। ‘মার্শালের শিপের কাছে সময়ের স্থানীয় ফাঁদ তৈরি হোক…
‘এবং কম্পিউটার রূমে,’ জরুরি তাগিদ কিশোরের কণ্ঠে।
‘এবং কম্পিউটার রূমে,’ ত্বরিত যোগ করল হিরু চাচা। উজ্জ্বল হাসল। ‘ভাল বলেছি না, ভাতিজা?’
‘ক্ষমতার দম্ভ ভাল নয়, হিরু চাচা,’ তিরস্কার করল কিশোর।
‘হয়েছে, হয়েছে, এটা মাত্র তিন সেকেণ্ডের সময়ের ফাঁদ। ক্রোনোডাইন ক্রিস্টালটার কী খবর, রোকু, এখনও অবনতি হচ্ছে?’
‘জি, প্রভু। তবে আগের চেয়ে ধীর গতিতে।
‘এরকমটাই শুনতে চেয়েছিলাম।’ এক লকার হাতড়াল হিরু চাচা,ওকের খোদাই করা এক পেডেস্টাল বের করল, এবং সময়ের চাবিটা ওটার মাথায় রাখল। ‘আমাদের মনে হয় কাজ চালু করা উচিত। কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়, এমনকী আমার সময়ের ফাঁদও!’
.
প্রিন্সেস ডায়ানা অন্ধকার এক বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, শ্যাডো ঠিক তাঁর পিছনে। ডায়ানা রয়েছেন বিশাল এক গোলাকার কামরায়, উঁচু এক মঞ্চ ছাড়া আর কিছু নেই এখানে। মঞ্চের উপরে একটি সিংহাসন। এটি শ্যাডোর গুহা।
‘ডক্টর চাবিটা ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে,’ হিসিয়ে উঠল শ্যাডো। ‘তার মানে নরকের সীমানা আর নিরাপদ নয়। আপনি ডক্টরকে এখানে আসতে প্রলুব্ধ করবেন এবং আমাকে টাইম মেশিনে ঢুকতে সাহায্য করবেন, বুঝতে পেরেছেন?’
‘জি, প্রভু,’ ভোঁতা গলায় বললেন ডায়ানা। ছাল দিয়ে আবৃত সাদা এক স্কার্ফ তাঁর গলার কন্ট্রোল সিলিণ্ডারটা ঢেকে রেখেছে।
‘আসুন। আমার সেবকরা আপনার সাথে ট্র্যান্সম্যাটে যাবে।’ হুড পরা নির্বাক মূর্তিগুলোকে হাতছানি দিয়ে ডেকে, ডায়ানাকে পিছনে নিয়ে পা বাড়াল শ্যাডো।