দশ
জ্ঞান ফেরার পর ডিলাক নিজেকে ইস্পাতের অগভীর এক শ্যাফটের তলায় পড়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলেন। একটা পা মচকে গেছে, নড়াচড়ার চেষ্টা করতেই ব্যথায় দপ দপ করে উঠল ওটা।
পরিচিত এক কণ্ঠস্বর বলল, ‘ডিলাক? ডিলাক, তুমি ঠিক আছ তো?’
মুখ তুলে চাইলেন তিনি। প্রিন্সেস ডায়ানা গহ্বরের কিনারায় দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রয়েছেন।
‘খুব বেশি লেগেছে?’ প্রশ্ন করলেন ডায়ানা।
ডিলাক কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়ালেন।
‘পা মচকেছে। কী হয়েছিল?’
‘আমি তোমাকে ডেকেছিলাম, তুমি আমার দিকে দৌড়ে আসতে গিয়ে পড়ে যাও। আমি তোমাকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আঁধারে আমার পাশ কাটিয়ে টলতে টলতে চলে যাও।’
‘আমি ভেবেছিলাম তুমি ভূত, ঘোরগ্রস্তের গলায় বললেন ডিলাক। চারপাশে চাইলেন। গহ্বরটা তেমন একটা গভীর নয়, একটু সটান হয়ে চেষ্টা করতেই কিনারায় আঙুল রাখতে পারলেন। ওটার দেয়ালগুলো ডায়াল আর ভারী তার দিয়ে ঢাকা; ডিলাক অনুমান করলেন তিনি কোনও ধরনের ইন্সপেকশন পিটে পড়ে গিয়েছিলেন।
নাও, আমার হাত ধরো,’ বললেন ডায়ানা। গহ্বরের প্রান্ত দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ডিলাকের হাত চেপে ধরলেন। গহ্বরের কিনারা আবার হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে, ডায়ানার সাহায্য নিয়ে শ্যাফট থেকে নিজেকে টেনে তুললেন তিনি।
‘ডক্টরকে আমাদের খুঁজে পেতে হবে…
আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরো,’ বললেন ডায়ানা, এবং ডিলাক তাঁর সাহায্য নিয়ে খুঁড়িয়ে–খুঁড়িয়ে করিডর ধরে পা বাড়ালেন।
কালো হুড পরা দুই মূর্তি আঁধার ভেদ করে তাঁদের পিছু নিল।
.
হিরু চাচা ইতোমধ্যে পিরামিডের ভিতরের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি বের করে ফেলেছে। এমুহূর্তে জট পাকানো তার আর সার্কিটের জঞ্জাল হাতড়াচ্ছে মরিয়ার মতন।
‘সুবিধের মনে হচ্ছে না, তাই না?’ বলল কিশোর।
‘হুঁ, যে-ই এই কম্পিউটারটা বানিয়ে থাকুক, তার মাথার মধ্যে প্যাচ ছিল! কোথাও নিশ্চয়ই একটা ফেইল-সেফ কাট-আউট থাকবে-কিন্তু আমি ওটা খুঁজে পাচ্ছি না!’ কাজে মন দিল আবার।
.
টাইম মেশিন রয়েছে যে ঘরটিতে সেটির দরজা পাহারা দিচ্ছে রোকু। আগুয়ান পদশব্দ পেয়ে সতর্ক হলো ও।
‘কে? নিজের পরিচয় দিন।’
ডিলাক কোনা ঘুরে বেরিয়ে এলেন, ডায়ানার সাহায্য নিয়ে।
‘আমি ডিলাক, রোকু
‘দ্বিতীয়জনের পরিচয় দিন।’
‘ইনি প্রিন্সেস ডায়ানা। ডক্টর ওর সাহায্য চান।’
ডিলাক খোঁড়াতে-খোঁড়াতে সামনে এগোলেন। রোকু শাণিত কণ্ঠে বলল, ‘দাঁড়ান! শত্রু উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে।’
‘কোথায়?’
‘শত্রু আসছে। আড়াল নিন।’
ডায়ানা আর ডিলাক কামরায় সাঁত করে ঢুকে পড়লেন, পরমুহূর্তে কালো হুড পরা দুই নির্বাক মূর্তি ব্লাস্টার হাতে করিডরে উদয় হলো।
রোকু এগিয়ে গিয়ে গুলি করল, এবং দুই মূর্তি ঘুরেই দিল দৌড়। অগ্নিবর্ষণ করতে-করতে তরতর করে পিছু ধাওয়া করল রোকু।
প্রিন্সেস ডায়ানা টাইম মেশিনের দিকে চেয়ে ছিলেন, যন্ত্রটার প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ বোধ করছেন তিনি।
‘এটার ভেতরে কী?’ ফিসফিস করে বললেন। ‘আমি ভেতরটা দেখব।’
‘সরি, শুধুমাত্র হিরন পাশা আর কিশোর ভেতরে ঢুকতে পারে।’ বললেন ডিলাক।
ডায়ানা তাঁর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। রোকু হামলাকারীদের তাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের এখন তোমার বন্ধুদের খুঁজে বের করতে যাওয়া দরকার।’
রোকুর তাড়া খেয়ে দুই মূর্তি ট্র্যান্সম্যাট কিউবিকলে তড়িঘড়ি ঢুকে পড়েছে, এবং আলোর ঝলকানির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
‘সন্তোষজনক,’ বলল রোকু, নিজের পিঠ কাল্পনিকভাবে চাপড়ে দিল। ‘শত্রুরা পালিয়েছে।’
আরেকটি ঝলক, এবং এক সাদামাঠা কালো বাক্স কিউবিকলে উদয় হলো। বারবার নিয়মিত ব্লিপ দিয়ে যাচ্ছে ওটা।
সাবধানে, স্বচ্ছন্দে সামনে এগোল রোকু।
ডিসট্রেস কল পেয়েছি। দয়া করে ট্র্যান্সমিশনের উৎস চিহ্নিত করুন।’
বাক্সটা ব্লিপ দিয়ে চলেছে।
রোকু কিউবিকলটার ভেতরে ঢুকে পড়ল।
আলো ঝলসে উঠল, এবং রোকু আর বাক্সটা উবে গেল।
.
প্রিন্সেস ডায়ানার সাহায্য নিয়ে ডিলাক কম্পিউটার রূমে ল্যাংচাতে- ল্যাংচাতে প্রবেশ করলে মুখ তুলে চাইল হিরু চাচা।
‘ডক্টর, আমি ওকে খুঁজে পেয়েছি। ও প্রিন্সেস ডায়ানা।’
হিরু চাচা উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করল।
‘আপনার সাথে দেখা হওয়াতে খুব খুশি হলাম, ইয়োর হাইনেস। এ আমার ভাতিজা কিশোর।’ ডিলাকের দিকে ঘুরে চাইল। ‘আপনি ওঁকে উদ্ধার করেছেন?’
ডিলাক বিষণ্ন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।
‘ও পালিয়েছে, নিজের চেষ্টায়, তারপর আমাকে উদ্ধার করেছে!’ হিরু চাচাকে জানালেন কী হয়েছিল।
ডায়ানার দিকে সপ্রশংস চোখে চাইল হিরু চাচা।
‘পালিয়েছেন, বাহ! কীভাবে পারলেন?’
‘আমি গার্ডদের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে এক ধরনের কিউবিকলের ভিতরে লুকাই। আলোর এক ঝলকানির পরে দেখি আমি এখানে। গার্ডরা আমাকে ফলো করে, কিন্তু আপনার-রোকু ওদের তাড়িয়ে দেয়।’
‘ভাল, ভাল,’ অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। নিজের অসমাপ্ত কাজের দিকে চাইল। ‘আমি বলি কি, ইয়োর হাইনেস, আপনি ডিলাককে নিয়ে ট্র্যান্সম্যাটের মাধ্যমে অ্যাট্রিয়সে ফিরে যান।
‘আমি আপনার কাছাকাছি থাকলে নিরাপদ বোধ করব, ডক্টর।’
‘ধন্যবাদ, কিন্তু আমাদেরকে খুব জটিল একটা কাজ শেষ করতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আপনি বাড়ি ফিরে গিয়ে জনগণকে জানান আপনি ভাল আছেন।’
ডায়ানার বাহুতে হাত রাখলেন ডিলাক ↓
‘ডক্টর ঠিকই বলেছেন, ডায়ানা। চলো। অ্যাট্রিয়সের কন্ট্রোলগুলো কীভাবে সেট করব?’
হিরু চাচা তাঁদেরকে সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দিল, এবং তাঁরা তড়িঘড়ি চলে গেলেন।
.
রোকু ট্র্যান্সম্যাট কিউবিকল থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে এক অনালোকিত পাথুরে সুড়ঙ্গে খুঁজে পেল।
‘এটা অ্যাট্রিয়স নয়, যিয়সও নয়। কোন্ জায়গা এটা?’
জবাব এল বিদ্রূপাত্মক প্রতিধ্বনির মাধ্যমে।
‘জায়গা এটা…জায়গা এটা… জায়গা এটা…
এবার এক কর্কশ, অশুভ কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে উঠল, ‘আমার রাজ্যে স্বাগতম। আমি শ্যাডো!’
রোকু নড়তে পারার আগেই, কালো আলখিল্লা পরা এক মূর্তি হামলে পড়ল ওর উপর, এবং ওর চিবুকের নীচে ধাতব এক সিলিণ্ডার আটকে দিল।
.
হিরু চাচা সটান সিধে হয়ে দাঁড়াল।
‘কোনও কাজ হচ্ছে না রে, ভাতিজা। আমাদেরকে অন্য কিছু ট্রাই করতে হবে।’
‘যেমন?’
‘আসল ছ’নম্বর টুকরোটা খুঁজে বের করা। ওটা করা গেলে আমাদের সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। আমি প্রয়োজনে ওই কম্পিউটারটাকে চিরস্থায়ী সময়ের ফাঁদে ফেলতে পারি।’ কিশোরকে পিছনে নিয়ে কামরা ত্যাগ করল সে।
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি, হিরু চাচা?’
‘তিন নম্বর গ্রহে, ভাতিজা। শ্যাডোর গুহায়!’
.
ডিলাক আঙুল তাক করলেন।
‘ওই যে ওটা, ডায়ানা। ট্র্যান্সম্যাট কিউবিকল।’
হঠাৎই ডায়ানা ওঁকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলেন। ডিলাকের পা ভাঁজ হয়ে গেল, এবং তিনি পড়ে গেলেন।
‘ডায়ানা, কী করছ তুমি? আমাকে ওঠাও।’
বাঁকা হাসি ফুটে উঠল ডায়ানার ঠোঁটের কোণে।
‘আমার আরও জরুরি কাজ আছে।’
ট্র্যান্সম্যাটে আলো জ্বলে উঠল এবং দুই সশস্ত্র নির্বাক উদয় হলো। ডায়ানা ওদেরকে নিজের দিকে ডাকলেন।
‘তুমি ডায়ানা নও,’ সভয়ে বললেন ডিলাক। ‘কে তুমি?’
‘তুমি একটা নির্বোধ,’ ঠাণ্ডা স্বরে বললেন ডায়ানা। দুই মূর্তিকে পিছনে নিয়ে চলে গেলেন। যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত পিষে ট্র্যান্সম্যাটের উদ্দেশে গুড়ি মেরে এগোলেন ডিলাক।
.
চাচা-ভাতিজা যখন টাইম মেশিনের কাছে পৌছল, রোকুকে কোথাও দেখতে পেল না!
‘ও হয়তো এখনও গার্ডগুলোকে তাড়া করছে,’ বাতলে দিল কিশোর।
হিরু চাচা, একটা হাত তুলল।
‘শোন!’
ওরা ব্লাস্টার ফায়ারের শব্দ পেল, আচমকা এক আর্তনাদ, এবং আগুয়ান ছুটন্ত পদশব্দ।
প্রিন্সেস ডায়ানা সবেগে কামরায় প্রবেশ করলেন।
‘ডক্টর, আমাকে বাঁচান। ওরা আমাকে ধাওয়া করছে!’
‘জলদি টাইম মেশিনে ঢুকে পড়ুন,’ বলল কিশোর। ডায়ানার হাত ধরে দরজার উদ্দেশে টেনে নিয়ে গেল।
হিরু চাচা ওদেরকে অনুগমন করল, পকেটগুলো চাপড়াচ্ছে।
‘চাবি, চাবি, চাবি, কোথায় যে-ওহ, এই যে!’
দরজা খুলল সে এবং সবাই তড়িঘড়ি ভিতরে ঢুকে পড়ল।
হিরু চাচা দরজাটা পিছনে লাগিয়ে দিল, এবং ডায়ানা চারপাশে অবাক দৃষ্টি বুলাতে লাগলেন।
হিরু চাচা চট করে স্ক্যানারের কাছে চলে গেল, মার্শালের কমাণ্ড শিপ যেখানে বারবার একই ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
হিরু চাচার কাঁধের উপর দিয়ে চাইল কিশোর।
‘দেখে মনে হচ্ছে ফাঁদটা পাঁচ সেকেণ্ডের।’
মাথা ঝাঁকাল হিরু চাচা।
‘এতে সত্যিকারের এক ঘণ্টা সময় পাওয়া যাচ্ছে।’ ডায়ানার দিকে ঘুরে চাইল। ‘ডিলাকের কী হয়েছিল?’
‘আমি ওকে ট্র্যান্সম্যাট কিউবিকলের কাছে নিয়ে যাই, কিন্তু গার্ডরা হাজির হয়ে গেলে তাদেরকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাই। ও এখন নিশ্চয়ই নিরাপদে আছে।’
কিশোর বলল, ‘তৃতীয় গ্রহটার খবর নেয়া দরকার।’
ডায়ানা বিস্মিত দৃষ্টিতে সময়ের চাবিটির দিকে চেয়ে ছিলেন। ‘কী এটা?’
‘সময়ের চাবি, মানে তার ছয় ভাগের পাঁচ ভাগ আরকী।’ হিরু চাচা কৌতূহলী চোখে তাঁর দিকে চাইল। ‘আপনি ঠিক আছেন তো, প্রিন্সেস?’
‘পুরোপুরি, ডক্টর।
‘চাবিটা কি আপনাকে কোনও গোপন স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়?’
‘না। আমার কাছে এটার কোনও অর্থ নেই।’
চিবুক ঘষল হিরু চাচা।
‘দুঃখের কথা! মনে পড়লে আমাদের বলতে পারতেন ছ’নম্বর টুকরোটা কোথায় পাওয়া যাবে। আমরা শেষ সূত্রটা খুঁজছি। ভাবুন, ডায়ানা, ভাবুন!’
ডায়ানা ধীর পায়ে চাবিটার কাছে হেঁটে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
‘ধরা ঠিক হবে না,’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। ‘খুব গরম!’
ছ’নম্বর টুকরোটার বিকল্প ক্রোনোডাইন ক্রিস্টালটা অতিরিক্ত গরম হয়ে উঠেছে, মৃদু হিস হিস শব্দ করছে আর ক্ষীণ ধোঁয়া ছাড়ছে।
কিশোর হঠাৎই বলে উঠল, ‘পেয়েছি, হিরু চাচা! বিশাল এক অ্যাস্টেরয়েড, দুই গ্রহের মাঝখানে। ভালভাবে ঢাকা দেয়া।’
‘ওয়েল ডান, ভাতিজা। কো-অর্ডিনেটগুলো সেট কর, আমরা রওনা হব।’
প্রিন্সেস ডায়ানা তখনও সময়ের চাবিটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন।
.
শ্যাডো তার গুহায় দাঁড়িয়ে, হিরু চাচার টাইম মেশিনটি পাথুরে করিডরে নামার সময় শব্দের যে প্রতিধ্বনি হচ্ছে সেটি শুনছে। রোকু তার পায়ের কাছে।
শ্যাডো চোখ নামাল।
‘মনে হচ্ছে তোর বন্ধুরা আসছে। চল, আমরা গিয়ে তাদের স্বাগত জানাই।’
‘জি, প্রভু।’
শ্যাডো পিছনে মাথা ঝটকা দিল, তার শয়তানী হাসির শব্দ মিশে গেল টাইম মেশিনের আওয়াজের সঙ্গে।
‘আপনি বোকা বলেই আমার রাজ্যে প্রবেশ করেছেন, ডক্টর। শীঘ্রি সময়ের চাবি আমার হবে!’
এগারো
টাইম মেশিনের কনসোলের সেন্ট্রাল কলাম ওঠা-নামা বন্ধ করল, এবং হিরু চাচা গভীর শ্বাস টানল।
‘হ্যাঁ, আমরা শ্যাডোর পিছু নিয়ে তার গুহায় পৌঁছে গেছি।’
কিশোর ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক বলেছ। ও আমাদেরকে যেখানে পেতে চায় সেখানে পৌঁছে গেছি আরকী!’
পেডেস্টালের দিকে মাথা নাড়ল হিরু চাচা।
‘আমাদের এখন কাজ হচ্ছে ছ’নম্বর টুকরোটা জোগাড় করা এবং শ্যাডো যাতে বাকি পাঁচটা হাত করতে না পারে সে ব্যবস্থা করা!’
‘ট্রেসার ছাড়া ছ’নম্বর টুকরোটা আমরা খুঁজে পাব কীভাবে? এবং আমরা ট্রেসারটা ব্যবহার করতে পারব না, কারণ ওটা চাবিটাকে জোড়া দিয়ে রেখেছে। ট্রেসার সরিয়ে নিলে সময়ের ফাঁদ হারাব আমরা, এবং তা হলে অ্যাট্রিয়স আর যিয়সের লাখ-লাখ মানুষ প্রাণ হারাবে!’ কিশোর নকল টুকরোটার দিকে চাইল। ওটা এখন ফেটে গিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
‘জিনিসটা আর কতক্ষণ টিকবে?’
শ্রাগ করল হিরু চাচা।
‘আমাদের একটু ডায়াগনাল ভাবনার দরকার, তাই না, প্রিন্সেস?’ ডায়ানা চাবিটার দিকে চেয়ে ছিলেন।
‘কী? সরি, আমি খেয়াল করিনি।’
‘শ্যাডোকে আর চাবিটাকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আপনার সাহায্য চাই।’
‘আমি এখানে থাকতে পারব না?’
‘না, ডায়ানা। আপনি আগে এখানে ছিলেন। আপনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।
‘আমি এখানে থাকতে চাই!’
কিশোর তাঁর দিকে অবাক চোখে চাইল।
‘আপনি চান না আমরা অ্যাট্রিয়সকে রক্ষা করি?’
‘অ্যাট্রিয়সের সাথে আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই।’
(কর্কশ এক কণ্ঠ কথা বলে উঠল ডায়ানার মাথার মধ্যে। ওদের সাথে যাও। কিশোরকে আমার কাছে এনে দাও।’)
ডায়ানা চোখ তুলে চাইলেন।
‘বুঝতে পেরেছি।’
কিশোর তাঁর দিকে কৌতূহলী চোখে চাইল।
‘আপনি ঠিক আছেন তো?’
হিরু চাচা বলল, ‘সব একদম ঠিক আছে, তাই না, ডায়ানা?’
‘অবশ্যই। আমি আপনাদের সাথে আসব, ডক্টর। শ্যাডোকে হারানোর জন্যে যা-যা করা দরকার সব করব আমরা।’
‘আপনি জানেন ও কোথায়?’ কিশোরের প্রশ্ন।
‘মনে হয় খুঁজে নিতে পারব।
হিরু চাচা দরজা খুলল, এবং ডায়ানা ওদেরকে পিছনে নিয়ে টাইম মেশিন থেকে বেরিয়ে এলেন।
‘আমি আপনাদের সাথেই থাকব,’ বলল হিরু চাচা। ‘জাস্ট লক করে আসি।’ টাইম মেশিনের কনসোলে ফিরে গেল, এবং মুহূর্ত খানেক কান পেতে শুনল, অডিও সার্কিটের টিউনিং অ্যাডজাস্ট করল। নিয়মিত প্যাটার্নের ব্লিপ কন্ট্রোল রুমটিকে ভরিয়ে তুলল। ‘কী যেন শুনলাম মনে হলো। প্যান-গ্যালাকটিক ডিসট্রেস সিগন্যাল। ভারী অদ্ভুত!’
হিরু চাচা একটা লকার হাতড়ে, কম্পাস-সদৃশ এক অডিও-ট্রেসার বের করে শশব্যস্তে অন্যদের পিছু নিল।
.
কালো অ্যাস্টেরয়েডটায় মৌচাকের মত অসংখ্য সুড়ঙ্গ আর প্যাসেজওয়ে। পাথুরে কলামের সাহায্য নিয়ে গঠিত ওটা, অশুভ এক সবুজ আভায় আলোকিত। পাথর থেকেই যেন আসছে আলোটা। এখানে-সেখানে সুড়ঙ্গ থেকে গুহা বেরিয়েছে। কোনও-কোনওটার আকৃতি খুদে প্রকোষ্ঠের সমান, অন্যগুলো একেকটা প্রকাণ্ড অনুজ্জ্বল হল। সব ক’টা আঁধার আর নীরব। ভাপসা বাতাস ভরে আছে দূরাগত ঠং-ঠং আর গোঙানি, বাদুড়ের ডাক আর ইঁদুরের মত খুদে প্রাণীর ছোটাছুটির শব্দে। ইতস্তত খোদাই করা মূর্তির মুখ কটাক্ষ হানছে নিরেট পাথর থেকে। গোটা এলাকাটায় বিচিত্র এক পরিবেশ বিরাজমান, পচা কোনও আপেল যেন কুরে-কুরে খাচ্ছে অসংখ্য পোকা।
কিশোর আর ডায়ানা দ্রুত পা চালাল। কিশোর কাঁধের উপর দিয়ে চকিতে হিরু চাচার দিকে চাইল। সে কেন জানি অনেক বেশি সময় নিচ্ছে।
দেয়ালের এক চোর-কুঠরিতে দাঁড়িয়ে থেকে রোকু ওদেরকে দেখছে, কালো আলখিল্লাধারী এক মূর্তি ওর পাশে।
‘নির্দেশ, প্ৰভু?’
‘কিশোরকে ডায়ানার সাথে ছেড়ে দাও। তুমি ডক্টরকে অনুসরণ করবে।’
‘জি, প্রভু।’
.
অডিও-ট্রেসার হাতে হিরু চাচা টাইম মেশিন থেকে হনহন করে বেরিয়ে এল, রিডিংগুলো জরিপ করল।
‘দুই ছয় শূন্য,’ আওড়াল এবং যন্ত্রটা পকেটে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। কিশোর আর ডায়ানাকে দূরে দেখতে পাচ্ছে সে।
‘আমার জন্যে দাঁড়া তোরা। আমরা একসাথে না থাকলে হারিয়ে যাব।’
হঠাৎই কিশোর আর ডায়ানা অদৃশ্য হয়ে গেল।
হিরু চাচা হন্তদন্ত হয়ে ওদের অনুসরণ করল, এবং নিজেকে খুঁজে পেল এমন এক জায়গায়, যেখানে অনেকগুলো সুড়ঙ্গ যুক্ত হয়েছে।
‘হিরু চাচা!’ কিশোরের ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠ ডাকল। এক প্যাসেজের শেষ প্রান্তে কিশোর দাঁড়িয়ে।
‘হিরু চাচা!’ কণ্ঠটা ডাকল আবারও, এবং কিশোর আরেকটি প্যাসেজেও উদয় হলো।
‘হিরু চাচা! হিরু চাচা! হিরু চাচা!’ ডাকল কণ্ঠগুলো এবং সহসাই কিশোরের ভিন্ন-ভিন্ন রূপকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল সব ক’টা প্যাসেজে।
সুড়ঙ্গগুলো ভরে উঠল শ্যাডোর বিদ্রূপাত্মক হাসিতে।
হিরু চাচা গর্জে উঠল, ‘এসবে কাজ হবে না!’
.
কিশোর থমকে দাঁড়িয়ে পিছন দিকে চাইল।
‘হিরু চাচা এতক্ষণ ধরে কী করছে? আমাদেরকে তো অবশ্যই দেখেছে!’
ডায়ানা চারধারে চোখ বুলাচ্ছিলেন।
‘এখন মনে পড়েছে, সব ক’টা সুড়ঙ্গ এক হয়েছে, সামনে। এ পথে তাড়াতাড়ি এগোলে সোজা তার সাথে দেখা হবে।’
হিরু চাচা যেহেতু কিশোরকে হারিয়ে ফেলেছে, সে সিদ্ধান্ত নিল ডিসট্রেস সিগন্যাল ট্রেস করবে। পকেট থেকে অডিও-ট্রেসারটা বের করে রিডিংটা আবারও পরীক্ষা করল। দুই সাত পাঁচ…’ শশব্যস্তে পা চালাল, এবং নিজেকে উল্টো দিকে যেতে দেখে বিস্মিত হলো।
‘মাফ করবেন,’ বিনীত কণ্ঠে বলল হিরু চাচা, এবং এক পাশে সরে দাঁড়াল নিজেকে পথ করে দেয়ার জন্য।
ব্যাপারটা হঠাৎ উপলব্ধি করে পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল সে। কেউ নেই ওখানে।
হিরু চাচা মৃদু হেসে সবচাইতে কাছের মূর্তিটার উদ্দেশে বলল, —তুমি কী করছ দেখতে পাচ্ছি আমি…আমাদের সবাইকে ভাগ করে দিচ্ছ। বিভক্তি এবং শাসন, তাই না? প্রাচীন কৌশল।’
মূর্তিটা তার দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। হেসে উঠল হিরু চাচা। ‘তুমি নিশ্চয়ই ভাবনি ডায়ানা আমাকে ধোঁকা দিতে পেরেছে-কী বলো, শ্যাডো?’
শ্যাডোর গুহায়, এক দেয়াল পর্দায় দেখা যাচ্ছে হিরু চাচার মুখ। তার আমুদে কণ্ঠস্বর অন্ধকারাচ্ছন্ন চেম্বারটিতে প্রতিধ্বনি তুলছে।
‘ডায়না তোমার বশে আছে, তাই না? গলায় ছোট্ট একটা জিনিস পরিয়ে দিয়েছ। খুবই কাঁচা প্রযুক্তি।’
শ্যাডো খেঁকিয়ে উঠল।
.
সুড়ঙ্গে হিরু চাচা খোশমেজাজে মূর্তিটার মাথার সঙ্গে কথা বলে চলেছে, তার দৃঢ় বিশ্বাস ওটা তার সব কথা শ্যাডোকে ট্র্যান্সমিট করছে।
‘আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। কিশোরও সাহসী ছেলে। ওকেও ভয় দেখাতে পারবে না।’ মস্ত বড় এক মাকড়সা হিরু চাচার কাঁধের উপর পড়ল এবং সে সেটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে টোকা দিয়ে ফেলে দিল। ‘আমরা টাইম লর্ডদের বন্ধু, যিয়স আর অ্যাট্রিয়সের নিরীহ মানুষগুলোর মত নই। আমাদেরকে পাঠিয়েছে গার্ডিয়ান- সময়ের চাবি উদ্ধার করতে!’
হঠাৎই হিরু চাচা শ্যাডোকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
‘আমি জানি আপনি কে, ডক্টর। প্রথম থেকেই জানি। আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি।’
শ্যাডোর কণ্ঠ সুড়ঙ্গে প্রতিধ্বনি তুলছে, মনে হলো অ্যাস্টেরয়েডটা নিজেই যেন কথা বলছে।
‘আমিও একজন গার্ডিয়ানের সেবা করি, ডক্টর। তিনি আপনার গার্ডিয়ানের সমকক্ষ এবং প্রতিপক্ষ। ব্ল্যাক গার্ডিয়ান, যিনি আঁধারে চলাফেরা করেন।’ বিদ্রূপাত্মক অট্টহাসির গর্জন উঠল। ‘এবং আপনি, ডক্টর, ছায়ার উপত্যকায় রয়েছেন!’
শ্যাডো অদৃশ্য হয়ে গেল।
সে যেখানে ছিল সেখানে দৌড়ে গেল হিরু চাচা। আচমকা নিরেট পাথর পরিণত হলো ঘূর্ণিপাকে, গিলে নিল তাকে…
রোকু ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।
‘ডক্টর বন্দি হয়েছে-প্রভু।’
.
প্রিন্সেস ডায়ানা এক খিলানাকৃতি পাথুরে দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিলেন।
‘এসো, কিশোর। তুমি এখানে একদম নিরাপদ!’
কিশোর কামরাটিতে ঢুকতেই কালো হুড পরা বিশালদেহী এক নির্বাক আবছায়া থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল, এবং ওকে তুলে নিল দু’বাহুতে। পা ছুঁড়ছে, চেঁচাচ্ছে, কিশোরকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।
প্রিন্সেস ডায়ানা মুচকি হাসলেন।
.
হিরু চাচার জ্ঞান ফিরল কারাগারে। প্রাচীন ধাঁচের এক কারাগার ওটা; পাথুরে ব্লকে তৈরি দেয়াল, লোহার দরজা, উঁচু গরাদের জানালা…স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে শ্যাডো এধরনের ব্যাপারে বেশ প্রাচীনপন্থী।
বিচিত্র এক ছন্দময় ব্লিপিং শোনা যাচ্ছে…
হিরু চাচা হন্যে হয়ে কারাপ্রকোষ্ঠে ঘুরে বেড়াতে লাগল এবং এক কোণে একটা সাদামাঠা কালো বাক্স খুঁজে পেল। চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে ওটা নিরীখ করল সে।
একটা ঘর-ঘর শব্দ কানে এল তার। ভিতরদিকের দেয়াল তৈরি করেছে এমন এক পাথুরে ব্লক ধীরে-ধীরে সামনে সরছে। সরতে সরতে শেষমেশ সশব্দে খসে পড়ল মাটিতে। হিরু চাচা লাফিয়ে পিছু হটল, এবং অপেক্ষা করতে লাগল এরপর কী ঘটে দেখার জন্য।
ফোকর দিয়ে একটা মাথা উঁকি দিল। গোল মুখো, ছোট করে ছাঁটা চুলের এক করালদর্শন চেহারা। কথা বলল ওটা।
‘উল্লো, ডক্টর, কেমন আছ তুমি, বাছা?’
হিরু চাচা একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
‘কী?’ ক্ষীণ স্বরে বলল।
‘এটা ডক্টর, ইনিট? পুরানো থেটা সিগমা? অবশ্যই! আমাকে মনে পড়ে?’
সরু একজোড়া কাঁধ উদয় হলো মাথাটার পিছনে এবং ফাঁকটা গলে বেরিয়ে আসতে লাগল। বান মাছের মতন এঁকেবেঁকে নবাগত ধপ করে মেঝেতে লাফিয়ে পড়ল, তারপর তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। মলিন স্পেস-কভারল পরা ছোটখাট একটি মানুষ। হিরু চাচার দিকে খুশিয়াল চোখে চাইল।
‘আমাকে মনে পড়ে, ডক্টর? আমার নাম ফ্ল্যাশ। নাইন্টি-থ্রি ক্লাস। একসাথে টেকনিক্যাল কোর্স করেছিলাম। অনেক বছর আগের কথা।
‘ফ্ল্যাশ! আমরা একসাথে একাডেমিতে ছিলাম।’ বলে উঠল হিরু চাচা, মনে পড়েছে তার।
‘হ্যাঁ। ওরা আমাকে বের করে দেয়ার আগ পর্যন্ত। প্র্যাকটিকালে আমার কোনও সমস্যা ছিল না, গোল বাধে টেম্পোরাল থিয়োরি নিয়ে।’ দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ও। ‘তুমি অবশ্য যোগ্যতা দেখিয়ে ঠিকই ডক্টরেট পেয়েছ।’
‘তোমার কথা বলো,’ গলা খাঁকরে বলল হিরু চাচা।
‘আমি এই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড টাইম মেশিনটা কিনে সারিয়ে-টারিয়ে নিয়েছি। যেখানে খুশি যেতে পারি। কিছু যন্ত্রপাতি কিনি, জোড়া দিই, বিক্রি করি। সাইবারনেটিক্স, গাইডেন্স সিস্টেম, যা খুশি বলতে পারো।
‘আর্মস?’ বাতলে দিল হিরু চাচা।
‘তাও। তবে নিয়মিত না। এবং কম্পিউটার। কম্পিউটারে আমার ধারে-কাছে কেউ নেই।’
‘যিয়সে মেন্টালিস নামে এক কম্পিউটারের সাথে দেখা হয়েছে আমার। ওটা কি তোমার তৈরি?’
‘হ্যাঁ। কাজটা শেষ করার পরপরই দেখি আমি এখানে। শ্যাডো আমাকে কিডন্যাপ করেছে।’ কালো বাক্সটা দেখতে পেয়ে ছুটে গেল ফ্ল্যাশ। ‘ওটাকে এখানেই রেখে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কেউ বুঝি চুরি করে নিয়ে গেছে।’ বাক্সটা এক মুহূর্ত পরখ করে সুইচ অফ করল। ‘এমন না যে এটা আমার অনেক উপকার করেছে!’
‘তুমি জিনিসটা বানিয়েছ-এখানে?’
‘যন্ত্রপাতি ছাড়া কোথাও যাই না আমি।’
হিরু চাচা দেয়ালের ফোকরটার উদ্দেশে ভ্রূ উঁচাল।
‘ওখান দিয়ে কি বেরনো যাবে?’
ব্যথিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ফ্ল্যাশ।
‘না। গোটা এলাকা জুড়ে প্যাসেজ আর সুড়ঙ্গ আছে, কিন্তু কেন জানি ট্র্যান্সম্যাট শ্যাফটটা খুঁজে পাই না আমি। সমস্যা হচ্ছে, আমার টাইম মেশিন যিয়সে ফিরে গেছে।’
‘এই ফোকরটা তা হলে কোনদিকে গেছে?’
‘দেখো,’ আমন্ত্রণ জানাল ফ্ল্যাশ।
হিরু চাচা ফোকরটা গলে ঢুকে পড়ল এবং নিজেকে খুঁজে পেল ছেড়ে আসা কারাগারটির মত আরেকটিতে-ব্যতিক্রম শুধু এটিতে একটি পাথুরে ওয়র্কবেঞ্চ আর এক সেট যন্ত্রপাতি রয়েছে।
জটিল চেহারার বেশ কিছু জিনিস ছড়ানো বেঞ্চটার উপরে, এবং হিরু চাচা সেগুলো গভীর মনোযোগে পরখ করল।
‘এগুলো স্ট্যাবিলাইযার কম্পোনেন্ট না? আমি ভেবেছিলাম তোমার টাইম মেশিন যিয়সে।’
‘স্ট্যাবিলাইযারটা বের করে নিয়েছি। সামান্য কাজ করতে হবে।’ হিরু চাচা ওর দিকে কঠোর চোখে চাইল।
‘তুমি এখানে কতদিন ধরে আছ, ফ্ল্যাশ?’
‘ওহ, এই বছর খানেক হবে আরকী…’
‘পুরো সময়টাই তোমার কাছে ডাইমেনশনাল স্ট্যাবিলাইযার ছিল, তারপরও তুমি পালাওনি।’
‘বললাম না, এটার কাজ বাকি আছে।’
হেসে উঠল হিরু চাচা।
‘তুমি এটা ঠিকঠাক করে নিয়ে বহু আগেই পালাতে পারতে-যদি চাইতে!’ সন্দিহান দৃষ্টিতে ফ্ল্যাশের গলার দিকে চাইল সে।
‘ভাবছ আমি শ্যাডোর দলে আছি, তাই না?’ আহত গলায় প্রশ্ন করল ফ্ল্যাশ। ‘আমি এমন কাজ করতে পারি?’
‘হ্যাঁ, পারো! তুমি নিশ্চয়ই এখন বলবে, চলো পালাই-আমার টাইম মেশিনে করে?’
‘ওহ, দারুণ আইডিয়া,’ বলল ফ্ল্যাশ, তবে গলায় উৎসাহ ফুটল না।
‘তাই বটে,’ ব্যঙ্গ ঝরল হিরু চাচার কণ্ঠে। ‘তুমি আর আমি টাইম মেশিনের ভিতরে! তারপর কী? লিড পাইপ। আমার ওপর হামলা। এবং তুমি সময়ের চাবি নিয়ে পগার পার হবে, ঠিক কি না?’
ফ্ল্যাশ লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল।
‘শ্যাডো আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। বলেছে একমাত্র আমিই ওটা হাতাতে পারব।’
‘ধরলাম যদি হাতাতে পারও, তোমার কি ধারণা ও তোমাকে ছেড়ে দেবে? কল্লা তোমার ঠিকই যাবে।’
‘হ্যাঁ, তোমার কথাই মনে হয় ঠিক।
‘তা হলে আমাকে সাহায্য করছ না কেন? মানে সত্যিকারের সাহায্য। আমরা একসাথে থাকলে জোর বাড়বে।’ হিরু চাচা খাটো মানুষটির কাঁধ জড়িয়ে ধরল। ‘হাজার হলেও আমরা এক ক্লাসের ছাত্র। আমরা এক না হলে কে হবে?’
হিরু চাচা উজ্জ্বল হাসল ফ্ল্যাশের দিকে চেয়ে, এবং সে মাথা ঝাঁকাল, পাল্টা অনিশ্চিত মৃদু হাসি হাসল।
ওর কেন জানি মনে হচ্ছে ওকে বোকা বানানো হয়েছে….
বারো
হীরকাকৃতি খাঁচায় বন্দি কিশোরকে জেরা করছে শ্যাডো। সামান্য দ্বিধা কিংবা উপেক্ষা করলেই কপালে জুটছে তীব্র যাতনা।
শেষমেশ জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলো, এবং শ্যাডো ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে সরে গেল।
‘ও যা জানে সবই বলেছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। অভিশপ্ত ডক্টর এখনও আমার আর চাবিটার মাঝখানে বাধা হয়ে রয়ে গেছে!’ কিশোরের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল ও। ‘দেখা যাক, ডক্টর তোমার জীবনকে কতখানি দাম দেয়।’
শিকের উপর এলিয়ে পড়েছে কিশোর, কিন্তু এখনও মনোবল হারায়নি।
‘হিরু চাচা আপনাকে কখনওই চাবিটা দেবে না। আমি মরতে ভয় পাই না।’
শ্যাডো ওকে পাত্তা দিল না।
‘রোকু, ডক্টরের কাছে যা। তুই জানিস তাকে কী বলতে হবে।’
‘জি, প্ৰভু।’
তরতর করে চলে গেল রোকু।
.
ফ্ল্যাশ তার বেঞ্চে ব্যস্ত, তার স্ট্যাবিলাইযারটা মেরামত করছে, নতুন করে জুড়ছে।
‘এতে কাজ হবে সত্যিই মনে করো? স্ট্যাবিলাইযার-গান?’
‘না হওয়ার কারণ দেখি না।’ হিরু চাচা দু’মুহূর্ত ওর কাজ দেখল। ‘সিন্যাপটিক অ্যাডহেশন ট্রাই করো।’
‘না, না। এটা ক্রোনোস্ট্যাট, সব সময়ই। আমি এধরনের কাজ হাজারটা করেছি, ডক্টর। হাজারটা!’
‘আমি বলছি সিন্যাপটিক অ্যাডহেশন।
ফ্ল্যাশ তার দিকে কঠোর চোখে চেয়ে যন্ত্রপাতি নামিয়ে রাখল। হিরু চাচা সঙ্গে-সঙ্গে বলল, ‘আচ্ছা, যাও, তোমার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি।’
‘সেটাই ভাল।’
অপর দেয়ালের এক ফোকর দিয়ে উঁকি দিল হিরু চাচা।
‘এটা কোথায় গেছে?’
‘আপার লেভেল। বোবাদের দেখা পাবে।’
হিরু চাচা হাঁচড়ে-পাঁচড়ে গর্তটা দিয়ে ঢুকে পড়ল এবং নিজেকে খুঁজে পেল লম্বা, সরু এক সুড়ঙ্গে। হাঁটু আর কনুইতে ভর দিয়ে এঁকেবেঁকে সামনে এগোল সে এবং খানিক পরে শেষ প্রান্তে অস্পষ্ট একটা আলোর দেখা পেল। হঠাৎই পরিচিত এক কণ্ঠ শুনতে পেল।
‘আপনাকে স্ক্যান করছি, ডক্টর। এ পথে চলতে থাকুন।’
‘ওটা রোকু,’ বিস্মিত হিরু চাচা ভাবল। ‘ও আগে কখনও আমাকে ডক্টর বলে ডাকেনি।’
সে কিলবিল করে এগিয়ে চলল যতক্ষণ না লোহার এক গ্রিলের কাছে পৌঁছল। ওটা এক পাশে সরাল হিরু চাচা, এবং দেখতে পেল এক সুড়ঙ্গের গ্রাউণ্ড লেভেলে ওটা সেট করা।
মাথা বের করে দিতেই রোকুর নাকে নাক ঠেকার দশা হলো হিরু চাচার।
‘ডক্টর!’
‘বল, বন্ধু!’ ব্যথিত গলায় বলল হিরু চাচা। এই নিচু লেভেল থেকে রোকুর গলার কালো সিলিণ্ডারটা সহজেই চোখে পড়ছে।
‘আপনার জন্যে একটা খবর আছে।
‘শুনতে পাচ্ছি না, কাছে আয়।’
রোকু কাছিয়ে এল, এবং হিরু চাচা থাবা মারল সিলিণ্ডারটা লক্ষ্য করে। রোকু তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ঝট করে পিছু হটল।
‘এধরনের কাজের শাস্তি তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড।’
‘ওহ, রোকু, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল হিরু চাচা।
‘আপনার খবরটা বলছি শুনুন। কিশোর আমার প্রভুর জিম্মায়। সময়ের চাবির বিনিময়ে আপনি তার জীবন বাঁচাতে পারেন।’ বিরতি নিল রোকু। ‘খবর শেষ। জবাব দিন, প্লিজ। অপেক্ষা করছি।’
‘ওকে বলিস আমি ভেবে দেখব,’ বলল হিরু চাচা, এবং সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল।
এবার সটান সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে কাপড়-চোপড় থেকে ধুলো ঝাড়ল।
‘চল রে, রোকু, যাওয়া যাক!’
রোকু আগে-আগে যাবে বলে যেই ঘুরেছে, হিরু চাচা এক লাফে ওকে টপকে গেল, পাঁই করে ঘুরিয়ে দিয়ে গর্তটা দিয়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল।
‘সরি, রোকু!’
শুনতে পেল খাড়া সুড়ঙ্গ দিয়ে ঝনঝন শব্দ তুলে পড়ে যাচ্ছে রোকু। মুহূর্তের নীরবতা, তারপর প্রচণ্ড ধাতব সংঘর্ষের আওয়াজ। হিরু চাচা বেদনাহত ভঙ্গিতে পিছিয়ে এসে হাঁক ছাড়ল, ‘তুমি নীচে ঠিক আছ তো, ফ্ল্যাশ?’
মুহূর্ত পরে এক হতচকিত কণ্ঠ ভেসে এল উপরে।
‘হ্যাঁ, তুমি? এটা কী জঞ্জাল ফেললে আমার ওপর?’
‘আমার কম্পিউটার। শোনো, ফ্ল্যাশ, ওর চিবুকের নীচ থেকে
কন্ট্রোল ডিভাইসটা খুলে নাও, বুঝতে পেরেছ?’
সামান্য বিরতির পর ফ্ল্যাশের গলা শোনা গেল আবার।
‘খুলেছি, ডক্টর। এখন কী করব?’
‘আমাদের ছোট্ট প্রজেক্টটা চালু রাখো। আমি শীঘ্রি ফিরব-আশা করি!’
ওয়র্কশপে ফ্ল্যাশ রোকুর দিকে চোখ নামিয়ে চাইল, জঞ্জালের স্তূপের উপর চিত হয়ে পড়ে রাগে গরগর করছে ও।
‘মনোযোগ দিন। আমাকে খাড়া করা জরুরি।’
‘আমি ব্যস্ত।’
রোকুর নাকের নীচ থেকে ব্লাস্টার বেরিয়ে এল। ‘আমাকে সোজা করুন।’
‘করছি, করছি,’ বলল ফ্ল্যাশ। রোকুকে জঞ্জালের গাদা থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। ‘হয়েছে এবার?’
‘হ্যাঁ।’ রোকু ছোটাছুটি শুরু করল। ‘ড্রাইভ সার্কিটগুলো রি- স্ট্যাবিলাইয হচ্ছে।’
ফ্ল্যাশ অবাক চোখে চেয়ে রইল।
‘আরি, এটা দেখি কুকুর! কে এই টিমের কুকুরটা?’
রোকু ওকে উপেক্ষা করল।
ফ্ল্যাশ তার কাজ করে চলল, স্ট্যাবিলাইয়ারটাকে রি-অ্যাসেম্বল করে এক বন্দুক-আকৃতির যন্ত্রে রূপ দিচ্ছে। চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে ওটার দিকে চাইল।
‘বুঝি না, এটা সব সময়ই ক্রোনোস্ট্যাট।’
রোকু যন্ত্রটা জরিপ করল।
‘দোষটা সিন্যাপটিক অ্যাডহেশনের প্রশ্ন।’
গুঙিয়ে উঠল ফ্ল্যাশ।
‘তুই আবার জ্ঞান দিতে শুরু করিস না, বাপ!’
.
হিরু চাচা সুড়ঙ্গগুলো ধরে সতর্কতার সঙ্গে চলছিল, এসময় আঁধার ফুঁড়ে বিশাল এক নির্বাক তার সামনে উদয় হলো। প্রকাণ্ড এক হাতে ব্লাস্টার ধরা, অপর হাতে হিরু চাচাকে হাতছানি দিয়ে সামনে ডাকল।
হিরু চাচা অগত্যা আদেশ পালন করল। সে জানে, শ্যাডোর হাত থেকে রক্ষা নেই, অন্তত এই শয়তানের গ্রহে। গোটা এলাকাটা একমাত্র শ্যাডোর ইচ্ছার অধীন।
নির্বাক মূর্তিটা হিরু চাচাকে শ্যাডোর বিশাল গুহাটায় নিয়ে গেল। হীরকাকৃতি খাঁচাটা গুহার মাঝখানে। কিশোর তখনও ভিতরে বন্দি।
প্রিন্সেস ডায়ানা খাঁচার কাছেই দাঁড়িয়ে, তাঁর মুখের চেহারা নিষ্প্রাণ, এবং শ্যাডো তার কালো সিংহাসনে বসা।
‘আপনি আমাকে সময়ের চাবিটা দেবেন, ডক্টর। নাকি আপনি আপনার ভাতিজার কষ্ট দেখতে চান?’
শ্যাডো হাত নাড়ল। খাঁচাটা ঘিরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠতেই কিশোর যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠল।
‘থামুন!’ গর্জে উঠল হিরু চাচা। ‘হুমকির মুখে কোনও সমঝোতায় রাজি নই আমি।’
অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থামল, এবং কিশোর এলিয়ে পড়ল শিকের ওপর। ‘ওকে ওটা দিয়ো না, হিরু চাচা। আমার যা হয় হোক, কিছু যায়- আসে না।’
‘যায়-আসে, ভাতিজা,’ মৃদু গলায় বলল হিরু চাচা। শ্যাডোর দিকে চাইল। ‘ছ’নম্বর টুকরোটা এখানে আছে, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি ওটা দেখতে চাই, যদি সম্ভব হয়।’
‘আপনি ওটা ইতোমধ্যেই দেখে ফেলেছেন, ডক্টর, ব্যঙ্গ করে বলল শ্যাডো।
‘ওহ!’ ক্লান্ত ভঙ্গিতে কপাল ডলল হিরু চাচা। ‘আচ্ছা, বলুন তো, আমি যদি পাঁচটা টুকরো আপনাকে দিই, যখন ছ’টাই আপনার হাতে এসে যাবে তখন কী করবেন আপনি? বলতে চাইছি, আপনি নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন যিয়স আর অ্যাট্রিয়সের ধ্বংস ঠেকাতে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি আমি?’
‘আপনার ফালতু সময়ের ফাঁদ?’ বিদ্রূপ ঝরল শ্যাডোর কণ্ঠে
আপনার কাছে ফালতু হতে পারে, কিন্তু ওতে কাজ হচ্ছে। আপনি ওটাকে আপসেট করলে লাখ-লাখ মানুষ মারা পড়বে।’
‘সেটাই সব সময় আমাদের ইচ্ছা ছিল, ডক্টর। এই ছোট্ট যুদ্ধটা আমাদের মহান নকশার একটা রিহার্সাল।’
‘আমাদের নকশা?’
‘আমার অভিভাবক আছেন, ডক্টর,’ সগর্বে বলল শ্যাডো, ‘আপনার যেমন আছে। আপনি আর আমি একই জিনিস খুঁজছি। কিন্তু আপনি যখন স্পেস আর টাইমে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আমি তখন ছ’নম্বর টুকরোটা এখানে খুঁজে পেয়ে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। আমি জানি আপনি বাকি টুকরোগুলো আমাকে ঠিক এনে দেবেন।’ সশব্দে হেসে উঠল শ্যাডো। ‘সময়ের চাবি পেয়ে গেলে আমরা মাত্র দুটো গ্রহ নয়, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যুদ্ধ বাধিয়ে দেব। ধ্বংসের শব্দ আমাদের কানে মধুর বাজনা হয়ে বাজবে। অন্যদের মত আমরা ক্ষমতা চাইব না। ধ্বংসেই আমাদের তৃপ্তি! বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আবারও শাসন করবে গোলযোগ।’ শ্যাডো বিরতি নিল, শ্বাস নিতে। ‘এখন চাবিটা এনে দিন, ডক্টর!’
‘ভাল কথা। তার আগে কিশোরকে খাঁচা থেকে মুক্তি দিতে হবে।’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একটা হাত নাড়ল শ্যাডো, এবং খাঁচার দরজাটা হাট হয়ে খুলে গেল।
‘দিলাম, ডক্টর। এবার?’
হিরু চাচা মাথা নোয়াল, এবং বিশালদেহী নির্বাক মূর্তিটি তাকে নিয়ে চলে গেল।
.
ফ্ল্যাশ সিধে হলো, পিঠ ঘষছে।
‘তুইই ঠিক বলেছিলি, টিনের কুকুর। সিন্যাপটিক অ্যাডহেশনই ছিল ওটা!’ যন্ত্রটার সুইচ অন করল, শক্তির গুঞ্জন তুলল ওটা। ‘কাজ হচ্ছে। আমি বরং গিয়ে ডক্টরকে খুঁজে বের করিগে, কী বলিস?’
‘হ্যাঁ! আমি এখানে অপেক্ষা করব।’
.
কিশোর শ্যাডোকে ডায়ানার দিকে হেঁটে যেতে দেখল। থাবাসদৃশ একটি হাত তাঁর গলা থেকে কন্ট্রোল-সিলিণ্ডারটা তুলে আনল।
‘প্রিন্সেস আমার, আপনার কাজ প্রায় শেষ। আপনার ভাগ্য আমার হাতে।’
ঘোরমুক্ত প্রিন্সেস ডায়ানা কঙ্কাল-মুখো শ্যাডোকে দেখে আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলেন।
‘কে আপনি?’
শ্যাডো যেন অহঙ্কারে বাড়তে-বাড়তে গোটা গুহা ভরিয়ে তুলল।
‘আমি ছায়া। যে ছায়া সবার সঙ্গে থাকে!’
.
সুড়ঙ্গের মাথায়, থমকে দাঁড়াল ফ্ল্যাশ। আগুয়ান পদশব্দ পেয়েছে। হিরু চাচা তাকে পাশ কাটাল, অতিকায় নির্বাকটি তাকে অনুসরণ করছে। আগেই লুকিয়ে পড়েছিল ফ্ল্যাশ।
এবার গর্ত থেকে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে বেরিয়ে এসে হিরু চাচা ও নির্বাকটির পিছু নিল পা টিপে-টিপে। দু’বাহুতে বইছে স্ট্যাবিলাইযার- গানটা।
.
টাইম মেশিনের দরজায় থমকে দাঁড়াল হিরু চাচা। চোখ তুলে নির্বাক দানবটার কঙ্কাল-মুখো চেহারার দিকে চাইল।
‘বুঝলে, শ্যাডোকে সময়ের চাবি দিয়ে দিলে সে আমাকে মেরে ফেলবে,’ আলাপচারিতার ঢঙে বলল হিরু চাচা। ‘তোমাকেও খুন করবে, এবং হয়তো তোমার অন্যান্য সঙ্গী সাথীদেরও। তোমাদেরকে তখন আর দরকার পড়বে না, ঠিক না?’
নির্বাকের মুখে কথা ফুটল না।
দানব প্রাণীটার কাঁধের উপর দিয়ে লক্ষ করল হিরু চাচা, ফ্ল্যাশ এক কোনা থেকে উঁকি দিচ্ছে।
‘তোমাদের হয়তো তাতে কিছু যায় আসে না,’ কথার খেই ধরল হিরু চাচা। ‘তোমরা আসলে হয়তো জ্যান্ত প্রাণীই নও!’
ফ্ল্যাশ কাছিয়ে এল সন্তর্পণে।
দানবটা হিরু চাচাকে টাইম মেশিনের দরজার কাছে যেতে বাধ্য করল, এবং ব্লাস্টার দিয়ে ইশারা করল।
চাবি হাতড়াচ্ছে হিরু চাচা, এবং একটু পরে টাইম মেশিনের দরজাটা খুলল। ফ্ল্যাশ এখন খুব কাছে, চাইলেই স্বচ্ছন্দে দানবটাকে গুলি করতে পারে। গুলি করছে না কেন ও?
হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল ফ্ল্যাশ, ‘দাঁড়াও, ডক্টর, আমি এসে পড়েছি!’ লাফিয়ে সামনে এগোল সে, স্ট্যাবিলাইযার-গানটা তুলল এবং গুলি করল-সোজা হিরু চাচাকে লক্ষ্য করে।
তেরো
আলোর বন্যায় ভেসে গেল হিরু চাচার দেহ। ছোট হয়ে গেল সে, ছোট, আরও ছোট…শেষমেশ অদৃশ্য হয়ে গেল।
… চোখের পলকে ফ্ল্যাশ স্ট্যাবিলাইযার-গানটা ঘুরিয়ে নিজেকে লক্ষ্য করে ফায়ার করল। সে নিজেও সঙ্কুচিত হয়ে, ছোট হতে-হতে অবশেষে উধাও হয়ে গেল।
হতভম্ব নির্বাক দানবটি চোখ নামিয়ে চেয়ে দুটো খুদে অবয়বকে মেঝের উপর দিয়ে দৌড়ে পালাতে দেখল। বুট তুলল ও…
হিরু চাচা আবিষ্কার করল সে যে মেঝের উপর দিয়ে দৌড়চ্ছে সেটি হঠাৎই এক অন্তহীন পাথুরে সমতলে পরিণত হয়েছে। অতিকায় এক কালো আকৃতি নেমে আসছে তাকে পিষে ভর্তা করতে…হিরু চাচা গোত্তা খেয়ে সরে যেতেই জুতোটা সশব্দে আছড়ে পড়ল পাথুরে মেঝেতে।
হিরু চাচা ছুটে চলল। একটা কণ্ঠস্বর কানে এল তার, ‘ডক্টর! ডক্টর, এদিকে!’
এবড়োখেবড়ো এক আর্চওয়ে থেকে হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছে ফ্ল্যাশ-আসলে, হিরু চাচা উপলব্ধি করল, দেয়ালের এক ছোট্ট ফাটল থেকে।
সে দৌড়ে গেল ফ্ল্যাশের দিকে। আচমকা কানে তালা লাগানো এক বিস্ফোরণের শব্দ এবং এক ঝলক তপ্ত হাওয়া ভেসে এল। হিরু চাচা চোখ তুলে চাইল ক্রুদ্ধ দানবটির দিকে, এবং টের পেল নির্বাকটি ব্লাস্টার দিয়ে তাকে গুলি করছে। বিস্ফোরণ এড়িয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে, ফাটলটার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে এবং ফ্ল্যাশের পাশে নেতিয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল।
‘তুমি ভুল মানুষকে ছোট করেছ,’ শ্বাসের ফাঁকে বলল হিরু চাচা। ‘দানোটাকে ছোট করা উচিত ছিল।’
কপাল চাপড়াল ফ্ল্যাশ। ‘একবারও মাথায় আসেনি।’
‘আসা উচিত ছিল-ওহ, না!’
‘কী হলো, ডক্টর?’
‘আমি এরচেয়েও বড় বোকামি করেছি-টাইম মেশিনের দরজা খুলে রেখেছি!’
‘চিন্তা কোরো না, বন্ধু। আমি বাইরে বেরিয়ে ওর দৃষ্টি সরিয়ে নেব, সেই ফাঁকে তুমি দরজাটা লাগিয়ে দিয়ো।’
‘এই সাইয নিয়ে?’
‘বুঝতে পেরেছি তুমি কী বলতে চাইছ।’ খুদে স্ট্যাবিলাইযার- গানটা খুঁটিয়ে পরখ করল ফ্ল্যাশ। ‘আমরা এই অবস্থায় বাইরে বেরোতে পারব না, কারণ ও আমাদের পিষে মারবে আবার এখানেও আমরা স্বাভাবিক আকারে ফিরতে পারছি না, কেননা এখানে জায়গা নেই, ফাটল দিয়ে বেরোতে পারব না।’
হিরু চাচা মাথা ঝাঁকাল।
‘হুঁ।’
‘সমস্যা।’
‘হ্যাঁ,’ সায় জানাল হিরু চাচা। এক-এক করে ওগুলো নিয়ে মাথা ঘামাল সে। ‘টাইম মেশিনের দরজা খোলা, কাজেই শ্যাডো সোজা ভিতরে ঢুকে সময়ের চাবির টুকরোগুলো নিয়ে নিতে পারবে। সময়ের ফাঁদটাও এখন মনে হয় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে-কাউণ্টডাউন যিরোতে পৌছলে অ্যাট্রিয়স, যিয়সসহ সব উড়ে যাবে।’
‘হতাশাজনক অবস্থা।’
‘হ্যাঁ, তারপর মার্শাল আছে।’
‘সে কি আমাদের পক্ষে?’
‘না, সে-ও সময়ের ফাঁদে আটকা পড়েছে, যিয়সে রকেট হামলা করতে চেষ্টা করছে।’ হিরু চাচা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘আমি শুধু চাই হার্ভে আর ডিলাক যেন অ্যাট্রিয়সে ফিরে যেতে পারেন…’
.
ওয়ার রূমে কেউ নেই-এটাই স্বাভাবিক, কারণ যুদ্ধটার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানা হয়েছে, হার্ভে সব টেকনিশিয়ানকে বিদায় করে দিয়েছেন, এবং এখন তিনি আর ডিলাক একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছেন কমিউনিকেশন্স কনসোলের পাশে। তাঁদেরকে দেখে মনে হচ্ছে একজোড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত সৈনিক। ডিলাকের মাথায় ব্যাণ্ডেজ, লাঠিতে ভর দিয়ে আছেন, ওদিকে হার্ভের বাঁ হাত স্লিঙে ঝুলছে।
কমিউনিকেটরে কথা বলছেন তিনি।
‘অ্যাট্রিয়ান কন্ট্রোল থেকে মার্শালের প্রতি। আসুন, মার্শাল…’ কোনও জবাব নেই। ‘খামোকা। হয় তিনি সাড়া দেবেন না নয়তো দিতে পারছেন না। আর এই সময়ের ফাঁদটা তাঁকে চিরদিনের জন্যে আটকে রাখবে না, তাই না?’
ডিলাক মাথা ঝাঁকালেন।
‘শেষ পর্যন্ত ওটা টানটান হয়ে ছিঁড়ে যাবে-যদি না ডক্টর ছ’নম্বর টুকরোটা হাত করতে পারেন-যেটি কোনও না কোনওভাবে প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে জড়িত।’
‘কিন্তু তিনি তো বলছেন ও ব্যাপারে কিছুই জানেন না।’
‘সচেতনভাবে জানেন না এটা ঠিক। কিন্তু অবচেতনে জেনে থাকতে পারেন, হয়তো কোনওভাবে জ্ঞানটা ইমপ্ল্যান্ট করা আছে, হয়তো পর্যালোচনা করলে বেরিয়ে আসবে।’
‘প্রিন্সেস তো এখানে নেই,’ নির্দেশ করলেন হার্ভে।
‘না-তিনি শ্যাডোর ক্ষমতাধীন। তাঁর সমস্ত মেডিকেল রেকর্ড কম্পিউটারে জমা আছে!’ লাঠিতে ভর দিয়ে মেইন কম্পিউটার টার্মিনালের কাছে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলে এলেন ডিলাক, এবং ডাটা পাঞ্চ করতে লাগলেন।
হার্ভে আবারও মার্শালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করলেন। বেশ খানিকক্ষণ পরে, ডিলাক তাঁর কাছে ফিরে এলেন। মুখ তুলে চাইলেন হার্ভে।
‘কিছু খুঁজে পেলেন?’
‘কিচ্ছু না। সম্ভাব্য সব কিছু চেক করেছি। বিহেভরিয়াল, ফিজিকাল, সাইকোলজিকাল। কিছুই জানা গেল না। ডায়ানা আর সবার মত একইরকম।’
‘পার্থক্য এটাই যে তিনি রাজপরিবারের সন্তান!?’ ঠাট্টা করে বললেন হার্ভে।
‘কী বললেন?’
‘ডায়ানা আর সবার মত একইরকম।’
‘পার্থক্য এটাই যে তিনি রাজপরিবারের সন্তান!’ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে ডিলাকের চোখজোড়া। ‘ওটা আমাদের মুখের দিকে চেয়ে আছে!’
‘কী?’
‘সবচেয়ে পরিষ্কার পার্থক্যটা। ডায়ানা অ্যাট্রিয়সের রয়্যাল হাউসের সন্তান।’ ডিলাক কম্পিউটার টার্মিনালটিতে শশব্যস্তে ফিরে গেলেন। ‘আমি জেনেটিক টেস্টের একটা সিরিজ চালু করতে যাচ্ছি। আমরা যা কল্পনা করেছি ডায়ানা হয়তো তারচাইতেও আলাদা।’
ডিলাকের উত্তেজনা সংক্রমিত হলো হার্ভের মধ্যেও। তিনি তাঁকে অনুসরণ করে কম্পিউটারের কাছে চলে এলেন। ডিলাক রিডআউট স্ক্রীনে ডাটা পাঞ্চ করছেন, আর হার্ভে চেয়ে-চেয়ে দেখছেন। তাঁর মনে হচ্ছে দীর্ঘকাল কেটে গেছে যেন। গভীর মনোযোগে প্রতীকগুলোর প্রবাহ লক্ষ করছেন তিনি। শেষমেশ ডিলাক কম্পিউটারটাকে প্রিন্ট আউটে নিয়ে গেলেন, এবং কাগজের তাড়া পরখ করলেন, মুখের চেহারা গম্ভীর তাঁর।
‘হ্যাঁ…যা আশঙ্কা করেছিলাম।’
‘কী?’
‘হাউস অভ অ্যাট্রিয়সের কাঠামোয় একটা আণবিক অনিয়ম লুকিয়ে আছে, যেটা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ট্র্যান্সমিট হয়েছে, এবং এখন শেষ পর্যন্ত ডায়ানার মধ্যে বর্তেছে।’
হার্ভে তাঁর দিকে চরম হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চাইলেন।
‘এসবের মানে কী?’
‘এর মানে ডায়ানা নিজে, তার প্রতিটি জীবন্ত কোষ সময়ের চাবির অংশ। ডায়ানাকে ধ্বংস করতে হবে, সবাইকে রক্ষা করার জন্য!’ চোখ ছলছল করছে ডিলাকের।
‘কেন এমন হলো, হার্ভে? কেন এমন হলো?’ তাঁর গলা ভেঙে গেল এবং তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
.
ফ্ল্যাশ ফাটল থেকে উঁকি মারল, এবং সাঁত করে মাথা টেনে নিল, কেননা পেল্লায় এক বুট জুতো তার মাথা পিষে দেয়ার জন্য নেমে এসেছিল। দানবটা এখনও করিডরে টহল দিচ্ছে।
‘ডক্টর, একটা জিনিস এখনও আমাদের পক্ষে রয়েছে।’
হিরু চাচা তার দিকে বিস্ময়ের চোখে চাইল।
‘তাই?’
‘চলাফেরার সুযোগ। এই সাইযে থাকার অর্থ আমরা প্রায় অদৃশ্য। তবে এখান থেকে বেরনো যাচ্ছে না।’
হিরু চাচা তখনও পরিকল্পনা ছকছে।
শ্যাডো যদি পাঁচটা টুকরো পেয়ে যায়, সন্দেহ নেই পাবে, সেক্ষেত্রে আমাদের কাজ হবে ছ’নম্বর টুকরোটা দখল করা!’
‘তুমি তো এমনকী এটাও জানো না জিনিসটা দেখতে কেমন,’ তর্কের সুরে বলল ফ্ল্যাশ। ‘সামনে কোনও পথ খোলা নেই। সব শেষ।’
হিরু চাচা গভীর ভাবনায় মগ্ন।
‘শ্যাডো বলেছে আমি নাকি এর মধ্যেই ওটা দেখেছি। ওটার সাথে ডায়ানার কিছু একটা সম্পর্ক আছে…এসো, দেখা যাক ফাটলের অন্য প্রান্ত কোথায় গেছে।’
মাথা ঝাঁকাল ফ্ল্যাশ।
‘বেশ। এখানে বসে থেকে বুটের তলায় পিষে মরার চেয়ে সে-ই ভাল।’
.
শ্যাডোর গুহার স্ক্রীনে টাইম মেশিনের ক্লোজ-আপ দেখাচ্ছে।
শ্যাডো কিশোরের দিক থেকে ডায়ানার দিকে বিজয়ীর সন্তুষ্টি নিয়ে চাইল।
‘দেখলে? তোমার হিরু চাচা আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে-কিন্তু সে তার শেষ ভুলটা করেছে। টাইম মেশিনের দরজা খোলা, সময়ের চাবি এখন আমার!’
উত্তেজনার বশে বন্দিদের কথা ভুলে গিয়ে শশব্যস্তে চলে গেল শ্যাডো। কিশোর কঠোর গলায় বলল, ‘ও যদি ভেবে থাকে আমরা হাল ছেড়ে দেব…ডায়ানা, আমাদেরকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।’
‘আমার নিয়তি এখানে, এই ঘরে। অ্যাট্রিয়সে নয়, যিয়সেও নয়, এখানে।’
কিশোর মেয়েটির দু’কাঁধ চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিল।
‘শ্যাডোর কথা ভুলে যান, আপনি এখন ওর নিয়ন্ত্রণমুক্ত। আমাদেরকে পালাতে হবে।’
‘না, আমি এখানেই থাকব। আমি অ্যাট্রিয়সের রাজবাড়ির ষষ্ঠ রাজবংশের ষষ্ঠ রাজকুমারী।’
‘দারুণ ব্যাপার, কোনও সন্দেহ নেই,’ শাণিত কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘তারপরও চলুন, আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাই, শ্যাডো ফিরে আসার আগেই।’
ডায়ানা মাথা নাড়লেন।
‘এটা আমার হয়ে-ওঠার সময়…এখন আমার সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার পালা।’
‘আপনি কীসের কথা বলছেন?’
ভুতুড়ে হাসি ফুটে উঠল প্রিন্সেসের ঠোঁটের কোণে।
‘রূপান্তর।’
‘কী বলছেন এসব-রূপান্তর!’
‘আমার নিয়তি এখানে!’
সহসা কিশোর ভয়ঙ্কর সত্যটা উপলব্ধি করল। ‘অ্যাট্রিয়সের রাজবাড়ির ষষ্ঠ রাজবংশের ষষ্ঠ রাজকুমারী! প্রিন্সেস ডায়ানা, আমার কথা শুনুন, আমাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। না গেলে শেষমেশ শ্যাডোরই জয় হবে!’
অনিচ্ছুক ডায়ানাকে কামরা থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করল ও-এবং দেখতে পেল ব্লাস্টার হাতে বোবা প্রহরীরা দরজা পাহারা দিচ্ছে।
.
দূর প্রান্তের ফাটলটা আরেকটি করিডরে মিশেছে। ফ্ল্যাশ তার জিনিসপত্র নিয়ে কোনা ঘুরে উঁকি দিল, তারপর পকেট থেকে একটা দোমড়ানো ম্যাপ বের করল।
‘আমরা এখন এখানে। সামনে ‘টি’ জংশন। ডানে গেলে জেলখানা, বাঁয়ে শ্যাডোর গুহায় যাওয়ার সুড়ঙ্গ-কিংবা আগামীতে হবে, আমি কাজটা শেষ করার পর। এখনও কয়েক ফুট যেতে হবে।’
‘তার মানে শ্যাডোর গুহায় যাওয়ার এই রাস্তাটার কথা ও জানে না?’
‘আগে সুড়ঙ্গের কাজটা শেষ করি,’ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল ফ্ল্যাশ। ‘তারপর জানবে। কিন্তু আমাদের মত দুটো বামন গাঁইতি-বেলচা দিয়ে কতটুকু কীই-বা করতে পারবে?’
‘আমরা রোকুর সাহায্য পেলে গাঁইতি-বেলচা লাগবে না। আমরা হয়তো শ্যাডোকে চমকে দিতে পারব।’
ফ্ল্যাশ স্ট্যাবিলাইযার-গানটায় মৃদু চাপড় দিল।
‘তা হলে স্বাভাবিক সাইযে ফেরত যাব?’
‘এখনই নয়। এমুহূর্তে ছোটই ভাল।’
‘হয়তো তাই, কিন্তু বড় হলে আরও ভাল হয়, তাই না?’
.
পিছনে অন্ধকারের মেঘ নিয়ে করিডরগুলো ধরে হাঁটছে শ্যাডো। শেষমেশ টাইম মেশিন রয়েছে যে কামরাটিতে সেখানে পৌছল। হতভম্ব নির্বাকটা তখনও দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।
‘শেষ পর্যন্ত, শ্বাস টেনে বলল শ্যাডো। ‘অপেক্ষার প্রহর ফুরাল! দরজা খোলো!’
দানবটা টাইম মেশিনের দরজা হাট করে খুলে দিল। করিডর ভেসে গেল আলোর বন্যায়। শ্যাডো কুঁকড়ে পিছু হটল, আলখিল্লায় কঙ্কাল-মুখ ঢাকল।
‘অতিরিক্ত আলো….’ ককিয়ে উঠল। সামনে এগোতে চেষ্টা করল, অনেকটা তীব্র স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানোর মত, কিন্তু টাইম মেশিন থেকে আসা রেডিয়েন্স ওর সহ্য হলো না।
শ্যাডো পিছিয়ে গেল এবং হাড়সর্বস্ব একটা হাত নির্দেশ করল নির্বাকটির দিকে।
‘এই যে, তুমি! ভেতরে গিয়ে চাবিটা এনে দাও। জলদি!’
দানবটা প্রায় লাফিয়ে ঢুকে পড়ল টাইম মেশিনের ভিতরে। অধৈর্য শ্যাডো অপেক্ষা করছে।
‘চাবিটা আমার হাতে এলে, সব আলো দূর করে দেব। শুধু আঁধার আর রাত্রি রাজত্ব করবে!’
দানবটা টাইম মেশিন থেকে আংশিক জোড়া দেয়া সময়ের চাবিটা হাতে করে বেরিয়ে এল।
খুশিতে চিৎকার ছেড়ে শ্যাডো ওটা ছিনিয়ে নিল দানবের হাত থেকে এবং হনহন করে তার গুহার দিকে রওনা হলো।
.
রোকু ধৈর্য ধরে ফ্ল্যাশের ওয়র্কশপের মেঝেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, খুদে হিরু চাচার উপর অতিকায় এক মূর্তির মত দেখাচ্ছে ওকে। ওর বাইরের কেসিঙের এক পার্শ্ব প্যানেল খোলা।
হিরু চাচা ওর দিকে চোখ তুলে চাইল।
‘সব ঠিক আছে, রোকু?’
‘হ্যাঁ।’
‘মনে রাখিস, শ্যাডো যেন মনে করে তুই এখনও ওর বশে আছিস। ব্যাপারটা জরুরি। সেজন্যেই আমরা কন্ট্রোল সিলিণ্ডার অকেজো করে দিয়েছি। শ্যাডোর সামনে একদম স্বাভাবিক থাকবি, ঠিক আছে?’
‘আমি রিপোর্ট করব: ডক্টর এবং ফ্ল্যাশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’
‘চমৎকার। এখন যাওয়ার আগে ব্লাস্টারটা টেস্ট করে নে।’
রোকু ব্লাস্টারের নয্ল বের করল।
‘পরীক্ষা করছি!’ ও ফায়ার করল এবং দেয়াল থেকে পাথরের এক চাঁই খসে পড়ল।
পিচ্চি ফ্ল্যাশ চেঁচিয়ে উঠল, ইতোমধ্যেই রোকুর ভিতরে ঢুকে পড়েছে সে।
‘তুমি ঠিক আছ তো?’ হেঁকে বলল হিরু চাচা।
‘মোটামুটি। যেটার উপর বসে আছি সেটা তেতে উঠছে!’
‘তা হলে অন্য কোথাও বসো। রেডি, রোকু?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা! এগো তবে, রোকু! রওনা দে!’ হিরু চাচা রোকুর ভিতরে প্রবেশ করল এবং প্যানেলটা বন্ধ হয়ে গেল।
হিরু চাচা রোকুর দেহের অভ্যন্তরে আঁধার হাতড়ে ফ্ল্যাশের পাশে এক সার্কিট কেসিঙে বসে পড়ল।
‘দুর্দান্ত আইডিয়া তোমার, ডক্টর,’ ফিসফিস করে বলল ফ্ল্যাশ।
স্মিত হাসল হিরু চাচা।
‘সব কৃতিত্ব আমি একা নিতে পারছি না। তুমি কখনও ট্রোজান ঘোড়ার কথা শুনেছ?’
খুদে গোপন যাত্রীদের নিয়ে এগিয়ে চলল রোকু।
হিরু চাচার শেষ মরিয়া জুয়াখেলা শুরু হয়ে গেল।
চোদ্দ
অ্যাট্রিয়সে এক নির্বাক ট্র্যান্সম্যাট বুদের প্রবেশদ্বার পাহারা দিচ্ছে। শ্যাডো তার রাজ্যে আর কোনও অনাহূত অতিথি চায় না।
সোনার এক ব্রেসলেট বাতাসে ঝিলিক তুলে নির্বাকটির পায়ের কাছে এসে পড়ল। ওটা তুলে নেয়ার জন্য ঝুঁকে পড়ল ও-এবং ডিলাকের ছুটন্ত শরীরের নীচে চাপা পড়ল।
ডিলাক নির্বাকটির হাত থেকে ব্লাস্টার কেড়ে নিয়ে ওর কঙ্কালসদৃশ মাথায় ঠেকালেন।
‘কিউবিকলে ঢোকো।’ নির্বাকটি আদেশ পালন করল এবং ডিলাক তাকে অনুসরণ করলেন। আলো ঝলসে উঠল এবং ডিলাক নিজেকে আরেকটি কিউবিকলে খুঁজে পেলেন।
তিনি নির্বাকের মুখের চেহারায় ঠেসে ধরলেন ব্লাস্টারের নফল।
‘এটা কি শ্যাডোর গ্রহ? বলো!’
মাথা ঝাঁকাল নির্বাক।
ডিলাক ব্লাস্টারটা তুলে সজোরে নামিয়ে আনলেন হাড়সর্বস্ব মাথাটার উপর। নির্বাকটি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল।
কিউবিকল থেকে দেহটা টেনে হিঁচড়ে বের করে, ডিলাক হাঁটু গেড়ে বসে ওটার গা থেকে কালো আলখিল্লা খুলতে শুরু করলেন।
নির্বাকটির কঙ্কালসদৃশ দেহাবশিষ্ট এক পার্শ্ব সুড়ঙ্গে টেনে নিয়ে গিয়ে, ডিলাক আলখিল্লাটা পরে নিলেন…হুড দিয়ে ঢাকলেন মুখ। কালো আলখিল্লাধারী একটি দল শোভাযাত্রা করে তাঁর সামনে দিয়ে সুড়ঙ্গ ধরে চলেছে। নেতৃত্বদানকারী লিকলিকে অবয়বটি একটি দীপ্তিমান ক্রিস্টাল বইছে।
ডিলাক গুপ্ত জায়গা থেকে আলগোছে বেরিয়ে এসে শোভাযাত্রার পিছনে যোগ দিলেন।
শ্যাডো গটগটিয়ে তার গুহায় ফিরে গেল, এতটাই আনন্দিত, বাড়তি একজন অনুসারী যোগ হয়েছে খেয়ালই করল না।
ক্রিস্টালটা বিশেষভাবে তৈরি প্লিনথের উপর রাখল এবং ভাল করে দেখার জন্য পিছিয়ে এল।
‘অনন্তকাল পরে আমার অপেক্ষার পালা ফুরোল!’
.
রোকু ও তার দুই খুদে যাত্রী দীর্ঘ পাথুরে এক সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছল। সুড়ঙ্গটা শেষ হয়েছে নিরেট এক পাথরের দেয়ালে গিয়ে, যার পিছনে শ্যাডোর গুহা, যদি কি না ফ্ল্যাশের অনুমান ঠিক হয় আরকী।
ব্লাস্টার তাক করল্ রোকু।
‘আমি তৈরি। গুলি শুরু করল ও, এবং পাথুরে দেয়ালটা গলতে লাগল।
.
অহঙ্কার পর্ব শেষ হওয়ার পর ডায়ানার দিকে ঘুরে দাঁড়াল শ্যাডো।
‘আসুন, প্রিন্সেস, এখন আপনার নিয়তিকে পরিপূর্ণ করার সময় এসেছে।’
ডায়ানা দেদীপ্যমান সময়ের চাবিটার উদ্দেশে এগিয়ে গেলেন।
কিশোর তাঁকে ঠেকাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এক নির্বাকের হাড়সর্বস্ব হাত ওর বাহু চেপে ধরে টেনে সরিয়ে আনল।
ডায়ানা ধীর পায়ে সামনে এগোলেন।
‘আমার নিয়তি!’
‘এটার জন্যেই আপনি জন্মেছিলেন, প্রিন্সেস,’ ফিসফিস করে বলল শ্যাডো। ‘অ্যাট্রিয়সের ষষ্ঠ রাজবংশের ষষ্ঠ প্রজন্মের ষষ্ঠ সন্তান। যার জন্ম হয়েছিল সময়ের চাবির ষষ্ঠ এবং শেষ অংশটি হওয়ার জন্যে!’
‘আমি প্রস্তুত,’ মৃদু কণ্ঠে বললেন ডায়ানা। দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন সময়ের চাবির উদ্দেশে।
ছদ্মবেশী ডিলাক এ সময় লাফিয়ে পড়লেন।
‘না!’ গর্জে উঠলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। শ্যাডোর চোখ ডায়ানার উপর নিবদ্ধ। তার কোনওদিকে খেয়াল নেই।
ডায়ানার দু’হাত ক্রিস্টালটা স্পর্শ করতেই, তাঁর দেহে দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো তিনি অগ্নিশিখার মতন জ্বলছেন এবং তারপর শিখাটা সঙ্কুচিত হলো।
উজ্জ্বলতা মিলিয়ে গেলে দেখা গেল ডায়ানা অদৃশ্য। মাঝ-বাতাসে ভাসছে অদ্ভুত আকৃতির এক দীপ্তিমান ক্রিস্টাল, সময়ের চাবির ষষ্ঠ এবং শেষ টুকরোটা।
শ্যাডো ক্রিস্টালটা ধরার জন্য হাত বাড়াল, এ সময় হুড়মুড় করে সশব্দে ভেঙে পড়ল কী যেন, এবং রোকু দেয়াল ভেদ করে তেড়ে এল।
চরকির মতন ঘুরে দাঁড়াল শ্যাডো।
‘কী হচ্ছেটা কী?’
‘ক্ষমা করবেন, প্রভু।’
‘টিনের গর্দভ কোথাকার-’
‘এখানে একজন অনুপ্রবেশকারী আছে।’
শ্যাডো ঘুরে দাঁড়াতেই হুড ফেলা ডিলাককে দেখতে পেল। কিশোরের পাশে দাঁড়িয়ে।
‘ওকে আমি গোণায় ধরি না। ডক্টর কোথায়?’
‘ডক্টর আর ফ্ল্যাশকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে।’
‘ভাল! এই দু’জন বেঁচে থাকবে-আমার চরম বিজয় দেখা অবধি। এদেরকে পাহারা দাও!’
‘জি, প্রভু!’
শ্যাডো দু’হাত বাড়িয়ে বাতাস থেকে ছ’নম্বর টুকরোটা পেড়ে নিল। পরম শ্রদ্ধায় এক হাতে ওটাকে প্লিনথের কাছে নিয়ে এল, এবং সময়ের চাবিটা নিল অপর হাতে।
‘এখন, প্রভু, নরম গলায় বলল রোকু
ওর পার্শ্ব প্যানেল হড়কে খুলে যেতেই খুদে হিরু চাচা আর ফ্ল্যাশ লাফিয়ে বেরিয়ে এল।
কিশোর আতঙ্কিত চোখে শ্যাডোকে দেখছিল।
‘আপনি সময়ের ফাঁদটা ধ্বংস করে দিলে লাখ-লাখ মানুষ মারা পড়বে…
খলখল করে হেসে উঠল শ্যাডো।
‘সবে তো শুরু…’
হিরু চাচা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘স্ট্যাবিলাইযারটা উল্টো করে দাও, ফ্ল্যাশ-এখুনি!’
ফ্ল্যাশ ফায়ার করল, হিরু চাচার দেহ আলোয় স্নান করে ক্রমেই বাড়তে লাগল….
নিমেষে গানটা নিজের দিকে ফিরিয়ে আবারও ফায়ার করল ফ্ল্যাশ…
এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটল, মনে হলো কোনও আশ্চর্য জাদুবলে উদয় হয়েছে হিরু চাচা আর ফ্ল্যাশ। হিরু চাচা এক লাফে আগে বাড়ল, সময়ের চাবি এবং ছ’নম্বর টুকরোটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিল শ্যাডোর হাত থেকে, তারপর দরজার দিকে ত্বরিত পায়ে এগোল। ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে থ বনে গেছে শ্যাডো। মুখের চেহারায় রাজ্যের বিস্ময়।
‘জলদি, আপনারা সবাই টাইম মেশিনে ফিরে আসুন।’ চেঁচাল হিরু চাচা।
হিরু চাচা উধাও, কিশোর ছুটল তাকে অনুসরণ করে, ডিলাক আর ফ্ল্যাশও পিছিয়ে রইল না।
‘গাধার দল,’ সংবিৎ ফিরে পেয়ে খেঁকিয়ে উঠল শ্যাডো। ‘আঁধারের শক্তিকে কেউ ঠেকাতে পারবে না!’ ইতোমধ্যে হিরু চাচা সদলবলে সটকে পড়েছে।
টাইম মেশিন রয়েছে সেই সুড়ঙ্গটিতে যখন পৌছল তারা, প্রায় নাগাল ধরে ফেলেছে ধাওয়ারত নির্বাকরা।
‘তুমি আর কিশোর চলে যাও, ডক্টর, চেঁচিয়ে বলল ফ্ল্যাশ। ‘আমি আর রোকু ওদেরকে ঠেকিয়ে রাখব।’
‘বেরোবে কীভাবে?’
ট্র্যান্সমিট শ্যাফট। এখন যাও। যিয়সের কম্পিউটার রূমে দেখা হবে আমাদের! কীভাবে সুইচ অফ করে জানি আমি-একটা ফেইল- সেফে বানিয়েছিলাম!’
চাচা-ভাতিজা আর ডিলাক দৌড়ে চললেন।
রোকু আর ফ্ল্যাশ অ্যামবুশ পেতে অপেক্ষায় রইল, অনুসরণকারী নির্বাকদের মোকাবিলা করল ব্লাস্টার চালিয়ে। নেতারা পড়ে গেল, কিন্তু পিছনে আরও অনেকে রয়েছে…
হিরু চাচা সুড়ঙ্গ ধরে দৌড়ে কামরাটায় ঢুকে পড়ল, এবং টাইম মেশিনের দরজা খুলে কিশোরকে হাতছানি দিয়ে ভিতরে ডাকল।
ডিলাক ঢুকবেন না।
‘আমি এখানে থাকি, ডক্টর। ফ্ল্যাশ আর রোকুকে সাহায্য করার জন্যে!’ ঘুরেই দৌড় দিলেন সুড়ঙ্গ ধরে ফিরতি পথে।
হিরু চাচা তীরবেগে টাইম মেশিনে প্রবেশ করল। ক’মিনিট পরে একটা শোঁ-শোঁ গোঙানির শব্দে টাইম মেশিনটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
হিরু চাচা ভক্তি ভরে সময়ের চাবিটা ওটার স্ট্যাণ্ডে রেখে দিল। কিশোর তাকে লক্ষ করছিল, ওর মুখের চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ।
‘আমরা খুনী, হিরু চাচা, তুমি ব্যাপারটা ফীল করছ?’
‘কীভাবে? অ্যাট্রিয়সের রাজবাড়িকে তো আমরা ছ’নম্বর টুকরোটার ক্যারিয়ার বানাইনি।
‘ডায়ানার ভাগ্যে যা ঘটল সেটা আমাদের দোষ। আমরা দাবার বড়ে, হিরু চাচা, গার্ডিয়ানের নোংরা কাজে আমাদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে।
‘আমারও এটা পছন্দ নয়-কিন্তু কাজটা তো এখন হয়ে গেছে। যিয়সে যাওয়ার জন্যে কো-অর্ডিনেটগুলো সেট করে ফেল, ভাতিজা।’
‘তুমি এর বেশি আর কী বলবে,’ তেতো শোনাল কিশোরের কণ্ঠস্বর। হিরু চাচার হাতে ধরা ছ’নম্বর টুকরোটার দিকে চাইল। ‘ডায়ানা একসময় জীবিত মানুষ ছিল-আর এখন স্রেফ একটা উপাদান। কোনও শক্তিরই মানুষের সাথে এমনটা করা উচিত নয়-এমনকী সে গার্ডিয়ান হলেও!’
‘কিশোর, আমরা যিয়সে না গেলে লক্ষ-লক্ষ মানুষ মারা পড়বে এবং সেজন্যে আমরাই দায়ী থাকব। তুই সময়ের ফাঁদের কথাটা ভুলে গেছিস?’
কনসোলের কাছে শশব্যস্তে চলে গেল কিশোর।
‘মনে হয় শেষ সেকেণ্ডে নেমে এসেছে! নতুন টুকরোটা ঢোকাতে পারো না?’
‘শেষ জোড়াটা সাবধানে জুড়তে হবে— হাতে একদম সময় নেই। যিয়স, কিশোর! আমাদেরকে ওই কম্পিউটারটা বন্ধ করতে হবে।’
.
কিশোরের দক্ষ নেভিগেশনের গুণে, টাইম মেশিন শীঘ্রি কম্পিউটার রূমে গিয়ে নামল। কাউন্টডাউন ঘড়িটা তখনও অন্তহীন সিকোয়েন্স রিপিট করে যাচ্ছে-তবে এবার সিকোয়েন্সের রিডিং ৩, ২, ১…৩, ২, ১…৩, ২, ১…সময়ের ফাঁদ কয়েক সেকেণ্ডে সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে।
টাইম মেশিনের টুলকিট থেকে একজোড়া কাটার তুলে নিয়ে, হিরু চাচা সবেগে কামরার ওপ্রান্তে চলে গেল। ভাঙাচোরা পিরামিডটার ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দিল সে।
কিশোর উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে দেখছে।
হঠাৎই ফ্ল্যাশ গুলির মতন ছুটে এসে ঘরে ঢুকল এবং হড়কে থেমে গেল। ভগ্নপ্রায় পিরামিডটা দেখে হতাশায় মাথা নাড়ল।
‘কী বিশ্রী অবস্থা!’
হিরু চাচা পিরামিডের ভিতর থেকে মাথা বের করল এবং দুটো তার টেনে বের করে আনল, একটা লাল, একটা নীল।
‘ফ্ল্যাশ, খামোকা দাঁড়িয়ে থেকো না! ফেইল-সেফ কোনটা? এটার কোনওটা?’
‘সবুজ!’ চেঁচিয়ে উঠল ফ্ল্যাশ। ‘সবুজটা কাটো।’ মাথা চুলকে ‘এক মিনিট, মনে হয় নীলটা…না, সবুজটা!’
হিরু চাচা নীলটা কেটে দিল।
ডিজিটাল ঘড়িটা কাউণ্ট করল ২, ১, ০…
পা বলেছিলাম না সবুজটা!’ চেঁচাল ফ্ল্যাশ।
কিশোর বিস্ফোরণের জন্য তৈরি হলো।
কিছুই ঘটল না।
উজ্জ্বল হেসে পিরামিডের ভিতর থেকে আবারও উদয় হলো হিরু চাচা। ফ্ল্যাশ তার দিকে তিরস্কারের চোখে চাইল।
‘এত নাটকের দরকার ছিল না।’
‘তোমার মূল্যবান সাহায্য ছাড়া…তুমি তো বেশ সময় নিয়ে এখানে এসেছ, তাই না? কী হয়েছিল বলো তো।’
‘ডিলাক বেচারার মাথায় ব্লাস্টারের গুলি লেগেছে, ওকে আমাদের বয়ে আনতে হয়েছে। তাই দেরিটা হলো।’
‘উনি কেমন আছেন?’
‘বেঁচে যাবে। রোকু বাইরে ওর দেখাশোনা করছে।’
হঠাৎ কিশোর বলে উঠল, ‘হিরু চাচা, মার্শালের কী হবে?’
‘মার্শাল?’ বলল হিরু চাচা! ‘তাই তো, মার্শাল! জলদি সবাই টাইম মেশিনে ঢোকো!’
সবাই তীরবেগে ভিতরে ঢুকতেই হিরু চাচা দ্রুত পায়ে কনসোলের কাছে চলে গেল।
‘ডিলাক আর রোকুর কী হবে, হিরু চাচা?’ বলল কিশোর।
হিরু চাচা ওকে উপেক্ষা করল। কিশোর অবাক হয়ে লক্ষ করল হিরু চাচা টেক অফ করার কোনও চেষ্টা করল না, বরং অল্প ব্যবহৃত বহু-পার্শ্ব কন্ট্রোল কনসোলের একটি অংশের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট করে মেইন সুইচ অন করল…
‘এতেই কাজ হওয়ার কথা…’
.
‘ফায়ার!’ গর্জালেন মার্শাল।
পাইলটের আঙুল বাটন চাপল-এবং সেই মুহূর্তে সময়ের ফাঁদ ছিঁড়ে গেল। রকেটগুলো চালু হলো এবং শিপ থেকে এঁকেবেঁকে ছিটকে বেরোল ভয়ঙ্কর মিসাইলগুলো।
মার্শাল মুচকি হেসে হেলান দিয়ে বসলেন।
‘বিজয়ের মুহূর্ত। যে-কোনও সময় আমার সুন্দর ব্যাঙের ছাতাগুলো বার্স্ট করবে।’
ভিউয়িং পোর্ট দিয়ে বাইরে তাকানোর জন্য সামনে ঝুঁকলেন তিনি, এবং সভয়ে শ্বাস চাপলেন।
‘না, না!’ ককিয়ে উঠলেন। ‘এটা তো ভুল টার্গেট!’
রকেটগুলো আঘাত হানল-এবং কালো অ্যাস্টেরয়েডটি, শ্যাডোর শয়তানের গ্রহ, বিশাল এক আগুনের গোলকে পরিণত হলো।
.
ডাইমেনশনগুলোর মাঝে, নরকের সীমান্ত অঞ্চলে শ্যাডোর প্রেতাত্মাসদৃশ অবয়ব ভাসছে, মারা যাচ্ছে।
‘আমি ব্যর্থ হয়েছি,’ ফিসফিস করে বলল ও। ‘ডক্টর সময়ের চাবি পেয়ে গেছে। সে সফল হয়েছে।’
মরণাপন্ন, এ সময় শ্যাডো একটি গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরের তিরস্কার শুনতে পেল।
‘ন্যাকা ভূত কোথাকার, তোমার মৃত্যু আমার পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল। ডক্টর এখন সময়ের চাবিটা আমাকে দিয়ে দেবে, এবং গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে গোলমাল বেধে যাবে!’
ক্ষোভে-হতাশায় শেষ আর্তনাদ ছেড়ে চিরকালের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল শ্যাডো।
টাইম মেশিনের স্ক্যানারের পর্দা থেকে শয়তানের গ্রহের শেষ অগ্নিশিখার দৃশ্য মুছে গেল।
‘গুড শট, স্যর,’ মৃদু গলায় বলল হিরু চাচা।
কিশোর তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
‘কিন্তু, হিরু চাচা, উনি তো অ্যাস্টেরয়েডে হিট করেছিলেন। কিন্তু যিয়সের দিকে তাক করছিলেন তিনি! তুমি কি কিছু করেছ?’
‘তেমন কিছুই না, হালকা চালে বলল হিরু চাচা। ‘মার্শাল আর যিয়সের মাঝখানে একটা ডিফ্লেকটিভ ফোর্সফিল্ড সেট আপ করেছিলাম। ওটায় বাউন্স করে মিসাইলগুলো অ্যাস্টেরয়েডটার ওপর আছড়ে পড়েছে।’
‘ও, এই? আমি ভেবেছিলাম তুমি না জানি কী চালাকি করেছ!’
‘তুমি আমাদেরকে বলতে পারতে,’ অনুযোগের সুরে বলল ফ্ল্যাশ। ‘আমরা তো উড়ে পুড়ে যাব ভেবেছিলাম।’
এ সময় রোকু দোরগোড়ায় উদয় হলো।
‘ঠিক!’
‘সরি-’ নিজেকে সামলে নিল হিরু চাচা। ‘আরি, আমি মাফ চাইছি কীসের জন্যে? আমি তো সবার জীবন বাঁচিয়েছি। তোমাকে কোথাও নামিয়ে দিতে হবে, ফ্ল্যাশ?’
‘না, ধন্যবাদ। ভাবছি ডিলাককে নিয়ে ট্র্যান্সম্যাটের মাধ্যমে অ্যাট্রিয়সে ফিরে যাব। ওখানে আমার একটা কনট্রাক্ট জব আছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রহটার পুনর্গঠন। আমি আর মার্শাল মিলে কাজটা করব।’
‘আপনি আর মার্শাল?’ কিশোরের কণ্ঠে অবিশ্বাস।
মাথা ঝাঁকাল ফ্ল্যাশ।
‘তাঁর তো এখন কোনও কাজ নেই, তাই ভেবেছি তাঁকেও সাথে নেব।’
এসব কখন অ্যারেঞ্জ করেছিলেন?’
ধূর্ত হাসল ফ্ল্যাশ।
‘এই আধ ঘণ্টা আগে, সম্ভবত।’ সময়ের চাবিটার দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে চাইল সে। ‘তুমি কখনও ওটা হাতছাড়া করতে চাইলে আমাকে বোলো, ডক্টর। আমি ভাল দাম দিতে রাজি আছি!’
স্মিত হাসল হিরু চাচা।
‘আমি তোমাকে জানাব! গুডবাই, ফ্ল্যাশ।’
‘বাই, বাই অল। আমাকে মনে রেখো!’
খুশিয়াল ভঙ্গিতে হাত নেড়ে উধাও হয়ে গেল ছোটখাটো মানুষটা, এবং হিরু চাচা টাইম মেশিনের দরজা লাগিয়ে দিল।
বেশ খানিকক্ষণ পরে, কিশোর আর রোকু সশ্রদ্ধ নীরবতায় হিরু চাচাকে সময়ের চাবিটাকে জুড়তে দেখল। প্রচণ্ড একাগ্রতায় কাজ করে ক্ষয়িষ্ণু ক্রোনোডাইন ক্রিস্টালটা সরিয়েছে সে, সেখানে বসিয়েছে আসল ছ’নম্বর টুকরোটা এবং গোটাটাকে সিল ও লক করেছে ট্রেসার দিয়ে।
কাজ শেষ হলে পর হিরু চাচা সময়ের চাবিটাকে ওটার পেডেস্টালে রাখল।
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওটার দিকে, মুখের চেহারায় পরিতৃপ্তি।
‘শেষমেশ জিনিসটা হাতে এল। সময়ের চাবি!’
কিশোর অস্বস্তির চোখে চাচার দিকে চাইল।
‘গ্যালিফ্রের দিকে কোর্স সেট করা দরকার না, হিরু চাচা?’
‘গ্যালিফ্রে?’ অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। ‘গ্যালিফ্রেতে কেন?’
‘আমরা তো ওখানেই যাচ্ছি, তাই না? চাবিটা ওদেরকে দেয়ার জন্যে?’
‘না তো।’ হিরু চাচা ওর উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল। ‘তুই বুঝতে পারছিস, ভাতিজা, আমার হাতে এখন যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা এসে গেছে? এমুহূর্তে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটা কণার ওপর আমার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা? শুনছিস, কিশোর?’
‘অবশ্যই, হিরু চাচা।’
হিরু চাচার কণ্ঠে আকস্মিক হুমকি।
‘না শুনলে তোকে শুনতে বাধ্য করতে পারি আমি। সব কিছু করার ক্ষমতা এখন আমার হাতে। এই মুহূর্ত থেকে স্বাধীন ইচ্ছা বলে আর কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শুধু একটাই ইচ্ছা চলবে-সেটা আমার! কারণ আমার কাছে সময়ের চাবি আছে!’
কিশোর পিছিয়ে গেল।
‘হিরু চাচা, তুমি ঠিক আছ তো?’
‘কী?’ হিরু চাচা শিউরে ওঠে, প্রচণ্ড মানসিক চাপ খাটিয়ে নিজেকে সামলে নিল। এবার নম্র কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছি, কিন্তু ধর যদি __ না থাকতাম? জিনিসটা আমাকে এমন এক অনুভূতি দিয়েছে… অন্য কারও এমন অনুভূতি হলে আমি ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতাম। বুঝতে পারছিস?’
‘পারছি, হিরু চাচা। গার্ডিয়ানের কাছে যত তাড়াতাড়ি আমরা চাবিটা পৌঁছে দিতে পারি ততই ভাল!’
হঠাৎই টাইম মেশিনের স্ক্যানার স্ক্রীনের শাটারগুলো খুলে গেল আপনাআপনি। এক সাদা আলখিল্লাধারী, সাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত অবয়ব উদয় হলো স্ক্রীনে। জ্ঞানী বৃদ্ধের প্রাচীন মুখের চেহারায় স্মিত হাসি।
‘আমার অভিনন্দন, ডক্টর।’
হিরু চাচা বাউ করল।
‘ধন্যবাদ, স্যর।’
‘তুমি তোমার কাজ চমৎকারভাবে সম্পন্ন করেছ। গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।’
‘ধন্যবাদ, স্যর। আমার সৌভাগ্য।’
কিশোর অবাক চোখে মুখটা দেখছিল। ‘হিরু চাচা, ইনি তো প্রেসিডেন্ট নন?’
‘আমি যে-কোনও আকৃতি বা চেহারা নিতে পারি,’ সহজ গলায় বললেন গার্ডিয়ান। ‘অভিযানের শুরুতে আমি তোমাদের সামনে প্রেসিডেন্টের রূপ ধরে হাজির হয়েছিলাম, তোমরা যাতে আতঙ্কিত না হও।’
‘কার সাথে কথা বলছিস মনে রাখিস, কিশোর,’ ভর্ৎসনার সুরে বলল হিরু চাচা। ‘আমি তখনই বলেছিলাম উনি স্রেফ প্রেসিডেন্ট নন।’
‘সরি, হিরু চাচা।’
গার্ডিয়ানের কণ্ঠে সামান্য অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠল।
‘তোমার কাছে এখন যেহেতু সময়ের চাবিটা আছে, ডক্টর—’
‘সত্যিই আছে,’ বাধা দিয়ে বলল হিরু চাচা। পেডেস্টালে রাখা জ্বলজ্বলে প্রকাণ্ড ক্রিস্টালটার দিকে আঙুল ইশারা করল সে। ‘জিনিসটা আপনার পছন্দ হয়েছে, সার?’
মৃদু হাসলেন গার্ডিয়ান।
‘হয়েছে, ডক্টর।’
‘শুনে খুব খুশি হলাম, স্যর, তাই না রে, কিশোর? এখন কী হবে, স্যর? আমাদের প্রথম সাক্ষাতে আপনি বলেছিলেন চাবিটা জোড়া হয়ে গেলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক মুহূর্তের জন্যে থেমে যাবে, এবং আপনি গোটা সৃষ্টির মধ্যে ভাল-মন্দের স্বাভাবিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
গার্ডিয়ান এখন স্পষ্টতই অধৈর্য।
‘হ্যাঁ, ডক্টর, কথাটা ঠিক! তুমি কি দয়া করে চাবিটা আমাকে দেবে যাতে আমি কাজটা করতে পারি?’
চাবিটার দিকে ঘুরে দাঁড়াল হিরু চাচা।
‘সময়ের চাবি, আমি তোকে আদেশ করছি-আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি, স্যর?’
‘করো।’
‘সময়ের চারিটা এর মধ্যেই জোড়া হয়েছে, তাই না? আপনি এখন চাইলেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পারেন।’
‘ডক্টর, চাবিটা আমার পেতে হবে সাবধানে তুলে রাখার জন্যে। জিনিসটা সাঙ্ঘাতিক শক্তিশালী।’
‘এবং ভুল লোকের হাতে পড়া চলবে না?’ হিরু চাচা মাথা ঝাঁকাল। ‘ঠিক তাই! সময়ের চাবি-’ আবারও নিজেকে বাধা দিল সে। আর ছ’নম্বর টুকরোটার কী হবে, স্যর? আপনি তো জানেন ওটা আসলে প্রিন্সেস ডায়ানা ছিল। চাবিটাকে এই শেপে রেখে দিলে তিনি সারা জীবনের জন্যে বন্দি হয়ে যাবেন।
‘ব্যাপারটা দুঃখজনক, ডক্টর। কিন্তু যেখানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভাগ্য ঝুঁকিতে, সেখানে একজন মানুষের গুরুত্ব কতটুকু?’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন, স্যর। সময়ের চাবি, আমি তোকে আদেশ করছি-তুই যেখানে আছিস ঠিক সেখানেই থাকবি এবং শুধুমাত্র আমার আদেশ মেনে চলবি! হিরু চাচা এক লাফে কনসোলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সব ক’টা সুইচ অন করে দিল।
‘কী ব্যাপার? টাইম মেশিনের ডিফেন্স চালু করলে কেন?’ গমগম করে উঠল গার্ডিয়ানের কণ্ঠস্বর
‘এই সামান্য সতর্কতা, স্যর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ে যাবে যদি আমি রংকানা হই-সাদা আর কালো গার্ডিয়ানের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারি!’
কিশোর হিরু চাচার বাহু আঁকড়ে ধরল।
‘এসব কী বলছ, হিরু চাচা?’
হিরু চাচা স্ক্যানারের দিকে তর্জনী নির্দেশ করল।
‘ওকে দেখ!’
স্ক্রীনের মুখটা কালো হয়ে বিকৃত হয়ে গেল, ভ্রূ কুঁচকে শয়তানের দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে, রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে।
‘দেখলি তো?’ বলল হিরু চাচা। ‘মানুষের জীবনের প্রতি সাদা গার্ডিয়ান কখনওই অমন অসম্মান দেখাতেন না। তিনি নিজের জন্যে সময়ের চাবিটাও চাইতেন না।’
‘অবশ্যই না, আস্তে করে বলল কিশোর। ‘তিনি চাবিটা ব্যবহার করে ওটাকে আবার অদৃশ্য করে দিতেন, প্রিন্সেস ডায়ানার জীবন ফিরিয়ে আনতেন।’
‘ঠিক তাই। চাবিটা খানিক আগে জোড়া হয়েছে। আমার ধারণা আসল সাদা গার্ডিয়ান ইতোমধ্যেই যথেষ্ট সময় পেয়ে গেছেন।’
পর্দার অশুভ অবয়বটা কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ডক্টর, তুমি এজন্যে মরবে!’
হেসে উঠল হিরু চাচা।
‘আমার মনে হয় না। সময়ের চাবি এখনও আমার, ভুলে যাবেন না। আপনি যত খুশি গোস্বা করুন, কিছু যায় আসে না!’
‘আমি তোমাকে ধ্বংস করে দেব, ডক্টর,’ বিদ্বেষপূর্ণ কণ্ঠটা বলে উঠল। ‘তোমার দেহের প্রতিটা কণাকে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে দেব!
‘কথা বলতে ভালই লাগছিল,’ খোশমেজাজে বলল হিরু চাচা। ‘কিন্তু আপনি তো জানেন, আমার অনেক কাজ। বহু জায়গায় যেতে হয়, অনেক লোকের সাথে দেখা করতে হয়, প্রচুর কাজ করতে হয়…কিশোর?’
‘বলো, হিরু চাচা।’
‘কনসোলের পাশে দাঁড়া। আমি বললেই ডিম্যাটেরিয়ালাইয করবি!’
কিশোর ত্বরিত কনসোলের কাছে চলে গেল এবং হিরু চাচা গেল পেডেস্টালটার কাছে।
মুহূর্ত খানেক দাঁড়িয়ে থেকে দীপ্তিমান ক্রিস্টালটার হৃৎপিণ্ডের দিকে চেয়ে রইল হিরু চাচা।
‘সময়ের চাবি, আমি তোকে আদেশ দিচ্ছি! টাইম মেশিন যখন অদৃশ্য হবে, তুই বিচ্ছিন্ন হয়ে সৃষ্টির দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়বি।’ বিরতি নিল হিরু চাচা। ‘শুধু প্রিন্সেস ডায়ানা ছাড়া অবশ্যই, তিনি অ্যাট্রিয়সে ফিরে গেলেই ভাল হয়। সেখানে ডিলাক তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন। কিশোর, রেডি?’
‘হ্যাঁ, হিরু চাচা।’
‘ডিম্যাটেরিয়ালাইয!’
.
টাইম মেশিন অদৃশ্য হয়ে গেল, এবং ক্ষণিকের জন্য জ্বলজ্বলে সময়ের চাবিটা মহাশূন্যে ঝুলে রইল। এবার ওটা আলাদা হয়ে গেল, অনন্তে উধাও হয়ে গেল পাঁচটি ক্রিস্টাল, ছ’নম্বরটা সবেগে ছুটল অ্যাট্রিয়সের উদ্দেশে—যেখানে আহত, হতবিহ্বল ডিলাক ঘুম ভেঙে তাঁর হাসপাতাল বেডের পাশে প্রিন্সেস ডায়ানাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তিনি ভাবলেন স্বপ্ন দেখছেন বুঝি—যতক্ষণ পর্যন্ত না ডায়ানা ঝুঁকে পড়ে চুমো খেলেন তাঁকে।
.
খানিক বাদে, টাইম মেশিন স্পেস/টাইম কণ্টিনামে ঝুলে রয়েছে, এসময় সেণ্টার কনসোল থেকে মুখ তুলে চাইল হিরু চাচা।
‘তোর স্বীকার করতেই হবে, ভাতিজা, আমি সব ব্যাপারে চিন্তা করি। আয়, দেখে যা!’
কনসোলের মাঝখানে ছোট, কালো একটি বাক্স বানানো হয়েছে। ওটার মাথায় এক সার বাতি ঝলসাচ্ছে, এবং এক পাশে একটা হাতল।
‘কী এটা, হিরু চাচা?’
‘এটাকে বলে র্যাণ্ডোমাইযার।’
‘তাই? আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’
‘কোনও ধারণা নেই,’ সগর্বে বলল হিরু চাচা। ‘মজাটাই তো সেখানে!’
‘তোমার কোনও দায়িত্বজ্ঞান নেই, হিরু চাচা। তুমি এমনকী এটাও জান না আমরা কোথায় চলেছি!’
‘ঠিক! আমি যদি জানতাম আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা হলে ব্ল্যাক গার্ডিয়ানও জানতে পারত। তাই এই র্যাণ্ডোমাইযার।’
‘কী কাজ এটার?’
‘আমি এটাকে গাইডেন্স সিস্টেমে ফিট করেছি। পট লাক নামে পরিচিত এক জটিল বৈজ্ঞানিক নীতিতে কাজ করে এটা। কেউ জানবে না আমরা কোথায় যাচ্ছি।’ হিরু চাচা হাতলটা ধরে টানল, এবং বাক্সের বাতিগুলো এলোমেলো অনুক্রমে ঝলসাতে লাগল। ‘এমনকী ব্ল্যাক গার্ডিয়ানও।’
ঝলসাতে-থাকা বাক্সটার দিকে চাইল কিশোর, ভাবছে সামনে ওদের জন্য নতুন কী অভিযান অপেক্ষা করছে কে জানে।
‘ঠিক বলেছ, হিরু চাচা। কেউ জানে না আমরা কোথায় যাচ্ছি-এমনকী আমরা নিজেরাও না!’
***