এক
‘অ্যাট্রিয়স!’ বলে উঠল হিরু চাচা। ‘জানিস, আমি আগে কখনও ওখানে যাইনি।’
টাইম মেশিনের কন্ট্রোল কনসোল থেকে মুখ তুলে চাইল কিশোর।
‘আর যিয়স?’
‘কোথায় ওটা?’
‘ওটার যমজ। হেলিফাল গ্যালাক্সির কিনারায় অ্যাট্রিয়স আর যিয়স দুটো যমজ গ্রহ। এটাও জানো না?’
‘কিন্তু আমরা তো যিয়সে যাচ্ছি না!’ আপত্তি জানাল হিরু চাচা।
‘না, আমরা অ্যাট্রিয়সে যাচ্ছি।
‘তা হলে ঝুলে আছি কেন? অপেক্ষা কীসের?’
কন্ট্রোলের উপর খেলে গেল কিশোরের দু’হাত।
‘এই যে অ্যাট্রিয়স! কে জানে জায়গাটা কেমন।’
হিরু চাচা আর তার ভাতিজা কিশোর দীর্ঘ এবং বিপজ্জনক এক অভিযানের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বেশ কিছুকাল আগে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্যতম শক্তিশালী প্রাণী ‘হোয়াইট গার্ডিয়ান’ তাদেরকে কঠিন এক দায়িত্ব দেন-সময়ের চাবির ছ’টা টুকরো খুঁজে বের করে জোড়া লাগাতে হবে। বহু আগে চাবিটা বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, এবং টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আনাচে-কানাচে।
এখন চাবিটা আবার দরকার। হোয়াইট গার্ডিয়ান সময়গত বৈষম্য শুধরাতে চান, সৃষ্টিকে যেটি হুমকিতে ফেলেছে। সে সঙ্গে তিনি ‘ব্ল্যাক গার্ডিয়ান’-এর অশুভ পরিকল্পনাও বানচাল করবেন।
হিরু চাচার কাজ কঠিন হয়ে গেছে, কারণ চাবির টুকরোগুলোর রয়েছে বেশ কিছু রহস্যময় ক্ষমতা, তার মধ্যে অন্য পদার্থে রূপান্তর একটি। তারা লকেট থেকে শুরু করে এমনকী গ্রহের আকৃতিও নিতে পারে। খোঁজাখুঁজির কাজে সহায়তার জন্য চাচা-ভাতিজাকে একটি ট্রেসার দেয়া হয়েছে। সরু দণ্ডের মত একটি জিনিস, টাইম মেশিনের কনসোলে যেটিকে প্লাগ করা যায়। ট্রেসারটি তাদেরকে কোনও গ্রহে চাবির টুকরো পাওয়া গেলে জানান দেয়। কনসোল থেকে খুলে ফেললে ওটাকে ডিটেক্টর হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, টুকরোটাকে নিজের আকারে ফিরিয়ে আনার শক্তি রয়েছে ওটার-যেটি আসলে বড়, এবড়োখেবড়ো ক্রিস্টালের একটি পিণ্ড।
অনেকগুলো বিপজ্জনক অভিযানের পর হিরু চাচার দখলে এখন পাঁচটা টুকরো, সব ক’টাকে জুড়ে বড় একটা ক্রিস্টালে রূপ দেয়া হয়েছে। বাকি কেবল ছ’নম্বর তথা শেষ টুকরোটা খুঁজে পাওয়া। ট্রেসার জানিয়েছে, শেষ টুকরোটা রয়েছে অ্যাট্রিয়সের কোথাও।
কিছুক্ষণ পরে কিশোর কনসোল থেকে চোখ তুলে চাইল। ‘আমরা পৌঁছে গেছি প্রায়, হিরু চাচা। ম্যাটেরিয়ালাইযের সময় হলো।’
হিরু চাচা কনসোলের কাছে এলে এক পাশে সরে দাঁড়াল কিশোর।
‘ঠিক আছে, আমি ব্যাপারটা দেখছি।’ কন্ট্রোলগুলোর উপর উড়ে বেড়াল তার দুটি হাত, এবং টাইম মেশিন স্পেস/টাইম কন্টিনাম ছেড়ে, সাধারণ এক পুলিস বক্সের রূপ নিয়ে নরমাল স্পেসে উদয় হলো। ‘অ্যাট্রিয়সকে ঘিরে পার্কিং অরবিটে রেখেছি আমাদের। একবার দেখে নেয়া যাক।’
স্ক্যানারের সুইচ অন করল হিরু চাচা। পর্দা ফাঁকা।
‘আজব তো! তাই না রে, কিশোর?’
‘ভীষণ অদ্ভুত,’ বলল কিশোর। ‘তোমার কো-অর্ডিনেটগুলো রিচেক করে নাও, হিরু চাচা।’
‘তুই যেগুলো দিয়েছিস সেগুলোই ফীড করেছি। ওগুলো ঠিক ছিল তুই শিয়োর তো?’
‘পুরোপুরি। টাইম মেশিন মনে হয় আবার ভুল পথে চলে গেছে।’
‘আমাকে আরেকটা রিডিং দে।’
কনসোলের যে অংশটিতে ট্রেসারটি রয়েছে, ঘুরে সেদিকে গেল কিশোর।
‘শূন্য, শূন্য, চার, শূন্য, আট, শূন্য, এক, শূন্য।’
‘এক গাদা শূন্য!’ হিরু চাচা কন্ট্রোলগুলো আবারও অপারেট করল। টাইম মেশিন প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ডিম্যাটেরিয়ালাইযড় হলো। স্ক্যানারে চাইল সে। পর্দার মাঝখানে ছোট্ট, লালচে এক বলয় দেখা যাচ্ছে। ‘কিছু একটা আছে যা হোক!’
কিশোর নেভিগেশনাল রিডিংগুলো চেক করল।
‘ওটা অ্যাট্রিয়স কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু কয়েক মিলিয়ন মাইল দূরে। আর যমজ গ্রহ যিয়স কোথায়? ওটার কোনও চিহ্ন নেই।’
‘আমি কী ভাবছি জানিস?’ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল হিরু চাচা। কিছু একটা মনে হয় ভুল হয়েছে। শুধুমাত্র সাঙ্ঘাতিক ক্ষমতাশালী কোনও শক্তি টাইম মেশিনের নেভিগেশনাল সার্কিটকে এভাবে বিভ্রান্ত করতে পারবে। মনে হচ্ছে কেউ একজন চায় না আমরা অ্যাট্রিয়স খুঁজে পাই।’
‘ব্ল্যাক গার্ডিয়ান?’
‘কে জানে, স্রেফ কাকতালীয়ও হতে পারে…’
‘আমি এর ওপর বাজি ধরব না,’ থমথমে গলায় বলল কিশোর। ‘আমিও না। কিন্তু কী ঘটছে জানার একটাই মাত্র পথ।’
‘জানি…তুমি ম্যানুয়ালে দিচ্ছ না কেন, হিরু চাচা?’
‘ম্যানুয়ালেই দেব ভাবছি-তবে সাবধানে…’
.
স্পেস, পাইলটটি অসম্ভব সুদর্শন, তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ নার্সটি অপরূপা সুন্দরী।
‘যেয়ো না, জান,’ মিনতি করল মেয়েটি। ‘তুমি মারা পড়বে! তখন আমার কী হবে? আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না!’
‘আমিও বাঁচব না। কিন্তু আমাদেরটার চাইতেও বড় এক ভালবাসার জন্যে আমার বন্ধুরা মারা পড়ছে। জীবন দিচ্ছে, যাতে অ্যাট্রিয়স বেঁচে থাকে! জয় না আসা পর্যন্ত তোমাকে মন শক্ত করতে হবে। শয়তান হারবে, শান্তি আসবে তারপর আমরা ভালবাসার কথা ভাবব।’ মেয়েটিকে চুমো খেল সে। ‘আমি এখন যাই। বাচ্চাদেরকে আমার চুমো দিয়ো। ওদেরকে বোলো বাবা একদিন ঠিক ফিরে আসবে।’
যুদ্ধ সঙ্গীত ক্লাইমেক্সে পৌছল; পর্দা থেকে মুছে গেল স্বামী-স্ত্রী, ভেসে উঠল অ্যাট্রিয়সের প্রতীক ঈগলের ছবি।
বাজনাটা মিশে গেল দূরাগত এয়ার রেইড সাইরেন আর বিস্ফোরণের ভোঁতা শব্দের সঙ্গে।
বিরক্ত মার্শাল ভিডিও স্ক্রীন বন্ধ করে দিলেন। যত্তসব আবেগী জঞ্জাল! তবে কোনও সন্দেহ নেই, এর ফলে অ্যাট্রিয়সের সাধারণ নাগরিকদের মনোবল বেড়ে যায়। যারা এখনও বেঁচে আছে আরকী…
অ্যাট্রিয়সের মার্শাল বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাঁর ওয়ার রূমের চারপাশে চোখ বুলালেন। বিশাল গোলাকার এক চেম্বার ওটা, সবুজ-কালো পুরু ধাতব দেয়াল দিয়ে সাজানো। অবশ্যই আণ্ডারগ্রাউণ্ড। অ্যাট্রিয়সের সব কিছুই এখন মাটির নীচে, এবং সেটা বহু বছর ধরে। উঁচু রেডিয়েশন মাত্রার কারণে মাটির উপরে জীবন ধারণ অসম্ভব।
ওয়ার রূমটি একটি প্রকাণ্ড কমিউনিকেশন্স সেন্টার, চারদিকে রয়েছে ইন্সট্রুমেন্ট কনসোল, কম্পিউটার টার্মিনাল আর রিড-আউট স্ক্রীন। এখান থেকেই যিয়সের সঙ্গে অন্তহীন যুদ্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়। কামরার সবখানে টেকনিশিয়ানরা কাজে মহা ব্যস্ত। দরজায় পাহারা দিচ্ছে কালো উর্দি, কালো হেলমেট পরা গার্ডরা।
মার্শালের এইড এবং সহকারী মেজর হার্ভে মূল ব্যাটল কম্পিউটারে রিড-আউট স্ক্রীন নিরীখ করছিলেন। গাঁট্টাগোট্টা, সিরিয়াস ধরনের এক যুবক তিনি, গোল মুখের চেহারা সাদামাঠা কালো উর্দির উঁচু কলারের উপরে বেখাপ্পা দেখাচ্ছে।
মার্শাল নিজে অনেক বেশি প্রভাবশালী চেহারার লোক। দীর্ঘকায়, চওড়া কাঁধ, মাথায় লালচে-ধূসর চুল। পরনে তাঁর সোনার সামরিক অলঙ্কার, বুকে রুপোখচিত অ্যাট্রিয়সের ঈগল প্রতীক। কঠোর মুখের চেহারা সুদর্শন, কণ্ঠস্বর গভীর আর কর্তৃত্বপূর্ণ।
গ্রহের ভূপৃষ্ঠ ঘিরে থাকা মিসাইল সাইটগুলো থেকে রিপোর্টের বন্যা ভেসে আসছে।
‘এরিয়া ছয়, নিশ্চিহ্ন… সেকশন সাত, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি… জেলা দশ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। লেভেল চোদ্দ, টিকে আছে এবং কার্যকর… এরিয়া তিন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সব ক’টা আপার লেভেলে হতাহতের সংখ্যা প্রচুর…’
রিপোর্টগুলো আসছে, আর হার্ভে সেগুলোকে মূল কম্পিউটারে পাঞ্চ করছেন। মেইন ডিসপ্লে স্ক্রীনের গ্রিড ম্যাপটা অবিরাম রিভাইস আর আপডেট করছে ওটা।
হার্ভের পাশে, গোলাপী গাউন পরা পাতলা-সাতলা এক তরুণী দাঁড়িয়ে। তাঁর সোনালী চুলে রাজকীয় সোনার চক্র বাঁধা। ইনি প্রিন্সেস ডায়ানা, কাগজে-কলমে এ গ্রহের শাসনকর্ত্রী। বাস্তবে, অ্যাট্রিয়স এত বেশি দিন ধরে যুদ্ধে লিপ্ত, সমস্ত ক্ষমতা চলে গেছে সামরিক বাহিনীর হাতে-যার অর্থ মার্শালের কাছে।
তিনি ওয়ার রুম পেরিয়ে দু’জনের মাঝখানে দাঁড়ালেন। তাঁর উর্দি পরা দেহ দু’জনেরই মাথা ছাড়িয়ে গেছে।
‘আমাদের পাল্টা আক্রমণের কী খবর, হার্ভে?’
‘খবর নেই, মার্শাল। আমাদের স্পেস ফ্লীট এখন টার্গেট লোকেট করতে চেষ্টা করছে।’
‘টার্গেট তো যিয়স গ্রহ! সেটা কি ওদের জন্য যথেষ্ট বড় নয়?’
‘নেভিগেশনাল সিস্টেমগুলো বন্ধ। যিয়নরা মনে হয় নতুন স্ক্রীনিং ডিভাইস ব্যবহার করছে। পুরো স্পেস ফ্লীট অন্ধের মত উড়ছে।’
‘তাই? নাকি সব কাপুরুষ হয়ে গেছে? আমি চাই যিয়নরা আমাদের টুকরো-টুকরো করে দেয়ার আগেই ওদের ওপর হামলা করতে। বোঝা গেছে?’
হার্ভে মাথা নোয়ালেন।
‘জি, স্যর।’
একটি লাউডস্পিকার থেকে কড়কড় করে উঠল একটি জরুরি কণ্ঠস্বর।
‘হসপিটাল কমপ্লেক্সে ডিরেক্ট হিটের রিপোর্ট এসেছে। সাত থেকে দশ নম্বর ওয়ার্ড ধ্বংস হয়ে গেছে।’
প্রিন্সেস ডায়ানা আতঙ্কে শ্বাস চাপলেন।
‘ওখানে আমার এখুনি যাওয়া উচিত।’
তিনি দরজার দিকে এগোলেন, কিন্তু এক গার্ড তাঁর পথরোধ করল।
‘আমি দুঃখিত, ইয়োর হাইনেস। এসকর্ট ছাড়া আপনি এখান থেকে যেতে পারবেন না-মার্শালের আদেশ।’
ডায়ানা পাঁই করে ঘুরলেন।
‘আমি এখুনি হাসপাতালে যেতে চাই।’
মার্শাল মাথা নাড়লেন।
‘খুবই বিপজ্জনক।’
‘কিন্তু ওখানে হিট করা হয়েছে!’
‘সবখানেই হয়েছে, ইয়োর হাইনেস।
ইয়োর হাইনেস। আমরা নিউক্লিয়ার আক্রমণের শিকার হয়েছি।’
প্রিন্সেস ডায়ানা মার্শালের দিকে কঠোর চাউনি হানলেন।
‘এই অহেতুক যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? অ্যাট্রিয়স ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের সমঝোতা করা দরকার। শান্তি প্রতিষ্ঠা করা উচিত!’
‘ভিক্ষা করে শান্তি পাওয়া যায় না, প্রিন্সেস। জিতে নিতে হয়। আমাদের পাল্টা আক্রমণ এখুনি শুরু হবে। আমরা সফল হলে, জয় আমাদের হাতে ধরা দেবে। তখন শান্তি ফিরে আসবে।’
‘কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন না, যুদ্ধ চলতে থাকলে অ্যাট্রিয়স আর যিয়স দুটোই শেষ হয়ে যাবে?’
‘আমি শুধু আমার দায়িত্ব বুঝি, প্রিন্সেস-এবং সেটা হচ্ছে সফলতার সাথে যুদ্ধটা শেষ করা।’ মার্শাল বিরতি নিলেন। ‘আপনার দায়িত্ব আপনার জনগণকে সান্ত্বনা আর অনুপ্রেরণা দেয়া।’
‘তা হলে আমাকে হাসপাতালে গিয়ে কাজটা করতে দিন। আমি এখানে থাকলে কোনও লাভ হবে না।’
মার্শাল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ভাবলেন এরকম এক লিকলিকে দেহে কতখানি অবাধ্যতা থাকতে পারে।
‘পরিস্থিতি কেমন, হার্ভে? রেইড শেষ হয়েছে?’
‘জি, স্যর, আপাতত।’
‘ঠিক আছে। প্রিন্সেস ডায়ানা, আমার এক গার্ড আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। কোনও সন্দেহ নেই চিফ-সার্জন ডিলাক আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। ‘
প্রিন্সেস ডায়ানা তাঁর দিকে বিরূপ চাহনি হেনে ঘর ত্যাগ করলেন। তাঁর পায়ে-পায়ে চলল এক গার্ড।
মার্শাল কামরার মাঝখান দখল করে-রাখা পেল্লায় সিংহাসনসদৃশ কমাণ্ড চেয়ারটার কাছে গেলেন।
‘ভিডিও-লিঙ্ক সেট আপ করুন, হার্ভে। আমি জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেব।’
হাসপাতাল কমপ্লেক্সে যেন নরক ভেঙে পড়েছে। চারদিকে মৃত আর মুমূর্ষুর ছড়াছড়ি। বোমা বিধ্বস্ত ওয়ার্ডগুলো থেকে ইতোমধ্যে জনাকীর্ণ ওয়ার্ডগুলোতে সরানো হচ্ছে লোকজনদের। আহতদের সারি বেঁধে শুইয়ে রাখা হয়েছে করিডরে।
চিফ-সার্জন ডিলাক এই শোরগোলের মধ্যে রোগীদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, ডাক্তার, নার্স আর আর্দালিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। শ্যামলা বর্ণের সুদর্শন যুবক তিনি। পরনে সার্জনের কালো-লাল গাউন। তাঁর পুরুষোচিত মুখের চেহারায় এখন ক্লান্তির ছাপ। অ্যাট্রিয়সের অন্যতম প্রাচীন এক পরিবারের সন্তান ডিলাক, রাজনীতিকের উঁচু পদ প্রত্যাখ্যান করে চিকিৎসকের জীবন বেছে নিয়েছেন। শৈশব থেকেই প্রিন্সেস ডায়ানাকে ভালবাসেন তিনি, এবং ডায়ানাও তাঁকে ভালবাসেন, যদিও ব্যাপারটা দু’জনের খুব ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু-বান্ধব ছাড়া কেউ জানে না।
ডিলাক মূল ওয়ার্ডে মুহূর্তের জন্য দাঁড়ালেন। গুরুতর আহত এক পাইলট মেঝেতে এক ম্যাট্রেসের কোনায় পড়ে আছে। তাকে পরীক্ষা করছেন তিনি। লোকটির অবস্থার অবনতি ঘটেছে এবং পালস ফেইল করছে।
গমগমে এক কণ্ঠস্বরে বাধা পড়ল ডিলাকের পরীক্ষা ‘অ্যাট্রিয়সের নাগরিকরা!’
ডিলাক মুখ তুলে চাইলেন। ওয়ার্ডের দেয়ালের ভিডিও স্ক্রীনটা কাজ করছে আবার, এবং তাতে দেখা যাচ্ছে মার্শালের দানবীয় ক্লোজ- আপ। ‘আবারও যিয়সের ঘৃণিত শত্রুরা হানা দিয়েছে। এবারও ওরা পার পাবে না। বুকে সাহস রাখুন, ভাইয়েরা আমার। দৃঢ়চিত্ত হোন। শত্রুবধে কঠিন শপথ নিন!’
ডিলাকের রোগী হঠাৎই গুঙিয়ে উঠল। তার মাথা পিছন দিকে হেলে পড়ল। মারা গেছে লোকটা।
পর্দার দিকে ক্রুদ্ধ চাহনি হানলেন ডিলাক, মার্শাল যেখানে উদ্দীপনাময় ভাষণ দিচ্ছেন। দু’জন আর্দালিকে ইশারা করলেন দেহটা বয়ে নিয়ে যেতে।
হাঁটা ধরবেন, এ সময় পরিচিত এক কণ্ঠ ডাকল, ‘সার্জন ডিলাক!’ প্রিন্সেস ডায়ানা এইমাত্র ওয়ার্ডে প্রবেশ করেছেন, তাঁর মুখের চেহারা ফ্যাকাসে আর রাগান্বিত।
‘আহত নারী-পুরুষদের এরকম জঞ্জালের মত করিডরে ফেলে রাখা হয়েছে কেন?’
ডিলাক চারধারে হাত দোলালেন। সেন্ট্রাল আইল ছাড়া মেঝের একটি ইঞ্চিও খালি নেই।
‘কারণ ইয়োর হাইনেস দেখতে পাচ্ছেন ওয়ার্ডে জায়গা নেই।’ উঠে দাঁড়িয়ে আইল ধরে প্রিন্সেসের দিকে হেঁটে গেলেন তিনি, তাঁর গাউনে ক্লিপ দিয়ে আটকানো প্লাস্টিক ইণ্ডিকেটরটা খুঁটিয়ে দেখলেন।
‘মাফ করবেন, ইয়োর হাইনেস, আপনার রেড-চেক রিনিউ করতে হবে। একটু এদিকে আসবেন?’ কোনার ছোট্ট চারকোনা অফিসটার দিকে প্রিন্সেসকে পিছনে নিয়ে পা বাড়ালেন ডিলাক। সন্দিহান গার্ডের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলেন। একাকী হলে পর, পরস্পরকে মুহূর্তের জন্য জড়িয়ে ধরলেন, তারপর ফের আলাদা হলেন। ডিলাকের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে চাইলেন ডায়ানা।
‘তুমি ঠিক আছ তো? যখন শুনলাম হাসপাতালে ওরা হিট করেছে…এত ভয় পেয়েছিলাম।’
ডিলাক ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন।
‘কপাল ভাল ছিল আমার।’
ডায়ানার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
‘এসব কবে শেষ হবে, ডিলাক?’
‘যিয়নদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছ?’
ডিলাক আর ডায়ানা এক আণ্ডারগ্রাউণ্ড শান্তি দলের সদস্য, তাঁরা বোঝাপড়ার মাধ্যমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তির চেষ্টা চালাচ্ছেন।
হতাশার সঙ্গে মাথা নাড়লেন ডায়ানা।
‘আমাদের কোনও মেসেজ মনে হয় পৌঁছচ্ছে না।’ ভ্রূ কুঁচকালেন ডিলাক।
‘এদিক থেকে কি ট্র্যান্সমিশন জ্যাম করে রেখেছে?’
‘না। তার মানে দাঁড়াবে মার্শাল আমাদের সন্দেহ করছে-এবং করলে আমাদের গ্রেপ্তার করত। শেষ মেসেজটা আমি নিজে পাঠিয়েছি। প্যালেস ট্র্যান্সমিটার থেকে। কোনও কন্ট্যাক্ট সিগন্যাল পাইনি, সাড়া পাইনি-কিচ্ছু না! মনে হয়েছে যিয়সের যেন কোনও অস্তিত্বই নেই!’
কাছেই বিস্ফোরণের গুড়-গুড় শব্দে কেঁপে উঠল কামরাটা। আণবিক বোমাবাজি শুরু হয়েছে আবার। ডিলাক মুখ তুলে চাইলেন।
‘যিয়স জায়গামতই আছে।’
দোরগোড়া থেকে একটি কণ্ঠস্বর বলল, ‘মাফ করবেন, ইয়োর হাইনেস, আমরা কিন্তু শিডিউলে পিছিয়ে পড়েছি।’
ঘুরে দাঁড়ালেন ওঁরা। সেই গার্ড।
ডিলাক ডেস্ক থেকে নতুন এক রেড-চেক তুলে নিলেন, প্রিন্সেসের পরে থাকাটা খুলে ফেললেন, এবং নতুনটা সেখানে পরিয়ে দিলেন।
‘রেড-চেক সময়মত রিনিউ করাবেন, প্রিন্সেস, কঠোর গলায় বললেন।
ডায়ানা মাথা ঝাঁকালেন শীতল ভঙ্গিতে।
‘ধন্যবাদ, সার্জন ডিলাক।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে গার্ডকে অনুগমন করে কামরা ত্যাগ করলেন।
ডিলাক ওঁকে চলে যেতে দেখলেন, মুখের চেহারা গম্ভীর। ওঁদেরকে যিয়সের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে—তাঁদের গোটা গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগেই।
দুই
মার্শাল তাঁর কমাণ্ড চেয়ারে গা এলিয়ে বসে ব্যস্ত ওয়ার রূমের দিকে ধ্যানমগ্ন চোখে চেয়ে রয়েছেন। তাঁরা হারছেন, বিষণ্ন মনে ভাবলেন। শীঘ্রি যদি কিছু না ঘটে…
হার্ভের কণ্ঠস্বর শুনে সচকিত হলেন তিনি।
‘মার্শাল, আমার মনে হচ্ছে আমরা কিছু একটা দেখতে পাচ্ছি। অচেনা একটা জিনিস।’
মার্শাল উঠে দাঁড়ালেন, চলে এলেন প্রধান রাডার সেকশনে। মেইন স্ক্রীনের আড়াআড়ি খুদে এক বিন্দু ধীরে-ধীরে নড়ছে।
‘একদম অজানা সিগন্যাল প্রোফাইল, স্যর,’ উত্তেজিত শোনাল হার্ভের কণ্ঠ। ‘বলতে গেলে নড়ছেই না প্রায়।’
কনসোলে মুঠো দাবালেন মার্শাল।
‘এটা যিয়নদের গোপন অস্ত্র। যে ডিভাইসটা আমাদের নেভিগেশনের সাথে ইণ্টারফেয়ার করছে মিসাইল রেঞ্জে না আসা পর্যন্ত ট্র্যাকিং করতে থাকুন। ওটাকে ধ্বংস করুন-এবং বিশ্বাস রাখুন এখনও আমার জিততে পারি! আমি প্রিন্সেস ডায়ানা আর তাঁর শান্তিবাদী বন্ধুদের দেখাব।’
মার্শাল রাডার সেকশন থেকে সরে ওয়ার রূমের নির্জন এক কোণে এক চোর-কুঠরির কাছে গেলেন। চোর-কুঠরির পেছনের দেয়ালে একটা আয়না রয়েছে-ভারী অদ্ভুত এক আয়না। সুসজ্জিত ধাতব পাত লাগানো কাঁচটা এতই কালচে, মানুষ যেন ওটার দিকে নয়, ওটা ভেদ করে তাকায়। মার্শাল তাঁর ছায়াময় প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে কথা বললেন, ভাবখানা এমন যেন কারও উদ্দেশে বলছেন।
‘মেয়েটা ভয় পেতে শুরু করেছে, গলার কাঁটা হয়ে উঠছে-বিরক্তিকর। ও আমার শত্রুদের কাজে লাগতে পারে।’ মার্শাল বিরতি নিলেন, জবাব আশা করছেন যেন। এবার ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন। ‘হ্যাঁ…কিছু একটা আমাকে বলছে মেয়েটার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসছে।’ কমিউনিকেশন্স এরিয়ার দিকে সরে গেলেন তিনি।
.
ভোঁতা ব্লীপের শব্দে প্রিন্সেস ডায়ানার গার্ড থমকে দাঁড়াল।
‘মাফ করবেন, ইয়োর হাইনেস।’ রিস্ট কমিউনিকেটর কানের কাছে তুলল সে। ‘জি, স্যর, উনি এখন আমার সাথে আছেন।’ বিরতি নিল। ‘জি, স্যর। খুব ভাল, স্যর। আমি এখুনি দেখছি।’ প্রিন্সেসের দিকে ফিরল। ‘নতুন অর্ডার, ইয়োর হাইনেস। বাচ্চাদের ওয়ার্ডে আপনার ভিজিট বাতিল করা হয়েছে, নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে। বাচ্চাদেরকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে কে ব্লকে। আমরা এখন ওখানে যাব, ওদের সাথে নতুন কোয়ার্টারে দেখা করতে পারবেন আপনি।’
‘আমি তো জানতাম কে ব্লক রেডিয়েশন দূষণের জন্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
‘সেটা বেশ কিছুদিন আগের কথা। এখন আর কোনও সমস্যা নেই। এদিকে, প্লিজ।’
‘বেশ।’
সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত এক উইঙে চলে এলেন ওঁরা। ধাতব এক খিলানাকৃতির দরজার সামনে থেমে দাঁড়াল গার্ড
‘ভেতরে বাচ্চারা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে, ইয়োর হাইনেস।’ দরজাটা খুলল সে। দোরগোড়ার ওপাশে অন্ধকার, এবং বাচ্চাদের কচিকণ্ঠের কলকাকলি নেই।
প্রিন্সেস ডায়ানা ইতস্তত করলেন, এবং গার্ড প্রায় জোর দিয়ে বলল, ‘আপনাকে ভেতরে ঢুকতে হবে, ইয়োর হাইনেস। আমার ওপর হুকুম আছে।’
‘বুঝতে পেরেছি।’ দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন তিনি, এবং গার্ড, দড়াম করে দরজা লাগিয়ে তালা বন্ধ করে দিল। সে সটান সিধে হতেই, আড়াআড়ি এক ছায়া পড়ল তার উপরে।
মার্শাল। হাতে ব্লাস্টার।
গার্ড অ্যাটেনশন হলো।
‘আপনার আদেশ পালিত হয়েছে, স্যর।’
‘চমৎকার,’ বললেন মার্শাল এবং গুলি করে ফেলে দিলেন গার্ডটিকে।
.
প্রিন্সেস ডায়ানা নিজেকে লম্বা, স্বপ্নালোকিত, ধাতব দেয়াল ঘেরা এক কামরায় আবিষ্কার করলেন। ওটা একদম ফাঁকা, এবং দেয়ালগুলো আর মেঝে পুরু ধুলোয় মলিন। তিনি বোঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করলেন। বন্ধ। তাঁর কলারের রেড-চেক থেকে সতর্কতা সঙ্কেত শুনতে পেলেন। নীচের দিকে চাইলেন প্রিন্সেস। খুদে যন্ত্রটা দপ-দপ করে জ্বলছে। অ্যালার্ম সিগন্যাল। তার মানে কে ব্লক রেডিয়েশন মুক্ত নয়।
.
কিশোর ইন্সট্রুমেন্ট-রিডিং থেকে মুখ তুলে চাইল।
‘এখনও যিয়সের ‘চিহ্ন নেই, হিরু চাচা। তবে আমি অ্যাট্রিয়সের পরিষ্কার রিডিং পাচ্ছি। রেডিয়েশন লেভেল তুমি বিশ্বাস করবে না। দেখো!’
হিরু চাচা দেখল।
‘হায় আল্লাহ! রাস্তায় ডিম ভাজা যাবে।’
‘ওখানে মনে হয় নিউক্লিয়ার যুদ্ধ চলছে!’
‘না-ও হতে পারে।’
‘অন্য কোনও ব্যাখ্যা আছে?’
‘কেউ হয়তো মস্ত বড় কোনও ব্রেকফাস্ট পার্টি দিয়েছে! তুই সব সময় খারাপটাই ভাবিস কেন, ভাতিজা?’
কারণ সাধারণত সেটাই ঘটে!’
‘নাহ, তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুই একটু আশাবাদী হতে পারিস না?
‘পারছি না, দুঃখিত,’ বিরস কণ্ঠে বলল কিশোর
এ সময় ভিতর দিকে এক দরজা খুলে গেল এবং ধাতব কুকুরসদৃশ এক প্রাণী সাবলীল ভঙ্গিতে কন্ট্রোলরূমে এসে ঢুকল। এটি রোকু, চাচা-ভাতিজার সঙ্গী। দেখে মনে হয় রোবট কুকুর, কিন্তু আসলে স্বয়ংক্রিয় এক কম্পিউটার, ওটার প্রতিরোধ ক্ষমতাও আছে। হিরু চাচা চোখ নামিয়ে রোকুর দিকে চাইল।
‘তুই নিশ্চয়ই জানিস আশাবাদ কাকে বলে?’
রোকু দ্রুত একপাক ঘুরে নিয়ে, শোঁ-শোঁ, টিক-টিক শব্দে ডাটা ব্যাঙ্ক কনসাল্ট করল।
‘আশাবাদ। অযৌক্তিক বিশ্বাস, সাধারণত পাগলরা ভাবে সব ঠিকঠাক মত কাজ করবে।’
‘ওহ, চুপ কর তো,’ খেঁকিয়ে উঠল হিরু চাচা, ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ‘শোন, ভাতিজা, যখনই কোনও নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবি, পুরো ঘটনা জানার আগে সবচেয়ে সেরাটাই বিশ্বাস করবি। তারপর সবচাইতে খারাপটা বিশ্বাস করতে পারিস!’
‘কিন্তু যদি দেখা যায় ব্যাপারটা অতটা খারাপ নয়?’
‘বোকার মত কথা বলিস না, সব সময় খারাপটাই হয়!’ চিবুক ঘষল হিরু চাচা। ‘নিউক্লিয়ার যুদ্ধ, না? এরকম পরিস্থিতিতে বোঝা মুশকিল হয়ে যায় কে কার সাথে যুদ্ধ করছে।’
‘কিংবা কেনই বা করছে,’ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল কিশোর।
‘আমরা আন্দাজ করতে পারি কেন।’
‘তাই?’
হিরু চাচার মুখের চেহারা গম্ভীর।
‘আমরা যেটা খুঁজছি সেটার সাথে অবশ্যই কোনও না কোনও সম্পর্ক আছে, তাই না? সময়ের ছ’নম্বর এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ চাবির টুকরো!’
.
মার্শাল গটগট করে ওয়ার রূমে প্রবেশ করলেন।
‘সব ঠিক আছে, হার্ভে? আপনার রহস্যময় জিনিসটার খবর কী?’
‘এখনও আছে, স্যর। একটুও নড়ছে না। সতর্ক অবস্থায় আছে হয়তো, আমাদের মনিটর আর অবজার্ভ করছে।’
‘মিসাইল রেঞ্জে এসেছে?’
‘জি, স্যর।’
দু’হাত ঘষে নিলেন মার্শাল।
‘তা হলে ওটা আর বেশিক্ষণ গুপ্তচরগিরি করতে পারবে না।’ কণ্ঠস্বর কঠোর হলো তাঁর। ‘নিশ্চিহ্ন করে দিন, হার্ভে। এখুনি!’
.
কিশোর স্ক্যানার পরখ করছিল।
‘হিরু চাচা, গ্রহের সার্ফেস থেকে আমাদের দিকে কী যেন আসছে।’
‘হয়তো অভ্যর্থনা পার্টি। তুই কী বলিস, রোকু?’
‘অভ্যর্থনা পার্টি নয়। জিনিসটা গ্রাউণ্ড-টু-এয়ার মিসাইল। নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড।’
‘এখান থেকে এক্ষুণি সরে পড়তে হবে,’ বলল কিশোর।
‘দাঁড়া, বলল হিরু চাচা। ‘আমরা শেষ মুহূর্তে সরব, শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার জন্যে। গাইডেন্স সিস্টেমে ট্রেসারটা জুড়ে দে, কিশোর, ল্যাণ্ড করার পর চাবির টুকরোটার কাছাকাছি থাকতে চাই। অ্যাট্রিয়সে যত কম সময় থাকা যায় ততই ভাল!’
‘ঠিক বলেছ!’ কনসোলের অন্য পাশে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কিশোর।
হিরু চাচা অপেক্ষা করল, হাত ডিম্যাটেরিয়ালাইযেশন সুইচের উপর।
‘স্ট্যাণ্ড বাই সবাই। আর কতক্ষণ, রোকু?’
রোকু কাউন্টডাউন শুরু করল।
‘চার…তিন…দুই… এক…’
হিরু চাচা ডিম্যাটেরিয়ালাইযেশন সুইচ টিপে দিল।
‘শূন্য!’
.
দৃষ্টি রাডার স্ক্রীনে নিবদ্ধ, মার্শাল অপেক্ষা করছেন। লক্ষ করলেন মিসাইল ট্র্যাক এঁকেবেঁকে ভেসে উঠল পর্দায়, ছুটে যাচ্ছে রহস্যময় বস্তুটার দিকে। দুটোতে স্পর্শ লাগল-এবং বস্তুটা এবং মিসাইল উধাও হয়ে গেল।
‘হয়েছে! হয়েছে! ওয়েল ডান, হার্ভে, আপনাকে মেডেল দেয়া হবে!’
ইন্সট্রুমেন্ট রিডিং থেকে মুখ তুললেন হার্ভে।
‘ধন্যবাদ, স্যর, কিন্তু আমি সত্যিই জানি না…’
‘কী জানেন না?’
‘ওটাকে লাগাতে পেরেছি কি না।’
‘আমি নিজের চোখে দেখলাম!’ মার্শাল বাঁ হাতের তালুতে ডান মুঠো দিয়ে ঘুষি মারলেন। ‘ডিরেক্ট হিট। দারুণ। একেই বলে যুদ্ধ।’ হার্ভে ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন।
‘জি, স্যর। কিন্তু জিনিসটা…শপথ করে বলতে পারি সংঘর্ষের ঠিক আগ মুহূর্তে টার্গেট অদৃশ্য হয়ে যায়।’
.
হাসপাতাল কমপ্লেক্সের অনেক নীচে, পরিত্যক্ত এক করিডরে অদ্ভুত এক শোঁ-শোঁ গোঙানির শব্দ উঠল, এবং এক চারকোনা লাল বাক্স কোত্থেকে যেন উদয় হলো।
মুহূর্ত পরে, টাইম মেশিনের দরজা খুলে গেল, এবং হিরু চাচা তার লম্বা স্কার্ফ গলায় পেঁচাতে-পেঁচাতে বেরিয়ে এল, চওড়া ব্রিমের ফ্লপি হ্যাটটা টেনেটুনে জায়গামত বসাচ্ছে। চারধারে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে পিছন দিকে হাত-ইশারা করল। কিশোর বেরিয়ে এল টাইম মেশিন থেকে। দীর্ঘ, অন্ধকারাচ্ছন্ন এক করিডরে এখন ওরা, দেয়ালগুলো ফাটা এবং প্লাস্টার খসা, মেঝেতে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে নুড়িপাথর।
‘কতটা নীচে আছি তাই ভাবছি,’ বলল কিশোর।
কাঁধের উপর দিয়ে চাইল হিরু চাচা।
‘রোকু, তুই লুকিয়ে আছিস নাকি? কোনও ভয় নেই, বেরিয়ে আসতে পারিস। পানি নেই, জলাভূমি নেই, দৈত্য-দানব নেই। একদম নিরাপদ।’
রোকু টাইম মেশিন ছেড়ে স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে এসে অর্ধবৃত্তাকারে এদিক-ওদিক ঘুরে নিল। ওর সেন্সর পরিবেশ-পরিস্থিতি স্ক্যান করছে। ওদের মাথার উপর কোথাও থেকে বিস্ফোরণের দূরাগত গুড়-গুড় শব্দ ভেসে এল।
রোকু মাথা কাত করল।
‘রেডিয়েশন লেভেল জানাচ্ছে গ্রহের মাটিতে পারমাণবিক যুদ্ধ চলছে।’
কিশোর হিরু চাচার দিকে বিজয়ীর চোখে চাইল।
‘দেখলে? আমরা কতটা গভীরে, রোকু?’
‘মাটির চারশো মিটার নীচে।’
শিস দিয়ে উঠল হিরু চাচা।
‘চারশো! এখানেই এই অবস্থা, তা হলে মাটির ওপরে কী!’
‘রেডিয়েশন লেভেল কেমন?’ নার্ভাস কণ্ঠে প্রশ্ন করল কিশোর।
রোকু ঘুরপাক খেয়ে টিক-টিক করে উঠল।
‘রেডিয়েশন লেভেল একেক জায়গায় একেক রকম, তবে কাছেপিঠে কোনও জীবিত প্রাণী নেই। সদ্য মৃত এক লাশ আছে আশপাশে।’
রোকু তরতর করে করিডর ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা কোনা ঘুরল। চাচা-ভাতিজা অনুসরণ করল। কোনা ঘুরতেই, ওরা উর্দি পরা এক লোকের দলামোচা পাকানো দেহ পড়ে থাকতে দেখল ভারী এক ধাতব দরজার কাছে।
হিরু চাচা দেহটা পরীক্ষা করল।
‘তোর কথাই ঠিক, রোকু। বেশি আগে মারা যায়নি বেচারা। মনে হচ্ছে কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে, এবং সামনে থেকে যার অর্থ হলো খুনীকে ও চিনত। আজকাল কাউকেই আর বিশ্বাস করা যায় না!’
শিউরে উঠল কিশোর।
‘মনে হচ্ছে না এখানে আমার ভাল লাগবে।’
‘আমারও। চল, তাড়াতাড়ি ছ’নম্বর টুকরোটা খুঁজে নিয়ে এখান থেকে বিদায় হই।’
‘সে আর বলতে।’ কিশোর ট্রেসারের সুইচ অন করে অর্ধবৃত্তাকারে ঘোরাতে লাগল।
অবাক হয়ে দেখল ইলেকট্রনিক বীপ ওকে সোজা ধাতব দরজাটার দিকে নিয়ে গেল।
‘মনে হচ্ছে এখান দিয়ে বেরোতে হবে।’
হিরু চাচা দরজাটা নিরীখ করল।
‘দেখে মনে হচ্ছে লিড-শিল্ডেড।’ হাতল ঘুরাল। ‘এবং বন্ধ, এর মানে কী, ভাতিজা?’
‘উঁচু মাত্রার রেডিয়েশন এলাকা?’
‘হ্যাঁ,’ নিশ্চিত করল রোকু
হিরু চাচা চিন্তিত চোখে দরজাটা দেখল।
‘ভেতরে কী, রোকু? প্রাণের লক্ষণ আছে?’
রোকু দরজাটা স্ক্যান করল।
‘লিড-শিল্ডিঙের জন্য যথাযথ পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়।’
‘এটা যা-ই হোক, পাহারা দিয়ে রাখা।’ পতিত দেহটার দিকে চোখ নামিয়ে চাইল হিরু চাচা। ‘কিংবা পাহারা ছিল আরকী। দরজাটা হয়তো বুবি-ট্র্যাপড্।’
শ্বাস চাপল কিশোর।
‘ব্ল্যাক গার্ডিয়ান?’
‘সম্ভাবনা আছে। মাকড়সার জালে কি মাছি পড়ল? রোকু, তুই দরজাটায় একটা ফুটো করতে পারবি?’
‘পারব, প্রভু।’
‘শুরুতে ছোট্ট একটা ফুটো। ভেতরে কী আছে জানিস না তো!’ রোকু গড়গড়িয়ে সামনে এগোল, ওর ব্লাস্টারের মাল বের করে ড্রিল করতে লাগল।
তিন
প্রিন্সেস ডায়ানা ফাঁকা কামরাটির এক কোণে জড়সড় হয়ে বসা, হাঁটু জড়িয়ে রেখেছেন দু’হাত দিয়ে, নোয়ানো মাথায় চমকাচ্ছে রাজকীয় সোনার টিকলি।
আধো অন্ধকারে এখনও দপ দপ করছে কলারের রেড-চেক। ওটার রিডিং অনুযায়ী, ঘরের রেডিয়েশন লেভেল তিনি যতটা ভয় পেয়েছিলেন অতটা খারাপ নয়। সত্যিকারের কোনও ক্ষতি হতে এখনও কয়েক ঘণ্টা বাকি। কিন্তু তাঁকে এখানে হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ থাকতে হতে পারে-কেউ খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত। রেডিও অ্যাক্টিভিটি অথবা ক্ষুধা-তৃষ্ণায়, যে কারণেই হোক, মৃত্যু নিশ্চিত তাঁর।
হঠাৎই আড়ষ্ট হয়ে গেলেন তিনি। ধাতব দেয়ালগুলো প্রায় সব শব্দ শুষে নেয়-তিনি বহুক্ষণ ধরে দুমাদুম কিল মেরেছেন আর আর্তচিৎকার করেছেন, শেষমেশ হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কি কিছু শুনলেন-ক্ষীণ একটা শব্দ?
কান্নাভেজা মুখ তুললেন প্রিন্সেস, দরজার দিকে আশান্বিত চোখে চাইলেন এবং খুদে এক বিন্দু আলোর দেখা পেলেন!
.
মার্শাল ধ্যানমগ্ন দৃষ্টিতে তাঁর কালো আয়নার দিকে চেয়ে রয়েছেন।
এ সময় হার্ভে তাঁর কাঁধ আলতোভাবে স্পর্শ করলেন।
‘কী করছেন!’ বলে উঠলেন মার্শাল।
হার্ভে চমকে পিছু হটলেন।
‘সরি, স্যর।’
‘আমি ভাবছিলাম…যাকগে, কী ব্যাপার?’
‘কে ব্লকের অ্যালার্ম সিস্টেম অনুপ্রবেশের চেষ্টা নির্দেশ করছে। ভাবলাম আপনাকে জানানো দরকার। কেউ অমন হাই-রেড এলাকায় ঢুকতে চাইবে কেন?’
মার্শাল তাঁর দিকে ভ্রূ কুঁচকে চাইলেন।
‘ঠিক আছে, হার্ভে, আমি নিজে ব্যাপারটা দেখব। অন্য কারও এতে জড়ানোর প্রয়োজন নেই। কারও না। ওহ, বেঈমান ডিলাককে খুঁজে বের করে আমার কাছে নিয়ে আসুন!’
ব্লাস্টার হাতড়াতে-হাতড়াতে মার্শাল শশব্যস্তে কামরা ত্যাগ করলেন।
.
দরজার লিড-শিল্ডিং নিশ্চয়ই অন্য কোনও শক্তিশালী ধাতুর সমন্বয়ে গড়া। ছোট একটা গর্ত করতে রোকুর দীর্ঘক্ষণ লেগে গেল। শেষমেশ হিরু চাচা বলল, ‘যথেষ্ট হয়েছে, রোকু, পিছে সরে যা। করিডর ধরে ফিরে গিয়ে পাহারা দে।’
রোকু সরে যেতেই হিরু চাচা হাঁটু গেড়ে বসে ফুটোটায় চোখ রাখল। অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেল আরেকটি চোখ তার দিকে চেয়ে রয়েছে। এবার চোখটা সরে গিয়ে মুখ এল, এবং অনুচ্চ স্বরে একটি কণ্ঠ ফিসফিস করে বলল, ‘আপনি যে-ই হোন, আমাকে সাহায্য করুন…’
‘হিরু চাচা!’ ডাকল কিশোর।
হিরু চাচা মুখ তুলে চাইল। সামরিক উর্দি পরা গাঁট্টাগোট্টা এক লোক ওদের দিকে ব্লাস্টার তাক করেছে।
‘আপনারা কারা?’
হিরু চাচা ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল।
‘আমি ডক্টর হিরন পাশা আর এ আমার ভাতিজা কিশোর। আপনি কে?’
‘অ্যাট্রিয়সের মার্শাল। আপনারা এখানে কী করছেন?’
‘আমরা ট্র্যাভেলার। আমরা আসলে হারিয়ে গেছি। এখানে এই বেচারাকে পেলাম। মানুষটা মনে হয় মারা গেছে।’
গার্ডের দলামোচা পাকানো দেহটির দিকে চোখ নামিয়ে চাইলেন মার্শাল।
‘তাই তো দেখছি। আপনাদের দু’জনকেই এজন্য গুলি করা হবে।’
‘আমরা ওকে মারিনি, প্রতিবাদ করল কিশোর। ‘এভাবেই পেয়েছি।’
‘তোমাদের কথা বিশ্বাস করব মনে করেছ? এদিকে যাও, দু’জনেই।’
ব্লাস্টার দিয়ে ইশারা করলেন মার্শাল এবং ওরা করিডর ধরে এগিয়ে চলল।
রোকু তরতর করে এক পার্শ্ব সুড়ঙ্গের আঁধারে ঢুকে পড়ল, গা ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। মার্শাল ও তাঁর বন্দিরা রওনা হলে, ও বেরিয়ে এসে সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করল।
.
ফুটো দিয়ে উঁকি মেরে ফুঁপিয়ে উঠলেন প্রিন্সেস ডায়ানা।
‘আমাকে সাহায্য করুন, প্লিজ।
কিন্তু ওখানে জবাব দেয়ার কেউ নেই।
.
রোকু করিডরগুলো ধরে এগোচ্ছে, ওর সেন্সরে তরতাজা বিস্ফোরণের কম্পন ধরা পড়ল। যিয়সের বোমা-বর্ষণ আবারও শুরু হয়েছে। টাইম মেশিনের দিকে যাওয়ার করিডরটা ধরে চলেছে, এ সময় আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটল, এবার খুব কাছে। গোটা করিডর কেঁপে উঠল এবং ছাদের একাংশ ধসে পড়ল। টাইম মেশিনের উদ্দেশে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল।
রোকু এক মুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর একটা-একটা করে সমস্যার মোকাবেলা করবে মনস্থির করে হিরু চাচার পিছু নিল।
.
ওয়ার রূমের চারধারে কৌতূহলী দৃষ্টি বুলাল হিরু চাচা। দেখতে পেল টেকনিশিয়ানরা অসংখ্য কনসোলে কাজে ব্যস্ত, কম্পিউটার রিড-আউট স্ক্রীনগুলো অবিরাম পরিসংখ্যান দিচ্ছে। আরও লক্ষ করল কমিউনিকেশন্স সেট আপ আর প্রকাণ্ড স্পেস রাডার স্ক্রীন। এখানে উত্তেজনা আর হতাশার মিশ্র এক পরিবেশ টের পেল সে। অ্যাট্রিয়স পুরোপুরি যুদ্ধে লিপ্ত, যে যুদ্ধে তারা হেরে যাচ্ছে।
মার্শাল তাঁর কমাণ্ড চেয়ারে বসে বন্দিদের দিকে জ্বলন্ত চোখে চাইলেন।
‘দরজার বাইরে আপনারা কী করছিলেন?’
‘আপনাকে তো বলেছি,’ শান্ত স্বরে বলল হিরু চাচা। ‘আমরা ট্র্যাভেলার, বোমাবাজির মধ্যে হারিয়ে যাই, ভেবেছিলাম দরজাটা দিয়ে আমরা নিরাপদ জায়গায় যেতে পারব।’
‘ওই দরজাটা শুধুই মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।’
‘সেক্ষেত্রে বলা যায়, আপনি আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। বুঝতে পারছি, আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ। আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্যে আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ, স্যর। এখন কি আমরা যেতে পারি?’
‘আপনারা যিয়সের গুপ্তচর,’ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন মার্শাল। ‘গুপ্তচর আর স্যাবোটাজকারী।’
হিরু চাচা নিরীহ হাসল।
‘আমাদেরকে দেখে গুপ্তচর মনে হয়? আমরা সাধারণ মানুষ!’ হার্ভে সামনে এগিয়ে এলেন।
‘সার্জন ডিলাক এখানে, স্যর।’ বন্দিদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন তিনি। ‘এরা কারা, স্যর?’
‘এরা অনুপ্রবেশকারী, হার্ভে, কে ব্লকে ঢোকার অপচেষ্টা করছিল।’
‘কিন্তু কেন, স্যর? এরা এসেছে কোত্থেকে?’
‘সেটাই জানতে চাইছি, হার্ভে—এদেরকে মেরে ফেলার আগে।’ ডিলাককে সামনে নিয়ে আসা হলো। দু’পাশে গার্ড পাহারায় রয়েছে। ভয়ানক ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে তাঁকে।
‘মার্শাল, আমার রোগীরা অপেক্ষা করছে—’
‘করুক! আপনি এদেরকে চেনেন?’
ডিলাক চাচা-ভাতিজার দিকে চেয়ে রইলেন।
‘না। আমার চেনার কথা?’
‘আমার মনে হয় আপনি এদেরকে চেনেন, ডিলাক। এরা যিয়সের গুপ্তচর আর স্যাবোটাজকারী।’
‘তার সাথে আমার কী সম্পর্ক?’
প্রিন্সেস ডায়ানা নিখোঁজ, ডিলাক। তাঁকে শেষবার আপনার সাথে দেখা গেছে। তারপর তাঁর বডিগার্ডের লাশ পাওয়া যায় এবং তিনি উধাও।’
‘নিখোঁজ?’ ডিলাক রীতিমত আতঙ্কিত। তাঁকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ভালমত তল্লাশী চালানোর জন্যে আপনার একটা দল বানানো উচিত…’
‘যা করার এর মধ্যেই করা হয়ে গেছে,’ কথাটাকে উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন মার্শাল। ‘এখন আমার কথা শুনুন। আমি জানি এই যুদ্ধের ব্যাপারে আপনি আমার সাথে একমত নন।’
‘আমি যুদ্ধের ব্যাপারে একমত নই-সে যে যুদ্ধই হোক,’ শুধরে দিলেন ডিলাক। ‘প্রিন্সেস ডায়ানারও একই মত।’
‘ঠিক তাই। সেজন্যে আপনি শত্রুদের সহযোগিতা করছেন?’
‘না, মার্শাল, আপনি ভুল করছেন!’
‘সব স্বীকার করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি এই দুই গুপ্তচরকে নিজে গ্রেপ্তার করেছি, এরা প্রিন্সেসের বডিগার্ডের লাশের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার ধারণা প্রিন্সেস যিয়সে গেছেন- যেখানে তাঁর সাথে আপনার যোগ দেয়ার কথা! ‘
মার্শাল কড়া চোখে ডিলাকের দিকে চাইলেন। তিনি জানেন, এসব অভিযোগের একটিও সত্যি নয়। কিন্তু এ-ও জানেন ডিলাক আর
প্রিন্সেসকে দোষী সাব্যস্ত করে তিনি এই গ্রহে নিজের কর্তৃত্ব জোরদার করতে পারবেন।
হিরু চাচা উপলব্ধি করল এখন হস্তক্ষেপ করার সময় এসেছে।
‘এটা বাজে কথা, মার্শাল, আমরা গার্ডটাকে খুন করিনি। আমাদের সাথে এমনকী অস্ত্রও নেই। এটাকে যদি না গোনায় ধরেন!’ পকেট থেকে একটা হুইস্ল্ বের করে বাড়িয়ে দিল।
মার্শাল সামনে ঝুঁকে এলেন।
‘কী ওটা?’
‘স্রেফ একটা পুরানো ডগ-হুইস্ল্। বাজাবেন?’
‘হার্ভে!’ গর্জে উঠলেন মার্শাল।
হিরু চাচার কাছ থেকে হুইসলটা নিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করলেন হার্ভে। ঠোঁটে ঠেকিয়ে জোরে ফুঁ দিলেন। কিছুই ঘটল না। হার্ভে হিরু চাচার উদ্দেশে ছুঁড়ে দিলেন ওটা।
‘কোনও কাজের না, স্যর।’
মার্শাল হুমকির সুরে বললেন, ‘আমার সাথে বোকার ভান করবেন না, ডক্টর। এখন বলুন কেন এখানে এসেছেন?’
‘বেড়াতে?’ বাতলে দিল হিরু চাচা।
‘পারমাণবিক যুদ্ধের মাঝখানে?’
‘আসলে আমি ছোট্ট একটা টাইম-ট্র্যাভেল এজেন্সি চালাই। অতীত আর ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্র, সভ্যতা কীভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, এধরনের ব্যাপার-স্যাপার আরকী। ঠিক না রে, কিশোর?’
‘হ্যাঁ,’ চট করে সায় জানাল কিশোর। শিক্ষামূলক ব্যাপার।’
‘শেষবারের মত। এখানে আপনারা কী করছেন?’
‘আপনার জানতেই যদি হয় তো বলি, একটা চাবি খুঁজছি।’
‘ফালতু কথা!’ গর্জে উঠলেন মার্শাল। ‘আপনার সব কথা মিথ্যে। আপনারা শত্রুপক্ষের এজেন্ট, আমাদের এক গার্ডকে খুন করেছেন, প্রিন্সেস ডায়ানাকে কিডন্যাপ করেছেন, কোনও সন্দেহ নেই ডিলাকের সাহায্য নিয়ে। আপনারা যদি স্বীকার না করেন, এবং প্রিন্সেসের খোঁজ না দেন তা হলে তিনজনকেই গুপ্তচর হিসেবে হত্যা করা হবে, বোঝা গেছে?’
‘খুব খোলসা করে বলেছেন,’ নম্র কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। কিন্তু আমি দুঃখিত, আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না।’
গার্ডদের অলক্ষে, দোরগোড়ায় হাজির হয়েছে রোকু।
‘এটাই কি আপনার শেষ কথা?’
দেঁতো হাসল হিরু চাচা।
মনে প্রাণে তা আশা করি না! তারপরও আমার ধারণা আমরা এখানে অনেকক্ষণ যাবৎ আছি।’ কণ্ঠস্বর কঠোর হলো তার। ‘আপনাকে সত্যি কথা বলছি, কিন্তু আপনি মানছেন না। যে অপরাধ আমরা করিনি সে অপরাধে আপনি আমাদের দোষী করছেন, এবং গুলি করার হুমকি দিচ্ছেন। দীর্ঘ যাত্রার পর এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আয়, কিশোর।’ হিরু চাচা ঘুরে দাঁড়াল।
‘যেখানে আছেন থাকুন,’ ক্ষিপ্তকণ্ঠে আদেশ করলেন মার্শাল। ‘আর একটু নড়লে…’
হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল হিরু চাচা, ‘বাতি বন্ধ, রোকু!’
রোকু সেন্ট্রাল পাওয়ার বক্স চিহ্নিত করল, ওর লেসার রশ্মি দিয়ে ওটার বিস্ফোরণ ঘটাল এবং গোটা কামরা কালিগোলা অন্ধকার আর বিভ্রান্তিতে ঢাকা পড়ল।
হিরু চাচা কিশোরের হাত চেপে ধরে দরজার এক পাশে টেনে নিয়ে গেল।
‘গার্ড!’ চেঁচালেন মার্শাল। ‘থামাও ওদের! গুলি করো!’
করিডর থেকে স্রোতের মত ওয়ার রূমে প্রবেশ করল প্রহরীরা, এতে বিভ্রান্তি আরও বাড়ল। ওরা দুদ্দাড় করে ভিতরে ঢুকতেই হিরু চাচা, কিশোর আর রোকু দরজা দিয়ে আলগোছে বেরিয়ে গেল। তাদেরকে অনুসরণ করলেন ডিলাক। তাঁর কোনও ধারণা নেই এই আগন্তুকরা কারা, কিন্তু তিনি এটা জানেন, মার্শালের চাইতে ওদের সঙ্গে তিনি অনেক বেশি নিরাপদ।
ওরা করিডরে বেরিয়ে আসার পর হিরু চাচা চিৎকার করে বলল, ‘দৌড় দে!’
‘কোনদিকে?’ শ্বাসের ফাঁকে জানতে চাইল কিশোর।
‘টাইম মেশিন যেখানে!’
.
সোনার টিকলিটা ডায়ানার কপালে খুব ভারী ঠেকছে। ওটা খুলে ফেলে, পাশে ধুলোটে মেঝেতে রাখলেন তিনি, ক্লান্তির সঙ্গে টনটনে কপালটা ঘষলেন। মাথা পিছন দিকে ঝুলে পড়ল, চোখ বন্ধ, অচেতন হয়ে পড়লেন প্রিন্সেস।
হঠাৎই কামরার ইতোমধ্যে ম্লান আলো আরও ক্ষীণ হয়ে এল। একই সঙ্গে, অপর পাশের দেয়ালে একটা ফাটল দিয়ে এক চিলতে আলোর রেখা ফুটে উঠল। ওটা চওড়া হতে লাগল ক্রমেই, শেষমেশ এক দরজার কিনারা দেখা গেল। দেয়ালের এক গোপন প্যানেল ধীরে- ধীরে হড়কে খুলে যাচ্ছে। লম্বা, কালো মাথা ঢাকা আলখিল্লা পরা এক ছায়ামূর্তি ফাঁকটা দিয়ে আলগোছে বেরিয়ে এসে নিঃশব্দে কামরাটা আড়াআড়ি পেরোল। ওটা ঘুমন্ত প্রিন্সেস ডায়ানাকে তুলে নিল, কামরা পেরিয়ে ফাঁকটা দিয়ে ঢুকে পড়ল। তাদের পিছনে লেগে গেল দরজা।
.
হিরু চাচা আর তার সঙ্গীরা করিডর ধরে ছুটে এসে একটা কোনা ঘুরল এবং স্কিড করে থেমে দাঁড়াল। তাদের সামনে, করিডরে নুড়িপাথরের জঞ্জালের মস্ত এক স্তূপ।
টাইম মেশিনে যাওয়ার পথ বন্ধ।
চার
কিশোর জঞ্জালের স্তূপের দিকে ক্রোধমিশ্রিত চোখে চেয়ে রইল।
‘কী ব্যাপার? টাইম মেশিন কই?’
শ্রাগ করল হিরু চাচা।
স্ত্রীর ‘জঞ্জালের নীচে কোথাও চাপা পড়েছে।
‘তার মানে আমরা ফাঁদে আটকা পড়েছি। বেরনোর পথ নেই। গার্ডরা আমাদের পিছু নেবে, যে-কোনও সময় এখানে পৌঁছে যাবে।
হিরু চাচাকে শান্ত দেখাল।
‘রোকু পিছন দিকটা পাহারা দিচ্ছে। ও ওদেরকে ঠেকিয়ে রাখবে।’
‘শোনো!’ হঠাৎই বলল কিশোর। ‘কে যেন আসছে!’
পদশব্দ দ্রুত এগিয়ে আসছে। মুহূর্ত পরে, ডিলাক সাবধানে কোনা ঘুরে উঁকি দিলেন। হিরু চাচাকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন।
‘আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম। ও কোথায়? প্রিন্সেস ডায়ানা?’
‘কে জানতে চায়?’
‘আমার নাম ডিলাক। প্রিন্সেস আমার বাগদত্তা।’
‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, মার্শালের হাতে ধরা পড়ার আগে আমি একজনকে খুঁজে পাই-গলা শুনে মনে হয় অল্পবয়সী কোনও মহিলা।’
‘কোথায়? কোথায় সে?’
কোনা ঘুরে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে গেল হিরু চাচা।
‘ওই মেটাল দরজাটার পিছনে।’
ডিলাক তার দিকে যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টিতে চাইলেন।
‘কিন্তু ওটা তো একটা হাই-রেড এলাকা। ওকে আমাদের বের করতেই হবে।’ দরজার গায়ে বৃথাই কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলেন তিনি।
হিরু চাচা তাঁকে এক পাশে সরিয়ে দিল।
‘এক মিনিট।’ ঝুঁকে পড়ে উঁকি দিল রোকুর তৈরি ফুটোটা দিয়ে ‘কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’ ঠোঁট ঠেকাল ফুটোয়। ‘শুনছেন? কেউ আছেন ওখানে?’ সাড়া মিলল না।
এ সময় কোনা ঘুরে উদয় হলো রোকু।
‘কীরে, ওরা পিছু নিয়েছে?’ প্রশ্ন করল হিরু চাচা।
‘আমি ওদেরকে ভুল পথে পাঠাতে পেরেছি।’
‘ভাল। আমরা এ দরজাটা খুলতে চাই, রোকু। কিন্তু সাবধান। ওপাশে একজন তরুণী থাকতে পারেন এবং আমরা তাঁর ক্ষতি চাই না।’
‘বুঝেছি, প্রভু।’ রোকু তরতর করে সামনে এগোল, ব্লাস্টার চালু করে, লক ঘিরে গোল করে কাটতে লাগল।
ডিলাক রীতিমত চমকিত।
‘কী এটা?’
‘চিন্তার কিছু নেই,’ আশ্বস্ত করার সুরে বলল কিশোর। ‘রোকু আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। ও আমাদের সাথে এসেছে।’
‘কিন্তু আপনারা কারা? যিয়ন, মার্শাল যেমনটা বলল?’
‘প্রশ্নই ওঠে না,’ চটপট বলল হিরু চাচা। ‘ভয় পাবেন না, আমরা শত্রু নই-বন্ধু। কিশোর, পিছন দিকে একটা চোখ রাখিস।’
কিশোর কোনার দিকে গেলে হিরু চাচা বলে চলল, ‘ডিলাক, মার্শাল প্রিন্সেসকে সরাতে চায় কেন?’
‘সে এর পেছনে আছে ভাবছেন কেন?’
‘অনেকগুলো কাকতালীয় ঘটনার কারণে। সে একটু আগে যে অভিযোগগুলো করছিল সেগুলো সে নিজেও বিশ্বাস করে না। সব অভিনয়।’
‘ডায়ানা আর আমি যিয়নদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে। মার্শাল যদি জানত…ও চায় যুদ্ধ চলতে থাকুক। আমার জানা ছিল আমি বিপদের মধ্যে আছি, কিন্তু ভেবেছিলাম ডায়ানা নিরাপদ থাকবে। মার্শাল ওর সমর্থন চায়, মানুষের ওপর ডায়ানার প্রভাবকে কাজে লাগাতে চায়।’
রোকুর চক্র কাটা শেষ হলে লকটা পড়ে গেল।
‘রেডি, প্রভু।’
ডিলাক হিরু চাচার পাশ কাটিয়ে সামনে এগোলেন, দরজা টেনে খুলে কামরায় ঢুকলেন।
ফাঁকা।
চাচা-ভাতিজা অনুসরণ করল। কিশোরের হাতে ট্রেসার। ঘরের চারপাশে নাড়ল ওটা।
‘এখানে কিছু নেই, হিরু চাচা।’
সোনার টিকলিটা মেঝে থেকে তুলে নিলেন ডিলাক।
‘দেখুন, ও এখানে ছিল!’
‘হ্যাঁ,’ চিন্তিত শোনাল হিরু চাচার কণ্ঠ। ধুলোটে মেঝেতে এক সার ট্র্যাক পরখ করছিল সে, যে ট্র্যাকগুলো আপাতদৃষ্টিতে নিরেট এক দেয়ালের দিকে চলে গেছে।
রোকু উত্তেজিত ভঙ্গিতে টিক-টিক, ঘর-ঘর করছে।
‘এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়।’
‘ঠিক,’ বলল হিরু চাচা। ‘আসুন আপনারা।’
ডিলাক অনড়।
‘আমি এখানে থাকব। ও যদি এখানে মারা গিয়ে থাকে….. কামরা থেকে তাঁকে টেনে বের করল হিরু চাচা।
‘মানুষ রেডিয়েশনে অদৃশ্য হয়ে যায় না, ডিলাক, আপনি তা জানেন। ডায়ানা এখানে না থাকলে অন্য কোথাও আছেন।’
‘এখানে দাঁড়িয়ে থেকে দুশ্চিন্তা করলে তাঁর কোনও লাভ হবে না, ‘ যোগ করল কিশোর। ‘চলুন, বাইরে গিয়ে তাঁকে খুঁজি।’ শেষমেশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলেন ডিলাক। হিরু চাচা রোকুর দিকে দৃষ্টি নামাল।
‘এখানকার রেডিয়েশনে তোর ক্ষতি হবে না, রোকু। তুই এখানে পাহারায় থাক। পিছনের দেয়ালটার দিকে নজর রাখবি। আমার ধারণা ওটার পিছনে কোনও প্যাসেজ আছে। স্ক্যানার কাজে লাগিয়ে দেখ কদ্দূর কী করতে পারিস।’
‘আচ্ছা, প্রভু।’
করিডরে বেরিয়ে আসার পর হিরু চাচা বলল, ‘ডিলাক আপনার জানা আছে ওই ঘরটার পিছনে কী আছে?’
‘আমি যদ্দূর জানি রিসাইক্লিং শ্যাফটের খানিকটা অংশ।’
‘রিসাইক্লিং কী?’
‘স্ক্র্যাপ, মেটাল ওয়েস্ট। যুদ্ধের জন্য সব রিসাইকল করা হয়। ওই শ্যাফট দিয়ে যে ধাতুই নামে সেটা ফার্নেসে রিপ্রসেড্ হয়। কেন?’
স্রেফ ইন্টারেস্ট,’ উদাসীন কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। ‘আসুন।’
‘কোথায়?’ প্রশ্ন করল কিশোর। ‘আমরা কি জঞ্জাল সরিয়ে টাইম মেশিনটা খুঁজে বের করব? রোকুকে গিয়ে নিয়ে আসব?’
মাথা নাড়ল হিরু চাচা।
‘এখন না। তা ছাড়া, পালিয়ে গেলে আমরা চাবির টুকরোটা খুঁজে পাব না। এবং আমি জানতে চাই মার্শালের মতলবটা কী।’
মার্শাল সে মুহূর্তে গভীর মনোযোগে তাঁর কালো আয়নাটার দিকে চেয়ে ছিলেন। হার্ভে তাঁর কাছে এগিয়ে এলে মুখ তুলে চাইলেন তিনি। T
‘কী ব্যাপার?’
‘আমরা ওদেরকে সিকিউরিটি স্ক্যানে ধরতে পেরেছি, স্যর, করিডর দিয়ে যাচ্ছে। ডিলাক আছে তাদের সাথে। ওরা এই পথে ফিরছে।’
‘এখুনি ধরার ব্যবস্থা করুন। বাতি ভেঙে দিল ওদের যে যন্ত্রটা সেটার কী খবর?’
‘এমুহূর্তে ওটার কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, স্যর।’
মার্শাল এক মুহূর্ত ভেবে নিলেন।
‘ওই মেশিনটা-ধাতু দিয়ে তৈরি, তাই না?’
‘খুব সম্ভব, স্যর।
‘ওটাকে রিসাইকল করুন, হার্ভে। ওটাকে লোকেট করে স্ক্র্যাপ বানাতে হবে, বুঝেছেন?’
হার্ভে ভালই বুঝেছেন। মার্শাল বোকা বনতে রাজি নন-বিশেষ করে কোনও যন্ত্রের কাছে।
তিনি সিকিউরিটি স্ক্যানার স্ক্রীনের কাছে গিয়ে টোকা দিয়ে ছবি ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন। সিটি কমপ্লেক্সের বেশিরভাগ এলাকা স্পাই ক্যামেরার নেটওয়র্ক দিয়ে মোড়া, তবে সব ক’টাকে একসঙ্গে মনিটর করা অসম্ভব। হার্ভে কে ব্লকের চারপাশের এলাকা স্ক্যান করতে লাগলেন, ফাঁকা করিডরগুলোর ছবি ফুটিয়ে তুলছেন, ভেসে উঠছে নির্জন কামরাগুলোর দৃশ্য। হঠাৎই মুখ তুললেন তিনি।
‘পেয়েছি, স্যর। এখনও কে ব্লকে আছে।’
‘খতম করে দিন!’
শহরের নীচে যে সেমি-অটোমেটেড রিসাইক্লিং নেটওয়র্ক রয়েছে, সেটিকে যে কনসোলটি নিয়ন্ত্রণ করে ওটার কাছে চলে গেলেন হার্ভে
‘রূমটায় একটা অ্যাক্সেস শ্যাফট রয়েছে। টাইমিং যদি নিখুঁত হয়…’ কন্ট্রোলগুলোর উপর খেলে গেল তাঁর দু’হাত।
.
রোকু এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে দেয়ালটি সে লক্ষ করছে ওটার পিছনে শুধু যে একটি কম্পার্টমেন্ট রয়েছে তা-ই নয়, রয়েছে একটি এনার্জি সোর্স। ডান পাশ থেকে কম্পন টের পেয়েছে ও। বোঁ করে ঘুরে গেল তদন্ত করতে। সহসা ওর সামনে একটা হ্যাচওয়ে হড়কে খুলে গেল। ওটার ভিতর থেকে চলন্ত যন্ত্রপাতির ঘর-ঘর, ঠনঠন শব্দ ভেসে এল। রোকু আরেকটু কাছিয়ে গেল—হঠাৎই ওর পায়ের নীচের মেঝে সরে গেল এবং ও হ্যাচওয়ে দিয়ে ছিটকে পড়ে গেল।
ছোট্ট, খাড়া এক শ্যাফট দিয়ে অসহায়ের মত পতন ঘটল ওর এবং বেরিয়ে এল শূন্য বাতাসে। এবার ক’ ফীট নীচে পড়ার পর ধাতব কোনও কিছুর উপর ঠং করে মাথা বাড়ি খেল ওর।
চট করে চারপাশের অবস্থা দেখে নিল ও। লম্বা, ধাতব এক কনভেয়ার বেল্টে পড়ে রয়েছে ও, আধো অন্ধকারে ঠনাৎ-ঠনাৎ করে সামনে এগোচ্ছে। ওর দু’পাশে বিকৃত ধাতব জিনিসপত্র, ভাঙা এঞ্জিন, জরাজীর্ণ এক স্পেসশিপের হাল প্লেট, তোবড়ানো ইস্পাতের গার্ডার।
রোকু চট করে নিজেকে একবার পরখ করে নিল, এবং ওর সার্কিটগুলো ঠিকঠাক আছে দেখে স্বস্তি পেল। কিন্তু ও এখনও অসহায়। ওর গঠনের অন্যতম ত্রুটি হচ্ছে, একবার উল্টে গেলে সোজা হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
তেলাপোকার মতন চিত হয়ে, কনভেয়ার বেল্টে চড়ে সামনে এগিয়ে চলল রোকু।
তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
.
‘মেশিনটাকে পেয়েছি, স্যর। ওটা এখন রিসাইক্লিং ফার্নেসের দিকে যাচ্ছে।’
‘দারুণ, হার্ভে,’ অন্যমনস্ক কণ্ঠে বললেন মার্শাল। তখনও কালচে আয়নাটার দিকে চেয়ে রয়েছেন। ‘অন্যদের যখন খুঁজে পাবেন, ভাল ব্যবহার করবেন। ‘
শায়েস্তা করব না, স্যর?’
‘না, এখনই না। মনে হচ্ছে ওদেরকে কাজে লাগানো যাবে…’
ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলেন মার্শাল।
.
করিডর ধরে হাঁটছে, কিশোর তখনও নিখোঁজ টুকরোটার কথা ভাবছে। ট্রেসারের মতে ওটা কে ব্লকের কামরাটার খুব কাছাকাছি ছিল। এবং নিশ্চিতভাবেই যেহেতু ওটা সেই টিকলিটা নয়…
‘মিস্টার ডিলাক, আপনি কি প্রিন্সেস ডায়ানাকে অনেকদিন ধরে চেনেন?’
‘সারা জীবন, সহজ গলায় বললেন ডিলাক।
‘টিকলিটা ছাড়া তাঁর সঙ্গে কি সারাক্ষণ থাকে এমন আর কিছু আছে? তিনি বহন করেন, বা পরেন?’
‘আমার জানা মতে নয়…’
ওরা একটা কোনা ঘুরতেই টহলরত গার্ডদের সামনে পড়ে গেল।
প্রহরীদের প্রধান ব্লাস্টার তুলল।
‘থামুন!’
‘জো হুকুম,’ বাধ্যগতর মত বলল হিরু চাচা।
‘মার্শাল আপনাদেরকে ডেকেছেন।’
‘খুব সুখের কথা। আমিও তাঁর সাথে দেখা করতে চাই!’
প্রহরীদল ওদেরকে নিয়ে রওনা হলো।
.
ওয়ার রূমে হার্ভে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
‘ডক্টর, আপনি আমার সাথে আসুন। আপনারা দু’জন এখানে দাঁড়ান।’
‘আমাদেরকে আবার আমন্ত্রণ জানানোয় ধন্যবাদ,’ খোশমেজাজে বলল হিরু চাচা।
হার্ভে তাকে নিয়ে গেলেন মার্শালের কাছে। তিনি কালো আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে চেয়ে ছিলেন। কামরায় ওদের উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত নন। হিরু চাচা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাঁকে লক্ষ করল। মার্শাল কান পেতে কী যেন শুনছেন। মাঝে মধ্যে মাথা নাড়ছেন, ঠোঁট নড়ছে, যদিও কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
হিরু চাচা হার্ভের দিকে ঘুরে চাইল।
‘উনি ঠিক আছেন তো?’
‘শশশ, উনি ধ্যান করছেন।’
‘প্রায়ই করেন?’
‘যখন অবস্থা অনুকূল থাকে না, এভাবেই তিনি বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নেন।’
‘বুঝতেই পারছি অবস্থা খারাপ কেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মনে কথা বলা মেগলোম্যানিয়ার প্রথম চিহ্ন। দেখুন, কীভাবে ভেন্ট্রিলোকুইস্টের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছেন…..
হিরু চাচার গলা হারিয়ে গেল। সে কি সত্যিটা বলে ফেলেছে? মার্শালের উগ্র মেজাজ আর দৃঢ়তার আড়ালে কিছু একটা সমস্যা আছে। তিনি কি কোনও রহস্যময় শক্তির হাতের পুতুল?
হঠাৎই পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালেন মার্শাল, উদ্ভাসিত হাসি মুখে নিয়ে হিরু চাচার উদ্দেশে এগিয়ে এলেন।
‘আসুন, বন্ধু আমার!’
হিরু চাচা ইতিউতি চাইল, ভাবছে মার্শাল বুঝি অন্য কাউকে সম্বোধন করেছেন।
‘বন্ধু? শেষবার যখন দেখা হলো তখন আপনি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলেন!’
‘ভুল বোঝাবুঝি। আমি ভুলেই গেছিলাম আপনার আসার কথা আমাকে আগেই জানানো হয়েছিল।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ‘যুদ্ধ, অন্তহীন এই যুদ্ধ। সব কিছু ছাপিয়ে এটাই শুধু আমার মাথায় প্যাঁচ খেয়ে থাকে। কিন্তু এখন যখন আপনি এখানে এসেছেন… আপনিই সে-ই!’
‘সত্যিই? কোন্জন?’
পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বললেন মার্শাল।
‘যে আমাদেরকে বিজয়ের পথে নিয়ে যাবে!’
‘ওহ, ভাল। যতক্ষণ না সত্যিকারের কোনও ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে, বুঝতে পেরেছেন?’
মার্শালকে কথা বলার নেশায় পেয়েছে যেন।
‘আমরা জঘন্য যিয়নদের ধ্বংস করে দেব, আকাশ থেকে মুছে দেব ওদের অস্তিত্ব, এই গ্রহকে মুক্ত করব, এই অ্যাট্রিয়সকে…এই…’
‘পুণ্য ভূমিকে?’ বাতলে দিল হিরু চাচা।
‘ঠিক বলেছেন! শয়তানের হাত থেকে এই পুণ্য ভূমিকে মুক্ত করা হবে। এবং আপনি আমাদেরকে বিজয় এনে দেবেন, ডক্টর।’